মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

৩. তাক্বদীরের অধ্যায়

হাদীস নং: ৪১
আন্তর্জাতিক নং: ২৭৪৮৪
(৫) পরিচ্ছেদঃ তাকদীর অস্বীকারকারীদের পরিত্যাগ করা এবং তাদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করা সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ
(৪১) আবূদ্ দারদা (রা) নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (নবী) ইরশাদ করেছেন, জান্নাতে প্রবেশ করবে না ঐ ব্যক্তি, যে পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়, আর যে মদ্য তৈরী করে এবং যে তাকদীরকে অস্বীকার করে । (তাবরানী, আউসাত গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
(5) باب في هجر المكذبين بالقدر والتغليظ عليهم
(41) وعن أبي الدرداء رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال لا يدخل الجنة عاق ولا مدمن خمر ولا مكذب بقدر

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছে তারপর বলা হয়েছে- فَسَدِّدُوا 'তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।سَدِّدُوا শব্দটি السداد থেকে গঠিত। এর অর্থ ইস্তিকামাত। অর্থাৎ সঠিক ও বিশুদ্ধ হওয়া এবং স্থায়িত্বলাভ করা। বোঝানো হচ্ছে- তোমরা দীনের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর ও তাতে স্থির থাক। কোনও অবস্থায়ই মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করো না। কেউ কেউ বলেন, السداد অর্থ কথা, কাজ ও উদ্দেশ্য সঠিক হওয়া। এ তিনওটি সঠিক হলে তাকে বলা হয় ইস্তিকামাত। এগুলো সঠিক হওয়া মানে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া।

তারপর বলা হয়েছে-وقاربوا সাধ্যানুযায়ী আমল কর'। قاربوا এর উৎপত্তি قرب থেকে, যার অর্থ নৈকট্য। সুতরাং قاربوا এর আক্ষরিক অর্থ- কাছাকাছি থাক অর্থাৎ তোমরা বিশুদ্ধতার কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা কর। অর্থাৎ তোমরা যতই চেষ্টা করো না কেন, শরী'আতের যাবতীয় বিধান ঠিক যেভাবে বলা হয়েছে শতভাগ সেভাবে মধ্যমপন্থায় পালন করতে পারবে না, কিছু না কিছু ত্রুটি হয়েই যাবে। হয়তো তাতে বাড়াবাড়ি ঘটবে, নয়তো শিথিলতা দেখা দেবে। ঠিক মাঝখানে অর্থাৎ শরী'আত যেভাবে বলেছে হুবহু সেভাবে পারবে না। তবে সতর্ক থাকবে যাতে হুবহু না পারলেও বেশি দূরে সরে না যাও। যথাসম্ভব বিশুদ্ধতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে। মোটকথা, মানুষের প্রতি শরী'আতের আদেশ হচ্ছে- সকল বিধানে যথাসম্ভব কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমলের চেষ্টা করা, ইচ্ছাকৃতভাবে তাতে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা না করা।

وَاسْتَعِينُوا بِالْغَدْوَةِ وَالرَّوْحَةِ، وَشَيْءٍ مِنْ الدُّلْجَةِ

এবং সকাল, সন্ধ্যা ও রাতের কিছু অংশ দ্বারা সাহায্য গ্রহণ কর'। الغَدْوَةِ এর অর্থ দিনের প্রথম অংশের যাত্রা। الرَّوْحَةِ এর অর্থ দিনের শেষভাগের যাত্রা। الدُّلْجَةِ এর অর্থ রাতের শেষভাগ। বলা হচ্ছে, তোমরা এই তিন বেলার 'ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা বাকি সব 'ইবাদত-বন্দেগী নিয়মিতভাবে করে যাওয়ার পক্ষে সাহায্য গ্রহণ কর। অর্থাৎ এ সময়গুলোতে নিয়মিত ইবাদত করতে থাকাটা অন্যান্য ইবাদত চালিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক হয়। কেননা এই তিনটি সময় পরিবেশ শান্ত থাকে, সেইসঙ্গে শরীর-মন থাকে চাঙ্গা। ফলে পূর্ণ আগ্রহ ও মনোনিবেশের সাথে 'ইবাদত করা সম্ভব হয়। এভাবে নিয়মিত করতে থাকলে 'ইবাদতের অভ্যাস গড়ে উঠে এবং তার প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। ইবাদতের প্রতি যখন মহব্বত সৃষ্টি হয়ে যায়, তখন আর সময়-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতিকূলতা তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। বান্দা তখন সব বাধা অগ্রাহ্য করে সর্বপ্রকার ইবাদতে যত্নবান থাকতে পারে। 'ইবাদতের সঙ্গে বান্দার এ পর্যায়ের গভীর সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে যেহেতু উল্লিখিত তিন সময়ের 'ইবাদত সহায়ক হয়, সেজন্যই এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মূলত এ বাক্যটি রূপকালঙ্কারস্বরূপ। এতে রূহানী ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রাকে বাহ্যিক সফরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মানুষ সফরের জন্য সাধারণত এ তিন সময়কে বেছে নিয়ে থাকে। কেননা এ সময় পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় ও শরীর-মন চাঙ্গা থাকায় যাত্রা আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য হয়। ইবাদত-বন্দেগী যেহেতু এক রূহানী সফর, যা দ্বারা বান্দা ধাপে ধাপে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যের স্তরসমূহ অতিক্রম করে থাকে, তাই এর জন্যও পরিবেশ অনুকূল ও শরীর-মন চাঙ্গা থাকা দরকার, যা এ তিন সময় হয়ে থাকে। ফলে এ সময়ের ইবাদত-বন্দেগীতে অনেক বেশি আস্বাদ পাওয়া যায় এবং এতে করে রূহানী সফর আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। এ কারণেই বিশেষভাবে ওই তিন সময়কে বেছে নিতে বলা হয়েছে।

বুখারী শরীফের অপর যে বর্ণনাটি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তার শেষবাক্য হচ্ছে- وَالْقَصْدَ الْقَصْدَ تَبْلُغُوا মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে'। অর্থাৎ তোমরা যদি মধ্যপন্থা রক্ষা করে আমল করতে থাক, তবে এই "ইবাদত-বন্দেগীতে নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পারবে। ফলে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টিলাভে সক্ষম হবে, যা কিনা মু'মিন বান্দার পরম লক্ষ্যবস্তু।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীন যেহেতু সহজ, তাই সহজভাবেই তার অনুসরণ বাঞ্ছনীয়। অহেতুক বাড়াবাড়ি করে কোনও আমলকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়।

খ. নফল ইবাদত যতটুকু নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে হবে ততটুকুই ধরা উচিত, তার বেশি নয়।

গ. ইবাদতে মধ্যপন্থা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা উচিত। কোনও ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি রক্ষা করতে না পারলেও সতর্ক থাকা উচিত যাতে বেশি দূরে সরে যাওয়া না হয়।

ঘ. ইবাদতকারীর মনে আশা রাখা উচিত যে, আল্লাহ নিজ মেহেরবানীতে তা কবুল করবেন এবং তার প্রতিশ্রুত ছাওয়াব ও প্রতিদানও নিজ রহমতে দান করবেন।

ঙ. হাদীছে বর্ণিত তিনটি সময়ের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত, যাতে এ সময়ের করণীয় 'ইবাদত অবশ্যই আদায় করা হয় এবং কিছুতেই গাফলাতি না হয়ে যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ - হাদীস নং ৪১ | মুসলিম বাংলা