আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২৩. অধ্যায়ঃ তাওবা ও যুহদ
হাদীস নং: ৪৭৯৪
অধ্যায়ঃ তাওবা ও যুহদ
অধ্যায়: তাওবা ও যুহদ।
তাওবা করা, তাওবার প্রতি ধাবিত হওয়া এবং মন্দকাজের পর ভালকাজ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান
তাওবা করা, তাওবার প্রতি ধাবিত হওয়া এবং মন্দকাজের পর ভালকাজ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান
৪৭৯৪. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন: তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিল, যে নিরানব্বই জন লোককে হত্যা করেছিল। অতঃপর সে জিজ্ঞেস করল যে গোটা পৃথিবীবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বড় আলিম কে? তখন তাকে এক পাদ্রীর সন্ধান দেয়া হল। লোকটি উক্ত পাদ্রীর কাছে গিয়ে বলল যে, সে নিরানব্বইজন লোককে হত্যা করেছে। এখন তার তাওবার কোন সুযোগ আছে কিনা? উত্তরে পাদ্রী বললঃ না। তখন সে উক্ত পাদ্রীকেও হত্যা করে তদ্বারা একশ' পূর্ণ করল। এরপর সে আবার জিজ্ঞেস করল যে, পৃথিবীবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বড় আলিম কে? তখন তাকে একজন আলিম ব্যক্তির সন্ধান দেয়া হল। লোকটি (তার কাছে গিয়ে) বলল যে, সে একশ' জন লোক হত্যা করেছে। তার তাওবার কোন সুযোগ আছে কি? উত্তরে আলিম বললেন: হ্যাঁ, (অবশ্যই আছে)। অপরাধী ও তাওবার মাঝে কে অন্তরায় হবে? তুমি অমুক অমুক স্থানে চলে যাও। কেননা এখানে এমন কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর ইবাদত করে। তুমিও তাদের সাথে থেকে আল্লাহর ইবাদত কর এবং তুমি তোমার নিজ এলাকায় ফিরে যেয়ো না। কারণ, সেটি একটি মন্দ স্থান। সুতরাং লোকটি (সেই স্থানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে) রওয়ানা হল। অতঃপর যখন সে পথের মাঝখানে পৌছল, তখন তার কাছে মৃত্যুর ফিরিশতা এসে উপনীত হল এবং তাকে নিয়ে রহমতের ফিরিশতাগণ ও আযাবের ফিরিশতাগণ (পরস্পরে) বিতর্কে লিপ্ত হল। রহমতের ফিরিশতাগণ বলল, লোকটি তাওবা করে আল্লাহমুখী হয়ে বেরিয়ে এসেছে। আর আযাবের ফিরিশতাগণ বলল যে, সে কখনও ভাল কাজ করে নি। ইত্যবসরে তাদের কাছে মানুষের আকৃতিতে একজন ফিরিশতা এল। তখন তারা তাকে নিজেদের মধ্যে সালিস মেনে নিল। সে ব্যক্তি বলল: তোমরা উভয় ভূমি (নিজ এলাকা ও গন্তব্য স্থান)-র মধ্যবর্তী স্থান মেপে দেখ, অতঃপর উভয় ভূমির মধ্যে সে যেটিরই নিকটবর্তী হবে সে তারই অধিবাসী বলে গণ্য হবে। তখন তারা মেপে দেখার পর লোকটিকে গন্তব্যভূমির নিকটবর্তী দেখতে পেল। ফলে রহমতের ফিরিশতাগণ তার প্রাণ কবয করল।
অপর এক রিওয়ায়েতে আছে, লোকটি সৎ লোকদের জনপদের দিকে এক বিঘৎ পরিমাণ বেশী এগিয়ে ছিল। ফলে তাকে তারই অধিবাসী হিসাবে গণ্য করা হল।
আরেক রিওয়ায়েতে আছে, অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা এদিকের পথ (অর্থাৎ তার নিজ এলাকার দিকের পথ)-কে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি এতটুক দূরে সরে যাও এবং ওদিকের পথ (অর্থাৎ, গন্তব্যস্থানের দিকের পথ)-কে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি একটু নিকটবর্তী হয়ে যাও। তার (ফিরিশতাগণকে সম্বোধন করে) বললেন: "তোমার উভয় পথ মেপে দেখ। অতঃপর তারা লোকটিকে গন্তব্যস্থানের দিকে এক বিঘৎ পরিমাণ বেশী নিকটবর্তী দেখতে পেল। ফলে তাকে মার্জনা করে দেয়া হল।"
অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, কাতাদাহ বলেন। হাসান (রা) বলেছেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, যখন লোকটির কাছে মৃত্যুর ফিরিশতা এল, তখন সে নিজ বুকের উপর ভর করে গন্তব্য স্থানের দিকে এগিয়ে গেল।
(বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজাহও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।)
অপর এক রিওয়ায়েতে আছে, লোকটি সৎ লোকদের জনপদের দিকে এক বিঘৎ পরিমাণ বেশী এগিয়ে ছিল। ফলে তাকে তারই অধিবাসী হিসাবে গণ্য করা হল।
আরেক রিওয়ায়েতে আছে, অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা এদিকের পথ (অর্থাৎ তার নিজ এলাকার দিকের পথ)-কে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি এতটুক দূরে সরে যাও এবং ওদিকের পথ (অর্থাৎ, গন্তব্যস্থানের দিকের পথ)-কে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি একটু নিকটবর্তী হয়ে যাও। তার (ফিরিশতাগণকে সম্বোধন করে) বললেন: "তোমার উভয় পথ মেপে দেখ। অতঃপর তারা লোকটিকে গন্তব্যস্থানের দিকে এক বিঘৎ পরিমাণ বেশী নিকটবর্তী দেখতে পেল। ফলে তাকে মার্জনা করে দেয়া হল।"
অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, কাতাদাহ বলেন। হাসান (রা) বলেছেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, যখন লোকটির কাছে মৃত্যুর ফিরিশতা এল, তখন সে নিজ বুকের উপর ভর করে গন্তব্য স্থানের দিকে এগিয়ে গেল।
(বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজাহও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।)
كتاب التوبة والزهد
كتاب التَّوْبَة والزهد
التَّرْغِيب فِي التَّوْبَة والمبادرة بهَا وإتباع السَّيئَة الْحَسَنَة
التَّرْغِيب فِي التَّوْبَة والمبادرة بهَا وإتباع السَّيئَة الْحَسَنَة
4794- وَعَن أبي سعيد الْخُدْرِيّ رَضِي الله عَنهُ أَن نَبِي الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ كَانَ فِيمَن كَانَ قبلكُمْ رجل قتل تِسْعَة وَتِسْعين نفسا فَسَأَلَ عَن أعلم أهل الأَرْض فَدلَّ على رَاهِب فَأَتَاهُ فَقَالَ إِنَّه قتل تِسْعَة وَتِسْعين نفسا فَهَل لَهُ من تَوْبَة فَقَالَ لَا فَقتله فكمل بِهِ مائَة ثمَّ سَأَلَ عَن أعلم أهل الأَرْض فَدلَّ على رجل عَالم فَقَالَ إِنَّه قتل مائَة نفس فَهَل لَهُ من تَوْبَة فَقَالَ نعم من يحول بَينه وَبَين التَّوْبَة انْطلق إِلَى أَرض كَذَا وَكَذَا فَإِن بهَا أُنَاسًا يعْبدُونَ الله فاعبد الله مَعَهم وَلَا ترجع إِلَى أَرْضك فَإِنَّهَا أَرض سوء فَانْطَلق حَتَّى إِذا نصف الطَّرِيق فَأَتَاهُ ملك الْمَوْت فاختصمت فِيهِ مَلَائِكَة الرَّحْمَة وملائكة الْعَذَاب فَقَالَت مَلَائِكَة الرَّحْمَة
جَاءَ تَائِبًا مُقبلا بِقَلْبِه إِلَى الله تَعَالَى وَقَالَت مَلَائِكَة الْعَذَاب إِنَّه لم يعْمل خيرا قطّ فَأَتَاهُم ملك فِي صُورَة آدَمِيّ فجعلوه بَينهم فَقَالَ قيسوا مَا بَين الْأَرْضين فَإلَى أَيَّتهمَا كَانَ أدنى فَهُوَ لَهُ فقاسوا فوجدوه أدنى إِلَى الأَرْض الَّتِي أَرَادَ فقبضته مَلَائِكَة الرَّحْمَة
وَفِي رِوَايَة فَكَانَ إِلَى الْقرْيَة الصَّالِحَة أقرب بشبر فَجعل من أَهلهَا
وَفِي رِوَايَة فَأوحى الله إِلَى هَذِه أَن تباعدي وَإِلَى هَذِه أَن تقربي وَقَالَ قيسوا بَينهمَا فوجدوه إِلَى هَذِه أقرب بشبر فغفر لَهُ
وَفِي رِوَايَة قَالَ قَتَادَة قَالَ الْحسن ذكر لنا أَنه لما أَتَاهُ ملك الْمَوْت نأى بصدره نَحْوهَا
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَابْن مَاجَه بِنَحْوِهِ
جَاءَ تَائِبًا مُقبلا بِقَلْبِه إِلَى الله تَعَالَى وَقَالَت مَلَائِكَة الْعَذَاب إِنَّه لم يعْمل خيرا قطّ فَأَتَاهُم ملك فِي صُورَة آدَمِيّ فجعلوه بَينهم فَقَالَ قيسوا مَا بَين الْأَرْضين فَإلَى أَيَّتهمَا كَانَ أدنى فَهُوَ لَهُ فقاسوا فوجدوه أدنى إِلَى الأَرْض الَّتِي أَرَادَ فقبضته مَلَائِكَة الرَّحْمَة
وَفِي رِوَايَة فَكَانَ إِلَى الْقرْيَة الصَّالِحَة أقرب بشبر فَجعل من أَهلهَا
وَفِي رِوَايَة فَأوحى الله إِلَى هَذِه أَن تباعدي وَإِلَى هَذِه أَن تقربي وَقَالَ قيسوا بَينهمَا فوجدوه إِلَى هَذِه أقرب بشبر فغفر لَهُ
وَفِي رِوَايَة قَالَ قَتَادَة قَالَ الْحسن ذكر لنا أَنه لما أَتَاهُ ملك الْمَوْت نأى بصدره نَحْوهَا
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَابْن مَاجَه بِنَحْوِهِ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
তাওবা সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। আল্লাহ তা'আলা যে কত উপায়ে বান্দার তাওবা কবুল করেন, এ হাদীছে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে একজন মানুষ যত বড় পাপীই হোক, তার তাওবা করার সুযোগ থাকে এবং সময়মত তাওবা করলে তা আল্লাহ কবূলও করেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত লোকটি একজন ঘোরতর পাপী ছিল। একশ'জন লোকের হত্যাকারী। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।
ঘটনাটির সারমর্ম এই যে, আমাদের পূর্বের জাতি খুব সম্ভব খৃষ্টান জাতির মধ্যে এক ব্যক্তি এক এক করে ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিল। নিশ্চয়ই তার এ পাপ অতি গুরুতর। কাজেই যখন তাওবার উদ্দেশ্যে কোনও রাহিবের কাছে আসল, তখন সে রাহিবও তার তাওবা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এমন ঘোরতর পাপীর আবার কিসের তাওবা!
মূলত এটা ছিল সে রাহিবের অজ্ঞতা। একজন পাপী, যে কিনা তাওবা করতে এসেছে, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা কোনও জ্ঞানীজনের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। যত বড় পাপীই হোক না কেন সে যদি একবার অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই এ ব্যক্তিকে নিরাশ করা রাহিবের উচিত হয়নি। এ অনুচিত কাজ করার “যে পরিণাম হওয়ার কথা তাই হয়েছে। এর ফলে তার মনে হতাশা দেখার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্রোধেরও সঞ্চার হয়েছে। হতাশ মনের লোক নির্দ্বিধায় যে-কোনও কাজ করে ফেলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত ব্যক্তিরও কোনও বিবেচনাবোধ থাকে না। ফলে যে-কোনও গর্হিত কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে।
হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তির মধ্যে সেই ক্রোধ ও হাতাশা- এ দুইই দেখা দিয়েছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ সে রাহিবকে হত্যা করে আর এভাবে সে একশ'র কোটা পূর্ণ করে ফেলে। সর্বশেষ এ হত্যার পর তার মধ্যে আবারও অনুশোচনা জাগে। সুতরাং কিভাবে তার মুক্তিলাভ ও তাওবার ব্যবস্থা হতে পারে, তা জানার জন্য বড় কোনও আলেমের সন্ধান করল। তাকে এক আলেমের সন্ধান দেওয়া হল এবং সে তার কাছে চলে গেল।
এবারের ব্যক্তি যথার্থই আলেম ছিলেন। তিনি তাকে হত্যশ করলেন না; বরং এই বলে তার মনে আশার সঞ্চার করলেন যে, কে পাপী ব্যক্তি ও তাওবার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। তাঁর কাছে তাওবার দুয়ার চির উন্মুক্ত। তিনি সকল পাপীকেই ক্ষমা করেন। তোমাকেও ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুনরায় যাতে পাপে লিপ্ত না হও, তাই তোমার আত্মসংশোধনের দরকার। সেই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সৎসঙ্গ। তাই নিজ এলাকা ছেড়ে তাকে এমন এক জনপদে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, যেখানে কিছু সংলোক বাস করে এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর ভেতর মশগুল থাকে। তাদের সাহচর্যে কিছুদিন কাটালে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আল্লাহর হুকুমমত চলার মানসিকতা তৈরি হবে। নেক কাজের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সবরকম বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। আর এভাবে ক্রমে সেও একজন সৎলোকে পরিণত হবে।
এই আলেমের পরামর্শ মোতাবেক পাপী লোকটি ওই নেককারদের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল। যেতে যেতে যখন তার বাড়ি ও নেককারদের এলাকার মাঝ বরাবর পৌঁছল, তখন তার আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন কে তার জান কবজ করবে? রহমতের ফিরিশতা, না আযাবের ফিরিশতা? ফিরিশতাদের দুই দলই উপস্থিত হয়ে গেলেন। আযাবের ফিরিশতাদের কথা- সে একজন ঘোর পাপী। কখনও নেককাজ করেনি। আমরাই তার জান কবজ করব। রহমতের ফিরিশতাদের দাবি তারা জান কাবজ করবেন। কারণ সে পাপী হলেও এখন তো তাওবা করেছে এবং সংশোধনের ইচ্ছায় নেককারদের সাহচর্য নিতে চেয়েছে। উভয়েরই শক্ত যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে পরম দয়ালু। তিনি দয়ার আচরণ করলেন। একজন ফিরিশতার মাধ্যমে ফয়সালা নিলেন উভয়দিকের রাস্তা মেপে দেখা হোক। যেদিকের রাস্তা কম হবে, অর্থাৎ সে যেদিকের বেশি কাছে হবে তাকে সেই দিকেরই গণ্য করা হবে। যদি সে নেককারদের বেশি কাছে হয়, তবে তাকে নেককারদের একজন গণ্য করা হবে আর সে হিসেবে রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করবেন। অন্যথায় তার জান কবজ করবেন আযাবের ফিরিশতাগণ। সুতরাং পথ মাপা শুরু হল। ওদিকে আল্লাহ তা'আলা যমীনের প্রতি হুকুম জারি করলেন। নেককারদের দিকের ভূমিকে বললেন, সংকুচিত হয়ে যাও। আর ওদিকের ভূমিকে বললেন, প্রসারিত হয়ে যাও। ভূমি হুকুম পালন করল। ফলে মেপে দেখা গেল নেককারদের দিকে দূরত্ব এক বিঘত কম এবং সে তাদেরই বেশি কাছে। সুতরাং ফয়সালা মোতাবেক রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবা কবুলের ব্যাপারে হতাশ হওয়া উচিত নয়। খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা বড় থেকে বড় পাপও ক্ষমা করেন।
খ. খাঁটি তাওবার একটা অংশ নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করা। নিজেকে সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায় নেককার লোকদের সাহচর্যগ্রহণ।
গ. নেককার লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলাও এক মূল্যবান ইবাদত। এর অছিলায়ও আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করেন।
ঘ. মানুষের ভালো-মন্দরূপে গড়ে উঠার পেছনে পরিবেশের ভূমিকা থাকে। তাই নিজের আমল-আখলাক তৈরি ও হেফাজতকল্পে মন্দ পরিবেশ পরিত্যাগ ও ভালো পরিবেশ অবলম্বন জরুরি।
ঙ. দীনী বিষয়ে সুযোগ্য আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আলেম কাছে না পাওয়া গেলে শারীরিক চিকিৎসার্থে যেমন দূরে যাওয়া হয়, তেমনি এ ব্যাপারেও দূরের কোনও যোগ্য আলেমের কাছে যেতে হবে।
চ. অযোগ্য ও বেআমল আলেমের সাহচর্য ক্ষতিকর।
ছ. অন্যকে পরামর্শদানে, বিশেষত দীনী বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। ভুল পরামর্শে অন্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
জ. যে বিষয়ে ভালো জানা নেই, সে বিষয়ে মাসআলা বলা ও ফতোয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ঝ. পাপী ব্যক্তিকে হতাশ না করে তাকে তাওবার প্রতি উৎসাহিত করা ও আল্লাহর রহমত লাভে আশাবাদী করে তোলাই তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা।
ঞ. নরহত্যা মহাপাপ। কুরআন মাজীদের ভাষ্যমতে যে-কোনও একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জগতের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য।
ট. এ হাদীছ দ্বারা ইলমেরও ফযীলত জানা যায়। একজন পরহেযগার আলেম কেবল নিজেই ভ্রান্তপথ থেকে বেঁচে থাকে না। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা অপরাপর মানুষকেও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেন ও সুপথে পরিচালিত করেন। এ হাদীছে এ ছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার তাগিদে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
ঘটনাটির সারমর্ম এই যে, আমাদের পূর্বের জাতি খুব সম্ভব খৃষ্টান জাতির মধ্যে এক ব্যক্তি এক এক করে ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিল। নিশ্চয়ই তার এ পাপ অতি গুরুতর। কাজেই যখন তাওবার উদ্দেশ্যে কোনও রাহিবের কাছে আসল, তখন সে রাহিবও তার তাওবা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এমন ঘোরতর পাপীর আবার কিসের তাওবা!
মূলত এটা ছিল সে রাহিবের অজ্ঞতা। একজন পাপী, যে কিনা তাওবা করতে এসেছে, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা কোনও জ্ঞানীজনের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। যত বড় পাপীই হোক না কেন সে যদি একবার অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই এ ব্যক্তিকে নিরাশ করা রাহিবের উচিত হয়নি। এ অনুচিত কাজ করার “যে পরিণাম হওয়ার কথা তাই হয়েছে। এর ফলে তার মনে হতাশা দেখার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্রোধেরও সঞ্চার হয়েছে। হতাশ মনের লোক নির্দ্বিধায় যে-কোনও কাজ করে ফেলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত ব্যক্তিরও কোনও বিবেচনাবোধ থাকে না। ফলে যে-কোনও গর্হিত কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে।
হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তির মধ্যে সেই ক্রোধ ও হাতাশা- এ দুইই দেখা দিয়েছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ সে রাহিবকে হত্যা করে আর এভাবে সে একশ'র কোটা পূর্ণ করে ফেলে। সর্বশেষ এ হত্যার পর তার মধ্যে আবারও অনুশোচনা জাগে। সুতরাং কিভাবে তার মুক্তিলাভ ও তাওবার ব্যবস্থা হতে পারে, তা জানার জন্য বড় কোনও আলেমের সন্ধান করল। তাকে এক আলেমের সন্ধান দেওয়া হল এবং সে তার কাছে চলে গেল।
এবারের ব্যক্তি যথার্থই আলেম ছিলেন। তিনি তাকে হত্যশ করলেন না; বরং এই বলে তার মনে আশার সঞ্চার করলেন যে, কে পাপী ব্যক্তি ও তাওবার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। তাঁর কাছে তাওবার দুয়ার চির উন্মুক্ত। তিনি সকল পাপীকেই ক্ষমা করেন। তোমাকেও ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুনরায় যাতে পাপে লিপ্ত না হও, তাই তোমার আত্মসংশোধনের দরকার। সেই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সৎসঙ্গ। তাই নিজ এলাকা ছেড়ে তাকে এমন এক জনপদে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, যেখানে কিছু সংলোক বাস করে এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর ভেতর মশগুল থাকে। তাদের সাহচর্যে কিছুদিন কাটালে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আল্লাহর হুকুমমত চলার মানসিকতা তৈরি হবে। নেক কাজের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সবরকম বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। আর এভাবে ক্রমে সেও একজন সৎলোকে পরিণত হবে।
এই আলেমের পরামর্শ মোতাবেক পাপী লোকটি ওই নেককারদের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল। যেতে যেতে যখন তার বাড়ি ও নেককারদের এলাকার মাঝ বরাবর পৌঁছল, তখন তার আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন কে তার জান কবজ করবে? রহমতের ফিরিশতা, না আযাবের ফিরিশতা? ফিরিশতাদের দুই দলই উপস্থিত হয়ে গেলেন। আযাবের ফিরিশতাদের কথা- সে একজন ঘোর পাপী। কখনও নেককাজ করেনি। আমরাই তার জান কবজ করব। রহমতের ফিরিশতাদের দাবি তারা জান কাবজ করবেন। কারণ সে পাপী হলেও এখন তো তাওবা করেছে এবং সংশোধনের ইচ্ছায় নেককারদের সাহচর্য নিতে চেয়েছে। উভয়েরই শক্ত যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে পরম দয়ালু। তিনি দয়ার আচরণ করলেন। একজন ফিরিশতার মাধ্যমে ফয়সালা নিলেন উভয়দিকের রাস্তা মেপে দেখা হোক। যেদিকের রাস্তা কম হবে, অর্থাৎ সে যেদিকের বেশি কাছে হবে তাকে সেই দিকেরই গণ্য করা হবে। যদি সে নেককারদের বেশি কাছে হয়, তবে তাকে নেককারদের একজন গণ্য করা হবে আর সে হিসেবে রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করবেন। অন্যথায় তার জান কবজ করবেন আযাবের ফিরিশতাগণ। সুতরাং পথ মাপা শুরু হল। ওদিকে আল্লাহ তা'আলা যমীনের প্রতি হুকুম জারি করলেন। নেককারদের দিকের ভূমিকে বললেন, সংকুচিত হয়ে যাও। আর ওদিকের ভূমিকে বললেন, প্রসারিত হয়ে যাও। ভূমি হুকুম পালন করল। ফলে মেপে দেখা গেল নেককারদের দিকে দূরত্ব এক বিঘত কম এবং সে তাদেরই বেশি কাছে। সুতরাং ফয়সালা মোতাবেক রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবা কবুলের ব্যাপারে হতাশ হওয়া উচিত নয়। খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা বড় থেকে বড় পাপও ক্ষমা করেন।
খ. খাঁটি তাওবার একটা অংশ নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করা। নিজেকে সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায় নেককার লোকদের সাহচর্যগ্রহণ।
গ. নেককার লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলাও এক মূল্যবান ইবাদত। এর অছিলায়ও আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করেন।
ঘ. মানুষের ভালো-মন্দরূপে গড়ে উঠার পেছনে পরিবেশের ভূমিকা থাকে। তাই নিজের আমল-আখলাক তৈরি ও হেফাজতকল্পে মন্দ পরিবেশ পরিত্যাগ ও ভালো পরিবেশ অবলম্বন জরুরি।
ঙ. দীনী বিষয়ে সুযোগ্য আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আলেম কাছে না পাওয়া গেলে শারীরিক চিকিৎসার্থে যেমন দূরে যাওয়া হয়, তেমনি এ ব্যাপারেও দূরের কোনও যোগ্য আলেমের কাছে যেতে হবে।
চ. অযোগ্য ও বেআমল আলেমের সাহচর্য ক্ষতিকর।
ছ. অন্যকে পরামর্শদানে, বিশেষত দীনী বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। ভুল পরামর্শে অন্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
জ. যে বিষয়ে ভালো জানা নেই, সে বিষয়ে মাসআলা বলা ও ফতোয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ঝ. পাপী ব্যক্তিকে হতাশ না করে তাকে তাওবার প্রতি উৎসাহিত করা ও আল্লাহর রহমত লাভে আশাবাদী করে তোলাই তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা।
ঞ. নরহত্যা মহাপাপ। কুরআন মাজীদের ভাষ্যমতে যে-কোনও একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জগতের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য।
ট. এ হাদীছ দ্বারা ইলমেরও ফযীলত জানা যায়। একজন পরহেযগার আলেম কেবল নিজেই ভ্রান্তপথ থেকে বেঁচে থাকে না। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা অপরাপর মানুষকেও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেন ও সুপথে পরিচালিত করেন। এ হাদীছে এ ছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার তাগিদে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)