রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৬২
আল্লাহর অবাধ্যতা হয় না এমন কাজে শাসকের আনুগত্য করার আবশ্যিকতা এবং আল্লাহর অবাধ্যতা হয় এমন কাজে আনুগত্য করার নিষিদ্ধতা

ইসলামে ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খলীফা ও আমীর ঐক্যের প্রতীক। তার প্রতি আনুগত্য রক্ষা করার দ্বারা উম্মতের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত থাকে। তাই ইসলাম আমীরের আনুগত্যের প্রতি জোর তাগিদ করেছে। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আমীরের আনুগত্য করা অবশ্যকর্তব্য। আমীরের যে আদেশ শরী'আতবিরোধী না হয়, তা অবশ্যই পালন করতে হবে।
আমীর যদি খলীফা বা খলীফার প্রতিনিধি হয়, সে ক্ষেত্রে যেমন তার আনুগত্য করা জরুরি, তেমনি যে আমীর নিজ ক্ষমতাবলে জনগণের উপর চেপে বসেছে, উম্মতের ঐক্য রক্ষার স্বার্থে তার আনুগত্য করাও একান্ত কর্তব্য। এরূপ শাসক যদি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুযায়ী দেশ শাসন না করে, তবে সে ফাসেক ও গুনাহগার বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার আনুগত্য করা ওয়াজিব, যতক্ষণ না তার দ্বারা সুস্পষ্ট কুফর প্রকাশ পায়। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়, এরূপ ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয নয়। সে একজন ফাসেক শাসক হলেও তার যে আদেশ শরী'আতবিরোধী না হয়, সে আদেশ পালন করা জরুরি। হাঁ, নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী হিকমত ও কল্যাণকামিতার সঙ্গে তাকে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং দু'আ করতে হবে আল্লাহ তা'আলা যেন তাকে আত্মসংশোধনের তাওফীক দেন।
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ধর্মনিরপেক্ষতা একটি কুফরী মতবাদ। এ নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কুফরী কর্ম। তবে ফুকাহায়ে কেরাম কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্ট করেছেন যে, কোনও কাজ কুফরী হওয়া এক কথা, আর সে কাজের কর্তাকে কাফের সাব্যস্ত করা আরেক কথা। যে-কোনও কাজ কুফরী হলেই তার কর্তাকে কাফের বলে ফাতওয়া দেওয়া যায় না। কাউকে কাফের ফাতওয়া দেওয়ার জন্য অনেকগুলো শর্ত আছে। ফুকাহায়ে কেরাম ফিকহী গ্রন্থাবলিতে তা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে তারা এমন কিছু বাধা বা প্রতিবন্ধকতার কথাও উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর কোনও একটি পাওয়া গেলে কাউকে কাফের বলে ফাতওয়া দেওয়া যায় না। অর্থাৎ এক ব্যক্তির মধ্যে কাফের ফাতওয়া দেওয়ার কোনও কারণ হয়তো লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিক থেকে যেসকল বাধার কারণে কাউকে কাফের বলা যায় না, তার কোনও একটিও তার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় কুফরী ফাতওয়া দেওয়ার কারণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাকে কাফের বলা যাবে না।
এরূপ প্রতিবন্ধকতাসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে জাহালাত বা অজ্ঞতা। হাদীছে এক পিতা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, সে তার পুত্রদেরকে অসিয়ত করেছিল তারা যেন তার মৃত্যুর পর তাকে পুড়ে ছাই করে জলে-স্থলে ছড়িয়ে দেয়। এর কারণ হিসেবে সে বলেছিল যে, সে একজন মস্ত পাপী। আল্লাহ তা'আলা তাকে ধরতে পারলে কঠিন শাস্তি দেবেন। তাই তাঁর ধরা থেকে বাঁচার জন্যই এ ব্যবস্থা। নিঃসন্দেহে এটি তার একটি কুফরী ধারণা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে কাফের সাব্যস্ত করা হয়নি। বরং সে আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করেছিল বলে আল্লাহ তা'আলা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এর কারণ এই যে, সে ওইরকম ধারণা করেছিল নিতান্তই জাহালাতের কারণে। সুতরাং জাহালাত বা অজ্ঞতা একটি প্রতিবন্ধকতা, যদ্দরুন কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা যায় না, যদিও কাফের সাব্যস্ত করার কোনও কারণ তার মধ্যে পাওয়া যায়।
কাজেই কাউকে কাফের সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এ মূলনীতিটি অবশ্যই সামনে রাখা দরকার। অন্যথায় এমন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যে, শরী'আত বিশেষ ওজরের কারণে যাকে কাফের সাব্যস্ত করে না, আমরা তাকে স্থূল চিন্তার বশবর্তীতে কাফের ফাতওয়া দিয়ে দিলাম। অথচ কোনও অমুসলিমকে মুসলিম বলাটা যেমন গুরুতর অপরাধ, কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে অমুসলিম বলে ঘোষণা করা তারচে' লঘু অপরাধ নয়।
সকল বিচার ও বিবেচনায় যার কুফর নিশ্চিত হয়ে যায়, সেরকম ব্যক্তি কিছুতেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর আমীর ও শাসক হওয়ার উপযুক্ততা রাখে না। এরূপ ব্যক্তি যদি ক্ষমতায় থাকে, তবে তার আনুগত্য করা জরুরি নয়; বরং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই জরুরি। উম্মতের কর্তব্য সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে কোনও যোগ্য ও আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে শাসকরূপে মনোনীত করা। হাঁ, এ প্রচেষ্টা অবশ্যই সম্মিলিত হওয়া দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে নয়। এরূপ চেষ্টা বিচ্ছিন্নভাবে হলে তা অধিকতর বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। কাফের শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি যে, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার শক্তি আসলে আছে কি না এবং ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা আরও বড় অনিষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে কি না। আরও বড় অনিষ্ট এভাবে হতে পারে যে, উৎখাতচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সেই শাসক অধিকতর জেদী হয়ে উঠবে। তখন সে কেবল আন্দোলনকারীদেরকেই দমন করবে না; নির্বিচারে সকল ইসলামপন্থীর উপর দমন-নিপীড়ন চালাবে। ঘটাবে ব্যাপক রক্তপাত। তার সৈন্য-সমর্থকদের হাতে। দীনদার নারীগণও নির্যাতনের শিকার হবে। হয়তো এমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও গ্রহণ করবে, যদ্দরুন নতুন প্রজন্ম পুরোপুরি দীনবিমুখ; বরং দীনবিদ্বেষীরূপে গড়ে উঠবে। আর এভাবে দেশব্যাপী ইসলামের অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। এমনও আশঙ্কা থাকে যে, সেই শাসককে হয়তো উৎখাত করা যাবে, কিন্তু তার স্থানে এমন কেউ গদিতে চাপবে যে, মিল্লাত ও জাতির জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক হবে।
বনূ উমায়্যা ও আব্বাসিয়া আমলে জালেম শাসকদের উৎখাত করার জন্য একাধিকবার চেষ্টা চালানো হয়েছে। অনেক বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তার সবগুলোই ব্যর্থ হয়েছে। সে ব্যর্থতার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। কেবল আন্দোলনকারী উলামাই নয়: সাধারণ জনগণকেও জান-মাল ও ইজ্জত-সম্ভ্রম দিয়ে সে আন্দোলনের মাশুল গুনতে হয়েছে। সেসব আন্দোলনের পরিণতি পর্যালোচনা করে পরবর্তীকালের উলামায়ে কেরাম। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এ জাতীয় আন্দোলন কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
এ কথা সত্য যে, বেদীন ও বেঈমান শাসকদের অধীনতা স্বীকার কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। তাই তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা অবশ্যই করা চাই। তবে সে চেষ্টার বেলায় আপন শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখাও জরুরি। সেইসঙ্গে সে প্রচেষ্টার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে তাও ভেবে দেখতে হবে। হঠকারিতা কিছুতেই কাম্য নয়। হঠকারিতা কখনও সুফল বয়ে আনে না। যতদিন না প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জিত হবে এবং এই আস্থাও জন্মাবে যে, ক্ষমতার পরিবর্তন অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে, ততোদিন অদূরদর্শী ব্যবস্থাগ্রহণ হতে বিরত থেকে বর্তমান শাসকের আনুগত্য করে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা মূলনীতি এটাই যে, দুই অনিষ্টের উভয়টি যদি একত্রে পরিত্যাগ করা সম্ভব না হয়, তবে তুলনামূলক যেটি বেশি অনিষ্টকর সেটি পরিত্যাগ করে কম অনিষ্টকরটি মেনে নেওয়া হবে।
সুতরাং যতদিন পর্যন্ত জালেম ও কাফের শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব না হয়, ততদিন জায়েয ক্ষেত্রসমূহে তাদের আনুগত্য করে যেতে হবে। এটাই মিল্লাত ও জাতির জন্য নিরাপদ। নাজায়েয ক্ষেত্রসমূহে কী করণীয়, তা পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। তবে সর্বাবস্থায় নিজ ঈমান-আমলের হেফাজত করা জরুরি। বলাবাহুল্য, এরূপ শাসকদের অধীনতা থেকে মুক্তিলাভের লক্ষ্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কী জীবনের মতো পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতী প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
যাহোক আমীর ও শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইসলাম এর প্রতি বিশেষ তাগিদ করেছে। কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। সে সম্পর্কেই রিয়াযুস সালেহীনের বর্তমান পরিচ্ছেদ।


‘আল্লাহর অবাধ্যতা হয় না এমন কাজে শাসকের আনুগত্য করার আবশ্যিকতা…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, তাঁর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতিয়ারধারী তাদেরও।( সূরা নিসা (৪), আয়াত ৫৯)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রথমত তাঁর আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছেন। তারপর তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছেন। তৃতীয় পর্যায়ে হুকুম দিয়েছেন শাসকের আনুগত্য করার। লক্ষণীয়, আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করার হুকুম দেওয়ার জন্য যেমন স্বতন্ত্রভাবে أَطِيعُوا (আনুগত্য করো) আজ্ঞাসূচক ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার হুকুম দেওয়ার জন্যও স্বতন্ত্রভাবে أَطِيعُوا (আনুগত্য করো) আজ্ঞাসূচক ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। তারপর তৃতীয় পর্যায়ে শাসকের আনুগত্য করার জন্য যে হুকুম দেওয়া হয়েছে, তাতে আলাদাভাবে اَطِيْعُوا (আনুগত্য করো) আজ্ঞাসূচক ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়নি। বরং এ হুকুমকে রাসূলের আনুগত্য করার হুকুমের অধীন করে দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা নিঃশর্তভাবে জরুরি। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যাই হুকুম করেন তা প্রশ্নাতীতভাবে আমাদেরকে মানতে হবে। তেমনি তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যে হুকুম করেন, তাও বিনাবাক্যে মানা জরুরি। কিন্তু শাসক যে হুকুম করেন, তা নিঃশর্তভাবে পালন করা জরুরি নয়। বরং তা মানতে হবে তখনই, যখন তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশের অধীনে বা তার অনুকূল হয়। যদি তার বিরোধী হয়, তবে তা কিছুতেই মানা যাবে না।
আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ আমরা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পেয়েছি। তার প্রায় সবটাই কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে। সেসব আদেশ-নিষেধ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। সে ব্যাখ্যা হাদীছ ও সুন্নাহ নামে পরিচিত। কিছু কিছু আদেশ-নিষেধ হাদীছেও আছে। কুরআন সরাসরি ওহী। হাদীছ পরোক্ষ ওহী। কুরআন বোঝার জন্য হাদীছের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। কুরআন ও হাদীছ উভয়টাই আমাদের জন্য অনুসরণীয়। উভয়ের অনুসরণ দ্বারাই আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা সম্ভব হয়।
এ আয়াত বলছে, আল্লাহর আনুগত্যের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করাও জরুরি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য। আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেন-
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ
‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।(সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮০)
বলাবাহুল্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা কেবল তাঁর সুন্নাহর আনুগত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। যে ব্যক্তি সুন্নাহ প্রত্যাখ্যান করবে, তার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য নয়; বরং তাঁর অবাধ্যতাই হবে। আর এ আয়াতের ভাষ্যমতে যেহেতু রাসূলের আনুগত্য আল্লাহরই আনুগত্য, সেহেতু এটাও অনিবার্য হয়ে যায় যে, যে ব্যক্তি রাসূলের অবাধ্যতা করবে, তা আল্লাহরই অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। সুতরাং সুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করার দ্বারা কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অবাধ্যতা হবে না, আল্লাহ তা'আলারও অবাধ্যতা হয়ে যাবে।
আয়াতটিতে দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে- وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ 'এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতিয়ারধারী তাদেরও (আনুগত্য করো)'। اُولِي অর্থ ওয়ালা, ধারক, অধিকারী। الأمر এর অর্থ অবস্থা, বিষয়, আদেশ, কর্তৃত্ব। কাজেই اُولِي اَلْاَمْرِ অর্থ কর্তৃত্ববান, এখতিয়ারধারী, যাদের উপর কোনও বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত। সুনির্দিষ্টভাবে এর দ্বারা কাদেরকে বোঝানো হয়েছে, সে বিষয়ে দু'রকম মত পাওয়া যায়। অনেকের মতে এর দ্বারা শাসক শ্রেণি অর্থাৎ যাদের হাতে রাষ্টপরিচালনার দায়িত্ব ন্যাস্ত, তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। আবার অনেকের মতে এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে উলামা, ফুকাহা ও দীনের যারা পথপ্রদর্শক তাদেরকে।
প্রকৃতপক্ষে উভয় মতের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। মানুষ যাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলে, তাদের সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত। তাদের শীর্ষে রয়েছেন নবী-রাসূলগণ। সাধারণ-বিশেষ সমস্ত মানুষের প্রকাশ্য ও গুপ্ত তথা বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক সকল বিষয়ে তাঁদের আদেশ প্রযোজ্য হয়। সকল মানুষের কর্তব্য তাঁদের সে আদেশ মেনে চলা। দ্বিতীয় হচ্ছে শাসক শ্রেণি। তাদের আদেশ কার্যকর হয় সাধারণ-বিশেষ সমস্ত মানুষের কেবল প্রকাশ্য বিষয়ে, গুপ্ত তথা আধ্যাত্মিক বিষয়ে নয়। তৃতীয় হচ্ছে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ারিছ। তাঁর ওয়ারিছ বা প্রতিনি হিসেবে তাদের কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক নির্দেশনা মেনে চলাও সকলের জরুরি। ব্যাপক অর্থে যারা ওয়াজ-নসীহত করা কিংবা যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিয়ে করার দায়িত্ব পালন করেন, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। এরা সকলেই أولى الأمر বা এখতিয়ার ও কর্তৃত্বধারী। তবে নবী-রাসূলের কর্তৃত্ব অন্যসব মাখলুকের উপরে। তাঁদের আনুগত করা সকলের জন্য নিঃশর্তভাবে জরুরি। তাঁদের পরে শাসকশ্রেণির অবস্থান। তাদে কর্তৃত্ব অন্যদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। কেননা তাদের আদেশ যদি কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী না হয়, তবে তা মানা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। কারও জন্য তা অমান করার অবকাশ নেই। অমান্য করলে সে আইনের আওতায় চলে যাবে ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। অপরদিকে উলামা-ফুকাহা ও দীনী পথপ্রদর্শকদের কর্তৃত্ব সেরকম বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ কেউ তা অমান্য করলে এসকল কর্তৃত্ববানদের পক্ষ থেকে তাদের শাস্তিপ্রায় হওয়ার অবকাশ নেই, যদিও শর'ঈ বিধান অমান্য করলে আখিরাতে শাস্তির ব্যবস্থ রয়েছে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুনিয়ায়ও ইসলামী আদালতের শাস্তিদানেদ এখতিয়ার আছে।
আয়াতটি এখতিয়ারধারী বা কর্তৃত্ববানদের আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছে। কাজেই উলামা-মাশায়েখ, মুফতী ও ফকীহগণও যেহেতু এর অন্তর্ভুক্ত, তাই দুনিয়ার আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হোক বা নাই হোক, আখিরাতের আদালত এড়ানো যেহেতু কারও পক্ষে সম্ভব নয়, অতএব সেদিনের নাজাত ও মুক্তির আশায় সকলেরই কর্তব্য তাদের দীনী নির্দেশনা মেনে চলা, তাদের নসীহতের উপর আমল করা ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা।
ক্ষমতাসীন ও শাসকবর্গের আনুগত্য করাও এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। বলা হয়েছে- এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতিয়ারধারী তাদেরও (আনুগত্য করো)। কাজেই শাসক যদি মুসলিম হয় এবং তার আদেশ মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণার্থে হয়, তবে তার আনুগত্য করা অবশ্যকর্তব্য। এটা যেহেতু কুরআনের হুকুম, তাই মুসলিম শাসকের বৈধ আদেশ অর্থাৎ যে আদেশ শরী'আতবিরোধী নয় তা অমান্য করা কুরআনের হুকুম অমান্য করারই নামান্তর হবে। সেই হিসেবে সে শাসকের আদেশ মান্য করার দীনী বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। তার আদেশ অমান্য করা যেমন সরকারের আইনের বরখেলাফ, তেমনি তা শরী'আতেরও বরখেলাফ বটে। কাজেই মুসলিম সরকারের বৈধ আইন অমান্য করা শরী'আতের দৃষ্টিতেও জায়েয নয়। এ বিষয়ে সকলের সচেতনতা জরুরি।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য তথা কুরআন মাজীদের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।
খ. রাসূলের আনুগত্য করাও আল্লাহর হুকুম। কাজেই তাঁর সুন্নাহ মেনে চলাও প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য।
গ. সরকারের বৈধ হুকুম অমান্য করা যাবে না। তা অমান্য করার দ্বারা কুরআনের আদেশ অমান্য করা হয়।
ঘ. উলামা-মাশায়েখ ও দীনের পথপ্রদর্শকগণ কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক যে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন, প্রকৃতপক্ষে তা যেহেতু কুরআন-সুন্নাহরই নির্দেশনা, তাই তা মেনে চলা সকলের জন্য জরুরি।
পাপকর্মের হুকুমে শাসকের আনুগত্য না করা অন্য সকল ক্ষেত্রে আনুগত্য করা
হাদীছ নং: ৬৬২

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির (শাসকের আদেশ) শ্রবণ ও আনুগত্য করা অবশ্যকর্তব্য, সে যা পসন্দ করে তাতেও এবং যা অপসন্দ করে তাতেও, যতক্ষণ না পাপকর্মের আদেশ করা হয়। যখন কোনও পাপকর্মের আদেশ করা হবে, তখন কোনও শ্রবণ ও আনুগত্য নেই। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭১৪৪; সহীহ মুসলিম: ১৮৩৯; জামে' তিরমিযী: ১৭০৭; সুনানে আবু দাউদ: ২৬২৬; সুনানে ইবন মাজাহ ২৪৬৪; সুনানে নাসাঈ ৬২০৬; মুসনাদে আহমাদ: ৪৬৬৮: বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৫৩৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৯৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৩৭০৭)
80 - باب وجوب طاعة ولاة الأمر في غير معصية وتحريم طاعتهم في المعصية
قَالَ الله تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الأَمْرِ مِنْكُمْ} [النساء: 59].
662 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «عَلَى المَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ والطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وكَرِهَ، إِلاَّ أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيةٍ، فَإذَا أُمِرَ بِمَعْصِيةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে পাপকর্মের হুকুম ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে শাসক-প্রশাসকের আনুগত্য করার অপরিহার্যতা বর্ণনা করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ 'প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির (শাসকের আদেশ) শ্রবণ ও আনুগত্য করা অবশ্যকর্তব্য'। শ্রবণ করা মানে শাসক যা বলে তা গ্রহণ করা। আনুগত করা মানে তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। এটা মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য। তার মানে এটা ইসলামের নির্দেশ। কাজেই যে ব্যক্তি নিজেকে ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করে, তার কর্তব্য মুসলিম সরকারের বৈধ সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। এটা যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় প্রযোজ্য ছিল, তেমনি তাঁর পরেও কিয়ামত পর্যন্ত সব কালেই সমান প্রযোজ্য। আমীর তথা খলীফা, তার প্রতিনিধি ও বিচারকের আদেশ-নিষেধ পালন করা সব কালেই জরুরি। তা অমান্য করা কেবল সরকারি আইন অমান্য করাই নয়; বরং ইসলামের নির্দেশ অমান্য করারও শামিল।

فِيمَا أَحَبَّ وَكَره (সে যা পসন্দ করে তাতেও এবং যা অপসন্দ করে তাতেও)। অর্থাৎ শাসকের হুকুম মনঃপূত হোক বা নাই হোক, নিজ রুচি-প্রকৃতির অনুকূল হোক বা প্রতিকূল, সর্বাবস্থায় তা মেনে চলতে হবে।

إِلَّا أَنْ يُؤْمَر بِمَعْصِية (যতক্ষণ না পাপকর্মের আদেশ করা হয়)। অর্থাৎ যদি সরকার এমন কোনও কাজের হুকুম করে, যা শরী'আত অনুমোদন করে না, ফলে তাতে আল্লাহর অবাধ্যতা হয় এবং তা পাপকর্মরূপে গণ্য হয়, তবে আলাদা কথা। অর্থাৎ তা মানা যাবে না। যেমন কোনও নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যা করার হুকুম। রাষ্ট্রপ্রধান যদি তার আঞ্চলিক কোনও প্রতিনিধিকে, বিচারককে বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিংবা সাধারণ কোনও নাগরিককে হুকুম করে যে, অমুককে হত্যা করো, অথচ সে হত্যার উপযুক্ত হওয়ার মতো কোনও অপরাধ করেনি, তবে রাষ্ট্রপ্রধানের এ হুকুম পালন করা কারও জন্যই জায়েয হবে না। এমনিভাবে সাজানো মামলা দেওয়া, নামায না পড়া, অন্যায়ভাবে মালক্রোক করা, মদপান করা, নাচ-গান করা এবং অনুরূপ যে-কোনও শরী'আতবিরোধী কাজের হুকুম করা হলে কারও জন্যই সে হুকুম পালন করা জায়েয নয়। হাদীছের পরবর্তী বাক্যে সুস্পষ্টভাবেই এটা বলে দেওয়া হয়েছে যে-
فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَة (যখন কোনও পাপকর্মের আদেশ করা হবে, তখন কোনও শ্রবণ ও আনুগত্য নেই)। অর্থাৎ যে কাজ করলে আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা হয়, সরকার যদি তা করার হুকুম দেয়, তবে তা শোনা ও মানা যাবে না। অর্থাৎ এরূপ ক্ষেত্রে তোমরা শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে না। কেননা যে কাজে আল্লাহর অবাধ্যতা হয়, তাতে শাসকের আনুগত্য করা জায়েয নয়। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ
‘সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা হয় এমন কাজে কোনও মাখলুকের আনুগত্য নেই। (মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৩৭১৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩৭৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ৩৮৮৯; মুসনাদুল বাযযার: ১৯৮৮; শারহুস সুন্নাহ: ২৪৫৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর :৩৮১)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শাসক-প্রশাসকের আদেশ মনঃপূত হোক বা নাই হোক, সর্বাবস্থায় পালন কর জরুরি।

খ. সরকারের বৈধ আদেশ পালন করা কেবল রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়; শরী'আতেরও হুকুম।

গ. সরকারের শরী'আতবিরোধী আদেশ পালন করা জায়েয নয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৬৬২ | মুসলিম বাংলা