মা'আরিফুল হাদীস

সলাত অধ্যায়

হাদীস নং: ২৩০
সলাত অধ্যায়
সালাতুত্ তাসবীহ
২৩০. হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একদা নবী কারীম ﷺ হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে বলেন: হে আব্বাস! হে প্রিয়তম চাচা! আমি কি আপনাকে দান করব না। আমি কি আপনাকে উপহার দিব না, আমি কি আপনাকে অবহিত করব না, আমি কি আপনার জন্য দশটি কাজ করব না। আপনি যদি তা করেন আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন, প্রথমের গুনাহ শেষের গুনাহ, পুরনো গুনাহ- নতুন গুনাহ, অনিচ্ছাকৃত গুনাহ, ইচ্ছাকৃত গুনাহ, সগীরাগুনাহ কবীরা গুনাহ, এবং গোপন গুনাহ ও প্রকাশ্য গুনাহ (সে আমল সালাতুস তাসবীহ্ এবং এর পদ্ধতি)। আপনি চার রাক'আত সালাত আদায় করবেন। এর প্রত্যেক রাক'আতে সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পাঠ করবেন। যখন আপনি প্রথম রাক'আতের কিরা'আত শেষে দাঁড়াবেন তখন পনের বার 'সুবাহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার' পাঠ করবেন। এরপর রুকূ করবেন এবং রুকু অবস্থায় এ বাক্য দশবার বলবেন। এর পর রুকূ থেকে মাথা উঠাবেন এবং দাঁড়ান অবস্থায় তা দশবার পাঠ করবেন। তার পর সিজদায় যাবেন এবং সিজদা অবস্থায় তা দশবার পাঠ করবেন। এরপর সিজদা হতে মাথা উঠাবেন এবং দশবার তা পাঠ করবেন। তারপর সিজদায় যাবেন এবং তা দশবার বলবেন। এবং তারপর মাথা উঠাবেন এবং তা দশবার বলবেন। সুতরাং এভাবে প্রত্যেক রাক'আতে পঁচাত্তর বার পাঠ করবেন। এভাবে আপনি চার রাক'আত সালাত আদায় করবেন। যদি আপনি প্রত্যহ একবার এরূপ সালাত আদায় করতে পারেন, তাহলে করবেন। যদি তা করতে না পারেন, তাহলে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করবেন। যদি তাও না পারেন, তবে প্রত্যেক মাসে একবার করবেন। যদি তাও করতে না পারেন, তাহলে বছরে একবার আদায় করবেন। যদি তাও না পারেন, তবে অন্ততঃ জীবনে একবার আদায় করবেন। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকীর দাওয়াতুল কাবীর। তিরমিযী (র.) আবূ রাফি' (রা.) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন)
کتاب الصلوٰۃ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِلْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ : " يَا عَبَّاسُ ، يَا عَمَّاهُ ، أَلَا أُعْطِيكَ ، أَلَا أَمْنَحُكَ ، أَلَا أُخْبِرُكَ ، أَلَا أَفْعَلُ بِكَ عَشْرَ خِصَالٍ ، إِذَا أَنْتَ فَعَلْتَ ذَلِكَ غَفَرَ اللَّهُ لَكَ ذَنْبَكَ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ ، قَدِيمَهُ وَحَدِيثَهُ ، خَطَأَهُ وَعَمْدَهُ ، صَغِيرَهُ وَكَبِيرَهُ ، سِرَّهُ وَعَلَانِيَتَهُ : أَنْ تُصَلِّيَ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ تَقْرَأُ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ وَسُورَةً ، فَإِذَا فَرَغْتَ مِنَ الْقِرَاءَةِ فِي أَوَّلِ رَكْعَةٍ وَأَنْتَ قَائِمٌ ، قُلْتَ : سُبْحَانَ اللَّهِ ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ ، خَمْسَ عَشْرَةَ مَرَّةً ، ثُمَّ تَرْكَعُ ، فَتَقُولُهَا وَأَنْتَ رَاكِعٌ عَشْرًا ، ثُمَّ تَرْفَعُ رَأْسَكَ مِنَ الرُّكُوعِ ، فَتَقُولُهَا عَشْرًا ، ثُمَّ تَهْوِي سَاجِدًا ، فَتَقُولُهَا وَأَنْتَ سَاجِدٌ عَشْرًا ، ثُمَّ تَرْفَعُ رَأْسَكَ مِنَ السُّجُودِ فَتَقُولُهَا عَشْرًا ، ثُمَّ تَسْجُدُ ، فَتَقُولُهَا عَشْرًا ، ثُمَّ تَرْفَعُ رَأْسَكَ ، فَتَقُولُهَا عَشْرًا ، فَذَلِكَ خَمْسٌ وَسَبْعُونَ ، فِي كُلِّ رَكْعَةٍ تَفْعَلُ ذَلِكَ فِي أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ ، إِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تُصَلِّيَهَا فِي كُلِّ يَوْمٍ مَرَّةً فَافْعَلْ ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَفِي كُلِّ جُمُعَةٍ مَرَّةً ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَفِي كُلِّ سَنَةٍ مَرَّةً ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ ، فَفِي عُمُرِكَ مَرَّةً " ، (رواه ابوداؤد وابن مانه والبيهقى فى الدعوات الكبير وروى الترمذى عن ابي رافع نحوه)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীস গ্রন্থসমূহে বিপুল সংখ্যক সাহাবী 'সালাতুত তাসবীহ' এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কীয় বিষয় রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র.) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মুক্তদাস হযরত আবু রাফি (রা.) সূত্রে এ বিষয়ে রিওয়ায়াত বর্ণনার পর লিখেছেন যে, এছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর এবং ফাযল ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রেও বর্ণিত আছে। হাফিয ইবনে হাজার (র.) 'আল খিসালুল মুকাফিরাহ' গ্রন্থে ইবনে জাওযীর এ হাদীস সংক্রান্ত অভিযোগ প্রত্যাখান করে১ তার সূত্রের উপর সবিস্তার আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর এই আলোচনার মূলকথা হল, এই হাদীসখানা কমপক্ষে 'হাসান' তথা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। কিছু সংখ্যক তাবিঈ ও তাবে তাবিঈ যাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক (রা)ও রয়েছেন। তাঁরা সালাতুত্ তাসবীহ্ আদায়ের বিষয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। এবং তাঁরা যে ফযীলাত বর্ণনা করেছেন তাও প্রামাণ্য বর্ণনা। তাঁদের মতে, সালাতুত্ তাসবীহ্'র শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা সংক্রান্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে প্রমাণিত। দীর্ঘকাল যাবত সালাতুত তাসবীহ্ উম্মতের অধিকাংশ পুণ্যবানদের আমলরূপে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে।

হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.) এই সালাত সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ণ কথা লিখেছেন যার সারমর্ম নিম্নরূপঃ "রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সকল সালাতের বিবিধ রকমের যিকর ও দু'আ প্রমাণিত। কাজেই আল্লাহর কোন বান্দা যদি এসব যিকর ও দু'আ স্বীয় সালাতে পুরোপুরি আদায় করতে না পারে তার জন্য 'সালাতুত তাসবীহ্' পূর্ণভাবে আদায়ের মধ্য দিয়ে তা উক্ত দু'আ ও যিকরের স্থলাভিষিক্ত রূপে বিবেচিত হতে পারে। কেননা এতে আল্লাহর যিকর, তাসবীহ্, তাহমীদ ইত্যাদির বিরাট অংশের সমাবেশ ঘটেছে। এ সালাতে যেহেতু একটি বাক্যই বারবার পাঠ করার বিধান রয়েছে তাই সাধারণের জন্য এ ধরনের সালাত আদায় করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সালাতুত তাসবীহ্ আদায়ের যে পদ্ধতি ইমাম তিরমিযী ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক (র.) থেকে প্রমাণিত তাতে অপরাপর সালাতের ন্যায় কিরা'আতের পূর্বে 'সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা' শেষ পর্যন্ত, রুকূতে 'সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম' সাজদায় 'সুবহানা রাব্বিয়াল আলা' পাঠ করার বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। প্রত্যেক রাক'আতে কিরা'আত পাঠের পূর্বে কিয়াম অবস্থায় 'সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার' পনেরবার, কিরা'আতের পর রুকুতে যাবার পূর্বে এই বাক্যটি দশবার পাঠ করার বিষয় উল্লেখ আছে। এভাবে প্রত্যেক রাক'আতের কিয়ামে এই বাক্যটি পঁচিশবার পাঠ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় সিজদার পর এই বাক্যটি কোন রাক্'আতে পাঠ করা হবে না, এভাবে এই বাক্যটি প্রত্যেক রাক'আতে পঁচাত্তরবার করে হবে এবং চার রাক'আতে হবে তিনশবার। মোটকথা সালাতুত তাসবীহর উভয় পদ্ধতিই স্বীকৃত ও আমলযোগ্য। এই সালাত আদায় কারী যে কোনভাবে তা আদায় করতে পারে।

টিকা: ১. আল্লামা ইবনে জাওযী (র.) এর হাদীস গ্রহণের কঠোর সর্বজনবিদিত। তিনি এমন বহু হাদীসকে জাল বলেছেন যা বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিসগণের নিকট প্রতিষ্ঠিত সত্য প্রমাণ্য। তিনি সালাতুত্ তাসবীহ সংক্রান্ত হাদীস ও জাল হাদীস মনে করেন। হাফিয ইবনে হাজার (র.) 'আল খিসালুল মুকাফফিরাহ' গ্রন্থে তাঁর এ অভিযোগ খণ্ডন ও প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সালাতুত তাসবীহ'র প্রভাব ও বরকত
সালাতের মাধ্যমে পাপ বিমোচিত হওয়ার এবং পাপের দুর্গন্ধ দূরীভূত হওয়ার বিষয়টি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। ইরশাদ হয়েছে: وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ "সালাত কায়েম করবে দিনের দুই প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথমাংশ। সৎকাজ অবশ্যই অসৎকাজ মিটিয়ে দেয়।" (১১, সূরা হুদ: ১১৪)
এ আয়াতের নিরিখে সালাতুত তাসবীহ'র যে বিরাট মাকাম রয়েছে তা হাদীসে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। অর্থ্যৎ এর বরকতে আল্লাহ্ তাঁর বান্দার আগে পিছের পুরনো নতুন, অনিচ্ছাকৃত ইচ্ছাকৃত, কাবীরা-সাগীরা, গোপন প্রকাশ্য সর্ববিধ গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। সুনানে আবূ দাউদের এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর এক সাহাবী (আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর) কে সালাতুত্ তাসবীহ্ শিক্ষা দানের পর বললেন: فإنك لو كنت أعظم أهل الأرض ذنبا غفر لك ذلك "তুমি যদি দুনিয়ার সব চাইতে বড় পাপীও হও, তবুও এর বরকতে তোমার পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।" আল্লাহ্ তা'আলা আমাদেরকে এ ফযীলত থেকে বঞ্চিত না করে ঐ সকল সৌভাগ্যবান বান্দাদের মধ্যে গণ্য হাওয়ার তাওফিক দিন, যাঁরা রহমত ও মাগফিরাতের আহবান শুনে তা থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যে তৎপর হয়ে উঠে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান