আল বাকারা

সূরা নং: ২, আয়াত নং: ১৫১

তাফসীর
کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَیُزَکِّیۡکُمۡ وَیُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَالۡحِکۡمَۃَ وَیُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ ؕۛ

উচ্চারণ

কামাআরছালনা-ফীকুম রাছূলাম মিনকুম ইয়াতলূ‘আলাইকুম আ-য়া-তিনা-ওয়া ইউঝাক্কীকুম ওয়া ইউ‘আলিলমুকুমুল কিতা-বা ওয়াল হিকমাতা ওয়া ইউ‘আলিলমুকুম মা-লাম তাকূনূতা‘লামূন।

অর্থ

মুফতী তাকী উসমানী

(এ অনুগ্রহ ঠিক সেই রকমই) যেমন আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য হতে, যে তোমাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম ১০৯ দেয় এবং তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না।

তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানী

১০৯. কাবা নির্মাণকালে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দু’টি দু‘আ করেছিলেন। এক. আমার বংশধরদের মধ্যে এমন একটি উম্মত সৃষ্টি করুন, যারা আপনার পরিপূর্ণ আনুগত্য করবে। দুই. তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করুন (দেখুন আয়াত ১২৮-১২৯)। আল্লাহ তাআলা প্রথম দু‘আটি এভাবে কবুল করেন যে, উম্মতে মুহাম্মাদীকে একটি মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ উম্মতরূপে সৃষ্টি করেছেন (দেখুন আয়াত ১৪৩)। এবার আল্লাহ তাআলা বলছেন, আমি যেমন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দু‘আ কবুল করে তোমাদের প্রতি এই অনুগ্রহ করেছি যে, তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি এবং স্থায়ীভাবে তোমাদেরকে মানবতার পথ-প্রদর্শনের দায়িত্ব দিয়েছি, যার একটি উল্লেখযোগ্য আলামত হল কাবাকে স্থায়ীভাবে তোমাদের কিবলা বানিয়ে দেওয়া, তেমনিভাবে আমি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় দু‘আও কবুল করেছি, সেমতে নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি, যিনি সেই সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার জন্য চেয়েছিলেন। তার মধ্যে প্রথম বৈশিষ্ট্য হল আয়াত তিলাওয়াতের দায়িত্ব পালন। এর দ্বারা জানা গেল, কুরআন মাজীদের আয়াত তেলাওয়াত করাও একটি স্বতন্ত্র পুণ্যের কাজ ও কাম্য বস্তু, তা অর্থ না বুঝেই তিলাওয়াত করা হোক না কেন! কেননা কুরআন মাজীদের অর্থ শিক্ষা দানের বিষয়টি সামনে একটি পৃথক দায়িত্বরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল কুরআন মাজীদের শিক্ষা দান করার দায়িত্ব পালন। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক শিক্ষাদান ব্যতিরেকে কুরআন মাজীদ যথাযথভাবে বোঝা সম্ভব নয়। কেবল তরজমা পড়ার দ্বারা কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন করা যেতে পারে না। আরববাসী তো আরবী ভাষা ভালোভাবেই জানত। তাদেরকে তরজমা শেখানোর জন্য কোনও শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল না। তথাপি যখন তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে কুরআনের তালীম নিতে হয়েছে, তখন অন্যদের জন্য তো কুরআন বোঝার জন্য নববী ধারার তালীম গ্রহণ আরও বেশি প্রয়োজন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তৃতীয় দায়িত্ব বলা হয়েছে ‘হিকমত’-এর শিক্ষা দান। এর দ্বারা জানা গেল যে, প্রকৃত হিকমত ও জ্ঞান সেটাই, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। এর দ্বারা কেবল তাঁর হাদীসসমূহের ‘হুজ্জত’ (প্রামাণিক মর্যাদাসম্পন্ন) হওয়াই বুঝে আসছে না; বরং আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁর কোনও নির্দেশ যদি কারও নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী যুক্তিসম্মত মনে না হয়, তবে সেক্ষেত্রে তার বুদ্ধি-বিবেচনাকে মাপকাঠি মনে করা হবে না; বরং মাপকাঠি ধরা হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশকেই। তাঁর চতুর্থ দায়িত্ব বলা হয়েছে এই যে, তিনি মানুষকে পরিশুদ্ধ করবেন। এর দ্বারা তাঁর বাস্তব প্রশিক্ষণদানকে বোঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি সাহাবায়ে কিরামের আখলাক-চরিত্র ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলীকে পঙ্কিল ভাবাবেগ ও অনুচিত চাহিদা থেকে মুক্ত করত: তাদেরকে উন্নত বৈশিষ্ট্যাবলীতে বিমন্ডিত করে তোলেন। এর দ্বারা জানা গেল, মানুষের আত্মিক সংশোধনের জন্য কুরআন-সুন্নাহর কেবল পুঁথিগত বিদ্যাই যথেষ্ট নয়; বরং সে বিদ্যাকে নিজ জীবনে প্রতিফলিত করার বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে নিজ সাহচর্যে রেখে তাঁদেরকে বাস্তব প্রশিক্ষণ দান করেছেন, তারপর সাহাবীগণ তাবিঈদেরকে এবং তাবিঈগণ তাবে তাবিঈনকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এভাবে প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার এ ধারা শত-শত বছর ধরে চলে আসছে। অভ্যন্তরীণ আখলাক চরিত্রের এ প্রশিক্ষণ যে জ্ঞানের আলোকে দেওয়া হয় তাকে ‘ইলমুল ইহসান ও তাযকিয়া বলা হয। ‘তাসাওউফ’-ও মূলত এ জ্ঞানেরই নাম ছিল, যদিও এক শ্রেণীর অযোগ্যের হাতে পড়ে এ মহান বিদ্যায় অনেক সময় ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার সংমিশ্রণ ঘটেছে, কিন্তু তার মূল এই তাযকিয়া (পরিশুদ্ধকরণ)-ই, যার কথা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। বস্তুত তাসাওউফের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করার মত লোক সব যুগেই বর্তমান ছিল, যারা সে অনুযায়ী আমল করে নিজেদের জীবনকে উৎকর্ষমণ্ডিত করেছেন এবং যথারীতি তা করে যাচ্ছেন।
﴾﴿