আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৮. অধ্যায়ঃ সদকা

হাদীস নং: ১২৯১
দান-খয়রাতের উৎসাহ দান, সামর্থ্যহীন ব্যক্তির প্রয়াস ও ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও দান প্রসংগ
১২৯১. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কৃপণ ও দানশীল ব্যক্তিকে এমন দু'ব্যক্তির সাথে উপমা দিয়েছেন, যাদের দেহে বুক থেকে গলা পর্যন্ত দুটি লৌহ বর্ম রয়েছে। দানশীল ব্যক্তি যখনই দান করতে চায়, তখন ঐ বর্ম তার দেহে ঢিলা ও বিস্তৃত হয়ে পড়ে, এমনকি তা তার নখাগ্র পর্যন্ত আবৃত করে ফেলে এবং তার পদচিহ্ন মিটিয়ে দেয়। আর কৃপণ যখন দান করতে চায়, তখন বর্মটি গায়ে চেপে বসে এবং তার প্রতিটি আংটা স্বস্থানে দৃঢ়ভাবে এঁটে যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে দেখেছি যে, তিনি এভাবে হাত দ্বারা ইশারা করছিলেন যে, কৃপণ লোকটি বর্মটিকে ঢিলা করতে চায়, কিন্তু তা ঢিলা হয় না।
(হাদীসটি বুখারী, মুসলিম ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন। ইমাম নাসাঈর বর্ণনায় হাদীসের পাঠ নিম্নরূপ: দানশীল ও কৃপণের দৃষ্টান্ত ঐ দু'ব্যক্তির ন্যায় যাদের দেহে বুক থেকে গলা পর্যন্ত লোহার জামা অথবা লৌহ বর্ম রয়েছে। দানশীল ব্যক্তি যখন দান করতে চায়, তখন বর্মটি প্রশস্ত অথবা ঢিলা হয়ে যায়, এমনকি তা তার নখাগ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে ও পায়ের চিহ্ন মুছে দেয়। আর কৃপণ যখন দান করতে চায় তখন বর্মটি দেহে চেপে বসে ও তার সব ক'টি আংটা স্বস্থানে এঁটে যায়। এমনকি গলা অথবা গর্দান চেপে ধরে। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে আমি তা ঢিলা করার চেষ্টা করতে দেখেছি কিন্তু তা ঢিলা হচ্ছে না।)
التَّرْغِيب فِي الصَّدَقَة والحث عَلَيْهَا وَمَا جَاءَ فِي جهد الْمقل وَمن تصدق بِمَا لَا يجب
1291 - وَعَن أبي هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ قَالَ ضرب رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم مثل الْبَخِيل والمتصدق كَمثل رجلَيْنِ عَلَيْهِمَا جنتان من حَدِيد قد اضطرت أَيْدِيهِمَا إِلَى ثديهما وتراقيهما
فَجعل الْمُتَصَدّق كلما تصدق بِصَدقَة انبسطت عَنهُ حَتَّى تغشى أنامله وَتَعْفُو أَثَره وَجعل الْبَخِيل كلما هم بِصَدقَة قلصت وَأخذت كل حَلقَة بمكانها
قَالَ أَبُو هُرَيْرَة فَأَنا رَأَيْت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول بِأُصْبُعَيْهِ هَكَذَا فِي جيبه يوسعها وَلَا تتوسع

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَالنَّسَائِيّ وَلَفظه
مثل الْمُنفق الْمُتَصَدّق والبخيل كَمثل رجلَيْنِ عَلَيْهِمَا جبتان أَو جنتان من حَدِيد من لدن ثديهما إِلَى تراقيهما فَإِذا أَرَادَ الْمُنفق أَن ينْفق اتسعت عَلَيْهِ الدرْع أَو مرت حَتَّى تجن بنانه وَتَعْفُو أَثَره فَإِذا أَرَادَ الْبَخِيل أَن ينْفق قلصت ولزمت كل حَلقَة موضعهَا حَتَّى أخذت بترقوته أَو بِرَقَبَتِهِ
يَقُول أَبُو هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ أشهد أَنه رأى رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يوسعها وَلَا تتسع

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে উপমা দ্বারা কৃপণ ও দানশীল ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা ও তাদের পরিণাম ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কৃপণ ও দানশীল ব্যক্তি উভয়ই যেন লোহার বর্ম পরিহিত অবস্থায় আছে। তা দ্বারা তাদের বুক থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে। আকারে উভয়ের বর্ম একই পরিমাণ। কিন্তু দান-খয়রাত করা না করার ভিত্তিতে তা দুই রকম হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(খরচকারী ব্যক্তির অবস্থা হল এমন যে, সে যখনই খরচ করতে চায়, তখন বর্মটি তার চামড়ার উপর প্রসারিত হয়ে যায় বা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমনকি তার আঙ্গুলের মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলে আর তার পায়ের ছাপ মুছে ফেলে)। অর্থাৎ এর দ্বারা মূলত তার দানশীল চরিত্রের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দানশীল ব্যক্তি যখনই দান করতে চায়, তার মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। মন তার ইচ্ছায় সাড়া দেয়। ফলে সে অকাতরে দান করতে পারে।আর যতই দান করে, মনের প্রসারতা বেড়ে যায়। আর এভাবে তার দানের গতিও বাড়তে থাকে। হাদীছে বলা হয়েছে, যতই সে দান-খয়রাত করে, ততোই সেটি বড় হতে থাকে। অর্থাৎ তার দানের প্রবণতা বাড়তে থাকে। বলা হয়েছে, সেটি বড় হতে হতে তার পুরো শরীর ঢেকে যায়। অর্থাৎ দানশীলতা তার গোটা সত্তাকে আচ্ছন্ন করে নেয়। বলা হয়েছে, এমনকি সেটি মাটিতেও হেঁচড়াতে থাকে। অর্থাৎ তার দানশীলতা তার সত্তাকে ছাপিয়ে যায়। পোশাক বড় হলে গোটা শরীর তার মধ্যে ঢাকা পড়ে যায়। আবার মাটিতে হেঁচড়ানোর ফলে তাতে তার পায়ের চিহ্নও মুছে যায়। ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে, তার পাপরাশি দান-খয়রাতের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। কেবল ঢাকাই পড়ে না, পোশাকের বাড়তি অংশ দ্বারা যেমন পায়ের চিহ্ন মুছে যায়, তেমনি বাড়তি দান-খয়রাত দ্বারা তার পাপরাশিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে না, তার অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(পক্ষান্তরে বখিল ব্যক্তির অবস্থা হল এই যে, যখনই সে কোনওকিছু খরচ করতে চায়, অমনি সেটির প্রতিটি আংটা আপন আপন স্থানে এঁটে যায়। সে তা প্রশস্ত করতে চায়, কিন্তু প্রশস্ত হয় না)। এর দ্বারা যেন তার মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার মনের ভেতর যেহেতু দানশীলতা নেই, তাই যখনই সে দান করতে চায়, তার মন সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে কিছুতেই সে দান করতে পারে না। তার কৃপণতা যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। তার হাত যেন বুকের সঙ্গে আটকা পড়ে যায়। কিছুতেই তা দান-খয়রাতের জন্য প্রসারিত করতে পারে না। হাদীছে বলা হয়েছে, এই ব্যক্তির বর্মের প্রতিটি আংটা আপন স্থানে এঁটে যায়। সে সেটি প্রশস্ত করতে চায়, কিন্তু প্রশস্ত হয় না। তার মানে পোশাকটি যেমন ছিল তেমনিই ছোট থেকে যায়। ফলে তার পোশাক দ্বারা সারা শরীর ঢাকে না। শরীরের বেশিরভাগই উন্মুক্ত থেকে যায়। ঠিক তেমনি দান-খয়রাত না করার ফলে কৃপণ ব্যক্তির মান-সম্মানের হেফাজত হয় না; বরং লোকসম্মুখে সে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। তার গুনাহসমূহ ঢাকা পড়ে না। দানশীল ব্যক্তি দান-খয়রাত করার দ্বারা যেমন পাপমুক্তির সুফল লাভ করে, এ ব্যক্তির পক্ষে তা লাভ করা সম্ভব হয় না।

কেউ কেউ বলেন, পোশাক বড় হওয়া না হওয়ার দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া না পাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে, তার সম্পদ বরকতের দিক থেকে তো বাড়েই, অনেক সময় বাহ্যিকভাবেও বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, তার সম্পদে বরকত হয় না, ফলে বাহ্যিকভাবে বাড়লেও তা বাস্তবিকপক্ষে কল্যাণকর হয় না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দানশীলতা মানুষের স্বভাবগত গুণ। চর্চা দ্বারা গুণটির বিকাশ হয়।

খ. কৃপণতাও মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সাধনার মাধ্যমে একে দমন করা না গেলে মানুষের পক্ষে দান-খয়রাত করা সম্ভব হয় না। তাই আল্লাহওয়ালার সাহচর্য ও পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে এ রিপুর দমন জরুরি।

গ. দান-খয়রাত দ্বারা মানুষের সম্মান বাঁচে ও গুনাহ মাফ হয়।

ঘ. কৃপণতা দ্বারা মানুষের সম্মান নষ্ট হয়।

ঙ. দানশীল ব্যক্তির সম্পদে বরকত হয়।

চ. কৃপণ ব্যক্তি সম্পদের প্রকৃত উপকারলাভ থেকে বঞ্চিত থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ১২৯১ | মুসলিম বাংলা