প্রবন্ধ
আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা আবশ্যক নয়! হেযবুত তওহীদ। পর্ব–৭
প্রিয় পাঠক, মহান আল্লাহ আমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ চান যেন সকল বান্দা তাঁকে ভালোবাসেন, তাঁকে মহব্বত করেন। যারা রব্ব থেকে দূরে সরে যায়, তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ হে মানুষ, কোন জিনিস তোমাকে তোমার সেই মহান প্রতিপালক সম্বন্ধে ধোঁকায় ফেলেছে? -সুরা ইনফিতার : ৬ সুতরাং বুঝা গেলো, আল্লাহর চাওয়া হলো, তাঁর বান্দারা দুনিয়াপ্রীতি থেকে সরে তাঁর ভালোবাসা কামনা করুক। অতএব একথা চিরসত্য যে, সকল বান্দার জন্য আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করাই হলো মূল টার্গেট। হেযবুত তওহীদ কী বলে? কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল বিষয়টি আবশ্যক নয় বলে দাবি করছে হেযবুত তওহীদ। তাদের বক্তব্য দেখুন- প্রশ্ন আসে তবে কি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের প্রয়োজনীয়তা এ দ্বীনে নেই? আছে, আগেই বলেছি এ দ্বীন ভারসাম্যযুক্ত, কাজেই দুটোই আছে। কিন্তু প্রথম হলো পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কোরে, তারপর আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা। প্রথমটা ফরজ, দ্বিতীয়টা নফল। ফরদ নামায বাদ দিয়ে শুধু সুন্নত বা নফল নামায পড়লে শরিয়াহ মোতাবেকই তা যেমন নাজায়েয, ঠিক তেমনি বিশ্ব নবীর (দঃ) ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে পূর্ণ করার ফরদ কাজ বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া অর্থাৎ নফল কাজ নিয়ে ব্যস্ত হোলে তা ঐ শরিয়াহ মোতবেকই জায়েয হবে না। প্রথমে ফরজ তারপর ওয়াজেব, তারপর সুন্নাহ, তারপর নফল ও তারপর মুস্তাহাব’। -এ ইসলাম ইসলামই নয়, পৃ. ১১০ প্রিয় পাঠক, একটু ভেবে দেখুন তো কথাটি কতবড় ভয়ঙ্কর কথা! হেযবুত তওহীদের উক্ত বক্তব্য থেকে তারা দুটি বিষয় স্পষ্ট করতে চেয়েছে, ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা ফরজ। কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা নফল, তথা আবশ্যক নয়’। ইসলাম কী বলে? মহান আল্লাহ-র নৈকট্য অর্জন করা সর্বাবস্থায় ফরজ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদিস রয়েছে। চলুন কয়েকটি প্রমাণ দেখা যাক। মহান রব্ব বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ ۗ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ এবং (এতদসত্ত্বেও) মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে (তাঁর প্রভুত্বে) অংশীদার সাব্যস্ত করে, যাদেরকে তারা ভালোবাসে আল্লাহর ভালোবাসার মত। তবে যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসে। হায়! এ জালিমগণ (দুনিয়ায়) যখন কোনও শাস্তি প্রত্যক্ষ করে, তখনই যদি বুঝতো যে, সমস্ত শক্তি আল্লাহরই এবং (আখিরাতে) আল্লাহর আযাব হবে সুকঠিন। -সুরা বাকারা : ১৬৫ প্রিয় দ্বীনি ভাই, উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারদের পরিচয় বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ঈমানদার হলো তারা, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। সুতরাং বুঝা গেলো–ঈমানদার হলো তরাই, যাঁদের অন্তরে সবচে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা থাকবে। সুতরাং যারা আল্লাহ-র নৈকট্যকে আবশ্যকীয় মনে করে না, তারা কখনও ঈমানদার হতে পারে না। আল্লাহপাব আরও বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَابْتَغُواْ إِلَيهِ الْوَسِيلَةَ হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য ওসিলা সন্ধান করো। –সুরা মায়িদা : ৩৫ “ওসীলা” শব্দের অর্থ কী? রঈসুল মুফাসসিরিন, বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এ আয়াতের ব্যাপারে মতামত পেশ করেছেন, عَنْ عَطَاءٍ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَيِ الْقُرْبَةَ বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা রহি. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, (ওসীলা) অর্থ হলো, নৈকট্য অর্জন করা। -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৩ পৃ. ৭৫ ইমাম ইবনে কাসীর রহি. আরও বলেন, وَكَذَا قَالَ مُجَاهِدٌ وَعَطَاءٌ وَأَبُو وَائِلٍ وَالْحَسَنُ وَقَتَادَةُ وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ كَثِيرٍ وَالسُّدِّيُّ وَابْنُ زَيْدٍ এমনই মত পোষণ করেছেন (অসংখ্য তাবেয়ী, যেমন) হযরত মুজাহিদ, আতা, আবু ওয়ায়িল, হাসান বসরী, কাতাদাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে কাসীর, সুদ্দী এবং ইবনে যায়েদ রহি. প্রমুখ। -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৩ পৃ. ৭৫ বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কাতাদাহ রহি. বলেন, قوله فيها أى تقربوا إليه بطاعته والعمل بما يرضيه আয়াতের অর্থ হলো- ‘তোমরা তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে এবং যে সকল কাজ তিনি খুশী হন, তার মাধ্যমে তাঁর (আল্লাহর) নিকটবর্তী হও। -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৩ পৃ. ১০৩ এ কথাগুলো উল্লেখ্য করার পর ইমাম ইবনে কাসীর রহি. বলেন, وهذا الذى قاله هؤلاء الأئمة لا خلاف بين المفسرين فيه এ সকল মহান ইমামগণ আয়াতের তাফসীরে এ কথাগুলোই বলেছেন, যে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে কোনও মতভেদ নেই। -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ৩ পৃ. ১০৩ সুতরাং প্রমাণ হলো, ওসীলা শব্দের অর্থ হলো, নৈকট্য অর্জন করা। আর এ আয়াত দিয়ে প্রমাণ হলো যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্য অর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা ফরজ। শুধু তাই নয়, বরং অপর আয়াতে মহান রব্ব বলেন, وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ এবং সিজদা করো ও নিকটবর্তী হও। -সুরা আলাক : ১৯ উক্ত আয়াতের তাফসীর কাতে গিয়ে ইমাম কুরতুবী রহি.বলেন, واسجد أي صل لله واقترب أَيْ تَقَرَّبْ إِلَى اللَّهِ جَلَّ ثَنَاؤُهُ بِالطَّاعَةِ وَالْعِبَادَةِ ‘সেজদা করো’ অর্থ হলো, ‘আল্লাহর জন্য নামাজ পড়ো’ এবং ‘নৈকট্য অর্জন করো’ অর্থ হলো, অনুসরণ ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করো। –তাফসীরে কুরতুবী, খ. ২০ পৃ. ১১৪ প্রিয় পাঠক, এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য সরাসরি শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং এখন তো আর অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই। কারণ উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্য অর্জনের কথা বলতে গিয়ে صيغة الامر তথা আদেশসূচক বাক্য ব্যবহার করেছেন। আর পবিত্র কুরআনের সকল আদেশসূচক শব্দ ফরজ বা ওয়াজীবের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবশ্য যেসব বিষয়ে ভিন্ন কোনো বিধান বর্ণিত হয়, সেগুলোর কথা ভিন্ন। কিন্তু এ আয়াতে বর্ণিত বিধানের বিপরীত ভিন্ন কোনও বিধান কোথাও নেই। সুতরাং মহান রব্বের নৈকট্য অর্জন করা ফরজ। এ ব্যাপারে একমাত্র হেযবুত তওহীদ ব্যতিত অন্য কারও দ্বিমত নেই।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান দুই মুখপাত্র
...
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ : পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
...
জান্নাত ও জাহান্নাম
...
উদারতা অর্থ আকীদা ও আদর্শের বিসর্জন নয়
এক হল মুদারাত তথা উদারতা, যার অর্থ হল, নিজের প্রতিপক্ষের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও কোমল ব্যবহার করা এবং তার...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন