রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
৭. রোগীর শুশ্রূষা ও মাইয়্যেতের প্রতি কর্তব্য
হাদীস নং: ৯২৩
পরিচ্ছেদ:৯ মায়্যিতের কাছে যা বলবে এবং যার কেউ মারা যায় তাকে যা বলতে হবে
প্রিয়জনের অসুস্থতা বা মৃত্যুতে শোকার্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা
হাদীছ নং: ৯২৩
হযরত উসামা ইবন যায়দ রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক কন্যা তাঁর কাছে লোক পাঠালেন তাকে ডাকার জন্য এবং এই খবর দেওয়ার জন্য যে, তার একটি বাচ্চা বা একটি ছেলে মৃত্যুমুখে। তিনি বার্তাবাহককে বললেন, তার কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জানাও যে, আল্লাহ তা'আলারই তা, যা তিনি নিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁরই তা, যা তিনি দান করেছেন। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্ধারিত মেয়াদ আছে। সুতরাং তাকে আদেশ করো যেন ধৈর্য ধরে এবং ছাওয়াবের আশা করে। তারপর বর্ণনাকারী পূর্ণাঙ্গ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
-বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭৩৭৭; সহীহ মুসলিম: ৯২৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৮৮; সুনানে নাসাঈ: ১৮৬২; মুসনাদুল বাযযার: ২৫৯৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৬৭০; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ৬৭১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৬১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৭১২৯)
হাদীছ নং: ৯২৩
হযরত উসামা ইবন যায়দ রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক কন্যা তাঁর কাছে লোক পাঠালেন তাকে ডাকার জন্য এবং এই খবর দেওয়ার জন্য যে, তার একটি বাচ্চা বা একটি ছেলে মৃত্যুমুখে। তিনি বার্তাবাহককে বললেন, তার কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জানাও যে, আল্লাহ তা'আলারই তা, যা তিনি নিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁরই তা, যা তিনি দান করেছেন। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্ধারিত মেয়াদ আছে। সুতরাং তাকে আদেশ করো যেন ধৈর্য ধরে এবং ছাওয়াবের আশা করে। তারপর বর্ণনাকারী পূর্ণাঙ্গ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
-বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭৩৭৭; সহীহ মুসলিম: ৯২৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৮৮; সুনানে নাসাঈ: ১৮৬২; মুসনাদুল বাযযার: ২৫৯৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৬৭০; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ৬৭১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৬১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৭১২৯)
باب ما يقال عند الميت وَمَا يقوله من مات له ميت
923 - وعن أسَامَة بن زَيدٍ رضي اللهُ عنهما، قَالَ: أرْسَلَتْ إحْدى بَنَاتِ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - إِلَيْهِ تَدْعُوهُ وَتُخْبِرُهُ أنَّ صَبِيًّا لَهَا - أَوْ ابْنًا - في المَوْتِ فَقَالَ للرسول: «ارْجِعْ إِلَيْهَا، فَأخْبِرْهَا أنَّ للهِ تَعَالَى مَا أخَذَ وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِأجَلٍ مُسَمّى، فَمُرْهَا، فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ» ... وذكر تمام الحديث. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক কন্যার পুত্র মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন। কোন কন্যার পুত্র তা বলা হয়নি। তাঁর কন্যাসন্তান ছিলেন চারজন। যায়নাব রাযি., রুকায়্যা রাযি., উম্মু কুলছুম রাযি. ও ফাতিমা রাযি.। হযরত যায়নাব রাযি.-এর স্বামী ছিলেন আবুল 'আস ইবনুর রাবী' রাযি.। আলী ও আবূ উমামা নামে তাঁদের এক পুত্র ও কন্যাসন্তান ছিল। বিভিন্ন বর্ণনাদৃষ্টে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ.-এর মতে অসুস্থ ছিলেন হযরত উমামা রাযি.। এ বর্ণনায় পুত্রসন্তানের কথা থাকলেও কোনও কোনও বর্ণনায় শিশুকন্যার উল্লেখ আছে। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় স্পষ্টভাবেই যায়নাব রাযি.-এর কন্যা উমামা রাযি.-এর নাম বলা রয়েছে। সুতরাং আলোচ্য বর্ণনাটিতে যে পুত্রের কথা বলা হয়েছে, তা বর্ণনাকারীর ভুল।
হযরত যায়নাব রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে অনুরোধ করেছিলেন সম্ভবত এই আশায় যে, হয়তো তাঁর উপস্থিতি ও দু'আর বরকতে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে আরোগ্য দান করবেন। তাছাড়া মহান পিতা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে থাকলে তিনি মনে শক্তি ও সাহস পাবেন।
কিন্তু প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন না। না আসার কারণ হয়তো প্রিয় কন্যাকে সবরের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এমনও হতে পারে যে, তখন তিনি বিশেষ কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাঁর নবুওয়াতী কাজকর্ম ছিল সুবিপুল। দীনের দাওয়াত দেওয়া, দীন কী তা বুঝিয়ে দেওয়া, সাহাবায়ে কেরামকে দীনের তা'লীম দেওয়া, সাক্ষাৎপ্রার্থীকে সাক্ষাৎকার দেওয়া, বিচার-আচার করা, বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিধি পাঠানো, জিহাদের উদ্দেশ্যে মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করা, বিভিন্ন বংশ- গোত্রের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করা, মদীনার ভেতর ও বাহিরের নানা শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়া করাসহ মদীনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম আঞ্জাম দেওয়া। ফলে তখনই তাঁর পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকে, তাদের পক্ষে এটা বোঝা খুবই সহজ।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে তখনই যাওয়া সম্ভব না হলেও তিনি প্রিয় কন্যাকে সান্ত্বনা ও সবরের একটি বাণী বলে পাঠালেন। বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ বাণী। তিনি বললেন-
أَنَّ للهِ تَعالى مَا أَخذَ ، ولهُ مَا أَعطى وكُلُّ شَىءٍ عِندهُ بأَجلٍ مُسمى
(আল্লাহ তা'আলারই তা, যা তিনি নিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁরই তা, যা তিনি দান করেছেন। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্ধারিত মেয়াদ আছে)। বাণীটিতে তিনি প্রথমে বলেছেন-
أَنَّ لِلَّهِ تَعَالَى مَا أَخَذَ وَلَهُ مَا أَعْطى (আল্লাহ তা'আলারই তা, যা তিনি নিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁরই তা, যা তিনি দান করেছেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যা নিয়ে যান তার মালিক তো তিনিই এবং তিনি যাকে যা দেন নিজ মালিকানা থেকেই দেন। যাকে দেন তার কাছে তা আমানতমাত্র। আমানতের মাল যদি মালিক নিয়ে যান, তাতে দুঃখিত হওয়া উচিত নয়। বরং এই ভেবে সান্ত্বনা বোধ করা উচিত যে, এই সম্পদের তো আমি মালিক ছিলাম না। আল্লাহ তা'আলাই মেহেরবানি করে আমাকে দান করেছিলেন। আমার কাছে যতদিন ছিল আমানতস্বরূপ ছিল। এখন সে সম্পদ তাঁর প্রকৃত মালিকের কাছেই ফিরে গেছে। তা নষ্ট হয়নি বা হারিয়েও যায়নি। তারপর বলেছেন-
وكُلُّ شَىءٍ عِندهُ بأَجلٍ مُسمى (আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্ধারিত মেয়াদ আছে)। অর্থাৎ তিনি যাকে যা দেন তা কতদিনের জন্য দেন, তার মেয়াদও তাঁর কাছে নির্ধারিত আছে। সেই মেয়াদ শেষ হলেই তিনি তা নিয়ে নেন। তার আগেও নেন না, পরেও নয়। সুতরাং এই ভেবে ধৈর্যধারণ করো যে, এ সন্তানের যদি মৃত্যু হয়, তবে নির্ধারিত সময়েই তা হবে। আর নির্ধারিত সময়ে অবশ্যই তাকে যেতেই হবে। কোনও উপায়েই তা ঠেকানো যাবে না। তাই অস্থির-উতলা না হয়ে ধৈর্যধারণ করাই শ্রেয়। এভাবে চিন্তা করলে বিপদ-আপদে, প্রিয়জনের অসুস্থতায় কিংবা সম্পদ ও সন্তান হারানোর কারণে অন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় না। বরং সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভ হয় এবং সবরের কারণে ছাওয়াবও পাওয়া যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যাকে সেই ছাওয়াব লাভের আশায় ধৈর্যধারণের উপদেশ দান করেছেন।
হাদীছটি এখানে সংক্ষিপ্ত। বিস্তারিত বর্ণনায় আছে, প্রিয় কন্যা যায়নাব রাযি. তারপরও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এবং তিনি যেন অবশ্যই আসেন, কসমের সাথে সেই অনুরোধ জানান। এর কারণ সম্ভবত যেমনটা বলা হয়েছে তাঁর আগমন দ্বারা মনে শক্তি পাওয়া এবং তাঁর দু'আর বরকতে সন্তানের সুস্থ হয়ে উঠার আশা থাকা। এরূপ আশা করা সবরের পরিপন্থি নয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সে আশা পূরণও করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষপর্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে হযরত যায়নাব রাযি.-এর বাড়িতে আসলেন। অসুস্থ শিশুকে তাঁর কোলে তুলে দেওয়া হল। শিশুটি রোগযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মমতাময় প্রাণ বিগলিত হল। আদরের নাতনীর কষ্টে তাঁরও মন কষ্টে ভরে গেল। তাঁর দু'চোখ থেকে পানি ঝড়তে লাগল। তা দেখে হযরত সা'দ ইবন উবাদা রাযি, প্রশ্নই করে বসলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে কাঁদছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, এ কান্না হল রহমত ও দয়ার প্রকাশ, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানবমনে যেহেতু সৃষ্টিগতভাবেই দয়ামায়া আছে, তাই শোকে-দুঃখে কাঁদা স্বাভাবিক। এ কান্না সে দয়ামায়ারই প্রকাশ। এতে কোনও দোষ নেই এবং এটা সবরেরও পরিপন্থি নয়। দোষ হচ্ছে বিলাপ করা ও সীমালঙ্ঘন করা।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বরকতময় হল। তাঁর দু'আয় হযরত উমামা রাযি. আরোগ্য লাভ করেন। এমনকি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও তিনি জীবিত থাকেন। হযরত ফাতিমা রাযি.- এর ওফাতের পর তাঁরই অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী রাযি. তাঁকে বিবাহ করেন।
হযরত আলী রাযি. শহীদ হওয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন। আহত অবস্থায় হযরত আলী রাযি. অসিয়ত করেছিলেন, তিনি বিবাহ করতে চাইলে যেন মুগীরা ইবন নাওফাল রাযি.-কে করেন। মুগীরা রাযি. ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হারিছের পৌত্র। অসিয়ত অনুযায়ী হযরত মুগীরা রাযি.-এর সাথে হযরত হাসান তাঁর বিবাহ সম্পাদন করেন। মুগীরা রাযি.-এর ঔরসে তিনি এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। তাঁর নাম ইয়াহইয়া। তাঁর বিবাহাধীন থাকা অবস্থায়ই হযরত উমামা রাযি. ইন্তিকাল করেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় বুযুর্গানে দীনের উপস্থিতির বরকত ও তাদের দু'আ লাভের জন্যে তাদেরকে মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট নিয়ে আসা ভালো। তাদের কষ্ট না হলে এজন্য তাদেরকে পীড়াপীড়ি করারও অবকাশ আছে।
খ. অসুস্থ ও শোকার্ত ব্যক্তিকে দেখার জন্যে অনুমতি ছাড়াও যাওয়া জায়েয আছে। এ ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন।
গ. বিপন্ন ও শোকার্ত ব্যক্তিকে সবরের উপদেশ দেওয়া উচিত। সবর করলে কী লাভ তাও শোনানো চাই।
ঘ. কাউকে নিজ বাড়িতে আসার আহ্বান জানালে কী উদ্দেশ্যে তাকে আসতে বলা হচ্ছে তা জানানো উচিত।
ঙ. কথা বলার আগে সালাম দেওয়া কর্তব্য।
চ. অসুস্থ ব্যক্তি ছোট বা অধীনস্থ হলেও তাকে দেখতে যাওয়া উচিত।
ছ. শোকে-দুঃখে সীমার ভেতর ক্রন্দন করা দূষণীয় নয়।
জ. অন্যের দুঃখ-কষ্টে সমবেদনা প্রকাশ করা প্রসংশনীয় কাজ।
ঝ. শোকার্ত ব্যক্তিকে সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানানোর জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীটি বা তার তরজমা ব্যবহার করা শ্রেয়।
হযরত যায়নাব রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে অনুরোধ করেছিলেন সম্ভবত এই আশায় যে, হয়তো তাঁর উপস্থিতি ও দু'আর বরকতে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে আরোগ্য দান করবেন। তাছাড়া মহান পিতা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে থাকলে তিনি মনে শক্তি ও সাহস পাবেন।
কিন্তু প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন না। না আসার কারণ হয়তো প্রিয় কন্যাকে সবরের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এমনও হতে পারে যে, তখন তিনি বিশেষ কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাঁর নবুওয়াতী কাজকর্ম ছিল সুবিপুল। দীনের দাওয়াত দেওয়া, দীন কী তা বুঝিয়ে দেওয়া, সাহাবায়ে কেরামকে দীনের তা'লীম দেওয়া, সাক্ষাৎপ্রার্থীকে সাক্ষাৎকার দেওয়া, বিচার-আচার করা, বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিধি পাঠানো, জিহাদের উদ্দেশ্যে মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করা, বিভিন্ন বংশ- গোত্রের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করা, মদীনার ভেতর ও বাহিরের নানা শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়া করাসহ মদীনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম আঞ্জাম দেওয়া। ফলে তখনই তাঁর পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকে, তাদের পক্ষে এটা বোঝা খুবই সহজ।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে তখনই যাওয়া সম্ভব না হলেও তিনি প্রিয় কন্যাকে সান্ত্বনা ও সবরের একটি বাণী বলে পাঠালেন। বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ বাণী। তিনি বললেন-
أَنَّ للهِ تَعالى مَا أَخذَ ، ولهُ مَا أَعطى وكُلُّ شَىءٍ عِندهُ بأَجلٍ مُسمى
(আল্লাহ তা'আলারই তা, যা তিনি নিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁরই তা, যা তিনি দান করেছেন। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্ধারিত মেয়াদ আছে)। বাণীটিতে তিনি প্রথমে বলেছেন-
أَنَّ لِلَّهِ تَعَالَى مَا أَخَذَ وَلَهُ مَا أَعْطى (আল্লাহ তা'আলারই তা, যা তিনি নিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁরই তা, যা তিনি দান করেছেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যা নিয়ে যান তার মালিক তো তিনিই এবং তিনি যাকে যা দেন নিজ মালিকানা থেকেই দেন। যাকে দেন তার কাছে তা আমানতমাত্র। আমানতের মাল যদি মালিক নিয়ে যান, তাতে দুঃখিত হওয়া উচিত নয়। বরং এই ভেবে সান্ত্বনা বোধ করা উচিত যে, এই সম্পদের তো আমি মালিক ছিলাম না। আল্লাহ তা'আলাই মেহেরবানি করে আমাকে দান করেছিলেন। আমার কাছে যতদিন ছিল আমানতস্বরূপ ছিল। এখন সে সম্পদ তাঁর প্রকৃত মালিকের কাছেই ফিরে গেছে। তা নষ্ট হয়নি বা হারিয়েও যায়নি। তারপর বলেছেন-
وكُلُّ شَىءٍ عِندهُ بأَجلٍ مُسمى (আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্ধারিত মেয়াদ আছে)। অর্থাৎ তিনি যাকে যা দেন তা কতদিনের জন্য দেন, তার মেয়াদও তাঁর কাছে নির্ধারিত আছে। সেই মেয়াদ শেষ হলেই তিনি তা নিয়ে নেন। তার আগেও নেন না, পরেও নয়। সুতরাং এই ভেবে ধৈর্যধারণ করো যে, এ সন্তানের যদি মৃত্যু হয়, তবে নির্ধারিত সময়েই তা হবে। আর নির্ধারিত সময়ে অবশ্যই তাকে যেতেই হবে। কোনও উপায়েই তা ঠেকানো যাবে না। তাই অস্থির-উতলা না হয়ে ধৈর্যধারণ করাই শ্রেয়। এভাবে চিন্তা করলে বিপদ-আপদে, প্রিয়জনের অসুস্থতায় কিংবা সম্পদ ও সন্তান হারানোর কারণে অন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় না। বরং সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভ হয় এবং সবরের কারণে ছাওয়াবও পাওয়া যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যাকে সেই ছাওয়াব লাভের আশায় ধৈর্যধারণের উপদেশ দান করেছেন।
হাদীছটি এখানে সংক্ষিপ্ত। বিস্তারিত বর্ণনায় আছে, প্রিয় কন্যা যায়নাব রাযি. তারপরও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এবং তিনি যেন অবশ্যই আসেন, কসমের সাথে সেই অনুরোধ জানান। এর কারণ সম্ভবত যেমনটা বলা হয়েছে তাঁর আগমন দ্বারা মনে শক্তি পাওয়া এবং তাঁর দু'আর বরকতে সন্তানের সুস্থ হয়ে উঠার আশা থাকা। এরূপ আশা করা সবরের পরিপন্থি নয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সে আশা পূরণও করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষপর্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে হযরত যায়নাব রাযি.-এর বাড়িতে আসলেন। অসুস্থ শিশুকে তাঁর কোলে তুলে দেওয়া হল। শিশুটি রোগযন্ত্রণায় ছটফট করছে। তা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মমতাময় প্রাণ বিগলিত হল। আদরের নাতনীর কষ্টে তাঁরও মন কষ্টে ভরে গেল। তাঁর দু'চোখ থেকে পানি ঝড়তে লাগল। তা দেখে হযরত সা'দ ইবন উবাদা রাযি, প্রশ্নই করে বসলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে কাঁদছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, এ কান্না হল রহমত ও দয়ার প্রকাশ, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানবমনে যেহেতু সৃষ্টিগতভাবেই দয়ামায়া আছে, তাই শোকে-দুঃখে কাঁদা স্বাভাবিক। এ কান্না সে দয়ামায়ারই প্রকাশ। এতে কোনও দোষ নেই এবং এটা সবরেরও পরিপন্থি নয়। দোষ হচ্ছে বিলাপ করা ও সীমালঙ্ঘন করা।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বরকতময় হল। তাঁর দু'আয় হযরত উমামা রাযি. আরোগ্য লাভ করেন। এমনকি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও তিনি জীবিত থাকেন। হযরত ফাতিমা রাযি.- এর ওফাতের পর তাঁরই অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী রাযি. তাঁকে বিবাহ করেন।
হযরত আলী রাযি. শহীদ হওয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন। আহত অবস্থায় হযরত আলী রাযি. অসিয়ত করেছিলেন, তিনি বিবাহ করতে চাইলে যেন মুগীরা ইবন নাওফাল রাযি.-কে করেন। মুগীরা রাযি. ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হারিছের পৌত্র। অসিয়ত অনুযায়ী হযরত মুগীরা রাযি.-এর সাথে হযরত হাসান তাঁর বিবাহ সম্পাদন করেন। মুগীরা রাযি.-এর ঔরসে তিনি এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। তাঁর নাম ইয়াহইয়া। তাঁর বিবাহাধীন থাকা অবস্থায়ই হযরত উমামা রাযি. ইন্তিকাল করেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় বুযুর্গানে দীনের উপস্থিতির বরকত ও তাদের দু'আ লাভের জন্যে তাদেরকে মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট নিয়ে আসা ভালো। তাদের কষ্ট না হলে এজন্য তাদেরকে পীড়াপীড়ি করারও অবকাশ আছে।
খ. অসুস্থ ও শোকার্ত ব্যক্তিকে দেখার জন্যে অনুমতি ছাড়াও যাওয়া জায়েয আছে। এ ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন।
গ. বিপন্ন ও শোকার্ত ব্যক্তিকে সবরের উপদেশ দেওয়া উচিত। সবর করলে কী লাভ তাও শোনানো চাই।
ঘ. কাউকে নিজ বাড়িতে আসার আহ্বান জানালে কী উদ্দেশ্যে তাকে আসতে বলা হচ্ছে তা জানানো উচিত।
ঙ. কথা বলার আগে সালাম দেওয়া কর্তব্য।
চ. অসুস্থ ব্যক্তি ছোট বা অধীনস্থ হলেও তাকে দেখতে যাওয়া উচিত।
ছ. শোকে-দুঃখে সীমার ভেতর ক্রন্দন করা দূষণীয় নয়।
জ. অন্যের দুঃখ-কষ্টে সমবেদনা প্রকাশ করা প্রসংশনীয় কাজ।
ঝ. শোকার্ত ব্যক্তিকে সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানানোর জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীটি বা তার তরজমা ব্যবহার করা শ্রেয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
