ইন্টারফেইথ ডায়ালগ (আন্তঃধর্ম) সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?
প্রশ্নঃ ১২১৩৯৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ইন্টারফেইথ ডায়ালগ(আন্তঃধর্ম) সম্পর্কে ইসলাম কি বলে? এটা কি কুফুরি? এবং সুরা কাফেরুণ এর শেষ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা কি? ফিকহি দলিলের আলোকে জানালে উপকৃত হবো।এবং গ্রহণযোগ্য মুফতিদের এই ব্যাপারে ফতোয়া জানতে চাই। এই ব্যাপারে উম্মাহর আলেমদের করণীয় কি? আশা করি সব গুলো উওর দিবেন।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই! ইন্টারফেইথ: ধর্মীয় ঐক্যের নামে ঈমানহানির গোপন জাল।
আজকের পৃথিবীতে “ধর্মীয় সম্প্রীতি” বা Interfaith Dialogue কথাটি এমনভাবে প্রচারিত হচ্ছে যেন এটি মানবতার এক মহান শিক্ষা। “Inter” মানে পারস্পরিক, আর “Faith” মানে ধর্ম বা বিশ্বাস অর্থাৎ Interfaith মানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বোঝাপড়া, সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রচেষ্টা। বাহ্যিকভাবে এটি খুব আকর্ষণীয় ও মানবিক মনে হলেও, বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। মুসলিম উম্মাহকে আকীদাগতভাবে দুর্বল করার জন্য আধুনিক যুগের এক সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের নাম হচ্ছে ইন্টারফেইথ ফিতনা। এটি এমন এক মতবাদ, যার উদ্দেশ্য মুসলমানদের ঈমান, আত্মপরিচয় ও আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাসকে ধীরে ধীরে নরম ও আপসকামী করে তোলা।
সুন্দর নামের আড়ালে ভয়ংকর উদ্দেশ্য
“ইন্টারফেইথ ডায়ালগ”, “ইন্টারফেইথ হারমোনি”, “ইন্টারফেইথ অ্যালায়েন্স”এসব নাম শুনতে যেমন শান্তি ও সম্প্রীতির কথা মনে হয়, আসলে এগুলোর পেছনে কাজ করছে এমন কিছু চিন্তাধারা যেগুলোর লক্ষ্য মুসলমানদের মনে এই ধারণা তৈরি করা যে, সব ধর্মই সমান ও সত্য। অথচ এটি সরাসরি কুরআনের মূল আকীদার বিরোধী।
ইতিহাসে যেমন বাদশাহ আকবর “দ্বীন-ই-ইলাহী” নামে সব ধর্মের মিশ্রণে এক কুফরি ধর্ম তৈরি করতে চেয়েছিল, আজকের “ইন্টারফেইথ” আন্দোলনও তেমনই এক আধুনিক রূপ। যেখানে ইসলামকে অন্য ধর্মের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা
১. ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন:
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الإِسْلاَمُ
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্য) দীন কেবল ইসলামই। সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯
তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন:
‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ। আল্লাহপ্রদত্ত ধর্মকে এ নামে অভিহিত করার কারণ, এ ধর্মের অনুসারী ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার হাতে সমর্পণ করে ও তাঁর যাবতীয় আদেশ শিরোধার্য করে। সে কারণেই এর অনুসারীকে মুসলিম অর্থাৎ আত্মসমর্পণকারী বলে। এমনিতে তো সকল আসমানী ধর্মই ইসলাম। কিন্তু প্রাচীন ধর্মগুলোকে যেহেতু তাদের অনুসারীগণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেনি, বরং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তা বিকৃত করে ফেলেছে, অবশেষে শেষ নবীর আবির্ভাবের পর তার শরীআত দ্বারা সেগুলোর অনেক বিধান রহিতও হয়ে গেছে, তাই সেগুলো আর ইসলাম নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত থাকেনি। এখন ইসলাম হল সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.) কর্তৃক আনীত ও প্রচারিত দীন ও শরীআত, যা এক পরিপূর্ণ, সার্বজনীন ও কিয়ামতকাল পর্যন্ত স্থায়ী ধর্ম।
২. ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম গ্রহণযোগ্য নয়:
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
যে ব্যক্তিই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও দীন অবলম্বন করতে চাবে, তার থেকে সে দীন কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে মহা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৮৫
নোট: এটি ইন্টারফেইথ মতবাদের মূল দাবিকে সরাসরি খণ্ডন করে।
ইসলামের অবস্থান
ইসলাম মানবিক সহাবস্থান ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দেয়, কিন্তু কখনোই অন্য ধর্মের বিশ্বাসকে “সত্য” হিসেবে স্বীকার করে না। ইসলামী দৃষ্টিতে শান্তি মানে আল্লাহর নির্দেশিত নিয়মে আত্মসমর্পণ, অন্য ধর্মের সাথে আপস নয়। তাই মুসলিমদের দায়িত্ব হলো ইন্টারফেইথের বাহ্যিক সৌন্দর্যে বিভ্রান্ত না হয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজেদের ঈমানকে রক্ষা করা।
শেষ কথা হচ্ছে,
ইন্টারফেইথ কোনো নিরীহ সামাজিক উদ্যোগ নয়; এটি আধুনিক যুগের এক বুদ্ধিবৃত্তিক ফিতনা। মুসলিমদের উচিত এই ফিতনা থেকে সতর্ক থাকা, কারণ একবার আকীদার ভিত দুর্বল হয়ে গেলে ঈমান অটুট রাখা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এমন সব চিন্তা ও আন্দোলন থেকে রক্ষা করুন, যা ইসলামি আকীদা ও তাওহীদের বিরুদ্ধে যায়। আল্লাহ একমাত্র সত্য ইলাহ, ইসলামই তাঁর মনোনীত দ্বীন।
মুমিনদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশ
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ. لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ. وَلَا أَنتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ. لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
বলো: হে কাফেরগণ! আমি তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করি না, এবং তোমরাও আমার উপাস্যের ইবাদত করো না... তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমার জন্য আমার ধর্ম।
সূরা আল-কাফিরুন, আয়াত ১–৬
নোট: এই সূরাটি ইন্টারফেইথের ধারণার সরাসরি প্রতিবাদ। ইসলাম স্পষ্টভাবে বিশ্বাসের সীমারেখা নির্ধারণ করেছে।
তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন:
এ সূরাটি নাযিল হওয়ার পটভূমি এই যে, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, আস ইবনে ওয়াইল প্রমূখ মক্কার কাফের নেতৃবৃন্দ একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই সমঝোতা প্রস্তাব পেশ করল যে, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদত করুন, পরের বছর আমরা আপনার মাবুদের ইবাদত করব। অন্য কিছু লোকও এ জাতীয় আরও কিছু প্রস্তাব রেখেছিল, সবগুলো প্রস্তাবের সারকথা ছিল এটাই যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে-কোনভাবে কাফেরদের রীতি অনুযায়ী ইবাদত করতে রাজি হলে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হতে পারে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ সূরাটি নাযিল হয় এবং এতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দেওয়া হয় যে, কুফর ও ঈমান সম্পূর্ণ আলাদা দুটো জিনিস। তার মধ্যে এ রকম কোন মীমাংসা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়, যা দ্বারা সত্য-মিথ্যার প্রভেদ ঘুচে যাবে এবং সত্য দীনের সাথে কুফর ও শিরকের মিশ্রণ ঘটে যাবে। হ্যাঁ, তোমরা যদি সত্য কবুল করতে প্রস্তুত না হও, তবে ঠিক আছে, নিজেদের ভ্রান্ত ধর্ম মতে কাজ করতে থাক। যার পরিণাম একদিন তোমাদেরকে ভোগ করতে হবে। আর আমিও আমার নিজ দীনের অনুসরণ করে যাব, যার দায়-দায়িত্ব আমার নিজের। এর দ্বারা বোঝা গেল, অমুসলিমদের সাথে এমন কোন চুক্তি জায়েয নয়, যার ফলে তাদের ধর্মীয় কোন রীতি-রেওয়াজ গ্রহণ করতে হয়। হ্যাঁ নিজ দীনের উপর পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত থেকে তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি হতে পারে, যেমন সূরা আনফালে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে (৮ : ৬১)। [‘তোমাদের জন্য তোমাদের দীন এবং আমার জন্য আমার দীন’ একথার দ্বারা কুফরের অনুমোদন দেওয়া হয়নি এবং দাওয়াত ও জিহাদকেও নিষিদ্ধ করা হয়নি; বরং তারা যে সমঝোতার প্রস্তাব করেছিল সেটাকেই সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, তোমাদের দীন কুফর ও শিরকের আর আমার দীন তাওহীদের। এ দুয়ের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব নয়। বরং তোমাদের কর্তব্য ওই ভ্রান্ত ধর্ম ত্যাগ করে সত্যের ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করা। তা করতে যদি প্রস্তুত না হও, তবে থাক তোমাদের ধর্ম নিয়ে, কিন্তু মনে রেখ সেজন্য তোমাদেরকে খেসারতও দিতে হবে। কেননা আমি তো আমার সত্য ধর্ম নিয়েই থাকব। আর এটা যেহেতু সার্বজনীন দীন, তাই আমার ও এর অনুসারীদের কর্তব্য বিশ্বব্যাপী এর প্রচার করা এবং যারা তাতে বাধা দেবে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তাতে আল্লাহ তাঁর দীনকে জয়যুক্ত করবেন এবং বিরুদ্ধবাদীদেরকে করবেন পর্যুদস্ত। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত ও জিহাদী কার্যক্রম চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত মক্কা বিজয় হয় এবং যারা বিরুদ্ধাচরণে জিদ ধরে থাকে তারা ধ্বংস হয়। পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কিরামও বিশ্বব্যাপী এ দীনের দাওয়াত ও জিহাদী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আয়াতের আরেক অর্থ হতে পারে তোমাদের কর্মফল তোমাদের ভোগ করতে হবে এবং আমার কর্মফল আমি ভোগ করব। কাজেই যদি আমার দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ না কর তবে তার অশুভ পরিণামের জন্য তোমরা প্রস্তুত থাক। তা দুনিয়ায়ও ভোগ করতে হতে পারে আর আখিরাতে তো অবশ্যই। সুতরাং ‘যার ধর্ম তার’ বা ‘ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ নিয়ে দাওয়াতদাতা, আলেম-উলামা বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই’ এ জাতীয় বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রসঙ্গে এ আয়াতকে টেনে আনলে নিঃসন্দেহে তা হবে আয়াতটির স্স্পুষ্ট অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ। আল্লাহ তাআলা হেফাজত করুন।
বিস্তারিত জানুন: https://muslimbangla.com/article/1006
আন্তঃধর্ম সংলাপ ও ধর্মসমীপতা বিষয়ে ড. ইউসুফ আল-কারজাবি (রহ.)-এর ব্যাখ্যা
আমাকে ইউরোপে বসবাসরত কিছু মুসলিম ভাই প্রশ্ন করেছিলেন:
“ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে ‘ধর্মসমীপতা’ বা ‘ধর্মীয় ঐক্য’ কতটুকু সম্ভব? এ ধরনের উদ্যোগ কি শরিয়তসম্মত? আমরা শুনেছি, কিছু আল-আযহার শরীফের শায়খও এতে অংশ নিয়েছেন দয়া করে বিষয়টি স্পষ্ট করুন।”
আমি আল্লাহর প্রশংসা করে উত্তর দিয়েছিলাম:
এই ‘ধর্মসমীপতা’ বা *التقريب بين الأديان* (তাকরীব বাইনাল আদইয়ান) এমন একটি শব্দ, যার একাধিক অর্থ ও ধারণা আছে—
এর কিছু অর্থ সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য, আর কিছু অর্থ গ্রহণযোগ্য ও শরীয়ত-সঙ্গত।
যে “ধর্মসমীপতা” বলতে বোঝানো হয়—
বিভিন্ন ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্যগুলোকে গলিয়ে ফেলা বা মুছে ফেলা,
যেমন ইসলামের তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং খ্রিষ্টধর্মের ত্রীত্ববাদ (ত্রিত্ববাদ / تثليث) এর মধ্যে পার্থক্য বিলোপ করা,
অথবা ইসলামে তাঞ্জীহ (আল্লাহকে সব অপূর্ণতা থেকে পবিত্র ঘোষণা) আর ইহুদীদের মধ্যে প্রচলিত তাশবীহ (আল্লাহকে মানুষের গুণে তুলনা করা) — এই মৌলিক পার্থক্যগুলো উপেক্ষা করা এ ধরনের “ঐক্য” বা “ধর্মসমীপতা” সম্পূর্ণরূপে **বাতিল ও শরীয়তবিরোধী।
এর ফলেই দেখা যায়, খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা (আ.)-কে ঈশ্বর, ঈশ্বরের পুত্র, অথবা ত্রিত্বের অংশ হিসেবে বিশ্বাস করে, অন্যদিকে মুসলমানরা ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর এক মহৎ রাসূল ও ‘উলুল আজম’ নবী মনে করে।
আল্লাহ তাঁকে ইনজিল প্রদান করেছেন, তাঁকে অলৌকিক নিদর্শন দ্বারা শক্তিশালী করেছেন, এবং তাঁকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ করেছেন।
কুরআনে এমন অনেক অলৌকিক ঘটনা উল্লেখ আছে যা ইনজিলে নেই,
যেমন, মাটির পাখিকে প্রাণ দেওয়া, এবং আসমান থেকে মাওয়িদা (খাবারের টেবিল) অবতীর্ণ হওয়া,
যার নামেই একটি সূরার নামকরণ হয়েছে সূরা আল-মায়িদাহ।
তবুও ঈসা (আ.) কেবল একজন মানব-প্রেরিত রাসূল ছিলেন—যিনি মানুষকে নিজের উপাসনা নয়, আল্লাহর উপাসনা করতে আহ্বান করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “المسيح لن يستنكف أن يكون عبدًا لله ولا الملائكة المقربون” “মসীহ (ঈসা) আল্লাহর বান্দা হতে লজ্জা পাননি, আর নিকটবর্তী ফেরেশতাগণও নয়।” (সূরা আন-নিসা ১৭২)
আরও বলেন: “ما المسيح ابن مريم إلا رسول قد خلت من قبله الرسل وأمه صديقة كانا يأكلان الطعام” “মারইয়ামের পুত্র মসীহ তো কেবল একজন রাসূল, তাঁর আগে বহু রাসূল অতীত হয়েছেন। তাঁর মা ছিলেন সত্যনিষ্ঠা; তারা উভয়েই আহার করতেন।” (সূরা আল-মায়িদাহ ৭৫)
যে খাদ্য গ্রহণ করে, সে তো নির্গমনও করে তাহলে সে কীভাবে ঈশ্বর হতে পারে?
কুরআন আরও বলেন:
“يا أهل الكتاب لا تغلوا في دينكم ولا تقولوا على الله إلا الحق، إنما المسيح عيسى بن مريم رسول الله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه، فآمنوا بالله ورسله ولا تقولوا ثلاثة انتهوا خيرًا لكم، إنما الله إله واحد.” (সূরা আন-নিসা ১৭১)
অতএব, ইসলামের সঙ্গে অন্য ধর্মের এই মৌলিক পার্থক্যগুলো মুছে ফেলার কোনো প্রচেষ্টা শরীয়তসম্মত নয়, বরং তা নিন্দনীয়।
মুসলমানদের কিতাব কুরআন আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংরক্ষিত:
“إنا نحن نزلنا الذكر وإنا له لحافظون” (সূরা আল-হিজর ৯)
অন্যদিকে তাওরাত ও ইনজিলের পরিবর্তন ও বিকৃতি প্রমাণিত সত্য—
শুধু মুসলিম আলেম নয়, বরং আধুনিক যুগের বহু ইহুদি-খ্রিষ্টান গবেষকরাও তা স্বীকার করেছেন।
তাদের কিতাবে এমন বিকৃতি হয়েছে, যাতে আল্লাহর সত্তার প্রতি অশোভন বর্ণনা,
যেমন—অজ্ঞতা, দুর্বলতা, হিংসা, অনুতাপ ইত্যাদি আরোপ করা হয়েছে (বিশেষত *সফরুত তাকওয়ীন / Genesis-এ)।
কিন্তু আমরা আল্লাহকে সর্বপ্রকার অপূর্ণতা থেকে পবিত্র বলে স্বীকার করি। তারা নবীদের সম্পর্কেও অনুপযুক্ত ও নিন্দনীয় বর্ণনা দিয়েছে, কিন্তু ইসলাম নবীদের অপরাধ-পাপ থেকে পবিত্রতা (عصمة الأنبياء) তে বিশ্বাস করে।
অতএব, যে কোনো “ধর্মসমীপতা” যদি মূল আকীদা, ইবাদত বা শরীয়তের বিধানে ছাড় দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে হয়, তবে তা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য ও হারাম।
ধর্মসমীপতার গ্রহণযোগ্য অর্থ: তবে “ধর্মসমীপতা” বা বরং “আন্তঃধর্ম সংলাপ (الحوار بين الأديان)”-এর একটি গ্রহণযোগ্য রূপ আছে, যেখানে উদ্দেশ্য হবে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা, এবং কিছু যৌথ মানবিক লক্ষ্য নিয়ে সহযোগিতা করা।
ড. কারজাবি বলেন, সংলাপ হোক “সুন্দর ও উত্তম পদ্ধতিতে:
আল্লাহ বলেন:
“ادعُ إلى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة وجادلهم بالتي هي أحسن” (সূরা আন-নাহল ১২৫)
অর্থাৎ, ইসলামে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিতর্ক বা আলোচনা করতে হলে “যে পদ্ধতি উত্তম, তার চেয়েও উত্তমভাবে” করতে হবে, শালীনতা, যুক্তি ও দয়ার সঙ্গে। এবং বলা হয়েছে:
“ولا تجادلوا أهل الكتاب إلا بالتي هي أحسن إلا الذين ظلموا منهم” (সূরা আল-আনকাবুত ৪৬)
পারস্পরিক মিল-সাদৃশ্যের উপর জোর দেওয়া:
“وقولوا آمنا بالذي أنزل إلينا وأنزل إليكم وإلهنا وإلهكم واحد ونحن له مسلمون.” (সূরা আল-আনকাবুত ৪৬-এর অংশ)
অর্থাৎ, বিতর্ক নয়—বরং সাধারণ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে সহযোগিতা করা,
যেমন, ন্যায়, দয়া, সৎচরিত্র, মানবমর্যাদা ইত্যাদি।
নাস্তিকতা, বস্তুবাদ ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ:
ইসলাম চায়, ঈমানদার সমাজ একসঙ্গে দাঁড়াক অবিশ্বাস, লাম্পট্য, ও নৈতিক অবক্ষয় -এর বিরুদ্ধে
যেমন সমকামিতা, উলঙ্গতা, অবৈধ গর্ভপাত, ও পরিবারবিনাশী আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
ড. কারজাবি উদাহরণ দেন:
১৯৯৪ সালের কায়রো জনসংখ্যা সম্মেলন ও ১৯৯৫ সালের বেইজিং নারী সম্মেলনে আল-আযহার, রাবিতা আল-আলাম আল-ইসলামী ও ভ্যাটিকান একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিল পশ্চিমা নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে।
মানবিক ন্যায়বিচার ও নিপীড়িতদের পক্ষে ঐক্য:
ইসলাম শুধু মুসলমানদের নয়, যে কোনো নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলে, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, কসোভো, কাশ্মীর ইত্যাদি মুসলিম অঞ্চলসহ সকল নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
রাসূলুল্লাহ ﷺ “হিলফুল ফুযূল”-এর প্রশংসা করেছিলেন, যা জাহিলিয়াত যুগে অবিচার রোধের জন্য গঠিত হয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন:
“لو دعيت إلى مثله في الإسلام لأجبت” “ইসলামে যদি এমন কোনো চুক্তির আহ্বান জানানো হয়, আমি তাতে সাড়া দেব।”
পারস্পরিক আচরণে দয়া ও সহমর্মিতা:
আল্লাহ বলেন:
“وما أرسلناك إلا رحمة للعالمين” (সূরা আল-আম্বিয়া ১০৭)
নবী ﷺ বলেছেন:
“إنما أنا رحمة مهداة” “আমি তো দয়ার উপহার।”
“إن الله يحب الرفق في الأمر كله” “আল্লাহ সব কাজে কোমলতা পছন্দ করেন।”
তিনি এমনকি একবার এক ইহুদি মৃতদেহের জানাজা দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।
সাহাবাগণ বললেন, “ইহুদির জানাজা?”
তিনি উত্তর দিলেন:
“أليست نفساً؟” — “সে কি মানুষ নয়?”
https://www.al-qaradawi.net/node/3568
https://darululoom-deoband.com/arabicarticles/archives/2960
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা
লেখক ও গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন