রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬০১
যে ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে সক্ষম এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে নিজেকে বিরত রাখে ও নিজে অন্যের থেকে কষ্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সবর করে তার জন্য মানুষের সঙ্গে মিলামিশে থাকা, জুমু‘আ, জামাত, ভালো কাজের জমায়েত এবং যিকির ও ইলমের মজলিসে উপস্থিত থাকা, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় হাজির হওয়া, অভাবগ্রস্তের প্রতি সহমর্মিতা জানানো, অজ্ঞজনদের সঠিক পথ দেখানো ও অন্যান্য কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করার ফযীলত
স্বাভাবিক অবস্থায় নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন না করে পারিবারিক জীবনযাপন করা ও জনসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই উত্তম। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। কেননা এভাবে জীবনযাপন করলে এমন অনেক নেককাজ করা সম্ভব হয়, যা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। যেমন-
(ক) জুমু‘আ ও জামাতে অংশগ্রহণ করা। জুমু‘আর নামায সর্বশ্রেষ্ঠ নামায। এর ফযীলত বিপুল। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
الْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُنَّ، مَا لَمْ تُغْشَ الْكَبَائِرُ
‘এক জুমু'আ অপর জুমু'আ পর্যন্ত তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের মোচনকারী, যাবৎ না কবীরা গুনাহ করা হয়।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৫৫৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭১২৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৪৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৫০৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ، وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ، وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ، وَدَنَا مِنَ الْإِمَامِ، فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ ، كَانَ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ، أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا
‘জুমু'আর দিন যে ব্যক্তি নিজ মাথা ধোয় ও গোসল করে, আগে আগে মসজিদে যায়, খুতবার শুরু ধরতে পারে, পায়ে হেঁটে যায়, বাহনে চড়ে না, ইমামের কাছে গিয়ে বসে, খুতবা শোনে এবং কোনও নিরর্থক কাজ করে না, সে তার প্রতি কদমে পূর্ণ এক বছর রোযা রাখার ও রাত জেগে নামায পড়ার ছাওয়াব অর্জন করে।(সুনানে ইবন মাজাহ ১০৮৭; সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫; জামে তিরমিযী: ৫০২; মুসনাদে আহমাদ: ১৬১৭৩; সহীহ ইবন হিব্বান ২৭৮১)
বলাবাহুল্য জুমু‘আর নামায একাকী পড়া যায় না। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায একাকী পড়া যায় বটে, কিন্তু জামাতে পড়ার যে বিপুল ছাওয়াব রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। জামাতে নামায আদায় করা সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ করা হয়েছে-
صَلَاةُ أَحَدِكُمْ فِي جَمَاعَةٍ ، تَزِيدُ عَلَى صَلَاتِهِ فِي سُوْقِهِ وَبَيْتِهِ بِضْعًا وَعِشْرِينَ دَرَجَةً
‘তোমাদের কারও বাজারে বা নিজ ঘরে নামায আদায় অপেক্ষা জামাতে নামায আদায়ের ছাওয়াব বিশ গুণেরও বেশি (অর্থাৎ সাতাশ গুণ) হয়ে থাকে।(সহীহ বুখারী: ২১১৯; সহীহ মুসলিম: ৬৪৯; সুনানে আবু দাউদ: ৫৫৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৭৮৬; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৫৩৪; মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৯০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১০১১)
(খ) ভালো কাজের জমায়েতে অংশগ্রহণ। যেমন কোনও পরামর্শসভায় শরীক হওয়া, ঈদ ও সূর্যগ্রহণের নামাযে অংশগ্রহণ করা...- এর প্রত্যেকটিতেই প্রচুর ছাওয়াব পাওয়া যায়। একাকী থাকলে সে ছাওয়াব থেকে মাহরুম থাকতে হয়।
(গ) ইলমের মজলিসে উপস্থিত থাকা। সহীহ নিয়তে ইলমের মজলিসে অংশগ্রহণের অনেক বড় ফযীলত রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَما اجْتَمع قَوْمٌ في بَيْتٍ مِن بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بيْنَهُمْ؛ إِلَّا نَزَلَتْ عليهمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ المَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَن عِنْدَهُ
‘কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকলে তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তার কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন।(সহীহ মুসলিম: ২৬৯৯; জামে তিরমিযী: ২৯৪৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ১০৭৩৭; সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৫; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ১২৭; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২৭)
(ঘ) যিকিরের মজলিসে উপস্থিত থাকা। যিকিরের মজলিসের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
“আল্লাহ তা'আলার একদল বিচরণরত অতিরিক্ত ফিরিশতা আছে। তারা আল্লাহর যিকিরের মজলিসসমূহ সন্ধান করে থাকে। যখনই কোথাও এমন মজলিস পায়, যেখানে আল্লাহ তা'আলার যিকির হয়, তারা যিকিরকারীদের সঙ্গে বসে যায়। তারপর তারা তাদের পরস্পরের ডানা মিলিয়ে সে মজলিস ঘিরে ফেলে। এভাবে তারা তাদের ও প্রথম আকাশের মধ্যবর্তী সবটা স্থান ভরে ফেলে। যখন যিকিরকারীগণ মজলিস ত্যাগ করে, তখন তারা আকাশে উঠে যায়। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনিই ভালো জানেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ? তারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অবস্থিত আপনার একদল বান্দার কাছ থেকে এসেছি। তারা আপনার সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করছিল আর তারা আপনার কাছে প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কী প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, আপনার কাছে আপনার জান্নাত প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, যদি তারা জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে আশ্রয়ও প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কিসের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা আপনার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে? তারা বলে, না। তিনি বলেন, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করছিল। তিনি বলেন, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। তারা যা চেয়েছে তা তাদেরকে দিলাম এবং তারা যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, তা থেকেও আমি তাদেরকে আশ্রয় দান করলাম। তখন তারা বলে, হে প্রতিপালক! তাদের মধ্যে অমুক এক গুনাহগার বান্দাও আছে। সে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তাদের সঙ্গে বসে পড়ে। তিনি বলেন, তাকেও ক্ষমা করে দিলাম। তারা এমন একটি দল, যাদের (মর্যাদার) কারণে তাদের সঙ্গে উপবেসনকারীও বঞ্চিত হয় না।(সহীহ মুসলিম: ২৬৮৯; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২০; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৫৬; হাকিম, আল মস্তাদরাক; ১৮২১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪১)
(ঙ) রোগী দেখতে যাওয়া। রোগী দেখতে যাওয়ারও বিপুল ছাওয়াব রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخَا لَهُ فِي اللهِ ، نَادَاهُ مُنَادٍ : بِأَنْ طِبْتَ، وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلًا
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, এক ঘোষক তাকে ডেকে বলে, তুমি আনন্দিত হও, তোমার চলা কল্যাণকর হোক এবং তুমি জান্নাতে ঠিকানা লাভ করো।(জামে তিরমিযী: ২০০৮; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯১৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৭২)
(চ) জানাযায় হাজির হওয়া। জানাযায় হাজির হওয়ার ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَلَهُ قِيرَاطٌ ، فَإِنْ شَهِدَ دَفْنَهَا فَلَهُ قِيرَاطَانِ ، الْقِيْرَاطُ مِثْلُ أُحُدٍ
‘যে ব্যক্তি কারও জানাযার নামায পড়ে, তার জন্য রয়েছে এক কীরাত ছাওয়াব। আর যে ব্যক্তি তার দাফনেও অংশগ্রহণ করে, তার জন্য রয়েছে দুই কীরাত ছাওয়াব। আর কীরাত হল উহুদ পাহাড় পরিমাণ।(সহীহ মুসলিম: ৯৪৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ: ১৯৯৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬২৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬১৫; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৫৪)
(ছ) অভাবগ্রস্তের প্রতি সহমর্মিতা জানানো। এক হাদীছে আছে-
مَن كانَ في حاجَةِ أخِيهِ كانَ اللَّهُ في حاجَتِهِ، ومَن فَرَّجَ عن مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللَّهُ عنْه بها كُرْبَةً مِن كُرَبِ يَومِ القِيامَةِ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন।(সহীহ বুখারী: ২৪৪২; সহীহ মুসলিম: ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী: ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ২২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৪৬)
(জ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মাধ্যমে অজ্ঞজনদের সঠিক পথ দেখানো। এটা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেকের জরুরি। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَن رَأَى مِنكُم مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بيَدِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسانِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وذلكَ أضْعَفُ الإيمانِ
তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর।(সহীহ মুসলিম : ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭১৫৩; আস সুনানুল কুবরা: ১১৫১৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৫৭)
(ঝ) অন্যান্য কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করা। জনকল্যাণমূলক প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তার অনেক ছাওয়াব। এরূপ কাজ আছে নানারকম। যেমন রাস্তাঘাট তৈরি করা, সেতু নির্মাণ করা, মানুষের পানির ব্যবস্থা করা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, পথভোলা লোককে পথ দেখিয়ে দেওয়া, মানুষের মাথায় বোঝা তুলে দেওয়া বা মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া, অন্ধ ও বিকলাঙ্গকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়া, যাদের বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই তাদের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি। লোকালয় ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব কাজ করার সুযোগ হয় না।
(ঞ) অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে নিজেকে বিরত রাখা। এটাও একটি পুণ্যের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যের সেবা করার ক্ষমতা রাখে না, সে যদি অন্ততপক্ষে এতটুকুও করে যে, তার দ্বারা যাতে কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ রাখে, তবে তাও অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই এ কাজ করার সুযোগ হয়। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত-
سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ العَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ، وَجِهَادٌ فِي سَبِيلِهِ» ، قُلْتُ: فَأَيُّ الرِّقَابِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «أَعْلاَهَا ثَمَنًا، وَأَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا» ، قُلْتُ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تُعِينُ ضَايِعًا، أَوْ تَصْنَعُ لِأَخْرَقَ» ،: قَالَ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تَدَعُ النَّاسَ مِنَ الشَّرِّ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ تَصَدَّقُ بِهَا عَلَى نَفْسِكَ
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, সর্বোত্তম আমল কী? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর পথে জিহাদ। তারপর বললাম, কোন দাসমুক্তি উত্তম? তিনি বললেন, যার দাম বেশি এবং যে তার মনিবের কাছে বেশি প্রিয়। বললাম, যদি আমি তা না পারি? তিনি বললেন, দুর্বলকে সাহায্য করবে কিংবা যে ভালো কাজ জানে না তার সহযোগিতা করবে। বললাম, যদি তা না পারি? তিনি বললেন, মানুষকে তোমার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এটাও একটি সদাকা, যা দ্বারা তুমি নিজের প্রতি সদাকা করতে পার।’(সহীহ বুখারী: ২৫১৮; সহীহ মুসলিম: ৮৪; মুসনাদুল বাযযার: ৪০৩৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৩১০; শু'আবুল ঈমান: ৪০৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪১৮; মুসনাদুল হুমায়দী: ১৩১)
(ট) অন্যের থেকে কষ্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সবর করা। অন্য কেউ কষ্ট দিলে তাতে সবর করাও একটি ফযীলতের কাজ। এ কাজ লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই সম্ভব হয়। এর ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اَلْمُؤْمِنُ اَلَّذِي يُخَالِطُ اَلنَّاسَ, وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنْ اَلَّذِي لَا يُخَالِطُ اَلنَّاسَ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ
‘যে মুসলিম মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে সবর করে, সে ওই মুসলিম অপেক্ষা উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে না এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে তার সবর করারও অবকাশ হয় না।’(জামে' তিরমিযী: ২৫০৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০১৭৪; শু'আবুল ঈমান: ৯২৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬২২০; মুসনাদে আহমাদ: ৫০২২)
উক্ত অধ্যায়শিরোনামের পর ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন-
اعْلَمْ: أَنَّ الْاخْتِلَاطَ بِالنَّاسِ عَلَى الْوَجْهِ الَّذِي ذَكَرْتُهُ هُوَ الْمِختَارُ الَّذِي كَانَ عَلَيْهِ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ ، وَسَائِرُ الْأَنْبِيَاءِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلَامُهُ عَلَيْهِمْ، وَكَذَلِكَ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنْ عُلَمَاءِ الْمُسْلِمِينَ وَأَخْيَارِهِمْ، وَهُوَ مَذْهَبُ أَكْثَرِ التَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ ، وَبِهِ قَالَ الشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَأَكْثَرُ الْفُقَهَاءِ أَجْمَعِينَ
'জ্ঞাতব্য যে, উপরে যেভাবে বললাম, সেভাবে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই শরী'আতে পসন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণের এটাই আদর্শ। খুলাফায়ে রাশিদীনসহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ও শ্রেষ্ঠ মুসলিমগণ এ নীতির উপরই ছিলেন। এটাই অধিকাংশ তাবি'ঈ ও তাদের পরবর্তী মনীষীদের মত। ইমাম শাফি'ঈ, ইমাম আহমাদ ও অধিকাংশ ফকীহ এ মতই ব্যক্ত করেছেন।’
ইমাম নাওয়াবী রহ. এই যে কথা বলেছেন, সামাজিক জীব হিসেবে সাধারণ অবস্থায় মানুষের জন্য এটাই প্রযোজ্য। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে।নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে সে দায়িত্বপালন সম্ভব হয় না। তবে সমাজজীবনে মিলেমিশে থাকার ভেতর দিয়েও এক রকম নিঃসঙ্গতা রক্ষা জরুরি। তা হল হৃদয়মনের নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থাকবে আর অন্তর থাকবে সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী। মানুষের পার্থিব ঐশ্বর্য ও চাকচিক্য যাতে অন্তরে প্রভাব বিস্তার না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দুনিয়াদারী ও শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তো নয়ই; বরং অন্তরে থাকবে তার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি। মানুষ ভালো কাজ করলে তার প্রতি সমর্থন জানানো হবে, অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা হবে। তাদের অন্যায়-অপরাধের সঙ্গে কোনওভাবেই নিজেকে যুক্ত রাখা যাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন, তুমি যখন মানুষের সঙ্গে থাকবে, তখন মানুষ আল্লাহর যিকিরে রত থাকলে তুমিও তাদের সঙ্গে যিকিরে রত থাকবে। আর তারা অন্য কিছুতে লিপ্ত হলে তুমি তা থেকে পাশ কাটিয়ে চলবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (68)
‘যারা আমার আয়াতের সমালোচনায় রত থাকে, তাদেরকে যখন দেখবে তখন তাদের থেকে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়। যদি শয়তান কখনও তোমাকে (এটা) ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেম লোকদের সাথে বসবে না।(সূরা আন‘আম (৬), আয়াত ৬৮)
একবার জনৈক ব্যক্তি ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ.-এর কাছে এসে বলল, মানুষ এখন যা-কিছুতে লিপ্ত তা আপনি দেখছেন। এ অবস্থায় আমি ভাবছি তাদের সঙ্গে আর মেলামেশা করব না। তিনি বললেন, এমনটি করো না। কেননা তোমার মানুষের প্রয়োজন রয়েছে আর মানুষেরও তোমাকে প্রয়োজন রয়েছে। তোমাকে ছাড়া তাদের চলবে না, তাদেরকে ছাড়াও তোমার চলবে না। তুমি বরং তাদের মধ্যে থাকবে (মন্দ কথার ক্ষেত্রে) বধির হয়ে, (ভালো কথার ক্ষেত্রে) শ্রবণশক্তিসম্পন্ন হয়ে। (মন্দ কাজের ক্ষেত্রে) অন্ধ হয়ে আর (ভালো কাজের ক্ষেত্রে) দৃষ্টিমান হয়ে এবং একইভাবে নীরব ও কথক হয়ে।
বস্তুত সমাজজীবন যাপনে এটাই মূলনীতি। ব্যাপক ফিতনা-ফাসাদ না হলে সমাজজীবন যাপন করাই বাঞ্ছনীয়। তবে সে ক্ষেত্রে অন্যের দ্বারা যাতে নিজ ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; বরং নিজ ঈমান ও আমল দ্বারা অন্যে উপকৃত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। আর এটা উল্লিখিত মূলনীতির অনুসরণ দ্বারাই সম্ভব। সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ প্রতি যুগের অনুসরণীয় উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন তাঁদের জীবনযাপনে এ নীতিই অনুসরণ করেছেন। তাঁরাই আমাদের আদর্শ। আমাদেরকেও এ অনুসারেই পার্থিব জীবন যাপন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
‘মানুষের সঙ্গে মিলামিশে... থাকার ফযীলত’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ: তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২)
ব্যাখ্যা
البر বলা হয় ওই সকল কাজ করাকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে, যথা- নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, পর্দা করা, হালাল খাওয়া, পিতা-মাতার হুকুম মানা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলেমদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি।
التقوى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে শরী'আতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন- জুয়া খেলা, মাদক সেবন করা, চুরি করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, জুলুম করা, অমুসলিমদের অনুকরণ করা, নাচ, গান ও অশ্লীল কাজ করা ইত্যাদি।
শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এ দু'টি শব্দের মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। এ সাহায্য হয় দীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার দ্বারা, বিশেষত মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মক্তব ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী মেহনত পরিচালনা করার দ্বারা। এমনিভাবে নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং কারও নেক আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ করার দ্বারাও সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে সহযোগিতা করা হয়।
সমাজে এমন অনেক কিছুই চালু আছে, যার সংস্পর্শে এসে মানুষ সৎকর্মের উৎসাহ হারায় এবং অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার উসকানি পায়। সুতরাং সৎকর্ম ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে সহযোগিতা করার জন্য সচেতন মহলের কর্তব্য শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং শরী'আতবিরোধী কার্যকলাপের আখড়া ও কেন্দ্রসমূহ উৎখাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালানো। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের দীনদারীতে পিতা-মাতাও বাধা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও অবশ্যকর্তব্য।
এ আয়াতে একে অন্যকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে কেবল নেককাজ ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে। সুতরাং নির্দেশনা পাওয়া গেল যে, কোনও কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য কেবল তখনই করা যাবে, যখন সে কাজটি শরী'আত মোতাবেক হবে। যদি তা শরী'আত মোতাবেক না হয় তবে কোনও অবস্থাতেই সে কাজে সাহায্য করা যাবে না, তাতে সাহায্যপ্রার্থী যত আপন লোকই হোক না কেন। সুতরাং আলোচ্য আয়াতেরই পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
‘গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।’
যেহেতু এ আয়াতে নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে একে অন্যকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আপন আপন শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী এটা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য। আলেমের কর্তব্য আপন ইলম দ্বারা মানুষের সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে ভূমিকা রাখা। সমাজের ধনী ও বিত্তবানদের কর্তব্য আপন ধন- সম্পদ দ্বারা সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীর বিস্তারে সহযোগিতা করা। যারা সাহসী ও শক্তিমান, তাদের কর্তব্য সৎকর্ম ও তাকওয়ার প্রচার-প্রতিষ্ঠায় আপন শক্তিকে কাজে লাগানো। এভাবে যার যে ক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে, তা দ্বারাই পারস্পরিক সৎকর্ম ও তাকওয়ার অর্জন ও সুরক্ষায় সাহায্য-সহযোগিতা করা একান্ত কর্তব্য।
বলাবাহুল্য এসকল দায়িত্ব পালন কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন সমাজ ও সমষ্টির একজনরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা হয়। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব দায়িত্ব পালনের কোনও অবকাশই আসে না। একজন মুমিন ও মুসলিমরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা, একতাবদ্ধ জীবনযাপন করা, সৎকর্মে পরস্পরে সহযোগিতা করা ও অসৎকর্ম প্রতিরোধ করা যে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য, তা কেবল এই এক আয়াতই নয়, কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন বাণী দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
‘(হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১১০)
সূরা 'আসূরে ইরশাদ হয়েছে-
وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
‘কালের শপথ! বস্তুত মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়।’
অন্যত্র ইরশাদ-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ (33) وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি আনুগত্য স্বীকারকারীদের একজন। ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয় যারা মহাভাগ্যবান।’(সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩৩-৩৫)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
‘আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১০৩)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. সাধারণ অবস্থায় নিঃসঙ্গ না থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা বাঞ্ছনীয়।
খ. সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে পরস্পরে সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে সহযোগিতা করা ঈমানের দাবি।
গ. সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য কোনটা সৎকর্ম ও কোনটা অসৎকর্ম, তা স্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে।
ঘ. কোনওক্রমেই যাতে শরী'আতবিরোধী কাজে সহযোগিতা না করা হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
অধ্যায় : ৭১
মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ
اَلتوَاضُعُ (তাওয়াযু‘) শব্দের উৎপত্তি ضعة থেকে। এর অর্থ হীনতা ও নমনীয়তা। তাওয়াযু'র শাব্দিক অর্থ নিজ ক্ষুদ্রতা, বিনয় ও নমনিয়তা প্রকাশ করা। তাওয়াযু' বা বিনয়ের পারিভাষিক অর্থ হল, নিজের তুলনায় যার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ করা যায় তাকে সম্মান করা। কারও মতে যাকে সম্মান দেখানো হয়, তার নিজেকে সে তুলনায় নিম্নস্তরের বলে প্রকাশ করাকে তাওয়াযু' বলে। ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাওয়াযু' কাকে বলে? তিনি বলেন, সত্যের সামনে নতিস্বীকার করা এবং যে-ই তা বলুক না কেন তা গ্রহণ করে নেওয়া।
হাসান বসরী রহ. বলেন, তাওয়াযু‘ হল এই যে, তুমি ঘর থেকে বের হয়ে যে-কোনও মুসলিমের সাক্ষাৎ পাবে, মনে করবে সে কোনও না কোনওভাবে তোমার চেয়ে উত্তম।
আবু ইয়াযীদ বিস্তামী রহ. *বলেন, কোনও বান্দা যতক্ষণ মনে করবে মানুষের মধ্যে তারচে' নিকৃষ্ট কেউ আছে, ততক্ষণ সে একজন অহংকারী।*(লোকমুখে বায়েযীদ বুস্তামী নামে বেশি প্রসিদ্ধ। -সম্পাদক)
বলা হয়ে থাকে, তাওয়াযু‘ ও বিনয়ের মধ্যেই মর্যাদা, তাকওয়ার মধ্যেই শক্তি এবং পরিতুষ্টির মধ্যেই স্বাধীনতা।
প্রকৃতপক্ষে তাওয়াযু‘ ও বিনয় হল অন্তরস্থ গুণ। অন্তরে এ গুণ জন্ম নেয় আল্লাহ তা'আলার ও নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে। বান্দা যখন আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর গুণাবলি, তাঁর গৌরব-মহিমা ও দয়া-ভালোবাসা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে, সেইসঙ্গে নিজ সত্তা, নিজ যোগ্যতা ও গুণাবলির ত্রুটি এবং নিজ কর্ম ও চারিত্রিক মন্দত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করে, তখন তার অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই তাওয়াযু' ও বিনয়। এটি একটি মহৎ গুণ। নিজ আচার-আচরণ দ্বারা এ গুণের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং অন্তরে যখন এ গুণ জন্ম নেয়, তখন বান্দা সত্য গ্রহণ করে নিতে দ্বিধাবোধ করে না, তা যেই বলুক, সে বড় হোক বা ছোট, নারী হোক বা পুরুষ, অভিজাত হোক বা সাধারণ, স্বাধীন হোক বা গোলাম। এমনিভাবে সে কাউকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে না; বরং আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও বান্দাকেই স্বচ্ছন্দমনে ভাই বলে গণ্য করতে পারে। সে কারও হক নষ্ট করতে পারে না, তা সে হক তার যত বড় শত্রুরই হোক না কেন। এমনিভাবে সে অতি সহজেই যে-কাউকে ক্ষমা করতে পারে, তা যত বড় অপরাধই হোক না কেন।
বিনয় যখন অন্তরের একটা অবস্থা, তখন বিনয়ী ব্যক্তি কখনও মনে করে না সে একজন বিনয়ী। লোকে তার আচরণকে বিনয় মনে করে। কিন্তু সে নিজে তা বিনয় বলে মনে করে না; বরং মনে করে তা-ই ন্যায্য আচরণ, যা তার করাই উচিত ছিল। উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে বিনয় আছে বলে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে সে একজন অহংকারী। কেননা সে যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন মনে করে- যে আচরণটা সে করল, সেই তুলনায় তার মর্যাদা আরও উপরে। আর প্রকৃত বিনয়ী ব্যক্তি যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন ভাবে সে তুলনায় তার মর্যাদা আরও নিচে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এক বিনয় হল ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে বিনয়। এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যাদের সঙ্গে বিনয় অবলম্বন করতে বলেছেন, তাদের সম্মুখেও। যেমন রাসূল, ইমাম (মুসলিম শাসক), আলেম ও পিতা-মাতা।
এছাড়া অন্যসব মানুষের ক্ষেত্রে বিনয়ের বিধান হল এই যে, যদি কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তা করা হয়, তবে তা প্রশংসনীয় ও কাম্য। এ বিনয়ের দ্বারা আল্লাহ তা'আলা মানুষের অন্তরে বিনয়ীর প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেন এবং তাদের কাছে তার সম্মান বৃদ্ধি করেন।
আরেক বিনয় হচ্ছে দুনিয়াদার ও জালেম অত্যাচারীদের সঙ্গে, যা দ্বারা তাদের সুদৃষ্টি লাভ করা উদ্দেশ্য হয়। এরূপ বিনয় নিন্দনীয় ও গর্হিত। এর দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে নিজ ইজ্জত-সম্মান নষ্ট হয়। কোনও এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি ধনীর ধনের কারণে বিনয় অবলম্বন করে, তার দীনের দুই-তৃতীয়াংশ বরবাদ হয়ে যায়।
‘বিনয়’ ইসলামের এক মৌলিক চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিনয়ী ছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন সময় অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। কখনও কখনও তিনি কোনও কোনও নবীকে নিজেরও উপরে মর্যাদাদান করেছেন। তিনি নিজ উম্মতকেও এ গুণ আয়ত্ত করার প্রতি উৎসাহদান করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম উচ্চতর বিনয়ের অধিকারী ছিলেন। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বিধবা মহিলাদের বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ দুইয়ে দিতেন। হযরত উমর ফারুক রাযি. নিজ কাঁধে পানির মশক বহন করেছেন। হযরত উছমান গনী রাযি, অনেক বড় ধনী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। হযরত আলী রাযি. বাজার থেকে সওদা কিনে নিজে বয়ে নিয়ে আসতেন। হযরত হাসান রাযি. একবার আরোহী অবস্থায় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একদল শিশু তাঁর সামনে পড়ল। তাদের কাছে রুটির টুকরো ছিল। তারা তাঁকে তাদের অতিথি হতে আহ্বান জানাল। তিনি বাহন থেকে নেমে তাদের সঙ্গে সেই রুটি খাওয়ায় শরীক হলেন। পরে তিনি তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে উট বোঝাই করে খাদ্য ও পোশাক পাঠিয়ে দিলেন। এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে, মহত্ত্ব তাদেরটাই বড়। কারণ তারা তাদের কাছে যা ছিল সবটা দিয়ে আমার মেহমানদারি করেছে। কিন্তু আমি তো তাদের কাছে পাঠিয়েছি আমার যা আছে তার অংশ মাত্র। একবার এক রাতে খলীফা হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ.-এর কাছে এক অতিথি আসল। অতিথি তাঁর সামনে বসা ছিল। এ অবস্থায় বাতি নিভে গেল। অতিথি নিজে তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে দিতে চাইল। তিনি বললেন, অতিথিকে দিয়ে কাজ করানো ভদ্রতা নয়। অতিথি বলল, তবে খাদেমকে ডেকে দিই? তিনি বললেন, সে মাত্র ঘুমিয়েছে। এখন তাকে জাগানো ঠিক হবে না। এই বলে তিনি নিজেই তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে নিলেন। অতিথি বলল, আপনি আমীরুল মুমিনীন হয়েও নিজে কাজ করলেন? তিনি বললেন, আমি যখন বাতি জ্বালাতে গিয়েছি তখনও উমর ছিলাম, আর যখন ফিরে এসেছি তখনও উমরই আছি। কাজ করাতে আমার কিছুই কমে যায়নি।
বস্তুত সব যুগেই প্রকৃত দীনদারগণ এরূপ বিনয়েরই অধিকারী ছিলেন। কুরআন ও হাদীছে এ গুণটির অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তারা তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ গুণটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। আমাদেরও কর্তব্য এ গুণ অর্জনের সাধনা করা। সে উদ্দেশ্যেই বর্তমান অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. এ সম্পর্কে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এসব আয়াত ও হাদীছ বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
‘মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (215)
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। মৌলিকভাবে শব্দটি পাখির ডানার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মানুষের হাত বোঝানোর জন্যও এর ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে যে-
وَاضْمُمْ إِلَيْكَ جَنَاحَكَ مِنَ الرَّهْبِ
‘ভয় দূর করার জন্য তোমার বাহু নিজ শরীরে চেপে ধরো।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৩২)
পিতা-মাতার প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ সম্পর্কিত এক আয়াতে ইরশাদ-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
‘তাদের প্রতি মমতায় নম্রতার ডানা নামিয়ে দাও।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪)
পাখি যখন নিচে নামে, তখন সে তার ডানা নামিয়ে দেয়। যখন উড়তে শুরু করে, তখন ডানা উঁচু করে দেয়। তো ডানা নামানো যেহেতু নিচে নামার ইঙ্গিত, তাই রূপকার্থে এর দ্বারা বিনয় ও নম্রতা বোঝানো হয়ে থাকে। সে কারণেই অর্থ করা হয়েছে- বিনয়-নম্র আচরণ করো।
‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণও বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
বিনয়-নম্রতা ও মমতা কাছাকাছি বিষয়ই। অন্তরে মমতা থাকলেই বিনয়-নম্র আচরণ করা হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি বিনয়-নম্র আচরণ করে, বোঝা যায় তার অন্তরে মমতা আছে। সুতরাং আয়াতটিতে এ দুই অর্থের যেটিই করা হোক তা সঠিকই হবে।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি গরীব মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন একে অন্যের প্রতি কোমল আচরণ করি ও মায়া-মমতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। যেমন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
‘যারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
অপর এক আয়াতে আছে-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র।’(সূরা ফাতহ (৪৮), আয়াত ২৯)
যাদের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিনয় ও নম্র আচরণ করতে বলেছেন, সেই সাহাবীগণ ছিলেন তাঁর অধীন ও অনুসারী। তাঁর ও তাঁদের মধ্যে মর্যাদাগত পার্থক্য ছিল দুস্তর। তা সত্ত্বেও যখন তাঁকে তাঁদের প্রতি বিনয়-নম্র আচরণ করার আদেশ করা হয়েছে, তখন অন্যদের প্রতি এ আদেশ আরও কত বেশি প্রযোজ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেকেরই কর্তব্য অধীন ব্যক্তিবর্গের প্রতি মমতাশীল হয়ে থাকা। তাদের প্রতি অহমিকাপূর্ণ আচরণ সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে কোমল। আপন কাজ ও আচরণে প্রকাশ পাবে বিনয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
তাঁর সে শিক্ষার ফল ছিল এই যে, সাহাবীগণও আপন আচার-আচরণে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ স্তরের বিনয় রক্ষা করতেন। কথা ও কাজে পরিপূর্ণ আদবের দিকে লক্ষ রাখতেন। অধীনদের পক্ষ থেকে বিনয় ও আদবের আচরণ যেমন অভিভাবক ও অধিকর্তার মমত্বপূর্ণ আচরণের সুফল, তেমনি অধীন ও অনুসারীরূপে এটা তাদের কর্তব্যও বটে। আয়াতে অভিভাবককেই যখন বিনয়-নম্র আচরণের আদেশ করা হয়েছে, তখন অধীন ও অনুসারীদের প্রতি তো এ আদেশ আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বর্তায়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুরুব্বী ও গুরুজনের কর্তব্য অধীনদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করা।
খ. প্রত্যেক অধীনকেও অবশ্যই আপন মুরুব্বী ও গুরুজনের প্রতি বিনয়ী হয়ে থাকতে হবে।
গ. ঈমানের সুবাদে প্রত্যেক মুমিন অপরাপর মুমিনদের কাছে বিনয়-নম্র আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে।
ঘ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কিছুতেই নিজেদের দীন পরিত্যাগ না করে। আল্লাহ না করুন, কেউ তা করলে তাতে আল্লাহ তা'আলার কোনও ক্ষতি নেই; সে নিজেই ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী নন। কাজেই কেউ পিছিয়ে গেলে তিনি এ লক্ষ্যে তাদের পরিবর্তে উন্নত গুণাবলির অধিকারী লোকদের দাঁড় করিয়ে দেবেন। তারা কি কি সগুণের অধিকারী হবে তাও এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- يُحِبُّهُمْ (তিনি তাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ যারা ইসলাম পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিবর্তে আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে দাঁড় করাবেন তাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন। আল্লাহ তা'আলা কাদেরকে ভালোবাসবেন, সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (31)
(হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৩১)
সুতরাং বোঝা গেল, তাদের প্রথম গুণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা'আলা তাদের ভালোবাসবেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- يُحِبُّونَهُ (তারাও তাকে ভালোবাসবে)। অর্থাৎ সে দলটির মধ্যে আল্লাহপ্রেম থাকবে। আর আল্লাহপ্রেমের দাবি হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা। এ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উভয়টি একই গুণ। কেননা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবেসে থাকলে কর্তব্য সুন্নতের অনুসরণ করা। আর সুন্নতের অনুসরণ করলে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্নতের অনুসরণই মূল কথা। এ গুণ যার মধ্যে থাকে, সে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিকও এবং আল্লাহ তা'আলার মাহবুব ও ভালোবাসার পাত্রও।
তাদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল- أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ (তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে)। أَذِلَّةٍ শব্দটি ذليل এর বহুবচন। এর উৎপত্তি ذل থেকে। অর্থ সহজতা, বিনয়, নম্রতা। اَعِزَّة শব্দটি عَزِيزٌ এর বহুবচন। এর উৎপত্তি عز থেকে। এর অর্থ শক্তি, ক্ষমতা, প্রতাপ, কঠোরতা। বাক্যটিতে বোঝানো হয়েছে- আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তারা ভালোবাসবে মুমিনদেরও। ফলে তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করবে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে, তাদেরকে নিজ দেহের অংশস্বরূপ মনে করবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকবে, কখনও তাদের সঙ্গে ঝগড়া- ফাসাদ ও হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না; বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে ও ক্ষমাশীলতার পরিচয় দেবে।
অপরদিকে তারা কাফের ও অমুসলিমদের প্রতি থাকবে কঠোর ও কঠিন। অর্থাৎ পার্থিব বিষয়ে তারা তাদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করবে বটে, কিন্তু দীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কখনও আপোস করবে না। প্রয়োজনে জান-মাল দিয়ে লড়াই করবে।
আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বেরাদার এমনকি পিতা-মাতাও যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না। এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক।
এ আয়াতটিতে সেই মুমিনদের আরও দু'টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। তার প্রথমটি হচ্ছে - يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে)। অর্থাৎ তারা দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে নিজেদের জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করবে। প্রয়োজনে সসস্ত্র যুদ্ধেও অবতীর্ণ হবে।
আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ (এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না)। অর্থাৎ দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে তারা অমুসলিম ও বেদীন কিসিমের লোকের নিন্দার কোনও তোয়াক্কা করবে না। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ (এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয়পাত্র হওয়া, তাঁর প্রেমিক হওয়া, মুমিনদের প্রতি বিনয়ের আচরণ করা, কাফেরদের প্রতি কঠোর হওয়া, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং দীনের পথে কোনও নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা না করা সকলের ভাগ্যে হয় না। এটা আল্লাহ তা'আলার দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই এসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকেন। সুতরাং কেউ যদি নিজের মধ্যে এসব গুণ দেখতে পায়, তার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা এবং তাঁর কাছে আরও বেশি বেশি চাওয়া। যার মধ্যে এসব গুণ অনুপস্থিত, তার কর্তব্য এগুলো অর্জনের জন্য সাধনা ও মুজাহাদা করা এবং এর জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইশারায় একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভবিষ্যদ্বাণীটি হল- কখনও কখনও এ উম্মতের কিছু কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ দীন ত্যাগ করে বেঈমান হয়ে যাবে। আর যখনই কেউ বা কোনও দল মুরতাদ হবে, আল্লাহ তা'আলা তাদের পরিবর্তে অপর একদল লোককে ঈমানদার বানিয়ে দেবেন। ঈমানে তারা হবে অনেক পাকাপোক্ত এবং তাদের মধ্যে আয়াতে বর্ণিত ৫টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। সর্বপ্রথম এ ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর আমলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের বিভিন্ন এলাকার লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। সে জিহাদে আল্লাহ তা'আলা সাহাবায়ে কেরামকে জয়যুক্ত করেন। তারপর শুরু হয়ে যায় ইসলামের অপ্রতিরোধ্য দিগ্বিজয়। তাতে বহু জাতিগোষ্ঠী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। নবদীক্ষিত সেসকল মুসলিম পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলাম বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তারা ছিলেন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। আয়াতে বর্ণিত পাঁচওটি বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষে তাদের জীবন এমন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল যে, আজও পর্যন্ত তারা গোটা মানবসাধারণের জীবনগঠনের অনুপম আদর্শ।
এটা কেবল সেই কালের কথাই নয়। তার পর থেকে অদ্যাবধি যখনই কেউ ইসলাম ত্যাগ করেছে, তার পরিবর্তে কেবল একজন নয়; বহু আল্লাহর বান্দা বিপুল উদ্যমে ইসলামের পথে ছুটে এসেছেন। আজও যখন কোনও কোনও হতভাগাকে বেঈমান ও নাস্তিক হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যাচ্ছে, তখন পৃথিবীর চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে, হাজারও মানুষ প্রবল আগ্রহের সঙ্গে ইসলাম কবুল করছে এবং নিজেরা ইসলামের দা'ঈ ও আহ্বায়করূপে পথহারা মানুষকে আল্লাহকে পাওয়ার পথ চেনাচ্ছে। কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী তো ব্যর্থ হতে পারে না। ইসলাম আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ মনোনীত দীন। দু'-চারজন মুরতাদের হল্লাচিল্লার কারণে এ দীনের নিরবচ্ছিন্ন গতি থেমে যেতে পারে কি? তা কখনও থামার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত এ দীন তার আপন গতিতে চলতে থাকবে। দু'-চারজন বিপথগামীর স্থানে হাজারও সত্যসন্ধানী এর দিকে অটল প্রত্যয়ে এগিয়ে আসতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা মৃত্যু পর্যন্ত আমাদেরকে ঈমানের উপর অবিচল রাখুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলাম এক জীবন্ত দীন, যা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।
খ. ইসলাম আপন স্থায়িত্বের জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের মুখাপেক্ষী নয়।
গ. ইসলাম থেকে কারও বিমুখ হওয়াটা তার চরম দুর্ভাগ্য।
ঘ. কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হলে আরও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি দ্বারা তার স্থান পূরণ হয়।
ঙ. আল্লাহপ্রেমিক হওয়া ও আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারাই একজন মুমিনের জীবনের পরম লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত।
চ. একজন মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি বিনয়ী থাকা ও কোমল আচরণ করা।
ছ. দীন ও ঈমান বিষয়ে মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও কঠিন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
জ. দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ও জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করা ঈমানের দাবি।
ঝ. দীনের উপর চলা ও দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠার মেহনত অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
ঞ. ঈমান ও ঈমানের গুণাবলি অর্জন আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এর জন্য মেহনত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দু'আও অব্যাহত রাখতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী।(সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১৩)
ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অতি মহান এক আয়াত। এটি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক কঠিন কষাঘাত। এর মাধ্যমে গায়ের রং ও ভাষাভিত্তিক বর্ণবাদ এবং অঞ্চল ও গোষ্ঠী- গোত্রভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জাহিলী যুগে সর্বত্র বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার ছেয়ে ছিল। ইসলাম এ আয়াতের মাধ্যমে তার অনুসারীদের সে অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছে। বর্ণিত আছে, মক্কাবিজয়ের দিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠে আযান দেওয়ার হুকুম দেন। তিনি আযান দিতে শুরু করলে মক্কার পুরোনো মোড়লেরা স্তম্ভিত হয়ে ওঠে। একজন কালো কুৎসিৎ লোককে কিনা পবিত্র কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠিয়ে দেওয়া হল! নানাজনে নানা মন্তব্য করতে শুরু করল। কেউ কেউ মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও এই ভয়ে মুখে কিছু বলল না, না জানি আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানিয়ে দেন। তা জানিয়ে দেওয়াও হল। তিনি তাদের ডেকে বললেন, তোমরা এই এই কথা বলাবলি করছিলে না? তারা তা স্বীকার করতে বাধ্য হল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى (হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি)। আয়াতটির সম্বোধন গোটা মানবজাতির প্রতি। আরব হোক বা অনারব, এশিয়ান হোক বা আফ্রিকান, সাদা হোক বা কালো, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, ধনী হোক বা গরীব, ব্যবসায়ী হোক বা শ্রমজীবী, মূলত সকলেই একই আদি পিতা-মাতার সন্তান। হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাউওয়া আলাইহাস সালাম থেকেই সকলের সৃষ্টি। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল মাটি দিয়ে। সে হিসেবে সকলেই মাটির মানুষ। আদম আলাইহিস সালামের বংশ পরম্পরায় দুনিয়ার সমস্ত নারী-পুরুষ পিতা-মাতার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে। কাজেই এ হিসেবে সকলেই এক। কারও উপর কারও কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন-
قَدْ أَذْهَبَ اللهُ عَنْكُمْ عُبَيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ، مُؤْمِنٌ تَقِيُّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ وَالنَّاسُ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ
‘আল্লাহ তা'আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদাদের নিয়ে গৌরব-গরিমা খতম করে দিয়েছেন। মানুষ হয় মুমিন-মুত্তাকী, নয়তো ফাসেক ও পাপী। সমস্ত মানুষ আদমসন্তান। আর আদম মাটির তৈরি।(জামে তিরমিযী: ৩৯৫৬; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১১৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৪৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৬২; শু'আবুল ঈমান: ৪৭৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৪)
وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا (এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার)। মানুষকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করাটা আল্লাহ তা'আলারই কাজ। কে আরব হবে কে অনারব, তা কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। এমনিভাবে কে সৈয়দ হবে কে চৌধুরী, কে সাদা হবে কে কালো, তাও আল্লাহ তা'আলারই ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে যে জাতি-গোষ্ঠীতে পাঠাতে চেয়েছেন, পাঠিয়েছেন। এতে কারও নিজস্ব কৃতিত্ব নেই। তাই এ নিয়ে অহমিকারও সুযোগ নেই। আল্লাহ তা'আলা এ বিভক্তি অহমিকার জন্য করেনইনি। তিনি এটা করেছেন মানুষের পরিচয়দানের সুবিধার্থে।
মানুষ এ বিভক্তি দ্বারা সুবিধা পেয়েও থাকে। বংশপরিচয় দিলেই লোকে সহজে চিনতে পারে। নয়তো চেনা কষ্টকর হয়ে যায়। একই নামের বহু লোক আছে। কেবল নাম বললে পরিচয় পরিষ্কার হয় না। নামের সঙ্গে গোত্রপরিচয় দিলেই বিভ্রম কেটে যায় ও পরিচয় পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং বংশ-গোত্রের ভাগ-বাটোয়ারা আল্লাহ তা'আলার এক নি'আমত। কোনও নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কঠিন পাপ। বরং শোকর আদায় করা দরকার যে, আল্লাহ তা'আলা আমাদের পরিচয়দানের সুবিধার্থে বংশ-গোত্র বিভাগের কী চমৎকার এক ব্যবস্থা করেছেন!
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে মানুষের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা কেবলই তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর নির্ভর করে; বিশেষ কোনও বংশ, বিশেষ কোনও বর্ণ, বিশেষ কোনও পেশা বা অঞ্চলের উপর নয়। না এটা কোনও মৌরুসি বিষয় যে, বাপ-দাদা শ্রেষ্ঠ ছিল বলে আমিও শ্রেষ্ঠ। যার অন্তরে তাকওয়া আছে, সে মানুষের মনগড়া আভিজাত্যের মাপকাঠিতে যতই নিম্নস্তরের হোক, আল্লাহ তা'আলার কাছে সে অনেক মর্যাদাবান। অপরদিকে কোনও ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিতে যতই অভিজাত হোক না কেন, মুত্তাকী-পরহেযগার না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। তাঁর কাছে মূল্য কেবলই তাকওয়ার। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْحَسَبُ الْمَالُ، وَالْكَرَمُ التَّقْوَى
‘হাসাব (দুনিয়াদারদের কাছে মর্যাদা) হল সম্পদ। আর কারাম (আল্লাহর কাছে মর্যাদা) হল তাকওয়া।(জামে' তিরমিযী ৩২৭১; সুনানে ইবন মাজাহ ৪২১৯; মুসনাদে আহমাদ: ২০১০২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৬৯১২; সুনানে দারা কুতনী: ৩৭৯৮; হাকিম, আল- মুস্তাদরাক: ২৬৯০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩৭৭৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৫)
অপর এক হাদীছে আছে-
مَرَّ رَجُلٌ علَى رَسولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، فَقالَ لرَجُلٍ عِنْدَهُ جَالِسٍ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: رَجُلٌ مِن أشْرَافِ النَّاسِ، هذا واللَّهِ حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ يُشَفَّعَ، قالَ: فَسَكَتَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ ثُمَّ مَرَّ رَجُلٌ آخَرُ، فَقالَ له رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: يا رَسولَ اللَّهِ، هذا رَجُلٌ مِن فُقَرَاءِ المُسْلِمِينَ، هذا حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ لا يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ لا يُشَفَّعَ، وإنْ قالَ أنْ لا يُسْمع لِقَوْلِهِ، فَقالَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: هذا خَيْرٌ مِن مِلْءِ الأرْضِ مِثْلَ هذا.
‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি তাঁর কাছে বসা এক ব্যক্তিকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইনি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের একজন। আল্লাহর কসম! তিনি এর উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে থাকলেন। তারপর অপর এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কাছে বসে থাকা) সেই ব্যক্তিকে বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ লোকটি দরিদ্র মুসলিমদের একজন। এ এরই উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে না এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে না। আর যদি কথা বলে তবে তার কথায় কর্ণপাত করা হবে না। এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ ব্যক্তি ওই লোকের মতো দুনিয়াভরা মানুষ অপেক্ষাও উত্তম।(সহীহ বুখারী: ৫০৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪১২০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৫৮৮৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯৯৯৮; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ৪০৬৯)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলামে কোনওরূপ বর্ণবৈষম্যের অবকাশ নেই।
খ. সমস্ত মানুষই যেহেতু এক আদি পিতা-মাতার সন্তান, তাই মানুষ হিসেবে কাউকে তুচ্ছ গণ্য করতে নেই।
গ. মানবপ্রজন্মের বিস্তারে নর-নারীর সমান ভূমিকা। উভয়েরই সে ভূমিকা স্বীকার করা উচিত।
ঘ. বংশ-গোত্রীয় বিভক্তি একটি নি'আমত, যেহেতু এর দ্বারা পরস্পরকে চেনা সহজ হয়েছে। কাজেই এ নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কিছুতেই সমীচীন নয়।
ঙ. আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় কেবলই তাকওয়ার দ্বারা। তাই আমাদেরকে এ গুণ অর্জনে অবশ্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
চ. বংশীয় আভিজাত্য, অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ইত্যাদির বড়াই এক আত্মপ্রবঞ্চনা। তাকওয়া ছাড়া এসবের কোনও মূল্য নেই।
চার নং আয়াত
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (32)
অর্থ: সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না। তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে।(সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা নাজমের ৩২ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَإِذْ أَنْتُمْ أَجِنَّةٌ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ
‘তিনি তোমাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন, যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে।’
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন মাটি থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন, তখনও তাঁর বংশধরদের বিস্তারিত অবস্থা তাঁর জানা ছিল। কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কতজন হবে, কে কতদিন বাঁচবে, কার জীবিকা কেমন হবে, কে সৎকর্মশীল হবে কে অসৎকর্মশীল, কে ঈমানদার হবে কে বেঈমান, কতজন জান্নাতবাসী হবে কতজন জাহান্নামী- এর কোনওকিছুই আল্লাহ তা'আলার অজানা ছিল না। তিনি এসব যেমন জানতেন হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টিকালে, তেমনি জানতেন ও জানেন মাতৃগর্ভে প্রত্যেকের ভ্রূণ অবস্থায় থাকাকালেও। মোটকথা তাঁর জ্ঞান অনাদি অনন্ত। প্রত্যেকের খুঁটিনাটি যাবতীয় অবস্থা তাঁর সবসময়ই জানা। আর সে কারণেই তিনি বলছেন-
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ (সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না)। অর্থাৎ কোনও পাপ বা মন্দ কাজ করছ না বলে আত্মপ্রশংসা করো না। কিংবা বেশি বেশি সৎকর্ম করছ বলে বড়াই করো না। কারণ কার শেষ পরিণাম কী হবে, তোমরা কেউ তা জান না। এমনও হতে পারে যে, এখন তো কোনও গুনাহ করছ না, কেবল ভালো ভালো কাজেই লেগে আছ, কিন্তু এ অবস্থা শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকবে না। এক পর্যায়ে দেখা যাবে তোমার অবস্থা বদলে গেছে। আগেকার সব ভালো কাজ জলাঞ্জলি দিয়ে অসৎকর্ম শুরু করে দিয়েছ। আর সে অসৎকর্মে নিমজ্জিত থাকা অবস্থায়ই তোমার মৃত্যু ঘটেছে। এভাবে তুমি একজন পাপীরূপে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে গেছ। অপরদিকে এমনও হতে পারে, যারা এখন পাপকর্মে নিমজ্জিত আর সে কারণে তোমরা তাদের ঘৃণা করছ এবং নিজেদেরকে তাদের তুলনায় উত্তম ভাবছ, এক পর্যায়ে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাদের মনে অনুশোচনা জেগেছে, ফলে তারা তাওবা করে জীবন বদলে ফেলেছে। এখন তারা পুরোপুরি ভালো মানুষ। তারা পাপকর্মের ধারেকাছেও যায় না। সৎকর্মের ভেতরেই দিবারাত্র পার করছে। আর এভাবে একজন সৎকর্মশীলরূপে কবরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। যদি এভাবেই তাদের মৃত্যু হয়, তবে অবশ্যই তারা জান্নাতবাসী হবে। সুতরাং আত্মপ্রশংসা করা এবং নিজেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ বলে বড়াই করার কোনওই অবকাশ নেই। বরং দরকার বর্তমান সময়ে সৎকর্মে মশগুল থেকে শেষ পরিণামের ভয়ে ভীত থাকা, যাতে জীবনশেষে শয়তানের ফাঁদে পড়ে দীন ও ঈমান বরবাদ না হয়; বরং একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যু নসীব হয়। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন তোমাদের মধ্যে কে সত্যিকার তাকওয়ার উপর আছে এবং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলছে। এমনিভাবে তিনিই জানেন কে সারাটা জীবন এরূপ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে থাকবে আর এভাবেই একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং তিনি তাঁর সে জ্ঞান অনুযায়ী ফয়সালা করবেন। আখিরাতে মুত্তাকী ব্যক্তিকে তার তাকওয়া-পরহেযগারীর পুরোপুরি প্রতিদান দেবেন। আর যেহেতু বিষয়টা কেবল তিনিই জানেন, তাই আত্মপ্রশংসা না করে বরং নেক আমলে মশগুল হও এবং যাতে ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পার, সে আশায় আল্লাহর অভিমুখী বান্দারূপে জীবন পরিচালনা করতে থাকো।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। তিনি সমস্ত মানুষের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত।
খ. কে প্রকৃত মুত্তাকী এবং যথাযথ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে, তা কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন। অন্য কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।
গ. নিজ পরিণাম কী হবে এবং কী অবস্থায় মৃত্যু হবে তা যেহেতু কারও জানা নেই, তাই কারও জন্যই আত্মপ্রশংসা করা সাজে না।
পাঁচ নং আয়াত
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (48) أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (49)
অর্থ: আরাফবাসীগণ একদল লোককে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে, ডাক দিয়ে বলবে, তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না। (অতঃপর জান্নাতবাসীদের প্রতি ইশারা করে বলবে) এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না? (তাদেরকে তো বলে দেওয়া হয়েছে,) তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।(সুরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৪৮-৪৯)
ব্যাখ্যা
আ‘রাফ হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী প্রাচীর। যাদের পাপ-পুণ্য সমান, তারা এ প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, যতক্ষণ না তাদের সম্পর্কে জান্নাতের ফয়সালা হয়। তারা জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় থাকবে। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের ফয়সালা করে দেবেন। তখন তারাও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। তারা যখন আ'রাফ তথা ওই প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, তখন সেখান থেকে জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের দেখতে ও চিনতে পারবে। প্রথমে তারা জান্নাতবাসীদের দেখে খুশি হবে এবং তাদের সালাম জানাবে। তারপর যখন জাহান্নামের দিকে তাকাবে, তখন তাদের লক্ষ্য করে কিছু কথা বলবে। তারা তাদেরকে কী বলবে, সে কথাই আলোচ্য আয়াতদু'টিতে তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا (আ‘রাফবাসীগণ একদল লোককে ডাক দিয়ে বলবে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে)। যাদেরকে চিনবে তারা খুবসম্ভব কাফেরদের নেতৃবর্গ। তাদের বিশেষ বিশেষ চিহ্ন দেখে আরাফবাসীগণ চিনতে পারবে যে, তারা অমুক অমুক। তখন তারা তাদের ডাক দেবে। যেমন হে ফেরাউন, হে নমরূদ, হে কারুন, হে আবূ জাল, হে উকবা, হে শায়বা ইত্যাদি।
مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না)। جَمْع এর অর্থ সঞ্চিত ধন-সম্পদ অথবা দলবল। অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ায় তোমাদের যে দলবল ও ধন-দৌলতের বড়াই করতে, আজ তা তোমাদের কোনও উপকারে আসল না। যেমন তারা দুনিয়ায় বলত-
وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ (35)
‘তারা বলেছে, আমরা ধনে-জনে তোমাদের চেয়ে বেশি আর আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার নই।’( সূরা সাবা‘ (৩৪), আয়াত ৩৫)
সূরা কাহফে বর্ণিত হয়েছে, এক ধনী ব্যক্তি অপর এক গরীব ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেছিল-
أَنَا أَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا (34) وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا (35) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا (36)
‘আমার অর্থ-সম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না এ বাগান কখনও ধ্বংস হবে। আমার ধারণা কিয়ামত কখনওই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তবে আমি নিশ্চিত (সেখানে) আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব।(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৩৪-৩৬)
أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ (এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না)? তারা এ কথা বলবে গরীব মুমিনদের দিকে ইশারা করে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ঈমান- আমলের বদৌলতে জান্নাতবাসী করেছেন। যেমন হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি., হযরত খাব্বাব রাযি. প্রমুখ গরীব সাহাবায়ে কেরাম ও সকল যুগের ঈমানদার দরিদ্রগণ, কাফের-বেঈমানগণ যাদের সম্পর্কে বলত- ওরা কখনও জান্নাতে যেতে পারবে না; ওরা দুনিয়ায় যেমন কষ্ট করছে, আখিরাতেও তেমনি কষ্টের জীবনই ভোগ করতে হবে। আ'রাফবাসীগণ তাদের দেখিয়ে দেবে যে, দুনিয়ায় তাদের এসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও হম্বিতম্বি কতটাই মিথ্যা ছিল। আজ সেই গরীব মুসলিমগণ কেমন চিরসুখের জান্নাত লাভ করেছে আর ওই অহংকারী ধনীগণ কীভাবে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করছে।
ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না)। এ কথাটি আ'রাফবাসীরও হতে পারে কিংবা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করেও হতে পারে। আ'রাফবাসীদের কথা হলে তখন এর অর্থ হবে যে, হে দাম্ভিকগণ! তোমরা তো বলেছিলে এ গরীবগণ জান্নাতে যেতে পারবে না। কিন্তু দেখো, তারা জান্নাতে চলে গেছে। তাদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না। আর যদি আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বলা হয়, তখন এর অর্থ হবে যে, হে আ'রাফবাসীগণ! তোমাদের বিষয়টা তো এ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। তোমরা নিজেরা আশা করছিলে যে, তোমাদের জান্নাত দেওয়া হবে। তোমাদের সে আশা পূরণ করা হল। এবার তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. শুরুতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে কেবল তারাই, যাদের নেক আমলের ওজন বেশি হবে।
খ. পাপ-পুণ্য সমান হলে তাদের জান্নাতলাভ বিলম্বিত হবে। শুরুতে কিছুকাল তাদের আ'রাফে কাটাতে হবে।
গ. ধন ও জনবলের বড়াই করতে নেই। আখিরাতে তা কোনও কাজে আসবে না।
ঘ. জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও ভয় ও দুঃখ থাকবে না।
স্বাভাবিক অবস্থায় নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন না করে পারিবারিক জীবনযাপন করা ও জনসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই উত্তম। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। কেননা এভাবে জীবনযাপন করলে এমন অনেক নেককাজ করা সম্ভব হয়, যা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। যেমন-
(ক) জুমু‘আ ও জামাতে অংশগ্রহণ করা। জুমু‘আর নামায সর্বশ্রেষ্ঠ নামায। এর ফযীলত বিপুল। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
الْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُنَّ، مَا لَمْ تُغْشَ الْكَبَائِرُ
‘এক জুমু'আ অপর জুমু'আ পর্যন্ত তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের মোচনকারী, যাবৎ না কবীরা গুনাহ করা হয়।(সহীহ মুসলিম: ২৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৯৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৫৫৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭১২৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৪৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৫০৪)
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ، وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ، وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ، وَدَنَا مِنَ الْإِمَامِ، فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ ، كَانَ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ، أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا
‘জুমু'আর দিন যে ব্যক্তি নিজ মাথা ধোয় ও গোসল করে, আগে আগে মসজিদে যায়, খুতবার শুরু ধরতে পারে, পায়ে হেঁটে যায়, বাহনে চড়ে না, ইমামের কাছে গিয়ে বসে, খুতবা শোনে এবং কোনও নিরর্থক কাজ করে না, সে তার প্রতি কদমে পূর্ণ এক বছর রোযা রাখার ও রাত জেগে নামায পড়ার ছাওয়াব অর্জন করে।(সুনানে ইবন মাজাহ ১০৮৭; সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৫; জামে তিরমিযী: ৫০২; মুসনাদে আহমাদ: ১৬১৭৩; সহীহ ইবন হিব্বান ২৭৮১)
বলাবাহুল্য জুমু‘আর নামায একাকী পড়া যায় না। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামায একাকী পড়া যায় বটে, কিন্তু জামাতে পড়ার যে বিপুল ছাওয়াব রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। জামাতে নামায আদায় করা সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ করা হয়েছে-
صَلَاةُ أَحَدِكُمْ فِي جَمَاعَةٍ ، تَزِيدُ عَلَى صَلَاتِهِ فِي سُوْقِهِ وَبَيْتِهِ بِضْعًا وَعِشْرِينَ دَرَجَةً
‘তোমাদের কারও বাজারে বা নিজ ঘরে নামায আদায় অপেক্ষা জামাতে নামায আদায়ের ছাওয়াব বিশ গুণেরও বেশি (অর্থাৎ সাতাশ গুণ) হয়ে থাকে।(সহীহ বুখারী: ২১১৯; সহীহ মুসলিম: ৬৪৯; সুনানে আবু দাউদ: ৫৫৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৭৮৬; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৫৩৪; মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৯০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১০১১)
(খ) ভালো কাজের জমায়েতে অংশগ্রহণ। যেমন কোনও পরামর্শসভায় শরীক হওয়া, ঈদ ও সূর্যগ্রহণের নামাযে অংশগ্রহণ করা...- এর প্রত্যেকটিতেই প্রচুর ছাওয়াব পাওয়া যায়। একাকী থাকলে সে ছাওয়াব থেকে মাহরুম থাকতে হয়।
(গ) ইলমের মজলিসে উপস্থিত থাকা। সহীহ নিয়তে ইলমের মজলিসে অংশগ্রহণের অনেক বড় ফযীলত রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَما اجْتَمع قَوْمٌ في بَيْتٍ مِن بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بيْنَهُمْ؛ إِلَّا نَزَلَتْ عليهمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ المَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَن عِنْدَهُ
‘কোনও লোকসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনও একটি ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত এবং নিজেদের মধ্যে তার পঠন-পাঠনে মশগুল থাকলে তাদের উপর সাকীনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং আল্লাহ তার কাছে উপস্থিত (ফিরিশতা)-দের মধ্যে তাদের উল্লেখ করেন।(সহীহ মুসলিম: ২৬৯৯; জামে তিরমিযী: ২৯৪৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ১০৭৩৭; সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৫; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ১২৭; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২৭)
(ঘ) যিকিরের মজলিসে উপস্থিত থাকা। যিকিরের মজলিসের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
“আল্লাহ তা'আলার একদল বিচরণরত অতিরিক্ত ফিরিশতা আছে। তারা আল্লাহর যিকিরের মজলিসসমূহ সন্ধান করে থাকে। যখনই কোথাও এমন মজলিস পায়, যেখানে আল্লাহ তা'আলার যিকির হয়, তারা যিকিরকারীদের সঙ্গে বসে যায়। তারপর তারা তাদের পরস্পরের ডানা মিলিয়ে সে মজলিস ঘিরে ফেলে। এভাবে তারা তাদের ও প্রথম আকাশের মধ্যবর্তী সবটা স্থান ভরে ফেলে। যখন যিকিরকারীগণ মজলিস ত্যাগ করে, তখন তারা আকাশে উঠে যায়। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনিই ভালো জানেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ? তারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অবস্থিত আপনার একদল বান্দার কাছ থেকে এসেছি। তারা আপনার সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করছিল আর তারা আপনার কাছে প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কী প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, আপনার কাছে আপনার জান্নাত প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, যদি তারা জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে আশ্রয়ও প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা আমার কাছে কিসের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল? তারা বলে, হে প্রতিপালক! তারা আপনার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে? তারা বলে, না। তিনি বলেন, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত, তবে কেমন হতো? তারপর তারা বলে, তারা আপনার কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করছিল। তিনি বলেন, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। তারা যা চেয়েছে তা তাদেরকে দিলাম এবং তারা যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, তা থেকেও আমি তাদেরকে আশ্রয় দান করলাম। তখন তারা বলে, হে প্রতিপালক! তাদের মধ্যে অমুক এক গুনাহগার বান্দাও আছে। সে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তাদের সঙ্গে বসে পড়ে। তিনি বলেন, তাকেও ক্ষমা করে দিলাম। তারা এমন একটি দল, যাদের (মর্যাদার) কারণে তাদের সঙ্গে উপবেসনকারীও বঞ্চিত হয় না।(সহীহ মুসলিম: ২৬৮৯; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪২০; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৫৬; হাকিম, আল মস্তাদরাক; ১৮২১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪১)
(ঙ) রোগী দেখতে যাওয়া। রোগী দেখতে যাওয়ারও বিপুল ছাওয়াব রয়েছে। এক হাদীছে ইরশাদ-
مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخَا لَهُ فِي اللهِ ، نَادَاهُ مُنَادٍ : بِأَنْ طِبْتَ، وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلًا
যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, এক ঘোষক তাকে ডেকে বলে, তুমি আনন্দিত হও, তোমার চলা কল্যাণকর হোক এবং তুমি জান্নাতে ঠিকানা লাভ করো।(জামে তিরমিযী: ২০০৮; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯১৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৪৭২)
(চ) জানাযায় হাজির হওয়া। জানাযায় হাজির হওয়ার ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ فَلَهُ قِيرَاطٌ ، فَإِنْ شَهِدَ دَفْنَهَا فَلَهُ قِيرَاطَانِ ، الْقِيْرَاطُ مِثْلُ أُحُدٍ
‘যে ব্যক্তি কারও জানাযার নামায পড়ে, তার জন্য রয়েছে এক কীরাত ছাওয়াব। আর যে ব্যক্তি তার দাফনেও অংশগ্রহণ করে, তার জন্য রয়েছে দুই কীরাত ছাওয়াব। আর কীরাত হল উহুদ পাহাড় পরিমাণ।(সহীহ মুসলিম: ৯৪৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ: ১৯৯৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬২৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১১৬১৫; মুসনাদে আহমাদ: ৪৪৫৪)
(ছ) অভাবগ্রস্তের প্রতি সহমর্মিতা জানানো। এক হাদীছে আছে-
مَن كانَ في حاجَةِ أخِيهِ كانَ اللَّهُ في حاجَتِهِ، ومَن فَرَّجَ عن مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللَّهُ عنْه بها كُرْبَةً مِن كُرَبِ يَومِ القِيامَةِ
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন।(সহীহ বুখারী: ২৪৪২; সহীহ মুসলিম: ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী: ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ২২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৪৬)
(জ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মাধ্যমে অজ্ঞজনদের সঠিক পথ দেখানো। এটা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেকের জরুরি। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَن رَأَى مِنكُم مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بيَدِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسانِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وذلكَ أضْعَفُ الإيمانِ
তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর।(সহীহ মুসলিম : ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭১৫৩; আস সুনানুল কুবরা: ১১৫১৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪১৫৭)
(ঝ) অন্যান্য কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করা। জনকল্যাণমূলক প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তার অনেক ছাওয়াব। এরূপ কাজ আছে নানারকম। যেমন রাস্তাঘাট তৈরি করা, সেতু নির্মাণ করা, মানুষের পানির ব্যবস্থা করা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, পথভোলা লোককে পথ দেখিয়ে দেওয়া, মানুষের মাথায় বোঝা তুলে দেওয়া বা মাথা থেকে নামিয়ে দেওয়া, অন্ধ ও বিকলাঙ্গকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়া, যাদের বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই তাদের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি। লোকালয় ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব কাজ করার সুযোগ হয় না।
(ঞ) অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে নিজেকে বিরত রাখা। এটাও একটি পুণ্যের কাজ। যে ব্যক্তি অন্যের সেবা করার ক্ষমতা রাখে না, সে যদি অন্ততপক্ষে এতটুকুও করে যে, তার দ্বারা যাতে কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ রাখে, তবে তাও অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই এ কাজ করার সুযোগ হয়। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত-
سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ العَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ، وَجِهَادٌ فِي سَبِيلِهِ» ، قُلْتُ: فَأَيُّ الرِّقَابِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «أَعْلاَهَا ثَمَنًا، وَأَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا» ، قُلْتُ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تُعِينُ ضَايِعًا، أَوْ تَصْنَعُ لِأَخْرَقَ» ،: قَالَ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: «تَدَعُ النَّاسَ مِنَ الشَّرِّ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ تَصَدَّقُ بِهَا عَلَى نَفْسِكَ
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, সর্বোত্তম আমল কী? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর পথে জিহাদ। তারপর বললাম, কোন দাসমুক্তি উত্তম? তিনি বললেন, যার দাম বেশি এবং যে তার মনিবের কাছে বেশি প্রিয়। বললাম, যদি আমি তা না পারি? তিনি বললেন, দুর্বলকে সাহায্য করবে কিংবা যে ভালো কাজ জানে না তার সহযোগিতা করবে। বললাম, যদি তা না পারি? তিনি বললেন, মানুষকে তোমার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এটাও একটি সদাকা, যা দ্বারা তুমি নিজের প্রতি সদাকা করতে পার।’(সহীহ বুখারী: ২৫১৮; সহীহ মুসলিম: ৮৪; মুসনাদুল বাযযার: ৪০৩৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৩১০; শু'আবুল ঈমান: ৪০৩৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪১৮; মুসনাদুল হুমায়দী: ১৩১)
(ট) অন্যের থেকে কষ্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সবর করা। অন্য কেউ কষ্ট দিলে তাতে সবর করাও একটি ফযীলতের কাজ। এ কাজ লোকসমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারাই সম্ভব হয়। এর ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اَلْمُؤْمِنُ اَلَّذِي يُخَالِطُ اَلنَّاسَ, وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ خَيْرٌ مِنْ اَلَّذِي لَا يُخَالِطُ اَلنَّاسَ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ
‘যে মুসলিম মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে সবর করে, সে ওই মুসলিম অপেক্ষা উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে না এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে তার সবর করারও অবকাশ হয় না।’(জামে' তিরমিযী: ২৫০৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০১৭৪; শু'আবুল ঈমান: ৯২৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬২২০; মুসনাদে আহমাদ: ৫০২২)
উক্ত অধ্যায়শিরোনামের পর ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন-
اعْلَمْ: أَنَّ الْاخْتِلَاطَ بِالنَّاسِ عَلَى الْوَجْهِ الَّذِي ذَكَرْتُهُ هُوَ الْمِختَارُ الَّذِي كَانَ عَلَيْهِ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ ، وَسَائِرُ الْأَنْبِيَاءِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلَامُهُ عَلَيْهِمْ، وَكَذَلِكَ الْخُلَفَاءُ الرَّاشِدُونَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِيْنَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ مِنْ عُلَمَاءِ الْمُسْلِمِينَ وَأَخْيَارِهِمْ، وَهُوَ مَذْهَبُ أَكْثَرِ التَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ ، وَبِهِ قَالَ الشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَأَكْثَرُ الْفُقَهَاءِ أَجْمَعِينَ
'জ্ঞাতব্য যে, উপরে যেভাবে বললাম, সেভাবে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই শরী'আতে পসন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণের এটাই আদর্শ। খুলাফায়ে রাশিদীনসহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ও শ্রেষ্ঠ মুসলিমগণ এ নীতির উপরই ছিলেন। এটাই অধিকাংশ তাবি'ঈ ও তাদের পরবর্তী মনীষীদের মত। ইমাম শাফি'ঈ, ইমাম আহমাদ ও অধিকাংশ ফকীহ এ মতই ব্যক্ত করেছেন।’
ইমাম নাওয়াবী রহ. এই যে কথা বলেছেন, সামাজিক জীব হিসেবে সাধারণ অবস্থায় মানুষের জন্য এটাই প্রযোজ্য। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে।নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে সে দায়িত্বপালন সম্ভব হয় না। তবে সমাজজীবনে মিলেমিশে থাকার ভেতর দিয়েও এক রকম নিঃসঙ্গতা রক্ষা জরুরি। তা হল হৃদয়মনের নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থাকবে আর অন্তর থাকবে সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী। মানুষের পার্থিব ঐশ্বর্য ও চাকচিক্য যাতে অন্তরে প্রভাব বিস্তার না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দুনিয়াদারী ও শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তো নয়ই; বরং অন্তরে থাকবে তার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি। মানুষ ভালো কাজ করলে তার প্রতি সমর্থন জানানো হবে, অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা হবে। তাদের অন্যায়-অপরাধের সঙ্গে কোনওভাবেই নিজেকে যুক্ত রাখা যাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন, তুমি যখন মানুষের সঙ্গে থাকবে, তখন মানুষ আল্লাহর যিকিরে রত থাকলে তুমিও তাদের সঙ্গে যিকিরে রত থাকবে। আর তারা অন্য কিছুতে লিপ্ত হলে তুমি তা থেকে পাশ কাটিয়ে চলবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (68)
‘যারা আমার আয়াতের সমালোচনায় রত থাকে, তাদেরকে যখন দেখবে তখন তাদের থেকে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়। যদি শয়তান কখনও তোমাকে (এটা) ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেম লোকদের সাথে বসবে না।(সূরা আন‘আম (৬), আয়াত ৬৮)
একবার জনৈক ব্যক্তি ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ.-এর কাছে এসে বলল, মানুষ এখন যা-কিছুতে লিপ্ত তা আপনি দেখছেন। এ অবস্থায় আমি ভাবছি তাদের সঙ্গে আর মেলামেশা করব না। তিনি বললেন, এমনটি করো না। কেননা তোমার মানুষের প্রয়োজন রয়েছে আর মানুষেরও তোমাকে প্রয়োজন রয়েছে। তোমাকে ছাড়া তাদের চলবে না, তাদেরকে ছাড়াও তোমার চলবে না। তুমি বরং তাদের মধ্যে থাকবে (মন্দ কথার ক্ষেত্রে) বধির হয়ে, (ভালো কথার ক্ষেত্রে) শ্রবণশক্তিসম্পন্ন হয়ে। (মন্দ কাজের ক্ষেত্রে) অন্ধ হয়ে আর (ভালো কাজের ক্ষেত্রে) দৃষ্টিমান হয়ে এবং একইভাবে নীরব ও কথক হয়ে।
বস্তুত সমাজজীবন যাপনে এটাই মূলনীতি। ব্যাপক ফিতনা-ফাসাদ না হলে সমাজজীবন যাপন করাই বাঞ্ছনীয়। তবে সে ক্ষেত্রে অন্যের দ্বারা যাতে নিজ ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; বরং নিজ ঈমান ও আমল দ্বারা অন্যে উপকৃত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। আর এটা উল্লিখিত মূলনীতির অনুসরণ দ্বারাই সম্ভব। সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ প্রতি যুগের অনুসরণীয় উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন তাঁদের জীবনযাপনে এ নীতিই অনুসরণ করেছেন। তাঁরাই আমাদের আদর্শ। আমাদেরকেও এ অনুসারেই পার্থিব জীবন যাপন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
‘মানুষের সঙ্গে মিলামিশে... থাকার ফযীলত’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ: তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২)
ব্যাখ্যা
البر বলা হয় ওই সকল কাজ করাকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে, যথা- নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, পর্দা করা, হালাল খাওয়া, পিতা-মাতার হুকুম মানা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলেমদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি।
التقوى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে শরী'আতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন- জুয়া খেলা, মাদক সেবন করা, চুরি করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, জুলুম করা, অমুসলিমদের অনুকরণ করা, নাচ, গান ও অশ্লীল কাজ করা ইত্যাদি।
শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এ দু'টি শব্দের মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। এ সাহায্য হয় দীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার দ্বারা, বিশেষত মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মক্তব ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী মেহনত পরিচালনা করার দ্বারা। এমনিভাবে নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং কারও নেক আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ করার দ্বারাও সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে সহযোগিতা করা হয়।
সমাজে এমন অনেক কিছুই চালু আছে, যার সংস্পর্শে এসে মানুষ সৎকর্মের উৎসাহ হারায় এবং অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার উসকানি পায়। সুতরাং সৎকর্ম ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে সহযোগিতা করার জন্য সচেতন মহলের কর্তব্য শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং শরী'আতবিরোধী কার্যকলাপের আখড়া ও কেন্দ্রসমূহ উৎখাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালানো। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের দীনদারীতে পিতা-মাতাও বাধা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও অবশ্যকর্তব্য।
এ আয়াতে একে অন্যকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে কেবল নেককাজ ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে। সুতরাং নির্দেশনা পাওয়া গেল যে, কোনও কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য কেবল তখনই করা যাবে, যখন সে কাজটি শরী'আত মোতাবেক হবে। যদি তা শরী'আত মোতাবেক না হয় তবে কোনও অবস্থাতেই সে কাজে সাহায্য করা যাবে না, তাতে সাহায্যপ্রার্থী যত আপন লোকই হোক না কেন। সুতরাং আলোচ্য আয়াতেরই পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
‘গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।’
যেহেতু এ আয়াতে নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে একে অন্যকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আপন আপন শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী এটা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য। আলেমের কর্তব্য আপন ইলম দ্বারা মানুষের সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে ভূমিকা রাখা। সমাজের ধনী ও বিত্তবানদের কর্তব্য আপন ধন- সম্পদ দ্বারা সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীর বিস্তারে সহযোগিতা করা। যারা সাহসী ও শক্তিমান, তাদের কর্তব্য সৎকর্ম ও তাকওয়ার প্রচার-প্রতিষ্ঠায় আপন শক্তিকে কাজে লাগানো। এভাবে যার যে ক্ষমতা ও সামর্থ্য আছে, তা দ্বারাই পারস্পরিক সৎকর্ম ও তাকওয়ার অর্জন ও সুরক্ষায় সাহায্য-সহযোগিতা করা একান্ত কর্তব্য।
