আযানের ভিতরে আল্লাহ শব্দে কতটুকু টান হবে জানতে চাই
প্রশ্নঃ ১১৪৯১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আযান এর ভিতরে আল্লাহ্ শব্দে কতটুকু টান হবে জানতে চাই।
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই!
আজান ইসলামের অন্যতম মহিমান্বিত নিদর্শন, এটি একদিকে নামাজের সময় ঘোষণা, অন্যদিকে তাওহিদের জ্বালাময়ী আহ্বান। রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুগ থেকে আজান মুসলিম সমাজের পরিচয় ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে আছে। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে এই পবিত্র ইবাদতটি নিয়ে দুটি বিপরীতমুখী চরম প্রবণতা গড়ে উঠেছে একটি বাড়াবাড়ি, অন্যটি ছাড়াছাড়ি।
এক শ্রেণি আজানের সৌন্দর্যের নামে অতিরিক্ত টান, কৃত্রিম সুর ও নাটকীয়তা যুক্ত করে একে তার স্বাভাবিক সরলতা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। কখনো কখনো এতে শব্দের শুদ্ধতা ও অর্থগত ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। অপরদিকে, আরেক শ্রেণি সব ধরনের সুর, স্বাভাবিক টান কিংবা কণ্ঠসৌন্দর্যকেই একেবারে অগ্রহণযোগ্য মনে করে, ফলে আজান শুষ্ক, রুক্ষ ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে যা আজানের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ আহ্বান ও ঘোষণা, তা পূর্ণভাবে প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়।
এই দুই চরমতার মাঝখানে রয়েছে সুন্নাহর পথ যেখানে আছে গাম্ভীর্য, শুদ্ধ উচ্চারণ ও সংযত সৌন্দর্য। আজান না তো প্রদর্শনীর বিষয়, না আবার নিছক যান্ত্রিক উচ্চারণ; বরং এটি ইবাদত ও ইলানের এমন এক সংমিশ্রণ, যা ভারসাম্য ও আদব রক্ষা করেই আদায় করা আবশ্যক।
আজানে "আল্লাহ" শব্দে কতটুকু টান হবে?
বিষয়টি বুঝার জন্য "আল্লাহ" শব্দের মদ্দ বুঝতে হবে।
মদ্দ দুই প্রকার। (১) আসলী। (২) আরযি।
মদ্দে আসলী হলো, এমন স্বাভাবিক টান, যা নিজে নিজেই হয়।
এটি পড়তে কোনো বিশেষ কারণ লাগে না। যেখানে আলিফ, ওয়াও বা ইয়ায়ের কারণে শব্দে টান আসে,
সেখানেই মদ্দে আসলী হবে।
মদ্দে আরযি হলো, এমন টান, যা থামার কারণে হয়।
যখন কোনো শব্দের শেষে থেমে পড়া হয়, তখন শেষ হরফে সুকুন আসে,
এই সুকুনের কারণেই টান বাড়ে।
এটাই মদ্দে আরযি।
‘আল্লাহ’ শব্দে যে মদ (مد) রয়েছে, তা মদ্দে আসলী। এর পরিমাণ হারাকাত হিসেবে এক আলিফের সমান। সুতরাং কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও কিরাআতের সময় (চাই তা নামাজের ভেতরে হোক বা বাহিরে) এক আলিফের চেয়ে অধিক টান দেওয়া সম্পূর্ণরূপে কিরাআতের নিয়মবিরুদ্ধ এবং নিষিদ্ধ।
তবে কুরআনের বাইরে বিশেষ করে আজানের বাক্যসমূহে মদ্দে আসলীর পরিমাণ কিছুটা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে; যাতে এর মাধ্যমে আল্লাহর মহিমা ও মর্যাদা আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় এবং ঘোষণা ও আহ্বানের উদ্দেশ্য সর্বোচ্চভাবে পূর্ণতা লাভ করে। এর শক্ত প্রমাণ ও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এই যে, আরবদের মধ্যে যিকর, দোয়া এবং সাহায্য প্রার্থনার সময় ‘মদ্দে মাআনাবী’ ব্যবহারের কথা তাজবিদ ও সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মদ্দকে তার মূল পরিমাণের চেয়ে বেশি টেনে পড়া শরীয়তসম্মত ও বৈধ।
এক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হলো, তাজবিদের কিতাবসমূহে যেসব নিয়ম-কানুন বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো মূলত কেবল কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত ও কিরাআতের আদব ও পদ্ধতির সঙ্গেই সম্পর্কিত। অতএব কুরআন মাজীদের ক্ষেত্রে এসব নিয়মের পূর্ণ অনুসরণ করা অত্যন্ত অপরিহার্য। কিন্তু কুরআনের বাইরে এসব নিয়ম সরাসরি নির্ধারিত ও সুস্পষ্ট নয়; বরং কুরআনের শব্দসমূহের ওপর কিয়াস করে কুরআনের বাইরের শব্দগুলোর ক্ষেত্রেও এ সম্পর্কিত বিধান নির্ণয় করা যায়।
সুতরাং কিরাআতের বিভিন্ন মাসআলা ও মূলনীতির ওপর কিয়াস করে অধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী মদের (আল্লাহ শব্দে) সর্বোচ্চ পরিমাণ পাঁচ আলিফ পর্যন্ত হতে পারে।
কোন কোন ক্বারী সাত আলিফ টেনে আজান দেয়াকে জায়েজ বলেছেন। যেমনটি নকল করেছেন, ক্বারী ফাতাহ মুহাম্মদ সাহেব "মিফতাহুল কামাল শরহে তুহফাতুল আতফালে" পৃ.৬৬, মীর মুহাম্মদ কুতুবখানা।
সুতরাং ৫-৭ আলিফের অতিরিক্ত টানা অনুত্তম। তবে অশুদ্ধ আজান দেয়ার অনুমতি শরীয়ত কর্তৃক অনুমদিত নয়। (মাকরুহ)।
উস্তাজুল উলামা, শায়খুল হাদীস, আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. তার কিতাব "আদাবে আযান ওয়া ইকামত" বইয়ের ৪৬ থেকে ৪৯ নং পৃ. (দারুল ইশাআত) এই বিষয়ে চমৎকার সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, (সংক্ষেপে) তিন আলিফ পরিমাণ টানা উত্তম। সাত আলিফ পর্যন্ত টানা জায়েজ। এর অতিরিক্ত টানা নাজায়েজ। এক আলিফ টানার পরিমাণ হলো, বন্ধ আঙ্গুল খোলা / খোলা আঙ্গুল বন্ধ করার পরিমাণ সময়। সুতরাং কিছু কিছু মুয়াজ্জিন শ্বাস পড়া পর্যন্ত টানাটা নাজায়েজ।
সুতরাং উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায়, আজানে "আল্লাহ" শব্দে টানাকে বিদআত বলা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়।
শরঈ দলীলঃ
الاتقان فی علوم القرآن :
"وأمّا السبب المعنوي فھو قصد المبالغة في النفي ، وھو سبب قوي مقصود عند العرب وھذا مذھب معروف عند العرب ؛ لأنّھا تمد عند الدعاء و عند الاستغاثة وعند المبالغة في نفي شيءٍ."
(الاتقان في علوم القرآن ، النوع الثاني والثلاثون ، في المد والقصر ،ج:1،ص:97، ط: مصطفی البابی مصر)
کتاب النشر فی القرا ءت العشر :
"واستحب العلماء المحققون مد الصوت بلا إلٰه إلاَّ اللّٰہ إشعاراً بما ذکرنا وبغیرہ ، قال الشیخ محي الدین النووي رحمه اللّٰہ في الأذکار : ولھٰذا کان المذھب الصحیح المختار استحباب مد الذاکر قوله : ’’ لاإلٰه إلاَّ اللّٰہ ‘‘ ؛ لما ورد من التدبر … قال : وأقوال السلف وأئمة الخلف في مد هذا مشھورۃ. "
(النشر في القراءات العشر ، باب المد والقصر ، فصل ،ج:1،ص:269،ط: دار الکتب العلمیة بیروت)
کتاب النشرفي القراء ات العشر ‘‘ :
"والمرتبة الخامسة فوقھا ( أي فوق الرابعة ) قلیلاً، وقدرت بخمس ألفات."
( النشر في القراء ات العشر ، باب المد والقصر ،ج:1،ص:254،ط: دار الکتب العلمیة بیروت )
البحر الرائق :
"ویترسل فیه ویحدر فیھا، وفسر الترسل في’’ الفوائد‘‘ بإطالة کلمات الأذان ، والحدر قصرھا، ولأنّ المقصود من الأذان الإعلام والترسل بحاله ألیق."
(البحر الرائق، کتاب الصلاۃ ، باب الأذان ، ج:1،ص:257، ط: سعید کراچی)
فتاوی شامی:
"(ولا لحن فيه) أي تغني بغير كلماته فإنه لا يحل فعله وسماعه كالتغني بالقرآن وبلا تغيير حسن، وقيل لا بأس به في الحيعلتين(قوله: بغير كلماته) أي بزيادة حركة أو حرف أو مد أو غيرها في الأوائل والأواخر قهستاني.(قوله: وبلا تغيير حسن) أي والتغني بلا تغيير حسن، فإن تحسين الصوت مطلوب، ولا تلازم بينهما بحر وفتح.(قوله: وقيل) أي قال الحلواني: لا بأس بإدخال المد في الحيعلتين؛ لأنهما غير ذكر، وتعبيره بلا بأس يدل على أن الأولى عدمه."
(کتاب الصلاۃ ،باب اذان،ج:1،ص:387،ط:سعید)
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা
লেখক ও গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন