আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

১- ঈমানের অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১৩
আন্তর্জাতিক নং: ১৬৪-১
৭৩. রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর মি’রাজ এবং নামায ফরয হওয়া
৩১৩। মুহাম্মাদ ইবনু মুসান্না (রাহঃ) ......... আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাবী বলেন, আনাস (রাযিঃ) সম্ভবত তার সম্প্রদায়ের জনৈক মালিক ইবনু সা’সাআ (রাযিঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নবী (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ একদা আমি কাবা শরীফের কাছে নিদ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম। তখন তিন ব্যক্তির মধ্যবতী একজনকে কথা বলতে শুনতে পেলাম। যাহোক তিনি আমার কাছে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। তারপর আমার কাছে একটি স্বর্ণের পাত্র আনা হল, তাতে যমযমের পানি ছিল। এরপর তিনি আমার বক্ষ এখান থেকে ওখান পর্যন্ত বিদীর্ন করলেন। বর্ণনাকারী কাতাদা (রাযিঃ) বলেন, আমি আমার পার্শ্বস্থ একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখান থেকে ওখান পর্যন্ত বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন?

তিনি জবাব দিলেন, “বক্ষ থেকে পেটের নীচ পর্যন্ত”। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ এরপর আমার হৃৎপিণ্ডটি বের করা হল এবং যমযমের পানি দিয়ে তা ধৌত করে পূনরায় যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হল। ঈমান ও হিকমতে আমার হৃদয় পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এরপর আমার কাছে ‘বুরাক’- নামের একটি সাদা জন্তু উপস্থিত করা হয়। এটি গাধা থেকে কিছু বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট। যতদুর দৃষ্টি যায় একেক পদক্ষেপে সে ততদূর চলে। এর উপর আমাকে আরোহণ করান হল। আমরা চললাম এবং দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত পৌছলাম। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) দরজা খুলতে বললেন। বলা হল, কে? তিনি বললেন, জিবরীল। বলা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, আমার সাথে মুহাম্মাদ আছেন। দ্বাররক্ষী বললেন, তাঁর কাছে আপনাকে পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর দরজা খুলে দিলেন এবং বললেন, মারহাবা! কত সম্মানিত আগন্তুকের আগমন হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তারপর আমরা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর কাছে আসলাম ......... এভাবে বর্ণনাকারী পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন। তবে এ রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) দ্বিতীয় আসমানে ঈসা ও ইয়াহয়া, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতূর্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারুন (আলাইহিমুস সালাম) এর সাথে সাক্ষাত করেছেন। রাসুলাল্লাহ(ﷺ) বলেনঃ তারপর আমরা ষষ্ঠ আসমানে গিয়ে পৌছি এবং মুসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে গিয়ে তাঁকে সালাম দেই। তিনি বললেন, মারহাবা, হে সুযোগ্য নবী, সুযোগ্য ভ্রাতা! এরপর আমরা ডাঁকে অতিক্রম করে চলে গেলে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আওয়াজ এল, আপনি কেন কাঁদছেন? তিনি জবাব দিলেন, প্রভু, এ বালককে আপনি আমার পরে পাঠিয়েছেন; অথচ আমার উম্মাত অপেক্ষা তাঁর উম্মাত অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ আমরা আবার চললাম এবং সপ্তম আসমানে গিয়ে পৌছলাম ও ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এর কাছে আসলাম। সাহাবী তাঁর এ হাদীসে আরো উল্লেখ করেন যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) আরও বলেছেনঃ সেখানে তিনি চারটি নহর দেখেছেন। তন্মধ্যে দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য। সবগুলোই সিদরাতূল মুনতাহার গোড়া হতে প্রবাহিত। নবী (ﷺ) বলেনঃ আমি বললাম, হে জিবরীল! এ নহর গুলো কি? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য নহরদ্বয় তো জান্নাতের নহর আর প্রকাশ্যগুলো নীল ও ফূরাত। অর্থাৎ এ দুটি নহরের সা’দূশ্য রয়েছে জান্নাতের ঐ দুটি নহরের সাথে।

এরপর আমাকে বায়তুল মামুরে উঠান হল। বললামঃ হে জিবরীল! এ কি? তিনি বললেন, এ হচ্ছে ‘বায়তুল মামুর’। প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার ফিরিশতা (তাওয়াফের জন্য) প্রবেশ করে। তারা একবার তাওয়াফ সেরে বের হলে কখনও আর ফের তাওয়াফের সুযোগ হয় না তাদের। তারপর আমার সম্মুখে দূটি পাত্র পেশ করা হলো, একটি শরাবের, অপরটি দুধের। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনি ঠিক করেছেন। আল্লাহ আপনার উম্মাতকেও আপনার ওসীলায় ফিতরাত এর উপর কায়েম রাখুন। তারপর আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়... এভাবে বর্ণনাকারী হাদীসের শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেন।
باب الإِسْرَاءِ بِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى السَّمَوَاتِ وَفَرْضِ الصَّلَوَاتِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي عَدِيٍّ، عَنْ سَعِيدٍ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، - لَعَلَّهُ قَالَ - عَنْ مَالِكِ بْنِ صَعْصَعَةَ، - رَجُلٌ مِنْ قَوْمِهِ - قَالَ قَالَ نَبِيُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " بَيْنَا أَنَا عِنْدَ الْبَيْتِ بَيْنَ النَّائِمِ وَالْيَقْظَانِ إِذْ سَمِعْتُ قَائِلاً يَقُولُ أَحَدُ الثَّلاَثَةِ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ . فَأُتِيتُ فَانْطُلِقَ بِي فَأُتِيتُ بِطَسْتٍ مِنْ ذَهَبٍ فِيهَا مِنْ مَاءِ زَمْزَمَ فَشُرِحَ صَدْرِي إِلَى كَذَا وَكَذَا " . قَالَ قَتَادَةُ فَقُلْتُ لِلَّذِي مَعِي مَا يَعْنِي قَالَ إِلَى أَسْفَلِ بَطْنِهِ " فَاسْتُخْرِجَ قَلْبِي فَغُسِلَ بِمَاءِ زَمْزَمَ ثُمَّ أُعِيدَ مَكَانَهُ ثُمَّ حُشِيَ إِيمَانًا وَحِكْمَةً ثُمَّ أُتِيتُ بِدَابَّةٍ أَبْيَضَ يُقَالُ لَهُ الْبُرَاقُ فَوْقَ الْحِمَارِ وَدُونَ الْبَغْلِ يَقَعُ خَطْوُهُ عِنْدَ أَقْصَى طَرْفِهِ فَحُمِلْتُ عَلَيْهِ ثُمَّ انْطَلَقْنَا حَتَّى أَتَيْنَا السَّمَاءَ الدُّنْيَا فَاسْتَفْتَحَ جِبْرِيلُ صلى الله عليه وسلم فَقِيلَ مَنْ هَذَا قَالَ جِبْرِيلُ . قِيلَ وَمَنْ مَعَكَ قَالَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم . قِيلَ وَقَدْ بُعِثَ إِلَيْهِ قَالَ نَعَمْ - قَالَ - فَفَتَحَ لَنَا وَقَالَ مَرْحَبًا بِهِ وَلَنِعْمَ الْمَجِيءُ جَاءَ - قَالَ - فَأَتَيْنَا عَلَى آدَمَ صلى الله عليه وسلم " . وَسَاقَ الْحَدِيثَ بِقِصَّتِهِ . وَذَكَرَ أَنَّهُ لَقِيَ فِي السَّمَاءِ الثَّانِيَةِ عِيسَى وَيَحْيَى - عَلَيْهِمَا السَّلاَمُ - وَفِي الثَّالِثَةِ يُوسُفَ وَفِي الرَّابِعَةِ إِدْرِيسَ وَفِي الْخَامِسَةِ هَارُونَ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَسَلَّمَ - قَالَ " ثُمَّ انْطَلَقْنَا حَتَّى انْتَهَيْنَا إِلَى السَّمَاءِ السَّادِسَةِ فَأَتَيْتُ عَلَى مُوسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَسَلَّمْتُ عَلَيْهِ فَقَالَ مَرْحَبًا بِالأَخِ الصَّالِحِ وَالنَّبِيِّ الصَّالِحِ . فَلَمَّا جَاوَزْتُهُ بَكَى فَنُودِيَ مَا يُبْكِيكَ قَالَ رَبِّ هَذَا غُلاَمٌ بَعَثْتَهُ بَعْدِي يَدْخُلُ مِنْ أُمَّتِهِ الْجَنَّةَ أَكْثَرُ مِمَّا يَدْخُلُ مِنْ أُمَّتِي . - قَالَ - ثُمَّ انْطَلَقْنَا حَتَّى انْتَهَيْنَا إِلَى السَّمَاءِ السَّابِعَةِ فَأَتَيْتُ عَلَى إِبْرَاهِيمَ " . وَقَالَ فِي الْحَدِيثِ وَحَدَّثَ نَبِيُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ رَأَى أَرْبَعَةَ أَنْهَارٍ يَخْرُجُ مِنْ أَصْلِهَا نَهْرَانِ ظَاهِرَانِ وَنَهْرَانِ بَاطِنَانِ " فَقُلْتُ يَا جِبْرِيلُ مَا هَذِهِ الأَنْهَارُ قَالَ أَمَّا النَّهْرَانِ الْبَاطِنَانِ فَنَهْرَانِ فِي الْجَنَّةِ وَأَمَّا الظَّاهِرَانِ فَالنِّيلُ وَالْفُرَاتُ . ثُمَّ رُفِعَ لِيَ الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ فَقُلْتُ يَا جِبْرِيلُ مَا هَذَا قَالَ هَذَا الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ يَدْخُلُهُ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ إِذَا خَرَجُوا مِنْهُ لَمْ يَعُودُوا فِيهِ آخِرُ مَا عَلَيْهِمْ . ثُمَّ أُتِيتُ بِإِنَاءَيْنِ أَحَدُهُمَا خَمْرٌ وَالآخَرُ لَبَنٌ فَعُرِضَا عَلَىَّ فَاخْتَرْتُ اللَّبَنَ فَقِيلَ أَصَبْتَ أَصَابَ اللَّهُ بِكَ أُمَّتُكَ عَلَى الْفِطْرَةِ . ثُمَّ فُرِضَتْ عَلَىَّ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسُونَ صَلاَةً " . ثُمَّ ذَكَرَ قِصَّتَهَا إِلَى آخِرِ الْحَدِيثِ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসরা ও মি'রাজের সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে বায়তুল মাকদিসে গমন করেন। সেখানে নবীগণকে নিয়ে নামায পড়েন। তারপর হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁকে নিয়ে এক এক করে সাত আসমান পাড়ি দেন। প্রত্যেক আসমানে পৌঁছলে সে আসমানের দ্বাররক্ষী জিজ্ঞেস করে, কে? হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি জিবরীল। তারপর জিজ্ঞেস করে, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দেন, মুহাম্মাদ। এভাবে প্রত্যেকবার তিনি পরিচয় দিতে গিয়ে নিজের নাম বলেছেন। বলেননি যে, আমি। নাম বলতে গিয়েও নিজের সুপরিচিত নাম 'জিবরীল' বলেছেন। অন্য কোনও নাম নয়। তাঁর এছাড়া আরও নাম আছে, যেমন আর-রূহুল আমীন, রূহুল কুদ্‌স। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিচয় দিতে গিয়েও তিনি তাঁর সুপরিচিত নাম 'মুহাম্মাদ' উল্লেখ করেছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও আরও বহু নাম আছে, যেমন আহমাদ, আল-মাহী, আল-হাশির, আল-আকিব ইত্যাদি। তাঁর কুনয়াত বা উপনাম হল আবুল কাসিম। তিনি খাতামুন নাবিয়্যীন। তিনি সায়্যিদুল বাশার। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসবের কোনওটিই না বলে উভয় প্রসিদ্ধ ও পরিচিত নামই বলেছেন। এর দ্বারা বোঝা গেল ঘরের ভেতর থেকে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাওয়া হলে তাকে যে নামে সবাই চেনে সেই নাম বলেই পরিচয় দিতে হবে। 'আমি' বলা কিংবা এমন কোনও নাম বা উপাধি বলাও ঠিক নয়, যা বললে জিজ্ঞাসাকারী তাকে ভালোভাবে চিনতে পারবে না। পরিচয় জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যই তো চিনতে পারা। যা বললে সে চিনতে পারবে না, তা বলার ফায়দা কী? তাতে বরং ঝামেলাই বাড়ে। কথা বেশি বলতে হয়, সময়ও নষ্ট হয়।

অনেক সময় বাক্তি বড় হলে নিজ নাম বলতে আত্মসম্মানে বাধে। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বড় মাখলূক আর কে আছে? তাঁদেরই যখন পরিচয় দিতে গিয়ে নিজ নাম বলতে কুণ্ঠাবোধ হয়নি, তখন অন্যদের কেন এতে আপত্তি লাগবে? অকপটে নিজ নাম উচ্চারণ করার দ্বারা কেবল পরিচয়দানই সহজ হয় না; এটা বিনয়েরও পরিচায়ক।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা ও মি'রাজের ঘটনা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।

খ. আকাশ সাতটি। এতেও বিশ্বাস রাখতে হবে।

গ. প্রত্যেক আকাশে উপরে ওঠার দরজা আছে। আছে দরজার প্রহরীও। একেক ফিরিশতাকে আল্লাহ তা'আলা একেক দরজার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছেন।

ঘ. দ্বাররক্ষী ফিরিশতাগণ সদা সতর্ক ও সচেতন। দায়িত্বপালনে তাদের দ্বারা কখনও কোনও ত্রুটি হয় না।

ঙ. কারও দরজায় পৌঁছলে নিজের নাম-পরিচয় দেওয়া কর্তব্য।

চ. পরিচয় দিতে গিয়ে সবাই যে নামে চেনে সেটাই বলা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)