আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১২. অধ্যায়ঃ জিহাদ

হাদীস নং: ২০৭৪
অধ্যায়ঃ জিহাদ
আল্লাহ্ তা'আলার পথে জিহাদে উৎসাহিতকরণ ও জিহাদে আহত হওয়া এবং জিহাদের সারিতে দু'আ করার ফযীলত প্রসঙ্গে
২০৭৪. হযরত আবু উমামা (রা) সূত্রে নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: আল্লাহর কাছে দু'টি ফোঁটা ও দু'টি চিহ্নের চাইতে অধিক পসন্দনীয় আর কিছুই নেইঃ (১) ঐ অশ্রু ফোঁটা যা আল্লাহর ভয়ে ঝরে এবং (২) সেই রক্তের ফোঁটা যা আল্লাহর পথের জিহাদে প্রবাহিত হয়। দু'টি চিহ্ন হলো, যা আল্লাহর পথের জিহাদে সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর কোন ফরয আদায়ে যা সৃষ্টি হয়।
(হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, হাদীসটি হাসান-গরীব।)
كتاب الْجِهَاد
التَّرْغِيب فِي الْجِهَاد فِي سَبِيل الله تَعَالَى وَمَا جَاءَ فِي فضل الْكَلم فِيهِ وَالدُّعَاء عِنْد الصَّفّ والقتال
2074- وَعَن أبي أُمَامَة رَضِي الله عَنهُ عَن النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ لَيْسَ شَيْء أحب إِلَى الله من قطرتين وأثرين قَطْرَة دموع من خشيَة الله وقطرة دم تهراق فِي سَبِيل الله وَأما الأثران فأثر فِي سَبِيل الله وَأثر فِي فَرِيضَة من فَرَائض الله

رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَقَالَ حَدِيث حسن غَرِيب

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে দু'টি বিন্দু ও দু'টি ছাপ (চিহ্ন) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার কাছে এরচে' বেশি প্রিয় আর কিছু নেই। এগুলো যখন আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি চান বান্দার পক্ষ হতে যেন এগুলো বেশি বেশি পাওয়া যায়। বান্দার পক্ষ হতে এগুলো যতবেশি পাওয়া যাবে, আল্লাহ তা'আলা বান্দার প্রতি ততবেশি খুশি হবেন এবং ততই উৎকৃষ্ট প্রতিদানও দেবেন।

দু'টি বিন্দুর প্রথমটি হল আল্লাহর ভয়ে নির্গত চোখের পানি। যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে যতবেশি জানে, আল্লাহ তা'আলাকে সে ভয়ও ততবেশি করে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে –
{ إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ} [فاطر: 28]
"আল্লাহকে তো কেবল তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী।”

এক হাদীছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
والله، إني لأعْلَمُكُمْ بِالله عَزَّ وَجَلَّ، وَأَخْشَاكُمْ لَهُ.
"আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্যে আল্লাহ সম্পর্কে আমি সবচেয়ে বেশি জানি এবং তোমাদের মধ্যে আমিই তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি।

যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে ভালোভাবে জানে তার কাছে এটা স্পষ্ট যে, সে আল্লাহ তাআলার কত অসংখ্য নি'আমত সর্বক্ষণ ভোগ করছে। এর বিপরীতে তাঁর শোকর ও কৃতজ্ঞতা কতইনা কম আদায় করা হয়ে থাকে। বরং সে অনুযায়ী নাফরমানি করা হয় অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলার শাস্তি সুকঠিন। এ নাশোকরী ও নাফরমানির কারণে না কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে! এটা কতইনা ভয়ের কারণ। সেইসঙ্গে আল্লাহ সম্পর্কে যার ভালো জানা আছে সে এ কথাও ভালোভাবে জানে যে, তিনি কী অসীম রহমত ও দয়ার মালিক। সে রহমত ও দয়ার অনুভূতি তার অন্তরে গভীর আল্লাহপ্রেম সঞ্চার করে।

নিজ নাশোকরী ও নাফরমানির অনুভূতি আল্লাহপ্রেমিকের অন্তরে অধিকতর ভীতি সৃষ্টি করে। কেননা নাশোকরী ও নাফরমানির কারণে আল্লাহ তা'আলা নারাজ হয়ে থাকেন। যে ব্যক্তি সত্যিকারভাবে আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসে, তার কাছে আল্লাহ তা'আলার নারাজীর চেয়ে বেশি অপ্রিয় ও বেশি অসহনীয় আর কিছুই হতে পারে না। তাঁর নারাজীর কল্পনা তাকে ব্যাকুল করে তোলে। তাই ছোটখাটো ভুলত্রুটি হয়ে গেলেও প্রেমিকজন আল্লাহ তা'আলার নারাজীর ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। এজন্যই দেখা যায়। সগীরা গুনাহতেও তারা কেঁদে বুক ভাসায়। অপরদিকে কবীরা গুনাহ করেও ঘোর পাপীর চোখে পানি আসে না। তো বান্দার চোখের পানি একইসঙ্গে আল্লাহভীতি ও আল্লাহপ্রেমের পরিচায়ক। তাই আল্লাহ তা'আলার কাছে এ পানির ফোঁটা অনেক পসন্দ।

আল্লাহ তাআলার কাছে পসন্দের দ্বিতীয় ফোঁটা হল ওই রক্তের ফোঁটা, যা তাঁর পথে প্রবাহিত করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার দীন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে রক্ত বহানো। এর সর্বোচ্চ ধাপ হল শহীদ হয়ে যাওয়া। কোনও অঙ্গহানি বা কোনও অঙ্গের জখমে যে রক্ত পড়ে, তারও অনেক মূল্য। তাই তো এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আঙ্গুল জখম হয়ে রক্ত ঝরতে থাকলে তিনি বলে উঠেছিলেন-
هَلْ أَنتِ إِلَّا إِصْبعٌ دَمِيْتِ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ مَا لَقِيتِ
“তুমি একটি আঙ্গুল মাত্রই তো, যে কিনা রক্তাক্ত হয়েছ? (কী সৌভাগ্য!) তোমর এই যেটুকু হল, তা হয়েছে আল্লাহরই পথে।”

যে দু'টি ছাপ আল্লাহ তাআলার প্রিয়, তার একটি হল আল্লাহর পথের ছাপ। অর্থাৎ আল্লাহর পথে জিহাদ করতে গিয়ে শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে শরীরে যে চিহ্ন পড়ে, আল্লাহ তাআলার কাছে এ চিহ্ন বড় পসন্দ। কারণ বান্দা তাঁর ইশক ও ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়েই জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিজ শরীরকে শত্রুর অস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দেয়।

সুতরাং নিজ শরীরে ধারণ করা ওই ক্ষতচিহ্ন সর্বক্ষণ তার বুকে লালন করা আল্লাহপ্রেমেরই জানান দিয়ে যায়। তাই এ চিহ্ন আল্লাহর বড় পসন্দ। ইলমের সন্ধানে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে চিহ্ন পড়া, উস্তাযের কাছ থেকে শেখা ইলম লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে শরীরে বা পোশাকে কালির দাগ পড়া, ইলমে দীন লিখতে লিখতে আঙ্গুলে গিট পড়ে যাওয়া ইত্যাদি চিহ্নসমূহও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা এ ছাপও আল্লাহর পথেই হয়েছে। হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ حَتَّى يَرْجِعَ.
"যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে বের হয় সে আল্লাহর পথেই থাকে, যতক্ষণ না ফিরে আসে।"

আল্লাহ তাআলার প্রিয় দ্বিতীয় ছাপ হল ওই চিহ্ন, যা আল্লাহ তা'আলার কোনও ফরয আদায় করতে গিয়ে বান্দার শরীরে পড়ে যায়। যেমন মসজিদে আসা-যাওয়া করতে থাকায় পায়ে কড়া পড়ে যাওয়া, সিজদার কারণে কপালে, হাঁটুতে কালো দাগ পড়ে যাওয়া, নামাযে বসতে থাকার কারণে পায়ে গিট পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহর ভয়ে চোখের পানি ফেলা আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়। তাই আমরা আল্লাহর ভয়ে চোখের পানি ফেলার সাধনা করব।

খ. আল্লাহর পথে রক্ত ঝরানোর জন্য আমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

গ. আল্লাহর পথে সংগ্রাম-সাধনায় ক্ষত-বিক্ষত হতে পারা অতি সৌভাগ্যের বিষয়।।

ঘ. আল্লাহ তাআলার যে-কোনও ফরয আদায় করতে গিয়ে যদি ক্ষত-বিক্ষতও হতে হয়, তবুও আমরা দমে যাব না। এরূপ ক্ষতচিহ্নকে পরম সৌভাগ্য গণ্য করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান