আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৫. অধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়

হাদীস নং: ২৭০৭
অধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়
ক্রয়-বিক্রয়ে উসারচিয়তার প্রতি উৎসাহ দান এবং মূল্য গ্রহণ ও পরিশোধে সৌজন্য রক্ষা প্রসঙ্গ
২৭০৭. আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে ঐ ব্যক্তির কথা বলব না, যে জাহান্নামের পক্ষে হারাম হয়ে যায় এবং জাহান্নামও তার পক্ষে হারাম হয়ে যায়? (তারা হল) প্রত্যেক উদার, নম্র ও ভদ্র ব্যক্তি।
(হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ এটি হাসান-গরীব হাদীস। তাবারানীও এটি তাঁর কবীর'-এ উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন। তিনি এখানে "বিনয়ী” কথাটিও উল্লেখ করেছেন। ইবন হিব্বানও এটি তাঁর 'সহীহ' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। ইবন হিব্বানের অপর এক বর্ণনায় এরূপ রয়েছে। প্রত্যেক নম্র, বিনয়ী, উদার ও ভদ্র ব্যক্তির উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়।)
كتاب البيوع
التَّرْغِيب فِي السماحة فِي البيع وَالشِّرَاء وَحسن التقاضي وَالْقَضَاء
2707- وَعَن عبد الله بن مَسْعُود رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم أَلا أخْبركُم بِمن يحرم على النَّار وَمن تحرم عَلَيْهِ النَّار على كل قريب هَين سهل

رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَقَالَ حَدِيث حسن غَرِيب وَالطَّبَرَانِيّ فِي الْكَبِير بِإِسْنَاد جيد وَزَاد لين
وَابْن حبَان فِي صَحِيحه
وَفِي رِوَايَة لِابْنِ حبَان إِنَّمَا تحرم النَّار على كل هَين لين قريب سهل

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করা মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। কে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, কী উপায়ে মুক্তি পাওয়া যাবে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা প্রত্যেকের জানা দরকার। তাই এর প্রতি উৎসাহ দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلا أَخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ؟ (আমি কি তোমাদের জানাব না কোন ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করা হয়)? প্রথমে 'আমি কি তোমাদের জানাব না' বলে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করা হয়েছে, যাতে অন্যসব চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দিয়ে, অন্য সবকিছু থেকে মনোযোগ তুলে নিয়ে তাঁর বক্তব্যের দিকে মনোযোগ দেন এবং তিনি কী বলেন তা মন দিয়ে শোনেন।

কাউকে জাহান্নামের জন্য হারাম করার অর্থ বাহ্যত এই যে, জাহান্নামের আগুন থেকে দহনশক্তি কেড়ে নেওয়া হবে, ফলে জাহান্নাম তাকে জ্বালাতে পারবে না। যেমন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুন জ্বালাতে পারেনি। তবে এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জাহান্নাম তাকে স্পর্শই করতে পারবে না। কেননা জাহান্নাম থেকে তাকে দূরে রাখা হবে।

أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارِ؟ (অথবা কার জন্য জাহান্নামকে হারাম করা হয়)? উভয় বাক্য দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য মূলত এ কথাই যে, সে ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে। ফলে জাহান্নাম তাকে কষ্ট দিতে পারবে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু'টি বাক্যের যে-কোনও একটি বলেছিলেন। কিন্তু বর্ণনাকারীর সন্দেহ হয়েছে যে, তিনি ঠিক কোনটি বলেছিলেন। সে কারণেই তিনি সুনির্দিষ্টভাবে একটি বাক্য উল্লেখ না করে দু'টিই উল্লেখ করে দিয়েছেন।

تَحْرُمُ عَلَى كُلِّ قَرِيبٍ، هَيْنِ، لَيْنِ، سَهْل জাহান্নামকে হারাম করা হয় প্রত্যেক ওই ব্যক্তির জন্য, যে (মানুষের) নিকটবর্তী, শান্ত, কোমল ও সহজস্বভাবের'। জাহান্নামকে যার জন্য হারাম করা হয় অর্থাৎ যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে, এখানে তার বৈশিষ্ট্যাবলি বোঝানোর জন্য চারটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হল قرِيب (নিকটবর্তী)। অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার আন্তরিকতাপূর্ণ ও সৌজন্যমূলক। ফলে মানুষ সহজেই তার কাছে আসতে পারে। অনেক লোক এমন হয়ে থাকে, যারা কাছে থেকেও যেন দূরবর্তী। কেননা কঠোর স্বভাবের কারণে মানুষ সহজে তার কাছে ভিড়তে পারে না। ফলে তারা তাকে এড়িয়ে চলে ও তার থেকে দূরে থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তি জান্নাতবাসী হবে, জাহান্নাম যাকে স্পর্শ করতে পারবে না, সে এমন স্বভাবের নয়। সে সদাচারী ও আন্তরিক হওয়ায় লোকে সহজেই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে। এরূপ ব্যক্তি মানুষ থেকে দূরে থেকেও যেন খুব কাছের।

দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শব্দ হল هَين- لَيْن - سَهْل (শান্ত, কোমল ও সহজস্বভাবের) তিনওটি শব্দ কাছাকাছি অর্থের। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য- জান্নাতবাসী ব্যক্তি দুনিয়ায় বিনয়ী ও কোমল স্বভাবের হয়ে থাকে। দুনিয়াবী বিষয়ে মানুষের সঙ্গে তাদের আচরণ হয় সহজ। তারা লেনদেনে হয় নমনীয়। ছাড় দিতে অভ্যস্ত থাকে। মানুষ তাদের সঙ্গে লেনদেন করে আরাম পায়। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
المُؤْمِنُونَ هَيِّنُوْنَ لَيِّنُوْنَ كَالْجَمَلِ الْأَنفِ، إِنْ قِيدَ انْقَادَ، وَإِنْ أُنِيخَ اسْتَنَاخَ عَلَى صَخْرَةٍ
মুমিনগণ সহজ ও কোমল হয়ে থাকে। পোষমানা উটের মতো। তাকে টেনে নেওয়া হলে চলতে থাকে। যদি বসানো হয়, পাথরের উপরও বসে পড়ে। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৭৭৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ : ৩৫০৬)

প্রকাশ থাকে যে, মুমিনদের এ নম্রতা কেবলই তাদের ব্যক্তিগত বা দুনিয়াবী বিষয়ে। দীনের ক্ষেত্রে তারা থাকে অটল ও আপোশহীন। সে ক্ষেত্রে তারা কখনও ছাড় দেয় না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাত লাভ করাই মুমিন ব্যক্তির পরম লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত।

খ. মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও লেনদেনে কিছুতেই কঠোর হতে নেই। কেননা পার্থিব বিষয়ে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন পরকালীন নাজাতলাভের পক্ষে সহায়ক।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান