মা'আরিফুল হাদীস

আখলাক অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫১
আখলাক অধ্যায়
ইখলাস ও একনিষ্ঠতা এবং নাম-যশ কামনা
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাধ্যমে এ মানবজগত উত্তম চরিত্র ও গুণাবলীর যে শিক্ষা পেয়েছে, এ অধমের দৃষ্টিতে এর পূর্ণতা, ইখলাস ও একনিষ্ঠতার শিক্ষা দ্বারা সাধিত হয়। অর্থাৎ, ইখলাস ও একনিষ্ঠতা হচ্ছে নৈতিকতা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তকারী শেষ পাঠ ও আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতির শেষ সোপান।

এ ইখলাস ও একনিষ্ঠতার মর্ম এই যে, প্রত্যেক সৎকর্ম অথবা কারো সাথে উত্তম আচরণ কেবল এ জন্য এবং এ নিয়্যতে করা যে, এতে আমার পরওয়ারদেগার খুশী হবেন, আমার উপর দয়া করবেন এবং আমি তাঁর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারব। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলে দিয়েছেন যে, ইখলাসই প্রত্যেক সৎকর্মের আত্মা ও প্রাণ। যদি কোন অতি উত্তম কাজও ইখলাসশূন্য হয় এবং এর উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন না হয়; বরং যশ, সুখ্যাতি অথবা এ ধরনের কোন মনোবৃত্তি এর পেছনে কার্যকর থাকে, তাহলে আল্লাহ্ তা'আলার কাছে এর কোনই মূল্য নেই এবং এর উপর কোন সওয়াবও পাওয়া যাবে না।

কথাটি অন্য শব্দমালায় এভাবেও বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ্ তা'আলার সন্তুষ্টি এবং আখেরাতের প্রতিদান- যা সৎকর্ম ও উত্তম চরিত্রের আসল পুরস্কার ও ফল এবং যা মানুষের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কামনা হওয়া চাই- সেটা কেবল কর্ম ও চরিত্রের ভিত্তিতেই লাভ করা যায় না; বরং সেটা কেবল তখন লাভ করা যায়, যখন ঐ কর্ম ও চরিত্র দ্বারা আল্লাহ্ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখেরাতের প্রতিদান লাভের ইচ্ছা এবং নিয়্যতও করা হয়, আর এটাই যখন এ কাজে উদ্বুদ্ধকারী হয়। আর আসলেও এমনটাই হওয়া চাই। কেননা, আমাদের নিজেদের ব্যাপারেও এটাই আমাদের নীতি।

মনে করুন, কোন ব্যক্তি আপনার খুব সেবা ও খেদমত করে, আপনাকে সর্বদিক দিয়ে শান্তি দিতে এবং খুশী রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোন সূত্রে আপনি যদি জানতে পারেন যে, আপনার প্রতি তার কোন আন্তরিকতা নেই; বরং তার এ আচরণ ও ব্যবহার তার কোন ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য অথবা সে আপনার কোন বন্ধু অথবা ঘনিষ্ঠজন থেকে নিজের কোন কাজ আদায় করে নিতে চায় এবং কেবল এ উদ্দেশ্যেই আপনাকে দেখানোর জন্য শুধু এ আচরণ করে, তাহলে আপনার অন্তরে তার এবং তার এ আচরণের কোন মূল্য থাকবে না।

আল্লাহ্ তা'আলার ব্যাপারটাও ঠিক তদ্রূপ। পার্থক্য শুধু এই যে, আমরা অন্যদের অন্তরের অবস্থা জানি না, আর আল্লাহ্ তা'আলা সকলের অন্তরের অবস্থা এবং তাদের নিয়্যত ও উদ্দেশ্য জানেন। অতএব, তাঁর যেসব বান্দার অবস্থা এই যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি ও রহমত কামনায় পুণ্যকাজ করে, আল্লাহ্ তাদের আমল কবুল করে তাদের প্রতি খুশী হন এবং তাদের উপর রহমত নাযিল করেন। আর আখেরাত- যা প্রকৃত প্রতিদান জগত- সেখানেই তাঁর সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহের পূর্ণ প্রকাশ ঘটবে। পক্ষান্তরে যেসব লোক দুনিয়ার মানুষের বাহবা কুড়ানোর জন্য অথবা নাম-যশ ও প্রসিদ্ধি লাভের জন্য সৎকর্মের মহড়া দেখায়, তাদের এসব উদ্দেশ্য দুনিয়াতে যদি সফলও হয়ে যায়, তবুও তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত থেকে বঞ্চিতই থাকবে। তাদের এ বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটির পূর্ণ প্রকাশও আখেরাতেই ঘটবে।

এ অধ্যায়ের মূল ভিত্তি তো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রসিদ্ধ ঐ হাদীস, যেখানে বলা হয়েছেঃ সকল কাজের মূল্যায়ন নিয়‍্যতের ভিত্তিতেই করা হয়। হাদীসটি মাআরিফুল হাদীসের একেবারে শুরুতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং সেখানেই এর ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে। তাই এখানে এর পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। এখানে ঐ হাদীসটি ব্যতীত এ সংক্রান্ত অন্য কয়েকটি হাদীস আনা হচ্ছে এবং এ হাদীসগুলোর মাধ্যমেই দ্বিতীয় খণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

আল্লাহ অন্তর ও আমল দেখেন
২৫১. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: আল্লাহ তোমাদের আকৃতি ও সম্পদের দিকে নযর করেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে নযর করেন। (মুসলিম)
کتاب الاخلاق
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ »

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আল্লাহ মানুষের বাহ্যিক আকৃতি, বেশ-ভূষা, সৌন্দর্য বা সম্পদের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন না। তিনি মানুষের অন্তর ও আমলের সৌন্দর্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যদি কোন ব্যক্তি বেশ-ভূষা, আকৃতি এবং সম্পদের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়; কিন্তু নিয়্যত এবং আমলের সৌন্দর্য তার না থাকে, তাহলে উত্তম আকৃতি ও প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সে সমাজের কোন উপকার করতে সক্ষম নয়। যে নেক চিন্তা করে, নেক নিয়্যত পোষণ করে, নেক আমল করে, মানুষকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করে, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য এগিয়ে আসে, তার উত্তম আকৃতি ও সম্পদ না থাকলেও সে সমাজের রত্ন এবং মানুষের বন্ধু। নেক নিয়্যত ও নেক আমলের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। আল্লাহ তা'আলা এরূপ বান্দাদের অধিক পসন্দ করেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান