রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭১৭
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
ইস্তিখারা ও মাশওয়ারা

اَلْإِسْتِخَارَةُ অর্থ কল্যাণ প্রার্থনা করা। আমরা যে কাজ করতে চাই, সেটি আমার জন্য কল্যাণকর কি না, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারি না। আমাদের জ্ঞান বড় কম। তাই আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ
‘এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমরা একটা জিনিসকে মন্দ মনে কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা মঙ্গলজনক। আর এটাও সম্ভব যে, তোমরা একটা জিনিসকে পসন্দ কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা মন্দ।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২১৬)
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। প্রকাশ্য-গুপ্ত যাবতীয় বিষয়ে তিনি পরিপূর্ণ অবহিত। আমাদের জন্য কোনটা মঙ্গলজনক কোনটা ক্ষতিকর, তার পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে। তাই আমরা যে কাজ করতে চাই সে বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালার ভার আল্লাহর উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। অর্থাৎ তাঁর কাছে এই দু'আ করা যে, কাজটি করার মধ্যে যদি কল্যাণ নিহিত থাকে, তবে তিনি যেন সেটি করিয়ে দেন। আর যদি কল্যাণ থাকে তা না করার ভেতর, তবে তিনি যেন তা সরিয়ে দেন। এ দু'আকে ইস্তিখারা বলা হয়। যে-কোনও কাজ করা না করা কিংবা একাধিক বিষয়ের মধ্যে কোনও একটি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল নিজ বুদ্ধি-বিবেকের উপর নির্ভরশীল না হয়ে ইস্তিখারা করা অর্থাৎ আল্লাহর কাছে দু'আ করার মাধ্যমেই আমাদেরকে সামনে বাড়তে বলা হয়েছে। তাতে সে কাজ বা সে বিষয়টি যত সাধারণই হোক না কেন। কেননা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ এমন বহু কাজই আছে, যা করার মধ্যে বিপুল ক্ষতি নিহিত থাকে। অপরদিকে এমন বহু তুচ্ছ বিষয়ই আছে, যা না করা হলে অনেক বড় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। তাই যাবতীয় বিষয়েই ইস্তিখারা করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। বলা হয়ে থাকে, ওই ব্যক্তি কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, যে ইস্তিখারার সঙ্গে কাজ করে। কাজেই ইস্তিখারা করতে অলসতা করা উচিত নয়। কোনও কারণে পূর্ণাঙ্গ ইস্তিখারা করতে না পারলে অন্তত এই দু'আর সঙ্গে কাজ করা উচিত যে- اَللّهُمَّ خِرْ لِي وَاخْتَرْ لِي (হে আল্লাহ! আমার জন্য কল্যাণের ফয়সালা করুন এবং আমার যা করণীয়, আপনিই তা নির্ধারণ করুন)।(জামে' তিরমিযী: ৩৫১৬; মুসনাদুল বাযযার ৫৯; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৪)
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতে যে কাজের সুস্পষ্ট আদেশ করা হয়েছে বা নিষেধ করা হয়েছে, তাতে ইস্তিখারা নেই। যেমন নামায পড়ব কি পড়ব না, হজ্জ আদায় করব কি করব না, সুদ-ঘুষ পরিহার করব কি না, এ বিষয়ে ইস্তিখারা করা জায়েযই নয়। হাঁ, হজ্জের বেলায় এ বিষয়ে ইস্তিখারা করা যেতে পারে যে, হজ্জ এ বছর করব না আগামী বছর, জাহাজে যাব না প্লেনে।
যে কাজে শরী'আতের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনও হুকুম নেই, বরং তা করা না করার বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ইস্তিখারা কেবল এরকম কাজেই মুস্তাহাব। যেমন কোনও চাকরির বেলায় সেটি করা বা না করা সম্পর্কে ইস্তিখারা করা। বিবাহে কোনও পাত্র বা পাত্রী সম্পর্কে আলোচনা হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে ইস্তিখারা করা। কোনও জমি ক্রয়ের ইচ্ছা করা হলে সেটি কিনব কি কিনব না, এ বিষয়ে ইস্তিখারা করা ইত্যাদি।
ইস্তিখারার নিয়ম হল দু'রাকাত নফল নামায পড়ে হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পড়া। ইস্তিখারায় স্বপ্নে দেখার বিষয়টি কোনও হাদীছে নেই। অনেকে মনে করে ইস্তিখারার পর যা স্বপ্নে দেখা হবে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এ ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। এমনিভাবে ইস্তিখারা করলে কোনও একদিকে মন ঝুঁকতে হবে এমন কোনও কথাও নেই। কোনও কোনও বর্ণনায় এরূপ কথা থাকলেও সে বর্ণনা সহীহ নয়।
প্রকৃতপক্ষে কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত মাশওয়ারার ভিত্তিতে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় শরী'আত মাশওয়ারার খুব গুরুত্ব দিয়েছে। কাজেই একইসঙ্গে ইস্তিখারা ও মাশওয়ারা উভয়ই করা চাই। করা হবে তাই, যা মাশওয়ারায় ফয়সালা হয়। ইস্তিখারার ফায়দা হল সে ফয়সালাটি যদি মঙ্গলজনক হয়, তবে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তা সম্পন্ন করার তাওফীক লাভ হবে। আর মঙ্গলজনক না হলে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে এমন কোনও বাধা দাঁড়িয়ে যাবে, যদ্দরুন সে কাজটি করা হবে না। তাছাড়া ইস্তিখারা করলে মাশওয়ারার ভেতরেও বরকত হবে। অর্থাৎ মাশওয়ারার ফয়সালাটি মঙ্গলজনক হবে। তাই কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে মাশওয়ারা করতে কিছুতেই অবহেলা করতে নেই।
পরামর্শ খুবই কল্যাণকর। কেননা বুদ্ধি-বিবেচনায় সকল লোক সমান নয়। একজন অপেক্ষা অন্যজন বেশি বুদ্ধিমান ও বেশি বিচক্ষণ হয়ে থাকে। কাজেই কোনও বিষয়ে বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শ করা হলে সে বিষয়ের সকল দিক সামনে চলে আসে। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দিকসমূহ পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে তুলনামূলক নিখুঁত ও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ সহজ হয়। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি কোনও কাজ করার ইচ্ছা করে এবং পরামর্শের ভিত্তিতে সে তা করা বা না করার সিদ্ধান্ত নেয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে সে যথার্থ ও উপকারী পন্থার নির্দেশনা লাভ করে। অপর এক বর্ণনায় আছে, যদি সঠিক পথের দিশা পেতে চাও, তবে বুদ্ধিমান ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করো। তোমরা বুদ্ধিমান ব্যক্তির মতামত প্রত্যাখ্যান করো না। তাহলে পস্তাতে হবে।
ইস্তিখারা ও মাশওয়ারার কল্যাণকরতা ও বহুবিধ ফায়দা একটি পরীক্ষিত বিষয়। কুরআন ও হাদীছে আমাদেরকে এর উপর আমল করার নির্দেশ ও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রিয়াযুস সালেহীনের এ পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই।


‘ইস্তিখারা ও মাশওয়ারা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত

এক নং আয়াত
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
অর্থ: এবং (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করতে থাকো।(সূরা আলে ‘ইমরান (৩), আয়াত ১৫৯)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। الْأَمْرِ শব্দের অর্থ গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তা লেনদেন বিষয়ে হোক, শাসনকার্য সম্পর্কে হোক বা অন্য কোনও বিষয়ে। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তো ওহী আসত, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি ওহীর অপেক্ষা করতে পারতেন, আল্লাহ তা'আলাই ওহীর মাধ্যমে তাঁকে নির্দেশনা দান করতেন, এ অবস্থায় অন্য কারও সঙ্গে তাঁর পরামর্শ করার প্রয়োজন হবে কেন? কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর নিজের পরামর্শের কোনও প্রয়োজন ছিল না। তাঁকে এ হুকুম করা হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের মনস্তুষ্টির জন্য। কিন্তু প্রকৃত বিষয় তা নয়। এমনিতে তো দীনী বিষয়সমূহে সাধারণত আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাঁকে ওহীর মাধ্যমেই নির্দেশনা দান করা হত। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সিদ্ধান্তগ্রহণের বিষয়টি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজ বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হত। এ আয়াতে হুকুম করা হয়েছে, তিনি যেন এরূপ ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাই করতেন। যেমন বদরের যুদ্ধে তিনি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধবন্দীদের বিষয়েও তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।
ওহীর জ্ঞান ছাড়াও আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা দান করেছিলেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অন্যের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই যে-কোনও বিষয়ে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তা সত্ত্বেও যে তাঁকে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে, এর একটা উদ্দেশ্য উম্মতকে শিক্ষাদান করা যে, তারা যেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
প্রকাশ থাকে যে, পরামর্শ করার এ আদেশ কেবল এমনসব বিষয়ে প্রযোজ্য, যে বিষয়ে কুরআন ও হাদীছে সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশনা নেই। যেসব বিষয়ে কুরআন ও হাদীছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, তাতে পরামর্শের কোনও প্রয়োজন নেই। বরং এরূপ বিষয়ে পরামর্শ করা জায়েযই নয়।

আয়াতটির শিক্ষা
কুরআন ও হাদীছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

দুই নং আয়াত
وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
অর্থ: এবং যাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হয়।(সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৩৮)

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আখিরাতে আল্লাহ তা'আলার কাছে কল্যাণপ্রাপ্ত লোকদের আরেকটা গুণ হল, তারা পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কুরআন-হাদীছে সুনির্দিষ্ট বিধান দেওয়া হয়নি, তাতে তারা পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা রাষ্ট্রীয় বিষয় হোক বা পারিবারিক বিষয়। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা। শাসকের জন্য এ ধরার অনুসরণ অপরিহার্য। ফকীহগণের মতে যে শাসক পরামর্শের তোয়াক্কা করে না, তার ক্ষমতায় থাকার কোনও অধিকার থাকে না। সে বরখাস্তের উপযুক্ত হয়ে যায়।
রাষ্ট্র পরিচালনা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছুতেই পরামর্শ ছাড়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন নয়। ইমাম জাসসাস রহ. আহকামুল কুরআন গ্রন্থে বলেন, এ আয়াত দ্বারা পরামর্শের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন কোনও কাজে তাড়াহুড়া না করে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিই। নিজের মতকে প্রাধান্য না দিয়ে বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শ করি।
পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করলে ভুলত্রুটি কম হয়। তাতে কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়। সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থাটি পরামর্শের দ্বারাই খুঁজে পাওয়া যায়। কোনও ব্যক্তি যত বুদ্ধিমানই হোক, প্রত্যেক বিষয়ের ভালোমন্দ সকল দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠা অনিবার্য নয়। বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শ করলে সকল দিক সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়। তাই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বার্থে পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পরামর্শ পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষায়ও সহায়ক। কেননা যার সঙ্গে পরামর্শ করা হয় সে উপলব্ধি করতে পারে যে, তাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং তার মতামতকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এতে করে পরামর্শপ্রার্থীর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই তার অন্তরে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। এভাবে পরামর্শ উভয়কে কাছাকাছি নিয়ে আসে। পারিবারিক সম্প্রীতিতেও পরামর্শ বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেসব পরিবার পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, সেসব পরিবারে শান্তি-শৃঙ্খলা তুলনামূলক বেশি থাকে। তাই সুখী পরিবার গড়ার লক্ষ্যে পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এতে করে কেবল দুনিয়ার সুখই নয়; পরকালীন কল্যাণও নিশ্চিত হয়। ঝগড়াঝাটি কেবল ইহজীবনেই ক্ষতি বয়ে আনে না; পরকালকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সে ক্ষতি থেকে বাঁচাটা বেশি জরুরি। সুতরাং সে লক্ষ্যেও পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতে অভ্যস্ত হওয়া দরকার।

আয়াতটির শিক্ষা
পরামর্শ করা প্রকৃত মুমিনের গুণ। এ গুণ মানুষের ইহলোক ও পরলোকের সাফল্য বয়ে আনে। তাই আমাদেরকে অবশ্যই এ গুণের চর্চা করতে হবে।
হাদীছ নং: ৭১৮
হযরত জাবির রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাবতীয় বিষয়ে আমাদেরকে ইস্তিখারার শিক্ষাদান করতেন ঠিক কুরআন মাজীদের সূরার মতো। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোনও কাজের ইচ্ছা করে, তখন যেন ফরযের অতিরিক্ত দু'রাকাত নামায পড়ে নেয়, তারপর বলে- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কল্যাণ চাই আপনার জ্ঞানের সাহায্যে, আপনার কাছে শক্তি চাই আপনার শক্তির সাহায্যে, এবং আপনার কাছে আপনার মহা অনুগ্রহ থেকে অনুগ্রহ কামনা করি। আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতা রাখেন। আমি কোনও ক্ষমতা রাখি না। আপনি জানেন, আমি জানি না। আপনি যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে মহাজ্ঞানী। হে আল্লাহ! আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা ও আমার পরিণামের দিক থেকে কল্যাণকর হয়, অথবা বলেছেন, আমার দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে (কল্যাণকর হয়), তবে আমার জন্য এর ব্যবস্থা করে দিন এবং আমার পক্ষে এটা সহজ করে দিন। তারপর এতে আমাকে বরকত দান করুন। পক্ষান্তরে আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা ও আমার পরিণামের দিক থেকে অনিষ্টকর হয়, অথবা বলেছেন, আমার দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে (অনিষ্টকর হয়), তবে এটা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকেও এর থেকে সরিয়ে দিন। এবং আমার জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা করুন, তা যেখানেই থাকে। তারপর আমাকে তাতে সন্তুষ্ট করে দিন। বর্ণনাকারী বলেন, এতে নিজ প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৬৩৮২; সুনানে আবু দাউদ: ১৫৩৮; সুনানে নাসাঈ: ৩২৫৩; জামে' তিরমিযী: ৪৮০; সুনানে ইবন মাজাহ ১৩৮৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৯৪০২; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮৮২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১০০১২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪৯২১)
كتاب الأدب
باب الاستِخارة والمشاورة
قَالَ الله تَعَالَى: {وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ} [آل عمران: 159]، وقال الله تَعَالَى: {وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ} [الشورى: 38] أيْ: يَتَشَاوَرُونَ بَيْنَهُمْ فِيهِ.
717 - وعن جابر - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - يُعَلِّمُنَا الاسْتِخَارَةَ في الأمُورِ كُلِّهَا كَالسُّورَةِ مِنَ القُرْآنِ، يَقُولُ: «إِذَا هَمَّ أحَدُكُمْ بِالأمْرِ، فَلْيَركعْ ركْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الفَرِيضَةِ، ثُمَّ ليقل: اللَّهُمَّ إنِّي أسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وأسْألُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيْمِ، فَإنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أعْلَمُ، وَأنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ. اللَّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هَذَا الأمْرَ خَيْرٌ لِي في دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أمْرِي» أَوْ قَالَ: «عَاجِلِ أمْرِي وَآجِلِهِ، فاقْدُرْهُ لي وَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ. وَإنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي في دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي» أَوْ قَالَ: «عَاجِلِ أمْرِي وَآجِلِهِ؛ فَاصْرِفْهُ عَنِّي، وَاصْرِفْنِي عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِيَ الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أرْضِنِي بِهِ» قَالَ: «وَيُسَمِّيْ حَاجَتَهُ». رواه البخاري. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি দ্বারা অনুমান করা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইস্তিখারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যে গুরুত্বের সঙ্গে তিনি কুরআন মাজীদের সূরা শেখাতেন, সেরকম গুরুত্বের সঙ্গে ইস্তিখারাও শেখাতেন। এতে ইস্তিখারার নিয়ম শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এরকম যে, প্রথমে দু'রাকাত নফল নামায পড়তে হবে। তারপর এ হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পড়তে হবে। যে-কোনও দু'আয় কিবলামুখী হওয়া উত্তম। কাজেই নফল নামাযের পর কিবলামুখী থাকা অবস্থায়ই দু'আটি পড়া চাই। দু'আর আগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম অর্থাৎ দরূদ শরীফ পড়ে নেওয়া উত্তম। এ ক্ষেত্রেও তাই করবে। হাদীছটিতে দু'আটির বর্ণনায় শব্দগত কিছু পার্থক্য আছে। সে পার্থক্যের কারণে দু'আটি দু'রকম হয়। নিচে দু'রকম শব্দেই আলাদা আলাদাভাবে দু'আটির উল্লেখ করা গেল।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ ، وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي ، فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِي ، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيْهِ. وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي، فَاصْرِفْهُ عني، وَاصْرِفْنِي عَنْهُ ، وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِي بِهِ
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কল্যাণ চাই আপনার জ্ঞানের সাহায্যে, আপনার কাছে শক্তি চাই আপনার শক্তির সাহায্যে, এবং আপনার কাছে আপনার মহা অনুগ্রহ থেকে অনুগ্রহ কামনা করি। আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতা রাখেন। আমি কোনও ক্ষমতা রাখি না। আপনি জানেন, আমি জানি না। আপনি যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে মহাজ্ঞানী। হে আল্লাহ! আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা ও আমার পরিণামের দিক থেকে কল্যাণকর হয়, তবে আমার জন্য এর ব্যবস্থা করে দিন এবং আমার পক্ষে এটা সহজ করে দিন। তারপর এতে আমাকে বরকত দান করুন। পক্ষান্তরে আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা ও আমার পরিণামের দিক থেকে অনিষ্টকর হয়, তবে এটা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকেও এর থেকে সরিয়ে দিন। এবং আমার জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা করুন, তা যেখানেই থাকে। তারপর আমাকে তাতে সন্তুষ্ট করে দিন।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ ، وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ، فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ. وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ ، فَاصْرِفْهُ عَنِّي ، وَاصْرِفْنِي عَنْهُ ، وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِي بِهِ.
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কল্যাণ চাই আপনার জ্ঞানের সাহায্যে, আপনার কাছে শক্তি চাই আপনার শক্তির সাহায্যে, এবং আপনার কাছে আপনার মহা অনুগ্রহ থেকে অনুগ্রহ কামনা করি। আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতা রাখেন। আমি কোনও ক্ষমতা রাখি না। আপনি জানেন, আমি জানি না। আপনি যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে মহাজ্ঞানী। হে আল্লাহ! আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা এবং আমার দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে কল্যাণকর হয়, তবে আমার জন্য এর ব্যবস্থা করে দিন এবং আমার পক্ষে এটা সহজ করে দিন। তারপর এতে আমাকে বরকত দান করুন। পক্ষান্তরে আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা এবং আমার দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে অনিষ্টকর হয়, তবে এটা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকেও এর থেকে সরিয়ে দিন। এবং আমার জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা করুন, তা যেখানেই থাকে। তারপর আমাকে তাতে সন্তুষ্ট করে দিন।

দু'আটিতে দুই জায়গায় هَذَا الْأَمْرَ (এ বিষয়টি) আছে। দু'আটি পড়ার সময় এ শব্দ না বলে যে বিষয়ে ইস্তিখারা করা হয়, সে বিষয়টি উল্লেখ করবে।

দু'আটির ব্যাখ্যা

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ (হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কল্যাণ চাই আপনার জ্ঞানের সাহায্যে)। অর্থাৎ যে বিষয়টি আমার সামনে এসেছে তা আমার জন্য ভালো না মন্দ আমি তা জানি না। এর খুঁটিনাটি সকল দিক আমার সামনে নেই। আপনি প্রত্যেকটি বিষয়ের যাবতীয় দিক সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। আপনি আপনার সে পরিপূর্ণ জ্ঞানের দ্বারা আমার জন্য কল্যাণের ফয়সালা করুন। আমার জন্য যা করণীয়, আমার অন্তরে তা স্পষ্ট করে দিন।

وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ (আপনার কাছে শক্তি চাই আপনার শক্তির সাহায্যে)। অর্থাৎ আমার পক্ষে যেটি কল্যাণকর, আমাকে তা করার শক্তি দিন। সকল বিষয়ে আপনি সর্বশক্তিমান। আপনি যাকে শক্তিদান করেন, সেই শক্তি পায়। আপনি শক্তি না দিলে কারও পক্ষে কোনওকিছু করা সম্ভব নয়।

وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ (এবং আপনার কাছে আপনার মহা অনুগ্রহ থেকে অনুগ্রহ কামনা করি)। অর্থাৎ আপনি মহা অনুগ্রহশীল। আপনি নিজ অনুগ্রহে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাকে জ্ঞান ও শক্তিদান করুন। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রেই আমি আপনার অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী।

فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ (আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতা রাখেন। আমি কোনও ক্ষমতা রাখি না)। অর্থাৎ সম্ভাব্য সকল বিষয়েই আপনার ক্ষমতা আছে। আপনি যা করতে চান তাই করার ক্ষমতা রাখেন। আপনার ইচ্ছা কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। অপরদিকে আমি এক দুর্বল বান্দা। আমার নিজস্ব কোনও ক্ষমতা নেই। আপনি আমাকে যতটুকু দেন, আমার ক্ষমতা কেবল ততটুকুই। আপনি আমাকে যা করার ক্ষমতা দেন, আমি কেবল তাই করতে পারি, তার বেশি নয়।

وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوْبِ (আপনি জানেন, আমি জানি না। আপনি যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে মহাজ্ঞানী)। কুল মাখলুকাতের প্রতিটি বিষয়ে আপনি পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। মহাজগতের যা-কিছু আমাদের দৃষ্টির আড়ালে, সেসব সম্পর্কেও আপনার জ্ঞান পরিপূর্ণ। মহাবিশ্বের ছোট-বড় কোনওকিছুই আপনার জ্ঞানের বাইরে নয়। অন্যদিকে আমি আপনার এক অজ্ঞ বান্দা। আপনি আমাকে যতটুকু জ্ঞান দেন আমি কেবল ততটুকুই জানি, তার বেশি নয়। কাজেই যে বিষয়ে আমি ইস্তিখারা করছি, তার যা-কিছু আমার দৃষ্টির আড়ালে আছে, সে সম্পর্কে আমি পরিপূর্ণ অজ্ঞ। সুতরাং আপনি নিজ জ্ঞানে আমাকে এ বিষয়ের জ্ঞান দান করুন এবং যা কল্যাণকর, আমাকে তা করার শক্তি দিন।
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي (হে আল্লাহ! আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা ও আমার পরিণামের দিক থেকে কল্যাণকর হয়)। অর্থাৎ যে কাজটি আমি করতে যাচ্ছি (যেমন সফরে যাওয়া, কোনও ব্যবসা শুরু করা, কোনও চাকরি বেছে নেওয়া, কোথাও বিবাহ করা অর্থাৎ পাত্রী বা পাত্র নির্বাচন করা ইত্যাদি), তা যদি আমার দীনদারি ও জীবিকার জন্য ক্ষতিকর না হয় এবং এর কারণে আখিরাতে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয় কিংবা ভবিষ্যতে এটা কোনও ক্ষতির কারণ না হয়।

فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ (তবে আমার জন্য এর ব্যবস্থা করে দিন এবং আমার পক্ষে এটা সহজ করে দিন। তারপর এতে আমাকে বরকত দান করুন)। অর্থাৎ এটা যাতে আমি করতে পারি, সেই ফয়সালা আপনি করুন এবং এটা করার জন্য যা-কিছু আসবাব-উপকরণের দরকার হয় তারও ব্যবস্থা করে দিন। আর এর সম্মুখ থেকে সকল জটিলতা সরিয়ে দিয়ে আমাকে এটা সহজে করে ফেলার তাওফীক দান করুন। তারপর এ বিষয়টি যেন আমার জন্য বরকতপূর্ণ হয়, এটা যেন আমার জন্য সুফল বয়ে আনে এবং এটা সবরকম ক্ষতি ও অনিষ্টকরতা থেকে মুক্ত থাকে, সেই মেহেরবানীও আপনি করুন।

وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي، فَاصْرِفْهُ عني، وَاصْرِفْنِي عَنْهُ (পক্ষান্তরে আপনার জ্ঞান অনুযায়ী যদি এ বিষয়টি আমার পক্ষে আমার দীন, আমার জীবিকা ও আমার পরিণামের দিক থেকে অনিষ্টকর হয়, তবে এটা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকেও এর থেকে সরিয়ে দিন)। অর্থাৎ এসকল দিক থেকে ক্ষতিকর হলে আপনি আপনার কুদরত ও হিকমত দিয়ে এ বিষয়টি আমার থেকে সরিয়ে দিন। আবার এটা যদি সরে যায় কিন্তু আমার নিজের মন এর থেকে না সরে; বরং মন বার বার এদিকেই ছুটে যায়, তবে তা আমার জন্য কঠিন পেরেশানির কারণ হবে। তাই এটাকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আমার নিজেকেও এর থেকে সরিয়ে দিন। আমার মন থেকে এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ মুছে দিন। যাতে আমার মন শান্ত থাকতে পারে এবং আমি স্বস্তিবোধ করতে পারি।

وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ (এবং আমার জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা করুন, তা যেখানেই থাকে)। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে আমার জন্য যা কল্যাণকর, যার ভেতর নিহিত আছে ছাওয়াব ও আপনার সন্তুষ্টি, তা যেখানেই থাকুক এবং যে সময়েই হোক, আমি যাতে তা করতে পারি সে ফয়সালা আপনি করুন এবং তা করার শক্তিও আমাকে দিন।

ثُمَّ أَرْضِنِي بِه (তারপর আমাকে তাতে সন্তুষ্ট করে দিন)। অর্থাৎ আমি যেন খুশিমনে তা গ্রহণ করতে পারি, আমি যেন আপনার সে নি'আমতকে কিছুতেই তুচ্ছ গণ্য না করি, তা নিয়ে যেন আমি কারও সঙ্গে হাসাদ না করি; বরং সর্বান্তকরণে ও সন্তুষ্টির সঙ্গে আমি তা মেনে নিতে পারি, আমাকে সেই তাওফীক দান করুন। তাতে তার পরিমাণ যাই হোক এবং তা অবিলম্বে হোক বা বিলম্বে।

وَعَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ (এবং আমার দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে কল্যাণকর হয়)। عاجل মানে নগদ। বোঝানো উদ্দেশ্য দুনিয়া। আর آجل মানে বাকি। অর্থাৎ আখিরাত। দুনিয়ায় আমরা বর্তমানে আছি। তাই একে 'নগদ' নামে অভিহিত করা হয়েছে।

আর আখিরাত মৃত্যুর পরে আসবে। তাই তাকে 'বাকি' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তো এ নগদ ও বাকি তথা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের পক্ষে যা কল্যাণকর, এ দু'আর ভেতর তাই চাওয়া হয়েছে। দুনিয়ার কল্যাণও জরুরি। কেননা দুনিয়ায় অকল্যাণ ও অমঙ্গলে জর্জরিত হতে থাকলে মানুষের পক্ষে আখিরাতের কল্যাণজনক কাজে মন দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই আখিরাতের কল্যাণের স্বার্থেই দুনিয়ার কল্যাণও জরুরি। ইসলামী শরী'আতের অনুসরণ মানুষের আখিরাতের কল্যাণের পাশাপাশি দুনিয়ার কল্যাণও নিশ্চিত করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ইস্তিখারার এ দু'আটির মধ্যে বান্দার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। যেমন-
ক. এর মধ্যে রয়েছে বান্দার নিজ অজ্ঞতা ও আল্লাহ তা'আলার সর্বব্যাপী জ্ঞানের স্বীকারোক্তি। কাজেই কোনও অবস্থায়ই নিজ জ্ঞানের অহমিকা দেখানো উচিত নয়। বরং সর্বাবস্থায় নিজ অজ্ঞতা বা জ্ঞানের কমতি ঘোচানোর জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে জ্ঞানবৃদ্ধির দু'আ করা উচিত।

খ. দু'আটিতে স্বীকার করা হয়েছে যে, আমার কোনও ক্ষমতা নেই, আল্লাহ তা'আলাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাই ক্ষমতার বড়াই না দেখিয়ে সর্বদা আল্লাহর সামনে নিজ অক্ষমতা প্রকাশ ও বিনয় প্রদর্শন করা উচিত। আল্লাহ তা'আলা বিনয়ীকে পসন্দ করেন।

গ. বান্দা যেহেতু জ্ঞান ও ক্ষমতায় দুর্বল, তাই গুরুত্বপূর্ণ কাজের বেলায় নিজ জ্ঞান-বুদ্ধির প্রতি অতি আস্থার পরিচয় না দিয়ে বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শ ও আল্লাহ তা'আলার কাছে ইস্তিখারা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

ঘ. বান্দা যেহেতু পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে না, তাই এমন হতে পারে যে, সে যে বিষয়টিকে নিজের জন্য কল্যাণকর ভাবছে, প্রকৃতপক্ষে তার জন্য তা ক্ষতিকর। আবার সে যে বিষয়টিকে নিজের জন্য ক্ষতিকর ভাবছে, বাস্তবে তার জন্য সেটাই উপকারী। তাই সর্বদা আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় খুশি থাকা উচিত।

ঙ. প্রকৃত কল্যাণ সেটাই, যা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের পক্ষে শুভ হয়। তাই কোনওকিছুতে কেবল দুনিয়ার লাভ দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে নেই। তা আখিরাতের জন্য লাভজনক কি না, তাও ভাবতে হবে।

চ. কোনও কোনও জিনিস উপস্থিত লাভজনক মনে হয়। কিন্তু তার পরিণাম ভালো হয় না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় পরিণামও ভেবে দেখা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)