আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৫. অধ্যায়ঃ নামাজ

হাদীস নং: ৭৬৬
অসম্পূর্ণ রুকু-সিজদা করার প্রতি ভীতি প্রদর্শন, রুকু-সিজদার মাঝে পিঠ সোজা করা এবং সালাতে আল্লাহ-ভীতি প্রসঙ্গে
৭৬৬. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ (সা) মসজিদের এক প্রান্তে উপবিষ্ট ছিলেন, এমন সময় একব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করল এরপর সে তাঁর কাছে এসে সালাম দিল। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন: ওয়া আলায়কাস-সালাম (অর্থাৎ তোমার প্রতিও শান্তি বর্ষিত হোক), তুমি চলে যাও এবং সালাত আদায় কর, কেননা তুমি সালাত আদায় কর নি। সেমতে সে আবার সালাত আদায় করল এবং ফিরে এসে তাকে সালাম দিল, তিনি বললেন: ওয়া আলায়কাস-সালাম, তুমি চলে যাও এবং সালাত আদায় কর, কেননা তুমি সালাত আদায় কর নি। সেমতে সে আবার সালাত আদায় করে এসে তাঁকে সালাম দিল। তিনি বললেন: ওয়া আলায়কাস-সালাম, তুমি চলে যাও এবং সালাত আদায় কর। কেননা তুমি সালাত আদায় কর নি। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়বারে সে বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সালাত শিক্ষা দিন। তিনি বললেন: তুমি সালাতে দাঁড়ানোর আগে পূর্ণরূপে উযূ করে নেবে, এরপর কিবলামুখী হয়ে তাকবীর বলবে। তারপর কুরআনের যে অংশ তোমার কাছে সহজ, তা তিলাওয়াত করবে। পরে সুস্থিরভাবে রুক্ করবে এবং সোজা হয়ে দাড়াঁবে। তারপর তুমি সুস্থিরভাবে সিজদা করবে এবং স্থিরভাবে মাথা উত্তোলন করে বসবে। এরপর সম্পূর্ণ সালাতে এরূপ করবে।
অন্য বর্ণনায় আছে: দ্বিতীয় সিজদা থেকে সোজা হয়ে বসবে।
(বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে মুসলিমের বর্ণনায় আছে,লোকটি বলল: শপথ ঐ সত্তার, যিনি সত্য সহকারে আপনাকে প্রেরণ করেছেন, এর চেয়ে উত্তম আমি আর কিছু মনে করি না। কাজেই আমাকে (তা) শিক্ষা দিন। তবে সে এক সিজদার কথা ব্যতীত উল্লেখ করে নি। এ বর্ণনা আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবন মাজাহর। আবূ দাউদের বর্ণনায় আছে: তুমি যদি এরূপ কর, তাহলে তোমার সালাত পুরোপুরি আদায় করলে, আর যদি অপূর্ণভাবে আদায় কর, তাহলে তুমি তোমার সালাত অপূর্ণভাবে আদায় করলে।)
التَّرْهِيب من عدم إتْمَام الرُّكُوع وَالسُّجُود وَإِقَامَة الصلب بَينهمَا وَمَا جَاءَ فِي الْخُشُوع
766 - وَعَن أبي هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ أَن رجلا دخل الْمَسْجِد وَرَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم جَالس فِي نَاحيَة الْمَسْجِد فصلى ثمَّ جَاءَ فَسلم عَلَيْهِ فَقَالَ لَهُ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَعَلَيْك السَّلَام ارْجع فصل فَإنَّك لم تصل فصلى ثمَّ جَاءَ فَسلم فَقَالَ وَعَلَيْك السَّلَام ارْجع فصل فَإنَّك لم تصل فصلى ثمَّ جَاءَ فَسلم فَقَالَ وَعَلَيْك السَّلَام ارْجع فصل فَإنَّك لم تصل
فَقَالَ فِي الثَّانِيَة أَو فِي الَّتِي تَلِيهَا عَلمنِي يَا رَسُول الله فَقَالَ إِذا قُمْت إِلَى الصَّلَاة فأسبغ الْوضُوء ثمَّ اسْتقْبل الْقبْلَة فَكبر ثمَّ اقْرَأ مَا تيَسّر مَعَك من الْقُرْآن ثمَّ اركع حَتَّى تطمئِن
رَاكِعا ثمَّ ارْفَعْ حَتَّى تستوي قَائِما ثمَّ اسجد حَتَّى تطمئِن سَاجِدا ثمَّ ارْفَعْ حَتَّى تطمئِن جَالِسا ثمَّ افْعَل ذَلِك فِي صَلَاتك كلهَا
وَفِي رِوَايَة ثمَّ ارْفَعْ حَتَّى تستوي قَائِما يَعْنِي من السَّجْدَة الثَّانِيَة
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَقَالَ فِي حَدِيثه فَقَالَ الرجل وَالَّذِي بَعثك بِالْحَقِّ مَا أحسن غير هَذَا فعلمني وَلم يذكر غير سَجْدَة وَاحِدَة
رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالتِّرْمِذِيّ وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه
وَفِي رِوَايَة لابي دَاوُد فَإِذا فعلت ذَلِك فقد تمت صَلَاتك وَإِن انتقصت من هَذَا فَإِنَّمَا انتقصته من صَلَاتك

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে যে সাহাবীর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, তার নাম খাল্লাদ ইবন রাফি'। তিনি একজন বেদুঈন সাহাবী। তিনি মসজিদে এসে তাড়াহুড়া করে নামায পড়ছিলেন। তা'দীলুল আরকান করছিলেন না। তা'দীলুল আরকান অর্থ নামাযের রুকন অর্থাৎ রুকূ'-সিজদা ইত্যাদি ফরযসমূহ ধীরস্থিরভাবে আদায় করা। যেমন রুকূ'তে গিয়ে এতটুকু সময় স্থির হয়ে থাকা, যাতে ধীরস্থিরভাবে অন্ততপক্ষে একবার সুবহানা রাব্বিয়াল 'আযীম পড়া যায়। তারপর রুকু' থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খানিকটা স্থির হওয়া। তারপর রুকূ'র মতো ধীরস্থিরভাবে সিজদা করা। দুই সিজদার মাঝখানে সোজা হয়ে স্থিরভাবে বসা। এসব কাজ ওয়াজিব। এগুলো না করলে নামায হয় না। এরূপ নামায পুনরায় পড়তে হয়। ওই সাহাবী তা'দীলুল আরকান ছাড়াই নামায পড়ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা লক্ষ করছিলেন।

ওই সাহাবী নামায শেষ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন এবং সালাম দিলেন। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন- اِرْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصل (ফিরে যাও, আবার নামায পড়ো। কেননা তুমি নামায পড়নি)। তাঁর নামায পড়াটা যেহেতু সহীহভাবে হয়নি, তাই বলেছেন তুমি নামায পড়নি। অর্থাৎ তোমার পড়াটা না পড়ার মতোই হয়েছে। তাই এ নামায আবার পড়তে হবে। কীভাবে পড়তে হবে তা তিনি বলে দেননি। সম্ভবত মনে করেছিলেন ওই সাহাবী নিজেই বুঝতে পারবেন তাঁর নামায কীভাবে পড়া উচিত ছিল আর কীভাবে পড়েছেন। কিন্তু সাহাবীর নামাযের সব নিয়ম-কানুন জানা ছিল না। তাই ফিরে গিয়ে আবারও নামায পড়লেন বটে, কিন্তু পড়লেন আগের মতোই। তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সালাম দিলেন। তিনি যথারীতি সালামের উত্তর দিলেন। ওই সাহাবী ক্ষনিক আগেই এসে সালাম দিয়েছিলেন। তারপর নামায পড়ে এসে আবার সাহাবী দিলেন। দুইবার সালাম দেওয়ার মাঝখানে ছিল নামাযের ব্যবধান। অল্পসময়ের বিরতির পর ফের সালাম দেওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপত্তি করেননি; বরং যথারীতি সালামের উত্তর দিয়েছেন। বোঝা গেল একবার সালাম দেওয়ার পর যদি ক্ষণিকের বিচ্ছেদ হয়, তারপর পুনরায় সাক্ষাৎকালে সালাম দেওয়া বিধিসম্মত। প্রথমবারের মতোই পরেরবারও সালাম দেওয়া সুন্নত।

যাহোক দ্বিতীয়বার সালামের জবাব দেওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন, ফিরে যাও, আবার নামায পড়ো। কেননা তুমি নামায পড়নি। এভাবে তিনবার হল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বারও তাঁকে নামাযের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন না। এর কারণ এ হতে পারে যে, তিনি তাঁকে সময় দিচ্ছিলেন। যাতে নিজ ত্রুটি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং বিশুদ্ধভাবে নামায পড়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তারপরও যখন তাঁর কাছে নিজ ত্রুটি ধরা পড়বে না, তখন তাঁর নিজের মধ্যেই শেখার আগ্রহ জন্মাবে এবং বিষয়টির গুরুত্বও তাঁর বুঝে আসবে। তখন জানতে চাইবেন সহীহ-শুদ্ধভাবে নামায কীভাবে পড়তে হয়। তখন যদি শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তা তার মনে বসে যাবে। কখনও ভুলবেন না। পরিশেষে তাই হল। শেষবার যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন 'ফিরে যাও, আবার নামায পড়ো। কেননা তুমি নামায পড়নি', তখন তিনি নিজ অপারগতা প্রকাশ করে বললেন-
والذي بعثك بالحق ما أحسن غيره، فعلمني،
‘যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমি এরচে' ভালো পারি না। আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন’।

তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্নেহ-মমতার সঙ্গে তাঁকে নামাযের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। নামাযের কোন রুকন কীভাবে আদায় করতে হবে তা বলে দিলেন। অর্থাৎ প্রতিটি রুকন আদায় করতে হবে ধীরস্থিরভাবে। তা'দীলুল আরকানের সঙ্গে। তাড়াহুড়া করা যাবে না। যদি তাড়াহুড়া করা হয়, তবে তা'দীলুল আরকান ছুটে যাবে, যা কিনা ওয়াজিব। রুকু'-সিজদায় গিয়ে স্থির না হলে, রুকু' থেকে সোজা হয়ে না দাঁড়ালে এবং দুই সিজদার মাঝখানে সোজা হয়ে না বসলে নামায হয় না। কেননা এর প্রতিটিই ওয়াজিব।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. একবার সালাম দেওয়ার পর ক্ষণিকের বিচ্ছেদ বা আড়ালের পর পুনরায় সাক্ষাৎ হলে পুনরায় সালাম দেওয়া সুন্নত।

খ. নামাযে তা'দীলুল আরকান ওয়াজিব। ওয়াজিব ছুটে গেলে নামায হয় না।

গ. কারও দ্বারা কোনও ভুল হলে তাকে শিক্ষাদানের একটা নববী পন্থা এটাও যে, তাকে সুযোগ দেওয়া হবে যাতে সে নিজে নিজেই অনুসন্ধান করে নিজ ভুল নির্ণয় করতে পারে এবং নিজে নিজেই তা সংশোধন করতে সক্ষম হয়।

ঘ. যার যে বিষয়ে জানা নেই তার উচিত, তা অকপটে স্বীকার করা এবং যে জানে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া।

ঙ. শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ ছিল খুবই মমতাপূর্ণ। প্রত্যেক শিক্ষাদাতার এ আদর্শ অনুসরণ করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ৭৬৬ | মুসলিম বাংলা