মা'আরিফুল হাদীস

আখলাক অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪৭
আখলাক অধ্যায়
উপরের হাদীসগুলোতে যেভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদেরকে পরস্পর ভালবাসা ও সহানুভূতিমূলক আচরণ করতে এবং একদেহ ও একপ্রাণ হয়ে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনিভাবে এর বিপরীত আচরণ যেমন, পরস্পর কুধারণা পোষণ, কটুবাক্য বিনিময়, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা, কারো বিপদে আনন্দিত হওয়া, কাউকে কষ্ট দেওয়া এবং হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদির কঠোর নিন্দাবাদ এবং অত্যন্ত তাকীদের সাথে এগুলো থেকে নিষেধ করেছেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
১৪৭. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেছেন: অপর সম্পর্কে ধারণা করা থেকে তোমরা সাবধান থাক। কেননা ধারণা করা সবচেয়ে বেশি অসত্য কথা, তোমরা সন্দেহ করো না, কারও ত্রুটি খুঁজে বের করো না, অপরকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করো না, একে অন্যকে ঈর্ষা করো না, ঘৃণা করো না এবং একে অন্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না, বরং আল্লাহর বান্দাগণ পরস্পর ভাই হিসেবে থাক। (বুখারী ও মুসলিম)
کتاب الاخلاق
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ ، وَلاَ تَحَسَّسُوا ، وَلاَ تَجَسَّسُوا ، وَلاَ تَنَاجَشُوا ، وَلاَ تَحَاسَدُوا ، وَلاَ تَبَاغَضُوا ، وَلاَ تَدَابَرُوا ، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا » (رواه البخارى ومسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মুসলমান আপাদ-মস্তক প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ। মুসলমান একে অন্যকে ভালবাসে, পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, সম্মান-সহযোগিতা এবং সহানুভূতি মুসলমান সমাজের শক্তি ও সৌন্দর্য। এসব গুণের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমেই মুসলমান সমাজ এক মযবুত লৌহকঠিন প্রাচীর ন্যায় সমস্যা ও সংঘাতের দুনিয়ায় উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম। মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের প্রাচীর যাকে কুরআন 'বুনিয়ানুম-মারসূস' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, প্রকৃতপক্ষে মযবুত ও সুদৃঢ় না হলে বাতিলের মোকাবিলা করা এবং অন্যান্য সামাজিক যিম্মাদারী পালন করা মুসলমানদের জন্য মোটেই সম্ভব নয়। তাই নবী করীম ﷺ মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের প্রাচীরকে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে রক্ষা করার জন্য উম্মতকে হুকুম করেছেন। আলোচ্য হাদীসে নবী করীম ﷺ কয়েকটি জিনিসকে নিষিদ্ধ করেছেন। এসব জিনিস ভ্রাতৃত্বের প্রাচীরকে দুর্বল ও অন্তঃসার শূন্য করে।

কারো সম্পর্কে ধারণা থেকে বাঁচবার জন্য বলা হয়েছে। কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তা মানুষের সমাজে ফিতনা ও সংঘাতের সৃষ্টি করে কিন্তু অনেক লোক ধারণা করাকে পাপ মনে করে না। অথচ নবী করীম ﷺ ধারণা করাকে সবচেয়ে বড় মিথ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোন লোক সম্পর্কে ধারণা করা বা নিছক ধারণার ভিত্তিতে কোন মানুষ বা জাতির বিরুদ্ধে ফয়সালা করা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা মারাত্মক পাপ। কোন ব্যক্তি বা জাতির সম্পর্কে যখন কোন ধারণার সৃষ্টি হয় অথচ তার কাছে তথ্য-প্রমাণ থাকে না, তখন সে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বতে কোন চূড়ান্ত রায় পোষণ করা এবং কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য নিজের এবং জাতির হিফাযতের জন্য আত্মরক্ষামূলক সতর্কতা অবলম্বন করা যেতে পারে; কিন্তু কোন অবস্থাতেই তা আক্রমণমূলক হবে না।

আল্লাহর বিশ্বাসী বান্দাগণ পরস্পর সম্মানিত এবং তারা আখিরাতের হিসাব-নিকাশকে ভয় করে যিন্দেগী যাপন করেন। তাই তাদের সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা বা তাদের অপ্রকাশিত পাপকে মানুষের কাছে প্রকাশ করার জন্য গোয়েন্দাগিরি করা খুবই নিকৃষ্ট ধরনের পাপ। জনগণের অপ্রকাশিত পাপ এবং অপরাধকে খুঁজে বের করা হুকুমতের জন্যও সমীচীন নয়। অপ্রকাশিত পাপ সম্পর্কে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলে তালীম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা দূর করা উচিত। গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে মানুষের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করে বা তাদেরকে শাস্তি প্রদান করে কখনো মানুষকে সংশোধন করা যায় না।

ধন-দৌলত বা প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে অন্যকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার চিন্তা বা চেষ্টা করা খুবই অন্যায়। অনুরূপভাবে অন্য লোকের ধন-দৌলত এবং নিয়ামত দেখে ঈর্ষা করাও পাপ। কারণ এ ধরনের চিন্তা বন্ধুত্ব বিনষ্ট করে এবং শত্রুতার সৃষ্টি করে। একমাত্র জ্ঞান, নেক আমল এবং বদান্যতার ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা বা এসব কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করা শরীআতের দৃষ্টিতে জায়েয।

পরস্পর মুখ ফিরিয়ে রাখা, বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক কায়েম না করা বা সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব পোষণ না করা মুসলমানদের ইমতিয়াযী গুণের বিপরীত এবং আল্লাহর কাছে নিন্দনীয় আমল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান