আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১২. অধ্যায়ঃ জিহাদ

হাদীস নং: ২০৪৮
আল্লাহ্ তা'আলার পথে জিহাদে উৎসাহিতকরণ ও জিহাদে আহত হওয়া এবং জিহাদের সারিতে দু'আ করার ফযীলত প্রসঙ্গে
২০৪৮. হযরত মুয়ায ইবন জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবুক যুদ্ধের আগে সাহাবীদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। চলতে চলতে যখন ভোর হয়ে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। এরপর সবাই আবার রওয়ানা হলেন। সূর্য উঠে গেল, শেষ রাতের সফরের ক্লান্তির দরুন সকলেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু মুয়ায রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সাথে থাকলেন এবং তাঁর পদাংক অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। সওয়ারীগুলো আরোহীদের নিয়ে সবুজ শ্যামল পথ ধরে ঘাস খেতে খেতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল। মুয়ায তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর পিছনে আসছিলেন। তাঁর উষ্ট্রীটি কখনো ঘাস খাচ্ছিল আবার কখনো পথ চলছিল। হঠাৎ উষ্ট্রীটি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মুয়ায তাকে লাগাম ধরে টান দিলেন। সে দৌড়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর উষ্ট্রীর কাছে পৌঁছে গেল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন নিজের চেহারা থেকে রুমাল খুলে ফেললেন। তিনি চোখ খুলে দেখলেন, মুয়ায-এর চাইতে অধিক নিকটবর্তী আর কেউই নেই। রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) ডাকলেনঃ হে মুয়ায! মুয়ায 'লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলে সাড়া দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেনঃ তুমি আমার আরো কাছে এসো। এরপর মুয়ায এতো কাছে চলে এলেন যে, তাঁদের উভয়ের সওয়ারী একেবারে গা ঘেঁষে চলছিল। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেনঃ লোকেরা আমাদের চেয়ে এতো পিছনে রয়ে গেছে, তা আমি ধারণাও করতে পারিনি। মুয়ায বললেন, সবাই তন্দ্রায় আবিষ্ট। তাই তাদের বাহনগুলো ঘাস খেতে খেতে এদিক সেদিক ছাড়িয়ে পড়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, আমিও তো তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। মুয়ায যখন রাসূল (ﷺ)-এর চেহারায় প্রসন্ন ভাব ও নির্জনাতার (দুর্লভ) সুযোগটি রয়েছে দেখতে পেলেন। তখন তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আমাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করার অনুমতি দিন, যেগুলো আমাকে অসুস্থ, পীড়াগ্রস্থ ও চিন্তিত করে রেখেছে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন: তোমার যা ইচ্ছা হয় জিজ্ঞেস করতে পার। মুয়ায বললেন, হে আল্লাহর নবী। এমন একটি আমলের কথা আমাকে বলুন, যা আমাকে জান্নাতে দাখিল করবে, এছাড়া আমি আপনার কাছ অন্য কিছু জিজ্ঞেস করব না। রাসুলুল্লাহ বললেন: বাহ। বাহ। নিঃসন্দেহে তুমি একটি বিরাট ব্যাপার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছ। নিশ্চয়ই তুমি একটি বিরাট ব্যাপার জানতে চেয়েছ। এ কথাটি। তিনি তিনবার বললেন। আল্লাহ্ যার মঙ্গল চান, তার জন্য এটা অত্যন্ত সহজসাধ্য। আল্লাহ্ যার মঙ্গল কামনা করেন, তার জন্য এটা অত্যন্ত সহজসাধ্য। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেকটি কথাই তিনবার বললেন, যাতে করে মুয়ায-এর মনে কথাটি বদ্ধমূল হয়ে যায়। তারপর রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: আল্লাহ ও কিয়ামতের উপর ঈমান রাখবে, সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং এক আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকবে। তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না-যাবৎ না তোমার মৃত্যু হয়, তুমি এ অবস্থায়ই থাকবে।
মুয়ায বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমার জন্য কথাটি পুনর্বার বলুন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কথাটির তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। এরপর আল্লাহর নবী বললেনঃ হে মুয়ায। তুমি যদি চাও, তাহলে আমি এ বিষয়ের (দীনের) শির, চালিকাশক্তি এবং চূড়া সম্পর্কে বলে দিচ্ছি। মুয়ায বললেন, জ্বী হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান। আপনি বলুন। আল্লাহর নবী বলেন: দীনের শির হলো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসুল, এ কথার সাক্ষ্য দেয়া, আর এর মূল চালিকা শক্তি হলো, সালাত কায়েম করা ও যাকাত আদায় করা। আর এর চূড়া হলো, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আমাকে মানুষের সাথে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যে পর্যন্ত না তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ও মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করবে। যদি তারা এ সকল নির্দেশ সঠিকমত পালন করে, তবে তারা নিজেদের জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করে ফেলেছে। কিন্তু শরঈ হকের কথা ভিন্ন। আর তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: ঐ সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মদ-এর জীবন। আখিরাতে উঁচু মর্যাদা লাভের জন্য ফরয সালাতের পর, আল্লাহর পথে চেহারা ও পা ধূলি মলিন করার মত আর কোন আমল নেই। আল্লাহর পথে বাহন দানও এর বোঝা বহনের কাজে ব্যবহারের চেয়ে বান্দার নেকী-বদী ওজনের পাল্লা ভারী করার মত আর কোন আমল নেই।
(হাদীসটি আহমদ ও বাযযার, শাহর ইব্‌ন হাওশাব সূত্রে মুয়ায থেকে বর্ণনা করেছেন। সংকলক বলেন, আমার ধারণা, শাহর ইবন হাওশাব মুয়ায থেকে হাদীসটি শুনেননি। আহমদ এবং তিরমিযীও এটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। নাসাঈ এবং ইবন মাজাহও আবু ওয়ায়িল সূত্রে মুয়ায থেকে সংক্ষিপ্তাকারে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
التَّرْغِيب فِي الْجِهَاد فِي سَبِيل الله تَعَالَى وَمَا جَاءَ فِي فضل الْكَلم فِيهِ وَالدُّعَاء عِنْد الصَّفّ والقتال
2048- وَعَن معَاذ بن جبل رَضِي الله عَنهُ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم خرج بِالنَّاسِ قبل غَزْوَة تَبُوك فَلَمَّا أَن أصبح صلى بِالنَّاسِ صَلَاة الصُّبْح ثمَّ إِن النَّاس ركبُوا فَلَمَّا أَن طلعت الشَّمْس نعس النَّاس على إِثْر الدلجة وَلزِمَ معَاذ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَتْلُو إثره وَالنَّاس تَفَرَّقت بهم رِكَابهمْ
على جواد الطَّرِيق تَأْكُل وتسير فَبينا معَاذ على إِثْر رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وناقته تَأْكُل مرّة وتسير أُخْرَى عثرت نَاقَة معَاذ فحنكها بالزمام فَهبت حَتَّى نفرت مِنْهَا نَاقَة رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم ثمَّ إِن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم كشف عَنهُ قناعه فَالْتَفت فَإِذا لَيْسَ فِي الْجَيْش أدنى إِلَيْهِ من معَاذ فناداه رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَقَالَ يَا معَاذ فَقَالَ لبيْك يَا رَسُول الله
قَالَ ادن دُونك فَدَنَا مِنْهُ حَتَّى لصقت راحلتاهما إِحْدَاهمَا بِالْأُخْرَى فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم مَا كنت أَحسب النَّاس منا بمكانهم من الْبعد
فَقَالَ معَاذ يَا نَبِي الله نعس النَّاس فتفرقت رِكَابهمْ ترتع وتسير فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَأَنا كنت ناعسا فَلَمَّا رأى معَاذ بشر رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وخلوته لَهُ فَقَالَ يَا رَسُول الله ائْذَنْ لي أَسأَلك عَن كلمة أمرضتني وأسقمتني وأحزنتني فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم سل عَمَّا شِئْت قَالَ يَا نَبِي الله حَدثنِي بِعَمَل يدخلني الْجنَّة لَا أَسأَلك عَن شَيْء غَيره قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بخ بخ بخ
لقد سَأَلت لعَظيم لقد سَأَلت لعَظيم ثَلَاثًا وَإنَّهُ ليسير على من أَرَادَ الله بِهِ الْخَيْر وَإنَّهُ ليسير على من أَرَادَ الله بِهِ الْخَيْر وَإنَّهُ ليسير على من أَرَادَ الله بِهِ الْخَيْر فَلم يحدثه بِشَيْء إِلَّا أَعَادَهُ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم ثَلَاث مَرَّات حرصا لكيما يتقنه عَنهُ فَقَالَ نَبِي الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم تؤمن بِاللَّه وَالْيَوْم الآخر وتقيم الصَّلَاة وتؤتي الزَّكَاة وَتعبد الله وَحده لَا تشرك بِهِ شَيْئا حَتَّى تَمُوت وَأَنت على ذَلِك
قَالَ يَا رَسُول الله أعد لي فَأَعَادَهَا ثَلَاث مَرَّات ثمَّ قَالَ نَبِي الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِن شِئْت يَا معَاذ حدثتك بِرَأْس هَذَا الْأَمر وقوام هَذَا الْأَمر وذروة السنام
فَقَالَ معَاذ بلَى يَا رَسُول الله حَدثنِي بِأبي أَنْت وَأمي فَقَالَ نَبِي الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِن رَأس هَذَا الْأَمر أَن تشهد أَن لَا إِلَه إِلَّا الله وَحده لَا شريك لَهُ وَأَن مُحَمَّدًا عَبده وَرَسُوله
وَإِن قوام هَذَا الْأَمر إقَام الصَّلَاة وإيتاء الزَّكَاة وَإِن ذرْوَة السنام مِنْهُ الْجِهَاد فِي سَبِيل الله إِنَّمَا أمرت أَن أقَاتل النَّاس حَتَّى يقيموا الصَّلَاة ويؤتوا الزَّكَاة ويشهدوا أَن لَا إِلَه إِلَّا الله وَحده لَا شريك لَهُ وَأَن مُحَمَّدًا عَبده وَرَسُوله فَإِذا فعلوا ذَلِك فقد اعتصموا وعصموا دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالهمْ إِلَّا بِحَقِّهَا وحسابهم على الله وَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَالَّذِي نفس مُحَمَّد بِيَدِهِ مَا شحب وَجه وَلَا اغبرت قدم فِي عمل تبتغى بِهِ دَرَجَات الْآخِرَة بعد الصَّلَاة الْمَفْرُوضَة كجهاد فِي سَبِيل الله وَلَا ثقل ميزَان عبد كدابة تنْفق فِي سَبِيل الله أَو يحمل عَلَيْهَا فِي سَبِيل الله

رَوَاهُ أَحْمد وَالْبَزَّار من رِوَايَة شهر بن حَوْشَب عَن معَاذ
وَلَا أرَاهُ سمع مِنْهُ وَرَوَاهُ أَحْمد أَيْضا وَالتِّرْمِذِيّ وَصَححهُ وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه كلهم من رِوَايَة أبي وَائِل عَنهُ مُخْتَصرا وَيَأْتِي فِي الصمت إِن شَاءَ الله تَعَالَى

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসলাম দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়। ইসলাম হলো আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূল বলে সাক্ষ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে দীন ও শরীআত নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করে নেওয়া। যে ব্যক্তি মুখে এটা স্বীকার করে নেয় সে-ই মুসলিম। যদি অন্তরে এর প্রতি বিশ্বাস না থাকে, সে মুনাফিক। তবে কার মনে বিশ্বাস আছে আর কার মনে বিশ্বাস নেই তা আল্লাহ তাআলা ছাড়া কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এ হিসেবে কাউকে মুনাফিক সাব্যস্ত করা সম্ভবও নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় কিছু সংখ্যক লোক মুনাফিক ছিল। তাঁকে ওহীর মাধ্যমে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল। তাই ইতিহাসে তারা মুনাফিকরূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু এখন যেহেতু ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ, তাই এখন বাস্তবিকপক্ষে কেউ মুনাফিক হলেও কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। দুনিয়ার বিচারে এখন মানুষ কেবল দু'প্রকার হয় মুসলিম নয়তো কাফের। সুতরাং বাহ্যিকভাবে যাকে মুসলিম মনে হবে, তাকে মুসলিমই গণ্য করতে হবে। আর বাহ্যিকভাবে যাকে কাফের মনে হবে, তাকে কাফেরই গণ্য করা হবে।

এমনিভাবে মুসলিম ব্যক্তির বাহ্যিক আমল ভালো হলে তাকে নেককার গণ্য করা হবে। তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ করা যাবে না। আবার বাহ্যিকভাবে পাপাচারে লিপ্ত থাকলে তাকে ফাসেক বলা হবে। মন ভালোর দোহাই দিয়ে তার পাপাচারকে উপেক্ষা করা হবে না। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়।

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে, কারা জান-মালের নিরাপত্তা পাবে এবং ইসলাম গ্রহণের পর কোনও কারণে কাউকে হত্যা করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে মৌলিক নির্দেশনা দান করেছেন। প্রথমে ইরশাদ করেন- মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাকে আদেশ করেছেন, যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না আবার জিযিয়াও দেবে না, তাদের সঙ্গে যেন আমি যুদ্ধ করি।

“আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই ও মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল' কথাটি ইসলামগ্রহণের বাণী। আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথাটি ঘোষণা করার দ্বারা অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সে মুসলিম বলে গণ্য হয়। এ কথা ঘোষণা করার অপরিহার্য দাবি হলো মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু নিয়ে এসেছেন তা সব সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং তিনি যে শরীআত পেশ করেছেন তা পালন করা। এ কারণেই কেবল এ ঘোষণার দ্বারাই জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয় না; বরং এর সঙ্গে নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াও শর্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের বিধান মানবে না, সরকার তাকে তা মানতে বাধ্য করবে। যদি অবিশ্বাস করে তবে তো মুরতাদই হয়ে যাবে। ফলে মুরতাদের শাস্তি হিসেবে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। আর যদি নামায ও যাকাত ফরয বলে বিশ্বাস করে কিন্তু পালন না করে, তবে মুরতাদ হবে না বটে, কিন্তু সরকার এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। যদি সংঘবদ্ধ কোনও দল নামায, যাকাত ইত্যাদি ফরয বিধান পালন করতে না চায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে, যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. যাকাত দিতে অস্বীকারকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

শরীআতের জরুরি বিধানসমূহ মেনে নেওয়া সহকারে ইসলামের ঘোষণা দিলে জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। সুতরাং হাদীছের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে-
(যখন তারা তা করবে তখন তারা নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা পাবে)। অর্থাৎ তারা যদি কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে এবং শরীআত মেনে নেয়, তবে তারা তাদের জান-মাল নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় তাদের রক্তপাত করা ও তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়।

যেসকল কারণে মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়
এমন কিছু অপরাধ আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তিও তাতে লিপ্ত হলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তার উপর মৃত্যুদন্ড আরোপিত হবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তবে ইসলামের হক (এর বিষয়টি) ব্যতিক্রম'। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে—কালেমায়ে শাহাদাতের 'হক'-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম উভয় বর্ণনার মর্ম একই। অর্থাৎ কেউ যদি কালেমায়ে শাহাদাত তথা ইসলামের হক নষ্ট করে, তবে তার জান ও মালের নিরাপত্তা থাকবে না। কালেমায়ে শাহাদাতের সে হক হলো তিনটি— ক. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা; খ. ব্যভিচার না করা। এবং গ. মুরতাদ না হওয়া। ইসলাম গ্রহণের পরে মুরতাদ হয়ে গেলে অথবা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে কিংবা কোনও বিবাহিত মুসলিম ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أمرْتُ أنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لا إله إلا الله، فإذا قَالُوْهَا عَصَمُوا مِن دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقَّهَا قِبْلَ: وَمَا حَقَّهَا؟ قَالَ: زنى بَعْدَ إِحْصَانِ، أَوْ كُفْرٌ بَعْدَ إِسلام أَوْ قَتْلُ نَفْسٍ فَيُقْتَلُ بِهِ

'আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা বলে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। যখন তারা এটা বলবে, আমার পক্ষ হতে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। তবে এ কালেমার হক-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম। জিজ্ঞেস করা হলো, এর হক কী? তিনি বললেন, বিবাহের পর ব্যভিচার, ইসলাম গ্রহণের পর কুফর এবং কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা। এ অপরাধের কারণে কতলের শাস্তি দেওয়া হবে।৩২৭

অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لا يَحِلُّ دَمُ امْرِي مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لا إلهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ، إِلَّا بِإِحْدَى ثَلاثِ النفس بالنفس، وَالتَّيْبُ الزَّانِي، وَالْمَارِقُ مِنَ الدِّينِ التارِكُ لِلْجَمَاعَةِ

'যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, এমন মুসলিম ব্যক্তিকে তিনটি কারণের কোনও একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়- বিবাহিত ব্যভিচারকারী (-কে ব্যভিচারের কারণে), প্রাণের বদলে প্রাণ, দীন পরিত্যাগকারী এমন ব্যক্তি, যে মুসলমানদের জামাত পরিত্যাগ করেছে।৩২৮

এই যা বলা হলো, এর সম্পর্ক দুনিয়ার সঙ্গে। অর্থাৎ কেউ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলে এবং ইসলামী শরীআত মেনে নিলে সে তার জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। উপর তাদের বাহ্যিক উপরে বর্ণিত কারণসমূহ ছাড়া অন্য কোনও কারণে তাকে হত্যা করা যাবে না। সে কালেমা পড়েছে খাঁটি মনে না কপট মনে, তা দেখার প্রয়োজন নেই। তা দেখা বান্দার কাজ নয়। সে হিসাব নেবেন আল্লাহ। যেমন হাদীছটির শেষে বলা হয়েছে—(আর তাদের হিসাব আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত)। অর্থাৎ দুনিয়ায় তার বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ীই আচরণ করা হবে। তবে আখেরাতের বিষয়টা আলাদা। সে আখেরাতে মুক্তি পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করে তার ইখলাসের উপর। অর্থাৎ সে যদি খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার ইসলাম গৃহীত হবে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যদি তার অন্তরে মুনাফিকী থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার বাহ্যিক ইসলাম গৃহীত হবে না। ফলে সে মুক্তিও পাবে না। মোটকথা আখেরাতের হিসাব হবে অন্তরের অবস্থা অনুযায়ী। সে হিসাব নেওয়া আল্লাহরই কাজ।

হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় কালেমা পাঠের সঙ্গে শরীআতের বিধানাবলী মেনে নেওয়ার দ্বারা।

খ. বাহ্যিক অবস্থা দ্বারা কাউকে মুমিন-মুসলিম বলে মনে হলেই সে নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। অন্তরে ঈমান আছে কি নেই তা দেখা বান্দার কাজ নয়। বান্দার পক্ষে তা নির্ণয় করা সম্ভবও নয়।

গ. এমন কিছু অপরাধও আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তি যাতে লিপ্ত হলে তার প্রাণের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে অপরাধের শরীআতী শাস্তি হলো হত্যা করা।

৩২৭. আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩২২১

৩২৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৭৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৭৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪০২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪০৪৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৫২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৬৪৯২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৩
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ২০৪৮ | মুসলিম বাংলা