রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬২০
উত্তম চরিত্র
উত্তম চরিত্র মানবমনের এমন এক অবস্থা ও ক্ষমতাকে বলে, যার উপর ভিত্তি করে সহজেই ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব হয়। ইসলাম মানবমনের এ ক্ষমতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ যেন এ ক্ষমতার পরিচর্যা করে এবং এর বিকাশ ঘটানোর সাধনা করে, সেজন্য তাকে নানাভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর বিকাশ ঘটানো অতীব জরুরি। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হয়। সে ভালো চরিত্রের হলে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ হয়, শান্তিপূর্ণ হয়। অন্যথায় পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দেয় এবং সমাজজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যখন যেখানে চারিত্রিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, সেখানেই মানুষের শান্তি নষ্ট হয়েছে।
জাহিলিয়াতের যুগ ছিল চারিত্রিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ। সে অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবী। ফলে মানুষ পেশিশক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। দুর্বলেরা শক্তিমানদের গ্রাসে পরিণত হয়েছিল। শক্তির মদমত্ততা মানুষের মননশক্তির বিকাশ থামিয়ে দিয়েছিল। ভালো কিছু ভাবা ও ভালো কিছু করার কথা যেন মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ অন্ধকার। তা থেকে উদ্ধারের জন্য দরকার ছিল উত্তম চরিত্রের বিকাশসাধন এবং এর সর্বাত্মক চর্চা। এ লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম নমুনা করে পাঠান। তিনি এসে ঘোষণা দিলেন-
بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ
‘আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।(মুআত্তা মালিক ৩৩৫৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩১৭৭৩; আল আদাবুল মুফরাদ : ২৭৩; মুসনাদুল বাযযার ৮৯৪৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩২; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪২২১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৭৮২)
সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় অনুসারী ও সাহাবীদেরকে এক এক করে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। সত্য কথা বলা, অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, দুর্বল, দুস্থ ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, উদারপ্রাণ হওয়া, অতিথিপরায়ণতা, জীবে দয়া, হাসিমুখে কথা বলা, বিনয় প্রদর্শন, কোমল আচরণ প্রভৃতি গুণাবলির চর্চায় তিনি তাঁদের দিয়ে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তুললেন। ইসলামী জীবনের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন, তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর্যায়ক্রমিক শিক্ষার বদৌলতে তাঁরা কোথায় পৌঁছে গেলেন! হাদীছের কিতাবসমূহ ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনীগ্রন্থসমূহ পড়লে আমরা তাঁদের সে উদ্ভাসিত জীবনের সন্ধান পাই ভালোভাবেই।
তাঁরা শিখেছিলেন নিজের কাছে অন্যের যা অধিকার তা অবশ্যই আদায় করতে হয়। অন্যের কাছে নিজের যা প্রাপ্য, তার দাবি-দাওয়া তুলতে নেই। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেতে হবে। নিজে অসুস্থ হলে কেউ যদি নাও আসে, আপত্তি করতে নেই। মানুষকে সালাম দেবে। কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দেবে। তোমার সালামের জবাব কেউ না দিলে দুঃখ করবে না। তোমাকে কেউ সম্মান না করলে আফসোস করবে না। কিন্তু তুমি অবশ্যই অন্যকে সম্মান করবে। তোমার সুপারিশ কেউ গ্রহণ না করলে নাই করুক, তোমার কাছে কেউ সুপারিশ করলে তুমি তার মর্যাদা দেবে। তুমি অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তোমার কথা কেউ অগ্রাহ্য করলে মনে কষ্ট নেবে না। তোমার বিবাহের প্রস্তাব কেউ ফিরিয়ে দিলে তা দিক না। আফসোস করো না। তোমার কাছে কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসলে তার অমর্যাদা করো না।কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে ক্ষমা করো। তুমি কিন্তু কাউকে কষ্ট দিয়ো না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন-
لا تَكونوا إمَّعةً، تقولونَ: إن أحسنَ النَّاسُ أحسنَّا، وإن ظلموا ظلَمنا، ولَكن وطِّنوا أنفسَكم، إن أحسنَ النَّاسُ أن تُحسِنوا، وإن أساءوا فلا تظلِموا
‘তোমরা যে যেমন তার সঙ্গে তেমন হবে না যে, এ কথা বলবে- লোকে আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে আমরাও ভালো ব্যবহার করব আর যদি তারা জুলুম করে, আমরাও জুলুম করব। বরং তোমরা নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখো এ নীতির উপর যে, লোকে ভালো ব্যবহার করলে তো অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে, আর যদি তারা মন্দ ব্যবহার করে, তোমরা কিন্তু জুলুম করবে না।(জামে' তিরমিযী: ২০০৭; মুসনাদুল বাযযার: ২৮০২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৪৪)
উন্নত আখলাক-চরিত্রের বীজ প্রত্যেকের মনেই জন্মগতভাবে বোনা রয়েছে। কারও অন্তরে বেশি, কারও অন্তরে কম। সে বীজ অঙ্কুরিত করে তোলা, তারপর তাকে ডালপালা ও ফলে-ফুলে ভরিয়ে তোলার ক্ষমতাও সকলের ভেতরই আছে। হয়তো কারও কম, কারও বেশি। অন্তরভূমি জগৎভূমির মতোই। কোনওটা বেশি উর্বর, কোনওটা কম। ভালো যত্ন নিলে অনুর্বর ভূমিতেও ফসল ফলানো যায়। আর যত্ন না নিলে উর্বর ভূমিও নিষ্ফলা হয়ে থাকে। যত্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই যত্ন নেওয়ার তাগিদ ও শিক্ষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকেরই দরকার নিজ আখলাক-চরিত্রকে উন্নত ও বিকশিত করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করা। কেননা প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুন্দর ও ভালো কাজে লাগানোর বিষয়টি এরই উপর নির্ভর করে। যার আখলাক-চরিত্র যত ভালো, তার দ্বারা ততো বেশি সৎকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি সৎকর্মের উপর নির্ভরশীল, উত্তম আখলাক-চরিত্র ছাড়া যা সম্ভব নয়। মানুষ যাতে তার উত্তম আখলাক নির্মাণে সচেষ্ট হয়, সেজন্য কুরআন মাজীদে এর ভরপুর শিক্ষা পেশ করা হয়েছে এবং তা গ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছও আছে প্রচুর। বর্তমান অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘উত্তম চরিত্র’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ (4)
অর্থ: এবং নিশ্চয়ই তুমি অধিষ্ঠিত আছ মহান চরিত্রে।(সূরা কলাম (৬৮), আয়াত ৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটিতে অতি সংক্ষেপে অথচ পূর্ণাঙ্গভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে যে, তিনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। অর্থাৎ মহান চরিত্র যেন একটি আসন, যার উপর তিনি পূর্ণ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সঙ্গে অধিষ্ঠিত। কিংবা মহান চরিত্র যেন এমন এক বাহন, যার উপর তিনি চেপে বসা ছিলেন এবং আপন ইচ্ছামতো তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। বোঝানো উদ্দেশ্য- উত্তম চরিত্র কখনও তাঁর হাতছাড়া হতে পারত না। কখনও তিনি সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতেন না। আনন্দ-বিষাদ, রাগ-বিরাগ, প্রকাশ্য-গুপ্ত সর্বাবস্থায় তাঁর উন্নত চরিত্র অটুট থাকত। কোনওরকম ভাবাবেগে তিনি তাঁর মহান চরিত্র থেকে একটুও বিচ্যুত হতেন না। তাঁর গোটা জীবন এ কথার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
বস্তুত কুরআন যে চারিত্রিক শিক্ষা দেয়, তাই মহান চরিত্র। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র কুরআন মাজীদ থেকেই নেওয়া। কুরআন মাজীদে যা-কিছু উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই পরিপূর্ণ মাত্রায় তাঁর মধ্যে বিরাজ করত। সততা ও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, দানশীলতা, দয়া ও সহমর্মিতা, শালীনতা ও লজ্জাশীলতা, আল্লাহনির্ভরতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, পরার্থপরতা, উদারতা, ন্যায়নিষ্ঠা, গুণগ্রাহিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রভৃতি সদগুণের এমন কোনটি আছে, যা পরিপূর্ণরূপে তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল না? আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করেছিলেন এবং তাঁর জীবনকে ওহীর শিক্ষার বাস্তব নমুনা বানিয়েছিলেন। সুতরাং সত্যকথা হচ্ছে কুরআন মাজীদ যে চরিত্রের শিক্ষাদান করে, তিনি ছিলেন তার জীবন্ত রূপ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন-
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ
‘কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।(মুসনাদে আহমাদ: ২৪৬০১; আল আদাবুল মুফরাদ: ৩০৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭২; শু'আবুল ঈমান: ১৩৫৯; শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৯৪)
হযরত আলী রাযি. বলেন, خُلُقٍ عَظِيمٍ হল কুরআনের শিক্ষামালা। জুনায়েদ বাগদাদী রহ. বলেন, তাঁর চরিত্রকে মহান চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে এ কারণে যে, আল্লাহ তা'আলা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তিনি তাঁর মহান চরিত্র দিয়ে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর প্রকাশ্য দিক ছিল মাখলুকের সঙ্গে, কিন্তু অন্তর্জগৎ ছিল স্রষ্টার সঙ্গে।
আয়াতটির শিক্ষা
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে নিজেদের জীবনে তাঁর মহান চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
দুই নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134)
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলে-ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগের আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, জান্নাত মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এ আয়াতে মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল রাগ হজম করা। এখানে বলা হয়েছে-
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার উপর রাগ ওঠে, তার উপর রাগের আচরণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা করা হতে নিজেকে বিরত রাখে। এটি একটি মহৎ গুণ। এর অনেক ফযীলত। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ ، وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ ، مَلَأَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَلْبَهُ أَمْنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি রাগ সংবরণ করে, অথচ সে চাইলে তা কার্যকর করতে পারত, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার অন্তর নিরাপত্তায় ভরে দেবেন।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৬০২৬; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ৩৫৪৩)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
وَمَنْ كَفَّ غَضَبَهُ كَفَّ اللَّهُ عَنْهُ عَذَابَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রোধ সংবরণ করে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার থেকে আযাব দূর করে দেবেন।(শু'আবুল ঈমান: ৭৯৫৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৩৮; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩২১)
এ বাক্যে বর্ণিত মুত্তাকীদের দ্বিতীয় গুণ হল ক্ষমতাশীলতা। বলা হয়েছে- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ কেউ বেয়াদবি করলে, আর্থিক ক্ষতি করলে, শারীরিকভাবে কষ্ট দিলে, মানসিক আঘাত করলে, এককথায় অপ্রীতিকর যে আচরণই করুক, মুত্তাকী ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করে দেয়। ক্ষমাশীলতা ইসলামের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল ছিলেন। তায়েফের দুরাচারদের ক্ষমা করে দেওয়া, এমনিভাবে মক্কাবিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা তাঁর ক্ষমাশীল চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ক্ষমাশীল হতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।’(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)
কেউ ভুল করার পর যদি ক্ষমা চায়, তবে তাকে ক্ষমা করা অবশ্যকর্তব্য। ক্ষমা না করা গুনাহ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنِ اعْتَذَرَ إِلَى أَخِيهِ فَلَمْ يَعْذُرْهُ أَوْ يَقْبَلْ عُذْرَهُ كَانَ عَلَيْهِ مِثْلُ خَطِيئَةِ صَاحِبِ مَكْسٍ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু সে তাকে ক্ষমা না করে বা তার ওজর কবুল না করে, তার গুনাহ হয় (জালেম) কর উসূলকারীর মতো।(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৭৯৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৮৬৪৪; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৬৪৯
قال البوصيري في الزوائد : رجاله ثقات إلا أنه مرسل)
আয়াতটিতে সবশেষে বলা হয়েছে- وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন)। অর্থাৎ উল্লিখিত গুণাবলি যাদের মধ্যে আছে, তারা পুণ্যবান। আর আল্লাহ তা'আলা এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আল্লাহ তা'আলা অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। مُحْسِنٌ শব্দটির উৎপত্তি إِحْسَانٌ থেকে।
ইহসান অর্থ দয়া ও অনুগ্রহ করা। এটা ন্যায় ও ইনসাফের পরবর্তী ধাপ। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ ও দয়া করার হুকুম দেন।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)
ইনসাফ হল যে যেমন ব্যবহার করে, তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা। আর ইহসান হল অন্যকে তার ন্যায্য অধিকারের চেয়ে আরও বেশি দেওয়া কিংবা যে ব্যক্তি মন্দ আচরণ করে, তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা। যেমন কুরআন মাজীদে আদেশ করা হয়েছে-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ
‘তুমি মন্দকে প্রতিহত করবে এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট।(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৬)
এর দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় হযরত যায়নুল আবিদীন রহ.-এর একটি ঘটনা দ্বারা। তার এক গোলামের আচরণে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। এতে তার রাগ হল। গোলাম বলে وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (যারা নিজের ক্রোধ হজম করে)। তিনি রাগ হজম করলেন। গোলাম বলল- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে)। তিনি বললেন, তোমাকে ক্ষমা করলাম। শেষে গোলাম বলল- وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন)। তিনি বললেন, যাও তোমাকে আযাদ করে দিলাম।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. রাগ হজম করা একটি মহৎ গুণ। এ গুণ আমাদের অর্জন করতে হবে।
খ. ক্ষমাশীলতা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। প্রত্যেক মুমিনের এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।
গ. ইহসান ও অনুগ্রহের আচরণ চরিত্রের উচ্চতর স্থান। এ স্তরে পৌঁছার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ হয়।
উত্তম চরিত্র মানবমনের এমন এক অবস্থা ও ক্ষমতাকে বলে, যার উপর ভিত্তি করে সহজেই ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব হয়। ইসলাম মানবমনের এ ক্ষমতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ যেন এ ক্ষমতার পরিচর্যা করে এবং এর বিকাশ ঘটানোর সাধনা করে, সেজন্য তাকে নানাভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর বিকাশ ঘটানো অতীব জরুরি। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হয়। সে ভালো চরিত্রের হলে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ হয়, শান্তিপূর্ণ হয়। অন্যথায় পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দেয় এবং সমাজজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যখন যেখানে চারিত্রিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, সেখানেই মানুষের শান্তি নষ্ট হয়েছে।
জাহিলিয়াতের যুগ ছিল চারিত্রিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ। সে অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবী। ফলে মানুষ পেশিশক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। দুর্বলেরা শক্তিমানদের গ্রাসে পরিণত হয়েছিল। শক্তির মদমত্ততা মানুষের মননশক্তির বিকাশ থামিয়ে দিয়েছিল। ভালো কিছু ভাবা ও ভালো কিছু করার কথা যেন মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ অন্ধকার। তা থেকে উদ্ধারের জন্য দরকার ছিল উত্তম চরিত্রের বিকাশসাধন এবং এর সর্বাত্মক চর্চা। এ লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম নমুনা করে পাঠান। তিনি এসে ঘোষণা দিলেন-
بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ
‘আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।(মুআত্তা মালিক ৩৩৫৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩১৭৭৩; আল আদাবুল মুফরাদ : ২৭৩; মুসনাদুল বাযযার ৮৯৪৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩২; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪২২১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৭৮২)
সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় অনুসারী ও সাহাবীদেরকে এক এক করে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। সত্য কথা বলা, অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, দুর্বল, দুস্থ ও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, উদারপ্রাণ হওয়া, অতিথিপরায়ণতা, জীবে দয়া, হাসিমুখে কথা বলা, বিনয় প্রদর্শন, কোমল আচরণ প্রভৃতি গুণাবলির চর্চায় তিনি তাঁদের দিয়ে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তুললেন। ইসলামী জীবনের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন, তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর্যায়ক্রমিক শিক্ষার বদৌলতে তাঁরা কোথায় পৌঁছে গেলেন! হাদীছের কিতাবসমূহ ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনীগ্রন্থসমূহ পড়লে আমরা তাঁদের সে উদ্ভাসিত জীবনের সন্ধান পাই ভালোভাবেই।
তাঁরা শিখেছিলেন নিজের কাছে অন্যের যা অধিকার তা অবশ্যই আদায় করতে হয়। অন্যের কাছে নিজের যা প্রাপ্য, তার দাবি-দাওয়া তুলতে নেই। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেতে হবে। নিজে অসুস্থ হলে কেউ যদি নাও আসে, আপত্তি করতে নেই। মানুষকে সালাম দেবে। কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দেবে। তোমার সালামের জবাব কেউ না দিলে দুঃখ করবে না। তোমাকে কেউ সম্মান না করলে আফসোস করবে না। কিন্তু তুমি অবশ্যই অন্যকে সম্মান করবে। তোমার সুপারিশ কেউ গ্রহণ না করলে নাই করুক, তোমার কাছে কেউ সুপারিশ করলে তুমি তার মর্যাদা দেবে। তুমি অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তোমার কথা কেউ অগ্রাহ্য করলে মনে কষ্ট নেবে না। তোমার বিবাহের প্রস্তাব কেউ ফিরিয়ে দিলে তা দিক না। আফসোস করো না। তোমার কাছে কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসলে তার অমর্যাদা করো না।কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে ক্ষমা করো। তুমি কিন্তু কাউকে কষ্ট দিয়ো না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন-
لا تَكونوا إمَّعةً، تقولونَ: إن أحسنَ النَّاسُ أحسنَّا، وإن ظلموا ظلَمنا، ولَكن وطِّنوا أنفسَكم، إن أحسنَ النَّاسُ أن تُحسِنوا، وإن أساءوا فلا تظلِموا
‘তোমরা যে যেমন তার সঙ্গে তেমন হবে না যে, এ কথা বলবে- লোকে আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে আমরাও ভালো ব্যবহার করব আর যদি তারা জুলুম করে, আমরাও জুলুম করব। বরং তোমরা নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখো এ নীতির উপর যে, লোকে ভালো ব্যবহার করলে তো অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে, আর যদি তারা মন্দ ব্যবহার করে, তোমরা কিন্তু জুলুম করবে না।(জামে' তিরমিযী: ২০০৭; মুসনাদুল বাযযার: ২৮০২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৪৪)
উন্নত আখলাক-চরিত্রের বীজ প্রত্যেকের মনেই জন্মগতভাবে বোনা রয়েছে। কারও অন্তরে বেশি, কারও অন্তরে কম। সে বীজ অঙ্কুরিত করে তোলা, তারপর তাকে ডালপালা ও ফলে-ফুলে ভরিয়ে তোলার ক্ষমতাও সকলের ভেতরই আছে। হয়তো কারও কম, কারও বেশি। অন্তরভূমি জগৎভূমির মতোই। কোনওটা বেশি উর্বর, কোনওটা কম। ভালো যত্ন নিলে অনুর্বর ভূমিতেও ফসল ফলানো যায়। আর যত্ন না নিলে উর্বর ভূমিও নিষ্ফলা হয়ে থাকে। যত্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই যত্ন নেওয়ার তাগিদ ও শিক্ষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকেরই দরকার নিজ আখলাক-চরিত্রকে উন্নত ও বিকশিত করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করা। কেননা প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুন্দর ও ভালো কাজে লাগানোর বিষয়টি এরই উপর নির্ভর করে। যার আখলাক-চরিত্র যত ভালো, তার দ্বারা ততো বেশি সৎকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি সৎকর্মের উপর নির্ভরশীল, উত্তম আখলাক-চরিত্র ছাড়া যা সম্ভব নয়। মানুষ যাতে তার উত্তম আখলাক নির্মাণে সচেষ্ট হয়, সেজন্য কুরআন মাজীদে এর ভরপুর শিক্ষা পেশ করা হয়েছে এবং তা গ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছও আছে প্রচুর। বর্তমান অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘উত্তম চরিত্র’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ (4)
অর্থ: এবং নিশ্চয়ই তুমি অধিষ্ঠিত আছ মহান চরিত্রে।(সূরা কলাম (৬৮), আয়াত ৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটিতে অতি সংক্ষেপে অথচ পূর্ণাঙ্গভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে যে, তিনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। অর্থাৎ মহান চরিত্র যেন একটি আসন, যার উপর তিনি পূর্ণ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সঙ্গে অধিষ্ঠিত। কিংবা মহান চরিত্র যেন এমন এক বাহন, যার উপর তিনি চেপে বসা ছিলেন এবং আপন ইচ্ছামতো তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। বোঝানো উদ্দেশ্য- উত্তম চরিত্র কখনও তাঁর হাতছাড়া হতে পারত না। কখনও তিনি সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতেন না। আনন্দ-বিষাদ, রাগ-বিরাগ, প্রকাশ্য-গুপ্ত সর্বাবস্থায় তাঁর উন্নত চরিত্র অটুট থাকত। কোনওরকম ভাবাবেগে তিনি তাঁর মহান চরিত্র থেকে একটুও বিচ্যুত হতেন না। তাঁর গোটা জীবন এ কথার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
বস্তুত কুরআন যে চারিত্রিক শিক্ষা দেয়, তাই মহান চরিত্র। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র কুরআন মাজীদ থেকেই নেওয়া। কুরআন মাজীদে যা-কিছু উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই পরিপূর্ণ মাত্রায় তাঁর মধ্যে বিরাজ করত। সততা ও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, দানশীলতা, দয়া ও সহমর্মিতা, শালীনতা ও লজ্জাশীলতা, আল্লাহনির্ভরতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, পরার্থপরতা, উদারতা, ন্যায়নিষ্ঠা, গুণগ্রাহিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রভৃতি সদগুণের এমন কোনটি আছে, যা পরিপূর্ণরূপে তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল না? আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করেছিলেন এবং তাঁর জীবনকে ওহীর শিক্ষার বাস্তব নমুনা বানিয়েছিলেন। সুতরাং সত্যকথা হচ্ছে কুরআন মাজীদ যে চরিত্রের শিক্ষাদান করে, তিনি ছিলেন তার জীবন্ত রূপ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন-
كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ
‘কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।(মুসনাদে আহমাদ: ২৪৬০১; আল আদাবুল মুফরাদ: ৩০৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪৪৩৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭২; শু'আবুল ঈমান: ১৩৫৯; শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৯৪)
হযরত আলী রাযি. বলেন, خُلُقٍ عَظِيمٍ হল কুরআনের শিক্ষামালা। জুনায়েদ বাগদাদী রহ. বলেন, তাঁর চরিত্রকে মহান চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে এ কারণে যে, আল্লাহ তা'আলা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তিনি তাঁর মহান চরিত্র দিয়ে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর প্রকাশ্য দিক ছিল মাখলুকের সঙ্গে, কিন্তু অন্তর্জগৎ ছিল স্রষ্টার সঙ্গে।
আয়াতটির শিক্ষা
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে নিজেদের জীবনে তাঁর মহান চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
দুই নং আয়াত
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134)
অর্থ: এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলে-ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগের আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, জান্নাত মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এ আয়াতে মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল রাগ হজম করা। এখানে বলা হয়েছে-
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার উপর রাগ ওঠে, তার উপর রাগের আচরণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা করা হতে নিজেকে বিরত রাখে। এটি একটি মহৎ গুণ। এর অনেক ফযীলত। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ ، وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ ، مَلَأَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ قَلْبَهُ أَمْنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি রাগ সংবরণ করে, অথচ সে চাইলে তা কার্যকর করতে পারত, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার অন্তর নিরাপত্তায় ভরে দেবেন।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৬০২৬; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ৩৫৪৩)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
وَمَنْ كَفَّ غَضَبَهُ كَفَّ اللَّهُ عَنْهُ عَذَابَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রোধ সংবরণ করে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার থেকে আযাব দূর করে দেবেন।(শু'আবুল ঈমান: ৭৯৫৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৩৮; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৩২১)
এ বাক্যে বর্ণিত মুত্তাকীদের দ্বিতীয় গুণ হল ক্ষমতাশীলতা। বলা হয়েছে- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত)। অর্থাৎ কেউ বেয়াদবি করলে, আর্থিক ক্ষতি করলে, শারীরিকভাবে কষ্ট দিলে, মানসিক আঘাত করলে, এককথায় অপ্রীতিকর যে আচরণই করুক, মুত্তাকী ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করে দেয়। ক্ষমাশীলতা ইসলামের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল ছিলেন। তায়েফের দুরাচারদের ক্ষমা করে দেওয়া, এমনিভাবে মক্কাবিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা তাঁর ক্ষমাশীল চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ক্ষমাশীল হতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।’(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)
কেউ ভুল করার পর যদি ক্ষমা চায়, তবে তাকে ক্ষমা করা অবশ্যকর্তব্য। ক্ষমা না করা গুনাহ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنِ اعْتَذَرَ إِلَى أَخِيهِ فَلَمْ يَعْذُرْهُ أَوْ يَقْبَلْ عُذْرَهُ كَانَ عَلَيْهِ مِثْلُ خَطِيئَةِ صَاحِبِ مَكْسٍ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু সে তাকে ক্ষমা না করে বা তার ওজর কবুল না করে, তার গুনাহ হয় (জালেম) কর উসূলকারীর মতো।(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৭৯৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৮৬৪৪; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ৬৪৯
قال البوصيري في الزوائد : رجاله ثقات إلا أنه مرسل)
আয়াতটিতে সবশেষে বলা হয়েছে- وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন)। অর্থাৎ উল্লিখিত গুণাবলি যাদের মধ্যে আছে, তারা পুণ্যবান। আর আল্লাহ তা'আলা এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আল্লাহ তা'আলা অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। مُحْسِنٌ শব্দটির উৎপত্তি إِحْسَانٌ থেকে।
ইহসান অর্থ দয়া ও অনুগ্রহ করা। এটা ন্যায় ও ইনসাফের পরবর্তী ধাপ। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ ও দয়া করার হুকুম দেন।( সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯০)
ইনসাফ হল যে যেমন ব্যবহার করে, তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা। আর ইহসান হল অন্যকে তার ন্যায্য অধিকারের চেয়ে আরও বেশি দেওয়া কিংবা যে ব্যক্তি মন্দ আচরণ করে, তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা। যেমন কুরআন মাজীদে আদেশ করা হয়েছে-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ
‘তুমি মন্দকে প্রতিহত করবে এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট।(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৬)
এর দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় হযরত যায়নুল আবিদীন রহ.-এর একটি ঘটনা দ্বারা। তার এক গোলামের আচরণে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। এতে তার রাগ হল। গোলাম বলে وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ (যারা নিজের ক্রোধ হজম করে)। তিনি রাগ হজম করলেন। গোলাম বলল- وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং যারা মানুষকে ক্ষমা করে)। তিনি বললেন, তোমাকে ক্ষমা করলাম। শেষে গোলাম বলল- وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন)। তিনি বললেন, যাও তোমাকে আযাদ করে দিলাম।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. রাগ হজম করা একটি মহৎ গুণ। এ গুণ আমাদের অর্জন করতে হবে।
খ. ক্ষমাশীলতা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। প্রত্যেক মুমিনের এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।
গ. ইহসান ও অনুগ্রহের আচরণ চরিত্রের উচ্চতর স্থান। এ স্তরে পৌঁছার দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ হয়।
কেমন ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র
হাদীছ নং: ৬২০
হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চরিত্রের দিক থেকে ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬২০৩; সহীহ মুসলিম: ৬৫৯; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭৩; জামে' তিরমিযী: ২০১৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৪৪৩ )
হাদীছ নং: ৬২০
হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চরিত্রের দিক থেকে ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬২০৩; সহীহ মুসলিম: ৬৫৯; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭৩; জামে' তিরমিযী: ২০১৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৪৪৩ )
73 - باب حسن الخلق
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ} [ن: 4]، وقال تَعَالَى: {وَالكَاظِمِينَ الغَيْظَ وَالعَافِينَ عَنِ النَّاسِ} [آل عمران: 134] الآية.
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ} [ن: 4]، وقال تَعَالَى: {وَالكَاظِمِينَ الغَيْظَ وَالعَافِينَ عَنِ النَّاسِ} [آل عمران: 134] الآية.
620 - وعن أنس - رضي الله عنه - قال: كَانَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - أحْسَنَ النَّاس خُلُقًا. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্রবান মানুষরূপে উল্লেখ করেছেন। এটা স্বাভাবিক যে, তাঁর চরিত্র সর্বশ্রেষ্ঠই হবে। কেননা তাঁর শিক্ষক ও তারবিয়াতকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা। ইরশাদ হয়েছে-
وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا (113)
আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং তোমাকে এমনসব বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছেন, যা তুমি জানতে না। বস্তুত তোমার প্রতি সর্বদাই আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।(সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৩)
সুতরাং আল্লাহ তা'আলা তাঁকে নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক-চরিত্রে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের আদর্শরূপে গড়ে তুলেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا (21)
বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ- এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত-দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে।(সূরা আহযাব (৩৫), আয়াত ২১)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কতটা উন্নত আখলাক-চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তা তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের সাক্ষ্য দ্বারাই বোঝা যায়। আখলাক-চরিত্রে যারা উন্নত নয়, তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা ক্রমান্বয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি হারায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে দেখি যে ব্যক্তি তাঁর যত বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে, সে তাঁর ততো বেশি ভক্ত হয়েছে। ঘনিষ্ঠতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসারও ক্রমোন্নতি ঘটেছে। হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. ছিলেন তাঁর দশ বছরের খাদেম। আলোচ্য এ হাদীছটি তাঁরই বর্ণিত। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উমর ফারুক রাযি. তথা আশারায়ে মুবাশশারাসহ আরও যত সাহাবী তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তাঁর সবচে' বেশি ঘনিষ্ঠ যারা, সেই উম্মাহাতুল মুমিনীনও জীবনভর তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা বজায় রেখেছিলেন। এটা তাঁর মধুর চরিত্রের পরিপূর্ণতারই নিদর্শন। সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন-
أَجْوَدُ النَّاسِ صَدْرًا ، وَأَصْدَقُ النَّاسِ لَهْجَةً، وَأَلْيَنهُمْ عَرِيكَةً، وَأَكْرَمُهُمْ عِشْرَةً، مَنْ رَآهُ بَدِيهَةً هَابَهُ، وَمَنْ خَالَطَهُ مَعْرِفَةً أَحَبَّهُ ، يَقُوْلُ نَاعِتُهُ : لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ مِثْلَهُ
তিনি ছিলেন মনের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতম দাতা, কথায় সর্বাপেক্ষা বেশি সত্যবাদী, ব্যবহারে সর্বাপেক্ষা বেশি কোমল, সাহচর্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মহানুভব। যে ব্যক্তি হঠাৎ করেই তাঁকে দেখত, সে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু যে ব্যক্তি মেলামেশা করে তাঁকে চিনত, সে তাঁকে ভালোবেসে ফেলত। তাঁর পরিচয়দাতা বলে থাকে, তাঁর আগে ও পরে তাঁর মতো কাউকে দেখিনি।(জামে' তিরমিযী: ৩৬৩৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩১৮০৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৭০৭; শু'আবুল ঈমান : ১৩৫০; ইবন শাব্বাহ, তারীখুল মাদীনাহ, ২ খণ্ড, ৬০৪ পৃষ্ঠা।)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তাই তাঁর উম্মত হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য উত্তম চরিত্র অর্জনের সাধনা করা।
وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا (113)
আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং তোমাকে এমনসব বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছেন, যা তুমি জানতে না। বস্তুত তোমার প্রতি সর্বদাই আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।(সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৩)
সুতরাং আল্লাহ তা'আলা তাঁকে নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক-চরিত্রে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের আদর্শরূপে গড়ে তুলেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا (21)
বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ- এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত-দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে।(সূরা আহযাব (৩৫), আয়াত ২১)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কতটা উন্নত আখলাক-চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তা তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের সাক্ষ্য দ্বারাই বোঝা যায়। আখলাক-চরিত্রে যারা উন্নত নয়, তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা ক্রমান্বয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি হারায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে দেখি যে ব্যক্তি তাঁর যত বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে, সে তাঁর ততো বেশি ভক্ত হয়েছে। ঘনিষ্ঠতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসারও ক্রমোন্নতি ঘটেছে। হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. ছিলেন তাঁর দশ বছরের খাদেম। আলোচ্য এ হাদীছটি তাঁরই বর্ণিত। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উমর ফারুক রাযি. তথা আশারায়ে মুবাশশারাসহ আরও যত সাহাবী তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তাঁর সবচে' বেশি ঘনিষ্ঠ যারা, সেই উম্মাহাতুল মুমিনীনও জীবনভর তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা বজায় রেখেছিলেন। এটা তাঁর মধুর চরিত্রের পরিপূর্ণতারই নিদর্শন। সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন-
أَجْوَدُ النَّاسِ صَدْرًا ، وَأَصْدَقُ النَّاسِ لَهْجَةً، وَأَلْيَنهُمْ عَرِيكَةً، وَأَكْرَمُهُمْ عِشْرَةً، مَنْ رَآهُ بَدِيهَةً هَابَهُ، وَمَنْ خَالَطَهُ مَعْرِفَةً أَحَبَّهُ ، يَقُوْلُ نَاعِتُهُ : لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ مِثْلَهُ
তিনি ছিলেন মনের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতম দাতা, কথায় সর্বাপেক্ষা বেশি সত্যবাদী, ব্যবহারে সর্বাপেক্ষা বেশি কোমল, সাহচর্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মহানুভব। যে ব্যক্তি হঠাৎ করেই তাঁকে দেখত, সে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু যে ব্যক্তি মেলামেশা করে তাঁকে চিনত, সে তাঁকে ভালোবেসে ফেলত। তাঁর পরিচয়দাতা বলে থাকে, তাঁর আগে ও পরে তাঁর মতো কাউকে দেখিনি।(জামে' তিরমিযী: ৩৬৩৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩১৮০৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৭০৭; শু'আবুল ঈমান : ১৩৫০; ইবন শাব্বাহ, তারীখুল মাদীনাহ, ২ খণ্ড, ৬০৪ পৃষ্ঠা।)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তাই তাঁর উম্মত হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য উত্তম চরিত্র অর্জনের সাধনা করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
