আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৪২
৩৪২৪. মালের যা অগ্রিম পাঠাবে তা-ই তার হবে।
৫৯৯৮। উমর ইবনে হাফস (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, নবী (ﷺ) লোকদের প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কে, যে নিজের সম্পদের চেয়ে তার উত্তরাধিকারীর সম্পদকে বেশী প্রিয় মনে করে? তারা সবাই জবাব দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সবাই তার নিজের সম্পদকে সবচাইতে বেশী প্রিয় মনে করি। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মানুষের নিজের সম্পদ তা-ই, যা সে আগে পাঠিয়েছে আর পিছনে যা ছেড়ে যাবে তা সবই ওয়ারিছের মাল।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে আল্লাহ তা'আলার পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। উৎসাহটি তিনি দিয়েছেন প্রশ্নোত্তরের পন্থায়। তিনি সাহাবীদের লক্ষ্য করে প্রশ্ন করেন- أَيُّكُم مَالُ وَارِثِهِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ؟ (তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যার কাছে তার নিজ সম্পদ অপেক্ষা তার ওয়ারিছের সম্পদ বেশি প্রিয়)? এ প্রশ্নে একই সম্পদকে এক হিসেবে ব্যক্তির নিজের মাল বলা হয়েছে, আরেক হিসেবে বলা হয়েছে ওয়ারিছের মাল। ব্যক্তির তো এ হিসেবে যে, এখন তা তার মালিকানায় আছে। এদিক থেকে বাস্তবিক অর্থেই তা তার মাল। মৃত্যুর পর এ মাল তার ওয়ারিছের মালিকানায় চলে যাবে। সেই হিসেবে তা ওয়ারিছেরও মাল। তবে তা বাস্তবিক অর্থে নয়; রূপক ও পরোক্ষ অর্থে। আবার তার মৃত্যুর পর বাস্তবিক অর্থেই তা তার ওয়ারিছের মাল হয়ে যায়।

সাহাবীগণ এর বাহ্যিক অর্থ হিসেবে মনে করেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্তমানে উভয়ের মালিকানাধীন সম্পদ বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ ব্যক্তির হাতে স্বতন্ত্র যে সম্পদ এখন আছে এবং স্বতন্ত্রভাবে তার ওয়ারিছের হাতেও যে সম্পদ বর্তমানে আছে। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তির কাছে তার নিজ সম্পদ তার ওয়ারিছের সম্পদ অপেক্ষা বেশি প্রিয়ই বটে। তাই তারা উত্তর দিলেন-
يَا رَسُوْلَ اللهِ ، مَا مِنَّا أَحَدٌ إِلَّا مَالُهُ أَحَبُّ إِلَيْهِ (ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের প্রত্যেকের কাছেই তো তার নিজ সম্পদই বেশি প্রিয়)। তাই মানুষ তার ওয়ারিছের মালিকানাধীন সম্পদের দিকেও সুদৃষ্টি রাখে বটে, কিন্তু তার নিজ সম্পদের প্রতিই সে তুলনামূলকভাবে বেশি যত্নবান থাকে। প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বোঝাতে চাচ্ছিলেন, সেই নিগূঢ় অর্থের দিকে তাদের দৃষ্টি যায়নি। সুতরাং তিনি প্রকৃত বিষয় তাদের সামনে খোলাসা করে দিলেন। তিনি বললেন-
فَإِنَّ مَالَهُ مَا قَدَّمَ وَمَالَ وَارِثِهِ مَا أَخَّرَ ‘প্রকৃতপক্ষে তার সম্পদ তো তাই, যা সে (আখিরাতের জন্য) অগ্রীম পাঠিয়েছে। আর তার ওয়ারিছের সম্পদ হল তাই, যা সে পেছনে রেখে গেছে'। আখিরাতের জন্য অগ্রীম পাঠানো অর্থ আল্লাহর পথে খরচ করা। এভাবে সে যা খরচ করে, প্রকৃতপক্ষে তাই তার সম্পদ। এটাই আখিরাতে তার কাজে আসবে। ওয়ারিছের জন্য যা রেখে গেছে তা তার কাজে আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। ওয়ারিছ নেককার হলে সে তা আল্লাহর হুকুম অনুসারে ব্যয় করবে। ফলে সে নিজেও ছাওয়াব পাবে এবং মৃতব্যক্তির আমলনামায়ও অনুরূপ ছাওয়াব লেখা হবে। পক্ষান্তরে ওয়ারিছ যদি নেককার না হয় আর সে সম্পদ ভ্রান্ত পথে খরচ করে, তবে মৃতব্যক্তির তা কোনও উপকারে আসবে না। বরং ভ্রান্ত পথে খরচ করার পেছনে যদি মৃতব্যক্তির কোনও ভূমিকা থাকে, তবে ওয়ারিছের মতো তার আমলনামায়ও গুনাহ লেখা হবে। সুতরাং জীবদ্দশায় নিজ সম্পদ আল্লাহ তা'আলার পথে যত বেশি খরচ করা যাই, ততোই মঙ্গল। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (18)
‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের (অর্থাৎ আখিরাতের) জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা যা-কিছু কর সে সম্পর্কে আল্লাহ পুরোপুরি অবগত।(সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ১৮)

অন্যত্র ইরশাদ-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
‘আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না।’(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৭)
অর্থাৎ আখিরাতে জান্নাত লাভই হবে মুখ্য বিষয়। তবে দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে বিমুখ হয়ে নয়। নিজ ও নিজ পরিবারের প্রয়োজন পূরণ করাও বাঞ্ছনীয়। এর পেছনে যা খরচ হয়, তাও বৃথা খরচ নয়। বৃথা খরচ সেটাই, যা খরচ হয় বিলাসিতায় কিংবা অহেতুক কাজে। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
يقولُ ابنُ آدَمَ: مَالِي، مَالِي، قالَ: وَهلْ لَكَ -يا ابْنَ آدَمَ- مِن مَالِكَ إلَّا ما أَكَلْتَ فأفْنَيْتَ، أَوْ لَبِسْتَ فأبْلَيْتَ، أَوْ تَصَدَّقْتَ فأمْضَيْتَ؟
‘আদমসন্তান বলে, আমার সম্পদ, আমার সম্পদ। হে আদমসন্তান! তোমার সম্পদের মধ্যে তোমার তো কেবল তাই, যা তুমি খেয়ে শেষ করেছ, যা পরিধান করে পুরোনো করেছ কিংবা দান-খয়রাত করে (তার ছাওয়াব) সঞ্চয় করেছ।’(সহীহ মুসলিম: ২৯৫৮; জামে' তিরমিযী: ২৩৪২; সুনানে নাসাঈ : ৩৬১৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩৩৯; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৮৬৮; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ১২৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান ৭০১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৮৭০)

প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছ ওয়ারিছদের জন্য সম্পদ রেখে যেতে নিষেধ করছে না। এর উদ্দেশ্য কেবলই বান্দাকে আখিরাতমুখী করা। বান্দা যেন সঞ্চয়ে মত্ত হয়ে আখিরাত ভুলে না যায়। আখিরাতের নাজাত ও মুক্তিই হয় তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সে লক্ষ্যে যেন যত বেশি সম্ভব আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করে। অন্য হাদীছে ওয়ারিছের জন্যও কিছু সম্পদ রেখে যাওয়ার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তবে তারচে'ও বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তাকে দীনদাররূপে গড়ে তোলার প্রতি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে উৎসাহ যোগায়।

খ. মনে রাখতে হবে, যে সম্পদ আখিরাতের কল্যাণে ব্যয় করা হয়, সেটাই ব্যক্তির আসল সম্পদ। সুতরাং আখিরাতের সঞ্চয়ই হওয়া উচিত প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

গ. রেখে যাওয়া সম্পদের মালিক হয় ওয়ারিছ। তাই ওয়ারিছ যাতে সে সম্পদের শরী'আতসম্মত ব্যবহার করে, সেই লক্ষ্যে তাকে দীনদাররূপে গড়ে তোলা চাই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন