আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২১. অধ্যায়ঃ সদ্ব্যবহার
হাদীস নং: ৩৮৯০
অধ্যায়ঃ সদ্ব্যবহার
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার প্রতি ভীতি প্রদর্শন এবং তার অধিকার আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ
৩৮৯০. হযরত আমর ইবনে শু'আয়ব (রা) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদা সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি তাঁর পরিবার ও সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রতিবেশীর ভয়ে দরজা বন্ধ রাখে, সে (প্রতিবেশী) মু'মিন নয় আর যে ব্যক্তি প্রতিবেশীর অনিষ্ট হতে নিজকে নিরাপদ মনে করে না, সে মু'মিন নয়। তুমি কি প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে জান? যখন সে তোমার সাহায্য কামনা করবে, তখন তুমি তাকে সাহায্য করবে। যখন সে তোমার নিকট ঋণ চাইবে, তাকে ঋণ দেবে, যখন সে দুর্ভিক্ষের শিকার হবে, তুমি তার নিকট বারবার যাতায়াত করবে, যখন সে রোগাক্রান্ত হবে, তুমি তার কুশল জিজ্ঞেস করবে। তার কোন কল্যাণ হলে তুমি তাকে মুবারাকবাদ জানাবে। বিপদগ্রস্ত হলে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। সে মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরীক হবে। তুমি তার বাড়ীর উপর তোমার ইমারতকে সুউচ্চ করবে না, যাতে তার বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার অনুমতি থাকলে ভিন্ন কথা। তোমার ডেকের তাপ দ্বারা তোমার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেবে না, বরং ধোঁয়া বেরুবার জন্য পথ করে দেব। তুমি ফল-মূল ক্রয় করলে তাকে হাদিয়া দেবে, যদি তা না কর, তবে তুমি ঘরে গোপনে প্রবেশ করবে। তোমার সন্তানরা তা যেন খুলাখুলিভাবে না খায়, যাতে তাদের সন্তানের মনে আঘাত লাগে।
(খারায়েতী মাকারিমুল আখলাক অনুচ্ছেদে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
(হাফিয মুনযিরী (র) বলেন)। সম্ভবত اتدرى ما حَقٌّ الْجَارِ الخ এই বাক্যটি মারফু সূত্রে বর্ণিত। তবে তাবারানী (র) মু'আবিয়া ইবনে হায়দা (রা) হতে মারফু' সূত্রে এরূপ বর্ণনা করেন: আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার প্রতি আমার প্রতিবেশীর কি হক আছে? তিনি বলেনঃ সে অসুস্থ হবে তার কুশল জিজ্ঞেস করবে, সে মারা গেলে তুমি তার (লাশের) সাথে যাবে। তোমার নিকট ঋণ চাইলে তা দেবে, সে ভুল করলে তা গোপন রাখবে। এরপর তিনি হাদীসটি বর্ণনা করেন।)
(খারায়েতী মাকারিমুল আখলাক অনুচ্ছেদে হাদীসটি বর্ণনা করেন।
(হাফিয মুনযিরী (র) বলেন)। সম্ভবত اتدرى ما حَقٌّ الْجَارِ الخ এই বাক্যটি মারফু সূত্রে বর্ণিত। তবে তাবারানী (র) মু'আবিয়া ইবনে হায়দা (রা) হতে মারফু' সূত্রে এরূপ বর্ণনা করেন: আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার প্রতি আমার প্রতিবেশীর কি হক আছে? তিনি বলেনঃ সে অসুস্থ হবে তার কুশল জিজ্ঞেস করবে, সে মারা গেলে তুমি তার (লাশের) সাথে যাবে। তোমার নিকট ঋণ চাইলে তা দেবে, সে ভুল করলে তা গোপন রাখবে। এরপর তিনি হাদীসটি বর্ণনা করেন।)
كتاب البر والصلة
التَّرْهِيب من أَذَى الْجَار وَمَا جَاءَ فِي تَأْكِيد حَقه
3890- وَرُوِيَ عَن عَمْرو بن شُعَيْب عَن أَبِيه عَن جده عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ من أغلق بَابه دون جَاره مَخَافَة على أَهله وَمَاله فَلَيْسَ ذَلِك بِمُؤْمِن وَلَيْسَ بِمُؤْمِن من لم يَأْمَن جَاره بوائقه
أَتَدْرِي مَا حق الْجَار إِذا استعانك أعنته وَإِذا استقرضك أَقْرَضته وَإِذا افْتقر عدت عَلَيْهِ وَإِذا مرض عدته وَإِذا أَصَابَهُ خير هنأته وَإِذا أَصَابَته مُصِيبَة عزيته وَإِذا مَاتَ اتبعت
جنَازَته وَلَا تستطيل عَلَيْهِ بالبنيان فتحجب عَنهُ الرّيح إِلَّا بِإِذْنِهِ وَلَا تؤذه بِقُتَارِ ريح قدرك إِلَّا أَن تغرف لَهُ مِنْهَا وَإِن اشْتريت فَاكِهَة فأهد لَهُ فَإِن لم تفعل فَأدْخلهَا سرا وَلَا يخرج بهَا ولدك ليغيظ بهَا وَلَده
رَوَاهُ الخرائطي من مَكَارِم الْأَخْلَاق
قَالَ الْحَافِظ وَلَعَلَّ قَوْله أَتَدْرِي مَا حق الْجَار إِلَى آخِره فِي كَلَام الرَّاوِي غير مَرْفُوع لَكِن قد روى الطَّبَرَانِيّ عَن مُعَاوِيَة بن حيدة قَالَ قلت يَا رَسُول الله مَا حق الْجَار عَليّ قَالَ إِن مرض عدته وَإِن مَاتَ شيعته وَإِن استقرضك أَقْرَضته وَإِن أعوز سترته
فَذكر الحَدِيث بِنَحْوِهِ
أَتَدْرِي مَا حق الْجَار إِذا استعانك أعنته وَإِذا استقرضك أَقْرَضته وَإِذا افْتقر عدت عَلَيْهِ وَإِذا مرض عدته وَإِذا أَصَابَهُ خير هنأته وَإِذا أَصَابَته مُصِيبَة عزيته وَإِذا مَاتَ اتبعت
جنَازَته وَلَا تستطيل عَلَيْهِ بالبنيان فتحجب عَنهُ الرّيح إِلَّا بِإِذْنِهِ وَلَا تؤذه بِقُتَارِ ريح قدرك إِلَّا أَن تغرف لَهُ مِنْهَا وَإِن اشْتريت فَاكِهَة فأهد لَهُ فَإِن لم تفعل فَأدْخلهَا سرا وَلَا يخرج بهَا ولدك ليغيظ بهَا وَلَده
رَوَاهُ الخرائطي من مَكَارِم الْأَخْلَاق
قَالَ الْحَافِظ وَلَعَلَّ قَوْله أَتَدْرِي مَا حق الْجَار إِلَى آخِره فِي كَلَام الرَّاوِي غير مَرْفُوع لَكِن قد روى الطَّبَرَانِيّ عَن مُعَاوِيَة بن حيدة قَالَ قلت يَا رَسُول الله مَا حق الْجَار عَليّ قَالَ إِن مرض عدته وَإِن مَاتَ شيعته وَإِن استقرضك أَقْرَضته وَإِن أعوز سترته
فَذكر الحَدِيث بِنَحْوِهِ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা ঈমানের অঙ্গ। যদিও মুমিন না হওয়ার দ্বারা পরিপূর্ণ মুমিন না হওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ সে কাফের হয়ে যায় না; তার ঈমান ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, ফলে সে আল্লাহ ও বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষমালাভ করতে না পারলে শুরুতে জান্নাতে যেতে পারবে না বটে, কিন্তু ঈমান নিয়ে মারা গেলে একসময় সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে অবশ্যই জান্নাতে যাবে, তবুও বাস্তবিকপক্ষে এটি একটি কঠিন সতর্কবাণীই বটে। কেননা প্রথমত জাহান্নামের শাস্তি যত অল্পদিনের জন্যই হোক না কেন এবং যত সামান্যই হোক না কেন, দুনিয়ার হাজারও বছরের কঠিনতম কষ্ট অপেক্ষাও তা বেশি ভয়াবহ। কোনও মুমিনেরই সে শাস্তিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কাজেই তা থেকে বাঁচতে চাইলে অবশ্যই প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত ছোট ক্ষতিও অনেক সময় অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে লাগাতার কষ্ট দিতে থাকবে, তার এ বেপরোয়া অবস্থার কারণে আশঙ্কা থেকে যায় যে, কোনও একদিন তার মূল ঈমানই ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। ফলে ঈমান নিয়ে তার কবরে যাওয়া হবে না। আল্লাহ তাআলা এ পরিণতি থেকে আমাদের সকলকে রক্ষা করুন।
এ হাদীছে সাধারণভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার ভয়াবহতা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আমাদেরকে খুঁজে দেখতে হবে কোন্ কোন্ পথে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হয়। মৌলিকভাবে এটা দু'রকম- কথা দিয়ে কষ্ট দেওয়া এবং কাজ দিয়ে কষ্ট দেওয়া। সুতরাং প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করে রূঢ় কথা বলা, গালাগাল করা, তার সমালোচনা করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা এবং তার মনে আঘাত লাগে এরকম যে-কোনও কথাবার্তা হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কেননা এর পরিণাম হতে পারে জাহান্নামের আযাব। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে সে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত قيل للنبي صلى الله عليه وسلم: إن فلانة تقوم الليل وتصوم النهار، وتفعل وتصدق، وتؤذي جيرانها بلسانها، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لا خير فيها، هي من أهل النار». قيل: وفلانة تصلي المكتوبة، وتصدق بأثوار، ولا تؤذي أحدا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: هي من أهل الجنة ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক মহিলা রাতে নফল নামায পড়ে, দিনে রোযা রাখে ও ইবাদত-বন্দেগী করে এবং দান সদাকা করে, কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদেরকে মুখ দিয়ে কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামীদের একজন। বলা হলো, অমুক মহিলা কেবল ফরয নামায পড়ে এবং রুটির ছোট ছোট টুকরা দান করে, কিন্তু সে কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইছি। ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতবাসীদের একজন।
প্রতিবেশীদেরকে বিভিন্ন কাজকর্ম দ্বারাও কষ্ট দেওয়া হয়। যেমন প্রতিবেশীর বাড়িতে আলো-বাতাসের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া, নিজ বাড়ির ধোঁয়া, দুর্গন্ধ, ময়লা আবর্জনা, পানি ইত্যাদি তার বাড়ির দিকে যেতে দেওয়া, অহেতুক উচ্চ আওয়াজ দ্বারা তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলা, বিবাহে ভাঙানি দেওয়া, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি। এরকম আরও যত কাজ দ্বারা প্রতিবেশী আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা থেকে বিরত থাকা এ হাদীছের শিক্ষা অনুযায়ী ঈমানের দাবি।
মানুষের হক মূলত তিন প্রকার জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। এক প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর এ তিনও প্রকার হকই রয়েছে। কাজেই এ তিন প্রকারের যে প্রকারেই প্রতিবেশীর হক খর্ব করা হবে এবং যেভাবেই তাকে কষ্ট দেওয়া হবে, তা-ই এ হাদীছের সতর্কবাণীর আওতাভুক্ত হবে। তাই লক্ষ রাখা জরুরি যাতে এক প্রতিবেশীর দ্বারা অন্য প্রতিবেশীর জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়; বরং তার এ তিনও প্রকার হকের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। এ নিরাপত্তা ভঙ্গ করা যে কত কঠিন পাপ, অপর এক হাদীছে তা এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে لأن يزني الرجل بعشرة نسوة خير عليه من أن يزني بامرأة جاره، ولأن يسرق الرجل من عشرة أبيات أيسر عليه من أن يسرق من بيت جاره 'কোনও ব্যক্তি যদি দশ নারীর সঙ্গেও ব্যভিচার করে, তবে তা তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা অপেক্ষা লঘু। এমনিভাবে কোনও ব্যক্তি যদি দশটি ঘরেও চুরি করে, তবে তা তার প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করা অপেক্ষা হালকা।”
ইমাম ইবন আবী জামরাহ রহ. বলেন, এই যে বাহ্যিক প্রতিবেশী, যার সঙ্গে অপর প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল বা অন্যকিছুর আড়াল থাকে, তার সম্পর্কেই যখন এত গুরুত্বের সঙ্গে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, কিছুতেই তাকে কষ্ট দেবে না এবং সর্বাবস্থায় তার প্রতি ভালো ব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকবে, তখন যেই প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের কোনও আড়াল নেই অর্থাৎ দুই কাঁধের দুই ফিরিশতা, তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা কতইনা গুরুত্বপূর্ণ হবে। সুতরাং বন্ধু হে, সাবধান! তুমি যে শরীআতের হুকুম অমান্য করে দিবারাত্র তাদেরকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ, এর থেকে বিরত হও। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, বান্দা যখন নেক আমল করে তখন তারা দু'জন খুশি হয়, আর বান্দা পাপকর্মে লিপ্ত হলে তারা কষ্ট পায়। সুতরাং সর্বদা বেশি বেশি সৎকর্মে লিপ্ত থেকে এবং অসৎকর্ম পরিহারে যত্নবান থেকে তাদের খুশি রাখতে সচেষ্ট থাকা চাই। মনে রাখতে হবে পার্থিব প্রতিবেশীদের হক আদায়ে যত্নবান থাকা অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবে তারচে'ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অদৃশ্য এ দুই প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় প্রতিবেশীর হক আদায় করা ঈমানের অঙ্গ।
খ. কথা ও কর্ম- কোনওভাবেই প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে নেই।
গ. সদা সচেষ্ট থাকা চাই যাতে এক প্রতিবেশীর পক্ষ হতে অপর প্রতিবেশী তার জান, মাল ও ইজ্জত এ তিনও দিক থেকে নিরাপদ থাকে।
দ্বিতীয়ত ছোট ক্ষতিও অনেক সময় অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে লাগাতার কষ্ট দিতে থাকবে, তার এ বেপরোয়া অবস্থার কারণে আশঙ্কা থেকে যায় যে, কোনও একদিন তার মূল ঈমানই ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। ফলে ঈমান নিয়ে তার কবরে যাওয়া হবে না। আল্লাহ তাআলা এ পরিণতি থেকে আমাদের সকলকে রক্ষা করুন।
এ হাদীছে সাধারণভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার ভয়াবহতা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আমাদেরকে খুঁজে দেখতে হবে কোন্ কোন্ পথে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হয়। মৌলিকভাবে এটা দু'রকম- কথা দিয়ে কষ্ট দেওয়া এবং কাজ দিয়ে কষ্ট দেওয়া। সুতরাং প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করে রূঢ় কথা বলা, গালাগাল করা, তার সমালোচনা করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা এবং তার মনে আঘাত লাগে এরকম যে-কোনও কথাবার্তা হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কেননা এর পরিণাম হতে পারে জাহান্নামের আযাব। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে সে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত قيل للنبي صلى الله عليه وسلم: إن فلانة تقوم الليل وتصوم النهار، وتفعل وتصدق، وتؤذي جيرانها بلسانها، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لا خير فيها، هي من أهل النار». قيل: وفلانة تصلي المكتوبة، وتصدق بأثوار، ولا تؤذي أحدا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: هي من أهل الجنة ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক মহিলা রাতে নফল নামায পড়ে, দিনে রোযা রাখে ও ইবাদত-বন্দেগী করে এবং দান সদাকা করে, কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদেরকে মুখ দিয়ে কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামীদের একজন। বলা হলো, অমুক মহিলা কেবল ফরয নামায পড়ে এবং রুটির ছোট ছোট টুকরা দান করে, কিন্তু সে কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইছি। ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতবাসীদের একজন।
প্রতিবেশীদেরকে বিভিন্ন কাজকর্ম দ্বারাও কষ্ট দেওয়া হয়। যেমন প্রতিবেশীর বাড়িতে আলো-বাতাসের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া, নিজ বাড়ির ধোঁয়া, দুর্গন্ধ, ময়লা আবর্জনা, পানি ইত্যাদি তার বাড়ির দিকে যেতে দেওয়া, অহেতুক উচ্চ আওয়াজ দ্বারা তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলা, বিবাহে ভাঙানি দেওয়া, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি। এরকম আরও যত কাজ দ্বারা প্রতিবেশী আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা থেকে বিরত থাকা এ হাদীছের শিক্ষা অনুযায়ী ঈমানের দাবি।
মানুষের হক মূলত তিন প্রকার জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। এক প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর এ তিনও প্রকার হকই রয়েছে। কাজেই এ তিন প্রকারের যে প্রকারেই প্রতিবেশীর হক খর্ব করা হবে এবং যেভাবেই তাকে কষ্ট দেওয়া হবে, তা-ই এ হাদীছের সতর্কবাণীর আওতাভুক্ত হবে। তাই লক্ষ রাখা জরুরি যাতে এক প্রতিবেশীর দ্বারা অন্য প্রতিবেশীর জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়; বরং তার এ তিনও প্রকার হকের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। এ নিরাপত্তা ভঙ্গ করা যে কত কঠিন পাপ, অপর এক হাদীছে তা এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে لأن يزني الرجل بعشرة نسوة خير عليه من أن يزني بامرأة جاره، ولأن يسرق الرجل من عشرة أبيات أيسر عليه من أن يسرق من بيت جاره 'কোনও ব্যক্তি যদি দশ নারীর সঙ্গেও ব্যভিচার করে, তবে তা তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা অপেক্ষা লঘু। এমনিভাবে কোনও ব্যক্তি যদি দশটি ঘরেও চুরি করে, তবে তা তার প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করা অপেক্ষা হালকা।”
ইমাম ইবন আবী জামরাহ রহ. বলেন, এই যে বাহ্যিক প্রতিবেশী, যার সঙ্গে অপর প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল বা অন্যকিছুর আড়াল থাকে, তার সম্পর্কেই যখন এত গুরুত্বের সঙ্গে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, কিছুতেই তাকে কষ্ট দেবে না এবং সর্বাবস্থায় তার প্রতি ভালো ব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকবে, তখন যেই প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের কোনও আড়াল নেই অর্থাৎ দুই কাঁধের দুই ফিরিশতা, তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা কতইনা গুরুত্বপূর্ণ হবে। সুতরাং বন্ধু হে, সাবধান! তুমি যে শরীআতের হুকুম অমান্য করে দিবারাত্র তাদেরকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ, এর থেকে বিরত হও। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, বান্দা যখন নেক আমল করে তখন তারা দু'জন খুশি হয়, আর বান্দা পাপকর্মে লিপ্ত হলে তারা কষ্ট পায়। সুতরাং সর্বদা বেশি বেশি সৎকর্মে লিপ্ত থেকে এবং অসৎকর্ম পরিহারে যত্নবান থেকে তাদের খুশি রাখতে সচেষ্ট থাকা চাই। মনে রাখতে হবে পার্থিব প্রতিবেশীদের হক আদায়ে যত্নবান থাকা অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবে তারচে'ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অদৃশ্য এ দুই প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় প্রতিবেশীর হক আদায় করা ঈমানের অঙ্গ।
খ. কথা ও কর্ম- কোনওভাবেই প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে নেই।
গ. সদা সচেষ্ট থাকা চাই যাতে এক প্রতিবেশীর পক্ষ হতে অপর প্রতিবেশী তার জান, মাল ও ইজ্জত এ তিনও দিক থেকে নিরাপদ থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)