রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬০০
অধ্যায় : ৬৯ যখন মানুষের মধ্যে ব্যাপক অবক্ষয় দেখা দেয়, যমানা খারাপ হয়ে যায় অথবা আপন দীনের ক্ষেত্রে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া বা হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে কিংবা এরূপ অন্য কিছুতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন নিঃসঙ্গতা অবলম্বন মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গ
জীবন ও জীবিকায় যারা শ্রেষ্ঠ
হাদীছ নং: ৬০০
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম জীবিকার অধিকারী হল আল্লাহর পথে ঘোড়ার লাগামধারী সেই ব্যক্তি, যে তার পিঠে চড়ে ধাবিত হয়। যখনই কোনও চিৎকার বা ভীতিকর আওয়াজ শোনে, সেদিকে ছুটে যায় যথাস্থানে শাহাদাত বা মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায়। অথবা সেই ব্যক্তি, যে কিছুসংখ্যক ছাগল নিয়ে কোনও এক পাহাড়চূড়ায় বা কোনও এক উপত্যকায় চলে যায়। সেখানে নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকে, যাবৎ না মৃত্যু আসে। মানুষের কোনওকিছুর সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে না, তবে যতটুকু পারে তাদের ভালো করে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ১৮৮৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৯৭৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৮৪৯৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭২৩)
হাদীছ নং: ৬০০
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম জীবিকার অধিকারী হল আল্লাহর পথে ঘোড়ার লাগামধারী সেই ব্যক্তি, যে তার পিঠে চড়ে ধাবিত হয়। যখনই কোনও চিৎকার বা ভীতিকর আওয়াজ শোনে, সেদিকে ছুটে যায় যথাস্থানে শাহাদাত বা মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায়। অথবা সেই ব্যক্তি, যে কিছুসংখ্যক ছাগল নিয়ে কোনও এক পাহাড়চূড়ায় বা কোনও এক উপত্যকায় চলে যায়। সেখানে নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকে, যাবৎ না মৃত্যু আসে। মানুষের কোনওকিছুর সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে না, তবে যতটুকু পারে তাদের ভালো করে। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ১৮৮৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৯৭৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৮৪৯৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭২৩)
69 - باب استحباب العزلة عند فساد الناس والزمان أَو الخوف من فتنة في الدين ووقوع في حرام وشبهات ونحوها
600 - وعنه، عن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أنَّه قَالَ: «مِنْ خَيْرِ مَعَاشِ النَّاسِ لهم رَجُلٌ مُمْسِكٌ عِنَانَ فَرَسِهِ في سَبيلِ الله، يَطيرُ عَلَى مَتْنِهِ كُلَّمَا سَمِعَ هَيْعَةً أَوْ فَزعَةً، طَارَ عَلَيْهِ يَبْتَغِي القَتْلَ، أَوْ المَوْتَ مَظَانَّه، أَوْ رَجُلٌ فِي غُنَيمَةٍ في رَأسِ شَعَفَةٍ مِنْ هذِهِ الشَّعَفِ، أَوْ بَطنِ وَادٍ مِنْ هذِهِ الأَوْدِيَةِ، يُقِيمُ الصَّلاَةَ، وَيُؤتِي الزَّكَاةَ، وَيَعْبُدُ رَبَّهُ حَتَّى يأتِيَهُ اليَقِينُ، لَيْسَ مِنَ النَّاسِ إِلاَّ فِي خَيْرٍ». رواه مسلم. (1)
«يَطِيرُ»: أيْ يُسْرعُ. وَ «مَتْنُهُ»: ظَهْرُهُ. وَ «الهَيْعَةُ»: الصوتُ للحربِ. وَ «الفَزعَةُ»: نحوه. وَ «مَظَانُّ الشَيْءِ»: المواضعُ الَّتي يُظَنُّ وجودُهُ فِيهَا. وَ «الغُنَيْمَة» بضم الغين: تصغير الغنم. وَ «الشَّعَفَةُ» بفتح الشين والعين: هي أعلى الجَبَل.
