রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৯৭
অধ্যায় : ৬৯ যখন মানুষের মধ্যে ব্যাপক অবক্ষয় দেখা দেয়, যমানা খারাপ হয়ে যায় অথবা আপন দীনের ক্ষেত্রে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া বা হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে কিংবা এরূপ অন্য কিছুতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন নিঃসঙ্গতা অবলম্বন মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গ
আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি কে
হাদীছ নং: ৫৯৭
হযরত আবু সা‘ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে কে উত্তম? তিনি বললেন, ওই মুমিন, যে নিজ জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর কোনও গিরিসংকটে নির্জনবাসী ওই ব্যক্তি, যে আপন প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যে আল্লাহকে ভয় করে এবং মানুষকে নিজ অনিষ্ট থেকে মুক্ত রাখে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২৭৮৬, ৬৪৯৪; সহীহ মুসলিম: ১৮৮৮; সুনানে দারিমী: ২৪৪০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৯৩৩১; মুসনাদে আহমাদ: ২১১৬; সুনানে নাসাঈ: ৬৫৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬০৪)
হাদীছ নং: ৫৯৭
হযরত আবু সা‘ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে কে উত্তম? তিনি বললেন, ওই মুমিন, যে নিজ জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর কোনও গিরিসংকটে নির্জনবাসী ওই ব্যক্তি, যে আপন প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যে আল্লাহকে ভয় করে এবং মানুষকে নিজ অনিষ্ট থেকে মুক্ত রাখে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২৭৮৬, ৬৪৯৪; সহীহ মুসলিম: ১৮৮৮; সুনানে দারিমী: ২৪৪০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৯৩৩১; মুসনাদে আহমাদ: ২১১৬; সুনানে নাসাঈ: ৬৫৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬০৪)
69 - باب استحباب العزلة عند فساد الناس والزمان أَو الخوف من فتنة في الدين ووقوع في حرام وشبهات ونحوها
597 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: أيُّ النَّاسِ أفْضَلُ يَا رسولَ الله؟ قَالَ: «مُؤْمِنٌ مُجَاهِدٌ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ في سَبيلِ اللهِ» قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: «ثُمَّ رَجُلٌ مُعْتَزِلٌ فِي شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَعْبُدُ رَبَّهُ».
وفي رواية: «يَتَّقِي اللهَ، وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
وفي رواية: «يَتَّقِي اللهَ، وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ও চিন্তা-চেতনা- সবদিক থেকে পরম যত্নের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সতর্ক প্রশিক্ষণে তাঁরা পার্থিব সকল দরকারি ব্যতিব্যস্ততার মধ্য দিয়েও আখিরাতের মানুষরূপে গড়ে উঠেছিলেন। তাই সর্বদা তাঁরা সৎকর্মে মশগুল থাকার উৎসাহ বোধ করতেন। বরং সে ক্ষেত্রে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। ছাড়িয়ে যাওয়ার সে আগ্রহেই তাঁরা জানতে চাইতেন কোন কোন কাজের ফযীলত তুলনামূলক বেশি এবং কোন কোন আমল আল্লাহ তা'আলার কাছে বেশি পসন্দ। কেবল মদীনা মুনাউওয়ারার বিশিষ্ট সাহাবীগণই নন; মরু ও পল্লী অঞ্চলের সাহাবীগণ পর্যন্ত এরূপ আমল সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করতেন। হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. বর্ণিত এ হাদীছটিতেও দেখা যাচ্ছে এক সাহাবী এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। কে সেই সাহাবী, হাদীছটির বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি ছিলেন একজন বেদুঈন। অজ্ঞাতনামা সেই বেদুঈন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلُ (মানুষের মধ্যে কে উত্তম)? অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে কে উত্তম? আল্লাহ তা'আলার কাছে উত্তম হতে পারাই ছিল তাঁদের জীবনের লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু তাঁর কাছে কে উত্তম, এটা কে বলতে পারে? তা জানেন তো কেবল আল্লাহ তা'আলা নিজেই আর সেই ব্যক্তি, যাকে তিনি জানান। আল্লাহ তা'আলা তা জানান নবী-রাসূলগণকে। তাই সাহাবী 'ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলে কথাটি জিজ্ঞেস করেছেন। এর ভেতর ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে কে উত্তম, তা একজন রাসূল হিসেবে তাঁর পক্ষেই জানা সম্ভব। সে কারণেই তাঁর কাছে এ জিজ্ঞাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন-
مُؤْمِنٌ مُجَاهِدٌ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ (ওই মুমিন, যে নিজ জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে)। জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ বলতে সাধারণত দীনের দুশমন কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে সসস্ত্র সংগ্রামকে বোঝায়। তবে আভিধানিক অর্থ হিসেবে 'জিহাদ' শব্দটি আরও ব্যাপক। আল্লাহ তা'আলার দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যে-কোনও ক্ষেত্রে নিজের জান-মাল ব্যবহার করাকে ব্যাপক অর্থে জিহাদ বলা হয়। সুতরাং বিশেষ অর্থের জিহাদ অর্থাৎ দীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে সংগ্রামকারী মুজাহিদের জন্য যেমন হাদীছটি প্রযোজ্য, তেমনি আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করার জন্য দীনের যে-কোনও খাতে জান-মাল ব্যয়কারীও স্তরভেদে এ হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হবে।
প্রকৃতপক্ষে একজন মুমিনের কর্তব্য সদা-সর্বদা দীনের জন্য নিজ জান-মাল খরচ করতে প্রস্তুত থাকা। তা খরচের যখন যে সুযোগ পাওয়া যায়, সে সুযোগকেই সে কাজে লাগায়। যখন সসস্ত্র সংগ্রামের পরিস্থিতি দেখা দেয়, তখন সে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর যখন সে পরিস্থিতি না থাকে, তখনও সে দীনের খেদমত অব্যাহত রাখবে। সে মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবে, দীনী বই-পুস্তক প্রকাশ ও প্রচার করবে, আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা ও সত্য প্রচারের জন্য নিজ বাকশক্তি ও কলমের শক্তি ব্যবহার করবে, আল্লাহর বান্দাদের সেবায় অকৃপণভাবে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে এবং এমনিভাবে দীনের প্রচার ও সৃষ্টির সেবা করার প্রতিটি ক্ষেত্রে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তার থাকবে অদম্য বিচরণ। এরূপ অদম্য আগ্রহী যে-কোনও ব্যক্তির পক্ষেই আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন উত্তম বান্দারূপে মর্যাদা লাভ করা সম্ভব।
সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন- ثُمَّ مَنْ؟ (তারপর কে)? অর্থাৎ জানা গেল, আল্লাহর পথে জান-মাল দিয়ে জিহাদকারী ব্যক্তির মর্যাদা সবার উপরে। তার পরের স্থানটি কার? অনেক সময় ওজরবশত মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাজটি করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে আগ্রহী ও উদ্যমী ব্যক্তি একদম নিরস্তও থাকতে পারে না। সে কোনও বিকল্প চায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণও সেরকমই ছিলেন। তারা পুণ্যার্জনে এগিয়ে থাকার লক্ষ্যে একটি না পারলে আরেকটি অবলম্বন করতে চাইতেন। সে কারণেই এ সাহাবীর এই জিজ্ঞাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-
ثُمَّ رَجُلٌ مُعْتَزِل فِي شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَعْبُدُ رَبَّهُ (তারপর কোনও গিরিসংকটে নির্জনবাসী ওই ব্যক্তি, যে আপন প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকে)। شِعْب শব্দটির অর্থ পাহাড়ি পথ, দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান, উপত্যকা ও পানির নালা। এ হাদীছে শব্দটি দ্বারা পাহাড়ের কোনও নির্জন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য, যেখানে মানুষের বিশেষ যাতায়াত থাকে না। এমন স্থানে গিয়ে থাকলে নিভৃতে ইবাদত-বন্দেগী করা যায়। কারও দ্বারা তাতে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। বিশেষ করে যখন ফিতনা-ফাসাদ ব্যাপক হয়ে যায়, পরিবেশ-পরিস্থিতি নষ্ট হয়ে যায়, মানুষ ব্যাপকভাবে বদদীনীর শিকার হয়ে পড়ে, নিজেরা বদদীন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের দীনদারীতেও ব্যাঘাত ঘটায়, তখন লোকালয় ছেড়ে নির্জন স্থানে চলে যাওয়াই নিরাপদ। সেখানে চলে গেলে ঈমান-আমলের হেফাজত হয় এবং অবাধে ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। সুতরাং যে ব্যক্তি ইবাদত-বন্দেগীর জন্য উপযুক্ত স্থান বেছে নেবে, সে অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার প্রিয়পাত্র হবে এবং তাঁর কাছে এক উত্তম বান্দারূপে গণ্য হবে। হযরত উকবা ইবন আমির রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি
يَعْجَبُ رَبُّكَ مِنْ رَاعِي غَنَمٍ فِي رَأْسِ شَظِيَّةِ الْجَبَلِ يُؤَذِّنُ بِالصَّلاَةِ وَيُصَلِّي فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي هَذَا يُؤَذِّنُ وَيُقِيمُ الصَّلاَةَ يَخَافُ مِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لِعَبْدِي وَأَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ
'তোমার প্রতিপালক ওই বকরিপালের রাখালকে বড় পসন্দ করেন, যে পাহাড়ের শিখরে কোনও স্থানে চলে যায় এবং সেখানে আযান দেয় ও নামায আদায় করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, তোমরা আমার এই বান্দার দিকে লক্ষ করো। সে আমার ভয়ে ভীত হয়ে আযান দেয় ও নামায পড়ে। আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাতে স্থান দিলাম।(সুনানে নাসাঈ: ৬৬৬; সুনানে আবু দাউদ: ১২০৩; সহীহ ইবন হিব্বান : ১৬৬০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৮৩৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৯০৫)
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে পাহাড় বা উপত্যকায় চলে যাওয়ার কথা বলা হলেও মূলত নির্জন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন মসজিদের ভেতর ই'তিকাফে বসে যাওয়া, সীমান্ত প্রহরায় নিযুক্ত হওয়া, বাইরে কম বের হয়ে নিজ ঘরের মধ্যেই অবস্থান করা ইত্যাদি। সেকালে সাধারণত নির্জনতা অবলম্বনের জন্য মানুষ পাহাড়-পর্বতে চলে যেত। সে দৃষ্টিতেই হাদীছে পাহাড়ের কথা বলা হয়েছে। নচেৎ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না হয় এমন দূরবর্তী যে-কোনও স্থানের জন্যই হাদীছটির বক্তব্য প্রযোজ্য।
হাদীসে আছে- يَتَّقِي اللَّهَ ، وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ (যে আল্লাহকে ভয় করে এবং মানুষকে নিজ অনিষ্ট থেকে মুক্ত রাখে)। অর্থাৎ নির্জন স্থানে অবস্থানকালেও সে আল্লাহকে ভয় করে। তার বিশ্বাস কোনও স্থানই আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে নয়। ফলে ওই নির্জন স্থানেও সে কোনও গুনাহ করে না। আর লোকসংসর্গ থেকে মুক্ত থাকার কারণে কাউকে কষ্টও দেওয়া হয় না। তার ভয় ছিল মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে হয়তো তার দ্বারা কেউ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদেরকে তার সেই ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সে নির্জন স্থানে চলে এসেছে। কাজেই তার এ চলে আসাটাও এক মহৎ লক্ষ্যেই সাধিত হয়েছে। অন্যকে নিজ ক্ষতি থেকে রক্ষা করাও একটি মহৎ কাজ।
تَكفُ شَرَّكَ عَنِ النَّاسِ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ مِنْكَ عَلَى نَفْسِكَ
‘তোমার অনিষ্টসাধনকে মানুষ থেকে নিরস্ত রাখবে (অর্থাৎ অন্যের ক্ষতি করা হতে বিরত থাকবে)। এটাও তোমার পক্ষ হতে তোমার নিজের প্রতি একটি সদাকা।’(সহীহ মুসলিম: ১৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান ৪৩১০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১২৫৯৮; সহীহ বুখারী: ২৫১৮; মুসনাদুল বাযযার: ৪০৩৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪১৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহর পথে জিহাদ সর্বোত্তম আমল।
খ. নিজ ঈমান-আমলের হেফাজতের লক্ষ্যে লোকসংসর্গ থেকে দূরে চলে যাওয়ার অবকাশ আছে।
গ. লোকচক্ষুর আড়ালেও আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করা ও গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা জরুরি।
ঘ. মানুষকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকাও একটি উৎকৃষ্ট নেক আমল।
مُؤْمِنٌ مُجَاهِدٌ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ (ওই মুমিন, যে নিজ জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে)। জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ বলতে সাধারণত দীনের দুশমন কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে সসস্ত্র সংগ্রামকে বোঝায়। তবে আভিধানিক অর্থ হিসেবে 'জিহাদ' শব্দটি আরও ব্যাপক। আল্লাহ তা'আলার দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যে-কোনও ক্ষেত্রে নিজের জান-মাল ব্যবহার করাকে ব্যাপক অর্থে জিহাদ বলা হয়। সুতরাং বিশেষ অর্থের জিহাদ অর্থাৎ দীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে সংগ্রামকারী মুজাহিদের জন্য যেমন হাদীছটি প্রযোজ্য, তেমনি আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করার জন্য দীনের যে-কোনও খাতে জান-মাল ব্যয়কারীও স্তরভেদে এ হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হবে।
প্রকৃতপক্ষে একজন মুমিনের কর্তব্য সদা-সর্বদা দীনের জন্য নিজ জান-মাল খরচ করতে প্রস্তুত থাকা। তা খরচের যখন যে সুযোগ পাওয়া যায়, সে সুযোগকেই সে কাজে লাগায়। যখন সসস্ত্র সংগ্রামের পরিস্থিতি দেখা দেয়, তখন সে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর যখন সে পরিস্থিতি না থাকে, তখনও সে দীনের খেদমত অব্যাহত রাখবে। সে মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবে, দীনী বই-পুস্তক প্রকাশ ও প্রচার করবে, আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা ও সত্য প্রচারের জন্য নিজ বাকশক্তি ও কলমের শক্তি ব্যবহার করবে, আল্লাহর বান্দাদের সেবায় অকৃপণভাবে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে এবং এমনিভাবে দীনের প্রচার ও সৃষ্টির সেবা করার প্রতিটি ক্ষেত্রে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তার থাকবে অদম্য বিচরণ। এরূপ অদম্য আগ্রহী যে-কোনও ব্যক্তির পক্ষেই আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন উত্তম বান্দারূপে মর্যাদা লাভ করা সম্ভব।
সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন- ثُمَّ مَنْ؟ (তারপর কে)? অর্থাৎ জানা গেল, আল্লাহর পথে জান-মাল দিয়ে জিহাদকারী ব্যক্তির মর্যাদা সবার উপরে। তার পরের স্থানটি কার? অনেক সময় ওজরবশত মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাজটি করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে আগ্রহী ও উদ্যমী ব্যক্তি একদম নিরস্তও থাকতে পারে না। সে কোনও বিকল্প চায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণও সেরকমই ছিলেন। তারা পুণ্যার্জনে এগিয়ে থাকার লক্ষ্যে একটি না পারলে আরেকটি অবলম্বন করতে চাইতেন। সে কারণেই এ সাহাবীর এই জিজ্ঞাসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-
ثُمَّ رَجُلٌ مُعْتَزِل فِي شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَعْبُدُ رَبَّهُ (তারপর কোনও গিরিসংকটে নির্জনবাসী ওই ব্যক্তি, যে আপন প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকে)। شِعْب শব্দটির অর্থ পাহাড়ি পথ, দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান, উপত্যকা ও পানির নালা। এ হাদীছে শব্দটি দ্বারা পাহাড়ের কোনও নির্জন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য, যেখানে মানুষের বিশেষ যাতায়াত থাকে না। এমন স্থানে গিয়ে থাকলে নিভৃতে ইবাদত-বন্দেগী করা যায়। কারও দ্বারা তাতে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। বিশেষ করে যখন ফিতনা-ফাসাদ ব্যাপক হয়ে যায়, পরিবেশ-পরিস্থিতি নষ্ট হয়ে যায়, মানুষ ব্যাপকভাবে বদদীনীর শিকার হয়ে পড়ে, নিজেরা বদদীন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের দীনদারীতেও ব্যাঘাত ঘটায়, তখন লোকালয় ছেড়ে নির্জন স্থানে চলে যাওয়াই নিরাপদ। সেখানে চলে গেলে ঈমান-আমলের হেফাজত হয় এবং অবাধে ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। সুতরাং যে ব্যক্তি ইবাদত-বন্দেগীর জন্য উপযুক্ত স্থান বেছে নেবে, সে অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার প্রিয়পাত্র হবে এবং তাঁর কাছে এক উত্তম বান্দারূপে গণ্য হবে। হযরত উকবা ইবন আমির রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি
يَعْجَبُ رَبُّكَ مِنْ رَاعِي غَنَمٍ فِي رَأْسِ شَظِيَّةِ الْجَبَلِ يُؤَذِّنُ بِالصَّلاَةِ وَيُصَلِّي فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي هَذَا يُؤَذِّنُ وَيُقِيمُ الصَّلاَةَ يَخَافُ مِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لِعَبْدِي وَأَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ
'তোমার প্রতিপালক ওই বকরিপালের রাখালকে বড় পসন্দ করেন, যে পাহাড়ের শিখরে কোনও স্থানে চলে যায় এবং সেখানে আযান দেয় ও নামায আদায় করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, তোমরা আমার এই বান্দার দিকে লক্ষ করো। সে আমার ভয়ে ভীত হয়ে আযান দেয় ও নামায পড়ে। আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাতে স্থান দিলাম।(সুনানে নাসাঈ: ৬৬৬; সুনানে আবু দাউদ: ১২০৩; সহীহ ইবন হিব্বান : ১৬৬০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৮৩৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৯০৫)
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে পাহাড় বা উপত্যকায় চলে যাওয়ার কথা বলা হলেও মূলত নির্জন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন মসজিদের ভেতর ই'তিকাফে বসে যাওয়া, সীমান্ত প্রহরায় নিযুক্ত হওয়া, বাইরে কম বের হয়ে নিজ ঘরের মধ্যেই অবস্থান করা ইত্যাদি। সেকালে সাধারণত নির্জনতা অবলম্বনের জন্য মানুষ পাহাড়-পর্বতে চলে যেত। সে দৃষ্টিতেই হাদীছে পাহাড়ের কথা বলা হয়েছে। নচেৎ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না হয় এমন দূরবর্তী যে-কোনও স্থানের জন্যই হাদীছটির বক্তব্য প্রযোজ্য।
হাদীসে আছে- يَتَّقِي اللَّهَ ، وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ (যে আল্লাহকে ভয় করে এবং মানুষকে নিজ অনিষ্ট থেকে মুক্ত রাখে)। অর্থাৎ নির্জন স্থানে অবস্থানকালেও সে আল্লাহকে ভয় করে। তার বিশ্বাস কোনও স্থানই আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে নয়। ফলে ওই নির্জন স্থানেও সে কোনও গুনাহ করে না। আর লোকসংসর্গ থেকে মুক্ত থাকার কারণে কাউকে কষ্টও দেওয়া হয় না। তার ভয় ছিল মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে হয়তো তার দ্বারা কেউ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদেরকে তার সেই ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সে নির্জন স্থানে চলে এসেছে। কাজেই তার এ চলে আসাটাও এক মহৎ লক্ষ্যেই সাধিত হয়েছে। অন্যকে নিজ ক্ষতি থেকে রক্ষা করাও একটি মহৎ কাজ।
تَكفُ شَرَّكَ عَنِ النَّاسِ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ مِنْكَ عَلَى نَفْسِكَ
‘তোমার অনিষ্টসাধনকে মানুষ থেকে নিরস্ত রাখবে (অর্থাৎ অন্যের ক্ষতি করা হতে বিরত থাকবে)। এটাও তোমার পক্ষ হতে তোমার নিজের প্রতি একটি সদাকা।’(সহীহ মুসলিম: ১৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান ৪৩১০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১২৫৯৮; সহীহ বুখারী: ২৫১৮; মুসনাদুল বাযযার: ৪০৩৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৪১৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহর পথে জিহাদ সর্বোত্তম আমল।
খ. নিজ ঈমান-আমলের হেফাজতের লক্ষ্যে লোকসংসর্গ থেকে দূরে চলে যাওয়ার অবকাশ আছে।
গ. লোকচক্ষুর আড়ালেও আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করা ও গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা জরুরি।
ঘ. মানুষকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকাও একটি উৎকৃষ্ট নেক আমল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
