রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৭. রোগীর শুশ্রূষা ও মাইয়্যেতের প্রতি কর্তব্য

হাদীস নং: ৯৩০
রোগীর শুশ্রূষা ও মাইয়্যেতের প্রতি কর্তব্য
পরিচ্ছেদ:১২ মায়্যিতের জানাযা পড়া, তার সাথে যাওয়া এবং তার দাফনে উপস্থিত থাকা। লাশের সঙ্গে নারীদের না যাওয়া
জানাযায় নারীদের অংশগ্রহণ
হাদীছ নং: ৯৩০

হযরত উম্মু আতিয়্যাহ রাযি. বলেন, আমাদেরকে লাশের সঙ্গে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এতে আমাদের উপর কঠোরতা করা হয়নি। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১২৭৮; সহীহ মুসলিম: ৯৩৮; সুনানে আবূ দাঊদ: ৩১৬৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৭৬; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬২৮৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১২৯৪; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহূয়াহ: ২৩৫৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১২)
كتاب عيادة المريض وتشييع الميت والصلاة عليه وحضور دفنه والمكث عند قبره بعد دفنه
باب الصلاة عَلَى الميت وتشييعه وحضور دفنه، وكراهة اتباع النساء الجنائز
930 - وعن أم عطية رضي الله عنها، قالت: نُهِينَا عَنِ اتِّبَاعِ الجَنَائِزِ، وَلَمْ يُعْزَمْ عَلَيْنَا. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
ومعناه: وَلَمْ يُشَدَّدْ في النَّهْيِ كَمَا يُشَدَّدُ في المُحَرَّمَاتِ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে হযরত উম্মু আতিয়্যাহ রাযি. জানান যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে জানাযার সঙ্গে চলতে নিষেধ করেছেন। 'জানাযা' শব্দটি দ্বারা যেমন জানাযার নামায বোঝানো হয়, তেমনি এর দ্বারা মায়্যিতকেও বোঝানো হয়ে থাকে। মায়্যিতের সঙ্গে চলার এক উদ্দেশ্য জানাযার নামায পড়া, আরেক উদ্দেশ্য কবর পর্যন্ত তার সঙ্গে যাওয়া ও তাকে চিরবিদায় জানানো।

ঘরের ভেতর থেকে যদি জানাযার নামাযে শরীক হওয়া সম্ভব হয়, তবে নারীদের জন্য তাতে শরীক হওয়া সম্পূর্ণ জায়েয। তাতে দোষের কিছু নেই। যদি তাতে শরীক হওয়ার জন্য ঘরের বাইরে যেতে হয়, তবে আলোচ্য হাদীছের দৃষ্টিতে তা সমীচীন নয়, যদিও তা নাজায়েয নয়। হাদীছটিতে হযরত উম্মু আতিয়্যাহ রাযি. বলেন- "আমাদেরকে লাশের সঙ্গে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এতে আমাদের উপর কঠোরতা করা হয়নি”। বোঝা গেল এ নিষেধাজ্ঞা হারাম বা তাহরীমী পর্যায়ের মাকরূহও নয়। কেবলই মাকরূহ তানযীহী- অপসন্দনীয় কাজ। তা অপসন্দনীয় এ কারণে যে, নারীর মন বড় নরম। তারা বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে, যা কিনা মায়েদের সৌন্দর্য। প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাদের মন ভেঙে পড়ে। এ কারণে ঘরের বাইরে গিয়ে জানাযায় শরীক হলে হয়তো ধৈর্যহারা হয়ে তাদের দ্বারা এমন আচরণ হয়ে যাবে, যা তাদের পর্দা ও শালীনতা ক্ষুন্ন করবে।

একই কারণে লাশের সঙ্গে কবর পর্যন্ত যেতেও তাদের নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া কবর পর্যন্ত গেলে তাদের দ্বারা পুরুষদের কিংবা পুরুষদের দ্বারা তাদের অথবা উভয়েরই ফিতনায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা লাশের সঙ্গে যাওয়ার বেলায় সাধারণত শৃঙ্খলা রক্ষা সম্ভব হয় না। তাতে নারী-পুরুষের আলাদা থাকা কঠিন। এরকম বিশৃঙ্খল ক্ষেত্রে নারীদের যাওয়াটা নিরাপদ নয়।

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন হতে পারে, নারীরা কবর যিয়ারতে যেতে পারবে কি না? সন্তান, পিতা-মাতা, স্বামী বা অন্য কোনও প্রিয়জনের কবর যিয়ারত করতে তাদের যাওয়ার অনুমতি আছে কি?

কারও কারও মতে এটা জায়েয নয়। কেননা হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. প্রমুখ সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে-
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ لَعَنَ زَوَّارَاتِ الْقُبُور
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী নারীদের লা'নত করেছেন’।
(জামে' তিরমিযী: ১০৫৬; সুনানে আবূ দাঊদ: ৩২৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৭৪; মুসনাদে আবূ দাঊদ তয়ালিসী: ২৪৭৮; মুসনাদে আহমাদ: ৮৪৩২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৭০৪; মুসনাদুল বাযযার: ৮৬৬৬; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫৯০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩১৭৮)

অধিকাংশ উলামার মতে নারীদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েয। তাদের মতে উল্লিখিত হাদীছটি মানসূখ (রহিত) হয়ে গেছে। এর প্রমাণ হল, হযরত বুরায়দা রাযি. বর্ণিত হাদীছ। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُنتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ ، فَزُورُوهَا ؛ فَإِنَّهَا تُزَهِّدُ فِي الدُّنْيَا، وَتُذَكِّرُ الْآخِرَةَ
'আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা তা যিয়ারত করতে পার। কেননা কবর যিয়ারত দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত করে এবং আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেয়’।
(সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৭১; সহীহ মুসলিম: ১৪০৬; সুনানে আবূ দাঊদ: ৩৬৯৮; জামে' তিরমিযী: ১০৫৪; সুনানে নাসাঈ ২০৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৮০৪; মুসনাদে আহমাদ: ১২৩৬; মুসনাদুল বাযযার: ৭৩৬৬; মুসনাদে আবূ ইয়ালা: ২৭৮; সুনানে দারা কুতনী: ৪৬৭৯)

এছাড়াও বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা নারীদের জন্য কবর যিয়ারতের বৈধতা প্রমাণিত হয়। যেমন হযরত হুসায়ন রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত ফাতিমা রাযি. প্রতি জুমু'আয় তাঁর চাচা হামযা রাযি.-এর কবর যিয়ারত করতে যেতেন। (হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১৩৯৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭২০৮)

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কবর যিয়ারতে গিয়ে তিনি কী বলবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বলবে-
السَّلَامُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ، وَيَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ
‘হে কবরবাসী মুমিন-মুসলিমগণ! তোমাদের প্রতি সালাম। আমাদের মধ্যে যারা আগে যায় এবং যারা পেছনে থেকে যায়, তাদের সকলের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। ইনশাআল্লাহ আমরাও তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব’। (সহীহ মুসলিম: ৯৭৪; সুনানে নাসাঈ: ২০৩৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭১১০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭২১১; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৭১২)

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, যে হাদীছে কবর যিয়ারতকারিনীদের লা'নত করা হয়েছে, তাতে ওইসকল নারীদের বোঝানো উদ্দেশ্য, যারা খুব বেশি বেশি কবর যিয়ারত করে। কেননা এ কারণে তাদের দ্বারা স্বামীর হক নষ্ট হওয়া, বেশি বেশি বাইরে যাওয়া, চিৎকার ও বিলাপ করা ইত্যাদি অনুচিত কাজের আশঙ্কা থাকে। যাদের বেলায় এসবের আশঙ্কা নেই, তাদের কবর যিয়ারতেও কোনও দোষ নেই। কবর যিয়ারত করা নারী-পুরুষ সকলেরই প্রয়োজন, যেহেতু এর দ্বারা মন নরম হয় ও আখিরাতের কথা স্মরণ হয়। লাশের সঙ্গে নারীদেরকে যে কবর পর্যন্ত যেতে নিষেধ করা হয়েছে, তার সঙ্গে এ কথার কোনও বিরোধ নেই। কেননা প্রিয়জনের মৃত্যুকালে শোক ও বেদনা থাকে অনেক তীব্র। তাই লাশের সঙ্গে কবর পর্যন্ত গেলে নারীদের দ্বারা ধৈর্যহারা হয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পরবর্তী সময়ে কবর যিয়ারত করতে যাওয়ার বেলায় সে আশঙ্কা থাকে না। কেননা ততোদিনে শোক অনেকটা প্রশমিত হয়ে যায়। ফলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আশঙ্কা তেমন একটা থাকে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নারীরা চাইলে ঘরের ভেতর থেকে জানাযার নামাযে অংশগ্রহণ করতে পারে।

খ. নারীদের জন্য লাশের সঙ্গে কবর পর্যন্ত যাওয়া উচিত নয়।

গ. নারীদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েয।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)