«يَطِيرُ»: أيْ يُسْرعُ. وَ «مَتْنُهُ»: ظَهْرُهُ. وَ «الهَيْعَةُ»: الصوتُ للحربِ. وَ «الفَزعَةُ»: نحوه. وَ «مَظَانُّ الشَيْءِ»: المواضعُ الَّتي يُظَنُّ وجودُهُ فِيهَا. وَ «الغُنَيْمَة» بضم الغين: تصغير الغنم. وَ «الشَّعَفَةُ» بفتح الشين والعين: هي أعلى الجَبَل.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে দুই শ্রেণির লোকের জীবন ও জীবিকাকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণি হল আল্লাহর পথের অশ্বারোহী মুজাহিদ। মুজাহিদ ব্যক্তির জিহাদী তৎপরতা দ্বারা আল্লাহর শত্রু দমন হয় ও তাঁর বন্ধুদের ইজ্জত-সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং এটি একটি মহান কর্ম। এ পন্থায় তার যে উপার্জন হয়, তাও এক মহৎ উপার্জন।
হাদীছটিতে বিশেষভাবে অশ্বারোহী মুজাহিদের কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, শত্রুর দর্প চূর্ণ করার কাজে অশ্বারোহী সৈনিকই ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। যুগে যুগে মানুষের দিগ্বিজয়ে অশ্বারোহী দলই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তাই সব যুগেই পদাতিক বা উষ্ট্রারোহী সৈনিকদের তুলনায় অশ্বারোহী সৈনিকদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন হাদীছে অশ্বারোহী সৈনিকের প্রশংসা করা হয়েছে। কোনও কোনও হাদীছে ঘোড়াকে কল্যাণকর পশুরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এক হাদীছে আছে-
الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيْهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
ঘোড়ার কপালে কল্যাণ বাঁধা কিয়ামত পর্যন্ত।(সহীহ বুখারী: ২৮৫০; সহীহ মুসলিম: ৯৮৭; সুনানে নাসাঈ ৩৫৬১; জামে তিরমিযী: ১৬৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৭৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫১০২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৩৪৮৩)
সেকালে অশ্বারোহী বাহিনী সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাসম্পন্ন হতো বলে যুদ্ধক্ষেত্রে তার গুরুত্ব বেশি ছিল। বর্তমানকালে বিমান বাহিনীকে সে স্থানে গণ্য করা যেতে পারে। সুতরাং যে-কোনও মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তিশালী বিমান বাহিনী গড়ে তোলা একান্ত কর্তব্য। এমনিভাবে নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনীও আপন আপন স্থানে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। তাই প্রতিটি বাহিনীকেই যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে গড়ে তোলা উচিত। একটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের তার কোনও বাহিনীকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।
হাদীছটি দ্বারা আরও বোঝা যায়, উপার্জনের যে পেশা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দাদের উপকার সাধিত হয়, তা এক মহৎ পেশা। সে পেশা দ্বারা যা উপার্জিত হয়, তাও শ্রেষ্ঠ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন চাষাবাদ করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা ইত্যাদি।
يَبْتَغِي القَتْلَ والْمَوْتَ مَظانَّهُ (যথাস্থানে শাহাদাত বা মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায়)। অর্থাৎ মুজাহিদ ব্যক্তির অন্তরে শাহাদাত ও মৃত্যুলাভ করার আকাঙ্ক্ষা থাকে প্রবল। ফলে যেসকল স্থানে পৌঁছলে তার এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে পারে, সে তার সন্ধানে থাকে। বলাবাহুল্য রণক্ষেত্রই এর উপযুক্ত স্থান। তাই কঠিন থেকে কঠিন রণক্ষেত্রেও সে নির্ভিকচিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষ যত শক্তিমানই হোক, তাতে সে ভয় পায় না। সে তো শহীদই হতে চায়। কাজেই প্রাণের ঝুঁকি থাকার কোনও তোয়াক্কা সে করে না। শহীদ হতে না পারলেও অন্ততপক্ষে মুজাহিদরূপে মৃত্যুবরণও যদি করা যায়, তবে তাও তার কাছে পরম প্রাপ্তি।
বাক্যটি ইঙ্গিত করছে, শহীদী মৃত্যু বা মুজাহিদরূপে মৃত্যুবরণের আশা যে ব্যক্তি লালন করে এবং যার যাবতীয় কর্মকাণ্ড সেই আশাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, প্রকৃত মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম জীবন কেবল তারই, তা ইহজগতেও এবং অবশ্যই আখিরাতেও। আল্লাহ তা'আলা আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে সেই অনুপ্রেরণা দান করুন।
দ্বিতীয় হচ্ছে ওই শ্রেণির লোক, যারা কিছুসংখ্যক ছাগল নিয়ে কোনও পাহাড়ের চূড়ায় বা কোনও উপত্যকায় চলে যায়। এদের সম্পর্কে চারটি কথা বলা হয়েছে।
(ক) তারা তাদের বাসস্থানরূপে লোকালয় থেকে দূরে কোনও পাহাড়ের চূড়া বা কোনও উপত্যকাকে বেছে নেয়। এর দ্বারা তাদের বাসস্থানের তুচ্ছতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। লোকালয় ছেড়ে তারা এরূপ স্থানে চলে যায় নিজেদের ঈমান ও আমল হেফাজতের লক্ষ্যে। সেইসঙ্গে তাদের দ্বারা যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তারা নিজেরাও অন্যের পক্ষ থেকে কোনও ক্ষতির শিকার না হয়, তাও তাদের লক্ষ্যবস্তু।
(খ) জীবিকার অবলম্বনরূপে তাদের কাছে থাকা সামান্য সংখ্যক ছাগল। অর্থাৎ তারা অতি সাধারণ ও অতি সামান্য জীবিকাতেই খুশি থাকে। আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার প্রতি কোনও দৃষ্টি রাখে না।
(গ) তৃতীয়ত বলা হয়েছে, তারা মৃত্যু পর্যন্ত নামায ও যাকাত আদায়সহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। হাদীছটিতে মৃত্যুর জন্য 'ইয়াকীন' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইয়াকীন মানে নিশ্চিত বিষয়। মৃত্যু এমনই এক নিশ্চিত বিষয়, যা কেউ এড়াতে পারে না এবং যার বাস্তবতায় কেউ কখনও সন্দেহ করেনি, সন্দেহ করতেও পারে না। তো এই চরম ও পরম সত্য তথা মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগীতে রত থাকা মুমিনজীবনের আসল কাজ। এরই জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়েছেন-
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ (99)
‘এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকো, যাবৎ না যার আগমন সুনিশ্চিত তোমার কাছে তা (অর্থাৎ মৃত্যু) এসে যায়।’(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৯৯)
(ঘ) চতুর্থত বলা হয়েছে যে, মানুষের কোনও কাজকর্ম ও বিষয়াবলির সঙ্গে তারা কোনওরূপ সম্পর্ক রাখে না। দূর থেকে যতটুকু সম্ভব তাদের কল্যাণসাধনের চেষ্টা করে। নিজ অনিষ্ট থেকে তাদের নিরাপদ রাখাও এক প্রকার কল্যাণ বৈ কি।
হাদীছটিতে এই চারটি গুণসম্পন্ন লোকদের জীবন ও জীবিকাকেও উৎকৃষ্ট বলা হয়েছে। তবে এটা কেবল সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন ব্যাপক ফিতনা ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্জনবাস ছাড়া নিজ ঈমান-আমল রক্ষা করা সম্ভব না হয়। সাধারণ অবস্থায় সকলের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করা ও সকল ক্ষেত্রে দীনের অনুসরণে সচেষ্ট থাকাই ইসলামের আসল হুকুম।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিজ ঈমান-আমলের হেফাজত করা দুরূহ হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনই শ্রেয়।
খ. দীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও সংগ্রাম করা একটি শ্রেষ্ঠ নেক আমল।
গ. জিহাদের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ তুলনামূলক উত্তম ও বরকতময়।
ঘ. শহীদী মৃত্যু ও জিহাদে রত থাকাকালীন মৃত্যু শ্রেষ্ঠতম মৃত্যু।
ঙ. জীবন ও জীবিকায় সাদামাটা থাকাই বেশি পসন্দনীয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করা মানবজীবনের আসল কর্তব্য। মৃত্যু পর্যন্ত এ কর্তব্য থেকে কেউ মুক্ত হতে পারে না।
হাদীছটিতে বিশেষভাবে অশ্বারোহী মুজাহিদের কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, শত্রুর দর্প চূর্ণ করার কাজে অশ্বারোহী সৈনিকই ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। যুগে যুগে মানুষের দিগ্বিজয়ে অশ্বারোহী দলই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তাই সব যুগেই পদাতিক বা উষ্ট্রারোহী সৈনিকদের তুলনায় অশ্বারোহী সৈনিকদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন হাদীছে অশ্বারোহী সৈনিকের প্রশংসা করা হয়েছে। কোনও কোনও হাদীছে ঘোড়াকে কল্যাণকর পশুরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এক হাদীছে আছে-
الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيْهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
ঘোড়ার কপালে কল্যাণ বাঁধা কিয়ামত পর্যন্ত।(সহীহ বুখারী: ২৮৫০; সহীহ মুসলিম: ৯৮৭; সুনানে নাসাঈ ৩৫৬১; জামে তিরমিযী: ১৬৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৭৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫১০২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৩৪৮৩)
সেকালে অশ্বারোহী বাহিনী সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাসম্পন্ন হতো বলে যুদ্ধক্ষেত্রে তার গুরুত্ব বেশি ছিল। বর্তমানকালে বিমান বাহিনীকে সে স্থানে গণ্য করা যেতে পারে। সুতরাং যে-কোনও মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তিশালী বিমান বাহিনী গড়ে তোলা একান্ত কর্তব্য। এমনিভাবে নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনীও আপন আপন স্থানে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। তাই প্রতিটি বাহিনীকেই যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে গড়ে তোলা উচিত। একটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের তার কোনও বাহিনীকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।
হাদীছটি দ্বারা আরও বোঝা যায়, উপার্জনের যে পেশা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দাদের উপকার সাধিত হয়, তা এক মহৎ পেশা। সে পেশা দ্বারা যা উপার্জিত হয়, তাও শ্রেষ্ঠ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন চাষাবাদ করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা ইত্যাদি।
يَبْتَغِي القَتْلَ والْمَوْتَ مَظانَّهُ (যথাস্থানে শাহাদাত বা মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায়)। অর্থাৎ মুজাহিদ ব্যক্তির অন্তরে শাহাদাত ও মৃত্যুলাভ করার আকাঙ্ক্ষা থাকে প্রবল। ফলে যেসকল স্থানে পৌঁছলে তার এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে পারে, সে তার সন্ধানে থাকে। বলাবাহুল্য রণক্ষেত্রই এর উপযুক্ত স্থান। তাই কঠিন থেকে কঠিন রণক্ষেত্রেও সে নির্ভিকচিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষ যত শক্তিমানই হোক, তাতে সে ভয় পায় না। সে তো শহীদই হতে চায়। কাজেই প্রাণের ঝুঁকি থাকার কোনও তোয়াক্কা সে করে না। শহীদ হতে না পারলেও অন্ততপক্ষে মুজাহিদরূপে মৃত্যুবরণও যদি করা যায়, তবে তাও তার কাছে পরম প্রাপ্তি।
বাক্যটি ইঙ্গিত করছে, শহীদী মৃত্যু বা মুজাহিদরূপে মৃত্যুবরণের আশা যে ব্যক্তি লালন করে এবং যার যাবতীয় কর্মকাণ্ড সেই আশাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, প্রকৃত মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম জীবন কেবল তারই, তা ইহজগতেও এবং অবশ্যই আখিরাতেও। আল্লাহ তা'আলা আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে সেই অনুপ্রেরণা দান করুন।
দ্বিতীয় হচ্ছে ওই শ্রেণির লোক, যারা কিছুসংখ্যক ছাগল নিয়ে কোনও পাহাড়ের চূড়ায় বা কোনও উপত্যকায় চলে যায়। এদের সম্পর্কে চারটি কথা বলা হয়েছে।
(ক) তারা তাদের বাসস্থানরূপে লোকালয় থেকে দূরে কোনও পাহাড়ের চূড়া বা কোনও উপত্যকাকে বেছে নেয়। এর দ্বারা তাদের বাসস্থানের তুচ্ছতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। লোকালয় ছেড়ে তারা এরূপ স্থানে চলে যায় নিজেদের ঈমান ও আমল হেফাজতের লক্ষ্যে। সেইসঙ্গে তাদের দ্বারা যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তারা নিজেরাও অন্যের পক্ষ থেকে কোনও ক্ষতির শিকার না হয়, তাও তাদের লক্ষ্যবস্তু।
(খ) জীবিকার অবলম্বনরূপে তাদের কাছে থাকা সামান্য সংখ্যক ছাগল। অর্থাৎ তারা অতি সাধারণ ও অতি সামান্য জীবিকাতেই খুশি থাকে। আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার প্রতি কোনও দৃষ্টি রাখে না।
(গ) তৃতীয়ত বলা হয়েছে, তারা মৃত্যু পর্যন্ত নামায ও যাকাত আদায়সহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। হাদীছটিতে মৃত্যুর জন্য 'ইয়াকীন' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইয়াকীন মানে নিশ্চিত বিষয়। মৃত্যু এমনই এক নিশ্চিত বিষয়, যা কেউ এড়াতে পারে না এবং যার বাস্তবতায় কেউ কখনও সন্দেহ করেনি, সন্দেহ করতেও পারে না। তো এই চরম ও পরম সত্য তথা মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগীতে রত থাকা মুমিনজীবনের আসল কাজ। এরই জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়েছেন-
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ (99)
‘এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকো, যাবৎ না যার আগমন সুনিশ্চিত তোমার কাছে তা (অর্থাৎ মৃত্যু) এসে যায়।’(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৯৯)
(ঘ) চতুর্থত বলা হয়েছে যে, মানুষের কোনও কাজকর্ম ও বিষয়াবলির সঙ্গে তারা কোনওরূপ সম্পর্ক রাখে না। দূর থেকে যতটুকু সম্ভব তাদের কল্যাণসাধনের চেষ্টা করে। নিজ অনিষ্ট থেকে তাদের নিরাপদ রাখাও এক প্রকার কল্যাণ বৈ কি।
হাদীছটিতে এই চারটি গুণসম্পন্ন লোকদের জীবন ও জীবিকাকেও উৎকৃষ্ট বলা হয়েছে। তবে এটা কেবল সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন ব্যাপক ফিতনা ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্জনবাস ছাড়া নিজ ঈমান-আমল রক্ষা করা সম্ভব না হয়। সাধারণ অবস্থায় সকলের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করা ও সকল ক্ষেত্রে দীনের অনুসরণে সচেষ্ট থাকাই ইসলামের আসল হুকুম।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিজ ঈমান-আমলের হেফাজত করা দুরূহ হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনই শ্রেয়।
খ. দীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও সংগ্রাম করা একটি শ্রেষ্ঠ নেক আমল।
গ. জিহাদের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ তুলনামূলক উত্তম ও বরকতময়।
ঘ. শহীদী মৃত্যু ও জিহাদে রত থাকাকালীন মৃত্যু শ্রেষ্ঠতম মৃত্যু।
ঙ. জীবন ও জীবিকায় সাদামাটা থাকাই বেশি পসন্দনীয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করা মানবজীবনের আসল কর্তব্য। মৃত্যু পর্যন্ত এ কর্তব্য থেকে কেউ মুক্ত হতে পারে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
