আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
১৬. অধ্যায়ঃ বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়
হাদীস নং: ৩০৬৬
অধ্যায়ঃ বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়
যার তিনটি সন্তান অথবা দু'টি সন্তান অথবা একটি সন্তান মারা যায়, তার প্রচুর সাওয়াব লাভ সম্পর্কিত আলোচনা ও অনুপ্রেরণা
৩০৬৬. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এলো এবং সে বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! পুরুষেরা আপনার হাদীস লাভ করে ধন্য হচ্ছে। কাজেই, আপনার তরফ থেকে আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করে দিন, যেন আল্লাহ তা'আলা আপনাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন তা আমাদের শেখাতে পারেন। তিনি বললেন: তোমরা অমুক অমুক জায়গায় অমুক অমুক দিন একত্র হবে। তারা একত্র হলো। নবী (ﷺ) তাদের নিকট আসেন এবং আল্লাহ তাঁকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি তাদের তা শিক্ষা দেন। এরপর তিনি বললেনঃ তোমাদের কোন মহিলার (অপ্রাপ্ত) তিনটি সন্তান মারা গেলে তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে (রক্ষা পাবার ক্ষেত্রে) পর্দা স্বরূপ হবে। এক মহিলা বলল: যদি দু'টি (সন্তান) হয়। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: দু'টি হলেও।
(বুখারী, মুসলিম ও অপরাপর হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত।)
(বুখারী, মুসলিম ও অপরাপর হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত।)
كتاب النكاح
ترغيب من مَاتَ لَهُ ثَلَاثَة من الْأَوْلَاد أَو اثْنَان أَو وَاحِد فِيمَا يذكر من جزيل الثَّوَاب
3066- وَعَن أبي سعيد الْخُدْرِيّ رَضِي الله عَنهُ قَالَ جَاءَت امْرَأَة إِلَى رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَقَالَت يَا رَسُول الله ذهب الرِّجَال بحديثك فَاجْعَلْ لنا من نَفسك يَوْمًا نأتك فِيهِ تعلمنا مِمَّا علمك الله
قَالَ اجْتَمعْنَ يَوْم كَذَا وَكَذَا فِي مَوضِع كَذَا وَكَذَا
فاجتمعن فأتاهن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فعلمهن مِمَّا علمه الله ثمَّ قَالَ مَا مِنْكُن من امْرَأَة تقدم ثَلَاثَة من الْوَلَد إِلَّا كَانُوا لَهَا حِجَابا من النَّار فَقَالَت امْرَأَة واثنين فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم واثنين
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَغَيرهمَا
قَالَ اجْتَمعْنَ يَوْم كَذَا وَكَذَا فِي مَوضِع كَذَا وَكَذَا
فاجتمعن فأتاهن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فعلمهن مِمَّا علمه الله ثمَّ قَالَ مَا مِنْكُن من امْرَأَة تقدم ثَلَاثَة من الْوَلَد إِلَّا كَانُوا لَهَا حِجَابا من النَّار فَقَالَت امْرَأَة واثنين فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم واثنين
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَغَيرهمَا
হাদীসের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের নাজাতের জন্য নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে দীন ও শরী'আত দিয়ে থাকেন। সে ধারার সর্বশেষ দীন ও শরী'আত হল ইসলাম। দুনিয়ার সমস্ত মানুষের মুক্তি ও নাজাত এর অনুসরণের মধ্যেই নিহিত। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোনও ভেদাভেদ নেই। সকলের জন্যই এর অনুসরণ জরুরি। যথাযথ অনুসরণ কেবল তখনই সম্ভব, যখন সঠিকভাবে জানাও থাকবে। তাই নারী- পুরুষ সকলের জন্যই দীনের মৌলিক ও বুনিয়াদি শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে নারীদেরও সে অনুভূতি ছিল। তারা দীন ও শরী'আতের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের চেষ্টা করতেন। তাই তাদের জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। বেশিরভাগ সময় পুরুষগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে থাকার কারনে নারীদের জন্য সরাসরি তাঁর কাছ থেকে শেখার সুযোগ কম হত। তাই একদিন তাদের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তিনি হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি.. হযরত আনাস রাযি.-এর মা। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন-
يَا رَسُولَ اللَّهِ، ذَهَبَ الرّجَالُ بِحَدِيْثك (ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষগণ আপনার বক্তব্য নিয়ে যায়)। অর্থাৎ পুরুষগণই আপনার বেশিরভাগ সময়টা নিয়ে নেয়। সাধারণত তারাই সরাসরি আপনার বক্তব্য শুনতে পায়। আমরা ঘরে থাকি বলে সে সুযোগ কম হয়। ফলে আমরা সরাসরি আপনার কাছ থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি না।
فَاجْعَلْ لَنَا مِنْ نَفْسِكَ يَوْمًا نَأْتِيكَ فِيْهِ تُعَلِّمُنَا مِمَّا عَلَّمَكَ اللهُ (আপনি আমাদের জন্য একটা দিন ধার্য করুন, যেদিন আমরা আপনার কাছে আসব। আপনি আমাদেরকে শেখাবেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিখিয়েছেন)। অর্থাৎ একটা দিন কেবল আমাদেরকেই দেবেন। সেদিন আপনার মজলিসে কেবল আমরাই থাকব। আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে আপনাকে বিশেষ যে শিক্ষাদান করেছেন, সেদিন আপনি আমাদেরকেও তা শেখাবেন। বলাবাহুল্য, তা ছিল দীনেরই শিক্ষা। দীনের শিক্ষা অর্জনের জন্যই তারা এ আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আবেদন গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন-
اجْتَمِعْنَ يَوْمَ كَذَا وَكَذَا (তোমরা অমুক অমুক দিন একত্র হও)। অর্থাৎ তিনি তাদের জন্য দিন-তারিখ ঠিক করে দিলেন। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কোথায় তারা একত্র হবেন তাও ঠিক করে দিয়েছিলেন। নারীদের জন্য যে-কোনও স্থানে জমা হওয়া সমীচীন নয়। তাদের পর্দা ও নিরাপত্তার দিকে লক্ষ করে উপযুক্ত জায়গা ও উপযুক্ত সময় বেছে নেওয়া চাই। সে হিসেবে তাদের জন্য দিন ও স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হল। সুতরাং নির্ধারিত দিনে তারা নির্ধারিত স্থানে একত্র হলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথারীতি সেখানে হাজির হলেন এবং তাদেরকে দীনের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিলেন। তাদেরকে কি কি শিক্ষা দিয়েছিলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তা এ হাদীছটিতে উল্লেখ করা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বর্ণনায় তার উল্লেখ রয়েছে। সেসব বিষয়ে শিক্ষাদানের পর একটা বিশেষ দিকের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন-
ما منكن من امرأة تقدم ثلاثة من الولد إلا كانوا لها حجابًا من النار ( তোমাদের মধ্যে যে-কোনও নারীর জীবদ্দশায় তার তিনটি সন্তান মারা যায়, তারই জন্য সে সন্তানেরা জাহান্নামের অন্তরায় হবে)। মা হিসেবে নারীদেরকে আল্লাহ তা'আলা স্বভাবগতভাবেই মমতাময়ী বানিয়েছেন। সন্তানের প্রতি তাদের মায়া-মমতা অসাধারণ। এটা জীবমাত্রেরই বৈশিষ্ট্য। মা পশু-পাখিরাও তাদের বাচ্চাদের প্রতি অশেষ মায়া-মমতা লালন করে। সৃষ্টির সেরা মানুষের ভেতর এ গুণ আরও বেশি। তাই মানবমায়েরা তাদের সন্তানদের ভালোবাসে প্রাণাধিক। গর্ভে ধারণ করা, প্রসব করা ও লালন-পালন করার এক দীর্ঘ মায়াময় সিলসিলার ভেতর দিয়ে তার সন্তানের অস্তিত্ব ও বেড়ে ওঠা। এহেন সন্তানের কিছু একটা হয়ে গেলে মায়ের পক্ষে তা হয় বড়ই মর্মবিদারী। সেই সন্তানের মৃত্যু হলে মায়ের যে কতটা কষ্ট হয়, তা কেবল মা'ই বুঝতে পারে। অধিকাংশ মা সে কষ্টে ধৈর্য রক্ষা করতে পারে না। তখন সে এমনই আকুল হয়ে পড়ে যে, উচিত-অনুচিতের বোধ-বুদ্ধি পর্যন্ত তখন হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় তার দ্বারা নানারকম সীমালঙ্ঘন হয়ে যায়। অনেক মা স্বভাবগত লজ্জা-শরমও হারিয়ে ফেলে। বরবাদ হয়ে যায় তার আকীদা-বিশ্বাস পর্যন্তও। তাই মায়েদের জন্য সবরের শিক্ষা অতীব প্রয়োজনীয়। কষ্ট অনেক বড়। তাই বড় রকমের সবরও দরকার, যাতে করে সন্তান হারানোর পরিণামে তার আখিরাতও হারিয়ে না যায়; বরং সবরের বদৌলতে আখিরাতে অনেক বড় পুরস্কারের অধিকারী হয়ে যায়। এ হাদীছটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়েদেরকে সে শিক্ষাই দিয়েছেন। বলেছেন, যে মা নিজ জীবদ্দশায় তার তিন-তিনটি সন্তান হারায়, সে এর বিনিময়ে আখিরাতে জান্নাত লাভ করবে। এই সন্তানেরা তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল হয়ে যাবে। মা ও জাহান্নামের মাঝখানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। এত বড় পুরস্কারের সুসংবাদ যার অন্তরে বদ্ধমূল থাকবে, নিশ্চয়ই সন্তান হারানোর কঠিন বেদনায়ও সে ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারবে। সে তার অন্তরে পাষাণ ভার বইবে, তার চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা বয়ে চলবে, কিন্তু তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণে কোনওরকম সীমালঙ্ঘন হবে না। এরূপ এক নারী তার প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে যখন হাজির হল, তখন তার শালীন পোশাক ও সংযত আচরণ দেখে কারও কারও কাছে অবাক লাগছিল। তারা কিছু কিছু মন্তব্যও করছিল। তখন সেই নারী বলে ওঠেন-
إِنْ أرْزَأ ابْنِي فَلَنْ أرْزَأَ حَيَائِي
'আমি পুত্রহারা হয়েছি বলে লজ্জা তো হারাতে পারব না!’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৮৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৮৫৯১; মুসনাদে আবূ ইয়ালা: ১৫৯১)
উপস্থিত নারীগণ যখন জানতে পারলেন যার তিনটি সন্তান মারা যায় সে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে, তখন কারও কারও জানার আগ্রহ জন্মাল যে, যদি কারও দু'টি সন্তান মারা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- اثنين (দুটি হলেও)। অর্থাৎ কোনও মায়ের যদি দু'টি সন্তানও মারা যায় আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে, তবে তার জন্যও ওই সন্তানদুটি জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হবে। ফলে সে মা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেয়ে জান্নাতবাসী হতে পারবে।
এ হাদীছটিতে যদিও একটি সন্তানের বেলায় উল্লিখিত সুসংবাদ বর্ণিত হয়নি, কিন্তু অন্য হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, একটি সন্তানের বেলায়ও একই কথা। যেমন এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يَقُولُ اللهُ تَعَالَى مَا لِعَبْدِي الْمُؤْمِنِ عِنْدِي جَزَاءٌ إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا ثُمَّ احْتَسَبَهُ إِلَّا الْجَنَّةُ
আল্লাহ তা'আলা বলেন, আমার মুমিন বান্দার জন্যে আমার কাছে জান্নাত ছাড়া কোনও প্রতিদান নেই, যখন আমি দুনিয়াবাসীদের মধ্যে তার প্রিয়বস্তু কেড়ে নিই আর সে তার প্রতিদান আশা করে। (সহীহ বুখারী: ৬৪২৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৩৯৫; ইবনুল মুবারক, আয-যুহ্দ ওয়ার- রাকাইক, ২য় খণ্ড, ২৭ পৃষ্ঠা; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫৪৭)
এমনকি কোনও মায়ের যদি গর্ভপাতও ঘটে, ভ্রূণ অবস্থায়ই তার সন্তানের মৃত্যু হয়ে যায়, তবে সেই সন্তানও মায়ের জান্নাতলাভের অসিলা হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ইআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ السِّقْطَ لَيَجُرُّ أُمَّهُ بِسَرَرِهِ إِلَى الْجَنَّةِ إِذَا احْتَسَبَتْهُ
'যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই আল্লাহর কসম! পতিত ভ্রূণও তার মায়ের নাড়ি ধরে জান্নাতে টেনে নিয়ে যাবে, যদি সে তার বিনিময়ে ছাওয়াবের আশা করে’। (মুসনাদে আহমাদ: ২১৫৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩০০)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইসলাম নারী-পুরুষ সকলের জন্যেই। তাই পুরুষের মতো নারীরও ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হতে হবে।
খ. নারীদের জন্য দীন শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেওয়া পুরুষদের কর্তব্য।
গ. যে নারী তার কোনও সন্তান হারায়, তাকে অবশ্যই ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। তা দিতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ সে জান্নাত লাভ করবে।
يَا رَسُولَ اللَّهِ، ذَهَبَ الرّجَالُ بِحَدِيْثك (ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষগণ আপনার বক্তব্য নিয়ে যায়)। অর্থাৎ পুরুষগণই আপনার বেশিরভাগ সময়টা নিয়ে নেয়। সাধারণত তারাই সরাসরি আপনার বক্তব্য শুনতে পায়। আমরা ঘরে থাকি বলে সে সুযোগ কম হয়। ফলে আমরা সরাসরি আপনার কাছ থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি না।
فَاجْعَلْ لَنَا مِنْ نَفْسِكَ يَوْمًا نَأْتِيكَ فِيْهِ تُعَلِّمُنَا مِمَّا عَلَّمَكَ اللهُ (আপনি আমাদের জন্য একটা দিন ধার্য করুন, যেদিন আমরা আপনার কাছে আসব। আপনি আমাদেরকে শেখাবেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিখিয়েছেন)। অর্থাৎ একটা দিন কেবল আমাদেরকেই দেবেন। সেদিন আপনার মজলিসে কেবল আমরাই থাকব। আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে আপনাকে বিশেষ যে শিক্ষাদান করেছেন, সেদিন আপনি আমাদেরকেও তা শেখাবেন। বলাবাহুল্য, তা ছিল দীনেরই শিক্ষা। দীনের শিক্ষা অর্জনের জন্যই তারা এ আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আবেদন গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন-
اجْتَمِعْنَ يَوْمَ كَذَا وَكَذَا (তোমরা অমুক অমুক দিন একত্র হও)। অর্থাৎ তিনি তাদের জন্য দিন-তারিখ ঠিক করে দিলেন। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কোথায় তারা একত্র হবেন তাও ঠিক করে দিয়েছিলেন। নারীদের জন্য যে-কোনও স্থানে জমা হওয়া সমীচীন নয়। তাদের পর্দা ও নিরাপত্তার দিকে লক্ষ করে উপযুক্ত জায়গা ও উপযুক্ত সময় বেছে নেওয়া চাই। সে হিসেবে তাদের জন্য দিন ও স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হল। সুতরাং নির্ধারিত দিনে তারা নির্ধারিত স্থানে একত্র হলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথারীতি সেখানে হাজির হলেন এবং তাদেরকে দীনের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিলেন। তাদেরকে কি কি শিক্ষা দিয়েছিলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তা এ হাদীছটিতে উল্লেখ করা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বর্ণনায় তার উল্লেখ রয়েছে। সেসব বিষয়ে শিক্ষাদানের পর একটা বিশেষ দিকের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন-
ما منكن من امرأة تقدم ثلاثة من الولد إلا كانوا لها حجابًا من النار ( তোমাদের মধ্যে যে-কোনও নারীর জীবদ্দশায় তার তিনটি সন্তান মারা যায়, তারই জন্য সে সন্তানেরা জাহান্নামের অন্তরায় হবে)। মা হিসেবে নারীদেরকে আল্লাহ তা'আলা স্বভাবগতভাবেই মমতাময়ী বানিয়েছেন। সন্তানের প্রতি তাদের মায়া-মমতা অসাধারণ। এটা জীবমাত্রেরই বৈশিষ্ট্য। মা পশু-পাখিরাও তাদের বাচ্চাদের প্রতি অশেষ মায়া-মমতা লালন করে। সৃষ্টির সেরা মানুষের ভেতর এ গুণ আরও বেশি। তাই মানবমায়েরা তাদের সন্তানদের ভালোবাসে প্রাণাধিক। গর্ভে ধারণ করা, প্রসব করা ও লালন-পালন করার এক দীর্ঘ মায়াময় সিলসিলার ভেতর দিয়ে তার সন্তানের অস্তিত্ব ও বেড়ে ওঠা। এহেন সন্তানের কিছু একটা হয়ে গেলে মায়ের পক্ষে তা হয় বড়ই মর্মবিদারী। সেই সন্তানের মৃত্যু হলে মায়ের যে কতটা কষ্ট হয়, তা কেবল মা'ই বুঝতে পারে। অধিকাংশ মা সে কষ্টে ধৈর্য রক্ষা করতে পারে না। তখন সে এমনই আকুল হয়ে পড়ে যে, উচিত-অনুচিতের বোধ-বুদ্ধি পর্যন্ত তখন হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় তার দ্বারা নানারকম সীমালঙ্ঘন হয়ে যায়। অনেক মা স্বভাবগত লজ্জা-শরমও হারিয়ে ফেলে। বরবাদ হয়ে যায় তার আকীদা-বিশ্বাস পর্যন্তও। তাই মায়েদের জন্য সবরের শিক্ষা অতীব প্রয়োজনীয়। কষ্ট অনেক বড়। তাই বড় রকমের সবরও দরকার, যাতে করে সন্তান হারানোর পরিণামে তার আখিরাতও হারিয়ে না যায়; বরং সবরের বদৌলতে আখিরাতে অনেক বড় পুরস্কারের অধিকারী হয়ে যায়। এ হাদীছটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়েদেরকে সে শিক্ষাই দিয়েছেন। বলেছেন, যে মা নিজ জীবদ্দশায় তার তিন-তিনটি সন্তান হারায়, সে এর বিনিময়ে আখিরাতে জান্নাত লাভ করবে। এই সন্তানেরা তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল হয়ে যাবে। মা ও জাহান্নামের মাঝখানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। এত বড় পুরস্কারের সুসংবাদ যার অন্তরে বদ্ধমূল থাকবে, নিশ্চয়ই সন্তান হারানোর কঠিন বেদনায়ও সে ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারবে। সে তার অন্তরে পাষাণ ভার বইবে, তার চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা বয়ে চলবে, কিন্তু তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণে কোনওরকম সীমালঙ্ঘন হবে না। এরূপ এক নারী তার প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে যখন হাজির হল, তখন তার শালীন পোশাক ও সংযত আচরণ দেখে কারও কারও কাছে অবাক লাগছিল। তারা কিছু কিছু মন্তব্যও করছিল। তখন সেই নারী বলে ওঠেন-
إِنْ أرْزَأ ابْنِي فَلَنْ أرْزَأَ حَيَائِي
'আমি পুত্রহারা হয়েছি বলে লজ্জা তো হারাতে পারব না!’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৮৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৮৫৯১; মুসনাদে আবূ ইয়ালা: ১৫৯১)
উপস্থিত নারীগণ যখন জানতে পারলেন যার তিনটি সন্তান মারা যায় সে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে, তখন কারও কারও জানার আগ্রহ জন্মাল যে, যদি কারও দু'টি সন্তান মারা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- اثنين (দুটি হলেও)। অর্থাৎ কোনও মায়ের যদি দু'টি সন্তানও মারা যায় আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে, তবে তার জন্যও ওই সন্তানদুটি জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হবে। ফলে সে মা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেয়ে জান্নাতবাসী হতে পারবে।
এ হাদীছটিতে যদিও একটি সন্তানের বেলায় উল্লিখিত সুসংবাদ বর্ণিত হয়নি, কিন্তু অন্য হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, একটি সন্তানের বেলায়ও একই কথা। যেমন এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يَقُولُ اللهُ تَعَالَى مَا لِعَبْدِي الْمُؤْمِنِ عِنْدِي جَزَاءٌ إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا ثُمَّ احْتَسَبَهُ إِلَّا الْجَنَّةُ
আল্লাহ তা'আলা বলেন, আমার মুমিন বান্দার জন্যে আমার কাছে জান্নাত ছাড়া কোনও প্রতিদান নেই, যখন আমি দুনিয়াবাসীদের মধ্যে তার প্রিয়বস্তু কেড়ে নিই আর সে তার প্রতিদান আশা করে। (সহীহ বুখারী: ৬৪২৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৩৯৫; ইবনুল মুবারক, আয-যুহ্দ ওয়ার- রাকাইক, ২য় খণ্ড, ২৭ পৃষ্ঠা; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫৪৭)
এমনকি কোনও মায়ের যদি গর্ভপাতও ঘটে, ভ্রূণ অবস্থায়ই তার সন্তানের মৃত্যু হয়ে যায়, তবে সেই সন্তানও মায়ের জান্নাতলাভের অসিলা হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ইআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ السِّقْطَ لَيَجُرُّ أُمَّهُ بِسَرَرِهِ إِلَى الْجَنَّةِ إِذَا احْتَسَبَتْهُ
'যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই আল্লাহর কসম! পতিত ভ্রূণও তার মায়ের নাড়ি ধরে জান্নাতে টেনে নিয়ে যাবে, যদি সে তার বিনিময়ে ছাওয়াবের আশা করে’। (মুসনাদে আহমাদ: ২১৫৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩০০)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইসলাম নারী-পুরুষ সকলের জন্যেই। তাই পুরুষের মতো নারীরও ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হতে হবে।
খ. নারীদের জন্য দীন শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেওয়া পুরুষদের কর্তব্য।
গ. যে নারী তার কোনও সন্তান হারায়, তাকে অবশ্যই ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। তা দিতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ সে জান্নাত লাভ করবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)