৪৬. হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে দিয়ে হযরত খাজির আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত করানো এবং এসব ঘটনা তাকে প্রত্যক্ষ করানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি বাস্তব সত্যের সাথে তাকে পরিচিত করানো। সে সত্যকে পরিষ্কার করে দেওয়ার লক্ষ্যেই কুরআন মাজীদ তাদের সাক্ষাতকারের ঘটনাটি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছে।অন্যের মালিকানায় তার অনুমতি ছাড়া কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয। বিশেষত অন্যের মালিকানাধীন বস্তুর কোনরূপ ক্ষতিসাধন করার অনুমতি ইসলাম কাউকে দেয়নি। এমনকি সে ক্ষতি যদি মালিকের উপকার করার অভিপ্রায়েও হয়ে থাকে। কিন্তু কুরআন মাজীদ হযরত খাজির আলাইহিস সালামের যে ঘটনা বর্ণনা করেছে, আমরা তাতে অন্য রকম দৃশ্য দেখতে পাই। তিনি মালিকদের অনুমতি ছাড়াই নৌকার তক্তা খুলে ফেলেন।
এমনিভাবে কোন নিরপরাধ লোককে হত্যা করা শরীয়তে একটি গুরুতর পাপ। বিশেষত কোন শিশুকে হত্যা করা তো যুদ্ধাবস্থায়ও জায়েয নয়। এমনকি যদি জানা থাকে সে শিশু বড় হয়ে দেশ ও দশের পক্ষে মুসিবতের কারণ হবে, তবুও এখনই তাকে হত্যা করা কোনক্রমেই বৈধ নয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও হযরত খাজির আলাইহিস সালাম একটি শিশুকে হত্যা করে ফেলেন। তাঁর এ কাজ দু’টি যেহেতু শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয ছিল না, তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালামের পক্ষে চুপ থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি সঙ্গে-সঙ্গেই আপত্তি জানিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে হযরত খাজির আলাইহিস সালাম এহেন শরীয়ত বিরোধী কাজ কিভাবে করলেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য প্রথমে একটা বিষয় বুঝে নেওয়া জরুরি। বিশ্ব-জগতে যত ঘটনা ঘটে, আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে তা ভালো মনে হোক বা মন্দ, প্রকৃতপক্ষে তার সম্পর্ক এক অলক্ষ্য জগতের সাথে; এমন এক জগতের সাথে যা আমাদের চোখের আড়ালে। পরিভাষায় তাকে ‘তাকবীনী জগত’ বলে। সে জগত সরাসরি আল্লাহ তাআলার হিকমত এবং সৃজন ও বিনাশ সংক্রান্ত বিধানাবলী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
কোন ব্যক্তি কতকাল জীবিত থাকবে, কখন তার মৃত্যু হবে, কতকাল সুস্থ থাকবে, কখন রোগাক্রান্ত হবে, তার পেশা কী হবে এবং তার মাধ্যমে সে কী পরিমাণ উপার্জন করবে, এবংবিধ যাবতীয় বিষয় সম্পাদন করার জন্য তিনি বিশেষ কর্মীবাহিনী নিযুক্ত করে রেখেছেন, যারা আমাদের অলক্ষ্যে থেকে আল্লাহ তাআলার এ জাতীয় হুকুম বাস্তবায়িত করেন।
উদাহরণত, আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন কোন ব্যক্তির মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মৃত্যুর ফিরিশতা তার ‘রূহ কবয’ (প্রাণ সংহার)-এর জন্য পৌঁছে যায়। সে যখন আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনার্থে কারও মৃত্যু ঘটায়, তখন সে কোন অপরাধ করে না; বরং আল্লাহ তাআলার হুকুম তামিল করে মাত্র। কোন মানুষের কিন্তু অপর কোন মানুষের প্রাণনাশ করার অধিকার নেই, কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেই ফিরিশতাকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছেন, তার পক্ষে এটা কোন অপরাধ নয়। বরং সম্পূর্ণ ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ, যেহেতু সে আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করছে।
আল্লাহ তাআলার তাকবীনী হুকুম কার্যকর করার জন্য সাধারণত ফিরিশতাদেরকেই নিযুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি চাইলে যে-কারও উপর এ ভার অর্পণ করতে পারেন। হযরত খাজির আলাইহিস সালাম যদিও মানুষ ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে ফিরিশতাদের মত তাকবীনী জগতের ‘বার্তাবাহক’ বানিয়েছিলেন। তিনি যা-কিছু করেছিলেন আল্লাহ তাআলার তাকবীনী হুকুমের অধীনে করেছিলেন সুতরাং মৃত্যুর ফিরিশতা সম্পর্কে যেমন প্রশ্ন তোলা যায় না সে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটাল কেন কিংবা বলা যায় না যে, এ কাজ করে সে একটা অপরাধ করেছে, যেহেতু সে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এ কাজের জন্য আদিষ্ট ছিল, তেমনিভাবে হযরত খাজির আলাইহিস সালামের প্রতিও তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে কোন আপত্তি তোলা যাবে না। কেননা তিনিও নৌকাটিতে খুঁত সৃষ্টি করা ও শিশুটিকে হত্যা করার কাজে আল্লাহ তাআলার তাকবীনী হুকুমের দ্বারা আদিষ্ট ছিলেন। ফলে তাঁর সে কাজ কোন অপরাধ ছিল না।
কিন্তু আমাদের ব্যাপার ভিন্ন। আমরা দুনিয়ায় শরয়ী বিধানাবলীর অধীন। আমাদেরকে তাকবীনী জগতের কোন জ্ঞানও দেওয়া হয়নি এবং সেই জগত সম্পর্কিত কোন দায়িত্বও আমাদের উপর অর্পিত হয়নি। আমরা দৃশ্যমান জগতে বাস করি, জাগ্রত জীবনে বিচরণ করি। চাক্ষুষ যা দেখতে পাই তাকে কেন্দ্র করেই আমাদের আবর্তন। তাই আমাদেরকে যেসব বিধান দেওয়া হয়েছে, তা দৃশ্যজগত ও চাক্ষুষ কার্যাবলীর সাথেই সম্পৃক্ত। তাকে ‘শরয়ী হুকুম’ বা শরীয়ত বলে।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এই চাক্ষুষ ও জাগ্রত জগতের নবী ছিলেন। তাকে এক শরীয়ত দেওয়া হয়েছিল। তিনি তার অধীন ছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে না হযরত খাজির আলাইহিস সালামের কর্মকাণ্ড দেখে চুপ থাকা সম্ভব হয়েছে, আর না তিনি পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে সফর অব্যাহত রাখতে পেরেছেন। পর পর ব্যতিক্রমধর্মী তিনটি ঘটনা দেখে তিনি বুঝে ফেলেছেন হযরত খাজির আলাইহিস সালামের কর্মক্ষেত্র তাঁর নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তাঁর পক্ষে তাঁর সঙ্গে চলা সম্ভব নয়। তবে তাঁর সঙ্গে আর থাকা সম্ভব না হলেও, এ ঘটনার মাধ্যমে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে খোলা চোখে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্বজগতে যা-কিছু ঘটছে তার পেছনে আল্লাহ তাআলার অপার হিকমত সক্রিয় রয়েছে। কোন ঘটনার রহস্য ও তাৎপর্য যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে তার ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলার ফায়সালা সম্পর্কে কোন আপত্তি তোলার সুযোগ আমাদের নেই। কেননা বিষয়টা যেহেতু তাকবীনী জগতের, তাই এর রহস্য উন্মোচনও সে জগতেই হতে পারে, কিন্তু সে জগত তো আমাদের চোখের আড়ালে।
দৈনন্দিন জীবনে এমন বহু ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে যা আমাদের অন্তর ব্যথিত করে। অনেক সময় নিরীহ-নিরপরাধ লোককে নিগৃহীত হতে দেখে আমাদের অন্তরে নানা সংশয় দেখা দেয়, যা নিরসনের কোন দাওয়াই আমাদের হাতে ছিল না। আল্লাহ তাআলা হযরত খাজির আলাইহিস সালামের মাধ্যমে তাকবীনী জগতের রঙ্গমঞ্চ থেকে খানিকটা পর্দা সরিয়ে এক ঝলক তার দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন এবং এভাবে মুমিনের অন্তরে যাতে এরূপ সংশয় সৃষ্টি হতে না পারে তার ব্যবস্থা করে দিলেন।
স্মরণ রাখতে হবে তাকবীনী জগত এক অদৃশ্য জগত এবং তার কর্মীগণ আমাদের চোখের আড়াল। হযরত খাজির আলাইহিস সালামও অদৃশ্যই ছিলেন। তাকবীনী জগতের খানিকটা দৃশ্য দেখানোর লক্ষ্যে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে ওহীর মাধ্যমে তাঁর সন্ধান দেওয়া হয়েছিল। এখন যেহেতু ওহীর দরজা বন্ধ, তাই এখন কারও পক্ষে নিশ্চিতভাবে তাকবীনী জগতের কোন কর্মীর সন্ধান ও সাক্ষাত লাভ সম্ভব নয়। এমনিভাবে দৃশ্যমান জগতের কোন ব্যক্তির পক্ষে এ দাবী করারও অবকাশ নেই যে, সে তাকবীনী জগতের একজন দায়িত্বশীল এবং সেই জগতের বিভিন্ন ক্ষমতা তার উপর ন্যস্ত আছে।
কাজেই হযরত খাজির আলাইহিস সালামের ঘটনাকে ভিত্তি করে যারা শরীয়তের বিধি-বিধানকে স্থগিত করা বা তার বিপরীত কাজকে বৈধ সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে, নিঃসন্দেহে তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত এবং তারা সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। কোন কোন নামধারী দরবেশ তাসাওউফের নাম দিয়ে বলে থাকে, ‘শরীয়তের বিধান কেবল স্থূলদর্শী লোকদের জন্য, আমরা তা থেকে ব্যতিক্রম’। নিঃসন্দেহে এটা চরম পথভ্রষ্টতা। এখন শরীয়তের বিধান সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কারও কাছে এমন কোন দলীল নেই, যার বলে সে শরীয়তের বিধান থেকে ব্যতিক্রম থাকতে পারে।