রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬১১
অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা
এখানে দু‘টি বিষয় আছে : اَلْكِبرُ (কিবর) ও اَلْعُجْبُ (‘উজব) অর্থাৎ অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা। কিবর বা অহংকার হল নিজেকে উত্তম ভাবা এবং অন্যকে তুচ্ছ গণ্য করা ও তাচ্ছিল্য করা। আর ‘উজব হল অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ছাড়া কেবল নিজেকে উত্তম ভাবা।
অহংকার যদি হয় আল্লাহর সঙ্গে, যদ্দরুন তাঁর আনুগত্য পরিত্যাগ করা হয় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হয়, তবে তা কুফর সাব্যস্ত হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে অবজ্ঞা করে, তাঁর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, সে নিশ্চিত কাফের। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে অবজ্ঞা করে না, স্রেফ নিজ গাফলাত ও ইন্দ্রিয়পরবশতার কারণে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে, সে একজন পাপী, সে কাফের নয়।
অহংকার যদি হয় মানুষের সঙ্গে, আর তাতে শরী'আত অবজ্ঞা করা না হয়, তবে তা কুফর নয়, কিন্তু কঠিন গুনাহ। যদি শরী'আত অবজ্ঞা করা হয়, তবে কুফর বটে।
অহংকার বহু রোগের মূল। ইমাম গাযালী রহ.-এর ভাষায় ‘উম্মুল আমরায’, সকল আত্মিক রোগের জননী। অর্থাৎ এর থেকে নানা আত্মিক রোগের জন্ম হয়। যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, অতিরিক্ত রাগ, গীবত ইত্যাদি। ইবলীস অভিশপ্ত হয়েছিল অহংকার করেই। আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম আলাইহিস সালামের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য সিজদার হুকুম করলে ফিরিশতারা সিজদা করেছিলেন, কিন্তু ইবলীস অহংকারবশে সিজদা করতে অপারগতা জানায়। সে বলে ওঠে-
أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ (12)
‘আমি তার চেয়ে উত্তম। তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি দ্বারা।(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১২)
যে চরিত্রের কারণে ইবলীস মরদুদ ও অভিশপ্ত হয়েছে তা যে কত মন্দ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুফয়ান ইবন উয়ায়না রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কোনও লোভ-লালসার কারণে গুনাহ করে ফেলে, তার তাওবার আশা রাখতে পার। কিন্তু যার গুনাহর কারণ হয় অহংকার, তার সম্পর্কে লা'নতের ভয় রাখো। কেননা ইবলীস গুনাহ করেছিল অহংকারবশে। পরিণামে সে লা'নতগ্রস্ত হয়েছে।
অহংকারের কারণে মানুষ যে কেবল গুনাহ করে তাই নয়; সে বহুবিধ কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত থাকে। যেমন অহংকারী ব্যক্তি অন্যের উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না। সে সম্মানী ব্যক্তির সামনেও বিনয় দেখাতে সক্ষম হয় না। অহংকারী ব্যক্তি সহজে নিজ অজ্ঞতা স্বীকার করতে পারে না, ফলে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে সে জ্ঞান আহরণ থেকে বঞ্চিত থাকে। এমনকি অহংকার মানুষের ঈমান আনার পক্ষেও বাধা হয়। মনেপ্রাণে সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও বহু লোক কেবল অহংকারের কারণেই তা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে কাফের অবস্থায় তাদের কবরে যেতে হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ (14)
‘তারা সীমালঙ্ঘন ও অহমিকাবশত তা সব অস্বীকার করল, যদিও তাদের অন্তর সেগুলো (সত্য বলে) বিশ্বাস করে নিয়েছিল। সুতরাং দেখে নাও ফাসাদকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল!’(সূরা নামল (২৭), আয়াত ১৪)
কিবর বা অহংকারের কাছাকাছি আরেকটি ব্যাধি হল ‘উজব বা আত্মমুগ্ধতা। নিজের ভালো কোনও অবস্থা দেখে সেজন্য অন্যের তুলনায় নিজেকে উত্তম ভাবা হচ্ছে ‘উজব। এটা অহংকারের উৎস। এর থেকেই অহংকার সৃষ্টি হয়। তাই এটাও অতি নিন্দনীয়। কেননা এটা নেক আমল বরবাদ করে দেয়। নেক আমল করার তাওফীক হলে সেজন্য দরকার আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা আর কবুলের আশা রাখা। সেইসঙ্গে এই ভয়ে ভীত থাকাও জরুরি যে, নাজানি আল্লাহ তা'আলা তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু যার অন্তরে ‘উজব থাকে, তার অবস্থা এরূপ হয় না। সে তো মনে করে এই এই আমল করে আমি অন্যের উপরে চলে গেছি। কে কার উপরে যেতে পারে, তা আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না। কেননা তা নির্ভর করে আমল কবুল হওয়ার উপর। আত্মমুগ্ধতা কবুলিয়াতের জন্য বাধা। তাই হাদীছে একে ধ্বংসাত্মক বলা হয়েছে। বিখ্যাত বুযুর্গ মুতাররিফ রহ. বলেন, আমি যদি ঘুমিয়ে থাকি আর ভোরবেলা অনুতপ্ত হয়ে জাগি, তবে এটাই আমার কাছে এরচে' বেশি পসন্দ যে, আমি রাতভর তাহাজ্জুদ পড়ব আর ভোরবেলা নিজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাব।
‘উজব ও আত্মমুগ্ধতা মানুষের দীনদারীর পথে অগ্রগামিতাও থামিয়ে দেয়। কেউ যখন নিজ আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যায়, তখন শয়তান তার অন্তরে এই ধারণা জন্মে দেয় যে, তুমি যথেষ্ট আমল করছ। এর বেশি আর কী প্রয়োজন? ফলে সে সামনে চলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সামনে চলা বন্ধ হয়ে গেলে অধঃপতন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার আমল তলানিতে নেমে যায়। একই অবস্থা হয় ইলম, আখলাক, দান- খয়রাত, খেদমতে খালকসহ দীনের যাবতীয় ক্ষেত্রে।
বস্তুত দীনের কোনওকিছুই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যক্তির মধ্যে যখন ‘উজব জন্ম নেয়, তখন দৃষ্টি আল্লাহ থেকে সরে নিজ চেষ্টা ও আসবাব-উপকরণের দিকে চলে যায়। ফলে সে আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। তখন তার চেষ্টা- মেহনত ও আসবাব-উপকরণ কোনওকিছুই কাজে আসে না। আল্লাহ তা'আলা হুনায়নের যুদ্ধে এর বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছেন। সে সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ (25)
‘বস্তুত আল্লাহ বহু ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং (বিশেষ করে) হুনায়নের দিন, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে আত্মপ্রসাদে লিপ্ত করেছিল। কিন্তু সে সংখ্যাধিক্য তোমাদের কোনও কাজে আসেনি এবং যমীন তার প্রশস্ততা সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে (যুদ্ধক্ষেত্র হতে) পলায়ন করেছিলে।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ২৫)
বোঝা গেল অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা কঠিন আত্মিক ব্যাধি। এর চিকিৎসা অতীব জরুরি। এজন্যই কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে কঠিনভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এগুলো বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।


‘অহংকার ও আত্মমুগ্ধতা হারাম হওয়ার ঘোষণা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (83)
অর্থ: ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে।( সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৩)

ব্যাখ্যা
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ (ওই পরকালীন নিবাস) অর্থাৎ জান্নাত, যা হবে আখিরাতে মুমিনদের স্থায়ী বাসস্থান এবং যার বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন নি'আমত সম্পর্কে কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ধারণা দেওয়া হয়েছে।

نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا (তা আমি সে সকল লোকের জন্য নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না)। عُلو এর অর্থ উপর, উচ্চতা। কেউ যখন কোনও দিক থেকে কারও উপরে চলে যায়, তখন তার অন্তরে অহমিকা জন্মায়। এ কারণে শব্দটি অহংকার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। فَسَاد অর্থ অশান্তি, বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা। যে-কোনও পাপকর্ম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই শব্দটি দ্বারা পাপকর্মও বোঝানো হয়ে থাকে।
আয়াতটির সারমর্ম হল, যারা পার্থিব জীবনে অহংকার পরিত্যাগ করে ও বিনয় অবলম্বন করে এবং সর্বপ্রকার পাপকর্ম পরিহার করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, আখিরাতে তারা জান্নাতবাসী হবে। বোঝা গেল যারা অহংকার দেখায় ও অশান্তি বিস্তার করে তথা পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, জান্নাতের চিরসুখের ঠিকানা তাদের জন্য নয়।
আয়াতটিতে প্রথমে অহংকার এবং তারপর অশান্তি বিস্তার বা পাপকর্মে লিপ্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, অশান্তি বিস্তার ও পাপকর্ম করার পেছনে অহংকারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই শান্তিময় জীবন ও পাপকর্ম হতে বিরত থাকার জন্য অন্তর থেকে অহংকার নির্মূল করা অতীব জরুরি। অহংকারের জন্য عُلو বা ‘উপরে ওঠা’ শব্দ ব্যবহারের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কেউ যখন কোনও দিক থেকে অন্যের উপরে উঠে যায়, তখন তার সতর্ক থাকা উচিত যাতে উপরে উঠাটা তাকে অহংকারে লিপ্ত করে না বসে। অন্যের উপরে থাকাটা ইলমের দিক থেকে হোক বা আমলের দিক থেকে, সম্পদের দিক থেকে হোক বা ক্ষমতার দিক থেকে, দৈহিক শক্তির দিক থেকে হোক বা অভ্যন্তরীণ গুণাবলিতে হোক, এমনিভাবে রূপ ও সৌন্দর্যে হোক বা প্রতিভার দিক থেকে, তা যেদিক থেকেই হোক না কেন, নিঃসন্দেহে তা আল্লাহ তা'আলারই দান। সেজন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা উচিত। শোকরের বিষয়কে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা কোনও মুমিনের কাজ হতে পারে না। যে- কোনও নি'আমতকে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা সে নি'আমতের সুস্পষ্ট অকৃতজ্ঞতা। নি'আমতের জন্য শোকর আদায় করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে পুরস্কার পাওয়া যায়। অকৃতজ্ঞদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা।
وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে)। শেষ পরিণাম মানে শুভ পরিণাম। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতলাভ। এ সৌভাগ্য কেবল তাদেরই হবে, যারা তাকওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ পালন করে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. জান্নাত মুত্তাকীদের স্থায়ী বাসস্থান।
খ. অহংকার ও অহমিকা জান্নাতলাভের পক্ষে বাধা।
গ. জান্নাতের আশাবাদী ব্যক্তিকে অবশ্যই অশান্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে।
ঘ. জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ করার জন্য আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালন করা অবশ্যকর্তব্য।

দুই নং আয়াত
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا
অর্থ: ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৭)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৭ নং আয়াতের প্রথম অংশ। এতে চালচলনে দম্ভ ও অহংকার দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে। মানুষের অহংকার যেমন তার পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় প্রকাশ পায়, তেমনি তা প্রকাশ পায় চালচলনেও। মানুষ আল্লাহর বান্দা। বন্দেগীর দাবি যাবতীয় ক্ষেত্রে বিনয় অবলম্বন করা, এমনকি হাঁটা- চলায়ও। সূরা ফুরকানে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا
‘রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে বিনয়-নম্রভাবে চলাফেরা করে।’(সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
বোঝা গেল যাদের হাঁটা-চলায় বিনয় থাকে না, তারা সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহর বান্দা হলেও কর্ম ও চরিত্রের দিক থেকে দয়াময় আল্লাহর বান্দা নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দা নয়। তারা তাঁর লা'নত ও আযাবের উপযুক্ত।
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ ……. وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ (48)
‘তোমরা তাদের মতো হবে না, যারা নিজ গৃহ থেকে দম্ভভরে এবং মানুষকে (নিজেদের ঠাটবাট) দেখাতে দেখাতে বের হয়েছিল......এবং আল্লাহর শাস্তি অতি কঠোর।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৪৭-৪৮)
আলোচ্য আয়াতটির শেষ অংশ হল- إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا (তুমি তো ভূমিকে ফাটিয়ে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না)। অর্থাৎ দম্ভভরে চলার উদ্দেশ্য কী? তুমি কি ভূমি ফাটিয়ে ফেলতে চাও, নাকি পাহাড়ের মতো উঁচু হতে চাও? নিশ্চয়ই তা চাও না। কারণ তা তোমার ক্ষমতায় নেই। তাহলে শুধু শুধু এভাবে চলছ কেন? শুধু শুধু কোনওকিছু করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। আর যদি তুমি মনে কর এভাবে চলার দ্বারা তুমি মানুষের চোখে বড় হয়ে যাবে, তবে তাও একটা ভুল ধারণা। কেননা দম্ভ-অহংকার দ্বারা কেউ কারও চোখে বড় হয় না। বরং তাতে মানুষ আরও ক্ষুদ্র ভাবে। অহংকারী ব্যক্তি নিজের চোখেই নিজে বড় থাকে, অন্যদের চোখে হয়ে যায় ছোট। সুতরাং এভাবে চলাটা বৃথা প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয়। তাই এভাবে না চলে নম্র-কোমল হয়ে চলো। তাতে আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারবে। ফলে আল্লাহ তা'আলা মাখলুকের দৃষ্টিতে তোমাকে উঁচু করে দেবেন।

আয়াতটির শিক্ষা
হাঁটা-চলায় আমাদেরকে দম্ভভাব পরিহার করে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করতে হবে।

তিন নং আয়াত
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (18)
অর্থ: এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৮)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দু'টি নিষেধাজ্ঞা আছে। এক নিষেধাজ্ঞা হল – وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ ‘এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না'। অর্থাৎ মানুষকে তাচ্ছিল্য করে অহংকারীদের মতো মুখ ভার করে কথা বলো না; বরং হাসিমুখে কথা বলো। এর আরেক অর্থ হল, যখন লোকজন তোমার সঙ্গে কথা বলবে, তখন অহংকারবশে তাদের তাচ্ছিল্য করো না এবং তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। বরং নম্রতার সঙ্গে তাদের দিকে মনোযোগী হও এবং তারা কী বলে, আগ্রহের সঙ্গে তা শোনো।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিষেধ করা হয়েছে তা হল- وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا (এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না)। উপরে ২ নং আয়াতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বস্তুত উভয় নিষেধাজ্ঞাই অহংকার সম্পর্কিত। একটি হল অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও কথাবার্তায় অহংকার করা। আর দ্বিতীয়টি হল অহংকারের সঙ্গে চলাচল করা। উভয়টিই অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন মুমিনের পক্ষে সম্পূর্ণ অশোভন এবং কাফেরদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মুমিনের সবকিছুতেই থাকবে বিনয়, যা আল্লাহ পসন্দ করেন। মুমিন ব্যক্তি তার যাবতীয় কাজে লক্ষ রাখবে আল্লাহ তা'আলা কী পসন্দ করেন এবং কী পসন্দ করেন না। অহমিকাপূর্ণ কোনও আচরণ আল্লাহ তা'আলার পসন্দ নয়। সুতরাং আয়াতটির শেষে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না)। আর এ কারণেই তিনি উল্লিখিত দু'টি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। বলাবাহুল্য একজন মুমিন যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহপ্রেমিক হবে, তাই আল্লাহ তা'আলার অপসন্দনীয় এ কাজদু'টি সে কিছুতেই করবে না; করতে পারে না।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. কথাবার্তা ও চলাফেরায় আমাদেরকে অহমিকার ভাব পরিহার করতে হবে।
খ. কেউ যখন কথা বলে, তখন তার প্রতি মনোযোগী থাকা চাই। উপেক্ষাভাব দেখানো উচিত নয়।
গ. অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় মুখ ভার করে রাখা নয়; বরং হাসিমুখে কথা বলতে হবে।
ঘ. ঔদ্ধত্য ও অহমিকা প্রকাশ পায় এমন যাবতীয় আচরণ পরিত্যাজ্য।

চার নং আয়াত
إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ (76) وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ (77) قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ (78) فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (79) وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (80) فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ (81)
অর্থ : কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ করো। আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না। সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি এতটুকুও জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতে তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং জনসংখ্যায়ও বেশি ছিল? অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়! আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই। পরিণামে আমি তাকে ও তার বাড়িটি ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। অতঃপর সে এমন একটি দলও পেল না, যারা আল্লাহর বিপরীতে তার কোনও সাহায্য করতে পারে এবং নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬-৮১)

ব্যাখ্যা
কারূন ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের লোক। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, সে ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের চাচাতো ভাই। সে অনেক বড় ধনী ছিল। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতলাভের আগে ফেরাউন তাকে বনী ইসরাঈলের নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম নবুওয়াত লাভ করলেন আর হযরত হারুন আলাইহিস সালামকে তাঁর নায়েব বানানো হল, তখন কারূন ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, সে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে দাবি জানিয়েছিল, তাকে যেন কোনও পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কোনও পদ দেওয়া হোক এটা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ ছিল না। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম অপারগতা প্রকাশ করলেন, এতে তার হিংসার আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল এবং তা চরিতার্থ করার জন্য মুনাফিকীর পন্থা অবলম্বন করল। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে বলেছেন- فَبَغَى عَلَيْهِمْ (কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল)। এর আরেক অর্থ হতে পারে- দম্ভ ও বড়াই করল। বর্ণিত আছে যে, ফেরাউনের পক্ষ থেকে তার উপর যখন বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব-ভার অর্পণ করা হয়, তখন সে তাদের উপর জুলুম করেছিল এবং সকলের উপর নিজ শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছিল। একে তো ছিল তার ধন-সম্পদ, তার উপর পেয়েছিল ক্ষমতা। যাদের মনে আল্লাহর ভয় থাকে না, তারা এ দু'টির কারণেই উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে যায়। কারূনেরও তাই হয়েছিল। সে কেমন ধনী ছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّة (আমি তাকে এমন ধনভাণ্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলি বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল)। কথিত আছে, কারুন যেখানেই যেত, নিজ ধন-ভাণ্ডারের চাবিসমূহ সঙ্গে নিয়ে যেত। চাবিগুলো ছিল লোহার। ক্রমান্বয়ে তার ধন-সম্পদ বাড়তে থাকলে চাবির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে বোঝা অনেক ভারী হয়ে যায়। ফলে সে কাঠের ছোট ছোট চাবি বানিয়ে নেয়। কিন্তু সংখ্যা প্রচুর হওয়ায় তাও এত ভারী হয়ে যায় যে, তা বহন করতে ৪০টি খচ্চর লাগত। কোনও কোনও বর্ণনা অনুযায়ী তার চাবি বহন করত ৪০ জন শক্তিশালী লোক। তারা যখন সেগুলো বহন করত, তখন তার ভারে তারা নুইয়ে পড়ত। এর দ্বারা অনুমান করা যায় তার সম্পদ কত বিপুল ছিল। ঈমান না থাকায় এ সম্পদের কারণে সে চরম উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে পড়ে। এ কারণে তার সম্প্রদায় তাকে নসীহত করেছিল। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ (যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না)। বস্তুত অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকলে এটাই হয় ঐশ্বর্যের পরিণতি। ধন-দৌলত মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى (6) أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى (7)
‘বস্তুত মানুষ সীমালঙ্ঘন করছে। কেননা সে নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে।’সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ৬-৭)
لَا تَفْرَحْ এর আরেক অর্থ হতে পারে- উৎফুল্ল হয়ো না। দুনিয়ার ধন-সম্পদে উৎফুল্ল হওয়া নিন্দনীয়, তাতে অন্তরে অহংকার থাকুক বা নাই থাকুক। কেননা দুনিয়ার সম্পদে উৎফুল্ল হওয়াটা দুনিয়ার প্রতি আসক্তির লক্ষণ। আর সম্পদের আসক্তি দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীনতার নিদর্শন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব ও নশ্বরতা সম্পর্কে উদাসীন হওয়াটা কিছুতেই কাম্য নয়। কেননা তাতে অন্তর আল্লাহ থেকে বিমুখ হয়ে যায়। আল্লাহবিমুখ অন্তর কখনও শোকরগুযার হয় না; বরং অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ তা'আলা শোকরগুযার বান্দাকে ভালোবাসেন এবং অকৃতজ্ঞকে ঘৃণা করেন। এ কারণেই কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে দুনিয়া ও দুনিয়ার সম্পদে উৎফুল্ল ও আসক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (23)
‘যাতে তোমরা যা হারিয়েছ তার জন্য দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন কোনও ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে।’(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৩)
কারূনকে আরো উপদেশ দেওয়া হয়েছিল- وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ (আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো)।অর্থাৎ অর্থ-সম্পদকে আল্লাহ তা'আলার বিধান মোতাবেক ব্যবহার করো। পরিণামে তুমি আখিরাতে পরম শান্তির জান্নাতী নিবাসে পৌঁছতে পারবে। আয়াতে সাধারণভাবে مَا آتَاكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন) বলা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহপ্রদত্ত প্রকাশ্য-গুপ্ত যাবতীয় নি'আমত এবং মানুষের শারীরিক ও মেধাগত সকল যোগ্যতা-ক্ষমতা মৌলিকভাবে আখিরাতের নাজাতলাভের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা উচিত।
কারুনকে আরও বলা হয়েছিল- وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا (এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না)। অর্থাৎ আখিরাতের নিবাস সন্ধানের মানে এ নয় যে, দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহ বিলকুল অগ্রাহ্য করা হবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা ও তা রাখাতে দোষের কিছু নেই। বরং নিজের ও পরিবারবর্গের প্রতি কর্তব্যপালনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও আসবাব-উপকরণ সংগ্রহ করা জরুরি বটে। প্রকৃতপক্ষে তাও ছাওয়াবের কাজই। এতে অবহেলা করা গুনাহ। কেননা তাতে দায়িত্বে অবহেলা হয়। হাঁ, দুনিয়ার কামাই-রোজগারে এভাবে নিমজ্জিত হতে নেই, যদ্দরুন আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাকে আরও উপদেশ দেওয়া হয়েছিল- وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ‘আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ করো’। ইশারা করা হয়েছে যে, দুনিয়ায় তুমি যে অর্থ-সম্পদ লাভ করেছ, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলাই তার মালিক। তিনি অনুগ্রহ করে তোমাকে তা দান করেছেন। তিনি যখন এভাবে তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তখন তুমিও মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো এবং তাঁর প্রদত্ত অর্থ-সম্পদে তাদেরকে শরীক করো।
অথবা এর অর্থ- আল্লাহ তা'আলা যেহেতু তোমাকে এসব সম্পদ দিয়েছেন, তাই তার শোকর আদায়ের লক্ষ্যে তুমি উত্তমরূপে আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করো ও সর্বদা তাঁকে স্মরণ করো।
তাকে বলা হয়েছিল- وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ (আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না)। অর্থাৎ এমনসব তৎপরতা থেকে বিরত থেকো, যাতে পৃথিবীর শান্তি নষ্ট হয় এবং বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। ইমাম বাগাবী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানি করে, সে পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে। অর্থাৎ যাবতীয় অশান্তির মূল আল্লাহ তা'আলার নাফরমানি ও পাপকর্ম।
উল্লিখিত নসীহত ও উপদেশের বিপরীতে কারুন বলেছিল - إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي (এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি)। অর্থাৎ কারূন দাবি করছিল, আমি এ ধন-সম্পদের মালিক হয়েছি নিজ বিদ্যা-বুদ্ধির বলে। সে যেন বলতে চাচ্ছিল, আল্লাহ আমার প্রতি কোনও অনুগ্রহ করেননি। এ ধন-সম্পদ তিনি আমাকে দান করেননি, তাই তার শোকর আদায় করারও কোনও প্রয়োজন আমার নেই। এসব আমার নিজ চেষ্টার ফল। আমি ব্যবসা-বাণিজ্যের কলা-কৌশল জানি। কৃষিবিজ্ঞানে আমার দখল আছে। অর্থোপার্জনের অন্যসব পদ্ধতি সম্পর্কেও আমি অবহিত। এ কারণেই এত অর্থবিত্ত আমার হাতে এসেছে। এতে আল্লাহর বান্দাদের কোনও অংশ থাকবে কেন? তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা আমার কর্তব্য হবে কেন?
সাহল রহ. বলেন, যে ব্যক্তি কেবল নিজেকে দেখেছে, সে সফল হয়নি। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি, যে তার নিজের দিকে অহংকারের দৃষ্টিতে তাকায়নি এবং আপন কথা ও কাজে অহংকার প্রকাশ করেনি। ওই ব্যক্তি বড় দুর্ভাগা, যে তার কথা, কাজ ও অবস্থাকে আকর্ষণীয় করেছে এবং সেজন্য অহমিকা দেখিয়েছে। সে চিন্তা করেনি যে, একদিন তাকে ধ্বংস করে ফেলা হবে, যেমন কারূনকে তার অহমিকার কারণে মাটির ভেতর ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কারুনের ওই আত্মম্ভরি বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ তা'আলা বলেন- أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا (সে কি এতটুকুও জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতে তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং জনসংখ্যায়ও বেশি ছিল)? অর্থাৎ কারূন নিজ জ্ঞানবত্তার দাবি করছে, অথচ তার বক্তব্য দ্বারাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উচ্চস্তরের জ্ঞান তো দূরের কথা, এই মামুলি জ্ঞানটুকুও তার ছিল না যে, সে যদি নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারাই অর্থোপার্জন করে থাকে, তবে সেই জ্ঞান-বুদ্ধি সে কোথায় পেল? কে তাকে তা দান করেছিল? সেইসঙ্গে সে এ বিষয়টাও অনুধাবন করছে না যে, তার আগেও তো তার মতো, বরং তার চেয়েও ধন-জনে শক্তিমান কত লোক ছিল, আজ তারা কোথায়? তারাও তার মতো দর্প দেখাত এবং তার মতো দাবি করে বেড়াত। পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি তো 'আদ জাতিকেও ধ্বংস করেছেন, যারা দৈহিক শক্তি ও অর্থশক্তিতে তারচে' অনেক বলীয়ান ছিল। শাদ্দাদ ছিল কত বড় সম্রাট! কী বিশাল ছিল তার রাজত্ব! তাকেও তিনি ধ্বংস করেছেন। কারূন চিন্তা করছে না যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে একই পরিণতি তারও ঘটাতে পারেন।
তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন- وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ (অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা অপরাধীদের অবস্থা ভালো করেই জানেন। কাজেই তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তাদেরকে তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন নেই। হাঁ, আখিরাতে যে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সেটা তাদের সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাদের অপরাধ তাদের দৃষ্টিতে সপ্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই করা হবে।
তারপর কারুনের পরিণতি সম্পর্কে জানানো হচ্ছে- فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ ‘অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল'। সে কী রকম জাঁকজমকের সঙ্গে বের হয়েছিল, কুরআন মাজীদে তার বিবরণ দেওয়া হয়নি। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন ইবরাহীম নাখা'ঈ রহ. বলেন, কারূন ও তার দলের লোকেরা সবুজ ও লাল পোশাক পরিধান করে বের হয়েছিল। মুজাহিদ রহ. বলেন, তারা সাদা ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে বের হয়েছিল। মুকাতিল রহ. বলেন, তার সঙ্গে ছিল চার হাজার ঘোড়সওয়ার ও তিনশ দাস-দাসী। তার এ জাঁকজমক দেখে এক শ্রেণির লোকের আক্ষেপ হল। তাদের সম্পর্কে আয়াতে জানানো হয়েছে-
قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ ‘যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারূনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান'। এখানে লক্ষণীয়, তারা এরূপ বলেনি যে, কারূনের ধন-সম্পদ যদি আমাদের হাতে এসে যেত। বরং বলেছে যে, তার মতো ধন-সম্পদ যদি আমাদেরও থাকত! এর দ্বারা বোঝা যায়, তারা দুনিয়াদার হলেও ঈর্ষাপরায়ণ ছিল না। বস্তুত বনী ইসরাঈলের মনে দুনিয়ার আসক্তি থাকলেও তারা ঈমানদারও ছিল বটে। তাই কারুনের সম্পদ দেখে তারা তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়নি। কেবল নিজেদের না থাকার দরুন আক্ষেপ প্রকাশ করেছে, যদিও এরূপ আক্ষেপ প্রকাশ করাও একজন মুমিনের পক্ষে কিছুতেই উচিত নয়। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা তাকে যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা, অন্যকে কী দেওয়া হয়েছে সেদিকে লক্ষ করা নয়। এমনিভাবে 'যে সম্পদশালী সে ভাগ্যবান' এ কথাও বলাও ঠিক নয়, যেমনটা তারা কারূনকে দেখে বলেছিল। কেননা কে ভাগ্যবান আর কে দুর্ভাগা, তার পরিচয় হবে আখিরাতে। সেখানে যে নাজাত পাবে সেই প্রকৃত ভাগ্যবান। নাজাত ধন-সম্পদের উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে কেবলই ঈমান ও সৎকর্মের উপর। ঈমান ও সৎকর্ম যেমন একজন ধনী অবলম্বন করতে পারে, তেমনি তা পারে একজন গরীবও। বরং গরীবের পক্ষেই তা অপেক্ষাকৃত সহজ।
বনী ইসরাঈলের মধ্যে কতিপয় লোক সত্যিকারের জ্ঞানীও ছিল। তারা দুনিয়াদারদের আক্ষেপমূলক কথাবার্তা শুনে তাদেরকে আশ্বাসবাণী শোনাল ও নসীহত করল। ইরশাদ হয়েছে- وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ‘আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়'! যাদের মধ্যে দীনের জ্ঞান ছিল, যারা দুনিয়ার হাকীকত বুঝত, আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমত সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং কীভাবে সেই নি'আমত অর্জিত হবে সে সম্পর্কেও তাদের জানা ছিল, তারা দুনিয়াদারদের ধিক্কার দিয়ে বলল, তোমরা কেন নশ্বর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদের প্রতি লালায়িত হচ্ছ! আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে মুমিন ও সৎকর্মশীলদের জন্য যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন, তা এরচে' অনেক অনেক উত্তম। তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না তা মান ও পরিমাণে এরচে' কত শ্রেয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (17)
‘সুতরাং কোনও ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফলস্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কী উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।(সূরা সাজদা (৩২), আয়াত ১৭)
সুতরাং তোমরা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার এসব অস্থায়ী সম্পদের জন্য আক্ষেপ করো না। আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমতলাভের আশা করো আর সেজন্য করণীয় কাজে রত থাকো। সেজন্য একটি করণীয় কর্ম হল সবর করা। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই)। 'সবর' শব্দটি কুরআন মাজীদের একটি পরিভাষা। নিজের ইন্দ্রিয় চাহিদা সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রেখে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যে অবিচলিত থাকাকে সবর বলা হয়। একজন আল্লাহপ্রেমিক ও আখিরাতের সফলতাকামীর জন্য সবরের প্রয়োজন পদে পদে। দুনিয়ার তুলনায় আখিরাতকে উত্তম মনে করে তা পাওয়ার চেষ্টা-মেহনত করতে পারে কেবল কষ্টসহিষ্ণু ব্যক্তি। এর জন্য সবর অপরিহার্য। যাদের কষ্ট-ক্লেশ করার ধৈর্য নেই, তারা নগদপ্রাপ্তির দুনিয়া উপেক্ষা করে আখিরাতের জন্য সাধনা করতে পারে না। তারা নগদের লোভে পড়ে যায়। এরূপ লোক দুনিয়াদারদের অর্থবিত্ত ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য দেখে মনে করে তারা বড় ভাগ্যবান। তার বিপরীতে নিজের অভাব-অনটন দেখে হতাশায় পড়ে যায়। বনী ইসরাঈলের দুনিয়াদার শ্রেণির সে অবস্থায় হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবরের গুণ থাকলে একটুও আক্ষেপ করত না। এ কারণেই তাদের ও তাদের মতো অন্যান্যদের সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, আখিরাতের অফুরন্ত নি'আমত লাভ করতে চাইলে তোমাদেরকে অবশ্যই সংযমী হতে হবে, সবরের গুণ অর্জন করতে হবে। এ গুণ যাদের নেই, তারা আখিরাতের নি'আমত লাভ করতে পারে না।
পরিশেষে কারূনের পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে- فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ (পরিনামে আমি তাকে ও তার বাড়িটি ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। অতঃপর সে এমন একটি দলও পেল না, যারা আল্লাহর বিপরীতে তার কোনও সাহায্য করতে পারে এবং নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে)।
অর্থাৎ কারূন যখন কারও কোনও উপদেশে কর্ণপাত করল না, উল্টো হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠল এবং তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগল, তখন আমি তাকে তার ঘরবাড়ি ও ধন-ভাণ্ডারসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম।
ঘটনার বিবরণ এরকম। কারুন অহংকার ও ঔদ্ধত্য করার পাশাপাশি মূসা আলাইহিস সালামকে সবসময় কষ্ট দিত। কুরআন মাজীদে সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ آذَوْا مُوسَىٰ فَبَرَّأَهُ اللَّهُ مِمَّا قَالُوا ۚ وَكَانَ عِندَ اللَّهِ وَجِيهًا (69)
‘হে মুমিনগণ! তাদের মতো হয়ো না, যারা মূসাকে কষ্ট দিয়েছিল, অতঃপর আল্লাহ তারা যা রটনা করেছিল তা হতে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। সে ছিল আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান।(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৬৯)
এর দ্বারা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কারূন ও তার সহচরদের একটি ঘটনার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। ঘটনা হয়েছিল এই যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম একদিন কারূনকে যাকাতের বিধান শোনালে সে তা দিতে অস্বীকৃতি জানাল। একদিন সে বনী ইসরাঈলকে বলল, এই লোকটি তো এতদিন নামাযের কথা বলত। সেইসঙ্গে আরও কিছু বিধানের কথাও প্রচার করত। তোমরা সেসব মেনে নিয়েছ। এখন সে যাকাতের বিধান নিয়ে হাজির হয়েছে। সে তোমাদের অর্থকড়ি হাতিয়ে নিতে চায়। এবার আমরা তাকে জনসম্মুখে অপদস্থ করে ছাড়ব, যাতে কেউ আর তার কথায় কান না দেয়। এ লক্ষ্যে সে ও তার অনুচরেরা এক ভ্রষ্টা মহিলাকে উৎকোচ দিয়ে প্রস্তুত করল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মহিলা এক ভরা মজলিসে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেবে। তারা তাই করল। একদিন তিনি উপস্থিত লোকদের নসীহত করছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, বিবাহিত লোক ব্যভিচার করলে আল্লাহর বিধান হল তাকে পাথর মেরে হত্যা করা। তখন কারুনের এক সমর্থক দাঁড়িয়ে বলল, এ কাজটি যদি আপনি নিজে করেন, তখনও একই বিধান? তিনি বললেন, হাঁ। তখন তারা ওই মহিলাকে ডেকে আনল। মহিলা ভরা মজলিসে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দিল। মূসা আলাইহিস সালাম মহিলাটিকে বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, সত্য কথা বলো। তাঁর এ কথা মহিলাটির মনে রেখাপাত করল। সে ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি যখন আল্লাহর নামে কসম করেছেন, তখন আমি সত্য প্রকাশ করে দিচ্ছি। কারূন এত পরিমাণ অর্থকড়ি দিয়ে আমাকে ভরা মজলিসে এ কথা বলতে বলেছে। তার কথামতোই আমি এটা বলেছি। প্রকৃতপক্ষে আপনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। মূসা আলাইহিস সালাম তখন সিজদায় পড়ে গেলেন। তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার সত্যনবী হয়ে থাকি, তবে তুমি আমার জন্য এই লোকটির উপর আযাব নাযিল করো। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করলেন। তিনি ভূমিকে হুকুম করলেন, মূসা তোমাকে যে আদেশ করবে, সেই মতো কাজ করবে। সেমতে মূসা আলাইহিস সালাম ভূমিকে আদেশ করলেন, তুমি কারূনকে তার ঘরবাড়ি ও ধন-দৌলতসহ গ্রাস করে নাও। সঙ্গে সঙ্গে ভূমি আদেশ পালন করল। সকলের চোখের সামনে কারূন তার ধন-দৌলতসমেত ধসে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে সে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেল। হাদীছে বলা হয়েছে, সে কিয়ামত পর্যন্ত ভূগর্ভে তলিয়ে যেতে থাকবে।
এই হল কারুনের পরিণতি। এ পরিণতি থেকে সে নিজেকে নিজেও রক্ষা করতে পারল না, তার ধন-সম্পদও কোনও কাজে আসল না, তার ভক্ত-অনুরক্ত ও সহচরেরাও তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারল না। যাকে তার কর্মদোষে আল্লাহ তা'আলা এভাবে ধ্বংস করেন, তাকে কেউ রক্ষা করতে পারে না। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার কারণে তার প্রচণ্ড অহমিকা ছিল। কিন্তু সে অহমিকা কোনও ফল দিল না। সে তার যাবতীয় অহমিকা নিয়ে ভূগর্ভে বিলীন হয়ে গেল।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. অহংকার ও সীমালঙ্ঘন কঠিন পাপ। এর থেকে মুক্ত হওয়া একান্ত জরুরি।
খ. অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যে অহংকার করতে নেই।
গ. মানুষ যতই চেষ্টা ও মেহনত করুক না কেন, অর্থ-সম্পদের প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাই। তাই এজন্য তাঁর শোকর আদায় করা উচিত।
ঘ. পার্থিব কোনও প্রাপ্তিতে উল্লাস করতে নেই। যা করতে হবে তা কেবলই শোকরগুযারী।
ঙ. আল্লাহপ্রদত্ত প্রকাশ্য-গুপ্ত যে-কোনও নি'আমত মৌলিকভাবে আখিরাতের সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবহার করা চাই।
চ. বৈরাগ্য ইসলামঅনুমোদিত নয়। নিজের ও পারিবারিক প্রয়োজনে যতটুকু দরকার, ততটুকু অর্থ উপার্জন অবশ্যকর্তব্য।
ছ. আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতের এক শোকর হল সৃষ্টির সেবা করা।
জ. পাপকর্মই যাবতীয় অশান্তির মূল। তাই অশান্তি বিস্তারের কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যেও পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ঝ. সম্পদের মতো ইলমেরও গৌরব দেখাতে নেই।
ঞ. শক্তি ও ক্ষমতার বড়াই করা উচিত নয়। বহু শক্তিমানকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
ট. রাস্তাঘাটে দম্ভভরে চলতে নেই।
ঠ. অন্যের ঐশ্বর্য দেখে আক্ষেপ করা উচিত নয়।
ড. কারও ঐশ্বর্য থাকলেই সে ভাগ্যবান হয়ে যায় না এবং গরীব হওয়াটাও দুর্ভাগ্য নয়। যে ব্যক্তি আখিরাতে নাজাত পাবে, সেই প্রকৃত ভাগ্যবান।
ঢ. দুনিয়া ও আখিরাতের হাকীকত কেবল সেই বুঝতে পারে, যার দীনী ইলম আছে।
ণ. আখিরাতের পুরস্কার ঈমান ও আমলে সালিহার উপর নির্ভরশীল।
ত. সবর ও সংযম ছাড়া আখিরাতের প্রতিদান পাওয়া সম্ভব নয়।
থ. আল্লাহ কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে ধনবল, জনবল, বাহুবল কোনওকিছু দ্বারাই তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।
দ. আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিকে কষ্ট দিতে নেই। তার পরিণাম হয় বড় ভয়ংকর।
অহংকারের পরিণাম ও অহংকার কাকে বলে
হাদীছ নং: ৬১১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল, কোনও ব্যক্তি পসন্দ করে তার পোশাক ভালো হোক ও তার জুতা ভালো হোক (এটাও কি অহংকার)? তিনি বললেন, আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অহংকার হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তাচ্ছিল্য করা। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৯১; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৯১; জামে তিরমিযী: ১৯৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৫৫৫৭; সহীহ ইবন হিব্বান ৫৪৬৬; মুসনাদে আহমাদ: ৩৯১৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১০৫৩৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৭৮২)
72 - باب تحريم الكبر والإعجاب
قَالَ الله تَعَالَى: {تِلْكَ الدَّارُ الآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًا فِي الأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ} [القصص: 83]، وقال تعالى: {وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحا} [الإسراء: 37]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحًا إنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ} [لقمان: 18].
ومعنى «تُصَعِّر خَدَّكَ لِلنَّاسِ»: أيْ تُمِيلُهُ وتُعرِضُ بِهِ عَنِ النَّاسِ تَكَبُّرًا عَلَيْهِمْ. وَ «المَرَحُ»: التَّبَخْتُرُ. وقال تَعَالَى: {إنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الكُنُوزِ مَا إنَّ مَفَاتِحَهُ لتَنُوءُ بِالعُصْبَةِ أُولِي القُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الفَرِحِينَ} [القصص: 76]، إِلَى قَوْله تَعَالَى: {فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الأَرْضَ} الآيات.
611 - وعن عبد الله بن مسعود - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّة مِنْ كِبْرٍ!» فَقَالَ رَجُلٌ: إنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا، ونَعْلُهُ حَسَنَةً؟ قَالَ: «إنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الجَمَالَ، الكِبْرُ: بَطَرُ الحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ». رواه مسلم. (1)
«بَطَرُ الحَقِّ»: دَفْعُهُ وَرَدُّهُ عَلَى قَائِلِهِ، وَ «غَمْطُ النَّاسِ»: احْتِقَارُهُمْ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে সতর্ক করা হয়েছে যে, কারও অন্তরে বিন্দু পরিমাণ কিন্তু (অহংকার) থাকলেও সে জান্নাতে যেতে পারবে না। কিবর দু’প্রকার। এক হল আল্লাহর সঙ্গে কিবর। তার মানে অহংকারবশত আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করা ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতে অস্বীকার করা। এরূপ কিবর কুফরী। যার অন্তরে এটা আছে, সে কোনওদিনই জান্নাতে যেতে পারবে না।

আরেক কিবর হল মানুষের সঙ্গে। এটা দু’প্রকার। এক হল মানুষের প্রতি অহমিকাবশত আল্লাহ তা'আলার কোনও হুকুম মানতে অস্বীকার করা। যেমন ইবলীস হযরত আদম আলাইহিস সালামের প্রতি অহমিকাবশত আল্লাহ তা'আলার হুকুম মানেনি। সে আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করেনি। এরকম কিবরও কুফরী। এরকম কিবরে লিপ্ত হওয়ার কারণে ইবলীস অভিশপ্ত হয়েছে। এটাও স্থায়ী জাহান্নামবাসকে অবধারিত করে।

মানুষের প্রতি আরেক কিবর এমন, যদ্দরুন সরাসরি আল্লাহ তা'আলার হুকুম প্রত্যাখ্যান করা হয় না বটে, কিন্তু মানুষের হক নষ্ট করা হয়। এরকম কিবর কবীরা গুনাহ ও মহাপাপ। যেমন অহংকারবশত কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, কারও পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা। এরকম কিবর যদি কারও মধ্যে থাকে, তবে তার প্রথমে জান্নাতে প্রবেশ করা বাধাগ্রস্ত হবে। শুরুতে তাকে এর জন্য জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। সে শাস্তিভোগ শেষ হওয়ার পর ঈমানের বদৌলতে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এ হাদীছটিতে যে বলা হয়েছে 'অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না', তা দ্বারা উল্লিখিত যে-কোনওরকমের অহংকারই বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। কুফরী পর্যায়ের অহংকার হলে সে তো কোনওদিনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর যদি কুফরী পর্যায়ের না হয়, তবে প্রথমে অহংকার পরিমাণে শাস্তি ভোগ করার পর সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, তারপর জান্নাতে প্রবেশ করবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে এ কথা শোনার পর জনৈক সাহাবীর মনে প্রশ্ন জাগল যে, তবে কি সুন্দর পোশাক-আশাক পরা যাবে না? তা পরা কি অহংকার বলে গণ্য হবে? সুতরাং তিনি এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন-
إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُوْنَ ثَوْبُهُ حَسَنًا، وَنَعْلُهُ حَسَنَةً؟ ‘কোনও ব্যক্তি পসন্দ করে তার পোশাক ভালো হোক ও তার জুতা ভালো হোক (এটাও কি অহংকার)'? এ প্রশ্নকারী কে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কেউ বলেন তিনি হযরত মালিক ইবন মুরারা রাযি.। কেউ বলেন তিনি আবু রায়হানা শামা'ঊন রাযি.। কেউ বলেন রাবী'আ ইবন আমির রাযি.। কেউ বলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি.। কারও মতে তিনি হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.।

এর উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ (আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন)। অর্থাৎ মৌলিক, নিখুঁত ও পরিপূর্ণ সৌন্দর্য কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। তাঁর সত্তা, তাঁর গুণাবলি, তাঁর কাজকর্ম সবই সুন্দর ও উৎকৃষ্ট। তাই তিনি তোমাদের দিক থেকেও সৌন্দর্য পসন্দ করেন। যেমন তিনি মহাদাতা, তোমাদের দিক থেকেও তিনি দান-খয়রাত পসন্দ করেন। তিনি জ্ঞানময় সত্তা, তোমাদের পক্ষ হতেও জ্ঞানের চর্চা পসন্দ করেন। তিনি পরম সত্যবাদী, তোমাদের দিক থেকেও সত্যবাদিতা পসন্দ করেন। তিনি গুণগ্রাহী, তোমাদের দিক থেকেও গুণগ্রাহিতা পসন্দ করেন। এর দ্বারা বোঝা গেল সৌন্দর্যপ্রিয়তা অহংকার নয়। এটা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। এটা অহংকার হয় তখনই, যখন বড়াই করা বা মানুষের সামনে নিজ বড়ত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে করা হয়। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য যদি হয় মহৎ, তবে তা কিছুতেই অহংকার নয়। মহৎ উদ্দেশ্য এরকম হতে পারে যে, পোশাক আল্লাহ তা'আলার দান। আল্লাহ তা'আলা পোশাক দিয়েছেন মানুষের সৌন্দর্য বিকাশের জন্যও। এমনিভাবে টাকা-পয়সাও আল্লাহ তা'আলারই দান। কাজেই আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায়ের জন্য আমি চাই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্দর পোশাক পরব। এবং যেহেতু এটা আল্লাহর দান, তাই একে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখব। আমি আমার পোশাক ময়লা করে রাখব না। তাতে নি'আমতের অমর্যাদা হবে। তাছাড়া দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাবে এবং তাতে মানুষ কষ্ট পাবে। এমনিভাবে যদি পোশাক মলিন করে রাখি কিংবা আপন অবস্থা অনুপাতে নিম্নমানের পোশাক পরি, তবে লোকে আমাকে অভাবগ্রস্ত মনে করবে এবং তখন তারা আমার প্রতি দান-দক্ষিণা করতে চাইবে। তাতে করে আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে এবং আল্লাহ তা'আলা আমাকে যে ভালো অবস্থায় রেখেছেন তা লুকানো হবে, যা কিনা নি'আমতের এক প্রকার অকৃতজ্ঞতা। আল্লাহ তা'আলা চান তিনি যাকে যে নি'আমত দিয়েছেন তার দ্বারা সে নি'আমতের প্রকাশ ঘটুক। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ (11)
‘এবং তোমার প্রতিপালকের যে নি'আমত (পেয়েছ), তার চর্চা করতে থাকো।’(সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ১১)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ أَنْ يَرَى أَثَرَ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ
আল্লাহ তা'আলা নিজ বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নি'আমতের ছাপ দেখতে পসন্দ করেন।(জামে তিরমিযী: ২৮১৯; মুসনাদে আহমাদ: ৬৭০৮; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৩৭৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩০৩৭; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৬৬৮)

অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিবর বা অহংকারের ব্যাখ্যাদান করেন যে- اَلْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ (অহংকার হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তাচ্ছিল্য করা)। অর্থাৎ সত্যকে সত্য বলে জানা সত্ত্বেও তা গ্রহণ না করা ও উপেক্ষা করা। সে সত্য যদি পরম সত্য তথা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর দীন হয়ে থাকে, তবে তো তা প্রত্যাখ্যান করা চরম অহংকার অর্থাৎ কুফর। আর যদি সে সত্য মানুষের পারস্পরিক কথাবার্তা ও অধিকারের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, তবে তা প্রত্যাখ্যান করা অবশ্যই গুনাহ, কিন্তু কুফর পর্যায়ের নয়। এটাও অহংকার। হাঁ, যদি সত্য সত্যরূপে পরিস্ফুট না হয়; বরং তা সত্য হওয়া-না হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ থাকে আর সে সন্দেহের কারণে তা গ্রহণ করা না হয়, তবে তা অহংকারের আলামত।

আর মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও অহংকার। কাউকে তুচ্ছ গণ্য করার কোনও সুযোগ নেই। সকলেই আদমসন্তান। যদি কেউ কাফের হয়, তবে তার ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা আছে যে, মৃত্যুর আগে কখনও আল্লাহ তা'আলা তাকে ঈমান দিয়ে দেবেন। আর যদি মুমিন হয় এবং পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তবে হতে পারে তার এমন কোনও নেক আমল আছে, যা আল্লাহ তা'আলা কবুল করে নিয়েছেন। আর পাপাচারের বিষয়ে সম্ভাবনা রয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে তাওবার তাওফীক দেবেন। অপরদিকে নিজের ক্ষেত্রে আমল কবুল না হওয়ার ভয় রয়ে গেছে। এমনও হতে পারে যে, কোনও পাপকর্ম রয়ে গেছে, কিন্তু তা থেকে তাওবা করা হয়নি। আর কার শেষ পরিণতি কেমন হবে তা তো কেউ জানে না। এ অবস্থায় নিজেকে উত্তম ভেবে অন্যকে তুচ্ছ গণ্য করার অবকাশ থাকে কোথায়? অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার অর্থই দাঁড়ায় যে, সে নিজেকে তারচে' বড় ও উত্তম মনে করে। এটা স্পষ্টই অহংকার। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সর্বপ্রকার অহংকার থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে দিন। আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান্নাতলাভে প্রত্যাশী ব্যক্তির কোনও অবস্থায়ই অহংকার করা সাজে না।

খ. আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায়ের উদ্দেশ্যে উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ গ্রহণ করাতে দোষ নেই এবং তা অহংকারও নয়।

গ. সৌন্দর্যপ্রিয়তা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ।

ঘ. কোনও অবস্থায়ই সত্য প্রত্যাখ্যান করতে নেই, তা যে-ই বলুক না কেন।

ঙ. কাউকে তার বর্তমান ও বাহ্যিক অবস্থা দেখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)