মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

৭. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৮৫
নামাযের অধ্যায়
(৮) অনুচ্ছেদঃ নিজ নামায বিনষ্টকারী হাদীস প্রসঙ্গে
(৩৮৫) আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে নামায আদায় করেন তারপর নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এসে সালাম জানালেন। তিনি তাঁর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ফিরে গিয়ে পুনরায় নামায আদায় কর। কেননা তুমি নামায আদায় কর নি। লোকটি ফিরে গিয়ে পূর্বের মতই নামায আদায় করল। এরূপ সে তিনবার করল। (তিনবারই রাসূল (ﷺ) তাকে একই কথা বললেন) এরপর লোকটি বলল, সেই মহান সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ প্রেরণ করেছেন। এর চেয়ে ভাল করে (নামায) আদায় করতে আমি জানি না। সুতরাং আমাকে শিখিয়ে দিন। তখন নবী করীম (ﷺ) বললেন, যখন তুমি নামায পড়তে দাঁড়াবে তাকবীরে (তাহরিমা) বলে (শুরু করবে) অতঃপর কুরআনের যেখান থেকে তোমার জন্য সহজ হয় সেখান থেকে পড়বে। এরপর রুকুতে যাবে প্রশান্তির সাথে রুকু করবে। তারপর সিজদা করবে, প্রশান্তির সাথে সিজদা করবে। সিজদা হতে উঠে প্রশান্তির সাথে দাঁড়াবে। এপর সিজদায় গিয়ে প্রশান্তির সাথে সিজদা করবে। তারপর সিজদা হতে (মাথা) উঠিয়ে প্রশান্তির সাথে বসবে। এভাবেই তোমার সকল নামায আদায় করবে।
(বুখারী, মুসলিম ও চার সুনান গ্রন্থ।)
كتاب الصلاة
(8) فصل من فى حديث المسى صلاته
(485) عن أبى هريرة رضى الله عنه قال دخل رجل (1) المسجد فصلى (2) ثم جاء إلى النبى صلى الله عليه وسلم فسلم فرد عليه السلام وقال ارجع فصل فإنك لم تصل (3) فرجع ففعل ذلك ثلاث مرات, قال فقال والذى بعثك بالحق ما أحسن غير هذا فعلمى. قال إذا قمت إلى الصلاة فكبر (4) ثم اقرأ ما تيسر معك من القرآن (5) ثم اركع حتى تطمن راكعا, ثم اسجد حتي تطمئن ساجدا, ثم أرفع حتى تستدل قائما, ثم أسجد حتى تطمئن ساجدا ثم ارفع حتى تطمئن جالسا, ثم افعل ذلك في صلاتك كلها

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে যে সাহাবীর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, তার নাম খাল্লাদ ইবন রাফি'। তিনি একজন বেদুঈন সাহাবী। তিনি মসজিদে এসে তাড়াহুড়া করে নামায পড়ছিলেন। তা'দীলুল আরকান করছিলেন না। তা'দীলুল আরকান অর্থ নামাযের রুকন অর্থাৎ রুকূ'-সিজদা ইত্যাদি ফরযসমূহ ধীরস্থিরভাবে আদায় করা। যেমন রুকূ'তে গিয়ে এতটুকু সময় স্থির হয়ে থাকা, যাতে ধীরস্থিরভাবে অন্ততপক্ষে একবার সুবহানা রাব্বিয়াল 'আযীম পড়া যায়। তারপর রুকু' থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খানিকটা স্থির হওয়া। তারপর রুকূ'র মতো ধীরস্থিরভাবে সিজদা করা। দুই সিজদার মাঝখানে সোজা হয়ে স্থিরভাবে বসা। এসব কাজ ওয়াজিব। এগুলো না করলে নামায হয় না। এরূপ নামায পুনরায় পড়তে হয়। ওই সাহাবী তা'দীলুল আরকান ছাড়াই নামায পড়ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা লক্ষ করছিলেন।

ওই সাহাবী নামায শেষ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন এবং সালাম দিলেন। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন- اِرْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصل (ফিরে যাও, আবার নামায পড়ো। কেননা তুমি নামায পড়নি)। তাঁর নামায পড়াটা যেহেতু সহীহভাবে হয়নি, তাই বলেছেন তুমি নামায পড়নি। অর্থাৎ তোমার পড়াটা না পড়ার মতোই হয়েছে। তাই এ নামায আবার পড়তে হবে। কীভাবে পড়তে হবে তা তিনি বলে দেননি। সম্ভবত মনে করেছিলেন ওই সাহাবী নিজেই বুঝতে পারবেন তাঁর নামায কীভাবে পড়া উচিত ছিল আর কীভাবে পড়েছেন। কিন্তু সাহাবীর নামাযের সব নিয়ম-কানুন জানা ছিল না। তাই ফিরে গিয়ে আবারও নামায পড়লেন বটে, কিন্তু পড়লেন আগের মতোই। তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সালাম দিলেন। তিনি যথারীতি সালামের উত্তর দিলেন। ওই সাহাবী ক্ষনিক আগেই এসে সালাম দিয়েছিলেন। তারপর নামায পড়ে এসে আবার সাহাবী দিলেন। দুইবার সালাম দেওয়ার মাঝখানে ছিল নামাযের ব্যবধান। অল্পসময়ের বিরতির পর ফের সালাম দেওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপত্তি করেননি; বরং যথারীতি সালামের উত্তর দিয়েছেন। বোঝা গেল একবার সালাম দেওয়ার পর যদি ক্ষণিকের বিচ্ছেদ হয়, তারপর পুনরায় সাক্ষাৎকালে সালাম দেওয়া বিধিসম্মত। প্রথমবারের মতোই পরেরবারও সালাম দেওয়া সুন্নত।

যাহোক দ্বিতীয়বার সালামের জবাব দেওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন, ফিরে যাও, আবার নামায পড়ো। কেননা তুমি নামায পড়নি। এভাবে তিনবার হল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বারও তাঁকে নামাযের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন না। এর কারণ এ হতে পারে যে, তিনি তাঁকে সময় দিচ্ছিলেন। যাতে নিজ ত্রুটি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং বিশুদ্ধভাবে নামায পড়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তারপরও যখন তাঁর কাছে নিজ ত্রুটি ধরা পড়বে না, তখন তাঁর নিজের মধ্যেই শেখার আগ্রহ জন্মাবে এবং বিষয়টির গুরুত্বও তাঁর বুঝে আসবে। তখন জানতে চাইবেন সহীহ-শুদ্ধভাবে নামায কীভাবে পড়তে হয়। তখন যদি শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তা তার মনে বসে যাবে। কখনও ভুলবেন না। পরিশেষে তাই হল। শেষবার যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন 'ফিরে যাও, আবার নামায পড়ো। কেননা তুমি নামায পড়নি', তখন তিনি নিজ অপারগতা প্রকাশ করে বললেন-
والذي بعثك بالحق ما أحسن غيره، فعلمني،
‘যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! আমি এরচে' ভালো পারি না। আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন’।

তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্নেহ-মমতার সঙ্গে তাঁকে নামাযের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। নামাযের কোন রুকন কীভাবে আদায় করতে হবে তা বলে দিলেন। অর্থাৎ প্রতিটি রুকন আদায় করতে হবে ধীরস্থিরভাবে। তা'দীলুল আরকানের সঙ্গে। তাড়াহুড়া করা যাবে না। যদি তাড়াহুড়া করা হয়, তবে তা'দীলুল আরকান ছুটে যাবে, যা কিনা ওয়াজিব। রুকু'-সিজদায় গিয়ে স্থির না হলে, রুকু' থেকে সোজা হয়ে না দাঁড়ালে এবং দুই সিজদার মাঝখানে সোজা হয়ে না বসলে নামায হয় না। কেননা এর প্রতিটিই ওয়াজিব।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. একবার সালাম দেওয়ার পর ক্ষণিকের বিচ্ছেদ বা আড়ালের পর পুনরায় সাক্ষাৎ হলে পুনরায় সালাম দেওয়া সুন্নত।

খ. নামাযে তা'দীলুল আরকান ওয়াজিব। ওয়াজিব ছুটে গেলে নামায হয় না।

গ. কারও দ্বারা কোনও ভুল হলে তাকে শিক্ষাদানের একটা নববী পন্থা এটাও যে, তাকে সুযোগ দেওয়া হবে যাতে সে নিজে নিজেই অনুসন্ধান করে নিজ ভুল নির্ণয় করতে পারে এবং নিজে নিজেই তা সংশোধন করতে সক্ষম হয়।

ঘ. যার যে বিষয়ে জানা নেই তার উচিত, তা অকপটে স্বীকার করা এবং যে জানে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া।

ঙ. শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ ছিল খুবই মমতাপূর্ণ। প্রত্যেক শিক্ষাদাতার এ আদর্শ অনুসরণ করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ - হাদীস নং ৪৮৫ | মুসলিম বাংলা