আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২৩. অধ্যায়ঃ তাওবা ও যুহদ
হাদীস নং: ৪৭৯৫
অধ্যায়ঃ তাওবা ও যুহদ
অধ্যায়: তাওবা ও যুহদ।
তাওবা করা, তাওবার প্রতি ধাবিত হওয়া এবং মন্দকাজের পর ভালকাজ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান
তাওবা করা, তাওবার প্রতি ধাবিত হওয়া এবং মন্দকাজের পর ভালকাজ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান
৪৭৯৫. হযরত আবু আবদে রাব্বিহ (র) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি মু'আবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রা.)কে মিম্বরে বসে এ হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন, এক ব্যক্তি পাপ করেছিল। অতঃপর সে অন্য এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলল যে, সে নিরানব্বইজন লোকের প্রত্যেককেই অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। অতএব আমার জন্য কি তাওবার কোন সুযোগ আছে? লোকটি বললঃ আমি যদি তোমাকে বলি যে, আল্লাহ্ তা'আলা তাওবাকারীর তাওবা কবুল করবেন না, তবে আমি তোমাকে মিথ্যা বললাম। ওখানে এমন কিছু লোক আছে, যারা (আল্লাহর) ইবাদত করে। তুমি তাদের কাছে গিয়ে তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদত কর। সেমতে লোকটি তাদের দিকে রওয়ানা হল। এমতাবস্থায় তার মৃত্যুর সময় এসে গেল। এ সময় রহমতের ফিরিশতাগণও আযাবের ফিরিশতাগণ একত্রিত হলেন। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা তাদের কাছে একজন ফিরিশতা পাঠালেন। ফিরিশতা বললেন: তোমরা উভয়স্থান (তার নিজ এলাকা ও গন্তব্যস্থান)-এর মধ্যবর্তী জায়গা মেপে দেখ। উভয়স্থানের অধিবাসীদের মধ্যে যারা তার নিকটবর্তী হয়, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সেমতে (মেপে দেখার পর) তারা তাকে তাওবাকারীদের ভূমির দিকে কয়েক আঙ্গুল নিকটবর্তী পেল। ফলে তাকে মার্জনা করে দেয়া হল।
(তাবারানী হাদীসটি দু'সনদে বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যেও একটি সনদ উত্তম। তিনি অপর একটি গ্রহণযোগ্য সনদে আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা)-এর সূত্রে অনুরূপ আরেকটি হাদীসও বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীস বর্ণনা করতে যেয়ে পরিশেষে তিনি বলেন: "অতঃপর লোকটি অপর এক সাধুর কাছে গেল এবং বলল: আমি একশ'জন লোক হত্যা করেছি। সুতরাং আমার জন্য কি তাওবার কোন সুযোগ আছে। সাধুটি বলল: তুমি তো অবশ্যই নিজের উপর অবিচার করেছ। আমি জানি না (তোমার তাওবার সুযোগ আছে কি নেই), তবে এখানে দু'টি জনপদ আছে, একটাকে বলা হয় 'নাসরা'। অপরটি বলা হয় 'কারা'। নাসরাবাসীরা জান্নাতীদের আমল করে। সেখানে তারা ব্যতীত অন্য কেউ টিকতে পারে না। আর কারাবাসীরা জাহান্নামীদের আমল করে। সেখানে তারা ব্যতীত অন্য কেউ টিকতে পারে না। সুতরাং তুমি নাসরাবাসীদের কাছে যাও। সেখানে যদি তুমি টিকে থাকতে পার এবং সে জনপদবাসীর মত আমল করতে পার, তবে তোমার তাওবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। (পরামর্শ মতে) লোকটি 'নাসরা'-র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। অতঃপর সে যখন দুই জনপদের মাঝখানে পৌঁছল, তখন তার মৃত্যুর সময় এসে গেল। ফিরিশতাগণ তাদের প্রতিপালকের কাছে লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তখন তিনি বললেন। তোমরা দেখ, লোকটি দু'টি জনপদের মধ্যে কোনটির অধিক নিকটবর্তী? সেমতে তাকে তার অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত কর। অতঃপর তারা তাকে 'নাসরা'-র দিকে কয়েক আংগুল পরিমাণ বেশী নিকটবর্তী পেল। ফলে তাকে নাসরাবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হল।)
(তাবারানী হাদীসটি দু'সনদে বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যেও একটি সনদ উত্তম। তিনি অপর একটি গ্রহণযোগ্য সনদে আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা)-এর সূত্রে অনুরূপ আরেকটি হাদীসও বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীস বর্ণনা করতে যেয়ে পরিশেষে তিনি বলেন: "অতঃপর লোকটি অপর এক সাধুর কাছে গেল এবং বলল: আমি একশ'জন লোক হত্যা করেছি। সুতরাং আমার জন্য কি তাওবার কোন সুযোগ আছে। সাধুটি বলল: তুমি তো অবশ্যই নিজের উপর অবিচার করেছ। আমি জানি না (তোমার তাওবার সুযোগ আছে কি নেই), তবে এখানে দু'টি জনপদ আছে, একটাকে বলা হয় 'নাসরা'। অপরটি বলা হয় 'কারা'। নাসরাবাসীরা জান্নাতীদের আমল করে। সেখানে তারা ব্যতীত অন্য কেউ টিকতে পারে না। আর কারাবাসীরা জাহান্নামীদের আমল করে। সেখানে তারা ব্যতীত অন্য কেউ টিকতে পারে না। সুতরাং তুমি নাসরাবাসীদের কাছে যাও। সেখানে যদি তুমি টিকে থাকতে পার এবং সে জনপদবাসীর মত আমল করতে পার, তবে তোমার তাওবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। (পরামর্শ মতে) লোকটি 'নাসরা'-র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। অতঃপর সে যখন দুই জনপদের মাঝখানে পৌঁছল, তখন তার মৃত্যুর সময় এসে গেল। ফিরিশতাগণ তাদের প্রতিপালকের কাছে লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তখন তিনি বললেন। তোমরা দেখ, লোকটি দু'টি জনপদের মধ্যে কোনটির অধিক নিকটবর্তী? সেমতে তাকে তার অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত কর। অতঃপর তারা তাকে 'নাসরা'-র দিকে কয়েক আংগুল পরিমাণ বেশী নিকটবর্তী পেল। ফলে তাকে নাসরাবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হল।)
كتاب التوبة والزهد
كتاب التَّوْبَة والزهد
التَّرْغِيب فِي التَّوْبَة والمبادرة بهَا وإتباع السَّيئَة الْحَسَنَة
التَّرْغِيب فِي التَّوْبَة والمبادرة بهَا وإتباع السَّيئَة الْحَسَنَة
4795- وَعَن أبي عبد ربه أَنه سمع مُعَاوِيَة بن أبي سُفْيَان على الْمِنْبَر يحدث أَنه سمع رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول إِن رجلا أسرف على نَفسه فلقي رجلا فَقَالَ إِن الآخر قتل تِسْعَة وَتِسْعين نفسا كلهم ظلما فَهَل تَجِد لي من تَوْبَة فَقَالَ إِن حدثتك أَن الله لَا يَتُوب على من تَابَ كذبتك هَهُنَا قوم يتعبدون فأتهم تعبد الله مَعَهم فَتوجه إِلَيْهِم فَمَاتَ على ذَلِك فاجتمعت مَلَائِكَة الرَّحْمَة وملائكة الْعَذَاب فَبعث الله إِلَيْهِم ملكا فَقَالَ قيسوا مَا بَين المكانين فَأَيهمْ كَانَ أقرب فَهُوَ مِنْهُم فوجدوه أقرب إِلَى دير التوابين بأنملة فغفر لَهُ
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ بِإِسْنَادَيْنِ أَحدهمَا جيد
وَرَوَاهُ أَيْضا بِنَحْوِهِ بِإِسْنَاد لَا بَأْس بِهِ عَن عبد الله بن عَمْرو فَذكر الحَدِيث إِلَى أَن قَالَ ثمَّ أَتَى رَاهِبًا آخر فَقَالَ إِنِّي قتلت مائَة نفس فَهَل تَجِد لي من تَوْبَة فَقَالَ لقد أسرفت وَمَا أَدْرِي وَلَكِن هَهُنَا قَرْيَتَانِ قَرْيَة يُقَال لَهَا نصْرَة وَالْأُخْرَى يُقَال لَهَا كفرة فَأَما أهل نصْرَة فيعملون عمل أهل الْجنَّة لَا يثبت فِيهَا غَيرهم وَأما أهل كفرة فيعملون عمل أهل النَّار لَا يثبت فِيهَا غَيرهم فَانْطَلق إِلَى أهل نصْرَة فَإِن ثَبت فِيهَا وعملت عمل أَهلهَا فَلَا شكّ فِي توبتك فَانْطَلق يؤمها حَتَّى إِذا كَانَ بَين القريتين أدْركهُ الْمَوْت فَسَأَلت الْمَلَائِكَة رَبهَا عَنهُ فَقَالَ انْظُرُوا إِلَى أَي القريتين كَانَ أقرب فاكتبوه من أَهلهَا فوجدوه أقرب إِلَى نصْرَة بِقَيْد أُنْمُلَة فَكتب من أَهلهَا
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ بِإِسْنَادَيْنِ أَحدهمَا جيد
وَرَوَاهُ أَيْضا بِنَحْوِهِ بِإِسْنَاد لَا بَأْس بِهِ عَن عبد الله بن عَمْرو فَذكر الحَدِيث إِلَى أَن قَالَ ثمَّ أَتَى رَاهِبًا آخر فَقَالَ إِنِّي قتلت مائَة نفس فَهَل تَجِد لي من تَوْبَة فَقَالَ لقد أسرفت وَمَا أَدْرِي وَلَكِن هَهُنَا قَرْيَتَانِ قَرْيَة يُقَال لَهَا نصْرَة وَالْأُخْرَى يُقَال لَهَا كفرة فَأَما أهل نصْرَة فيعملون عمل أهل الْجنَّة لَا يثبت فِيهَا غَيرهم وَأما أهل كفرة فيعملون عمل أهل النَّار لَا يثبت فِيهَا غَيرهم فَانْطَلق إِلَى أهل نصْرَة فَإِن ثَبت فِيهَا وعملت عمل أَهلهَا فَلَا شكّ فِي توبتك فَانْطَلق يؤمها حَتَّى إِذا كَانَ بَين القريتين أدْركهُ الْمَوْت فَسَأَلت الْمَلَائِكَة رَبهَا عَنهُ فَقَالَ انْظُرُوا إِلَى أَي القريتين كَانَ أقرب فاكتبوه من أَهلهَا فوجدوه أقرب إِلَى نصْرَة بِقَيْد أُنْمُلَة فَكتب من أَهلهَا
হাদীসের ব্যাখ্যা:
তাওবা সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। আল্লাহ তা'আলা যে কত উপায়ে বান্দার তাওবা কবুল করেন, এ হাদীছে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে একজন মানুষ যত বড় পাপীই হোক, তার তাওবা করার সুযোগ থাকে এবং সময়মত তাওবা করলে তা আল্লাহ কবূলও করেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত লোকটি একজন ঘোরতর পাপী ছিল। একশ'জন লোকের হত্যাকারী। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।
ঘটনাটির সারমর্ম এই যে, আমাদের পূর্বের জাতি খুব সম্ভব খৃষ্টান জাতির মধ্যে এক ব্যক্তি এক এক করে ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিল। নিশ্চয়ই তার এ পাপ অতি গুরুতর। কাজেই যখন তাওবার উদ্দেশ্যে কোনও রাহিবের কাছে আসল, তখন সে রাহিবও তার তাওবা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এমন ঘোরতর পাপীর আবার কিসের তাওবা!
মূলত এটা ছিল সে রাহিবের অজ্ঞতা। একজন পাপী, যে কিনা তাওবা করতে এসেছে, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা কোনও জ্ঞানীজনের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। যত বড় পাপীই হোক না কেন সে যদি একবার অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই এ ব্যক্তিকে নিরাশ করা রাহিবের উচিত হয়নি। এ অনুচিত কাজ করার “যে পরিণাম হওয়ার কথা তাই হয়েছে। এর ফলে তার মনে হতাশা দেখার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্রোধেরও সঞ্চার হয়েছে। হতাশ মনের লোক নির্দ্বিধায় যে-কোনও কাজ করে ফেলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত ব্যক্তিরও কোনও বিবেচনাবোধ থাকে না। ফলে যে-কোনও গর্হিত কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে।
হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তির মধ্যে সেই ক্রোধ ও হাতাশা- এ দুইই দেখা দিয়েছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ সে রাহিবকে হত্যা করে আর এভাবে সে একশ'র কোটা পূর্ণ করে ফেলে। সর্বশেষ এ হত্যার পর তার মধ্যে আবারও অনুশোচনা জাগে। সুতরাং কিভাবে তার মুক্তিলাভ ও তাওবার ব্যবস্থা হতে পারে, তা জানার জন্য বড় কোনও আলেমের সন্ধান করল। তাকে এক আলেমের সন্ধান দেওয়া হল এবং সে তার কাছে চলে গেল।
এবারের ব্যক্তি যথার্থই আলেম ছিলেন। তিনি তাকে হত্যশ করলেন না; বরং এই বলে তার মনে আশার সঞ্চার করলেন যে, কে পাপী ব্যক্তি ও তাওবার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। তাঁর কাছে তাওবার দুয়ার চির উন্মুক্ত। তিনি সকল পাপীকেই ক্ষমা করেন। তোমাকেও ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুনরায় যাতে পাপে লিপ্ত না হও, তাই তোমার আত্মসংশোধনের দরকার। সেই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সৎসঙ্গ। তাই নিজ এলাকা ছেড়ে তাকে এমন এক জনপদে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, যেখানে কিছু সংলোক বাস করে এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর ভেতর মশগুল থাকে। তাদের সাহচর্যে কিছুদিন কাটালে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আল্লাহর হুকুমমত চলার মানসিকতা তৈরি হবে। নেক কাজের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সবরকম বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। আর এভাবে ক্রমে সেও একজন সৎলোকে পরিণত হবে।
এই আলেমের পরামর্শ মোতাবেক পাপী লোকটি ওই নেককারদের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল। যেতে যেতে যখন তার বাড়ি ও নেককারদের এলাকার মাঝ বরাবর পৌঁছল, তখন তার আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন কে তার জান কবজ করবে? রহমতের ফিরিশতা, না আযাবের ফিরিশতা? ফিরিশতাদের দুই দলই উপস্থিত হয়ে গেলেন। আযাবের ফিরিশতাদের কথা- সে একজন ঘোর পাপী। কখনও নেককাজ করেনি। আমরাই তার জান কবজ করব। রহমতের ফিরিশতাদের দাবি তারা জান কাবজ করবেন। কারণ সে পাপী হলেও এখন তো তাওবা করেছে এবং সংশোধনের ইচ্ছায় নেককারদের সাহচর্য নিতে চেয়েছে। উভয়েরই শক্ত যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে পরম দয়ালু। তিনি দয়ার আচরণ করলেন। একজন ফিরিশতার মাধ্যমে ফয়সালা নিলেন উভয়দিকের রাস্তা মেপে দেখা হোক। যেদিকের রাস্তা কম হবে, অর্থাৎ সে যেদিকের বেশি কাছে হবে তাকে সেই দিকেরই গণ্য করা হবে। যদি সে নেককারদের বেশি কাছে হয়, তবে তাকে নেককারদের একজন গণ্য করা হবে আর সে হিসেবে রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করবেন। অন্যথায় তার জান কবজ করবেন আযাবের ফিরিশতাগণ। সুতরাং পথ মাপা শুরু হল। ওদিকে আল্লাহ তা'আলা যমীনের প্রতি হুকুম জারি করলেন। নেককারদের দিকের ভূমিকে বললেন, সংকুচিত হয়ে যাও। আর ওদিকের ভূমিকে বললেন, প্রসারিত হয়ে যাও। ভূমি হুকুম পালন করল। ফলে মেপে দেখা গেল নেককারদের দিকে দূরত্ব এক বিঘত কম এবং সে তাদেরই বেশি কাছে। সুতরাং ফয়সালা মোতাবেক রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবা কবুলের ব্যাপারে হতাশ হওয়া উচিত নয়। খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা বড় থেকে বড় পাপও ক্ষমা করেন।
খ. খাঁটি তাওবার একটা অংশ নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করা। নিজেকে সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায় নেককার লোকদের সাহচর্যগ্রহণ।
গ. নেককার লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলাও এক মূল্যবান ইবাদত। এর অছিলায়ও আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করেন।
ঘ. মানুষের ভালো-মন্দরূপে গড়ে উঠার পেছনে পরিবেশের ভূমিকা থাকে। তাই নিজের আমল-আখলাক তৈরি ও হেফাজতকল্পে মন্দ পরিবেশ পরিত্যাগ ও ভালো পরিবেশ অবলম্বন জরুরি।
ঙ. দীনী বিষয়ে সুযোগ্য আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আলেম কাছে না পাওয়া গেলে শারীরিক চিকিৎসার্থে যেমন দূরে যাওয়া হয়, তেমনি এ ব্যাপারেও দূরের কোনও যোগ্য আলেমের কাছে যেতে হবে।
চ. অযোগ্য ও বেআমল আলেমের সাহচর্য ক্ষতিকর।
ছ. অন্যকে পরামর্শদানে, বিশেষত দীনী বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। ভুল পরামর্শে অন্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
জ. যে বিষয়ে ভালো জানা নেই, সে বিষয়ে মাসআলা বলা ও ফতোয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ঝ. পাপী ব্যক্তিকে হতাশ না করে তাকে তাওবার প্রতি উৎসাহিত করা ও আল্লাহর রহমত লাভে আশাবাদী করে তোলাই তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা।
ঞ. নরহত্যা মহাপাপ। কুরআন মাজীদের ভাষ্যমতে যে-কোনও একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জগতের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য।
ট. এ হাদীছ দ্বারা ইলমেরও ফযীলত জানা যায়। একজন পরহেযগার আলেম কেবল নিজেই ভ্রান্তপথ থেকে বেঁচে থাকে না। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা অপরাপর মানুষকেও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেন ও সুপথে পরিচালিত করেন। এ হাদীছে এ ছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার তাগিদে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
ঘটনাটির সারমর্ম এই যে, আমাদের পূর্বের জাতি খুব সম্ভব খৃষ্টান জাতির মধ্যে এক ব্যক্তি এক এক করে ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিল। নিশ্চয়ই তার এ পাপ অতি গুরুতর। কাজেই যখন তাওবার উদ্দেশ্যে কোনও রাহিবের কাছে আসল, তখন সে রাহিবও তার তাওবা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এমন ঘোরতর পাপীর আবার কিসের তাওবা!
মূলত এটা ছিল সে রাহিবের অজ্ঞতা। একজন পাপী, যে কিনা তাওবা করতে এসেছে, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা কোনও জ্ঞানীজনের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। যত বড় পাপীই হোক না কেন সে যদি একবার অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই এ ব্যক্তিকে নিরাশ করা রাহিবের উচিত হয়নি। এ অনুচিত কাজ করার “যে পরিণাম হওয়ার কথা তাই হয়েছে। এর ফলে তার মনে হতাশা দেখার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্রোধেরও সঞ্চার হয়েছে। হতাশ মনের লোক নির্দ্বিধায় যে-কোনও কাজ করে ফেলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত ব্যক্তিরও কোনও বিবেচনাবোধ থাকে না। ফলে যে-কোনও গর্হিত কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে।
হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তির মধ্যে সেই ক্রোধ ও হাতাশা- এ দুইই দেখা দিয়েছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ সে রাহিবকে হত্যা করে আর এভাবে সে একশ'র কোটা পূর্ণ করে ফেলে। সর্বশেষ এ হত্যার পর তার মধ্যে আবারও অনুশোচনা জাগে। সুতরাং কিভাবে তার মুক্তিলাভ ও তাওবার ব্যবস্থা হতে পারে, তা জানার জন্য বড় কোনও আলেমের সন্ধান করল। তাকে এক আলেমের সন্ধান দেওয়া হল এবং সে তার কাছে চলে গেল।
এবারের ব্যক্তি যথার্থই আলেম ছিলেন। তিনি তাকে হত্যশ করলেন না; বরং এই বলে তার মনে আশার সঞ্চার করলেন যে, কে পাপী ব্যক্তি ও তাওবার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। তাঁর কাছে তাওবার দুয়ার চির উন্মুক্ত। তিনি সকল পাপীকেই ক্ষমা করেন। তোমাকেও ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুনরায় যাতে পাপে লিপ্ত না হও, তাই তোমার আত্মসংশোধনের দরকার। সেই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সৎসঙ্গ। তাই নিজ এলাকা ছেড়ে তাকে এমন এক জনপদে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, যেখানে কিছু সংলোক বাস করে এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর ভেতর মশগুল থাকে। তাদের সাহচর্যে কিছুদিন কাটালে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আল্লাহর হুকুমমত চলার মানসিকতা তৈরি হবে। নেক কাজের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সবরকম বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। আর এভাবে ক্রমে সেও একজন সৎলোকে পরিণত হবে।
এই আলেমের পরামর্শ মোতাবেক পাপী লোকটি ওই নেককারদের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল। যেতে যেতে যখন তার বাড়ি ও নেককারদের এলাকার মাঝ বরাবর পৌঁছল, তখন তার আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন কে তার জান কবজ করবে? রহমতের ফিরিশতা, না আযাবের ফিরিশতা? ফিরিশতাদের দুই দলই উপস্থিত হয়ে গেলেন। আযাবের ফিরিশতাদের কথা- সে একজন ঘোর পাপী। কখনও নেককাজ করেনি। আমরাই তার জান কবজ করব। রহমতের ফিরিশতাদের দাবি তারা জান কাবজ করবেন। কারণ সে পাপী হলেও এখন তো তাওবা করেছে এবং সংশোধনের ইচ্ছায় নেককারদের সাহচর্য নিতে চেয়েছে। উভয়েরই শক্ত যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে পরম দয়ালু। তিনি দয়ার আচরণ করলেন। একজন ফিরিশতার মাধ্যমে ফয়সালা নিলেন উভয়দিকের রাস্তা মেপে দেখা হোক। যেদিকের রাস্তা কম হবে, অর্থাৎ সে যেদিকের বেশি কাছে হবে তাকে সেই দিকেরই গণ্য করা হবে। যদি সে নেককারদের বেশি কাছে হয়, তবে তাকে নেককারদের একজন গণ্য করা হবে আর সে হিসেবে রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করবেন। অন্যথায় তার জান কবজ করবেন আযাবের ফিরিশতাগণ। সুতরাং পথ মাপা শুরু হল। ওদিকে আল্লাহ তা'আলা যমীনের প্রতি হুকুম জারি করলেন। নেককারদের দিকের ভূমিকে বললেন, সংকুচিত হয়ে যাও। আর ওদিকের ভূমিকে বললেন, প্রসারিত হয়ে যাও। ভূমি হুকুম পালন করল। ফলে মেপে দেখা গেল নেককারদের দিকে দূরত্ব এক বিঘত কম এবং সে তাদেরই বেশি কাছে। সুতরাং ফয়সালা মোতাবেক রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবা কবুলের ব্যাপারে হতাশ হওয়া উচিত নয়। খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা বড় থেকে বড় পাপও ক্ষমা করেন।
খ. খাঁটি তাওবার একটা অংশ নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করা। নিজেকে সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায় নেককার লোকদের সাহচর্যগ্রহণ।
গ. নেককার লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলাও এক মূল্যবান ইবাদত। এর অছিলায়ও আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করেন।
ঘ. মানুষের ভালো-মন্দরূপে গড়ে উঠার পেছনে পরিবেশের ভূমিকা থাকে। তাই নিজের আমল-আখলাক তৈরি ও হেফাজতকল্পে মন্দ পরিবেশ পরিত্যাগ ও ভালো পরিবেশ অবলম্বন জরুরি।
ঙ. দীনী বিষয়ে সুযোগ্য আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আলেম কাছে না পাওয়া গেলে শারীরিক চিকিৎসার্থে যেমন দূরে যাওয়া হয়, তেমনি এ ব্যাপারেও দূরের কোনও যোগ্য আলেমের কাছে যেতে হবে।
চ. অযোগ্য ও বেআমল আলেমের সাহচর্য ক্ষতিকর।
ছ. অন্যকে পরামর্শদানে, বিশেষত দীনী বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। ভুল পরামর্শে অন্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
জ. যে বিষয়ে ভালো জানা নেই, সে বিষয়ে মাসআলা বলা ও ফতোয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ঝ. পাপী ব্যক্তিকে হতাশ না করে তাকে তাওবার প্রতি উৎসাহিত করা ও আল্লাহর রহমত লাভে আশাবাদী করে তোলাই তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা।
ঞ. নরহত্যা মহাপাপ। কুরআন মাজীদের ভাষ্যমতে যে-কোনও একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জগতের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য।
ট. এ হাদীছ দ্বারা ইলমেরও ফযীলত জানা যায়। একজন পরহেযগার আলেম কেবল নিজেই ভ্রান্তপথ থেকে বেঁচে থাকে না। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা অপরাপর মানুষকেও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেন ও সুপথে পরিচালিত করেন। এ হাদীছে এ ছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার তাগিদে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)