আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
১৪. অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ
হাদীস নং: ২৫৮৭
অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ
সর্বদা বেশি করে নবী করীম (ﷺ) -এর প্রতি দরূদ পাঠের ব্যাপারে উৎসাহ দান ও তাঁর আলোচনার সময় যে ব্যক্তি দরূদ পাঠ করে না, তার সম্পর্কে সতর্কবাণী
২৫৮৭. হযরত উবাই ইবন কা'ব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের এক-চতুর্থাংশ অতিবাহিত হলে উঠে গেলেন এবং বলতে লাগলেনঃ হে লোক সকল। তোমরা আল্লাহর যিক্র কর, তোমরা আল্লাহর যিক্র কর। প্রকম্পিতকারী এসে গিয়েছে যার পিছনে আসবে পশ্চাদগামী মৃত্যু তার তিক্ততা নিয়ে এসে গিয়েছে, মৃত্যু তার তিক্ততা নিয়ে এসে গিয়েছে। উবাই ইবন কা'ব বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তো দু'আর মধ্যে অনেক সময় কাটাই, অতএব আপনার উপর দুরূদের জন্য কতটুকু সময় দেব? তিনি বললেন, তোমার ইচ্ছা। আমি বললাম, এক চতুর্থাংশ? তিনি বললেন, তোমার ইচ্ছা, তবে আরে বাড়িয়ে নিলে তোমার জন্য বেশি ভাল হয়। উবাই বলেন, আমি বললাম, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার ইচ্ছা, তবে আরো বেশি করলে তোমার জন্য ভাল হবে। আমি বললাম তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেন, তোমার ইচ্ছা, তবে আরো বাড়িয়ে দিতে পারলে বেশি ভাল। উবাই তখন বললেনঃ আমার দু'আর সবটুকু সময় আপনার উপর দুরূদ পড়ার জন্য দিয়ে দিব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তাহলে তোমার সব দুশ্চিন্তার জন্যে যথেষ্ট করে দেয়া হবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
(হাদীসটি আহমদ, তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন। হাকিম এটিকে সহীহ বলেও মন্তব্য করেছেন। তিরমিযী বলেছেনঃ হাদীসটি হাসান-সহীহ।
আহমদের অপর এক বর্ণনা উবাই থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক ব্যাক্তি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আপনি বলুনতো, আমি যদি আমার দু'আর সবটুকু সময় আপনার উপর দরূদ পাঠের জন্য রেখে দেই? তিনি বললেন। তাহলে মহান আল্লাহ তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের দুশ্চিন্তার ব্যাপারে যথেষ্ট হয়ে যাবেন।
এর সনদটি খুবই উত্তম।)
(হাদীসটি আহমদ, তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন। হাকিম এটিকে সহীহ বলেও মন্তব্য করেছেন। তিরমিযী বলেছেনঃ হাদীসটি হাসান-সহীহ।
আহমদের অপর এক বর্ণনা উবাই থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক ব্যাক্তি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আপনি বলুনতো, আমি যদি আমার দু'আর সবটুকু সময় আপনার উপর দরূদ পাঠের জন্য রেখে দেই? তিনি বললেন। তাহলে মহান আল্লাহ তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের দুশ্চিন্তার ব্যাপারে যথেষ্ট হয়ে যাবেন।
এর সনদটি খুবই উত্তম।)
كتاب الذّكر وَالدُّعَاء
التَّرْغِيب فِي إكثار الصَّلَاة على النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم والترهيب من تَركهَا عِنْد ذكره صلى الله عَلَيْهِ وَسلم كثيرا دَائِما
2587- وَعَن أبي بن كَعْب رَضِي الله عَنهُ قَالَ كَانَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِذا ذهب ربع اللَّيْل قَامَ فَقَالَ يَا أَيهَا النَّاس اذْكروا الله اذْكروا الله جَاءَت الراجفة تتبعها الرادفة جَاءَ الْمَوْت بِمَا فِيهِ جَاءَ الْمَوْت بِمَا فِيهِ
قَالَ أبي بن كَعْب فَقلت يَا رَسُول الله إِنِّي أَكثر الصَّلَاة فكم أجعَل لَك من صَلَاتي
قَالَ مَا شِئْت قَالَ قلت الرّبع
قَالَ مَا شِئْت وَإِن زِدْت فَهُوَ خير لَك قَالَ فَقلت فثلثين قَالَ مَا شِئْت فَإِن زِدْت فَهُوَ خير لَك
قلت النّصْف قَالَ مَا شِئْت وَإِن زِدْت فَهُوَ خير لَك
قَالَ أجعَل لَك صَلَاتي كلهَا قَالَ إِذا يكفى همك وَيغْفر لَك ذَنْبك
رَوَاهُ أَحْمد وَالتِّرْمِذِيّ وَالْحَاكِم وَصَححهُ قَالَ التِّرْمِذِيّ حَدِيث حسن صَحِيح
وَفِي رِوَايَة لاحمد عَنهُ قَالَ قَالَ رجل يَا رَسُول الله أَرَأَيْت إِن جعلت صَلَاتي كلهَا عَلَيْك قَالَ إِذا يَكْفِيك الله تبَارك وَتَعَالَى مَا أهمك من دنياك وآخرتك وَإسْنَاد هَذِه جيد
قَالَ أبي بن كَعْب فَقلت يَا رَسُول الله إِنِّي أَكثر الصَّلَاة فكم أجعَل لَك من صَلَاتي
قَالَ مَا شِئْت قَالَ قلت الرّبع
قَالَ مَا شِئْت وَإِن زِدْت فَهُوَ خير لَك قَالَ فَقلت فثلثين قَالَ مَا شِئْت فَإِن زِدْت فَهُوَ خير لَك
قلت النّصْف قَالَ مَا شِئْت وَإِن زِدْت فَهُوَ خير لَك
قَالَ أجعَل لَك صَلَاتي كلهَا قَالَ إِذا يكفى همك وَيغْفر لَك ذَنْبك
رَوَاهُ أَحْمد وَالتِّرْمِذِيّ وَالْحَاكِم وَصَححهُ قَالَ التِّرْمِذِيّ حَدِيث حسن صَحِيح
وَفِي رِوَايَة لاحمد عَنهُ قَالَ قَالَ رجل يَا رَسُول الله أَرَأَيْت إِن جعلت صَلَاتي كلهَا عَلَيْك قَالَ إِذا يَكْفِيك الله تبَارك وَتَعَالَى مَا أهمك من دنياك وآخرتك وَإسْنَاد هَذِه جيد
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত উবাঈ ইবন কা‘ব রাযি. জানাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের এক-তৃতীয়াংশ গত হওয়ার পর উঠে দাঁড়াতেন এবং মানুষকে লক্ষ্য করে একটি বক্তব্য দিতেন। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তিনি এটা করতেন রাতের এক-চতুর্থাংশ পার হওয়ার পর। এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। দু'রকমই হতো। তিনি তাঁর সে বক্তৃতায় মানুষকে উদাসীনতা ঝেড়ে আমলে সচেষ্ট থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا اللَّهَ (হে মানুষ! আল্লাহকে স্মরণ করো)। 'স্মরণ করা' কথাটির অর্থ ব্যাপক। এটা মুখে হয়, অন্তরে হয় এবং আমলের দ্বারাও হয়। মুখে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি যিকির করা যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি মনে মনে আল্লাহর নি'আমত চিন্তা করা, আল্লাহর গুণাবলি কল্পনা করা, আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখা এবং এ জাতীয় আল্লাহসম্পর্কিত অন্যান্য ভাবনা-কল্পনাও এর মধ্যে পড়ে। তবে সর্বাপেক্ষা বড় যিকির ও স্মরণ হল আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালন করা।
جَاءَتِ الرَّاجِفَةُ (প্রথম ফুৎকার এসেই পড়ল)। الرَّاجِفَةُ এর মূল অর্থ প্রকম্পিতকারী। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য শিঙ্গায় হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালামের প্রথম ফুৎকার। সে ফুৎকারে পাহাড়-পর্বতসহ গোটা পৃথিবী প্রকম্পিত হবে এবং সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। সারা জগতে মহাপ্রলয় নেমে আসবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ
‘এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করবেন সে ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই মূর্ছিত হয়ে পড়বে।’(সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৬৮)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ تَرْجُفُ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ وَكَانَتِ الْجِبَالُ كَثِيبًا مَهِيلًا (14)
যেদিন ভূমি ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে এবং সমস্ত পাহাড় বহমান বালুর স্তুপে পরিণত হবে।(সূরা মুযযাম্মিল (৭৩), আয়াত ১৪)
تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ (তার অনুগামী হয়ে আসছে পরের ফুৎকার)। এটা শিঙ্গার দ্বিতীয় ফুৎকার। আল্লাহ তা'আলা যখন মানুষকে পুনর্জীবিত করে হিসাব-নিকাশের জন্য একত্র করার ইচ্ছা করবেন, তখন তাঁর হুকুমে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি আপন আপন স্থান থেকে জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ
তারপর তাতে দ্বিতীয় ফুঁক দেওয়া হবে, অমনি তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকিয়ে থাকবে।(সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৬৮)
সূরা ইয়াসীনে আছে-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ (51) قَالُوا يَاوَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ (52) إِنْ كَانَتْ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ جَمِيعٌ لَدَيْنَا مُحْضَرُونَ (53)
‘এবং শিঙ্গায় (দ্বিতীয়) ফুঁ দেওয়া হবে। অমনি তারা আপন-আপন কবর থেকে বের হয়ে তাদের প্রতিপালকের দিকে ছুটে চলবে। তারা বলতে থাকবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠাল? (উত্তর দেওয়া হবে,) এটা সেই জিনিস, যার প্রতিশ্রুতি দয়াময় আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য কথা বলেছিল। আর কিছুই নয়, কেবল একটি মহানাদ হবে, অমনি তাদের সকলকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে।’(সূরা ইয়াসীন (৩৬), আয়াত ৫১-৫৩)
جَاءَ الْمَوْتُ بِمَا فِيْهِ، جَاءَ الْمَوْتُ بِمَا فِيهِ ‘মৃত্যু আসছে তার ভেতর যা আছে তা সহ'। 'মৃত্যুর ভেতর যা আছে' বলে মৃত্যুর কঠিন যন্ত্রণা, আত্মীয়-স্বজন ও ধন-সম্পদ ছেড়ে যাওয়ার বেদনা, তারপর মাটির অন্ধকার কবরে নিঃসঙ্গ অবস্থান- এ যাবতীয় বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কথাটি দু'বার বলে এসব যে কতটা ভয়াবহ সেদিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য।
এ পর্যন্ত ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণ। এরপর হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি, জানাচ্ছেন যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বেশি পরিমাণে দরূদ পড়তেন। আবার তিনি অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এবং দু'আও নিয়মিত করতেন। তবে দরূদ পাঠের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না অন্যান্য ইবাদত, দু'আ ও দরূদ সব মিলিয়ে যে সময় ব্যয় করেন, তার মধ্যে কতটুকু সময় দরূদ পড়ার জন্য বরাদ্দ করবেন। এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন-
فَكمْ أَجْعَلُ لَكَ مِنْ صَلَاتِي؟ ‘তা আমার ইবাদতের মধ্যে আপনার (প্রতি দরূদপাঠের) জন্য কতটুকু সময় বরাদ্দ করব'? صَلَاة (সালাত) শব্দটি নামায, ইবাদত, দু'আ, রহমত, দরূদ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে 'ইবাদত' অর্থ নেওয়াই বেশি সঙ্গত। তাতে শব্দটির অর্থে ব্যাপকতা আসে এবং নামায, যিকির, তিলাওয়াত, দু'আ, দরূদ সবই এর অন্তর্ভুক্ত হয়। উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. এসব ইবাদতের সবই করতেন। তিনি চাচ্ছিলেন দরূদপাঠের জন্য এর মধ্য থেকে নির্ধারিত একটা অংশ বরাদ্দ থাকুক। সে কারণেই তাঁর এ জিজ্ঞাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
مَا شِئْتَ (তোমার যতটুকু ইচ্ছা)। তিনি সময়ের কোনও অংশ নির্ধারণ করে দিলেন না; বরং তাঁর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলেন। বোঝাচ্ছিলেন, তোমার নফল ইবাদতের সবটা সময়ও যদি দরূদপাঠে ব্যবহার কর, তাতেও কোনও অসুবিধা নেই। বাকি বিভিন্ন সময় মনের বিভিন্ন অবস্থা হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতিও সবসময় একরকম থাকে না। এ অবস্থায় সময়ের কোনও অংশ নির্ধারণ করে দিলে তা রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তুমি নিজের অবস্থা নিজেই ভালো জান। কাজেই সে অনুযায়ী নিজেই সময় ঠিক করে নাও।
তারপরও হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেই সময় বরাদ্দ করিয়ে নিতে চাইলেন। এটা ছিল তাঁর আদব ও নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সেইসঙ্গে বরকতলাভের আকাঙ্ক্ষাও এর মধ্যে নিহিত ছিল। সেমতে তিনি প্রথমে সময়ের চার ভাগের একভাগ, তারপর অর্ধেক এবং সবশেষে তিন ভাগের দুই ভাগ দরূদ পাঠের জন্য বরাদ্দ করবেন কি না, তা জিজ্ঞেস করলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি পরিমাণকেই অনুমোদন করলেন এবং চাইলে তারচে' বেশি পড়ারও এখতিয়ার দিলেন। সেইসঙ্গে এ কথাও জানিয়ে দিলেন যে, দরূদ যত বেশি পড়বে, ততোই কল্যাণ। হযরত উবাঈ রাযি. এ কথায় খুব উৎসাহ পেলেন। শেষে তিনি বললেন-
أَجْعَلُ لَكَ صَلَاتِي كُلَّهَا؟ ‘আমার নফল ইবাদতের সবটা (সময়)ই কি আপনার প্রতি সালাতের জন্য বরাদ্দ করব'? এ বাক্যটি প্রশ্নবোধকও হতে পারে এবং সংবাদমূলকও হতে পারে। সংবাদমূলক হলে অর্থ হবে- যদি দরূদের জন্য তিন ভাগের দুই ভাগেরও বেশি সময় বরাদ্দ রাখা আমার পক্ষে কল্যাণকর হয়, তবে ঠিক আছে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে আমি আমার সবটা সময়ই আপনার প্রতি দরূদ পাঠের জন্য সংরক্ষিত রাখব এবং সে হিসেবে অন্যান্য নফল ইবাদত, যিকির ও দু'আ করার পরিবর্তে সবটা সময় আপনার প্রতি দরূদপাঠেই খরচ করব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করলেন এবং উৎসাহ বর্ধনের লক্ষ্যে বললেন-
إِذَا تُكْفَى هَمَّكَ، وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبَكَ (তাহলে সেটা তোমার যাবতীয় দুশ্চিন্তা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হবে এবং তোমার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে)। অর্থাৎ আমার প্রতি দরূদ পাঠ করতে থাকলে তার বরকতে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে দুনিয়াবী ও পরকালীন উভয় জগতের যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখবেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, এক সাহাবী এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি আমার (নফল) ইবাদতের সবটা সময় আপনার প্রতি দরূদপাঠের জন্য বরাদ্দ করি, তবে সে ব্যাপারে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন-
إِذًا يَكْفِيْكَ اللَّهُ أَمْرَ دُنْيَاكَ وَآخِرَتِكَ
‘তবে আল্লাহ তা'আলা তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় বিষয়ের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন।’(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১৪৭৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৮৭০৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৫৭৪)
হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. রোজানা কী পরিমাণ দরূদ পাঠ করবেন সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হলেন। এর দ্বারা বোঝা যায় নিয়মিতভাবে করার জন্য কোনও নফল আমলের পরিমাণ নিজে নিজে নির্ধারণ না করে ইসলাহী মুরুব্বীর মাধ্যমে করানো ভালো। এটা আমলের স্থায়িত্ব রক্ষার পক্ষে সহায়ক। নিজে নিজে নির্ধারণ করলে সাধারণত তা ক্ষণিকের জযবায় করা হয়ে থাকে। তাতে আনুষাঙ্গিক বিষয়সমূহের প্রতি লক্ষ রাখা হয় না। ফলে পরিমাণ নির্ধারণ যথাযথ হয় না। এক পর্যায়ে তা অনেক ভারি মনে হয়। তখন তা ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনও আমল নিয়মিতভাবে শুরু করার পর ছেড়ে দেওয়া খুবই নিন্দনীয়। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদপাঠ অনেকগুলো ইবাদতের সমষ্টি। দরূদ পাঠ করা আল্লাহ তা'আলার হুকুম। কাজেই দরূদ পাঠ করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করা হয়। দরূদপাঠের মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তা'আলার যিকির। দরূদপাঠে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করা হয়- যেন তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর খাস রহমত বর্ষণ করেন। এ দু'আর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার প্রতি বান্দার বন্দেগী প্রকাশ করা হয় এবং নিজ ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দরূদপাঠ দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। এর প্রত্যেকটিই একেকটি স্বতন্ত্র ইবাদত। দরূদপাঠ যেহেতু আল্লাহ তা'আলার যিকিরও, আর যিকিরের একটি ফযীলত হল তা দু'আরও বিকল্প, সেহেতু দরূদ পাঠকারী দু'আ না করেও আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আর ফল পেয়ে যায়। এক হাদীছে-কুদসীতে আছে-
مَنْ شَغَلَهُ ذِكْرِي عَنْ مَسْأَلَتِي أَعْطَيْتُهُ أَفْضَلَ مَا أُعْطِي السَّائِلِينَ
‘যে ব্যক্তি আমার যিকিরে মশগুল থাকার কারণে আমার কাছে প্রার্থনা করতে পারে না, আমি তাকে প্রার্থনাকারীদের যা দিয়ে থাকি তারচে'ও উত্তম কিছু দিই।(শু'আবুল ঈমান : ৫৬৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৯২৭১; বুখারী, খালকু আফ'আলিল ইবাদ, ১ খণ্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা; বায়হাকী, ফাযাইলুল আওকাত : ১৯৪)
তাহলে দেখা যাচ্ছে দরূদে সবটা সময় ব্যয় করার দ্বারা কোনও ইবাদতই হারানো হয় না। বরং সবকিছু করার দ্বারা যা লাভ হতে পারে, এর দ্বারা তারচে'ও বেশি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ছাওয়াব, পাওয়া যায় দু'আর প্রতিদান, তদুপরি পাওয়া যায় আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমতও। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا
‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন।(সহীহ মুসলিম: ৪০৮; সুনানে আবু দাউদ: ১৫৩০; সুনানে নাসাঈ ১২৯৬; সুনানে দারিমী: ২৮১৪; সহীহ ইবন হিব্বান: ৯০৬; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭২৩৫)
তারপর আবার দরূদপাঠ দ্বারা গুনাহও মাফ হয়। গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তি জীবনের এক পরম লক্ষ্য। আল্লাহ তা'আলার কাছে যে ব্যক্তি ক্ষমা পায়, সে তাঁর সন্তুষ্টিও পেয়ে যায়। ফলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে হয়ে যায় জান্নাতের অধিকারী, যা কিনা মানবজীবনের পরম সফলতা। তাহলে দরূদ পাঠ দ্বারা যা পাওয়া যায়, তারচে' বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? সুতরাং নিজ সময়ের সবটা যদি দরূদপাঠের জন্য বরাদ্দ করা সম্ভব হয়, তবে এরচে' সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সর্বাবস্থায় অন্তরে ও মুখে আল্লাহ তা'আলার যিকির জারি রাখা চাই।
খ. হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় দু'বার ফুঁ দেবেন। এটা সত্য। একবারের ফুঁকে জগৎ ধ্বংস হবে, আরেকবারের ফুঁকে পুনরুত্থান ঘটবে।
গ. মৃত্যু বড় কঠিন। সে কথা কখনও ভুলতে নেই।
ঘ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদপাঠ যত বেশি করা যায় ততোই কল্যাণ। তাতে দুনিয়া ও আখিরাতের দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচা যায় ও গুনাহ মাফ হয়।
ঙ. নিয়মিত আমলের জন্য নফল ইবাদতের পরিমাণ ইসলাহী মুরুব্বীর পরামর্শে নির্ধারণ করা ভালো।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا اللَّهَ (হে মানুষ! আল্লাহকে স্মরণ করো)। 'স্মরণ করা' কথাটির অর্থ ব্যাপক। এটা মুখে হয়, অন্তরে হয় এবং আমলের দ্বারাও হয়। মুখে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি যিকির করা যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি মনে মনে আল্লাহর নি'আমত চিন্তা করা, আল্লাহর গুণাবলি কল্পনা করা, আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখা এবং এ জাতীয় আল্লাহসম্পর্কিত অন্যান্য ভাবনা-কল্পনাও এর মধ্যে পড়ে। তবে সর্বাপেক্ষা বড় যিকির ও স্মরণ হল আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালন করা।
جَاءَتِ الرَّاجِفَةُ (প্রথম ফুৎকার এসেই পড়ল)। الرَّاجِفَةُ এর মূল অর্থ প্রকম্পিতকারী। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য শিঙ্গায় হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালামের প্রথম ফুৎকার। সে ফুৎকারে পাহাড়-পর্বতসহ গোটা পৃথিবী প্রকম্পিত হবে এবং সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। সারা জগতে মহাপ্রলয় নেমে আসবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ
‘এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করবেন সে ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই মূর্ছিত হয়ে পড়বে।’(সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৬৮)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ تَرْجُفُ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ وَكَانَتِ الْجِبَالُ كَثِيبًا مَهِيلًا (14)
যেদিন ভূমি ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবে এবং সমস্ত পাহাড় বহমান বালুর স্তুপে পরিণত হবে।(সূরা মুযযাম্মিল (৭৩), আয়াত ১৪)
تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ (তার অনুগামী হয়ে আসছে পরের ফুৎকার)। এটা শিঙ্গার দ্বিতীয় ফুৎকার। আল্লাহ তা'আলা যখন মানুষকে পুনর্জীবিত করে হিসাব-নিকাশের জন্য একত্র করার ইচ্ছা করবেন, তখন তাঁর হুকুমে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি আপন আপন স্থান থেকে জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ
তারপর তাতে দ্বিতীয় ফুঁক দেওয়া হবে, অমনি তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকিয়ে থাকবে।(সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৬৮)
সূরা ইয়াসীনে আছে-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ (51) قَالُوا يَاوَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ (52) إِنْ كَانَتْ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ جَمِيعٌ لَدَيْنَا مُحْضَرُونَ (53)
‘এবং শিঙ্গায় (দ্বিতীয়) ফুঁ দেওয়া হবে। অমনি তারা আপন-আপন কবর থেকে বের হয়ে তাদের প্রতিপালকের দিকে ছুটে চলবে। তারা বলতে থাকবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠাল? (উত্তর দেওয়া হবে,) এটা সেই জিনিস, যার প্রতিশ্রুতি দয়াময় আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য কথা বলেছিল। আর কিছুই নয়, কেবল একটি মহানাদ হবে, অমনি তাদের সকলকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে।’(সূরা ইয়াসীন (৩৬), আয়াত ৫১-৫৩)
جَاءَ الْمَوْتُ بِمَا فِيْهِ، جَاءَ الْمَوْتُ بِمَا فِيهِ ‘মৃত্যু আসছে তার ভেতর যা আছে তা সহ'। 'মৃত্যুর ভেতর যা আছে' বলে মৃত্যুর কঠিন যন্ত্রণা, আত্মীয়-স্বজন ও ধন-সম্পদ ছেড়ে যাওয়ার বেদনা, তারপর মাটির অন্ধকার কবরে নিঃসঙ্গ অবস্থান- এ যাবতীয় বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কথাটি দু'বার বলে এসব যে কতটা ভয়াবহ সেদিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য।
এ পর্যন্ত ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণ। এরপর হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি, জানাচ্ছেন যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বেশি পরিমাণে দরূদ পড়তেন। আবার তিনি অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এবং দু'আও নিয়মিত করতেন। তবে দরূদ পাঠের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না অন্যান্য ইবাদত, দু'আ ও দরূদ সব মিলিয়ে যে সময় ব্যয় করেন, তার মধ্যে কতটুকু সময় দরূদ পড়ার জন্য বরাদ্দ করবেন। এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন-
فَكمْ أَجْعَلُ لَكَ مِنْ صَلَاتِي؟ ‘তা আমার ইবাদতের মধ্যে আপনার (প্রতি দরূদপাঠের) জন্য কতটুকু সময় বরাদ্দ করব'? صَلَاة (সালাত) শব্দটি নামায, ইবাদত, দু'আ, রহমত, দরূদ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে 'ইবাদত' অর্থ নেওয়াই বেশি সঙ্গত। তাতে শব্দটির অর্থে ব্যাপকতা আসে এবং নামায, যিকির, তিলাওয়াত, দু'আ, দরূদ সবই এর অন্তর্ভুক্ত হয়। উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. এসব ইবাদতের সবই করতেন। তিনি চাচ্ছিলেন দরূদপাঠের জন্য এর মধ্য থেকে নির্ধারিত একটা অংশ বরাদ্দ থাকুক। সে কারণেই তাঁর এ জিজ্ঞাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
مَا شِئْتَ (তোমার যতটুকু ইচ্ছা)। তিনি সময়ের কোনও অংশ নির্ধারণ করে দিলেন না; বরং তাঁর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলেন। বোঝাচ্ছিলেন, তোমার নফল ইবাদতের সবটা সময়ও যদি দরূদপাঠে ব্যবহার কর, তাতেও কোনও অসুবিধা নেই। বাকি বিভিন্ন সময় মনের বিভিন্ন অবস্থা হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতিও সবসময় একরকম থাকে না। এ অবস্থায় সময়ের কোনও অংশ নির্ধারণ করে দিলে তা রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তুমি নিজের অবস্থা নিজেই ভালো জান। কাজেই সে অনুযায়ী নিজেই সময় ঠিক করে নাও।
তারপরও হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেই সময় বরাদ্দ করিয়ে নিতে চাইলেন। এটা ছিল তাঁর আদব ও নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সেইসঙ্গে বরকতলাভের আকাঙ্ক্ষাও এর মধ্যে নিহিত ছিল। সেমতে তিনি প্রথমে সময়ের চার ভাগের একভাগ, তারপর অর্ধেক এবং সবশেষে তিন ভাগের দুই ভাগ দরূদ পাঠের জন্য বরাদ্দ করবেন কি না, তা জিজ্ঞেস করলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি পরিমাণকেই অনুমোদন করলেন এবং চাইলে তারচে' বেশি পড়ারও এখতিয়ার দিলেন। সেইসঙ্গে এ কথাও জানিয়ে দিলেন যে, দরূদ যত বেশি পড়বে, ততোই কল্যাণ। হযরত উবাঈ রাযি. এ কথায় খুব উৎসাহ পেলেন। শেষে তিনি বললেন-
أَجْعَلُ لَكَ صَلَاتِي كُلَّهَا؟ ‘আমার নফল ইবাদতের সবটা (সময়)ই কি আপনার প্রতি সালাতের জন্য বরাদ্দ করব'? এ বাক্যটি প্রশ্নবোধকও হতে পারে এবং সংবাদমূলকও হতে পারে। সংবাদমূলক হলে অর্থ হবে- যদি দরূদের জন্য তিন ভাগের দুই ভাগেরও বেশি সময় বরাদ্দ রাখা আমার পক্ষে কল্যাণকর হয়, তবে ঠিক আছে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে আমি আমার সবটা সময়ই আপনার প্রতি দরূদ পাঠের জন্য সংরক্ষিত রাখব এবং সে হিসেবে অন্যান্য নফল ইবাদত, যিকির ও দু'আ করার পরিবর্তে সবটা সময় আপনার প্রতি দরূদপাঠেই খরচ করব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করলেন এবং উৎসাহ বর্ধনের লক্ষ্যে বললেন-
إِذَا تُكْفَى هَمَّكَ، وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبَكَ (তাহলে সেটা তোমার যাবতীয় দুশ্চিন্তা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হবে এবং তোমার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে)। অর্থাৎ আমার প্রতি দরূদ পাঠ করতে থাকলে তার বরকতে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে দুনিয়াবী ও পরকালীন উভয় জগতের যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখবেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, এক সাহাবী এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি আমার (নফল) ইবাদতের সবটা সময় আপনার প্রতি দরূদপাঠের জন্য বরাদ্দ করি, তবে সে ব্যাপারে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন-
إِذًا يَكْفِيْكَ اللَّهُ أَمْرَ دُنْيَاكَ وَآخِرَتِكَ
‘তবে আল্লাহ তা'আলা তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় বিষয়ের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন।’(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১৪৭৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৮৭০৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৫৭৪)
হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. রোজানা কী পরিমাণ দরূদ পাঠ করবেন সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হলেন। এর দ্বারা বোঝা যায় নিয়মিতভাবে করার জন্য কোনও নফল আমলের পরিমাণ নিজে নিজে নির্ধারণ না করে ইসলাহী মুরুব্বীর মাধ্যমে করানো ভালো। এটা আমলের স্থায়িত্ব রক্ষার পক্ষে সহায়ক। নিজে নিজে নির্ধারণ করলে সাধারণত তা ক্ষণিকের জযবায় করা হয়ে থাকে। তাতে আনুষাঙ্গিক বিষয়সমূহের প্রতি লক্ষ রাখা হয় না। ফলে পরিমাণ নির্ধারণ যথাযথ হয় না। এক পর্যায়ে তা অনেক ভারি মনে হয়। তখন তা ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনও আমল নিয়মিতভাবে শুরু করার পর ছেড়ে দেওয়া খুবই নিন্দনীয়। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদপাঠ অনেকগুলো ইবাদতের সমষ্টি। দরূদ পাঠ করা আল্লাহ তা'আলার হুকুম। কাজেই দরূদ পাঠ করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করা হয়। দরূদপাঠের মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তা'আলার যিকির। দরূদপাঠে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করা হয়- যেন তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর খাস রহমত বর্ষণ করেন। এ দু'আর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার প্রতি বান্দার বন্দেগী প্রকাশ করা হয় এবং নিজ ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দরূদপাঠ দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। এর প্রত্যেকটিই একেকটি স্বতন্ত্র ইবাদত। দরূদপাঠ যেহেতু আল্লাহ তা'আলার যিকিরও, আর যিকিরের একটি ফযীলত হল তা দু'আরও বিকল্প, সেহেতু দরূদ পাঠকারী দু'আ না করেও আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আর ফল পেয়ে যায়। এক হাদীছে-কুদসীতে আছে-
مَنْ شَغَلَهُ ذِكْرِي عَنْ مَسْأَلَتِي أَعْطَيْتُهُ أَفْضَلَ مَا أُعْطِي السَّائِلِينَ
‘যে ব্যক্তি আমার যিকিরে মশগুল থাকার কারণে আমার কাছে প্রার্থনা করতে পারে না, আমি তাকে প্রার্থনাকারীদের যা দিয়ে থাকি তারচে'ও উত্তম কিছু দিই।(শু'আবুল ঈমান : ৫৬৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৯২৭১; বুখারী, খালকু আফ'আলিল ইবাদ, ১ খণ্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা; বায়হাকী, ফাযাইলুল আওকাত : ১৯৪)
তাহলে দেখা যাচ্ছে দরূদে সবটা সময় ব্যয় করার দ্বারা কোনও ইবাদতই হারানো হয় না। বরং সবকিছু করার দ্বারা যা লাভ হতে পারে, এর দ্বারা তারচে'ও বেশি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ছাওয়াব, পাওয়া যায় দু'আর প্রতিদান, তদুপরি পাওয়া যায় আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমতও। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا
‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন।(সহীহ মুসলিম: ৪০৮; সুনানে আবু দাউদ: ১৫৩০; সুনানে নাসাঈ ১২৯৬; সুনানে দারিমী: ২৮১৪; সহীহ ইবন হিব্বান: ৯০৬; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭২৩৫)
তারপর আবার দরূদপাঠ দ্বারা গুনাহও মাফ হয়। গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তি জীবনের এক পরম লক্ষ্য। আল্লাহ তা'আলার কাছে যে ব্যক্তি ক্ষমা পায়, সে তাঁর সন্তুষ্টিও পেয়ে যায়। ফলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে হয়ে যায় জান্নাতের অধিকারী, যা কিনা মানবজীবনের পরম সফলতা। তাহলে দরূদ পাঠ দ্বারা যা পাওয়া যায়, তারচে' বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? সুতরাং নিজ সময়ের সবটা যদি দরূদপাঠের জন্য বরাদ্দ করা সম্ভব হয়, তবে এরচে' সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সর্বাবস্থায় অন্তরে ও মুখে আল্লাহ তা'আলার যিকির জারি রাখা চাই।
খ. হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় দু'বার ফুঁ দেবেন। এটা সত্য। একবারের ফুঁকে জগৎ ধ্বংস হবে, আরেকবারের ফুঁকে পুনরুত্থান ঘটবে।
গ. মৃত্যু বড় কঠিন। সে কথা কখনও ভুলতে নেই।
ঘ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদপাঠ যত বেশি করা যায় ততোই কল্যাণ। তাতে দুনিয়া ও আখিরাতের দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচা যায় ও গুনাহ মাফ হয়।
ঙ. নিয়মিত আমলের জন্য নফল ইবাদতের পরিমাণ ইসলাহী মুরুব্বীর পরামর্শে নির্ধারণ করা ভালো।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)