মা'আরিফুল হাদীস

আখলাক অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫২
আখলাক অধ্যায়
বেমিসাল কুরবানীর প্রতিদান
২৫২. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: তিন ব্যক্তি রাস্তা চলছিল। বৃষ্টি তাদেরকে পেল। তারা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল। পাহাড় থেকে একটা পাথর এসে তাদের গুহার মুখে পড়ল এবং তাদেরকে ঢেকে ফেলল। তারা পরস্পর বলতে লাগল; খালেস আল্লাহর জন্য যেসব আমল করেছ, তার দিকে নজর কর এবং তার উল্লেখ করে আল্লাহর কাছে দু'আ কর, সম্ভবত আল্লাহ তা দূর করে দিবেন। তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার বৃদ্ধ পিতামাতা এবং কয়েকজন সন্তান ছিল। আমি তাদের জন্য ছাগল চরাতাম। যখন তাদের কাছে ফিরে আসতাম তখন দুধ দোহাতাম এবং ছেলেমেয়েদেরকে দুধপান করানোর পূর্বে পিতামাতাকে দুধপান করতে দিতাম। একদিন চারণ ভূমির গাছ আমাকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ ছাগল চরাতে চরাতে দূরে চলে গিয়েছিলাম)। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে তাদেরকে নিদ্রিত পেলাম। যেরূপ দুধ দোহাতাম সেরূপ দুধ দোহালাম, দুধ নিয়ে এলাম এবং তাদের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি তাদেরকে জাগাতে অপসন্দ করলাম এবং তাদের আগে আমার ছেলেমেয়েদেরকে দুধপান করতে দিতেও অপসন্দ করলাম। ফজর পর্যন্ত তারা আমার পায়ের কাছে চিৎকার করছিল এবং আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। হে আল্লাহ! যদি তুমি জান যে, এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তাহলে আমাদের জন্য পাথরকে একটু সরিয়ে দাও যাতে আমরা আসমান দেখতে পারি। আল্লাহ তা একটু সরিয়ে দিলেন এবং তারা আসমান দেখতে লাগল।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাত বোন ছিল। একজন পুরুষ একজন মেয়েকে যতটুকু ভালবাসে, আমি তাকে ততটুকু ভালবাসতাম। আমি তার সাথে আমার ইচ্ছা পূরণ করতে চাইলাম। সে বলল, তাকে একশত দিনার না দেয়া পর্যন্ত সে রাযী হবে না। আমি একশত দিনার যোগাড় করলাম এবং তা নিয়ে তার সাথে দেখা করলাম। যখন আমি তার উভয় পায়ের মাঝখানে বসলাম, সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর এবং মোহরকৃত জিনিসকে উন্মুক্ত করো না। আমি তার কাছ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। হে আল্লাহ! যদি তুমি জান যে, আমি তা তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তাহলে তা আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে দাও এবং আমাদের জন্য রাস্তা করে দাও। আল্লাহ তাদের জন্য পাথর আরো একটু সরিয়ে দিলেন।

শেষ ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি এক ফরক (ওজন বিশেষ) চাউলের বিনিময়ে একজন মজদুর নিয়োগ করেছিলাম। কাজ শেষ করার পর সে বলল, আমার হক আমাকে দাও। আমি তাকে তার হক দিতে লাগলাম। কিন্তু সে তা ছেড়ে চলে গেল এবং তা নিতে পসন্দ করল না। সে ফিরে না আসা পর্যন্ত তার চাউলের অর্থের দ্বারা কৃষিকাজ শুরু করলাম এবং তার অর্থের দ্বারা গরু এবং চারণকারীর ব্যবস্থা করলাম। অতঃপর সে আমার কাছে এল এবং বলল, আল্লাহকে ভয় কর, আমার উপর যুলম করো না এবং আমার হক আমাকে দাও। আমি তাকে গরু ও তার চারনকারীর কাছে যেতে বললাম। সে বলল, আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার সাথে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, তুমি এ গরু ও চারণকারী নিয়ে যাও। সে তা গ্রহণ করল এবং চলে গেল। যদি তুমি জান যে, আমি তা তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তাহলে তুমি পাথরের বাকীটুকুও সারিয়ে দাও। আল্লাহ তাদের উপর থেকে পাথর সরিয়ে দিলেন এবং তাদের জন্য রাস্তা করে দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
کتاب الاخلاق
عَنْ بْنِ عُمَرَ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : " بَيْنَمَا ثَلاَثَةُ نَفَرٍ يَتَمَاشَوْنَ ، أَخَذَهُمُ المَطَرُ ، فَمَالُوْا إِلَى غَارٍ فِي الْجَبَلِ ، فَانْحَطَّتْ عَلَى فَمِ غَارِهِمْ صَخْرَةٌ مِنَ الْجَبَلِ ، فَاطْبَقَتْ عَلَيْهِمْ ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ : انْظُرُوا أَعْمَالًا عَمِلْتُمُوهَا لِلَّهِ صَالِحَةً ، فَادْعُوا اللَّهَ بِهَا لَعَلَّهُ يُفَرِّجُهَا ، فَقَالَ أَحَدُهُمْ : اللَّهُمَّ إِنَّهُ كَانَ لِي وَالِدَانِ شَيْخَانِ كَبِيرَانِ ، وَلِي صِبْيَةٌ صِغَارٌ ، كُنْتُ أَرْعَى عَلَيْهِمْ ، فَإِذَا رُحْتُ عَلَيْهِمْ فَحَلَبْتُ ، بَدَأْتُ بِوَالِدَيَّ أَسْقِيهِمَا قَبْلَ وُلْدِىْ ، وَاَنَّهُ قَدْ نَآئ بِىَ الشَّجَرُ فَمَا اَتَيْتُ حَتَّى أَمْسَيْتُ ، فَوَجَدْتُهُمَا قَدْ نَامَا ، فَحَلَبْتُ كَمَا كُنْتُ أَحْلُبُ ، فَجِئْتُ بِالْحِلَابِ فَقُمْتُ عِنْدَ رُءُوسِهِمَا أَكْرَهُ أَنْ أُوقِظَهُمَا ، وَأَكْرَهُ أَنْ اَبْدَأَ بِالصَّبِيَّةِ قَبْلَهُمَا ، وَالصِّبْيَةُ يَتَضَاغَوْنَ عِنْدَ قَدَمَيَّ فَلَمْ يَزَلْ ذَلِكَ دَأْبِي وَدَأْبَهُمْ حَتَّى طَلَعَ الفَجْرُ ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ لَنَا فُرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ . فَفَرَجَ اللَّهُ لَهُمْ حَتَّى يَرَوْنَ السَّمَاءَ . قَالَ الثَّانِي : اللَّهُمَّ إِنَّهُ كَانَتْ لِي بِنْتُ عَمٍّ أُحِبُّهَا كَأَشَدِّ مَا يُحِبُّ الرِّجَالُ النِّسَاءَ ، فَطَلَبْتُ إِلَيْهَا نَفْسَهَا ، فَأَبَتْ حَتَّى آتِيَهَا بِمِائَةِ دِينَارٍ ، فَسَعَيْتُ حَتَّى جَمَعْتُ مِائَةَ دِينَارٍ فَلَقِيتُهَا بِهَا ، فَلَمَّا قَعَدْتُ بَيْنَ رِجْلَيْهَا قَالَتْ : يَا عَبْدَ اللَّهِ اتَّقِ اللَّهَ ، وَلاَ تَفْتَحِ الخَاتَمَ ، فَقُمْتُ عَنْهَا ، اللَّهُمَّ فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَاَخْرِجْ لَنَا مِنْهَا . فَفَرَّجَ لَهُمْ فُرْجَةً . وَقَالَ الآخَرُ : اللَّهُمَّ إِنِّي كُنْتُ اسْتَأْجَرْتُ أَجِيرًا بِفَرَقِ أَرُزٍّ ، فَلَمَّا قَضَى عَمَلَهُ قَالَ : أَعْطِنِي حَقِّي ، فَعَرَضْتُ عَلَيْهِ حَقَّهُ فَتَرَكَهُ وَرَغِبَ عَنْهُ ، فَلَمْ أَزَلْ أَزْرَعُهُ حَتَّى جَمَعْتُ مِنْهُ بَقَرًا وَرَاعِيَهَا ، فَجَاءَنِي فَقَالَ : اتَّقِ اللَّهَ وَلاَ تَظْلِمْنِي وَأَعْطِنِي حَقِّي ، فَقُلْتُ : اذْهَبْ إِلَى البَقَرِ وَرَاعِيهَا ، فَقَالَ : اتَّقِ اللَّهَ وَلاَ تَهْزَأْ بِي ، فَقُلْتُ : إِنِّي لاَ أَهْزَأُ بِكَ ، فَخُذْ ذَلِكَ البَقَرَ وَرَاعِيَهَا ، فَأَخَذَهُ فَانْطَلَقَ بِهَا ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ ، فَاَفْرِجْ مَا بَقِيَ . فَفَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُمْ " (رواه البخارى ومسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে কাজ করা হয়, তার ফায়দা অফুরন্ত। নেক নিয়্যতের প্রতিদান আখিরাতের যিন্দেগীতে বান্দাকে দেয়া হবে। নিয়্যতের বিশুদ্ধতার কারণে নগণ্য সৎকর্মের ওজন আখিরাতের যিন্দেগীতে পাহাড়ের ওজনের মত ভারী হবে। অনুরূপভাবে নিয়্যতের বিশুদ্ধতার অভাবে পাহাড়ের মত বিরাট ওজনের সৎকর্মও মাছির ওজনের চেয়ে কম হালকা হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে গলদ নিয়্যতের কারণে বিরাট সৎকর্মকারী বান্দা আখিরাতের আদালতে দণ্ডিত ও অপমানিত হবে।

আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে কাজ করা হয়, তার প্রতিফল বান্দাকে দুনিয়ার যিন্দেগীতেও দান করা হয়। বিশুদ্ধ নিয়্যতসহকারে সৎকর্ম সম্পাদন করার কারণে বান্দার উপর থেকে বালা-মুসীবত দূর করা হয় বা তার আকাঙ্ক্ষিত বস্তু তাকে দান করা হয়।

আলোচ্য হাদীসে তিনটি বিরাট নেককর্ম এবং দুনিয়াতে প্রদত্ত তার প্রতিফলের উল্লেখ করা হয়েছে। এক. পিতামাতার খিদমত করা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়। মাতাপিতার খিদমত করার ব্যাপারে যে যত বেশি ত্যাগ স্বীকার করে, তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে তত বুলন্দ। দুই. আল্লাহর ভয়ে যেনা বা ব্যাভিচার থেকে বিরত থাকা খুব সওয়াবের কাজ। সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কোন সুন্দরীকে হাতের মুঠোয় সম্পূর্ণভাবে পেয়ে শুধু আল্লাহর ভয়ে মনোবাসনা চরিতার্থ না করা এবং কোন যুবতীকে পুত-পবিত্র ছেড়ে দেয়া নফসের অসাধারণ কুরবানী। বলা বাহুল্য, প্রত্যেক অসাধারণ কুরবানীর সওয়াবও দুনিয়া ও আখিরাতে অসাধারণ। তিন. গচ্ছিত আমানতের হিফাযত করা খুবই পূণ্যের কাজ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমানতের বস্তুকে শুধু হিফাযত করা নয়, বর্ধিত ও বিকশিত করা এবং তা সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে দেয়া এক বেমিসাল মহৎ কাজ। এ ধরনের বেমিসাল কুরবানী দুনিয়া এবং আখিরাতে কখনো বিফল হয় না। নেক কর্মের উল্লেখ করে দু'আ করলে আল্লাহ তা কবুল করেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান