আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৯- শপথ ও মান্নতের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৬৫৩
২৭৫৬. " আল্লাহ যা চান ও তুমি যা চাও" বলবে না। "আমি আল্লাহর সাথে এরপর তোমার সাথে" এরূপ বলা যাবে কি?
৬১৯৮। আমর ইবনে আসিম (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন যে, বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা করতে চাইলেন এবং একজন ফিরিশতা পাঠালেন। ফিরিশতা কুষ্ঠরোগীর কাছে এল। সে বলল, আমার যাবতীয় উপায়-উপকরণ ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন আমার জন্য আল্লাহ ছাড়া, অতঃপর তুমি ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। এরপর পুরো হাদীস বর্ণনা করলেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বনী ইসরাঈল বলা হয় হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বংশধরদেরকে। ‘ইসরাঈল' হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামের আরেক নাম। তিনি হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের পুত্র। হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ছোট ভাই। তাঁরা উভয়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পুত্র। বর্তমানে বনী ইসরাঈল বলতে ইহুদীদেরকে বোঝায়। কুরআন মাজীদে ও হাদীছে তাদের বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তারা নিজেদের হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী বলে দাবি করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছে। তারা তাওরাত গ্রন্থও বিকৃত করে ফেলেছে।

এ হাদীছে তাদের তিন ব্যক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা পরীক্ষা করেছিলেন। তিনজনই ছিল নিতান্ত গরীব এবং একেকজন একেক রোগে আক্রান্ত। মানুষ তাদের ঘৃণা করত। আল্লাহ তা'আলা তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে যায়। হয়ে যায় অনেক সম্পদের মালিক। এ পরিবর্তনের জন্য তাদের কর্তব্য ছিল আল্লাহর শোকর আদায় করা। প্রত্যেকের উচিত ছিল অতীতের দুরাবস্থার কথা স্মরণ রেখে বর্তমান সুখের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা ও আপন আপন সম্পদের হক আদায় করা। কিন্তু এ কর্তব্যকর্ম তাদের মধ্যে মাত্র একজনই উপলব্ধি করেছিল। সে যথারীতি আল্লাহর শোকরগুযারী করে এবং আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ে যত্নবান থাকে। কিন্তু বাকি দু'জন ছিল এর বিপরীত। অবস্থা পরিবর্তনের পর তারা বিগত জীবনের কথা মনে রাখেনি। তারা যে একদিন গরীব ছিল, ছিল মারাত্মক রোগে আক্রান্ত, তা বেমালুম ভুলে যায়। সম্পদের মোহে পড়ে ভুলে যায় তার প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাকেও। ফিরিশতা এসে যখন তাদের কাছে সাহায্য চাইল, তখন সাহায্য তো করলই না, উল্টো তাদের অতীত দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে দাবি করে বসল, তারা বাপ-দাদার আমল থেকেই ধন-দৌলতের মালিক। হঠাৎ করে ধনী হয়ে যায়নি। এ যেন কারূনের কথারই প্রতিধ্বনি। তাকে যখন তার সম্পদ থেকে গরীব-দুঃখীকে দান করতে বলা হল, সে ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলেছিল কেন তা করবে? সে তো ধন-দৌলতের মালিক নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি বলেই হয়েছে। তার প্রতি এটা কারও দান নয়। কুরআন মাজীদে তার কথা বর্ণিত হয়েছে-

قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي

"সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি।"

অর্থাৎ এ সম্পদ আমি আল্লাহর কাছ থেকে পাইনি। এ দুই ব্যক্তিও বলল, এ সম্পদ পুরুষানুক্রমে পেয়েছি। অর্থাৎ তাতে যেন আল্লাহর কোনও হাত নেই। কত বড় অকৃতজ্ঞতা! তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ ছিল। ফিরিশতা তাদের প্রত্যেকের কাছে এসেছিলেন তাদের অতীত রূপ ও অতীত বেশভূষা নিয়ে। অন্ধের কাছে অন্ধ হয়ে, কুষ্ঠীর কাছে কুষ্ঠীরূপে এবং টেকোর কাছে টেকোবেশে। এ রূপ দেখে তারা মনে করতে পারত, একদিন তারাও এরকম ছিল। তাদের কিছুই ছিল না। নিতান্তই দরিদ্র ছিল। আল্লাহ তা'আলাই নিজ করুণায় তাদের রোগমুক্তিও দান করেছেন এবং দিয়েছেন অঢেল সম্পদ। অন্ধ লোকটি তা ঠিকই মনে করেছিল এবং স্বীকার করেছিল একদিন সে নিতান্ত গরীব ছিল। ছিল অন্ধ। আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তার অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। তারপর সে সাহায্য প্রার্থীকে খালি হাতেও ফিরিয়ে দেয়নি। তাকে তার যা দরকার, নিজ ইচ্ছামত নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু অপর দু'জন অকৃতজ্ঞতা দেখায়। দাবি করে বসে, আগে থেকেই তারা ধনী ছিল। তারা তাকে কিছুই দিল না। নানারকম খরচের অজুহাত দেখাল, যেমনটা সবকালের কৃপণরা করে থাকে। তারা চিন্তা করেনি ধন-সম্পদ ও আরোগ্য দিয়ে আল্লাহ তা'আলা হয়তো তাদের পরীক্ষা করছেন যে, তারা শোকর আদায় করে কি না। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে নানাভাবেই পরীক্ষা করে থাকেন। কখনও পরীক্ষা করেন সুস্থতা দিয়ে, কখনও অসুস্থতা দিয়ে। কখনও পরীক্ষা করেন দারিদ্র্য দিয়ে, কখনও ধন-সম্পদ দিয়ে। কখনও পরীক্ষা করেন ভয়-ভীতির সম্মুখীন করে, কখনও স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিয়ে। এক অবস্থায় কাম্য সবর করা, অন্য অবস্থায় শোকর আদায় করা। তা করতে পারলেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা অকৃতজ্ঞতা দেখিয়ে আল্লাহর পরীক্ষায় ফেল করেছে। এর জন্য আখিরাতে যে শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা তো রয়েছেই, দুনিয়ায়ও তাদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

ফিরিশতা তাদের বলল, তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে মিথ্যুক হও, তবে আল্লাহ তা'আলা যেন তোমাদেরকে আগের মতই করে দেন। সন্দেহ নেই আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করেছিলেন। আগেও তো তাঁর দু'আ কবুল করে তাদের সুস্থ করেছিলেন এবং ধন-সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তাঁর দু'আ বৃথা যাওয়ার কথা নয়। ফলে হয়তো আগের মত কুষ্ঠী ও টেকো হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদ হারিয়ে ফকীর বনে যায়। অকৃতজ্ঞের পরিণাম এমনই হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

لين شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَبِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيد

“তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ আমার শাস্তি অতি কঠিন।”

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।

ক. সুস্থতা-অসুস্থতা এবং দারিদ্র্য ও ধনাঢ্যতাকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে দেখা উচিত। সেই হিসেবে এক অবস্থায় কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা, অন্য অবস্থায় শোকর আদায় করা।

খ. নিজের অতীত কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান অবস্থাকে শোধরানোর চেষ্টা করা উচিত। অকৃতজ্ঞতার পরিণাম হয় অত্যন্ত অশুভ।

গ. কৃতজ্ঞতা দ্বারা নি'আমত বৃদ্ধি পায়।

ঘ. কৃপণতা একটি কঠিন আত্মিক ব্যাধি। এর ফলে মানুষ নাশোকরিতে লিপ্ত হয় ও মিথ্যাচার করে। সুতরাং কৃপণতা পরিহার করা উচিত।

ঙ. বিশ্বাস করা উচিত যে, নিজ অর্থ-সম্পদে গরীবেরও হক আছে। প্রত্যেকের কর্তব্য সে হক আদায়ে যত্নবান থাকা এবং কখনও কাউকে বঞ্চিত না করা।

চ. অন্তরে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ধ্যান জাগরুক রাখা উচিত। তিনিই সবকিছুর প্রকৃত দাতা- এ কথা স্মরণ রাখলে নিজের জান-মাল সবকিছু তাঁর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করা সহজ হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন