আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২২. অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৪৬৮৬
অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার
ওজর ব্যতিরেকে মানুষের উপুড় হয়ে নিদ্রা যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কীকরণ
৪৬৮৬. হযরত ইয়াঈশ ইব্‌ন তাখফা ইবন কায়স গিফারী (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমার পিতা ছিলেন অসহায় সুফফার অন্তর্ভুক্ত। একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তোমাদের নিয়ে আয়েশার ঘরে চল। আমরা চলতে লাগলাম। অতঃপর তিনি (সেখানে পৌছে) বললেন, হে আয়েশা। আমাদেরকে খাবার দাও! তখন তিনি হাশীশা'* নিয়ে এলেন। আমরা তা খেলাম। তিনি আবার বললেন, হে আয়েশা। আমাদেরকে খাবার দাও। তখন তিনি হায়সা'** নামক হালুয়া জাতীয় এক প্রকার খাবার নিয়ে এলেন। আমরা তাও খেলাম। তারপর তিনি বললেন, হে আয়েশা। আমাদেরকে পানীয় দাও। তখন তিনি দুধের একটি বড় পাত্র নিয়ে এলেন। আমরা তা পান করলাম। অতঃপর তিনি ছোট্ট একটি পানপাত্র নিয়ে এলেন। আমরা তাও পান করলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তোমরা ইচ্ছা করলে (এখানে) রাত্রি যাপন করতে পার; আর ইচ্ছা করলে মসজিদে চলে যেতে পার। রাবী বলেন: অতঃপর আমি আমার পেটের উপর ভর করে শেষ রাত্রে (মসজিদে) শুয়েছিলাম। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি এসে পা দ্বারা আমাকে নাড়িয়ে বললেন : নিশ্চয়ই এ শয়ন আল্লাহ্ তা'আলা অপসন্দ করেন। রাবী বলেনঃ আমি তাকিয়ে দেখি, তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)।
(আবু দাউদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসের উল্লিখিত পাঠ তারই। নাসাঈ হাদীসটি কায়স ইবন তাগফা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমার পিতা বর্ণনা করেছেন। অতঃপর হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। ইবন মাজাহ (র) কায়স ইবন তাহফার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে সংক্ষিপ্তাকারে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবন হিববান ও নাসাঈর মত কায়স ইবন তাগফা থেকে তাঁর হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজাহ ও প্রতিলিপির বিভিন্নতা অনুসারে ইবন তাহফা বা তাখফার সূত্রে আবু যর (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (উক্ত রিওয়ায়াতে) আবু যার (র) বলেন। রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। আর আমি আমার পেটের উপর ভর করে শুয়ে ছিলাম। তখন তিনি স্বীয় পা দ্বারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, হে জুনায়দার! নিশ্চয় এটা জাহান্নামীদের শয়ন। আবু উমর নামাবী বলেন, এ হাদীসের সনদে অনেক মতভেদ রয়েছে এবং বহু মতানৈক্য হয়েছে। কেউ তাহফা ইবন কায়স বলেছেন, কেউ তাখফা বলেছেন, কেউ যাগফা বলেছেন, কেউ তাক্ফা বলেছেন, কেউ কায়স ইবন তাখফা বলেছেন, কেউ আব্দুল্লাহ ইবন তাখফার সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, আবার কেউ তাহফার সূত্রে আবূ যার (রা)-এর মধ্যস্থতায় নবী (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাদের সবার হাদীসই এক।
রাবী বলেনঃ "আমি সুফফায় ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন রাসুলুল্লাহ স্বীয় পা দ্বারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন: এ নিদ্রা আল্লাহ্ অপসন্দ করেন। হাদীস বর্ণনাকারী সুফফার অধিবাসী একজন সাহাবী ছিলেন। কোন কোন আলিম বলেন। রাবীর পিতা আব্দুল্লাহ্ সুহবাত প্রাপ্ত ছিলেন। তিনিই এ কাহিনীর মূল ব্যক্তি। বুখারী (র) এতে অনেক মতভেদ উল্লেখ করে বলেন, তাগফা নামটি ভুল। আল্লাহই অধিকতর জ্ঞাত।)

*এক প্রকার ভূমিজাত আহার্য বস্তু।
**খেজুর, পানীয় ও ঘি দ্বারা প্রস্তুত এক প্রকার খাবার।
كتاب الأدب
التَّرْهِيب أَن ينَام الْإِنْسَان على وَجهه من غير عذر
4686- وَعَن يعِيش بن طخفة بن قيس الْغِفَارِيّ قَالَ كَانَ أبي من أَصْحَاب الصّفة فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم انْطَلقُوا بِنَا إِلَى بَيت عَائِشَة
فَانْطَلَقْنَا فَقَالَ يَا عَائِشَة أطعمينا فَجَاءَت بجشيشة فأكلنا ثمَّ قَالَ يَا عَائِشَة أطعمينا فَجَاءَت بحيسة مثل القطاة فأكلنا ثمَّ قَالَ يَا عَائِشَة اسقينا
فَجَاءَت بعس من لبن فشربنا فَجَاءَت بقدح صَغِير فشربنا ثمَّ قَالَ إِن شِئْتُم بتم وَإِن شِئْتُم انطلقتم إِلَى الْمَسْجِد
قَالَ فَبينا أَنا مُضْطَجع من السحر على بَطْني إِذْ جَاءَ رجل يحركني بِرجلِهِ فَقَالَ إِن هَذِه ضجعة يبغضها الله عز وَجل
قَالَ فَنَظَرت فَإِذا هُوَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم

رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَاللَّفْظ لَهُ وَرَوَاهُ النَّسَائِيّ عَن قيس بن طغفة بالغين الْمُعْجَمَة قَالَ حَدثنِي أبي فَذكره وَابْن مَاجَه عَن قيس بن طهفة بِالْهَاءِ عَن أَبِيه مُخْتَصرا وَرَوَاهُ ابْن حبَان فِي صَحِيحه عَن قيس بن طغفة بالغين الْمُعْجَمَة عَن أَبِيه كَالنَّسَائِيِّ وَرَوَاهُ ابْن مَاجَه أَيْضا عَن ابْن طهفة أَو طخفة على اخْتِلَاف النّسخ عَن أبي ذَر قَالَ مر بِي رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَأَنا مُضْطَجع على بَطْني فركضني بِرجلِهِ وَقَالَ يَا جنيدب إِنَّمَا هَذِه ضجعة أهل النَّار
قَالَ أَبُو عمر النمري اخْتلف فِيهِ اخْتِلَافا كثيرا واضطرب فِيهِ اضطرابا شَدِيدا فَقيل طهفة بن قيس بِالْهَاءِ وَقيل طخفة بِالْخَاءِ وَقيل ضغفة بالغين وَقيل طقفة بِالْقَافِ وَالْفَاء وَقيل قيس بن طخفة وَقيل عبد الله بن طخفة عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَقيل طهفة عَن أبي ذَر رَضِي الله عَنهُ عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وحديثهم كلهم وَاحِد
قَالَ كنت نَائِما بِالصّفةِ فركضني رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بِرجلِهِ وَقَالَ هَذِه نومَة يبغضها الله
وَكَانَ من أهل الصّفة وَمن أهل الْعلم من يَقُول إِن الصُّحْبَة لِأَبِيهِ عبد الله وَإنَّهُ صَاحب الْقِصَّة انْتهى وَذكر البُخَارِيّ اخْتِلَافا كثيرا وَقَالَ طغفة بالغين خطأ وَالله أعلم
الحيسة على معنى الْقطعَة من الحيس وَهُوَ الطَّعَام الْمُتَّخذ من التَّمْر والأقط وَالسمن وَقد يَجْعَل عوض الأقط دَقِيق
والعس الْقدح الْكَبِير الضخم حرز ثَمَانِيَة أَرْطَال أَو تِسْعَة

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন দরদী শিক্ষক। তিনি কেবল পরকালীন কল্যাণই নয়; পার্থিব কল্যাণেরও শিক্ষাদান করতেন। এমনিভাবে আখিরাতের পক্ষে যা ক্ষতিকর সে সম্পর্কে যেমন সতর্ক করতেন, তেমনি পার্থিব ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কেও সতর্ক করতেন। ঘুম মানুষের জন্য অশেষ উপকারী। তার শোওয়াটা স্বাস্থ্যসম্মত না হলে তাতে নানা ক্ষতিরও আশঙ্কা থাকে। তাই নবী কারী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন এবং যে শয়ন ক্ষতিকর সে সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে হযরত তিখফা রাযি. উপুড় হয়ে শুইলে তিনি তাঁকে জাগিয়ে দেন এবং এই বলে সতর্ক করেন যে-
إِنَّ هذِهِ ضِجْعَةٌ يُبْغِضُهَا اللَّهُ (এটা এমন এক শয়ন, যা আল্লাহ অপসন্দ করেন)। কোনও কোনও বর্ণনায় এর কারণ বলা হয়েছে যে, এটা জাহান্নামীদের শয়ন। হযরত আবূ যার্র রাযি. একদিন উপুড় হয়ে শোওয়া ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইইি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জাগ্রত করে বললেন-
يَا جُنَيْدِبُ، إِنَّمَا هذِهِ ضِجْعَةُ أَهْلِ النَّارِ
'হে প্রিয় জুনদুব! এটা তো জাহান্নামীদের শয়ন।(সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৭২৪)
অর্থাৎ জাহান্নামে জাহান্নামীদেরকে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ
যেদিন তাদেরকে উপুড় করে আগুনের দিকে টেনে নেওয়া হবে (সেদিন তাদের চৈতন্য হবে এবং তাদেরকে বলা হবে) জাহান্নামের স্পর্শ-স্বাদ ভোগ করো। (সূরা কমার, আয়াত ৪৮)

হাদীছে উপুড় হয়ে শোওয়াকে জাহান্নামীদের শয়ন বলার অর্থ এমনও হতে পারে যে, এটা অমুসলিমদের শয়ন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, তারা সব কাজই নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো করে। তাদের শয়ন-বসনও যেমন ইচ্ছা তেমন হয়ে থাকে। চিৎ হয়ে শুইল না উপুড় হয়ে নাকি কাত হয়ে, এতে তাদের কিছু যারা আসে না। তা জাহান্নামে জাহান্নামীদের শয়ন হোক কিংবা দুনিয়ায় অমুসলিমদের শয়ন হোক, মুমিন-মুসলিমদের জন্য এ শয়ন আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করতে না। মুমিনগণ তাঁর প্রিয়। প্রিয় বান্দাদের শয়ন অপ্রিয় ও অভিশপ্তদের মতো হবে কেন? মুমিনদের শয়ন-বসন কোনওকিছুই বেঈমানদের মতো হওয়া উচিত নয়।

উপুড় হয়ে শোওয়া অপসন্দনীয় হওয়ার আরও একটি কারণ হতে পারে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি। স্বাস্থ্য আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এটা তাঁর আমানতও বটে। এর হেফাজত করা জরুরি। যে কাজ দ্বারা স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তা থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য। উপুড় হয়ে শোওয়াটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। এতে বুকে চাপ পড়ে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে করে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ক্ষতি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। তাই এরূপ শয়ন অবশ্যই পরিহার করা উচিত। বিশেষত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এভাবে শোওয়া অপসন্দ করেছেন, তখন তার কোনও ক্ষতি বুঝে আসুক বা নাই আসুক, একজন নবীপ্রেমিক নিজের জন্য এরূপ শয়নকে কিছুতেই পসন্দ করতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুসরণ করার মধ্যেই আমাদের দোজাহানের কল্যাণ নিহিত। তাই বিনাবাক্যে তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করা উচিত।

উল্লেখ্য, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত তিখফা রাযি.-কে যে পা দ্বারা নাড়া দিয়ে ঘুম থেকে তুলেছেন, এটাকে স্থূল দৃষ্টিতে দেখা চলবে না। সাহাবীদের প্রতি তাঁর মমতা ছিল অপরিসীম। তাঁরাও তাঁকে ভালোবাসতেন প্রাণাধিক। তাঁর পদস্পর্শ একেকজন সাহাবীর কাছে ছিল জীবনের অমূল্য সম্পদ ও পরম প্রাপ্তি। এ ছিল তাঁদের কামনার ধন। এ ধরনের সম্পর্ক যাদের মধ্যে থাকে, তাদের একজনের পায়ের ছোঁয়া অন্যজনের কাছে ভক্তি-ভালোবাসার মাধুর্য বহন করে।
এরূপ পদস্পর্শ যেহেতু ভালোবাসার নিদর্শন, তাই ভালোবাসার স্থানেই এটা প্রযোজ্য। স্থূল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা বেমানান। সুতরাং সম্পর্ক যেখানে গভীর নয়, সেখানে এর থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। পিতা-মাতা ও সন্তান, শিক্ষক ও ছাত্র কিংবা শায়খ ও মুরীদের মধ্যকার সম্পর্ক এমনিতে তো অনেক উন্নত ও ওজনদার। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক মধুর ও গভীর নাও হতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রেও পায়ের ব্যবহারে খুব হিসেবী হওয়া প্রয়োজন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. উপুড় হয়ে ঘুমানো উচিত নয়।

খ. আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা পসন্দ করেন না, তা পরিহার করে চলা উচিত।

গ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির পায়ের ছোঁয়াকে ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করা চাই।

ঘ. কাউকে অপসন্দনীয় কোনও অবস্থায় দেখলে তাকে দরদের সঙ্গে সতর্ক করতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান