আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২২. অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৪৬৮৫
অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার
ওজর ব্যতিরেকে মানুষের উপুড় হয়ে নিদ্রা যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কীকরণ
৪৬৮৫. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী (ﷺ) পেটের উপর ভর করে শুয়ে থাকা এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তখন তিনি স্বীয় পা দ্বারা তাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন: নিশ্চয় এ উপুড় হয়ে শয়ন আল্লাহ্ তা'আলা পসন্দ করেন না।
(আহমাদ (স্বীয় মুসনাদে) ও ইবন হিব্বান স্বীয় সহীহে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির উল্লিখিত পাঠ ইব্‌ন হিব্বান (র) কর্তৃক বর্ণিত। বুখারী এ হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।)
كتاب الأدب
التَّرْهِيب أَن ينَام الْإِنْسَان على وَجهه من غير عذر
4685- وَعَن أبي هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ قَالَ مر النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بِرَجُل مُضْطَجع على بَطْنه فغمزه بِرجلِهِ وَقَالَ إِن هَذِه ضجعة لَا يُحِبهَا الله عز وَجل

رَوَاهُ أَحْمد وَابْن حبَان فِي صَحِيحه وَاللَّفْظ لَهُ وَقد تكلم البُخَارِيّ فِي هَذَا الحَدِيث

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন দরদী শিক্ষক। তিনি কেবল পরকালীন কল্যাণই নয়; পার্থিব কল্যাণেরও শিক্ষাদান করতেন। এমনিভাবে আখিরাতের পক্ষে যা ক্ষতিকর সে সম্পর্কে যেমন সতর্ক করতেন, তেমনি পার্থিব ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কেও সতর্ক করতেন। ঘুম মানুষের জন্য অশেষ উপকারী। তার শোওয়াটা স্বাস্থ্যসম্মত না হলে তাতে নানা ক্ষতিরও আশঙ্কা থাকে। তাই নবী কারী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন এবং যে শয়ন ক্ষতিকর সে সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে হযরত তিখফা রাযি. উপুড় হয়ে শুইলে তিনি তাঁকে জাগিয়ে দেন এবং এই বলে সতর্ক করেন যে-
إِنَّ هذِهِ ضِجْعَةٌ يُبْغِضُهَا اللَّهُ (এটা এমন এক শয়ন, যা আল্লাহ অপসন্দ করেন)। কোনও কোনও বর্ণনায় এর কারণ বলা হয়েছে যে, এটা জাহান্নামীদের শয়ন। হযরত আবূ যার্র রাযি. একদিন উপুড় হয়ে শোওয়া ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইইি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জাগ্রত করে বললেন-
يَا جُنَيْدِبُ، إِنَّمَا هذِهِ ضِجْعَةُ أَهْلِ النَّارِ
'হে প্রিয় জুনদুব! এটা তো জাহান্নামীদের শয়ন।(সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৭২৪)
অর্থাৎ জাহান্নামে জাহান্নামীদেরকে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ
যেদিন তাদেরকে উপুড় করে আগুনের দিকে টেনে নেওয়া হবে (সেদিন তাদের চৈতন্য হবে এবং তাদেরকে বলা হবে) জাহান্নামের স্পর্শ-স্বাদ ভোগ করো। (সূরা কমার, আয়াত ৪৮)

হাদীছে উপুড় হয়ে শোওয়াকে জাহান্নামীদের শয়ন বলার অর্থ এমনও হতে পারে যে, এটা অমুসলিমদের শয়ন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, তারা সব কাজই নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো করে। তাদের শয়ন-বসনও যেমন ইচ্ছা তেমন হয়ে থাকে। চিৎ হয়ে শুইল না উপুড় হয়ে নাকি কাত হয়ে, এতে তাদের কিছু যারা আসে না। তা জাহান্নামে জাহান্নামীদের শয়ন হোক কিংবা দুনিয়ায় অমুসলিমদের শয়ন হোক, মুমিন-মুসলিমদের জন্য এ শয়ন আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করতে না। মুমিনগণ তাঁর প্রিয়। প্রিয় বান্দাদের শয়ন অপ্রিয় ও অভিশপ্তদের মতো হবে কেন? মুমিনদের শয়ন-বসন কোনওকিছুই বেঈমানদের মতো হওয়া উচিত নয়।

উপুড় হয়ে শোওয়া অপসন্দনীয় হওয়ার আরও একটি কারণ হতে পারে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি। স্বাস্থ্য আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এটা তাঁর আমানতও বটে। এর হেফাজত করা জরুরি। যে কাজ দ্বারা স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তা থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য। উপুড় হয়ে শোওয়াটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। এতে বুকে চাপ পড়ে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে করে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ক্ষতি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। তাই এরূপ শয়ন অবশ্যই পরিহার করা উচিত। বিশেষত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এভাবে শোওয়া অপসন্দ করেছেন, তখন তার কোনও ক্ষতি বুঝে আসুক বা নাই আসুক, একজন নবীপ্রেমিক নিজের জন্য এরূপ শয়নকে কিছুতেই পসন্দ করতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুসরণ করার মধ্যেই আমাদের দোজাহানের কল্যাণ নিহিত। তাই বিনাবাক্যে তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করা উচিত।

উল্লেখ্য, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত তিখফা রাযি.-কে যে পা দ্বারা নাড়া দিয়ে ঘুম থেকে তুলেছেন, এটাকে স্থূল দৃষ্টিতে দেখা চলবে না। সাহাবীদের প্রতি তাঁর মমতা ছিল অপরিসীম। তাঁরাও তাঁকে ভালোবাসতেন প্রাণাধিক। তাঁর পদস্পর্শ একেকজন সাহাবীর কাছে ছিল জীবনের অমূল্য সম্পদ ও পরম প্রাপ্তি। এ ছিল তাঁদের কামনার ধন। এ ধরনের সম্পর্ক যাদের মধ্যে থাকে, তাদের একজনের পায়ের ছোঁয়া অন্যজনের কাছে ভক্তি-ভালোবাসার মাধুর্য বহন করে।
এরূপ পদস্পর্শ যেহেতু ভালোবাসার নিদর্শন, তাই ভালোবাসার স্থানেই এটা প্রযোজ্য। স্থূল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা বেমানান। সুতরাং সম্পর্ক যেখানে গভীর নয়, সেখানে এর থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। পিতা-মাতা ও সন্তান, শিক্ষক ও ছাত্র কিংবা শায়খ ও মুরীদের মধ্যকার সম্পর্ক এমনিতে তো অনেক উন্নত ও ওজনদার। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক মধুর ও গভীর নাও হতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রেও পায়ের ব্যবহারে খুব হিসেবী হওয়া প্রয়োজন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. উপুড় হয়ে ঘুমানো উচিত নয়।

খ. আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা পসন্দ করেন না, তা পরিহার করে চলা উচিত।

গ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির পায়ের ছোঁয়াকে ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করা চাই।

ঘ. কাউকে অপসন্দনীয় কোনও অবস্থায় দেখলে তাকে দরদের সঙ্গে সতর্ক করতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান