রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭১৬
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১৩ আপনজনকে বিদায় দেওয়া, সফর বা অন্য কোনও উপলক্ষ্যে বিচ্ছেদকালে তাকে অসিয়ত করা, তার জন্য দু'আ করা এবং তার কাছে দু'আ চাওয়া
সফরে গমনেচ্ছু ব্যক্তির জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিনটি দু‘আ
হাদীছ নং: ৭১৬

হযরত আনাস রাযি. বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সফরের ইচ্ছা করেছি। আমাকে পাথেয় দিন। তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাকে তাকওয়ার পাথেয় দান করুন। সে বলল, আমাকে আরও বেশি কিছু দিন। তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার গুনাহ মাফ করুন। সে বলল, আরও বেশি দিন। তিনি বললেন, তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহ তোমার জন্য কল্যাণপ্রাপ্তি সহজ করুন। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ৩৪৪৪; মুসনাদুল বাযযার ৬৯৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা ২৫৩২; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লাহ: ৫০২; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ২৪৭৭)
كتاب الأدب
باب وداع الصاحب ووصيته عند فراقه للسفر وغيره والدعاء لَهُ وطلب الدعاء مِنْهُ
716 - وعن أنسٍ - رضي الله عنه - قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النبي - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: يَا رسولَ الله، إنّي أُرِيدُ سَفَرًا، فَزَوِّدْنِي، فَقَالَ: «زَوَّدَكَ الله التَّقْوَى» قَالَ: زِدْنِي قَالَ: «وَغَفَرَ ذَنْبَكَ» قَالَ: زِدْنِي، قَالَ: «وَيَسَّرَ لَكَ الْخَيْرَ حَيْثُمَا كُنْتَ». رواه الترمذي (1)، وقال: «حديث حسن».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

জনৈক সাহাবী সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে পাথেয় চাইলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দু‘আ করলেন-
زَوَّدَكَ الله التَّقْوَى (আল্লাহ তোমাকে তাকওয়ার পাথেয় দান করুন)। এ দু'আর দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় সেই সাহাবী কোনও বস্তুগত পাথেয় চাননি। অর্থাৎ পথখরচা ও রসদ চাওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য সেরকম হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল দু'আ করেই ক্ষান্ত হতেন না; বরং কিছু না কিছু পথখরচা অবশ্যই দিতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ওই সাহাবীর পথখরচার প্রয়োজন নেই; তার প্রয়োজন দু'আর। তাই তিনি এ দু'আ করলেন। দু'আও করেছেন তাকওয়া সম্পর্কে। আল্লাহ তা'আলা যেন তাকে তাকওয়ার অধিকারী করেন। তাকওয়া মানে আল্লাহভীরুতা। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার ভয়ে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তাকওয়াকে পাথেয় বলা হয়েছে। বরং এটা উত্তম পাথেয়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى
‘বস্তুত তাকওয়াই উৎকৃষ্ট পাথেয়।’ (সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৯৭)
কেননা বস্তুগত পাথেয় অর্থাৎ টাকা-পয়সা মানুষের ইহজীবন রক্ষার কাজে লাগে। ইহজীবন ক্ষণস্থায়ী। আখিরাতের জীবন স্থায়ী। সে স্থায়ী জীবন রক্ষার জন্য তাকওয়ার প্রয়োজন। কেননা তাকওয়া দ্বারা মানুষের ঈমান-আমল রক্ষা হয়। ঈমান-আমল রক্ষা হলে আখিরাতে মানুষ জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাতের অধিকারী হয়। কাজেই বস্তুগত পাথেয়র চেয়ে তাকওয়ার পাথেয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'আপ্রার্থী সাহাবীর জন্য দু'আ করেছেন যেন আল্লাহ তা'আলা তাকে পুরোটা সফরে তাকওয়ার সঙ্গে রাখেন।

সাহাবী আরও দু'আ চাইলেন। তিনি দু'আ করলেন- وَغَفَرَ ذَنْبَكَ (আল্লাহ তোমার গুনাহ মাফ করুন)। অর্থাৎ তাকওয়ার পাথেয় থাকলে ভবিষ্যতে তোমার দ্বারা কোনও গুনাহ হবে না। কিন্তু অতীতের যে গুনাহ হয়ে গেছে তা থেকে তো মাফ পাওয়া দরকার। কেননা সে গুনাহ থেকে গেলে আখিরাতে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অতীত গুনাহর জন্য মাগফিরাতের দু'আ করেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা তোমার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দিন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দু'আ চাচ্ছেন আর তিনিও দু'আ করছেন। এ তো এমন এক প্রাপ্তি, যাতে তৃষ্ণা মেটার কথা নয়। এজন্য যত পাওয়া যায় ততোই আরও পাওয়ার সাধ জাগে। তাই সাহাবী আবারও দু'আ চাইলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরক্ত হলেন না। তাকে নিরাশ করলেন না। ফের দু'আ করলেন- وَيَسَّرَ لَكَ الْخَيْرَ حَيْثُمَا كُنْتَ (তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহ তোমার জন্য কল্যাণপ্রাপ্তি সহজ করুন)। অর্থাৎ তুমি ঘরে থাক আর বাইরে থাক, যেখানেই থাক না কেন, তুমি যেন দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণ সবটাই অনায়াসে পেয়ে যাও। তা পেয়ে যাওয়াকে আল্লাহ তা'আলা তোমার জন্য সহজ করে দিন। এ এমন এক পূর্ণাঙ্গ দু'আ, যার পর আর কিছু বাকি থাকে না। এরপর এমন কী আর থাকতে পারে, যার জন্য দু'আর আবেদন জানানো যায়? কাজেই সাহাবীর তৃষ্ণা মিটে গেল। তিনি ক্ষান্ত হলেন। তিনি যা চাইতে পারতেন আর যা পারতেন না, হয়তো কল্পনায়ও আসত না, তা সবই এ দু'আর মধ্যে এসে গেছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের জন্যও দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বপ্রকার কল্যাণপ্রাপ্তিকে সহজ করে দিন। আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছে সফরযাত্রীর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তিনটি দু'আ করেছেন, আমরাও সে দু'আ করতে পারি। একসঙ্গে তা হবে এরকম-
زَوَّدَكَ اللهُ التَّقْوَى، وَغَفَرَ ذَنْبَكَ ، وَيَسَّرَ لَكَ الْخَيْرَ حَيْثُمَا كُنْتَ
‘আল্লাহ তোমাকে তাকওয়ার পাথেয় দান করুন। আল্লাহ তোমার গুনাহ মাফ করুন। তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহ তোমার জন্য কল্যাণপ্রাপ্তি সহজ করুন'।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৭১৬ | মুসলিম বাংলা