আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
৮. অধ্যায়ঃ সদকা
হাদীস নং: ১২৯০
দান-খয়রাতের উৎসাহ দান, সামর্থ্যহীন ব্যক্তির প্রয়াস ও ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও দান প্রসংগ
১২৯০. হযরত আবূ কাবশাহ আনমারী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে বলতে শুনেছেন, তিনটি বিষয় আমি হলফ করে বলছি। আর তোমাদের নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করছি, তোমরা তা মনে রাখবে। তিনি বললেন: দানে কোন বান্দার সম্পদ কমেনি, কোন বান্দা মযলূম হয়ে ধৈর্যধারণ করেছে আর আল্লাহ্ তার সম্মান বাড়িয়ে দেননি, এমনটি কোন দিন হয়নি। আর কোন বান্দা (নিজের জন্যে) ভিক্ষার দ্বার খুলেছে আর আল্লাহ্ তার উপর দারিদ্র্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেননি, এমনটি কোনদিন হয়নি। অথবা অনুরূপ অন্য কোন শব্দ তিনি বলেছেন। আর আমি তোমাদের নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করছি, তোমরা তা মনে রাখবে। তিনি বললেন, দুনিয়া চার প্রকার লোকের জন্যঃ (১) এমন মানুষ যাকে আল্লাহ্ সম্পদ ও ইলম উভয়টিই দান করেছেন। সে এ ব্যাপারে তার প্রভুকে ভয় করে চলে, আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখে, আর এতে আল্লাহর হক আছে বলে জ্ঞান করে। সে হচ্ছে সর্বোত্তম স্তরে। (২) এমন লোক যাকে আল্লাহ ইলম দান করেছেন। কিন্তু সম্পদ দেননি। অবশ্য সে নিয়্যতে সত্যবাদী। সে মনে মনে বলে: আমাকেও যদি ধন-সম্পদ দেয়া হতো, তাহলে আমিও অমুকের মতই কাজ করতাম। এ ব্যক্তি তার নিয়্যত অনুযায়ী পুরস্কৃত হবে। অতএব প্রতিদান প্রাপ্তির বেলায় এরা দু'জনই সমান। (৩) এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্ ধন-সম্পদ দিয়েছেন। কিন্তু ইলম দান করেননি। সে প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে (আল্লাহর নির্দেশের তোয়াক্কা না করে) অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে না। আত্মীয়তার দাবি পূরণ করে না এবং এতে আল্লাহর কোন হক আছে বলে জ্ঞান করে না, সে হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্তরের। (৪) ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্ ধন-সম্পদ ও ইলম কোনটাই দান করেননি। সে মনে মনে বলে: আমার যদি ধন-সম্পদ থাকতো তাহলে আমি অমুকের মতই (অপকর্ম) করতাম। সে তার নিয়্যত অনুপাতে শাস্তিযোগ্য হবে। অতএব তাদের উভয়ের গুনাহই সমান।
(হাদীসটি তিরমিযী ও ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান-সহীহ বলে অভিহিত করেছেন।)
(হাদীসটি তিরমিযী ও ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান-সহীহ বলে অভিহিত করেছেন।)
التَّرْغِيب فِي الصَّدَقَة والحث عَلَيْهَا وَمَا جَاءَ فِي جهد الْمقل وَمن تصدق بِمَا لَا يجب
1290 - وَعَن أبي كَبْشَة الْأَنمَارِي رَضِي الله عَنهُ أَنه سمع رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول ثَلَاث أقسم عَلَيْهِنَّ وَأُحَدِّثكُمْ حَدِيثا فاحفظوه قَالَ مَا نقص مَال عبد من صَدَقَة وَلَا ظلم عبد مظْلمَة صَبر عَلَيْهَا إِلَّا زَاده الله عزا وَلَا فتح عبد بَاب مَسْأَلَة إِلَّا فتح الله عَلَيْهِ بَاب فقر أَو كلمة نَحْوهَا وَأُحَدِّثكُمْ حَدِيثا فاحفظوه
قَالَ إِنَّمَا الدُّنْيَا لأربعة نفر عبد رزقه الله مَالا وعلما فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ ربه ويصل فِيهِ رَحمَه وَيعلم لله فِيهِ حَقًا فَهَذَا بِأَفْضَل الْمنَازل وَعبد رزقه الله علما وَلم يرزقه مَالا فَهُوَ صَادِق النِّيَّة يَقُول لَو أَن لي مَالا لعملت بِعَمَل فلَان فَهُوَ بنيته فأجرهما سَوَاء وَعبد رزقه الله مَالا وَلم يرزقه علما يخبط فِي مَاله بِغَيْر علم وَلَا يَتَّقِي فِيهِ ربه وَلَا يصل فِيهِ رَحمَه وَلَا يعلم لله فِيهِ حَقًا فَهَذَا بأخبث الْمنَازل وَعبد لم يرزقه الله مَالا وَلَا علما فَهُوَ يَقُول لَو أَن لي مَالا لعملت فِيهِ بِعَمَل فلَان فَهُوَ بنيته فوزرهما سَوَاء
رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَابْن مَاجَه وَقَالَ التِّرْمِذِيّ حَدِيث حسن صَحِيح
قَالَ إِنَّمَا الدُّنْيَا لأربعة نفر عبد رزقه الله مَالا وعلما فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ ربه ويصل فِيهِ رَحمَه وَيعلم لله فِيهِ حَقًا فَهَذَا بِأَفْضَل الْمنَازل وَعبد رزقه الله علما وَلم يرزقه مَالا فَهُوَ صَادِق النِّيَّة يَقُول لَو أَن لي مَالا لعملت بِعَمَل فلَان فَهُوَ بنيته فأجرهما سَوَاء وَعبد رزقه الله مَالا وَلم يرزقه علما يخبط فِي مَاله بِغَيْر علم وَلَا يَتَّقِي فِيهِ ربه وَلَا يصل فِيهِ رَحمَه وَلَا يعلم لله فِيهِ حَقًا فَهَذَا بأخبث الْمنَازل وَعبد لم يرزقه الله مَالا وَلَا علما فَهُوَ يَقُول لَو أَن لي مَالا لعملت فِيهِ بِعَمَل فلَان فَهُوَ بنيته فوزرهما سَوَاء
رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَابْن مَاجَه وَقَالَ التِّرْمِذِيّ حَدِيث حسن صَحِيح
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি একটি দীর্ঘ হাদীছ। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে তিনটি কথা বলেছেন। তারপর আলাদাভাবে আরেকটি কথা বলেছেন। প্রথম তিনটি সম্পর্কে তিনি বলেন-
ثَلاثَة أقْسِمُ عَلَيْهِنَّ (তিনটি বিষয়ে আমি কসম করছি)। কসম করার দ্বারা উদ্দেশ্য কথা তিনটির গুরুত্ব বোঝানো, সেদিকে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, তাদেরকে তা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং তার উপর আমল করার জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করা। তারপর স্বতন্ত্রভাবে যে কথাটি বলেছেন, তার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ইরশাদ করেন-
وَأَحَدثكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوْهُ ‘এবং তোমাদেরকে (তা ছাড়াও) একটি কথা বলছি। তোমরা তা স্মরণ রেখো'। অর্থাৎ বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তা মনে রেখো এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট থেকো। এই ভূমিকা দেওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে যে বিষয় তিনটি সম্পর্কে কসম করেছেন, একটি একটি করে সেগুলো উল্লেখ করছেন, যা নিম্নরূপ-
দান-খয়রাত দ্বারা সম্পদ কমে না
مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ (দান-সদাকার কারণে কোনও বান্দার সম্পদ কমে না)। অর্থাৎ এই ভয়ে তোমরা দান-খয়রাত করা হতে বিরত থেকো না যে, তাতে তোমাদের সম্পদ কমে যাবে। বাহ্যিকভাবে কমে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কমে না। কেননা এক তো দান-খয়রাত করলে সম্পদে বরকত হয়। দ্বিতীয়ত আখিরাতে প্রভূত ছাওয়াব পাওয়া যায়। এর দ্বারা বাহ্যিকভাবে যা কমে তার প্রতিকার হয়ে যায়। ইমাম ইযযুদ্দীন ইবন আব্দিস সালাম রহ. এর খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। তার ব্যাখ্যার সারমর্ম হল- আদমসন্তান দান-খয়রাত করার দ্বারা মূলত কিছুই হারায় না। তাতে দুনিয়ায় কোনও উপকার না পেলেও আখিরাতে অবশ্যই উপকার পাবে। কোনও ব্যক্তির যদি দু'টি বাড়ি থাকে আর এ অবস্থায় সে একটি বাড়ির সম্পদ আরেকটি বাড়িতে স্থানান্তরিত করে, সে ক্ষেত্রে কেউ বলবে না যে, সম্পদ কমে গেছে। স্থানান্তরিত হয়েছে মাত্র! ঠিক তেমনি দান-খয়রাত করলে দুনিয়ার বাড়ি থেকে সম্পদ আখিরাতের বাড়িতে চলে যায়। সন্দেহ নেই যে, এটাই বেশি লাভজনক।
জনৈক আল্লাহওয়ালা সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনও সওয়ালকারীকে দেখতেন তখন বলে উঠতেন- স্বাগত জানাই তাকে, যে আমাদের দুনিয়ার সম্পদ আখিরাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।
জুলুম সহ্য করার সুফল
وَلَا ظُلِمَ عَبْدٌ مَظْلَمَةً صَبَرَ عَلَيْهَا إِلَّا زَادَهُ اللَّهُ عِزَّا (যে বান্দার প্রতি কোনও জুলুম করা হয় আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তার সম্মান বৃদ্ধি করেন)। مَظْلَمَةً শব্দটি অনির্দিষ্টবাচক, যা নঞর্থক বাক্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে আরবী ভাষার নিয়ম অনুযায়ী শব্দটির অর্থে ব্যাপকতা এসে গেছে। অর্থাৎ যে-কোনও প্রকার জুলুম। জুলুম বলা হয় অন্যের হক নষ্ট করাকে। মানুষের হক তিন প্রকার। জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। কেউ যদি কারও জানের ক্ষতি করে অর্থাৎ হত্যা করে বা অঙ্গহানি করে কিংবা মারধর করে, এমনিভাবে যদি কাউকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে অথবা কারও ইজ্জত-সম্মানের উপর আঘাত করে, তবে এর প্রত্যেকটি দ্বারাই তার উপর জুলুম করা হয়। হাদীছটিতে বলা হয়েছে, যদি কারও উপর যে-কোনওরকমের জুলুম করা হয় আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে, জুলুমকারী থেকে প্রতিশোধ না নেয়, তবে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াতেও তার প্রতিদান দিয়ে দেন। তিনি তাকে উচ্চমর্যাদা দান করেন। এক পর্যায়ে জুলুমকারী ব্যক্তি তার কাছে নতিস্বীকার করে। সে অনুতপ্ত হয়। এমনকি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীলও হয়ে ওঠে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয় যারা মহাভাগ্যবান।(সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩৪-৩৫)
ভিক্ষা করার পরিণতি
وَلَا فَتَحَ عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلَّا فَتَحَ اللّهُ عَلَيْهِ بَابَ فَقْرٍ ‘কোনও বান্দা (মানুষের কাছে) চাওয়ার দরজা খুললে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য দারিদ্র্যের দুয়ার খুলে দেন'। অর্থাৎ নিতান্ত ঠেকার অবস্থা না হলে যদি কেউ অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চায়, তবে পরিণামে তার অভাব-অনটন আরও বেড়ে যায়। তার উচিত ছিল আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা করা, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং নিজে পরিশ্রম করা। তা না করে সে অন্যের মালের উপর ভরসা করেছে এবং ঠেকায় পড়ার ভান ধরেছে। এ কারণে 'যেমন কর্ম তেমন ফল' এ নিয়ম অনুযায়ী সে অধিকতর অভাবের শাস্তি ভোগ করার উপযুক্ত হয়ে গেছে। সে ভিক্ষা করে হয়তো কিছু টাকা জমায়। অন্যদিকে এমন এক বিপদ দাঁড়িয়ে যায়, যদ্দরুন সেই জমানো টাকা সবটাই খরচ হয়ে যায়। আর এভাবে যেমনটা অভাব সে প্রকাশ করেছিল তারচে'ও বেশি অভাবের শিকার হয়ে যায়।
তারপর বর্ণনাকারী বলছেন- أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهًا (অথবা অনুরূপ কোনও শব্দ বলেছেন)। অর্থাৎ উপরের বাক্যটিতে বর্ণনাকারীর সন্দেহ হয়েছে যে, তিনি যেভাবে শুনেছিলেন ঠিক প্রস্তাবেই বর্ণনা করতে পেরেছেন কি না। তবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত যে, মিথ্যবিষয়ে কোনও হেরফের হয়নি। তিনি যা শুনেছিলেন, নিজের বলা বাক্যটি দ্বারা তার মর্মবস্তু আদায় হয়ে গেছে। এটা বর্ণনাকারীদের একটি সতর্কতা। তারা হাদীছেরা বাক্য ঠিক যে ভাষায় শুনেছেন সে ভাষায়ই বর্ণনা করতে চেষ্টা করতেন। কখনও বাক্যের শব্দে যদি সন্দেহ হতো, কিন্তু বিষয়বস্তু যথাযথভাবে মনে থাকত, তবে নিজ ভাষায় সেটি বর্ণনা করে দিতেন আর সেইসঙ্গে বলে দিতেন যে, আমি যার নিকট থেকে শুনেছি, তিনি এরকম বা এর কাছাকাছি কোনও শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে যে কথাটি স্মরণ রাখতে বলেছেন তা নিম্নরূপ-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لِأَرْبَعَةِ نَفَرٍ (দুনিয়া কেবল চার শ্রেণির লোকের জন্য)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদের দিক থেকে মানুষের অবস্থা চার রকম। তারপর সে চার রকম লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা নিম্নরূপ-
عَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ ، وَيَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মাল ও 'ইলম দান করেছেন। সে এ বিষয়ে তার প্রতিপালককে ভয় করে, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে এবং এর ভেতর সে আল্লাহর হক সম্পর্কে সচেতন থাকে)। অর্থাৎ সম্পদের সঙ্গে যেহেতু তার ইলমও আছে, তাই সে ইলম অনুযায়ী সম্পদের ব্যবহার করে। ফলে সে তার সম্পদ কোনও পাপকর্মে ব্যয় করে না। যে খাতে ব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা নারাজ হতে পারেন, তা থেকে বিরত থাকে। কেবল শরী'আত অনুযায়ীই তা খরচ করে। তার মধ্যে একটা বিশেষ দিক হল আত্মীয়তা রক্ষা করা। সে নিজ অর্থ-সম্পদ দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের খেদমত করে। পাশাপাশি তাতে বান্দার যত হক আছে তাও আদায় করে। এমনিভাবে তার সম্পদে আল্লাহ তা'আলার কি কি হক আছে তাও বুঝে বুঝে আদায় করে। যেমন যাকাত, সদাকায়ে ফিতর, মানত ও কাফফারা। এগুলো আদায় করা ফরয। সে তা যথাযথভাবে আদায় করে। তাছাড়া 'ফরযে কিফায়া' হিসেবে যেসকল খাতে অর্থব্যয় করা জরুরি, সেসব খাতেও ব্যয় করে। যেমন মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া ইত্যাদি।
فَهذَا بِأَفْضَلِ الْمَنازِلِ (এটা হল সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর)। অর্থাৎ এ ব্যক্তি জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে থাকবে। কেননা সে দীন শিখেছে, সেই শিক্ষা অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের ব্যবহার করেছে, অর্থ-সম্পদকে নিষিদ্ধ খাতে ব্যয় করা হতে বিরত থেকেছে এবং আল্লাহর সন্তোষজনক খাতে তা ব্যয় করেছে। এভাবে নিজের ইলম ও মাল আল্লাহ তা'আলার মর্জিমতো ব্যবহার করায় আল্লাহর কাছে সে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا ، وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا، فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ، يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ 'ইলম দিয়েছেন, কিন্তু মাল দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আমার যদি ধন-সম্পদ থাকত, তবে আমি অমুক ব্যক্তির আমলের মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ দীনী ইলমের অধিকারী হওয়ার কারণে সে তার নিয়ত খালেস করতে পারে। সে জানে অর্থ-সম্পদ কীভাবে অর্জন করতে হয় এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করতে হয়। তাই সে সংকল্প করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে সম্পদ দিলে শরী'আত মোতাবেক তা খরচ করবে এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করবে, যেমন প্রথমোক্ত ব্যক্তি করে থাকে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ، فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ (তাকে তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচনা করা হয়। এ দুই ব্যক্তির প্রতিদান সমান সমান)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার খালেস নিয়ত অনুসারে তার সঙ্গে ব্যবহার করেন। তার সংকল্প অনুযায়ী তাকে প্রতিদান দেন। তার সংকল্প যেহেতু প্রথম ব্যক্তির আমলের মতো আমল করা, তাই তার মতোই ছাওয়াব তাকে দেওয়া হয়। এভাবে সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সে সম্পদশালী ব্যক্তির সমান ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য তার এ সৌভাগ্য হয় দীনী ইলমের বদৌলতে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمَ يَرْزُقْهُ عِلْمًا، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ، لَا يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ وَلَا يَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَلَا يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, কিন্তু 'ইলম দেননি। সে 'ইলম ছাড়াই তার মালের ভেতর খেয়াল-খুশির আচরণ করে। এ বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে না, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং এর ভেতর সে আল্লাহ তা'আলার কোনও হক জানে না)। অর্থাৎ ইলম না থাকার কারণে সে আল্লাহ তা'আলাকে চিনতে পারে না। আর তাঁকে চিনতে না পারায় তাঁকে ভয়ও করে না। ফলে অর্জিত মাল সে নাজায়েয পন্থায় খরচ করে। না তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করে, না বান্দার হক। উল্টো সে মালের লোভে পড়ে যায়। লোভ পূরণের জন্য সে নানা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। সে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। হয়ে যায় অহংকারী ও ঈর্ষাকাতর। এভাবে সম্পদ তার জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তার পাপের বোঝা ভারী হতে থাকে।
فَهذَا بأَخْبَثِ الْمَنازِل (এটা হল সর্বনিকৃষ্ট স্তর)। অর্থাৎ দীনী ইলম না থাকার কারণে সে যে তার অর্থ-সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও অবৈধ খাতে খরচ করতে থাকে, আর সম্পদের নেশায় পড়ে হাজারও কুকর্মে জড়িত হয়ে যায়, তার পরিণামে পাপীদের মধ্যেও সর্বনিকৃষ্ট স্তরে সে পৌঁছে যায়।
وَعَبْد لَمْ يَرْزُقهُ اللَّهُ مَالًا وَلَا عِلْمًا فَهُوَ يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ فِيْهِ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মালও দেননি, 'ইলমও না। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে আমি তাতে অমুক ব্যক্তির মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ এ ব্যক্তির মালও নেই, ইলমও নেই। মাল না থাকার কারণে দরকার ছিল সবর করা। কিন্তু ইলম না থাকায় সে উল্টো আক্ষেপ করে আর বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে ওই ব্যক্তির মতো বিলাসিতা করতাম। আমিও তার মতো সে মাল পাপাচারে ব্যয় করতাম। অর্থাৎ তার নিয়ত হল কোনওভাবে সম্পদ অর্জিত হয়ে গেলে সে বিলাসিতায় গা ডুবিয়ে দেবে এবং অসৎপথে তা খরচ করবে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ (সেও তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচিত হয়। এদের দু'জনের পাপভার সমান সমান)। অর্থাৎ তার নিয়ত যেহেতু খারাপ, তাই আল্লাহ তা'আলা তাকে সে অনুসারে প্রতিফল দেন। তার নিয়ত তৃতীয় ব্যক্তির মতো সম্পদের অসৎ ব্যবহার করা। তাই অসৎ ব্যবহারের দরুন ওই ব্যক্তির আমলনামায় যেমন পাপ লেখা হয়, এই ব্যক্তির আমলনামায়ও তদ্রূপ পাপ লেখা হয়ে থাকে। এভাবে উভয়ের পাপভার সমান সমান হয়ে যায়।
দেখা যাচ্ছে এই চতুর্থ ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও মালের অসৎ ব্যবহার করার যে গুনাহ, সেই গুনাহের ভারে আক্রান্ত হয়ে গেল। এর কারণ কেবল তার দীনী ইলমে অজ্ঞতা। ইলম না থাকার দরুনই সে মাল সম্পর্কে ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা পোষণ করেছে। প্রথম ব্যক্তি মালের সদ্ব্যবহার করেছে দীনী ইলম থাকার কারণে। দ্বিতীয় ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও সৎপথে মাল খরচ করার ছাওয়াব পেয়ে গেছে, তাও দীনী ইলমের বদৌলতে। তৃতীয় ব্যক্তি অসৎপথে মাল খরচ করে গুনাহগার হয়েছে দীনী ইলমের অভাবে। চতুর্থ ব্যক্তিও মাল না থাকা সত্ত্বেও অসৎপথে মাল খরচ করার গুনাহে গুনাহগার হয়েছে, এরও কারণ কেবল ইলম না থাকা। সুতরাং ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। যে ব্যক্তি ইলম পেয়ে যায়, সে এক মহাদৌলত পায়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় এর মাধ্যমে সে বহুবিধ পাপ থেকে বাঁচতে পারে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হতে পারে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও তাতে মানুষকে মনোযোগী করে তোলার লক্ষ্যে যদি কসম করা হয়, তবে তার অবকাশ আছে।
খ. মূল্যবান কথা যাতে অবহেলার শিকার না হয়; বরং শ্রোতা তা মনে রাখে, সেজন্য তাদেরকে বিশেষভাবে তাগিদ করা চাই।
গ. সম্পদ কমে যাবে এ আশঙ্কায় দান-খয়রাত থেকে পিছিয়ে থাকতে নেই।
ঘ. অন্যের দ্বারা জুলুমের শিকার হলে তাতে ধৈর্যধারণ করা মঙ্গলজনক।
ঙ. অন্যের কাছে অর্থসাহায্য প্রার্থনা করার দ্বারা অর্থের অভাব দূর হয় না; আরও বাড়ে।
চ. সম্পদের পাশাপাশি যদি দীনী ইলমও অর্জিত হয়, তবে তা বড়ই সৌভাগ্য।
ছ. যার সম্পদ আছে তার কর্তব্য তাতে আল্লাহর ও বান্দার হক বুঝে নেওয়া।
জ. সম্পদশালী ব্যক্তির উচিত তার সম্পদ দ্বারা বিশেষভাবে আত্মীয়-স্বজনের সেবা করা।
ঝ. যার সম্পদ নেই কিন্তু ইলম আছে, সেও একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। তার উচিত নিজ ইলমের জন্য শোকরগুযার হয়ে থাকা।
ঞ. যার সম্পদ আছে কিন্তু ইলম নেই, তার কর্তব্য সম্পদের ক্ষতি থেকে বাঁচা ও তার উপকার লাভ করার উদ্দেশ্যে দীনের জরুরি ইলম শিখে নেওয়া।
ট. যার সম্পদও নেই ইলমও নেই, তাকে অবশ্যই উপার্জনের চেষ্টা করার পাশাপাশি দীনের জরুরি ইলমও শিখতে হবে।
ঠ. নেক আমল না করেও কেবল নিয়তের দ্বারা আমলের ছাওয়াব অর্জন করা যেতে পারে, যদি সে নিয়ত খালেস হয়। অনুরূপ অসৎকর্ম না করেও মানুষ গুনাহগার হতে পারে, যদি নিয়ত মন্দ হয়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ নিয়ত খালেস করে নেওয়া।
ثَلاثَة أقْسِمُ عَلَيْهِنَّ (তিনটি বিষয়ে আমি কসম করছি)। কসম করার দ্বারা উদ্দেশ্য কথা তিনটির গুরুত্ব বোঝানো, সেদিকে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, তাদেরকে তা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং তার উপর আমল করার জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করা। তারপর স্বতন্ত্রভাবে যে কথাটি বলেছেন, তার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ইরশাদ করেন-
وَأَحَدثكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوْهُ ‘এবং তোমাদেরকে (তা ছাড়াও) একটি কথা বলছি। তোমরা তা স্মরণ রেখো'। অর্থাৎ বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তা মনে রেখো এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট থেকো। এই ভূমিকা দেওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে যে বিষয় তিনটি সম্পর্কে কসম করেছেন, একটি একটি করে সেগুলো উল্লেখ করছেন, যা নিম্নরূপ-
দান-খয়রাত দ্বারা সম্পদ কমে না
مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ (দান-সদাকার কারণে কোনও বান্দার সম্পদ কমে না)। অর্থাৎ এই ভয়ে তোমরা দান-খয়রাত করা হতে বিরত থেকো না যে, তাতে তোমাদের সম্পদ কমে যাবে। বাহ্যিকভাবে কমে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কমে না। কেননা এক তো দান-খয়রাত করলে সম্পদে বরকত হয়। দ্বিতীয়ত আখিরাতে প্রভূত ছাওয়াব পাওয়া যায়। এর দ্বারা বাহ্যিকভাবে যা কমে তার প্রতিকার হয়ে যায়। ইমাম ইযযুদ্দীন ইবন আব্দিস সালাম রহ. এর খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। তার ব্যাখ্যার সারমর্ম হল- আদমসন্তান দান-খয়রাত করার দ্বারা মূলত কিছুই হারায় না। তাতে দুনিয়ায় কোনও উপকার না পেলেও আখিরাতে অবশ্যই উপকার পাবে। কোনও ব্যক্তির যদি দু'টি বাড়ি থাকে আর এ অবস্থায় সে একটি বাড়ির সম্পদ আরেকটি বাড়িতে স্থানান্তরিত করে, সে ক্ষেত্রে কেউ বলবে না যে, সম্পদ কমে গেছে। স্থানান্তরিত হয়েছে মাত্র! ঠিক তেমনি দান-খয়রাত করলে দুনিয়ার বাড়ি থেকে সম্পদ আখিরাতের বাড়িতে চলে যায়। সন্দেহ নেই যে, এটাই বেশি লাভজনক।
জনৈক আল্লাহওয়ালা সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনও সওয়ালকারীকে দেখতেন তখন বলে উঠতেন- স্বাগত জানাই তাকে, যে আমাদের দুনিয়ার সম্পদ আখিরাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।
জুলুম সহ্য করার সুফল
وَلَا ظُلِمَ عَبْدٌ مَظْلَمَةً صَبَرَ عَلَيْهَا إِلَّا زَادَهُ اللَّهُ عِزَّا (যে বান্দার প্রতি কোনও জুলুম করা হয় আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তার সম্মান বৃদ্ধি করেন)। مَظْلَمَةً শব্দটি অনির্দিষ্টবাচক, যা নঞর্থক বাক্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে আরবী ভাষার নিয়ম অনুযায়ী শব্দটির অর্থে ব্যাপকতা এসে গেছে। অর্থাৎ যে-কোনও প্রকার জুলুম। জুলুম বলা হয় অন্যের হক নষ্ট করাকে। মানুষের হক তিন প্রকার। জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। কেউ যদি কারও জানের ক্ষতি করে অর্থাৎ হত্যা করে বা অঙ্গহানি করে কিংবা মারধর করে, এমনিভাবে যদি কাউকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে অথবা কারও ইজ্জত-সম্মানের উপর আঘাত করে, তবে এর প্রত্যেকটি দ্বারাই তার উপর জুলুম করা হয়। হাদীছটিতে বলা হয়েছে, যদি কারও উপর যে-কোনওরকমের জুলুম করা হয় আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে, জুলুমকারী থেকে প্রতিশোধ না নেয়, তবে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াতেও তার প্রতিদান দিয়ে দেন। তিনি তাকে উচ্চমর্যাদা দান করেন। এক পর্যায়ে জুলুমকারী ব্যক্তি তার কাছে নতিস্বীকার করে। সে অনুতপ্ত হয়। এমনকি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীলও হয়ে ওঠে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয় যারা মহাভাগ্যবান।(সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩৪-৩৫)
ভিক্ষা করার পরিণতি
وَلَا فَتَحَ عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلَّا فَتَحَ اللّهُ عَلَيْهِ بَابَ فَقْرٍ ‘কোনও বান্দা (মানুষের কাছে) চাওয়ার দরজা খুললে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য দারিদ্র্যের দুয়ার খুলে দেন'। অর্থাৎ নিতান্ত ঠেকার অবস্থা না হলে যদি কেউ অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চায়, তবে পরিণামে তার অভাব-অনটন আরও বেড়ে যায়। তার উচিত ছিল আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা করা, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং নিজে পরিশ্রম করা। তা না করে সে অন্যের মালের উপর ভরসা করেছে এবং ঠেকায় পড়ার ভান ধরেছে। এ কারণে 'যেমন কর্ম তেমন ফল' এ নিয়ম অনুযায়ী সে অধিকতর অভাবের শাস্তি ভোগ করার উপযুক্ত হয়ে গেছে। সে ভিক্ষা করে হয়তো কিছু টাকা জমায়। অন্যদিকে এমন এক বিপদ দাঁড়িয়ে যায়, যদ্দরুন সেই জমানো টাকা সবটাই খরচ হয়ে যায়। আর এভাবে যেমনটা অভাব সে প্রকাশ করেছিল তারচে'ও বেশি অভাবের শিকার হয়ে যায়।
তারপর বর্ণনাকারী বলছেন- أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهًا (অথবা অনুরূপ কোনও শব্দ বলেছেন)। অর্থাৎ উপরের বাক্যটিতে বর্ণনাকারীর সন্দেহ হয়েছে যে, তিনি যেভাবে শুনেছিলেন ঠিক প্রস্তাবেই বর্ণনা করতে পেরেছেন কি না। তবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত যে, মিথ্যবিষয়ে কোনও হেরফের হয়নি। তিনি যা শুনেছিলেন, নিজের বলা বাক্যটি দ্বারা তার মর্মবস্তু আদায় হয়ে গেছে। এটা বর্ণনাকারীদের একটি সতর্কতা। তারা হাদীছেরা বাক্য ঠিক যে ভাষায় শুনেছেন সে ভাষায়ই বর্ণনা করতে চেষ্টা করতেন। কখনও বাক্যের শব্দে যদি সন্দেহ হতো, কিন্তু বিষয়বস্তু যথাযথভাবে মনে থাকত, তবে নিজ ভাষায় সেটি বর্ণনা করে দিতেন আর সেইসঙ্গে বলে দিতেন যে, আমি যার নিকট থেকে শুনেছি, তিনি এরকম বা এর কাছাকাছি কোনও শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে যে কথাটি স্মরণ রাখতে বলেছেন তা নিম্নরূপ-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لِأَرْبَعَةِ نَفَرٍ (দুনিয়া কেবল চার শ্রেণির লোকের জন্য)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদের দিক থেকে মানুষের অবস্থা চার রকম। তারপর সে চার রকম লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা নিম্নরূপ-
عَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ ، وَيَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মাল ও 'ইলম দান করেছেন। সে এ বিষয়ে তার প্রতিপালককে ভয় করে, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে এবং এর ভেতর সে আল্লাহর হক সম্পর্কে সচেতন থাকে)। অর্থাৎ সম্পদের সঙ্গে যেহেতু তার ইলমও আছে, তাই সে ইলম অনুযায়ী সম্পদের ব্যবহার করে। ফলে সে তার সম্পদ কোনও পাপকর্মে ব্যয় করে না। যে খাতে ব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা নারাজ হতে পারেন, তা থেকে বিরত থাকে। কেবল শরী'আত অনুযায়ীই তা খরচ করে। তার মধ্যে একটা বিশেষ দিক হল আত্মীয়তা রক্ষা করা। সে নিজ অর্থ-সম্পদ দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের খেদমত করে। পাশাপাশি তাতে বান্দার যত হক আছে তাও আদায় করে। এমনিভাবে তার সম্পদে আল্লাহ তা'আলার কি কি হক আছে তাও বুঝে বুঝে আদায় করে। যেমন যাকাত, সদাকায়ে ফিতর, মানত ও কাফফারা। এগুলো আদায় করা ফরয। সে তা যথাযথভাবে আদায় করে। তাছাড়া 'ফরযে কিফায়া' হিসেবে যেসকল খাতে অর্থব্যয় করা জরুরি, সেসব খাতেও ব্যয় করে। যেমন মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া ইত্যাদি।
فَهذَا بِأَفْضَلِ الْمَنازِلِ (এটা হল সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর)। অর্থাৎ এ ব্যক্তি জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে থাকবে। কেননা সে দীন শিখেছে, সেই শিক্ষা অনুযায়ী অর্থ-সম্পদের ব্যবহার করেছে, অর্থ-সম্পদকে নিষিদ্ধ খাতে ব্যয় করা হতে বিরত থেকেছে এবং আল্লাহর সন্তোষজনক খাতে তা ব্যয় করেছে। এভাবে নিজের ইলম ও মাল আল্লাহ তা'আলার মর্জিমতো ব্যবহার করায় আল্লাহর কাছে সে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا ، وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا، فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ، يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ 'ইলম দিয়েছেন, কিন্তু মাল দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আমার যদি ধন-সম্পদ থাকত, তবে আমি অমুক ব্যক্তির আমলের মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ দীনী ইলমের অধিকারী হওয়ার কারণে সে তার নিয়ত খালেস করতে পারে। সে জানে অর্থ-সম্পদ কীভাবে অর্জন করতে হয় এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করতে হয়। তাই সে সংকল্প করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে সম্পদ দিলে শরী'আত মোতাবেক তা খরচ করবে এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করবে, যেমন প্রথমোক্ত ব্যক্তি করে থাকে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ، فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ (তাকে তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচনা করা হয়। এ দুই ব্যক্তির প্রতিদান সমান সমান)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার খালেস নিয়ত অনুসারে তার সঙ্গে ব্যবহার করেন। তার সংকল্প অনুযায়ী তাকে প্রতিদান দেন। তার সংকল্প যেহেতু প্রথম ব্যক্তির আমলের মতো আমল করা, তাই তার মতোই ছাওয়াব তাকে দেওয়া হয়। এভাবে সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সে সম্পদশালী ব্যক্তির সমান ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য তার এ সৌভাগ্য হয় দীনী ইলমের বদৌলতে।
وَعَبْد رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمَ يَرْزُقْهُ عِلْمًا، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ، لَا يَتَّقِي فِيْهِ رَبَّهُ وَلَا يَصِلُ فِيْهِ رَحِمَهُ، وَلَا يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيْهِ حَقًّا (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, কিন্তু 'ইলম দেননি। সে 'ইলম ছাড়াই তার মালের ভেতর খেয়াল-খুশির আচরণ করে। এ বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে না, এর দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং এর ভেতর সে আল্লাহ তা'আলার কোনও হক জানে না)। অর্থাৎ ইলম না থাকার কারণে সে আল্লাহ তা'আলাকে চিনতে পারে না। আর তাঁকে চিনতে না পারায় তাঁকে ভয়ও করে না। ফলে অর্জিত মাল সে নাজায়েয পন্থায় খরচ করে। না তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করে, না বান্দার হক। উল্টো সে মালের লোভে পড়ে যায়। লোভ পূরণের জন্য সে নানা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। সে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। হয়ে যায় অহংকারী ও ঈর্ষাকাতর। এভাবে সম্পদ তার জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তার পাপের বোঝা ভারী হতে থাকে।
فَهذَا بأَخْبَثِ الْمَنازِل (এটা হল সর্বনিকৃষ্ট স্তর)। অর্থাৎ দীনী ইলম না থাকার কারণে সে যে তার অর্থ-সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও অবৈধ খাতে খরচ করতে থাকে, আর সম্পদের নেশায় পড়ে হাজারও কুকর্মে জড়িত হয়ে যায়, তার পরিণামে পাপীদের মধ্যেও সর্বনিকৃষ্ট স্তরে সে পৌঁছে যায়।
وَعَبْد لَمْ يَرْزُقهُ اللَّهُ مَالًا وَلَا عِلْمًا فَهُوَ يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ فِيْهِ بِعَمَل فُلَانٍ (ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ মালও দেননি, 'ইলমও না। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে আমি তাতে অমুক ব্যক্তির মতো আমল করতাম)। অর্থাৎ এ ব্যক্তির মালও নেই, ইলমও নেই। মাল না থাকার কারণে দরকার ছিল সবর করা। কিন্তু ইলম না থাকায় সে উল্টো আক্ষেপ করে আর বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে ওই ব্যক্তির মতো বিলাসিতা করতাম। আমিও তার মতো সে মাল পাপাচারে ব্যয় করতাম। অর্থাৎ তার নিয়ত হল কোনওভাবে সম্পদ অর্জিত হয়ে গেলে সে বিলাসিতায় গা ডুবিয়ে দেবে এবং অসৎপথে তা খরচ করবে।
فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ (সেও তার নিয়ত অনুযায়ী বিবেচিত হয়। এদের দু'জনের পাপভার সমান সমান)। অর্থাৎ তার নিয়ত যেহেতু খারাপ, তাই আল্লাহ তা'আলা তাকে সে অনুসারে প্রতিফল দেন। তার নিয়ত তৃতীয় ব্যক্তির মতো সম্পদের অসৎ ব্যবহার করা। তাই অসৎ ব্যবহারের দরুন ওই ব্যক্তির আমলনামায় যেমন পাপ লেখা হয়, এই ব্যক্তির আমলনামায়ও তদ্রূপ পাপ লেখা হয়ে থাকে। এভাবে উভয়ের পাপভার সমান সমান হয়ে যায়।
দেখা যাচ্ছে এই চতুর্থ ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও মালের অসৎ ব্যবহার করার যে গুনাহ, সেই গুনাহের ভারে আক্রান্ত হয়ে গেল। এর কারণ কেবল তার দীনী ইলমে অজ্ঞতা। ইলম না থাকার দরুনই সে মাল সম্পর্কে ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা পোষণ করেছে। প্রথম ব্যক্তি মালের সদ্ব্যবহার করেছে দীনী ইলম থাকার কারণে। দ্বিতীয় ব্যক্তি মাল না থাকা সত্ত্বেও সৎপথে মাল খরচ করার ছাওয়াব পেয়ে গেছে, তাও দীনী ইলমের বদৌলতে। তৃতীয় ব্যক্তি অসৎপথে মাল খরচ করে গুনাহগার হয়েছে দীনী ইলমের অভাবে। চতুর্থ ব্যক্তিও মাল না থাকা সত্ত্বেও অসৎপথে মাল খরচ করার গুনাহে গুনাহগার হয়েছে, এরও কারণ কেবল ইলম না থাকা। সুতরাং ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। যে ব্যক্তি ইলম পেয়ে যায়, সে এক মহাদৌলত পায়। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় এর মাধ্যমে সে বহুবিধ পাপ থেকে বাঁচতে পারে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হতে পারে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও তাতে মানুষকে মনোযোগী করে তোলার লক্ষ্যে যদি কসম করা হয়, তবে তার অবকাশ আছে।
খ. মূল্যবান কথা যাতে অবহেলার শিকার না হয়; বরং শ্রোতা তা মনে রাখে, সেজন্য তাদেরকে বিশেষভাবে তাগিদ করা চাই।
গ. সম্পদ কমে যাবে এ আশঙ্কায় দান-খয়রাত থেকে পিছিয়ে থাকতে নেই।
ঘ. অন্যের দ্বারা জুলুমের শিকার হলে তাতে ধৈর্যধারণ করা মঙ্গলজনক।
ঙ. অন্যের কাছে অর্থসাহায্য প্রার্থনা করার দ্বারা অর্থের অভাব দূর হয় না; আরও বাড়ে।
চ. সম্পদের পাশাপাশি যদি দীনী ইলমও অর্জিত হয়, তবে তা বড়ই সৌভাগ্য।
ছ. যার সম্পদ আছে তার কর্তব্য তাতে আল্লাহর ও বান্দার হক বুঝে নেওয়া।
জ. সম্পদশালী ব্যক্তির উচিত তার সম্পদ দ্বারা বিশেষভাবে আত্মীয়-স্বজনের সেবা করা।
ঝ. যার সম্পদ নেই কিন্তু ইলম আছে, সেও একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। তার উচিত নিজ ইলমের জন্য শোকরগুযার হয়ে থাকা।
ঞ. যার সম্পদ আছে কিন্তু ইলম নেই, তার কর্তব্য সম্পদের ক্ষতি থেকে বাঁচা ও তার উপকার লাভ করার উদ্দেশ্যে দীনের জরুরি ইলম শিখে নেওয়া।
ট. যার সম্পদও নেই ইলমও নেই, তাকে অবশ্যই উপার্জনের চেষ্টা করার পাশাপাশি দীনের জরুরি ইলমও শিখতে হবে।
ঠ. নেক আমল না করেও কেবল নিয়তের দ্বারা আমলের ছাওয়াব অর্জন করা যেতে পারে, যদি সে নিয়ত খালেস হয়। অনুরূপ অসৎকর্ম না করেও মানুষ গুনাহগার হতে পারে, যদি নিয়ত মন্দ হয়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ নিয়ত খালেস করে নেওয়া।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: