রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৬৩
অধ্যায় : ৮০ আল্লাহর অবাধ্যতা হয় না এমন কাজে শাসকের আনুগত্য করার আবশ্যিকতা এবং আল্লাহর অবাধ্যতা হয় এমন কাজে আনুগত্য করার নিষিদ্ধতা
সামর্থ্য অনুযায়ী আমীর ও শাসকের আনুগত্য করার বাধ্যবাধকতা
হাদীছ নং: ৬৬৩

হযরত ইবনে উমর রাযি. বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইয়ি ওয়াসাল্লামের নিকট শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার উপর বায়আত গ্রহণ করতাম, তখন তিনি আমাদের বলতেন, তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭২০২; সহীহ মুসলিম: ১৮৬৭; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ১৯৯২ মুসনাদুল হুমায়দী: ৬৫৪; মুসনাদে আহমাদ: ৫৫৩১; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮৬৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৫৪৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৩০২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪৫৪)
80 - باب وجوب طاعة ولاة الأمر في غير معصية وتحريم طاعتهم في المعصية
663 - وعنه، قَالَ: كُنَّا إِذَا بَايَعْنَا رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - عَلَى السَّمعِ والطَّاعَةِ، يَقُولُ لَنَا: «فِيمَا اسْتَطَعْتُمْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

بايَع শব্দটির উৎপত্তি مُبَايَعَةٌ থেকে। অর্থ পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হওয়া, অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া। এর মূল হল بيع। অর্থ বেচাকেনা। বেচাকেনায় ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে মাল ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। প্রত্যেকের পক্ষ থেকে অন্যকে একটা কিছু দেওয়া হয়। পারস্পরিক চুক্তি ও অঙ্গীকারের মধ্যেও এ বিষয়টা থাকে। জনগণ যখন তাদের নেতার সঙ্গে আনুগত্যের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, তখন তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় আনুগত্য করার প্রতিশ্রুতি আর নেতার পক্ষ থেকে দেওয়া হয় নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের কল্যাণসাধনের প্রতিশ্রুতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বেলায় তাঁরা তাঁর হাতে হাত রাখতেন। এভাবে তাঁরা যেন তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজেদের জান-মাল বিক্রি করে দিতেন।

অপরদিকে আল্লাহ তা'আলা যেন তাঁর মাধ্যমে জান্নাতের বিনিময়ে তাঁদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করে নিতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহ তা'আলার প্রতিনিধি। তাঁর হাতে হাত রাখার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেই অঙ্গীকার সম্পন্ন করা হত। পরবর্তীকালে জনগণের পক্ষ থেকে খলীফাদের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের হাতে হাত রাখার রীতি চালু থাকে। পরিভাষায় একে বায়'আত বলা হয়ে থাকে। সুতরাং সাধারণত বায়'আত বলতে হাতে হাত রেখে কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। বর্তমানে শায়খ ও মুরীদের মধ্যে বায়'আতের এ রেওয়াজ অব্যাহত আছে। এর মানে হল কোনও শায়খের হাতে হাত রেখে নিজেকে সংশোধন করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া।

যাহোক সাহাবায়ে কেরাম বলছেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার অর্থাৎ তাঁর আদেশ শোনা ও মানার উপর বায়'আত গ্রহণ করতাম, তখন তিনি আমাদের বলতেন-
فِيمَا اسْتَطَعْتُم (তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী)। অর্থাৎ আমীর যে হুকুম করে তা যতক্ষণ এ পর্যন্ত পালন করার সামর্থ্য তোমাদের থাকবে, ততক্ষণ অবশ্যই পালন করবে। এটা এই উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মমত্বের বহিঃপ্রকাশ। তিনি আমীরের আদেশ পালন করাকে সামর্থ্যের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে দিয়েছেন। এমন নয় যে, পালন করার ক্ষমতা থাকুক বা নাই থাকুক সর্বাবস্থায় তা পালন করতে হবে। সেরকম হলে উম্মতের পক্ষে বিষয়টা কঠিন হয়ে যেত। অথচ শরী'আত নিজ বিধানাবলি দ্বারা মানুষকে জটিলতায় ফেলতে চায় না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৭৮)

এ কারণেই সাধ্যের অতীত কোনও বিধান মানুষকে দেওয়া হয়নি। শরী'আতের প্রত্যেকটি বিধানই এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষের পক্ষে তা পালন করা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
আল্লাহ কারও উপর তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৮৬)

সুতরাং এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আমীরের আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছেন। কাজেই আমীরের বিশেষ কোনও হুকুমের ক্ষেত্রে কারও যদি এমন কোনও ওজর দেখা দেয়, যদ্দরুন তার পক্ষে সে হুকুম পালন করা সম্ভব নয় আর এ কারণে সে হুকুমটি পালন না করে, তবে তাকে আমীরের অবাধ্য গণ্য করা হবে না। এমনিভাবে আমীর যদি তাকে শরী'আতবিরোধ কোনও কাজের হুকুম করে এবং তা পালন না করলে হত্যা করার অথবা অসহনীয় কোনও শাস্তির হুমকি দেয়, সে ক্ষেত্রেও তাকে মা'যূর মনে করা হবে। ধরে নেওয়া হবে শরী'আতবিরোধী সে কাজটি থেকে বিরত থাকার সামর্থ্য তার নেই। এ অবস্থায় অবৈধ সেই কাজটি করলে তার কোনও গুনাহ হবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শাসক ও তার প্রতিনিধির শরী'আতসম্মত আদেশ পালন করা অবশ্যকর্তব্য।

খ. আমীর ও শাসকের আনুগত্য করার বিষয়টি আপন সামর্থ্যের সঙ্গে শর্তযুক্ত। কাজেই তার কোনও হুকুম নিজ সামর্থ্যের অতীত হলে সে ক্ষেত্রে তা পালনন করলে শরী'আতের দৃষ্টিতে কোনও অপরাধ হবে না।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৬৬৩ | মুসলিম বাংলা