আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৭৯- আহকাম (রাষ্ট্রনীতি) অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৬৭৭
আন্তর্জাতিক নং: ৭১৬৩ - ৭১৬৪
৩০২০. ব্যক্তি কখন বিচারক হওয়ার যোগ্য হয়।
হাসান (রাহঃ) বলেন, আল্লাহ্ তাআলা বিচারকদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তারা যেন কখনও প্রবৃত্তির অনুসরণ না করেন, মানুষকে ভয় না করেন এবং স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে আল্লাহর আয়াতকে বিক্রয় না করেন। এরপর তিনি (এর প্রমাণ হিসাবে) পড়লেন, ইরশাদ হলোঃ হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না। কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ পরিত্যাগ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ তারা বিচার দিবস সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে আছে (৩৮: ২৬)।
তিনি আরো পাঠ করলেন, (আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের বাণীঃ) আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম। এতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। নবীগণ, যারা আল্লাহর অনুগত ছিল, তারা ইহুদীদের তদনুসারে বিধান দিত, আরো বিধান দিত রাব্বানীরা এবং বিজ্ঞানীরা, কারণ তাদের করা হয়েছিল আল্লাহর কিতাবের রক্ষক ........ আল্লাহ্ তাআলা যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয়না, তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী (৫: ৪৪)।
এবং আরো পাঠ করলেন, (আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ) স্মরন কর দাউদ ও সুলাইমানের কথা, যখন তারা বিচার করেছিল শস্যক্ষেত্র সম্পর্কে; এতে রাতে প্রবেশ করেছিল কোন সম্প্রদায়ের মেষ; আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম তাদের বিচার এবং সুলাইমানকে এ মিমাংসা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। আমি তাদের প্রত্যেককে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান.....(২১: ৭৮-৭৯)। (আল্লাহ্ তাআলা) সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর প্রশংসা করেছেন, তবে দাউদ (আলাইহিস সালাম) এর তিরস্কার করেননি। যদি আল্লাহ্ তাআলা দু’জনের অবস্থাকেই উল্লেখ না করতেন, তাহলে মনে করা হত যে, বিচারকরা ধ্বংস হয়ে গেছেন। তিনি তাঁর (সুলাইমানের) ইলমের প্রশংসা করেছেন এবং (দাউদকে) তাঁর ইজতিহাদের জন্য ক্ষমা করে দিয়েছেন।
মুযাহিম ইবনে যুফার (রাহঃ) বলেন, উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রাহঃ) আমাদের বলেছেন যে, পাঁচটি গুণ এমন যে, কাযীর মধ্যে যদি একটিরও অভাব থাকে, তা হলে সেটা তার জন্য দোষ বলে গণ্য হবে। তাকে হতে হবে বুদ্ধিমান, ধৈর্যশীল, পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী, দৃঢ়প্রত্যয়ী ও জ্ঞানী-জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু।
অনুচ্ছেদঃ ৩০২১. প্রশাসক ও প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভাতা।
বিচারপতি শুরায়হ্ (রাহঃ) বিচারকার্যের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন।
আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, (ইয়াতীমের) তত্ত্বাবধানকারী সম্পদ থেকে তার পারিশ্রমিকের সমপরিমাণ খেতে পারবেন। আবু বকর (রাযিঃ) ও উমর (রাযিঃ) (রাষ্ট্রীয় ভাতা) ভোগ করেছেন।
৬৬৭৭। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দী (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন যে, উমর (রাযিঃ) এর খিলাফতকালে তিনি একবার তার কাছে আসলেন। তখন উমর (রাযিঃ) তাকে বললেন, আমাকে কি এ মর্মে অবগত করা হয়নি যে, তুমি জনগণের অনেক দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে থাক। অথচ যখন তোমাকে এর পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ করাকে অপছন্দ কর? আমি বললাম, হ্যাঁ। উমর (রাযিঃ) বললেন, কী উদ্দেশ্যে তুমি এরূপ কর। আমি বললাম, আমার বহু ঘোড়া ও গোলাম রয়েছে এবং আমি ভাল অবস্থায় আছি। সুতরাং আমি চাই যে, আমার পারিশ্রমিক মুসলমান জনসাধারনের জন্য সাদ্‌কা হিসাবে পরিগণিত হোক। উমর (রাযিঃ) বললেনঃ এরূপ করো না। কেননা, আমিও তোমার মত এরূপ ইচ্ছা পোষণ করতাম। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আমাকে কিছু দিতেন, তখন আমি বলতাম, আমার চেয়ে যার প্রয়োজন বেশী তাকে প্রদান করুন। এভাবে একবার তিনি আমাকে কিছু মাল দিলেন। আমি বললাম, আমার চেয়ে এ মালের প্রয়োজন যার বেশী তাকে দিন। তখন নবী (ﷺ) বললেনঃ একে গ্রহণ করে মালদার হও এবং বৃদ্ধি করে তা থেকে সাদ্‌কা কর। আর এই মাল সম্পদের যা কিছু তোমার নিকট এভাবে আসে, তুমি যার প্রত্যাশী নও বা প্রার্থী নও তা গ্রহণ করো। অন্যথায় তার পিছনে নিজেকে ধাবিত করো না।
যুহরী (রাহঃ)......... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) সূত্রে বলেন, তিনি উমর (রাযিঃ) কে বলতে শুনেছেন যে, নবী (ﷺ) আমাকে যখন কিছু দান করতেন, তখন আমি বলতাম আমার চেয়ে যার প্রয়োজন বেশী তাকে দিন। এভাবে একবার তিনি আমাকে কিছু মাল দিলেন। আমি বললাম, আমার চেয়ে যার প্রয়োজন বেশী তাকে প্রদান করুন। তখন নবী (ﷺ) বললেনঃ একে গ্রহণ কর এবং বৃদ্ধি করে তা থেকে সাদ্‌কা কর। আর এই প্রকার মালের যা কিছু তোমার কাছে এমতাবস্থায় আসে যে তুমি তার প্রত্যাশীও নও এবং প্রার্থীও নও তাহলে তা গ্রহণ করো, তবে যা এভাবে আসবে না তার পিছনে নিজেকে ধাবিত করো না।
بَابٌ: مَتَى يَسْتَوْجِبُ الرَّجُلُ القَضَاءَ
وَقَالَ الحَسَنُ: " أَخَذَ اللَّهُ عَلَى الحُكَّامِ أَنْ لاَ يَتَّبِعُوا الهَوَى، وَلاَ يَخْشَوُا النَّاسَ، وَلاَ يَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا، ثُمَّ قَرَأَ: {يَا دَاوُدُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الأَرْضِ، فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالحَقِّ، وَلاَ تَتَّبِعِ الهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ، إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الحِسَابِ} ، وَقَرَأَ: {إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ، وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ، فَلاَ تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ، وَلاَ تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الكَافِرُونَ} [المائدة: 44] ، " {بِمَا اسْتُحْفِظُوا} [المائدة: 44] : اسْتُوْدِعُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ "، وَقَرَأَ: {وَدَاوُدَ، وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الحَرْثِ إِذْ نَفَشَتْ فِيهِ غَنَمُ القَوْمِ وَكُنَّا لِحُكْمِهِمْ شَاهِدِينَ، فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ وَكُلًّا آتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا} ، «فَحَمِدَ سُلَيْمَانَ وَلَمْ يَلُمْ دَاوُدَ، وَلَوْلاَ مَا ذَكَرَ اللَّهُ مِنْ أَمْرِ هَذَيْنِ لَرَأَيْتُ أَنَّ القُضَاةَ هَلَكُوا، فَإِنَّهُ أَثْنَى عَلَى هَذَا بِعِلْمِهِ وَعَذَرَ هَذَا بِاجْتِهَادِهِ» وَقَالَ مُزَاحِمُ بْنُ زُفَرَ: قَالَ لَنَا عُمَرُ بْنُ عَبْدِ العَزِيزِ: " خَمْسٌ إِذَا أَخْطَأَ القَاضِي مِنْهُنَّ خَصْلَةً، كَانَتْ فِيهِ وَصْمَةٌ: أَنْ يَكُونَ فَهِمًا، حَلِيمًا، عَفِيفًا، صَلِيبًا، عَالِمًا، سَئُولًا عَنِ العِلْمِ "
باب رِزْقِ الْحُكَّامِ وَالْعَامِلِينِ عَلَيْهَا وَكَانَ شُرَيْحٌ الْقَاضِي يَأْخُذُ عَلَى الْقَضَاءِ أَجْرًا. وَقَالَتْ عَائِشَةُ يَأْكُلُ الْوَصِيُّ بِقَدْرِ عُمَالَتِهِ، وَأَكَلَ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ
7163 - حَدَّثَنَا أَبُو اليَمَانِ، أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ [ص:68]، عَنِ الزُّهْرِيِّ، أَخْبَرَنِي السَّائِبُ بْنُ يَزِيدَ، ابْنُ أُخْتِ نَمِرٍ، أَنَّ حُوَيْطِبَ بْنَ عَبْدِ العُزَّى، أَخْبَرَهُ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ السَّعْدِيِّ، أَخْبَرَهُ أَنَّهُ قَدِمَ عَلَى عُمَرَ فِي خِلاَفَتِهِ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: أَلَمْ أُحَدَّثْ أَنَّكَ تَلِيَ مِنْ أَعْمَالِ النَّاسِ أَعْمَالًا، فَإِذَا أُعْطِيتَ العُمَالَةَ كَرِهْتَهَا، فَقُلْتُ: بَلَى، فَقَالَ عُمَرُ: فَمَا تُرِيدُ إِلَى ذَلِكَ، قُلْتُ: إِنَّ لِي أَفْرَاسًا وَأَعْبُدًا وَأَنَا بِخَيْرٍ، وَأُرِيدُ أَنْ تَكُونَ عُمَالَتِي صَدَقَةً عَلَى المُسْلِمِينَ، قَالَ عُمَرُ: لاَ تَفْعَلْ، فَإِنِّي كُنْتُ أَرَدْتُ الَّذِي أَرَدْتَ، فَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْطِينِي العَطَاءَ، فَأَقُولُ: أَعْطِهِ أَفْقَرَ إِلَيْهِ مِنِّي، حَتَّى أَعْطَانِي مَرَّةً مَالًا، فَقُلْتُ: أَعْطِهِ أَفْقَرَ إِلَيْهِ مِنِّي، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خُذْهُ، فَتَمَوَّلْهُ، وَتَصَدَّقْ بِهِ، فَمَا جَاءَكَ مِنْ هَذَا المَالِ وَأَنْتَ غَيْرُ مُشْرِفٍ وَلاَ سَائِلٍ فَخُذْهُ، وَإِلَّا فَلاَ تُتْبِعْهُ نَفْسَكَ»
7164 - وَعَنِ الزُّهْرِيِّ، قَالَ: حَدَّثَنِي سَالِمُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ، قَالَ: سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الخَطَّابِ يَقُولُ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْطِينِي العَطَاءَ، فَأَقُولُ أَعْطِهِ أَفْقَرَ إِلَيْهِ مِنِّي، حَتَّى أَعْطَانِي مَرَّةً مَالًا، فَقُلْتُ: أَعْطِهِ مَنْ هُوَ أَفْقَرُ إِلَيْهِ مِنِّي، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خُذْهُ، فَتَمَوَّلْهُ، وَتَصَدَّقْ بِهِ، فَمَا جَاءَكَ مِنْ هَذَا المَالِ وَأَنْتَ غَيْرُ مُشْرِفٍ وَلاَ سَائِلٍ فَخُذْهُ، وَمَالاَ فَلاَ تُتْبِعْهُ نَفْسَكَ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত উমর রাযি. বলেন- (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কিছু দান করতে চাইলে আমি বলি)। এখানে (দান) দ্বারা গনীমতের অংশ বোঝানো হয়েছে। ইমাম তহাবী রহ. বলেন, এ হাদীছে যে দানের কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা সদাকা-যাকাত বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং ইমাম (সরকার) ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মুসলিমের মধ্যে যা বণ্টন করে থাকে, সেই অর্থ-সম্পদ বোঝানো হয়েছে। কাজেই এ দেওয়াটা দারিদ্র্যের কারণে নয়; বরং হক ও প্রাপ্য হিসেবে ছিল।

أَعْطِهِ مَنْ هُوَ أَفْقَرُ إِلَيْهِ مِنيْ (এটা আমার চেয়ে যার বেশি প্রয়োজন তাকে দিন)। হযরত উমর রাযি. এ কথা বলেছিলেন এ কারণে যে, তাঁর জানা ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার প্রতি লোভ করতে নিষেধ করেন। তিনি অর্থ-সম্পদ বাড়ানোর ফিকিরে পড়াটা পসন্দ করেন না। আর তাঁর নিজের যা আছে তাতে তাঁর চলে যায়। কাজেই এ অবস্থায় শুধু শুধু বাড়তি সম্পদ গ্রহণ করা কেন? কিন্তু তাঁর এ প্রত্যাখ্যান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পসন্দ করেননি। কেননা তিনি তো তা তাঁর দারিদ্র্য বিবেচনায় দিতে চাননি কিংবা তাঁর চাওয়ার কারণেও নয়; বরং তাঁর হক ও অধিকার হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন। সুতরাং তিনি বললেন-
خُذْهُ إِذَا جَاءَكَ مِنْ هذَا الْمَالِ شَيْء وَأَنْتَ غَيْرُ مُشْرِفٍ وَلَا سَائِل، فَخُذْهُ فَتَمَوَّلْهُ (তুমি এটা গ্রহণ করো। এই সম্পদ থেকে কোনওকিছু যদি তোমার কাছে এ অবস্থায় আসে যে, তুমি তার আকাঙ্ক্ষাকারীও নও এবং প্রার্থনাকারীও নও, তবে তা গ্রহণ করো এবং তাকে নিজ সম্পদ বানিয়ে নাও)। এ আদেশ পরামর্শমূলক, বাধ্যতামূলক নয়। বোঝা গেল বিনা চাওয়ায় বা মনের আগ্রহ ছাড়া যদি কারও পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু আসে, তবে তা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়। চাইলে গ্রহণ করতেও পারে, নাও করতে পারে। তবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু গ্রহণ করতে বলেছেন, তাই গ্রহণ করাটাই উত্তম, তাতে দাতা যেমনই হোক। দাতা সাধারণ ব্যক্তি হোক, শাসক হোক, ন্যায়পরায়ণ হোক, ফাসেক হোক, সর্বাবস্থায় তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েয। যদি তা হারাম বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত বলে জানা না থাকে, তবে গ্রহণ করাই উত্তম। কেননা নিজের বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে তা দ্বারা দান-সদাকা করে পুণ্যার্জনের সুযোগ হয়। হযরত আয়েয ইবনে আমর আল মুযানী রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ عُرِضَ عَلَيْهِ شَيْءٌ مِنْ هَذَا الرِّزْقِ مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ، وَلَا إِشْرَافِ نَفْسٍ فَلْيُوَسِّعْ لَهُ فِي رِزْقِهِ، فَإِنْ كَانَ بِهِ عَنْهُ غِنًى فَلْيُوَجِّهْهُ إِلَى مَنْ هُوَ أَحْوَجُ إِلَيْهِ مِنْهُ
চাওয়া ও লোভ ব্যতিরেকে যদি এ রিযিকের কিছু কারও সামনে পেশ করা হয়, তবে সে যেন তা গ্রহণ করে নিজ জীবিকায় সচ্ছলতা আনে। যদি তার প্রয়োজন না পড়ে, তবে যেন তার চেয়ে যে ব্যক্তি বেশি অভাবগ্রস্ত তার কাছে পাঠিয়ে দেয়।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩২৭৬)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْهَدِيَّةُ رِزْقٌ مِنْ رِزْقِ اللهِ ، فَمَنْ أهْدِيَ لَهُ شَيْءٌ فَلْيَقْبَلْهُ، لَا يَرُدُّهُ، وَلْيُكَافِى عَلَيْهِ
‘হাদিয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক। কাজেই কাউকে কোনও জিনিস হাদিয়া দেওয়া হলে সে যেন তা গ্রহণ করে এবং ফেরত না দেয়। তারপর হাদিয়াদাতাকে যেন তার কোনও বিনিময় দেয়।( ইবন আব্দুল বার, আল-ইসতিযকার ৪১৬৯৪)

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, যে-কেউ আমাকে হাদিয়া দেয়, আমি তা গ্রহণ করে নিই। তবে আমি কারও কাছে চাওয়া পসন্দ করি না। হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। হযরত মু'আবিয়া রাযি. উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কাছে মাঝেমধ্যেই হাদিয়া পাঠাতেন। তিনি তা গ্রহণও করতেন। হযরত মু'আবিয়া রাযি. একবার হযরত হুসায়ন রাযি.-এর কাছে চার হাজার দিরহাম হাদিয়া পাঠান। তিনি তা গ্রহণ করে নেন। মুখতার ছাকাফী একজন জালেম শাসনকর্তা ছিল। তা সত্ত্বেও তার পাঠানো হাদিয়া হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. গ্রহণ করতেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আলী আল-বাকির রহ.-কে শাসকদের পাঠানো হাদিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, যদি জানা থাকে তা জবরদখল করা বা হারাম মাল, তবে তা গ্রহণ করো না। আর সেরকম কিছু জানা না থাকলে গ্রহণ করো।

শাসক যদি জালেম হয় এবং জনগণ থেকে অর্থ-সম্পদ গ্রহণে বৈধ-অবৈধের বাছ-বিচার না করে, তবে তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ না করাই শ্রেয়। আমাদের পূর্বসুরী তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তীকালের বুযুর্গানে দীনের অনেকেই এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ., মাসরূক রহ., আবু রাযীন রহ., সুফয়ান ছাওরী রহ., আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ., ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. প্রমুখ মহান ব্যক্তিবর্গ সরকারি উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ করা হতে বিরত থাকতেন।

فَخُذْهُ فَتَمَوَّلُهُ (তবে তা গ্রহণ করো এবং তাকে নিজ সম্পদ বানিয়ে নাও)। তারপর তোমার এখতিয়ার। তুমি চাইলে তা নিজ প্রয়োজনেও ব্যয় করতে পার, চাইলে দান-খয়রাতও করতে পার। যেমন হাদীসে আছে- فَإِنْ شِئْتَ كُلْهُ، وَإِنْ شِئْتَ تَصَدَّقْ بِهِ (তারপর চাইলে তুমি তা খাও এবং চাইলে দান করে দাও)। এই বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর রাযি.-কে অধিকতর ছাওয়াব হাসিলের উপায় বাতলে দিলেন। কেননা হযরত উমর রাযি. তাঁকে দেওয়া সম্পদ গ্রহণ না করার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন কিংবা নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার যে মানসিকতা প্রকাশ করেছিলেন তাও নেকীর কাজ ছিল বটে, কিন্তু সম্পদ নিজ মালিকানায় নিয়ে তা দান-সদাকা করা অধিকতর পুণ্যের কাজ। কারণ কোনও সম্পদের মালিক হওয়ার পর তাতে এক রকম মায়া-মমতা জন্ম নেয়। এ অবস্থায় তা দান করতে গেলে মনের উপর বেশ চাপ পড়ে। নফসকে দমন করেই তা দান করা সম্ভব হয়। এ কারণে তাতে ছাওয়াবও বেশি হয়।

এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে হালাল অর্থ-সম্পদ গ্রহণ না করা অপেক্ষা সুবন্দোবস্ত করা ও দান-খয়রাতের লক্ষ্যে তা গ্রহণ করাটাই উত্তম।

وَما لَا، فلا تُتْبِعْهُ نَفْسَكَ (আর যা এরূপ নয়, তুমি নিজেকে তার অনুগামী বানিয়ো না)। অর্থাৎ যা তোমার চাওয়ার দ্বারা আসে কিংবা যার প্রতি তোমার লোভ থাকে, তা গ্রহণ করো না)। কেননা তাতে বরকত থাকে না। কারও কাছে কিছু চাইলে ও অনেক সময় ভয়ে বা লজ্জায় পড়ে দিয়ে থাকে, খুশিমনে দেয় না। অন্যের মাল ততক্ষন পর্যন্ত পুরোপুরি হালাল হয় না, যতক্ষণ না সে তা খুশিমনে দেয়। এমনিভাবে যে মালের প্রতি লোভ থাকে, তার জন্য অপেক্ষা করা হয় এবং তাতে নফস যুক্ত হয়। এটাও বরকতের পক্ষে বাধা। তাই এরূপ মাল থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অর্থ-সম্পদ আল্লাহ তা'আলার নি'আমত। তার মূল্যায়ন করা চাই।

খ. হাদিয়া গ্রহণ করা উত্তম, যদি তা হারাম উপায়ে অর্জিত বলে জানা না থাকে।

গ. নিতান্ত ঠেকা না হলে কারও কাছে কিছু চাইতে নেই।

ঘ. সম্পদের প্রতি লোভ করতে নেই। বিশেষত অন্যের মালিকানাধীন সম্পদে।

ঙ. সদুদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করা জায়েয।

চ. যদি দান-খয়রাতের নিয়ত থাকে, তবে সম্পদ গ্রহণ করাটা গ্রহণ না করা অপেক্ষা উত্তম।

ছ. দীনদার মান্যগণ্য ব্যক্তির দেওয়া হাদিয়া প্রত্যাখ্যান না করা আদবের দাবি।

জ. নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য।

ঝ. অধীন ও সম্পৃক্তজনদের কল্যাণকর কাজের পরামর্শ দেওয়া চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)