বলাবাহুল্য এসকল দায়িত্ব পালন কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন সমাজ ও সমষ্টির একজনরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা হয়। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলে এসব দায়িত্ব পালনের কোনও অবকাশই আসে না। একজন মুমিন ও মুসলিমরূপে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা, একতাবদ্ধ জীবনযাপন করা, সৎকর্মে পরস্পরে সহযোগিতা করা ও অসৎকর্ম প্রতিরোধ করা যে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য, তা কেবল এই এক আয়াতই নয়, কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন বাণী দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
‘(হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১১০)
সূরা 'আসূরে ইরশাদ হয়েছে-
وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
‘কালের শপথ! বস্তুত মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়।’
অন্যত্র ইরশাদ-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ (33) وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি আনুগত্য স্বীকারকারীদের একজন। ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মধ্যে শত্রুতা ছিল, সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবর করে এবং এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয় যারা মহাভাগ্যবান।’(সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩৩-৩৫)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
‘আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১০৩)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. সাধারণ অবস্থায় নিঃসঙ্গ না থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা বাঞ্ছনীয়।
খ. সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে পরস্পরে সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে সহযোগিতা করা ঈমানের দাবি।
গ. সৎকর্ম ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য কোনটা সৎকর্ম ও কোনটা অসৎকর্ম, তা স্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে।
ঘ. কোনওক্রমেই যাতে শরী'আতবিরোধী কাজে সহযোগিতা না করা হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
অধ্যায় : ৭১
মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ
اَلتوَاضُعُ (তাওয়াযু‘) শব্দের উৎপত্তি ضعة থেকে। এর অর্থ হীনতা ও নমনীয়তা। তাওয়াযু'র শাব্দিক অর্থ নিজ ক্ষুদ্রতা, বিনয় ও নমনিয়তা প্রকাশ করা। তাওয়াযু' বা বিনয়ের পারিভাষিক অর্থ হল, নিজের তুলনায় যার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ করা যায় তাকে সম্মান করা। কারও মতে যাকে সম্মান দেখানো হয়, তার নিজেকে সে তুলনায় নিম্নস্তরের বলে প্রকাশ করাকে তাওয়াযু' বলে। ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাওয়াযু' কাকে বলে? তিনি বলেন, সত্যের সামনে নতিস্বীকার করা এবং যে-ই তা বলুক না কেন তা গ্রহণ করে নেওয়া।
হাসান বসরী রহ. বলেন, তাওয়াযু‘ হল এই যে, তুমি ঘর থেকে বের হয়ে যে-কোনও মুসলিমের সাক্ষাৎ পাবে, মনে করবে সে কোনও না কোনওভাবে তোমার চেয়ে উত্তম।
আবু ইয়াযীদ বিস্তামী রহ. *বলেন, কোনও বান্দা যতক্ষণ মনে করবে মানুষের মধ্যে তারচে' নিকৃষ্ট কেউ আছে, ততক্ষণ সে একজন অহংকারী।*(লোকমুখে বায়েযীদ বুস্তামী নামে বেশি প্রসিদ্ধ। -সম্পাদক)
বলা হয়ে থাকে, তাওয়াযু‘ ও বিনয়ের মধ্যেই মর্যাদা, তাকওয়ার মধ্যেই শক্তি এবং পরিতুষ্টির মধ্যেই স্বাধীনতা।
প্রকৃতপক্ষে তাওয়াযু‘ ও বিনয় হল অন্তরস্থ গুণ। অন্তরে এ গুণ জন্ম নেয় আল্লাহ তা'আলার ও নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে। বান্দা যখন আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর গুণাবলি, তাঁর গৌরব-মহিমা ও দয়া-ভালোবাসা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে, সেইসঙ্গে নিজ সত্তা, নিজ যোগ্যতা ও গুণাবলির ত্রুটি এবং নিজ কর্ম ও চারিত্রিক মন্দত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করে, তখন তার অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই তাওয়াযু' ও বিনয়। এটি একটি মহৎ গুণ। নিজ আচার-আচরণ দ্বারা এ গুণের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং অন্তরে যখন এ গুণ জন্ম নেয়, তখন বান্দা সত্য গ্রহণ করে নিতে দ্বিধাবোধ করে না, তা যেই বলুক, সে বড় হোক বা ছোট, নারী হোক বা পুরুষ, অভিজাত হোক বা সাধারণ, স্বাধীন হোক বা গোলাম। এমনিভাবে সে কাউকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে না; বরং আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও বান্দাকেই স্বচ্ছন্দমনে ভাই বলে গণ্য করতে পারে। সে কারও হক নষ্ট করতে পারে না, তা সে হক তার যত বড় শত্রুরই হোক না কেন। এমনিভাবে সে অতি সহজেই যে-কাউকে ক্ষমা করতে পারে, তা যত বড় অপরাধই হোক না কেন।
বিনয় যখন অন্তরের একটা অবস্থা, তখন বিনয়ী ব্যক্তি কখনও মনে করে না সে একজন বিনয়ী। লোকে তার আচরণকে বিনয় মনে করে। কিন্তু সে নিজে তা বিনয় বলে মনে করে না; বরং মনে করে তা-ই ন্যায্য আচরণ, যা তার করাই উচিত ছিল। উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে বিনয় আছে বলে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে সে একজন অহংকারী। কেননা সে যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন মনে করে- যে আচরণটা সে করল, সেই তুলনায় তার মর্যাদা আরও উপরে। আর প্রকৃত বিনয়ী ব্যক্তি যখন বিনয় প্রদর্শন করে, তখন ভাবে সে তুলনায় তার মর্যাদা আরও নিচে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এক বিনয় হল ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে বিনয়। এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা যাদের সঙ্গে বিনয় অবলম্বন করতে বলেছেন, তাদের সম্মুখেও। যেমন রাসূল, ইমাম (মুসলিম শাসক), আলেম ও পিতা-মাতা।
এছাড়া অন্যসব মানুষের ক্ষেত্রে বিনয়ের বিধান হল এই যে, যদি কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তা করা হয়, তবে তা প্রশংসনীয় ও কাম্য। এ বিনয়ের দ্বারা আল্লাহ তা'আলা মানুষের অন্তরে বিনয়ীর প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেন এবং তাদের কাছে তার সম্মান বৃদ্ধি করেন।
আরেক বিনয় হচ্ছে দুনিয়াদার ও জালেম অত্যাচারীদের সঙ্গে, যা দ্বারা তাদের সুদৃষ্টি লাভ করা উদ্দেশ্য হয়। এরূপ বিনয় নিন্দনীয় ও গর্হিত। এর দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে নিজ ইজ্জত-সম্মান নষ্ট হয়। কোনও এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি ধনীর ধনের কারণে বিনয় অবলম্বন করে, তার দীনের দুই-তৃতীয়াংশ বরবাদ হয়ে যায়।
‘বিনয়’ ইসলামের এক মৌলিক চারিত্রিক শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিনয়ী ছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন সময় অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। কখনও কখনও তিনি কোনও কোনও নবীকে নিজেরও উপরে মর্যাদাদান করেছেন। তিনি নিজ উম্মতকেও এ গুণ আয়ত্ত করার প্রতি উৎসাহদান করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম উচ্চতর বিনয়ের অধিকারী ছিলেন। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বিধবা মহিলাদের বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ দুইয়ে দিতেন। হযরত উমর ফারুক রাযি. নিজ কাঁধে পানির মশক বহন করেছেন। হযরত উছমান গনী রাযি, অনেক বড় ধনী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। হযরত আলী রাযি. বাজার থেকে সওদা কিনে নিজে বয়ে নিয়ে আসতেন। হযরত হাসান রাযি. একবার আরোহী অবস্থায় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একদল শিশু তাঁর সামনে পড়ল। তাদের কাছে রুটির টুকরো ছিল। তারা তাঁকে তাদের অতিথি হতে আহ্বান জানাল। তিনি বাহন থেকে নেমে তাদের সঙ্গে সেই রুটি খাওয়ায় শরীক হলেন। পরে তিনি তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে উট বোঝাই করে খাদ্য ও পোশাক পাঠিয়ে দিলেন। এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে, মহত্ত্ব তাদেরটাই বড়। কারণ তারা তাদের কাছে যা ছিল সবটা দিয়ে আমার মেহমানদারি করেছে। কিন্তু আমি তো তাদের কাছে পাঠিয়েছি আমার যা আছে তার অংশ মাত্র। একবার এক রাতে খলীফা হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ.-এর কাছে এক অতিথি আসল। অতিথি তাঁর সামনে বসা ছিল। এ অবস্থায় বাতি নিভে গেল। অতিথি নিজে তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে দিতে চাইল। তিনি বললেন, অতিথিকে দিয়ে কাজ করানো ভদ্রতা নয়। অতিথি বলল, তবে খাদেমকে ডেকে দিই? তিনি বললেন, সে মাত্র ঘুমিয়েছে। এখন তাকে জাগানো ঠিক হবে না। এই বলে তিনি নিজেই তেল ভরে বাতি জ্বালিয়ে নিলেন। অতিথি বলল, আপনি আমীরুল মুমিনীন হয়েও নিজে কাজ করলেন? তিনি বললেন, আমি যখন বাতি জ্বালাতে গিয়েছি তখনও উমর ছিলাম, আর যখন ফিরে এসেছি তখনও উমরই আছি। কাজ করাতে আমার কিছুই কমে যায়নি।
বস্তুত সব যুগেই প্রকৃত দীনদারগণ এরূপ বিনয়েরই অধিকারী ছিলেন। কুরআন ও হাদীছে এ গুণটির অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তারা তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ গুণটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। আমাদেরও কর্তব্য এ গুণ অর্জনের সাধনা করা। সে উদ্দেশ্যেই বর্তমান অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. এ সম্পর্কে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এসব আয়াত ও হাদীছ বোঝার ও এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
‘মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (215)
অর্থ: আর যে মুমিনগণ তোমার অনুসরণ করে, তাদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করো।(সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ২১৫)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। মৌলিকভাবে শব্দটি পাখির ডানার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মানুষের হাত বোঝানোর জন্যও এর ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে যে-
وَاضْمُمْ إِلَيْكَ جَنَاحَكَ مِنَ الرَّهْبِ
‘ভয় দূর করার জন্য তোমার বাহু নিজ শরীরে চেপে ধরো।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৩২)
পিতা-মাতার প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ সম্পর্কিত এক আয়াতে ইরশাদ-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
‘তাদের প্রতি মমতায় নম্রতার ডানা নামিয়ে দাও।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪)
পাখি যখন নিচে নামে, তখন সে তার ডানা নামিয়ে দেয়। যখন উড়তে শুরু করে, তখন ডানা উঁচু করে দেয়। তো ডানা নামানো যেহেতু নিচে নামার ইঙ্গিত, তাই রূপকার্থে এর দ্বারা বিনয় ও নম্রতা বোঝানো হয়ে থাকে। সে কারণেই অর্থ করা হয়েছে- বিনয়-নম্র আচরণ করো।
‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণও বোঝানো হয়। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং 'মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও'-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
বিনয়-নম্রতা ও মমতা কাছাকাছি বিষয়ই। অন্তরে মমতা থাকলেই বিনয়-নম্র আচরণ করা হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি বিনয়-নম্র আচরণ করে, বোঝা যায় তার অন্তরে মমতা আছে। সুতরাং আয়াতটিতে এ দুই অর্থের যেটিই করা হোক তা সঠিকই হবে।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি গরীব মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন একে অন্যের প্রতি কোমল আচরণ করি ও মায়া-মমতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। যেমন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
‘যারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
অপর এক আয়াতে আছে-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র।’(সূরা ফাতহ (৪৮), আয়াত ২৯)
যাদের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিনয় ও নম্র আচরণ করতে বলেছেন, সেই সাহাবীগণ ছিলেন তাঁর অধীন ও অনুসারী। তাঁর ও তাঁদের মধ্যে মর্যাদাগত পার্থক্য ছিল দুস্তর। তা সত্ত্বেও যখন তাঁকে তাঁদের প্রতি বিনয়-নম্র আচরণ করার আদেশ করা হয়েছে, তখন অন্যদের প্রতি এ আদেশ আরও কত বেশি প্রযোজ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেকেরই কর্তব্য অধীন ব্যক্তিবর্গের প্রতি মমতাশীল হয়ে থাকা। তাদের প্রতি অহমিকাপূর্ণ আচরণ সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে কোমল। আপন কাজ ও আচরণে প্রকাশ পাবে বিনয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
তাঁর সে শিক্ষার ফল ছিল এই যে, সাহাবীগণও আপন আচার-আচরণে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ স্তরের বিনয় রক্ষা করতেন। কথা ও কাজে পরিপূর্ণ আদবের দিকে লক্ষ রাখতেন। অধীনদের পক্ষ থেকে বিনয় ও আদবের আচরণ যেমন অভিভাবক ও অধিকর্তার মমত্বপূর্ণ আচরণের সুফল, তেমনি অধীন ও অনুসারীরূপে এটা তাদের কর্তব্যও বটে। আয়াতে অভিভাবককেই যখন বিনয়-নম্র আচরণের আদেশ করা হয়েছে, তখন অধীন ও অনুসারীদের প্রতি তো এ আদেশ আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বর্তায়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুরুব্বী ও গুরুজনের কর্তব্য অধীনদের সঙ্গে বিনয়-নম্র আচরণ করা।
খ. প্রত্যেক অধীনকেও অবশ্যই আপন মুরুব্বী ও গুরুজনের প্রতি বিনয়ী হয়ে থাকতে হবে।
গ. ঈমানের সুবাদে প্রত্যেক মুমিন অপরাপর মুমিনদের কাছে বিনয়-নম্র আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে।
ঘ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কিছুতেই নিজেদের দীন পরিত্যাগ না করে। আল্লাহ না করুন, কেউ তা করলে তাতে আল্লাহ তা'আলার কোনও ক্ষতি নেই; সে নিজেই ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী নন। কাজেই কেউ পিছিয়ে গেলে তিনি এ লক্ষ্যে তাদের পরিবর্তে উন্নত গুণাবলির অধিকারী লোকদের দাঁড় করিয়ে দেবেন। তারা কি কি সগুণের অধিকারী হবে তাও এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- يُحِبُّهُمْ (তিনি তাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ যারা ইসলাম পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিবর্তে আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে দাঁড় করাবেন তাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন। আল্লাহ তা'আলা কাদেরকে ভালোবাসবেন, সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (31)
(হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৩১)
সুতরাং বোঝা গেল, তাদের প্রথম গুণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা'আলা তাদের ভালোবাসবেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- يُحِبُّونَهُ (তারাও তাকে ভালোবাসবে)। অর্থাৎ সে দলটির মধ্যে আল্লাহপ্রেম থাকবে। আর আল্লাহপ্রেমের দাবি হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা। এ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উভয়টি একই গুণ। কেননা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবেসে থাকলে কর্তব্য সুন্নতের অনুসরণ করা। আর সুন্নতের অনুসরণ করলে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্নতের অনুসরণই মূল কথা। এ গুণ যার মধ্যে থাকে, সে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিকও এবং আল্লাহ তা'আলার মাহবুব ও ভালোবাসার পাত্রও।
তাদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল- أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ (তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে)। أَذِلَّةٍ শব্দটি ذليل এর বহুবচন। এর উৎপত্তি ذل থেকে। অর্থ সহজতা, বিনয়, নম্রতা। اَعِزَّة শব্দটি عَزِيزٌ এর বহুবচন। এর উৎপত্তি عز থেকে। এর অর্থ শক্তি, ক্ষমতা, প্রতাপ, কঠোরতা। বাক্যটিতে বোঝানো হয়েছে- আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তারা ভালোবাসবে মুমিনদেরও। ফলে তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করবে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে, তাদেরকে নিজ দেহের অংশস্বরূপ মনে করবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকবে, কখনও তাদের সঙ্গে ঝগড়া- ফাসাদ ও হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না; বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে ও ক্ষমাশীলতার পরিচয় দেবে।
অপরদিকে তারা কাফের ও অমুসলিমদের প্রতি থাকবে কঠোর ও কঠিন। অর্থাৎ পার্থিব বিষয়ে তারা তাদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করবে বটে, কিন্তু দীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কখনও আপোস করবে না। প্রয়োজনে জান-মাল দিয়ে লড়াই করবে।
আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বেরাদার এমনকি পিতা-মাতাও যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না। এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক।
এ আয়াতটিতে সেই মুমিনদের আরও দু'টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। তার প্রথমটি হচ্ছে - يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে)। অর্থাৎ তারা দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে নিজেদের জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করবে। প্রয়োজনে সসস্ত্র যুদ্ধেও অবতীর্ণ হবে।
আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ (এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না)। অর্থাৎ দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে তারা অমুসলিম ও বেদীন কিসিমের লোকের নিন্দার কোনও তোয়াক্কা করবে না। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ (এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার প্রিয়পাত্র হওয়া, তাঁর প্রেমিক হওয়া, মুমিনদের প্রতি বিনয়ের আচরণ করা, কাফেরদের প্রতি কঠোর হওয়া, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং দীনের পথে কোনও নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা না করা সকলের ভাগ্যে হয় না। এটা আল্লাহ তা'আলার দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই এসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে থাকেন। সুতরাং কেউ যদি নিজের মধ্যে এসব গুণ দেখতে পায়, তার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা এবং তাঁর কাছে আরও বেশি বেশি চাওয়া। যার মধ্যে এসব গুণ অনুপস্থিত, তার কর্তব্য এগুলো অর্জনের জন্য সাধনা ও মুজাহাদা করা এবং এর জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইশারায় একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভবিষ্যদ্বাণীটি হল- কখনও কখনও এ উম্মতের কিছু কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ দীন ত্যাগ করে বেঈমান হয়ে যাবে। আর যখনই কেউ বা কোনও দল মুরতাদ হবে, আল্লাহ তা'আলা তাদের পরিবর্তে অপর একদল লোককে ঈমানদার বানিয়ে দেবেন। ঈমানে তারা হবে অনেক পাকাপোক্ত এবং তাদের মধ্যে আয়াতে বর্ণিত ৫টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। সর্বপ্রথম এ ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর আমলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের বিভিন্ন এলাকার লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। সে জিহাদে আল্লাহ তা'আলা সাহাবায়ে কেরামকে জয়যুক্ত করেন। তারপর শুরু হয়ে যায় ইসলামের অপ্রতিরোধ্য দিগ্বিজয়। তাতে বহু জাতিগোষ্ঠী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। নবদীক্ষিত সেসকল মুসলিম পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলাম বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তারা ছিলেন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। আয়াতে বর্ণিত পাঁচওটি বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষে তাদের জীবন এমন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল যে, আজও পর্যন্ত তারা গোটা মানবসাধারণের জীবনগঠনের অনুপম আদর্শ।
এটা কেবল সেই কালের কথাই নয়। তার পর থেকে অদ্যাবধি যখনই কেউ ইসলাম ত্যাগ করেছে, তার পরিবর্তে কেবল একজন নয়; বহু আল্লাহর বান্দা বিপুল উদ্যমে ইসলামের পথে ছুটে এসেছেন। আজও যখন কোনও কোনও হতভাগাকে বেঈমান ও নাস্তিক হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যাচ্ছে, তখন পৃথিবীর চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে, হাজারও মানুষ প্রবল আগ্রহের সঙ্গে ইসলাম কবুল করছে এবং নিজেরা ইসলামের দা'ঈ ও আহ্বায়করূপে পথহারা মানুষকে আল্লাহকে পাওয়ার পথ চেনাচ্ছে। কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী তো ব্যর্থ হতে পারে না। ইসলাম আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ মনোনীত দীন। দু'-চারজন মুরতাদের হল্লাচিল্লার কারণে এ দীনের নিরবচ্ছিন্ন গতি থেমে যেতে পারে কি? তা কখনও থামার নয়। কিয়ামত পর্যন্ত এ দীন তার আপন গতিতে চলতে থাকবে। দু'-চারজন বিপথগামীর স্থানে হাজারও সত্যসন্ধানী এর দিকে অটল প্রত্যয়ে এগিয়ে আসতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা মৃত্যু পর্যন্ত আমাদেরকে ঈমানের উপর অবিচল রাখুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলাম এক জীবন্ত দীন, যা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।
খ. ইসলাম আপন স্থায়িত্বের জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের মুখাপেক্ষী নয়।
গ. ইসলাম থেকে কারও বিমুখ হওয়াটা তার চরম দুর্ভাগ্য।
ঘ. কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হলে আরও উৎকৃষ্ট ব্যক্তি দ্বারা তার স্থান পূরণ হয়।
ঙ. আল্লাহপ্রেমিক হওয়া ও আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারাই একজন মুমিনের জীবনের পরম লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত।
চ. একজন মুমিনের কর্তব্য অপর মুমিনের প্রতি বিনয়ী থাকা ও কোমল আচরণ করা।
ছ. দীন ও ঈমান বিষয়ে মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও কঠিন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
জ. দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ও জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করা ঈমানের দাবি।
ঝ. দীনের উপর চলা ও দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠার মেহনত অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
ঞ. ঈমান ও ঈমানের গুণাবলি অর্জন আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এর জন্য মেহনত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দু'আও অব্যাহত রাখতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী।(সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১৩)
ব্যাখ্যা
এটি কুরআন মাজীদের অতি মহান এক আয়াত। এটি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক কঠিন কষাঘাত। এর মাধ্যমে গায়ের রং ও ভাষাভিত্তিক বর্ণবাদ এবং অঞ্চল ও গোষ্ঠী- গোত্রভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জাহিলী যুগে সর্বত্র বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার ছেয়ে ছিল। ইসলাম এ আয়াতের মাধ্যমে তার অনুসারীদের সে অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছে। বর্ণিত আছে, মক্কাবিজয়ের দিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠে আযান দেওয়ার হুকুম দেন। তিনি আযান দিতে শুরু করলে মক্কার পুরোনো মোড়লেরা স্তম্ভিত হয়ে ওঠে। একজন কালো কুৎসিৎ লোককে কিনা পবিত্র কা'বাঘরের ছাদের উপর উঠিয়ে দেওয়া হল! নানাজনে নানা মন্তব্য করতে শুরু করল। কেউ কেউ মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও এই ভয়ে মুখে কিছু বলল না, না জানি আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানিয়ে দেন। তা জানিয়ে দেওয়াও হল। তিনি তাদের ডেকে বললেন, তোমরা এই এই কথা বলাবলি করছিলে না? তারা তা স্বীকার করতে বাধ্য হল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى (হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি)। আয়াতটির সম্বোধন গোটা মানবজাতির প্রতি। আরব হোক বা অনারব, এশিয়ান হোক বা আফ্রিকান, সাদা হোক বা কালো, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, ধনী হোক বা গরীব, ব্যবসায়ী হোক বা শ্রমজীবী, মূলত সকলেই একই আদি পিতা-মাতার সন্তান। হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাউওয়া আলাইহাস সালাম থেকেই সকলের সৃষ্টি। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছিল মাটি দিয়ে। সে হিসেবে সকলেই মাটির মানুষ। আদম আলাইহিস সালামের বংশ পরম্পরায় দুনিয়ার সমস্ত নারী-পুরুষ পিতা-মাতার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে। কাজেই এ হিসেবে সকলেই এক। কারও উপর কারও কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন-
قَدْ أَذْهَبَ اللهُ عَنْكُمْ عُبَيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ، مُؤْمِنٌ تَقِيُّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ وَالنَّاسُ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ
‘আল্লাহ তা'আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদাদের নিয়ে গৌরব-গরিমা খতম করে দিয়েছেন। মানুষ হয় মুমিন-মুত্তাকী, নয়তো ফাসেক ও পাপী। সমস্ত মানুষ আদমসন্তান। আর আদম মাটির তৈরি।(জামে তিরমিযী: ৩৯৫৬; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১১৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৪৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৬২; শু'আবুল ঈমান: ৪৭৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৪)
وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا (এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার)। মানুষকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করাটা আল্লাহ তা'আলারই কাজ। কে আরব হবে কে অনারব, তা কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। এমনিভাবে কে সৈয়দ হবে কে চৌধুরী, কে সাদা হবে কে কালো, তাও আল্লাহ তা'আলারই ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে যে জাতি-গোষ্ঠীতে পাঠাতে চেয়েছেন, পাঠিয়েছেন। এতে কারও নিজস্ব কৃতিত্ব নেই। তাই এ নিয়ে অহমিকারও সুযোগ নেই। আল্লাহ তা'আলা এ বিভক্তি অহমিকার জন্য করেনইনি। তিনি এটা করেছেন মানুষের পরিচয়দানের সুবিধার্থে।
মানুষ এ বিভক্তি দ্বারা সুবিধা পেয়েও থাকে। বংশপরিচয় দিলেই লোকে সহজে চিনতে পারে। নয়তো চেনা কষ্টকর হয়ে যায়। একই নামের বহু লোক আছে। কেবল নাম বললে পরিচয় পরিষ্কার হয় না। নামের সঙ্গে গোত্রপরিচয় দিলেই বিভ্রম কেটে যায় ও পরিচয় পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং বংশ-গোত্রের ভাগ-বাটোয়ারা আল্লাহ তা'আলার এক নি'আমত। কোনও নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কঠিন পাপ। বরং শোকর আদায় করা দরকার যে, আল্লাহ তা'আলা আমাদের পরিচয়দানের সুবিধার্থে বংশ-গোত্র বিভাগের কী চমৎকার এক ব্যবস্থা করেছেন!
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে মানুষের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা কেবলই তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর নির্ভর করে; বিশেষ কোনও বংশ, বিশেষ কোনও বর্ণ, বিশেষ কোনও পেশা বা অঞ্চলের উপর নয়। না এটা কোনও মৌরুসি বিষয় যে, বাপ-দাদা শ্রেষ্ঠ ছিল বলে আমিও শ্রেষ্ঠ। যার অন্তরে তাকওয়া আছে, সে মানুষের মনগড়া আভিজাত্যের মাপকাঠিতে যতই নিম্নস্তরের হোক, আল্লাহ তা'আলার কাছে সে অনেক মর্যাদাবান। অপরদিকে কোনও ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিতে যতই অভিজাত হোক না কেন, মুত্তাকী-পরহেযগার না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। তাঁর কাছে মূল্য কেবলই তাকওয়ার। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْحَسَبُ الْمَالُ، وَالْكَرَمُ التَّقْوَى
‘হাসাব (দুনিয়াদারদের কাছে মর্যাদা) হল সম্পদ। আর কারাম (আল্লাহর কাছে মর্যাদা) হল তাকওয়া।(জামে' তিরমিযী ৩২৭১; সুনানে ইবন মাজাহ ৪২১৯; মুসনাদে আহমাদ: ২০১০২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৬৯১২; সুনানে দারা কুতনী: ৩৭৯৮; হাকিম, আল- মুস্তাদরাক: ২৬৯০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩৭৭৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৪৫)
অপর এক হাদীছে আছে-
مَرَّ رَجُلٌ علَى رَسولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، فَقالَ لرَجُلٍ عِنْدَهُ جَالِسٍ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: رَجُلٌ مِن أشْرَافِ النَّاسِ، هذا واللَّهِ حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ يُشَفَّعَ، قالَ: فَسَكَتَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ ثُمَّ مَرَّ رَجُلٌ آخَرُ، فَقالَ له رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: ما رَأْيُكَ في هذا فَقالَ: يا رَسولَ اللَّهِ، هذا رَجُلٌ مِن فُقَرَاءِ المُسْلِمِينَ، هذا حَرِيٌّ إنْ خَطَبَ أنْ لا يُنْكَحَ، وإنْ شَفَعَ أنْ لا يُشَفَّعَ، وإنْ قالَ أنْ لا يُسْمع لِقَوْلِهِ، فَقالَ رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ: هذا خَيْرٌ مِن مِلْءِ الأرْضِ مِثْلَ هذا.
‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি তাঁর কাছে বসা এক ব্যক্তিকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইনি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের একজন। আল্লাহর কসম! তিনি এর উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে থাকলেন। তারপর অপর এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কাছে বসে থাকা) সেই ব্যক্তিকে বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ লোকটি দরিদ্র মুসলিমদের একজন। এ এরই উপযুক্ত যে, বিবাহের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হবে না এবং কারও সম্পর্কে সুপারিশ করলে তা গৃহীত হবে না। আর যদি কথা বলে তবে তার কথায় কর্ণপাত করা হবে না। এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ ব্যক্তি ওই লোকের মতো দুনিয়াভরা মানুষ অপেক্ষাও উত্তম।(সহীহ বুখারী: ৫০৯১; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪১২০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর: ৫৮৮৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯৯৯৮; বাগাবী, শারহুস্সুন্নাহ: ৪০৬৯)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলামে কোনওরূপ বর্ণবৈষম্যের অবকাশ নেই।
খ. সমস্ত মানুষই যেহেতু এক আদি পিতা-মাতার সন্তান, তাই মানুষ হিসেবে কাউকে তুচ্ছ গণ্য করতে নেই।
গ. মানবপ্রজন্মের বিস্তারে নর-নারীর সমান ভূমিকা। উভয়েরই সে ভূমিকা স্বীকার করা উচিত।
ঘ. বংশ-গোত্রীয় বিভক্তি একটি নি'আমত, যেহেতু এর দ্বারা পরস্পরকে চেনা সহজ হয়েছে। কাজেই এ নি'আমতকে অহমিকার বিষয়ে পরিণত করা কিছুতেই সমীচীন নয়।
ঙ. আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় কেবলই তাকওয়ার দ্বারা। তাই আমাদেরকে এ গুণ অর্জনে অবশ্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
চ. বংশীয় আভিজাত্য, অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ইত্যাদির বড়াই এক আত্মপ্রবঞ্চনা। তাকওয়া ছাড়া এসবের কোনও মূল্য নেই।
চার নং আয়াত
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (32)
অর্থ: সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না। তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে।(সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা নাজমের ৩২ নং আয়াতের শেষ অংশ। এর আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَإِذْ أَنْتُمْ أَجِنَّةٌ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ
‘তিনি তোমাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন, যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে।’
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন মাটি থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন, তখনও তাঁর বংশধরদের বিস্তারিত অবস্থা তাঁর জানা ছিল। কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কতজন হবে, কে কতদিন বাঁচবে, কার জীবিকা কেমন হবে, কে সৎকর্মশীল হবে কে অসৎকর্মশীল, কে ঈমানদার হবে কে বেঈমান, কতজন জান্নাতবাসী হবে কতজন জাহান্নামী- এর কোনওকিছুই আল্লাহ তা'আলার অজানা ছিল না। তিনি এসব যেমন জানতেন হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টিকালে, তেমনি জানতেন ও জানেন মাতৃগর্ভে প্রত্যেকের ভ্রূণ অবস্থায় থাকাকালেও। মোটকথা তাঁর জ্ঞান অনাদি অনন্ত। প্রত্যেকের খুঁটিনাটি যাবতীয় অবস্থা তাঁর সবসময়ই জানা। আর সে কারণেই তিনি বলছেন-
فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ (সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করো না)। অর্থাৎ কোনও পাপ বা মন্দ কাজ করছ না বলে আত্মপ্রশংসা করো না। কিংবা বেশি বেশি সৎকর্ম করছ বলে বড়াই করো না। কারণ কার শেষ পরিণাম কী হবে, তোমরা কেউ তা জান না। এমনও হতে পারে যে, এখন তো কোনও গুনাহ করছ না, কেবল ভালো ভালো কাজেই লেগে আছ, কিন্তু এ অবস্থা শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকবে না। এক পর্যায়ে দেখা যাবে তোমার অবস্থা বদলে গেছে। আগেকার সব ভালো কাজ জলাঞ্জলি দিয়ে অসৎকর্ম শুরু করে দিয়েছ। আর সে অসৎকর্মে নিমজ্জিত থাকা অবস্থায়ই তোমার মৃত্যু ঘটেছে। এভাবে তুমি একজন পাপীরূপে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে গেছ। অপরদিকে এমনও হতে পারে, যারা এখন পাপকর্মে নিমজ্জিত আর সে কারণে তোমরা তাদের ঘৃণা করছ এবং নিজেদেরকে তাদের তুলনায় উত্তম ভাবছ, এক পর্যায়ে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাদের মনে অনুশোচনা জেগেছে, ফলে তারা তাওবা করে জীবন বদলে ফেলেছে। এখন তারা পুরোপুরি ভালো মানুষ। তারা পাপকর্মের ধারেকাছেও যায় না। সৎকর্মের ভেতরেই দিবারাত্র পার করছে। আর এভাবে একজন সৎকর্মশীলরূপে কবরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। যদি এভাবেই তাদের মৃত্যু হয়, তবে অবশ্যই তারা জান্নাতবাসী হবে। সুতরাং আত্মপ্রশংসা করা এবং নিজেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ বলে বড়াই করার কোনওই অবকাশ নেই। বরং দরকার বর্তমান সময়ে সৎকর্মে মশগুল থেকে শেষ পরিণামের ভয়ে ভীত থাকা, যাতে জীবনশেষে শয়তানের ফাঁদে পড়ে দীন ও ঈমান বরবাদ না হয়; বরং একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যু নসীব হয়। তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-
هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (তিনি ভালোভাবেই জানেন মুত্তাকী কে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন তোমাদের মধ্যে কে সত্যিকার তাকওয়ার উপর আছে এবং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলছে। এমনিভাবে তিনিই জানেন কে সারাটা জীবন এরূপ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে থাকবে আর এভাবেই একজন প্রকৃত ঈমানদাররূপে মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং তিনি তাঁর সে জ্ঞান অনুযায়ী ফয়সালা করবেন। আখিরাতে মুত্তাকী ব্যক্তিকে তার তাকওয়া-পরহেযগারীর পুরোপুরি প্রতিদান দেবেন। আর যেহেতু বিষয়টা কেবল তিনিই জানেন, তাই আত্মপ্রশংসা না করে বরং নেক আমলে মশগুল হও এবং যাতে ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পার, সে আশায় আল্লাহর অভিমুখী বান্দারূপে জীবন পরিচালনা করতে থাকো।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। তিনি সমস্ত মানুষের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত।
খ. কে প্রকৃত মুত্তাকী এবং যথাযথ তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে, তা কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন। অন্য কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।
গ. নিজ পরিণাম কী হবে এবং কী অবস্থায় মৃত্যু হবে তা যেহেতু কারও জানা নেই, তাই কারও জন্যই আত্মপ্রশংসা করা সাজে না।
পাঁচ নং আয়াত
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (48) أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (49)
অর্থ: আরাফবাসীগণ একদল লোককে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে, ডাক দিয়ে বলবে, তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না। (অতঃপর জান্নাতবাসীদের প্রতি ইশারা করে বলবে) এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না? (তাদেরকে তো বলে দেওয়া হয়েছে,) তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।(সুরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৪৮-৪৯)
ব্যাখ্যা
আ‘রাফ হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী প্রাচীর। যাদের পাপ-পুণ্য সমান, তারা এ প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, যতক্ষণ না তাদের সম্পর্কে জান্নাতের ফয়সালা হয়। তারা জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় থাকবে। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের ফয়সালা করে দেবেন। তখন তারাও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। তারা যখন আ'রাফ তথা ওই প্রাচীরের উপর অবস্থান করবে, তখন সেখান থেকে জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের দেখতে ও চিনতে পারবে। প্রথমে তারা জান্নাতবাসীদের দেখে খুশি হবে এবং তাদের সালাম জানাবে। তারপর যখন জাহান্নামের দিকে তাকাবে, তখন তাদের লক্ষ্য করে কিছু কথা বলবে। তারা তাদেরকে কী বলবে, সে কথাই আলোচ্য আয়াতদু'টিতে তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا (আ‘রাফবাসীগণ একদল লোককে ডাক দিয়ে বলবে, যাদেরকে তারা তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে)। যাদেরকে চিনবে তারা খুবসম্ভব কাফেরদের নেতৃবর্গ। তাদের বিশেষ বিশেষ চিহ্ন দেখে আরাফবাসীগণ চিনতে পারবে যে, তারা অমুক অমুক। তখন তারা তাদের ডাক দেবে। যেমন হে ফেরাউন, হে নমরূদ, হে কারুন, হে আবূ জাল, হে উকবা, হে শায়বা ইত্যাদি।
مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ (তোমাদের সংগৃহীত সঞ্চয় তোমাদের কোনও কাজে আসল না এবং তোমরা যাদেরকে বড় মনে করতে তারাও না)। جَمْع এর অর্থ সঞ্চিত ধন-সম্পদ অথবা দলবল। অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ায় তোমাদের যে দলবল ও ধন-দৌলতের বড়াই করতে, আজ তা তোমাদের কোনও উপকারে আসল না। যেমন তারা দুনিয়ায় বলত-
وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ (35)
‘তারা বলেছে, আমরা ধনে-জনে তোমাদের চেয়ে বেশি আর আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার নই।’( সূরা সাবা‘ (৩৪), আয়াত ৩৫)
সূরা কাহফে বর্ণিত হয়েছে, এক ধনী ব্যক্তি অপর এক গরীব ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেছিল-
أَنَا أَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا (34) وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا (35) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا (36)
‘আমার অর্থ-সম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না এ বাগান কখনও ধ্বংস হবে। আমার ধারণা কিয়ামত কখনওই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তবে আমি নিশ্চিত (সেখানে) আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব।(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৩৪-৩৬)
أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ (এরাই কি তারা, যাদের সম্পর্কে তোমরা শপথ করে বলতে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতের কোনও অংশ দেবেন না)? তারা এ কথা বলবে গরীব মুমিনদের দিকে ইশারা করে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ঈমান- আমলের বদৌলতে জান্নাতবাসী করেছেন। যেমন হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি., হযরত খাব্বাব রাযি. প্রমুখ গরীব সাহাবায়ে কেরাম ও সকল যুগের ঈমানদার দরিদ্রগণ, কাফের-বেঈমানগণ যাদের সম্পর্কে বলত- ওরা কখনও জান্নাতে যেতে পারবে না; ওরা দুনিয়ায় যেমন কষ্ট করছে, আখিরাতেও তেমনি কষ্টের জীবনই ভোগ করতে হবে। আ'রাফবাসীগণ তাদের দেখিয়ে দেবে যে, দুনিয়ায় তাদের এসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও হম্বিতম্বি কতটাই মিথ্যা ছিল। আজ সেই গরীব মুসলিমগণ কেমন চিরসুখের জান্নাত লাভ করেছে আর ওই অহংকারী ধনীগণ কীভাবে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করছে।
ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ (তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না)। এ কথাটি আ'রাফবাসীরও হতে পারে কিংবা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করেও হতে পারে। আ'রাফবাসীদের কথা হলে তখন এর অর্থ হবে যে, হে দাম্ভিকগণ! তোমরা তো বলেছিলে এ গরীবগণ জান্নাতে যেতে পারবে না। কিন্তু দেখো, তারা জান্নাতে চলে গেছে। তাদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না। আর যদি আ'রাফবাসীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বলা হয়, তখন এর অর্থ হবে যে, হে আ'রাফবাসীগণ! তোমাদের বিষয়টা তো এ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। তোমরা নিজেরা আশা করছিলে যে, তোমাদের জান্নাত দেওয়া হবে। তোমাদের সে আশা পূরণ করা হল। এবার তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের কোনও ভয় নেই এবং তোমরা কোনও দুঃখেরও সম্মুখীন হবে না।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. শুরুতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে কেবল তারাই, যাদের নেক আমলের ওজন বেশি হবে।
খ. পাপ-পুণ্য সমান হলে তাদের জান্নাতলাভ বিলম্বিত হবে। শুরুতে কিছুকাল তাদের আ'রাফে কাটাতে হবে।
গ. ধন ও জনবলের বড়াই করতে নেই। আখিরাতে তা কোনও কাজে আসবে না।
ঘ. জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও ভয় ও দুঃখ থাকবে না।
অহংকার ও জুলুমের প্রতি নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং: ৬০১
হযরত ইয়ায ইবন হিমার রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি ওহী নাযিল করেছেন যে, তোমরা একে অন্যের প্রতি বিনয় প্রদর্শন করো, যাতে কেউ কারও প্রতি অহমিকা না দেখায় এবং কেউ কারও উপর জুলুম না করে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৮৬৫; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮০: আল- আদাবুল মুফরাদ: ৪২৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৮২; শু'আবুল ঈমান: ৬২৪৫)
হাদীছ নং: ৬০১
হযরত ইয়ায ইবন হিমার রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি ওহী নাযিল করেছেন যে, তোমরা একে অন্যের প্রতি বিনয় প্রদর্শন করো, যাতে কেউ কারও প্রতি অহমিকা না দেখায় এবং কেউ কারও উপর জুলুম না করে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৮৬৫; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮০: আল- আদাবুল মুফরাদ: ৪২৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১০৮২; শু'আবুল ঈমান: ৬২৪৫)
70 - باب فضل الاختلاط بالناس وحضور جمعهم وجماعاتهم، ومشاهد الخير، ومجالس الذكر معهم، وعيادة مريضهم، وحضور جنائزهم، ومواساة محتاجهم، وإرشاد جاهلهم، وغير ذلك من مصالحهم لمن قدر على الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر، وقمع نفسه عن الإيذاء وصبر على الأذى
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ المُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينهِ فَسَوْفَ يَأتِي اللهُ بِقَومٍ يُحِبُّهُم وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى المُؤْمِنينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الكَافِرِينَ} [المائدة: 54]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ} [الحجرات: 12]، وقال تَعَالَى: {فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى} [النجم: 32]، وقال تَعَالَى: {وَنَادَى أَصْحَابُ الأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عنكم جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ أَهؤُلاَءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لا يَنَالُهُمُ اللهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الجَنَّةَ لاَ خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلاَ أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ} [الأعراف: 48 - 49].
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ المُؤْمِنِينَ} [الشعراء: 215]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينهِ فَسَوْفَ يَأتِي اللهُ بِقَومٍ يُحِبُّهُم وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى المُؤْمِنينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الكَافِرِينَ} [المائدة: 54]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ} [الحجرات: 12]، وقال تَعَالَى: {فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى} [النجم: 32]، وقال تَعَالَى: {وَنَادَى أَصْحَابُ الأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عنكم جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ أَهؤُلاَءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لا يَنَالُهُمُ اللهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الجَنَّةَ لاَ خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلاَ أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ} [الأعراف: 48 - 49].
601 - وعن عِيَاضِ بنِ حمارٍ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ اللهَ أوْحَى إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أحَدٌ عَلَى أحَدٍ، وَلاَ يَبْغِي أحَدٌ عَلَى أحَدٍ». رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান যে, ওহীর মাধ্যমে পারস্পরিক বিনয় অবলম্বন সম্পর্কে তাঁর প্রতি আদেশ এসেছে। প্রকাশ থাকে যে, ওহী দু'প্রকার- ওহী মাতলু ও ওহী গায়রে মাতলু। মাতলু হল কুরআন মাজীদ। আর গায়রে মাতলু হাদীছ। কুরআন মাজীদের ভাষা ও ভাব উভয়ই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে এসেছে। আর হাদীছের ভাব আল্লাহ তা'আলার, কিন্তু ভাষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। সুতরাং এ হাদীছে যে বলা হয়েছে তাওয়াযু‘ বা বিনয় সম্পর্কে তাঁর কাছে ওহী এসেছে, তা এ উভয় প্রকার ওহীর যে-কোনওটি হতে পারে। হয়তো তাঁর অন্তরে এ আদেশ সম্পর্কিত ভাব সঞ্চার করা হয়েছিল। পরিভাষায় এ ভাবসঞ্চারকে ইলহাম বলা হয়ে থাকে। আবার এমনও হতে পারে যে, কুরআন মাজীদে বিনয় অবলম্বনের আদেশ সম্পর্কিত যেসব আয়াত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63)
রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে।( সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
এমনিভাবে ইরশাদ হয়েছে-
وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ
নিজ পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং নিজ কণ্ঠস্বর সংযত রাখো।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৯)
হাদীছটিতে দু'টি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। তার একটি হল- لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ (যাতে কেউ কারও প্রতি অহমিকা না দেখায়)। অর্থাৎ ধন, বংশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতা ইত্যাদি যে-কোনও দিক থেকেই অন্যের তুলনায় নিজেকে উপরে দেখলে সে কারণে নিজেকে বড় ও উত্তম ভাববে না। কেননা সেরকম ভাবাটাই অহংকার। বরং মনে করবে দুনিয়ার প্রত্যেকেই তোমার চেয়ে উত্তম, তুমি কারও চেয়ে উত্তম নও। এমনিভাবে মনে করবে দুনিয়ার প্রত্যেকেরই তোমার কাছে প্রাপ্য আছে, কারও কাছে তোমার কোনও প্রাপ্য নেই।
আর দ্বিতীয়টি হল- وَلَا يَبْغِي أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ (এবং কেউ কারও উপর জুলুম না করে)। يَبْغِي শব্দটির উৎপত্তি بغي থেকে। এর অর্থ সীমালঙ্ঘন করা। জুলুম করার দ্বারা অন্যের প্রতি সীমালঙ্ঘন করা হয়। অর্থাৎ তার প্রাপ্যের সীমানা অতিক্রম করে নিজে তার ভেতর প্রবেশ করা হয় এবং তাকে বঞ্চিত করা হয়। সুতরাং যে-কোনও সীমালঙ্ঘনই জুলুম। জুলুম করা অহংকারী ব্যক্তির স্বভাব। অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে তার প্রকৃত মর্যাদার উপরে গণ্য করে। তাই সে কারও কোনও হক মেনে নিতে পারে না। সুতরাং জুলুম করার নিষেধাজ্ঞা দ্বারা প্রকারান্তরে অহংকারের প্রতিও নিষেধাজ্ঞা বটে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. বিনয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা।
খ. একজন ঈমানদারের অপর এক ঈমানদারের উপর অহমিকা দেখানোর কোনও সুযোগ নেই।
গ. কোনও অবস্থায়ই কারও উপর জুলুম করা যাবে না।
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63)
রহমানের বান্দা তারা, যারা ভূমিতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে।( সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩)
এমনিভাবে ইরশাদ হয়েছে-
وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ
নিজ পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং নিজ কণ্ঠস্বর সংযত রাখো।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৯)
হাদীছটিতে দু'টি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। তার একটি হল- لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ (যাতে কেউ কারও প্রতি অহমিকা না দেখায়)। অর্থাৎ ধন, বংশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতা ইত্যাদি যে-কোনও দিক থেকেই অন্যের তুলনায় নিজেকে উপরে দেখলে সে কারণে নিজেকে বড় ও উত্তম ভাববে না। কেননা সেরকম ভাবাটাই অহংকার। বরং মনে করবে দুনিয়ার প্রত্যেকেই তোমার চেয়ে উত্তম, তুমি কারও চেয়ে উত্তম নও। এমনিভাবে মনে করবে দুনিয়ার প্রত্যেকেরই তোমার কাছে প্রাপ্য আছে, কারও কাছে তোমার কোনও প্রাপ্য নেই।
আর দ্বিতীয়টি হল- وَلَا يَبْغِي أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ (এবং কেউ কারও উপর জুলুম না করে)। يَبْغِي শব্দটির উৎপত্তি بغي থেকে। এর অর্থ সীমালঙ্ঘন করা। জুলুম করার দ্বারা অন্যের প্রতি সীমালঙ্ঘন করা হয়। অর্থাৎ তার প্রাপ্যের সীমানা অতিক্রম করে নিজে তার ভেতর প্রবেশ করা হয় এবং তাকে বঞ্চিত করা হয়। সুতরাং যে-কোনও সীমালঙ্ঘনই জুলুম। জুলুম করা অহংকারী ব্যক্তির স্বভাব। অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে তার প্রকৃত মর্যাদার উপরে গণ্য করে। তাই সে কারও কোনও হক মেনে নিতে পারে না। সুতরাং জুলুম করার নিষেধাজ্ঞা দ্বারা প্রকারান্তরে অহংকারের প্রতিও নিষেধাজ্ঞা বটে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. বিনয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা।
খ. একজন ঈমানদারের অপর এক ঈমানদারের উপর অহমিকা দেখানোর কোনও সুযোগ নেই।
গ. কোনও অবস্থায়ই কারও উপর জুলুম করা যাবে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
