রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৫৬
অধ্যায়: ৭৮ শাসকবর্গকে জনগণের প্রতি নম্রতা দেখানো, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও মমত্ব প্রদর্শনের হুকুম এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোরতা আরোপ, তাদের কল্যাণকর বিষয়সমূহ উপেক্ষা করা, তাদের প্রতি অমনোযোগিতা ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অবহেলা প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞা
জনগণের প্রতি শাসকবর্গের নম্র-কোমল হওয়ার উপদেশ
হাদীছ নং: ৬৫৬

হযরত আইয ইবন আমর রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ওহে বাছা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট রাখাল সেই ব্যক্তি, যে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে। সুতরাং তুমি তাদের একজন হয়ো না। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৮৩০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৫১১; মুস্তাখরাজ আবূ 'আওয়ানা: ৭০৪৯)
78 - باب أمر وُلاة الأمور بالرفق برعاياهم ونصيحتهم والشفقة عليهم والنهي عن غشهم والتشديد عليهم وإهمال مصالحهم والغفلة عنهم وعن حوائجهم
656 - وعن عائِذ بن عمرو - رضي الله عنه: أَنَّهُ دَخَلَ عَلَى عُبَيْد اللهِ بن زيادٍ، فَقَالَ لَهُ: أيْ بُنَيَّ، إنِّي سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ»، فإيَاكَ أن تَكُونَ مِنْهُمْ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা শাসককে উপদেশদান এবং তাকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আইয ইবন আমর রাযি. যাকে নসীহত করছিলেন তিনি ছিলেন বসরার এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ। তার কঠোর শাসন এবং জনগণের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা ইতিহাসখ্যাত। তার সে কঠোরতা দেখে হযরত আইয রাযি. তাকে উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। সুতরাং তিনি তার সঙ্গে দেখা করে অত্যন্ত কোমল ভাষায় নসীহত করছিলেন। তিনি তাকে 'ওহে বাছা' বলে সম্বোধন করেছিলেন। নসীহত ও উপদেশদানে নম্র-কোমল কথা বলা কর্তব্য। শাসকদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি জরুরি। আল্লাহ তা'আলা যখন হযরত মূসা ও হারুন আলাইহিমাস-সালামকে ফির'আউনের কাছে পাঠান তখন আদেশ করেছিলেন-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ
তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে। (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ৪৪)

হযরত আইয রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে নসীহত করতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীছ শোনান। হাদীছটিতে শাসককে রাখালের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একজন ভালো রাখাল গবাদি পশুর প্রতি সদয় আচরণ করে থাকে। সে তাদের খাদ্য ও পানির ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকে। কোন মাঠে তাদের চরালে ভালো ঘাস পাবে, কোথায় নিলে সহজে পানি পান করানো যাবে তার অনুসন্ধানে থাকে। পশুরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করলে যত্নের সাথে তাদের ফিরিয়ে আনে এবং সর্বতোপ্রযত্নে তাদের আগলে রাখে। পশুদের প্রতি যে রাখাল নির্দয় ও নিষ্ঠুর, তার আচরণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, তারও উচিত জনগণের প্রতি একজন দরদী রাখালের মতো আচরণ করা। সে যদি তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখায়, তবে সে একজন নিকৃষ্ট শাসকরূপে গণ্য হবে।

শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করার একটা তাৎপর্য এই যে, গবাদি পশু বোধ-বুদ্ধিহীন হয়ে থাকে। তারা কোনও যুক্তিতর্ক বোঝে না। কল্যাণ-অকল্যাণেরও পার্থক্য করতে পারে না। কাজেই তাদের সঙ্গে রাগারাগি করার বা তাদেরকে মারামারি করার কোনও যুক্তি নেই এবং তার কোনও ফায়দাও নেই। সর্বাবস্থায় ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে। কোনও পশু হয়তো চারণভূমি ছেড়ে কারও শস্যক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, কোনওটি পালিয়ে যেতে চায় এবং আরও নানারকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। সব ক্ষেত্রেই রাখালকে ধৈর্য রক্ষা করতে হয় এবং হিকমত ও কৌশলের সাথে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। ঠিক তেমনি জনগণের মধ্যেও নানারকমের লোক থাকে। অধিকাংশেরই ভালোমন্দ জ্ঞান পরিপক্ক থাকে না। ফলে নানারকম অশান্তিকর ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ কর্মকাণ্ড তাদের দ্বারা হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় আচরণ কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। সাময়িকভাবে হয়তো তাদেরকে দমন করা যায়, কিন্তু কঠোরতার ফলে তাদের অন্তরে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে, একপর্যায়ে তার বিস্ফোরণ ঘটে। তাই একজন ভালো শাসকের কর্তব্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি আচার-আচরণে কোমলতা রক্ষা করা এবং সর্বাবস্থায় জনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়া।

শাসককে রাখালের সঙ্গে তুলনা করার আরও একটি তাৎপর্য এই যে, রাখাল গবাদিপশুর মালিক হয় না। মালিক অন্য কেউ। পশুগুলো তার কাছে আমানতস্বরূপ থাকে। তার কাজ আমানতদারির সঙ্গে সেগুলোর পরিচর্যা করা। ঠিক তেমনি শাসকও রাষ্ট্র ও জনগণের মালিক নয়। শাসনক্ষমতা তার উপর আরোপিত এক আমানত ও গুরুদায়িত্ব। তারও কর্তব্য আমানতদারির সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করা। সে যদি নিজেকে রাষ্ট্রের মালিক-মুখতার মনে করে বসে এবং সে হিসেবে নিজ ইচ্ছামতো রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তবে তা হবে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে বিদ্রোহ করার নামান্তর। এ কারণে তাকে আখিরাতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সেরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন যাতে শাসকবর্গকে না হতে হয়, সে লক্ষ্যে তাকে রাখালের সঙ্গে তুলনা করে বার বার বিভিন্ন হাদীছে তার প্রকৃত অবস্থান ও গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. রাষ্ট্রের শাসক রাষ্ট্রের মালিক নয়; বরং আমানতস্বরূপ রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বশীল মাত্র। কাজেই তাকে আমানতদারির সঙ্গে আপন দায়িত্ব পালন করতে হবে।

খ. কোনও শাসক অন্যায়-অসৎকাজ করলে সে ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা এবং তাকে তার অন্যায়-অসৎকাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা ঈমানী দায়িত্ব।

গ. শাসক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে উপদেশ দানকালে তার বাহ্যিক মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখা এবং নম্র-কোমল কথা বলা জরুরি।

ঘ. উপদেশ ও নসীহত করার কাজ কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৬৫৬ | মুসলিম বাংলা