আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১৪- বৃষ্টি প্রার্থনার অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১০৩১
৬৫৬. ইসতিসকায় ইমামের হাত উঠানো।
৯৭৪। মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) ইসতিসকা ব্যতীত অন্য কোথাও দুআর মধ্যে হাত উঠাতেন না।* তিনি হাত এতটা উপরে উঠাতেন যে, তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখা যেত।

*ইসতিসকা ছাড়া অন্যান্য স্থানে নবী (ﷺ) হাত উঠিয়ে দু'আ করতেন, সহীহ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। এ স্থলে হাত উঠাতেন না দ্বারা বেশী উর্ধ্বে হাত উঠাতেন না বুঝানো হয়েছে। এ ছাড়া আনাস (রাযিঃ) এর অজানা থাকা অন্যদের অজানাকে আবশ্যক করে না।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বিতরের তৃতীয় রাকাতে কুনূত পড়ার পূর্বে তাকবীর বলা ও হাত উত্তোলন করে হাত বাঁধা সুন্নাত,তাকবীর দিয়ে পুনরায় হাত বাঁধার এ নিয়ম সুন্নাহ সম্মত।

তাকবীর দিয়ে হাত উঠানো ও হাত বাঁধার দলিলঃ

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বিতর নামাযের শেষ রাকাতে কুনূতের জন্য তাকবীর বলে হাত উঠাতেন। এ বিষয়ে ইবনে মাসউদ রা. থেকে বিশুদ্ধসূত্র্রে একাধিক বর্ণনা হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে এসেছে। ইমাম বুখারী একে সহীহ বলেছেন। [দেখুন- জুয্উ রাফইল ইয়াদাইন- ইমাম বুখারী পৃ.১৪৬ হা. ১৬৩ ইমাম বুখারী এর সনদকে সহীহ বলেছেন। ( ) মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/৫৩০ হা. ৭০২৭-২৮]

অনুরূপ তাবেয়ী ইবরাহীম নাখাঈ থেকেও সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। [দেখুন- মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/৫৩১ হা.৭০২৬, মুছান্নাফে আব্দুর রায্যাক হা.৫০০১, কিতাবুল আসার, মুহাম্মদ রহ. এর বর্ণনা পৃ.২০৭, আবু ইউসুফ রহ. এর বর্ণনা ৬৬, কিতাবুল হুজ্জা আলা-আহলিল মদীনা, পৃ.৫৬ শারহু মাআনিল আসার ১/৩৯১]

এ ছাড়া মারওয়াযী তাঁর ‘কিয়ামুল লায়ল’ গ্রন্থে [পৃ.২৯৪] হযরত উমর, আলী ও বারা ইবনে আযিব রা. থেকেও তাকবীরের কথা উল্লেখ করেছেন।( )

হযরত সুফয়ান সাউরী রহ. তাঁর পূর্বসুরী তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের থেকেও কুনূতের শুরুতে তাকবীরের কথা বর্ণনা করেছেন। [মুখাতাছারু কিয়ামিল লাইল, ২৯৪, ২৯৬] ইমাম আহমদ রহ. বলেন, রুকুর পূর্বে যদি কুনূত পড়া হয় তাহলে তাকবীর দিয়ে কুনূত শুরু করবে। [মুখাতাছারু কিয়ামিল লাইল, ইবনে নছর মারওয়াযী, ২৯৪]

কিছু আপত্তি ও তার পর্যালোচনাঃ (দলিলসহ নামাযের মাসায়েল থেকে )

অতঃপর গ্রন্থকার ইবনে মাসউদ রা. এর হাদীসটি সম্পর্কে বন্তব্য করেছেন যে, “বর্ণনাটি ভিত্তিহীন। আলবানী (রহঃ) বলেন, لم أقف على سند عند الأثرم، لأنني لم أقف على كتابه ... وغالب الظن أنه لا يصح - আছরামের সনদ সম্পর্কে অবগত নই। এমনকি তার কিতাব সম্পর্কেও অবগত নই। ... আমার একান্ত ধারণা, এই বর্ণনা সঠিক নয়।” (অর্থাৎ ১. আসরাম বর্ণিত এ হাদীসের সনদ পাওয়া যায়নি কেননা কিতাবটিই তিনি পাননি ২. তিনি ধারণা করলেন এটি সহীহ নয়)

পর্যালোচনা
১.ভুল তরজমা

তিনি লেখেছেন: “এমনকি তার কিতাব সম্পর্কেও অবগত নই ” এটি আলবানী সাহেবের বক্তব্যের ভুল তরজমা। বিশুদ্ধ তরজমা হল- ‘কেননা আমি তার কিতাবের সন্ধান পাইনি’।

২. নিজের থেকে সনদবিহীন হাদীস উল্লেখ করে তাকে যঈফ সাব্যস্ত করা?

ক. নবীজীর নামায ও দলিলসহ নামাযের মাসায়েল বই দুটি গ্রন্থকারের সামনে রয়েছে। আর দুটি বইতেই হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) এর বর্ণনাটি উদ্ধৃত হয়েছে মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ও শরহু মুশকিলিল আসার গ্রন্থদ্বয়ের বরাতে। এর সনদ সহীহ। কিন্তু আফসোসের কথা, গ্রন্থকার সহীহ সনদ বিশিষ্ট বর্ণনাটি না এনে আলবানী সাহেবের কিতাব থেকে আসামের বর্ণনা উল্লেখ করলেন- যে কিতাবটি পাওয়া যায় না। তারপর বর্ণনাটিকে সহীহ নয় বলে তার বক্তব্যকে প্রমাণ করে দিলেন!

খ. আলবানী সাহেবের ‘ইরওয়াউল গালিল’ কিতাবের যে পৃষ্ঠা থেকে (২/১৬৯) গ্রন্থকার এ তাহক্বীকটি পেশ করেছেন সেখানেই আলবানী সাহেব বলেছেন, এটি ইবনে আবী শাইবা, তাবারানী ও বাইহাকীর বর্ণনায়ও এসেছে। কিন্তু তিনি তাহক্বীক করতে যেয়ে উক্ত হাদীস গ্রন্থ সমূহ ও সেগুলির সনদের প্রতি কোন ইঙ্গিতও দেননি।

গ. গ্রন্থকার নিজেও পূর্বের টীকায় ইবনে আবী শাইবা (হা.৭০২১-৭০২৫) ও আব্দুর রাযযাকের (হা.৫০০১) বরাত উল্লেখ করেছেন। তার টীকায় হা. ৭০২১-৭০২৫ পর্যন্ত ইবনে মাসউদ রা., ইবরাহীম নাখায়ী, হাকাম, হাম্মাদ ও আবু ইসহাক থেকে মোট ছটি বর্ণনার বরাত দিয়েছেন। কিন্তু তাহক্বীকের সময় কেবল আসরামের বর্ণনা সম্পর্কিত আলবানীর বক্তব্য উল্লেখ করে ক্ষান্ত রইলেন। আর এ ছটি বর্ণনা সম্পর্কে কিছুই বললেন না। আবার তিনি ইবনে মাসউদ রা. এর বর্ণনা সম্পর্কে টীকায় দ্বিতীয় নাম্বারে আব্দুর রাযযাকের যে (হা.৫০০১) বরাত উল্লেখ করেছেন, তাতে বর্ণনা আছে ইবরাহীম নাখাঈ থেকে, ইবনে মাসউদ থেকে নয়।

ঘ. ইমাম বুখারী রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর এ বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন। তিনি জুয্উ রাফইল ইয়াদাইন গ্রন্থে (পৃ.১৪৬ হা. ১৬৩) এ বর্ণনাটি এবং অনুরূপ আরো কিছু বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন- (هذه الأحاديث كلها صحيحة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم، لا يخالف بعضها بعضا، وليس فيها تضاد لأنها في مواطن مختلفة،) - ‘এ সব বর্ণনাগুলোই সহীহ ...’। ইমাম তাহাবী রহ. ও হাদীসটিকে সহীহ ধরে নিয়েই দলিল পেশ করেছেন তাঁর ‘শরহু মুশকিলুল আসার’ গ্রন্থে। শায়খ শ‘আইব আরনাউত বলেন- ‘হাদীসটি হাসান, কেবল হুদাইজ ইবনে মুআবিয়া ব্যতীত সকলেই বুখারী মুসলিমের বর্ণনাকারী ...’। [মুশকিলিল আসার ১১/৩৭৪] মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবার সনদটিও ছহীহ লিগাইরিহি বা হাসান। তাছাড়া ইবনে মাসউদ রা. এর শিষ্যদের কাছ থেকেই ইবরাহীম নাখাঈ ইলম শিখেছেন। তিনি এ তরীকাই তাদের থেকে গ্রহণ করেছেন। সুত্ররাং এতে বর্ণনাটি আরো শক্তিশালি হয় বৈকি।

ঙ. আলবানী সাহেবও এ বর্ণনা বিষয়ে দুটি বড় ধরণের আপত্র্তিকর কাজ করেছেন। আর গ্রন্থকার এক্ষেত্রে তার অন্ধ তাকলীদ করেছেন।

● (এক) তিনি আছরামের বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন, এর সনদ তার জানা নেই। কিন্তু যে হাদীসের সনদ সম্পর্কে তিনি জানতে পারেননি, সে সম্পর্কে তার উচিত্র্র্র ছিল- মন্তব্য থেকে বিরত থাকা। অথবা মন্তব্য করলেও সম্ভাবনা ব্যক্ত করে বলা। কিন্তু তিনি বলে দিলেন- “আমার প্রবল ধারণা যে, এটি সহীহ নয়”! তিনি যখন বর্ণনাটি তিনটি কিতাবে একই সনদে পেয়েছেন তখনি তাঁর ধারণা জন্মেছে যে, হয়ত সেখানেও সেই একই সনদ হয়ে থাকবে। আর যে সনদ পাওয়া গেছে সেটি লাইছ ইবনে আবী সুলাইম এর কারণে ‘তার দৃষ্টিতে’ যঈফ, সুত্ররাং তিনি বলে দিলেন সবই যঈফ! কিন্তু তিনি কি করে ভাবলেন যে, আছরামের কিতাবেও এর একই সনদ হবে? অথচ তাঁর হাতের নাগালের কিতাব ‘শরহু মুশকিলিল আসারে’ই এ বর্ণনাটি উক্ত লাইছ ইবনে আবী সুলাইম ব্যতীত ভিন্ন সনদে এসেছে যে সম্পর্কে তার খবরই নেই! তাই এরও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে, আছরামের কিতাবে বর্ণনাটি তৃতীয় কোন সনদেও থাকতে পারে। বা অন্তত মুশকিলুল আসারে যে সহীহ সনদে এসেছে তাও হতে পারে। সুত্ররাং এমন চোখ বুঝে একটি সনদকে যঈফ বলে দেয়া যায় কি?

● (দুই) আলবানী সাহেব ইবনে আবী শাইবায় বর্ণিত হাদীসের বর্ণনাকারী ‘লাইছ ইবনে আবী সুলাইমকে’ যঈফ বলেই বর্ণনাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু লাইছ এর কারণে হাদীসকে যঈফ বলে দেওয়া যায় না।

লাইছ সম্পর্কে হাদীসবিদগণর মতামত নিম্নরূপঃ

লাইছ ইবনে আবী সুলাইম রহ. এর বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কারণ, ইমাম বুখারী সহীহ বুখারীর ‘তালীকাতে’ তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। ইমাম মুসলিম রহ. সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় তাকে আতা ইবনুস সাইব এর মত দ্বিতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারী গণ্য করেছেন। এবং তাকে সত্যবাদিতা, দোষ মুক্ততা ও ইলমে হাদীসের সাথে ঘনিষ্টতার গুণে গুণান্বিত করেছেন। ( )

আবুদাউদ তিরমিযী নাসাঈ ইবনে মাজা চারটি কিতাবেই তাঁর হাদীস রয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহ. বলেন- (صدوق يهم) ‘বিস্বস্ত, কখনো ভুল করে থাকেন’। ইমাম ইবনে আদী রহ. তাঁর বর্ণিত কিছু (মুনকার) আপত্র্তিকর বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন- (لَهُ أَحَادِيْثُ صَالِحَةٌ غَيْرُ مَا ذَكَرتُ، وقد روى عنه شعبة والثوري وَغَيْرُهُمَا مِنَ الثِّقَاتِ، وَمَعَ الضَّعفِ الَّذِي فِيْهِ يُكْتَبُ حَدِيْثُه) : অর্থাৎ ‘এছাড়া তার কিছু ভাল হাদীসও রয়েছে। শোবা, ছাউরী প্রমুখ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর মধ্যে যে দূর্বলতাটুকু রয়েছে তা সত্ত্বেও তার হাদীস লিপিবদ্ধ করা যায়’।

ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন- (وليث وإن كان ضعيف الحفظ فإنه يعتبر به ويستشهد فيعرف أن له من رواية عبد الرحمن بن الأسود عن أبيه أصلا، وقال أيضا: ... وتابع أبا إسحاق على روايته عن عبد الرحمن المذكور ليث بن أبي سليم وحديثه يستشهد به) : ‘অর্থাৎ ‘যদিও লাইছ দূর্বল স্মৃতি শক্তির অধিকারী তবুও অন্য বর্ণনা সহায়ক ও সমর্থক হিসেবে গ্রহণযোগ্য .... ।’ অন্যত বলেন- ‘আব্দুর রহমান থেকে আবু ইসহাকের সমর্থন করেছেন লাইছ। আর তার বর্ণনা সমর্থক হিসেবে উল্লেখযোগ্য। [ফাতহুল বারী- ভূমিকা ৩৪৯, ১/২৫৮]

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন- (قُلْتُ: بَعْضُ الأَئِمَّةِ يُحَسِّنُ لِلَّيْثِ، وَلاَ يَبلُغُ حَدِيْثُه مَرتَبَةَ الحَسَنِ بَلْ عِدَادُه فِي مَرتَبَةِ الضَّعِيْفِ المُقَاربِ، فَيُرْوَى فِي الشَّوَاهِدِ وَالاعْتِبَارِ، وَفِي الرَّغَائِبِ، وَالفَضَائِلِ، أَمَّا فِي الوَاجِبَاتِ، فَلاَ.) : ‘কোন কোন ইমাম লাইছের হাদীসকে হাসান গণ্য করেছেন। কিন্তু তার হাদীস হাসান পর্যায়ের নয়। বরং তা হাসানের নিকটবর্তী যঈফরূপে গণ্য। তাই তা (অন্য বর্ণনার) সহায়ক ও সমর্থকরূপে বর্ণনা করা যাবে। এবং ফযীলতের বিষয়েও বর্ণনা করা যাবে। কিন্তু ওয়াজিব বিধান সাব্যস্ত করতে তা বর্ণনা করা যাবে না’। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/১৭৯]

সুত্ররাং তাঁর বর্ণনা সাধারণ সকল যঈফের মত নয়, বরং হাসানের কাছাকাছি পর্যায়ের। ফযীলতের ক্ষেত্রে তাঁর বর্ণনায় নির্ভর করা যায়। অন্য বর্ণনার সমর্থন পেলেই তা হাসান স্তরে উন্নীত হয়। তখন বিধানের ক্ষেত্রেওতো প্রযোজ্য হবে। একারণে আলবানী সাহেবও ‘সিলসিলতুস্-সহীহা’ গ্রন্থে (হা.৫৮৬) লাইছের একটি বর্ণনাকে সালামা ইবনে ওয়ারদান সূত্র্রে বর্ণিত আরেকটি যঈফ বর্ণনার সমর্থনে হাসান বলেছেন। আলোচ্য হাদীসেও লাইছের বর্ণনার সমর্থনে রয়েছে, তাহাবীর শারহু মুশকিলিল আসারের বর্ণনা। তাই আলবানী সাহেবের যুক্তিতেই একে হাসান বলতে হবে।

লাইছ রহ. এর স্মৃতিশক্তির দূর্বলতা কখন থেকে

লাইছের যঈফ হওয়ার মূল কারণ ইঙ্গিত করে ইমাম ইবনে হিব্বান রহ. বলেন- (اخْتُلِطَ فِي آخِرِ عُمُرِهِ، ... كُلُّ ذَلِكَ كَانَ مِنْهُ فِي اخْتِلاَطِه.) : অর্থাৎ ‘শেষ বয়সে তার ইখতিলাত- স্মৃতি শক্তির মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল’। আর এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন লাইছ থেকে দুজন নির্ভরযোগ্য রাবী। আব্দুস সালাম ইবনে হারব ও যায়েদা ইবনে কুদামা। তন্মধ্যে যায়েদা একদিকে লাইছের এলাকার লোক এবং তার পবীণ শিষ্য। আবার তার স্বভাব ছিল কারো কাছ থেকে হাদীস নেয়ার সময় এবং তা বর্ণনা করার সময় ভাল রকম যাচাই-বাছাই করা। এ কারণেই ইমাম আহমদ বলেন- ‘যায়েদা ও যুহাইর থেকে কোন হাদীস শুনলে, তা আর কারো কাছ থেকে না শুনলেও কোন সমস্যা নেই। তবে আবু ইসহাকের হাদীস ব্যতীত’। তিনি আরো বলেন- ‘চারজন বর্ণনাকারী হলেন, মুতাসাব্বিত [নির্ভুল বর্ণনাকারী] সুফইয়ান, শুবা, যুহাইর ও যায়েদা। [সিয়ারু আলামিন নুবালা] তিনি আরো বলেন- ‘যায়েদা কোন হাদীস বর্ণনাকালে ইত্কান তথা দৃঢ়তা ও যতেœর সাথে করতেন’। একবার এক উপলক্ষে সুফইয়ান যায়েদাকে বললেন- ‘নিশ্চয় আপনি সিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য এবং সিকাহ বর্ণনাকারী থেকেই আমাদেরকে হাদীস শুনিয়ে থাকেন ...’। (যায়েদা এতে মৌন সমর্থন ব্যক্ত করলেন)। [ইলাল]।

সুত্ররাং যায়েদা ইবনে কুদামা হলেন লাইছের যে বর্ণনা গ্রহণ করেছেন তা হয়ত তার ইখতিলাত তথা স্মৃতিশক্তি দূর্বল হওয়ার আগের, অথবা পরের হলেও তা ছিল নির্ভুল। আব্দুস সালামও লাইছ থেকে একই হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুত্ররাং এ বর্ণনায় লাইসের কোন ভুল হয়নি। সম্ভবত একারণেই ইমাম বুখারী রহ. যায়েদা সূত্র্রে লাইছের এ বর্ণনাটিকে স্পষ্ট ভাষায় সহীহ বলে দিয়েছেন।

চ. গ্রন্থকার আলবানী সাহেবের এমন দলিলবিহীন ও অনুমান নির্ভর হুকুমের অন্ধ তাকলীদই করেছেন। তার মাথায় এতটুকু কথাও আসেনি যে, আছরামের সনদকে তিনি কিভাবে যঈফ বলছেন অথচ তিনি তা দেখেনইনি।

গ্রন্থকার - ২৯
বাতিল কথার পুনরাবৃত্তি!

গ্রন্থকার বলেন- “আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার মধ্যে পুনরায় হাত বেঁধে কুনূত পড়ার কথা নেই। এ মর্মে কোন দলীলও নেই। অথচ এটাই সমাজে চলছে। বরং এটাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে।”

পর্যালোচনা

এক. ‘হাত বেঁধে’ কুনূত পড়াকে ওয়াজিব বলা হয়নি। বরং শুধু কুনূত পড়াকেই ওয়াজিব বলা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের ফিকহের কিতাবে যা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তাই এখানে গ্রন্থকার নিজে ভুল বুঝে অন্যের উপরে দোষ চাপ্রিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এটা তার অন্যায় আপত্র্তি।

দুই. “এ মর্মে কোন দলীলও নেই।” একথা দ্বারা গ্রন্থকার কি ধরণের দলিল চান? নবীজীর বক্তব্য বা আমল, সাহাবী বা তাবেয়ীর ফতোয়া বা আমল, না কোন ইমামের কথা বা আমল? গ্রন্থকার তার বইয়ে কুনূত পড়ার ছহীহ নিয়মের যে দলিল দিয়েছেন তাতে পাওয়া গেছে শুধু ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়ার আমল বা কর্ম (দেখুন-পৃ.৩৩৬ টীকা-১৩০৪, ইরওয়াউল গালীল ২/৭১)। এ থেকে তো বুঝা যায় কোন ইমামের কথা বা আমল পাওয়া গেলেই ছহিহ দলিল হয়ে যায়।

তাই যদি হয় তাহলে হাত বেঁধে কুনূত পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে মহান ফকীহ তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী (মৃ.৯৬ হি.) থেকে। যিনি মূলত ইলম শিখেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর পধান শিষ্যদের কাছ থেকে। সুত্ররাং এটা সুস্পষ্ট যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে তাকবীর বলা ও হাত উঠানোর যে সহীহ বর্ণনা রয়েছে এরই বাস্তবরূপ ও সহীহ ব্যাখ্যা হল ইবরাহীম নাখাঈর কথা ও আমল। কারণ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর পধান ফকীহ শিষ্য হলেন আলকামা। আলকামার পধান ফকীহ শিষ্য হলেন ইবরাহীম নাখাঈ। [সিয়ারু আলামিন নুবালা] তাই এটি নিঃসন্দেহে গ্রন্থকারের দলিলের চেয়ে বহু গুণে শক্তিশালী। [দেখুন- কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদীনা, ইমাম মুহাম্মদ পৃ. ২০০ (পৃ.৫৫ পুরাতন ছাপা) কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মদের বর্ণনা পৃ.২০৭]

তিন. গ্রন্থকারের উপরিউক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বরং ইমাম আবু হানীফার (মৃত.১৫০ হি.) ফতোয়া ও আমলই এ বিষয়ে দলিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেননা ইসহাক ইবনে রাহুইয়া (মৃত.২৩৮ হি.)-এর আমল এর চেয়ে তার আমলের গুরুত্ব অবশ্যই বেশি। আবু হানীফা রহ. ছিলেন তাবেঈ। আবার তিনি সাহাবীদের থেকে সরাসরি শিক্ষাপ্রাপ্ত বহু বড় বড় তাবেঈ থেকেই নামায শিখেছেন। যে সুযোগ ইসহাক ইবনে রাহুয়া রহ. এর হয়নি।

চার. গ্রন্থকার বলেন- “আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার মধ্যে পুনরায় হাত বেঁধে কুনূত পড়ার কথা নেই। ” আমি বলব এ বর্ণনা দ্বারা যদি এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, কুনূতের শুরুতে তাকবীর বলবে আর হাত উঠাবে তাতেই যথেষ্ট। কেননা কুনূত পড়ার সময় হাত কিভাবে থাকবে বিষয়টি গ্রন্থকার নিজেই ‘কুনূত পড়ার ছহীহ নিয়ম’ শিরোনামে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন- (পৃ.৩৩৬) “শেষ রাক‘আতে হাত বাঁধা অবস্থায় দু‘আয়ে কুনূত পড়া”। ব্যস, কুনূত পড়ার আগে তাকবীর বলা ও হাত উঠানোর দলিলতো আছেই। এখন কুনূত পড়ার সময় হাত বেঁধে রাখার দলিল কি তা গ্রন্থকার বলুন! আমরাত ইবরাহীম নাখাঈর আছার উল্লেখ করেছি।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন