রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৯৬
যখন মানুষের মধ্যে ব্যাপক অবক্ষয় দেখা দেয়, যমানা খারাপ হয়ে যায় অথবা আপন দীনের ক্ষেত্রে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া বা হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে কিংবা এরূপ অন্য কিছুতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন নিঃসঙ্গতা অবলম্বন মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গ
العزلة এর অর্থ বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা। মানুষকে আল্লাহ তা'আলা সামাজিক জীবরূপে সৃষ্টি করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তাকে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হয়। সে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে পারে না। ইসলাম এক স্বভাবধর্ম। ইসলামের যাবতীয় বিধানে মানুষের এই স্বাভাবিক অবস্থার প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে। তার মৌলিক প্রতিটি বিধানই সমাজঘনিষ্ঠ। সে তার অনুসারীদের সমাজের একজন হয়ে থাকতে উৎসাহ দেয় এবং সকলের ভেতরে থেকেই দীনী দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে রত থাকতে বলে। তবে যদি কখনও এমন কোনও ব্যতিক্রম অবস্থা দেখা দেয়, যখন মিলেমিশে থাকার দ্বারা তার আসল কাজ ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হয়, তখন তাকে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা জরুরিও সাব্যস্ত করা হয়েছে।
সাধারণ অবস্থায় মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দিয়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কারও মতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করাই উত্তম। কেননা তাতে করে যেসব গুনাহ অন্যের দেখাদেখি হয়ে যায়, তা থেকে বাঁচা যায়। তাছাড়া এর দ্বারা নিজ অনিষ্ট থেকেও অন্যের হেফাজত হয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শর্ত হল ইবাদত-বন্দেগী ও দীনের জরুরি বিষয়ে নিজের জানা থাকতে হবে।
কারও মতে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা উত্তম। কেননা এর মধ্যে বহুবিধ ফায়দা রয়েছে। যেমন জুমু'আ ও জামাতে হাজির হতে পারা, মুসলিমদের দল বড় করে দেখানোয় ভূমিকা রাখা, দুস্থ ও বিপন্নের সাহায্য করতে পারা, রোগীর সেবা করতে পারা, জানাযায় শরীক হতে পারা, সালামের রেওয়াজদানে ভূমিকা রাখা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এবং তাকওয়া ও নেকীর কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা করার সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি।
ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন, মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে যার প্রবল ধারণা থাকে যে, সে কোনও গুনাহে লিপ্ত হবে না, তার পক্ষে মিলেমিশে থাকাই উত্তম। আর যার কাছে এটা স্পষ্ট না থাকে, তার জন্য আলাদা থাকাই শ্রেয়।
কারও মতে ব্যক্তিভেদে বিষয়টা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আবার কারও মতে অবস্থাভেদে এর বিধান বিভিন্ন রকম হয়। যার সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ক্ষমতা আছে, তার পক্ষে সকলের সঙ্গে মিলে থাকাই জরুরি। যার সে ক্ষমতা নেই, আবার সকলের মধ্যে থাকার কারণে নিজ আমল নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা নেই, তার পক্ষে সকলের সঙ্গে মিলে থাকা জরুরি না হলেও থাকার অবকাশ আছে। পক্ষান্তরে যার নিজ আমল নষ্ট হওয়ার ভয় আছে, তার জন্য আলাদা থাকাই জরুরি। তবে এ কথা প্রযোজ্য সেই ক্ষেত্রে, যখন ফিতনা-ফাসাদ ব্যাপক না হয়। সুতরাং যদি ব্যাপক ফিতনা দেখা দেয়, তবে নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেওয়া জরুরি। কেননা সেরূপ ক্ষেত্রে অন্যদের প্রভাবে নিজেরও অন্যায়-অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া এরূপ ক্ষেত্রে অন্যায়-অনাচারকারীদের উপর আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে ব্যাপক আযাব আসে, নিরপরাধ ব্যক্তিগণও তার থাবায় পড়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)
‘এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় করো, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখো, আল্লাহর আযাব সুকঠিন।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫)
সে ভয়ের একটা দিক তো হল জালেমদের মধ্যে থাকলে আযাবের মধ্যে পড়ে যাওয়া। তাই তা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনও নিরাপদ স্থানে গিয়ে বাস করা। এর আরেকটা দিক হল যে কারণে আযাব আসে, সে কারণ থেকে আত্মরক্ষা করা। কারণটি হল জালেমদের অবারিতভাবে জুলুম করতে থাকা এবং কারও পক্ষ থেকে তাতে কোনও বাধা না আসা। যারা জালেমকে জুলুম করতে দেখা সত্ত্বেও মুখ বন্ধ করে রাখে, তাকে জুলুম করতে বাধাও দেয় না ও নিষেধও করে না, প্রকারান্তরে তারাও জুলুমবাজির অংশীদার। তাই ব্যাপক আযাবের মধ্যে তারাও পড়ে যায়। এর থেকে মুক্তির উপায় হল জুলুম করতে বাধা দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া।
কিন্তু পরিস্থিতি যদি নাগালের বাইরে চলে যায় এবং অবস্থা এমন কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা হয়তো সম্ভবই নয় কিংবা সম্ভব হলেও তা কোনও কাজে আসে না, উল্টো নিজের ঈমান ও আমলই ঝুঁকিতে পড়ে যায়, তখন নিজ ঈমান ও আমল রক্ষার জন্য যা করা জরুরি তাই করতে হবে। যদি লোকালয় ছেড়ে নির্জন স্থানে যাওয়া ছাড়া উপায় না থাকে, তবে তাই গ্রহণ করে নিতে হবে। আসহাবে কাহফ সেটাই করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলাই তাদেরকে পাহাড়ের গুহায় চলে যাওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ فَأْوُوا إِلَى الْكَهْفِ يَنْشُرْ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيُهَيِّئْ لَكُمْ مِنْ أَمْرِكُمْ مِرْفَقًا (16)
‘(সাথী বন্ধুরা!) তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকেও, তখন চলো, ওই গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য নিজ রহমত বিস্তার করে দেবেন এবং তোমাদের বিষয়টা যাতে সহজ হয় সেই ব্যবস্থা করে দেবেন।(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১৬)
এর দ্বারা বোঝা গেল ক্ষেত্রবিশেষে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করাও জরুরি হয়ে পড়ে। তা জরুরি হয়ে পড়ে বলেই ইসলাম তার অনুমতি দিয়েছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীছে তার প্রমাণ মেলে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।
‘যখন মানুষের মধ্যে ব্যাপক অবক্ষয়…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
فَفِرُّوا إِلَى اللَّهِ إِنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مُبِينٌ (50)
অর্থ: সুতরাং ধাবিত হও আল্লাহর দিকে। নিশ্চয়ই আমি তাঁর পক্ষ হতে তোমাদের কাছে এক সুস্পষ্ট সতর্ককারী (হয়ে এসেছি)।(সূরা যারিয়াত (৫১), আয়াত ৫০)
ব্যাখ্যা
فِرُّوا আদেশসূচক ক্রিয়াটির উৎপত্তি اَلْفَرَارُ থেকে। এর অর্থ পলায়ন করা; এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে ও এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে পালানো। এর উদ্দেশ্য হয় ক্ষতি থেকে বাঁচা। দুনিয়ায় মানুষ যা-কিছুকেই নিজ জান- মাল ও ইজ্জতের জন্য ক্ষতিকর মনে করে, তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। দুনিয়ার ক্ষতি অপেক্ষা আখিরাতের ক্ষতি অনেক বড়। সে ক্ষতি থেকে নিজেকে বাঁচানো আরও বেশি জরুরি। আখিরাতের ক্ষতি হয় আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা দ্বারা। সুতরাং যা-কিছু দ্বারা আল্লাহর অবাধ্যতা হয়, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করে তাঁর বাধ্যতামূলক কাজে মশগুল হওয়া অতীব জরুরি। এ আয়াতে আল্লাহর দিকে পালানো ও তাঁর দিকে ধাবিত হওয়া দ্বারা এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা'আলার দিকে পালানোর জন্য প্রথম কাজ হল আল্লাহ তা'আলাকে চেনা এবং আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে নিজ অজ্ঞতা দূর করা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার দিকে পালাতে চায়, তার প্রথম কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে নিজ আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করা। তিনি নিজ গুণাবলি সম্পর্কে আমাদেরকে যতটুকু অবহিত করেছেন তা যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া। তাঁর জগৎপরিচালনা ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা। কুরআন ও হাদীছ দ্বারা আমাদেরকে এসব বিষয় অবগত করা হয়েছে। সুতরাং যাদের পক্ষে সরাসরি কুরআন ও হাদীছ পাঠ করে এসব জানা সম্ভব, তারা তো সরাসরি আর যাদের পক্ষে তা সম্ভব নয় তারা উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে এসব বিষয় জেনে নেবে। এসব বিষয়ে জানার দাবি হল আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের সঙ্গে জীবনযাপন করা। সে লক্ষ্যে প্রত্যেকের কর্তব্য আল্লাহপ্রদত্ত বিধানাবলি সম্পর্কে অবগত হওয়া, যাকে শরী'আত বলা হয়ে থাকে। আকীদা-বিশ্বাস ও শরী'আতের ইলম জানার দ্বারা জ্ঞানগতভাবে আল্লাহ তা'আলার দিকে পলায়ন করা হয়। এটা হল অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের দিকে পলায়ন। পরবর্তী কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের দিকে পলায়ন। অর্থাৎ পাপকর্ম ছেড়ে সৎকর্মে মশগুল হয়ে যাওয়া। এটা সম্ভব হয় শরী'আতের অনুসরণ দ্বারা। যদি শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করা হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে শরী'আতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আল্লাহর দিকে পলায়ন পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ আয়াত আমাদেরকে সে নির্দেশই দান করছে।
সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে যারা উদাসীন, যারা পাপকর্মে ডুবে আছে, এ আয়াত তাদের ডেকে বলছে- তোমরা সতর্ক হও। তোমরা শত্রু দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছ। তোমরা নফসের ধোঁকায় পড়ে রয়েছ। তোমরা শয়তানের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছ। শয়তান তোমাদের চিরশত্রু। সে তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যেতে চায়। তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে হবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাইলে শয়তান থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। তার থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় সেই সত্তার আশ্রয়প্রার্থী হওয়া, যিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান, অমর, অক্ষয় ও জীবন্ত। সকল দাসত্ব ছিঁড়ে সব ভরসা ছেড়ে সেই মহামহিয়ানের দিকে ফিরে এসো। তোমরা তাওবা করো। তাঁর অভিমুখী হও। এ এক মহান পলায়ন। এ পলায়ন অবলম্বন করতে পারলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সত্যিকারের সফলতা লাভ করতে পারবে।
পক্ষান্তরে যদি নফস ও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পাপাচারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা হয়, তবে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনই ধ্বংস হবে। দুনিয়ার কষ্ট না হয় মৃত্যুতে শেষ, কিন্তু আখিরাতের কষ্টের তো কোনও শেষ নেই, সীমা নেই। সেখানে আল্লাহ তা'আলা পাপী বান্দাকে কঠিনভাবে ধরবেন। সে ধরা থেকে নিস্তারলাভের কোনও উপায় সেখানে থাকবে না। তাই এ আয়াতে সেই কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করে দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মাজীদের আয়াত ও নিজ বাণী দ্বারা উম্মতকে বারবার সে সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি ছিলেন এক সুস্পষ্ট সতর্ককারী। প্রত্যেকের কর্তব্য তাঁর সে সতর্কবাণী গ্রহণ করে আত্মসংশোধনে মনোনিবেশ করা এবং কালক্ষেপণ না করে এখনই আল্লাহ তা'আলার অনুগত বান্দারূপে জীবনযাপন শুরু করে দেওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَأَنِيبُوا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنْصَرُونَ (54) وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ (55)
‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হয়ে যাও এবং তাঁর সমীপে আনুগত্য প্রকাশ করো তোমাদের নিকট শাস্তি আসার আগে, যার পর আর তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করো তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না।(সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৪-৫৫)
আল্লাহর দিকে পলায়ন তথা সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর অভিমুখী হওয়ার উপায় দু'টি। এক তো হল সকলের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ হয়ে থাকা। অর্থাৎ সকলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে বাহ্যিক ও শারীরিক। অন্তর সকল থেকে ছিন্ন হয়ে এক আল্লাহতে মগ্ন থাকবে। অন্তর যদি আল্লাহভিন্ন অন্যতে মগ্ন হয়ে যায়, তবে পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাই মানুষের সঙ্গে যতই মেলামেশা করা হোক না কেন, নিজ হৃদয়মনকে কিছুতেই তাদের স্রোতে ভেসে যেতে দেওয়া যাবে না। হৃদয়মন সম্পূর্ণ আল্লাহর অভিমুখী করে রাখতে হবে। মনে থাকবে কেবলই আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহভীতি।
যাদের পক্ষে সকলের ভেতরে থেকে নিঃসঙ্গ থাকা সম্ভব হয় না, শারীরিক মেলামেশা করতে গেলে হৃদয়মনও তাদের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, পরিণামে অন্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা থেকে যায়, তাদের জন্য শারীরিক ও সামাজিকভাবেও নিঃসঙ্গ থাকাই বেশি নিরাপদ। এ আয়াত যে আল্লাহ তা'আলার দিকে পলায়ন করার হুকুম দিয়েছে, তা দ্বারা এ উভয়রকম নিঃসঙ্গতার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাপকর্ম থেকে বাঁচার জন্য যার যেরকম নিঃসঙ্গতা অবলম্বনের প্রয়োজন, তার সেরকম নিঃসঙ্গতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। বলা হচ্ছে, আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করার প্রয়োজনে তোমরা নিঃসঙ্গ জীবন অবলম্বন করো, তা শারীরিক ও আত্মিক উভয়রকম নিঃসঙ্গতা হোক কিংবা কেবলই আত্মিক নিঃসঙ্গতা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুর আকর্ষণ মানুষের আল্লাহপ্রাপ্তির পথে বাধা। তাই প্রকৃত আল্লাহপ্রেমিকের জন্য তা শত্রুস্বরূপ।
খ. শয়তান ও অন্যান্য দীনী শত্রু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া।
গ. পাপকর্ম থেকে বাঁচার লক্ষ্যে যদি সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের প্রয়োজন পড়ে, তবে সে জীবনই বেছে নেওয়া উচিত।
ঘ. যে-কোনও বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় আল্লাহর আশ্রয়প্রার্থী হওয়া।
ঙ. সকল প্রয়োজনে আল্লাহর অভিমুখী হওয়াই একজন বান্দার শান।
العزلة এর অর্থ বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা। মানুষকে আল্লাহ তা'আলা সামাজিক জীবরূপে সৃষ্টি করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তাকে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হয়। সে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে পারে না। ইসলাম এক স্বভাবধর্ম। ইসলামের যাবতীয় বিধানে মানুষের এই স্বাভাবিক অবস্থার প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে। তার মৌলিক প্রতিটি বিধানই সমাজঘনিষ্ঠ। সে তার অনুসারীদের সমাজের একজন হয়ে থাকতে উৎসাহ দেয় এবং সকলের ভেতরে থেকেই দীনী দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে রত থাকতে বলে। তবে যদি কখনও এমন কোনও ব্যতিক্রম অবস্থা দেখা দেয়, যখন মিলেমিশে থাকার দ্বারা তার আসল কাজ ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হয়, তখন তাকে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা জরুরিও সাব্যস্ত করা হয়েছে।
সাধারণ অবস্থায় মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দিয়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কারও মতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করাই উত্তম। কেননা তাতে করে যেসব গুনাহ অন্যের দেখাদেখি হয়ে যায়, তা থেকে বাঁচা যায়। তাছাড়া এর দ্বারা নিজ অনিষ্ট থেকেও অন্যের হেফাজত হয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শর্ত হল ইবাদত-বন্দেগী ও দীনের জরুরি বিষয়ে নিজের জানা থাকতে হবে।
কারও মতে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা উত্তম। কেননা এর মধ্যে বহুবিধ ফায়দা রয়েছে। যেমন জুমু'আ ও জামাতে হাজির হতে পারা, মুসলিমদের দল বড় করে দেখানোয় ভূমিকা রাখা, দুস্থ ও বিপন্নের সাহায্য করতে পারা, রোগীর সেবা করতে পারা, জানাযায় শরীক হতে পারা, সালামের রেওয়াজদানে ভূমিকা রাখা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এবং তাকওয়া ও নেকীর কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা করার সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি।
ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন, মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে যার প্রবল ধারণা থাকে যে, সে কোনও গুনাহে লিপ্ত হবে না, তার পক্ষে মিলেমিশে থাকাই উত্তম। আর যার কাছে এটা স্পষ্ট না থাকে, তার জন্য আলাদা থাকাই শ্রেয়।
কারও মতে ব্যক্তিভেদে বিষয়টা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আবার কারও মতে অবস্থাভেদে এর বিধান বিভিন্ন রকম হয়। যার সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ক্ষমতা আছে, তার পক্ষে সকলের সঙ্গে মিলে থাকাই জরুরি। যার সে ক্ষমতা নেই, আবার সকলের মধ্যে থাকার কারণে নিজ আমল নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা নেই, তার পক্ষে সকলের সঙ্গে মিলে থাকা জরুরি না হলেও থাকার অবকাশ আছে। পক্ষান্তরে যার নিজ আমল নষ্ট হওয়ার ভয় আছে, তার জন্য আলাদা থাকাই জরুরি। তবে এ কথা প্রযোজ্য সেই ক্ষেত্রে, যখন ফিতনা-ফাসাদ ব্যাপক না হয়। সুতরাং যদি ব্যাপক ফিতনা দেখা দেয়, তবে নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেওয়া জরুরি। কেননা সেরূপ ক্ষেত্রে অন্যদের প্রভাবে নিজেরও অন্যায়-অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া এরূপ ক্ষেত্রে অন্যায়-অনাচারকারীদের উপর আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে ব্যাপক আযাব আসে, নিরপরাধ ব্যক্তিগণও তার থাবায় পড়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)
‘এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় করো, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখো, আল্লাহর আযাব সুকঠিন।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫)
সে ভয়ের একটা দিক তো হল জালেমদের মধ্যে থাকলে আযাবের মধ্যে পড়ে যাওয়া। তাই তা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনও নিরাপদ স্থানে গিয়ে বাস করা। এর আরেকটা দিক হল যে কারণে আযাব আসে, সে কারণ থেকে আত্মরক্ষা করা। কারণটি হল জালেমদের অবারিতভাবে জুলুম করতে থাকা এবং কারও পক্ষ থেকে তাতে কোনও বাধা না আসা। যারা জালেমকে জুলুম করতে দেখা সত্ত্বেও মুখ বন্ধ করে রাখে, তাকে জুলুম করতে বাধাও দেয় না ও নিষেধও করে না, প্রকারান্তরে তারাও জুলুমবাজির অংশীদার। তাই ব্যাপক আযাবের মধ্যে তারাও পড়ে যায়। এর থেকে মুক্তির উপায় হল জুলুম করতে বাধা দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া।
কিন্তু পরিস্থিতি যদি নাগালের বাইরে চলে যায় এবং অবস্থা এমন কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা হয়তো সম্ভবই নয় কিংবা সম্ভব হলেও তা কোনও কাজে আসে না, উল্টো নিজের ঈমান ও আমলই ঝুঁকিতে পড়ে যায়, তখন নিজ ঈমান ও আমল রক্ষার জন্য যা করা জরুরি তাই করতে হবে। যদি লোকালয় ছেড়ে নির্জন স্থানে যাওয়া ছাড়া উপায় না থাকে, তবে তাই গ্রহণ করে নিতে হবে। আসহাবে কাহফ সেটাই করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলাই তাদেরকে পাহাড়ের গুহায় চলে যাওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ فَأْوُوا إِلَى الْكَهْفِ يَنْشُرْ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيُهَيِّئْ لَكُمْ مِنْ أَمْرِكُمْ مِرْفَقًا (16)
‘(সাথী বন্ধুরা!) তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকেও, তখন চলো, ওই গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য নিজ রহমত বিস্তার করে দেবেন এবং তোমাদের বিষয়টা যাতে সহজ হয় সেই ব্যবস্থা করে দেবেন।(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১৬)
এর দ্বারা বোঝা গেল ক্ষেত্রবিশেষে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করাও জরুরি হয়ে পড়ে। তা জরুরি হয়ে পড়ে বলেই ইসলাম তার অনুমতি দিয়েছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীছে তার প্রমাণ মেলে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছসমূহ সে সম্পর্কেই।
‘যখন মানুষের মধ্যে ব্যাপক অবক্ষয়…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
فَفِرُّوا إِلَى اللَّهِ إِنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مُبِينٌ (50)
অর্থ: সুতরাং ধাবিত হও আল্লাহর দিকে। নিশ্চয়ই আমি তাঁর পক্ষ হতে তোমাদের কাছে এক সুস্পষ্ট সতর্ককারী (হয়ে এসেছি)।(সূরা যারিয়াত (৫১), আয়াত ৫০)
ব্যাখ্যা
فِرُّوا আদেশসূচক ক্রিয়াটির উৎপত্তি اَلْفَرَارُ থেকে। এর অর্থ পলায়ন করা; এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে ও এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে পালানো। এর উদ্দেশ্য হয় ক্ষতি থেকে বাঁচা। দুনিয়ায় মানুষ যা-কিছুকেই নিজ জান- মাল ও ইজ্জতের জন্য ক্ষতিকর মনে করে, তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। দুনিয়ার ক্ষতি অপেক্ষা আখিরাতের ক্ষতি অনেক বড়। সে ক্ষতি থেকে নিজেকে বাঁচানো আরও বেশি জরুরি। আখিরাতের ক্ষতি হয় আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা দ্বারা। সুতরাং যা-কিছু দ্বারা আল্লাহর অবাধ্যতা হয়, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করে তাঁর বাধ্যতামূলক কাজে মশগুল হওয়া অতীব জরুরি। এ আয়াতে আল্লাহর দিকে পালানো ও তাঁর দিকে ধাবিত হওয়া দ্বারা এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা'আলার দিকে পালানোর জন্য প্রথম কাজ হল আল্লাহ তা'আলাকে চেনা এবং আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে নিজ অজ্ঞতা দূর করা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার দিকে পালাতে চায়, তার প্রথম কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে নিজ আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করা। তিনি নিজ গুণাবলি সম্পর্কে আমাদেরকে যতটুকু অবহিত করেছেন তা যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া। তাঁর জগৎপরিচালনা ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা। কুরআন ও হাদীছ দ্বারা আমাদেরকে এসব বিষয় অবগত করা হয়েছে। সুতরাং যাদের পক্ষে সরাসরি কুরআন ও হাদীছ পাঠ করে এসব জানা সম্ভব, তারা তো সরাসরি আর যাদের পক্ষে তা সম্ভব নয় তারা উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে এসব বিষয় জেনে নেবে। এসব বিষয়ে জানার দাবি হল আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের সঙ্গে জীবনযাপন করা। সে লক্ষ্যে প্রত্যেকের কর্তব্য আল্লাহপ্রদত্ত বিধানাবলি সম্পর্কে অবগত হওয়া, যাকে শরী'আত বলা হয়ে থাকে। আকীদা-বিশ্বাস ও শরী'আতের ইলম জানার দ্বারা জ্ঞানগতভাবে আল্লাহ তা'আলার দিকে পলায়ন করা হয়। এটা হল অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের দিকে পলায়ন। পরবর্তী কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের দিকে পলায়ন। অর্থাৎ পাপকর্ম ছেড়ে সৎকর্মে মশগুল হয়ে যাওয়া। এটা সম্ভব হয় শরী'আতের অনুসরণ দ্বারা। যদি শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করা হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে শরী'আতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আল্লাহর দিকে পলায়ন পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ আয়াত আমাদেরকে সে নির্দেশই দান করছে।
সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে যারা উদাসীন, যারা পাপকর্মে ডুবে আছে, এ আয়াত তাদের ডেকে বলছে- তোমরা সতর্ক হও। তোমরা শত্রু দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছ। তোমরা নফসের ধোঁকায় পড়ে রয়েছ। তোমরা শয়তানের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছ। শয়তান তোমাদের চিরশত্রু। সে তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যেতে চায়। তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে হবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাইলে শয়তান থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। তার থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় সেই সত্তার আশ্রয়প্রার্থী হওয়া, যিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান, অমর, অক্ষয় ও জীবন্ত। সকল দাসত্ব ছিঁড়ে সব ভরসা ছেড়ে সেই মহামহিয়ানের দিকে ফিরে এসো। তোমরা তাওবা করো। তাঁর অভিমুখী হও। এ এক মহান পলায়ন। এ পলায়ন অবলম্বন করতে পারলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সত্যিকারের সফলতা লাভ করতে পারবে।
পক্ষান্তরে যদি নফস ও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পাপাচারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা হয়, তবে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনই ধ্বংস হবে। দুনিয়ার কষ্ট না হয় মৃত্যুতে শেষ, কিন্তু আখিরাতের কষ্টের তো কোনও শেষ নেই, সীমা নেই। সেখানে আল্লাহ তা'আলা পাপী বান্দাকে কঠিনভাবে ধরবেন। সে ধরা থেকে নিস্তারলাভের কোনও উপায় সেখানে থাকবে না। তাই এ আয়াতে সেই কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করে দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মাজীদের আয়াত ও নিজ বাণী দ্বারা উম্মতকে বারবার সে সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি ছিলেন এক সুস্পষ্ট সতর্ককারী। প্রত্যেকের কর্তব্য তাঁর সে সতর্কবাণী গ্রহণ করে আত্মসংশোধনে মনোনিবেশ করা এবং কালক্ষেপণ না করে এখনই আল্লাহ তা'আলার অনুগত বান্দারূপে জীবনযাপন শুরু করে দেওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَأَنِيبُوا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنْصَرُونَ (54) وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ (55)
‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হয়ে যাও এবং তাঁর সমীপে আনুগত্য প্রকাশ করো তোমাদের নিকট শাস্তি আসার আগে, যার পর আর তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করো তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না।(সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৪-৫৫)
আল্লাহর দিকে পলায়ন তথা সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর অভিমুখী হওয়ার উপায় দু'টি। এক তো হল সকলের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ হয়ে থাকা। অর্থাৎ সকলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে বাহ্যিক ও শারীরিক। অন্তর সকল থেকে ছিন্ন হয়ে এক আল্লাহতে মগ্ন থাকবে। অন্তর যদি আল্লাহভিন্ন অন্যতে মগ্ন হয়ে যায়, তবে পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাই মানুষের সঙ্গে যতই মেলামেশা করা হোক না কেন, নিজ হৃদয়মনকে কিছুতেই তাদের স্রোতে ভেসে যেতে দেওয়া যাবে না। হৃদয়মন সম্পূর্ণ আল্লাহর অভিমুখী করে রাখতে হবে। মনে থাকবে কেবলই আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহভীতি।
যাদের পক্ষে সকলের ভেতরে থেকে নিঃসঙ্গ থাকা সম্ভব হয় না, শারীরিক মেলামেশা করতে গেলে হৃদয়মনও তাদের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, পরিণামে অন্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা থেকে যায়, তাদের জন্য শারীরিক ও সামাজিকভাবেও নিঃসঙ্গ থাকাই বেশি নিরাপদ। এ আয়াত যে আল্লাহ তা'আলার দিকে পলায়ন করার হুকুম দিয়েছে, তা দ্বারা এ উভয়রকম নিঃসঙ্গতার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাপকর্ম থেকে বাঁচার জন্য যার যেরকম নিঃসঙ্গতা অবলম্বনের প্রয়োজন, তার সেরকম নিঃসঙ্গতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। বলা হচ্ছে, আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করার প্রয়োজনে তোমরা নিঃসঙ্গ জীবন অবলম্বন করো, তা শারীরিক ও আত্মিক উভয়রকম নিঃসঙ্গতা হোক কিংবা কেবলই আত্মিক নিঃসঙ্গতা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুর আকর্ষণ মানুষের আল্লাহপ্রাপ্তির পথে বাধা। তাই প্রকৃত আল্লাহপ্রেমিকের জন্য তা শত্রুস্বরূপ।
খ. শয়তান ও অন্যান্য দীনী শত্রু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া।
গ. পাপকর্ম থেকে বাঁচার লক্ষ্যে যদি সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের প্রয়োজন পড়ে, তবে সে জীবনই বেছে নেওয়া উচিত।
ঘ. যে-কোনও বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় আল্লাহর আশ্রয়প্রার্থী হওয়া।
ঙ. সকল প্রয়োজনে আল্লাহর অভিমুখী হওয়াই একজন বান্দার শান।
আল্লাহ যে বান্দাকে ভালোবাসেন
হাদীছ নং: ৫৯৬
হযরত সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকী (আত্মিক) ঐশ্বর্যবান প্রচারবিমুখ বান্দাকে ভালোবাসেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৯৬৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৪২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৭৩৭; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৬০৫০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯৮৮৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪২২৯)
হাদীছ নং: ৫৯৬
হযরত সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকী (আত্মিক) ঐশ্বর্যবান প্রচারবিমুখ বান্দাকে ভালোবাসেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৯৬৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৪২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৭৩৭; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৬০৫০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯৮৮৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪২২৯)
69 - باب استحباب العزلة عند فساد الناس والزمان أَو الخوف من فتنة في الدين ووقوع في حرام وشبهات ونحوها
قَالَ الله تَعَالَى: {فَفِرُّوا إِلَى اللهِ إنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مبِينٌ} [الذاريات: 50].
قَالَ الله تَعَالَى: {فَفِرُّوا إِلَى اللهِ إنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مبِينٌ} [الذاريات: 50].
596 - وعن سعد بن أَبي وقاص - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ الله يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِيَّ الغَنِيَّ الْخَفِيَّ». رواه مسلم. (1)
والمُرَادُ بـ «الغَنِيّ» غَنِيُّ النَّفْسِ، كَمَا سَبَقَ في الحديث الصحيح.
والمُرَادُ بـ «الغَنِيّ» غَنِيُّ النَّفْسِ، كَمَا سَبَقَ في الحديث الصحيح.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে ৩টি গুণসম্পন্ন বান্দা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে মহব্বত করেন। 'মহব্বত' শব্দের প্রকৃত অর্থ কারও প্রতি মনের ঝোঁক ও আসক্তি। এ অর্থ আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রযোজ্য হয় না। কাজেই আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে যখন শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা রূপক অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আর তা হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক দেওয়া, দয়া ও অনুগ্রহ করা এবং ফিরিশতাদের কাছে প্রশংসা করা। অর্থাৎ যে বান্দার মধ্যে এ গুণগুলো থাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক দান করেন, তার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন এবং ফিরিশতাদের কাছে তার প্রশংসা করেন।
গুণ তিনটির প্রথমটি হল তাকওয়া। আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু আদেশ করেছেন তা যথাযথ পালনের চেষ্টা এবং যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার সাধনাকে তাকওয়া বলা হয়। এরূপ ব্যক্তিকে তাকী ও মুত্তাকী বলা হয়। আল্লাহ তা'আলা মুত্তাকীকে ভালোবাসেন। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৪)
দ্বিতীয় গুণ হল 'গিনা' (ঐশ্বর্য)। হাদীছে 'ঐশ্বর্য' দ্বারা হৃদয়ের ঐশ্বর্য বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثرَةِ الْعَرَضِ، وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ
সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না; মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।(সহীহ বুখারী: ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫১; জামে' তিরমিযী: ২৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩১৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৩৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৪০)
এ গুণ যার মধ্যে থাকে, তাকেই প্রকৃত গনী (ধনী ও ঐশ্বর্যবান) বলা হয়। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। বোঝা গেল যাদের প্রচুর ধন-সম্পদ আছে, কিন্তু তাদের অন্তরে ঐশ্বর্য নেই; বরং আছে সম্পদের মোহ ও লোভ-লালসা, আল্লাহ তা'আলা তাদের পসন্দ করেন না। পক্ষান্তরে গরীব হওয়া সত্ত্বেও যাদের মনে অর্থ-সম্পদের মোহ নেই; বরং যা আছে তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট এবং সেজন্য তারা আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তারা আল্লাহর প্রিয়। অবশ্য ধনী ব্যক্তি যদি হৃদয়ের দিক থেকেও ঐশ্বর্যবান হয়, ধন-সম্পদের কারণে অহমিকা দেখায় না; বরং সেজন্য আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে দান-খয়রাত করে, তবে সে আল্লাহ তা'আলার কাছে অধিকতর প্রিয় হবে বৈ কি।
তৃতীয় গুণ হল প্রচারবিমুখতা, মানুষের কাছে অপরিচিত ও অখ্যাত হয়ে থাকা। অর্থাৎ যারা মানুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে না, নিজ ঈমান-আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যেসব বিষয় ঈমান-আমলের পক্ষে ক্ষতিকর, তা এড়িয়ে চলে, নিজেদের নেক আমলের কথা প্রচার করে বেড়ায় না; বরং সতর্ক থাকে যাতে তা প্রকাশ না পায়, ফলে মুত্তাকী-পরহেযগার ও ইবাদতগুযার হিসেবে লোকসমাজে তাদের খ্যাতি ছড়ায় না, এরূপ লোকদেরকে আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসেন।
এর আরেক অর্থ হতে পারে- যারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের অভাব-অনটনের কথা কারও কাছে প্রকাশ করে না; বরং তা গোপন রাখতে চেষ্টা করে এবং যা চাওয়ার তা কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছেই চায়, কোনও মাখলুকের কাছে নয়, ফলে কেউ তাদের অভাব-অনটন সম্পর্কে জানতে পারে না যে, তাদের কোনওরূপ আর্থিক সাহায্যের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তা'আলা এরূপ লোকদের ভালোবাসেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
খ. আমরা ধনী হই বা গরীব, সর্বাবস্থায় মনের দিক থেকে ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠার সাধনা করতে হবে।
গ. ইবাদত-বন্দেগীতে রিয়া বা লোকদেখানোর মানসিকতা বর্জন করা জরুরি।
ঘ. নিজ ঈমান ও আমলের হেফাজত করার লক্ষ্যে যদি লোকসংসর্গ এড়িয়ে নিভৃত জীবন যাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সেজন্যও প্রস্তুত থাকা চাই।
গুণ তিনটির প্রথমটি হল তাকওয়া। আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু আদেশ করেছেন তা যথাযথ পালনের চেষ্টা এবং যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার সাধনাকে তাকওয়া বলা হয়। এরূপ ব্যক্তিকে তাকী ও মুত্তাকী বলা হয়। আল্লাহ তা'আলা মুত্তাকীকে ভালোবাসেন। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৪)
দ্বিতীয় গুণ হল 'গিনা' (ঐশ্বর্য)। হাদীছে 'ঐশ্বর্য' দ্বারা হৃদয়ের ঐশ্বর্য বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثرَةِ الْعَرَضِ، وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ
সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না; মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।(সহীহ বুখারী: ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫১; জামে' তিরমিযী: ২৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩১৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৩৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৪০)
এ গুণ যার মধ্যে থাকে, তাকেই প্রকৃত গনী (ধনী ও ঐশ্বর্যবান) বলা হয়। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। বোঝা গেল যাদের প্রচুর ধন-সম্পদ আছে, কিন্তু তাদের অন্তরে ঐশ্বর্য নেই; বরং আছে সম্পদের মোহ ও লোভ-লালসা, আল্লাহ তা'আলা তাদের পসন্দ করেন না। পক্ষান্তরে গরীব হওয়া সত্ত্বেও যাদের মনে অর্থ-সম্পদের মোহ নেই; বরং যা আছে তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট এবং সেজন্য তারা আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তারা আল্লাহর প্রিয়। অবশ্য ধনী ব্যক্তি যদি হৃদয়ের দিক থেকেও ঐশ্বর্যবান হয়, ধন-সম্পদের কারণে অহমিকা দেখায় না; বরং সেজন্য আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে দান-খয়রাত করে, তবে সে আল্লাহ তা'আলার কাছে অধিকতর প্রিয় হবে বৈ কি।
তৃতীয় গুণ হল প্রচারবিমুখতা, মানুষের কাছে অপরিচিত ও অখ্যাত হয়ে থাকা। অর্থাৎ যারা মানুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে না, নিজ ঈমান-আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যেসব বিষয় ঈমান-আমলের পক্ষে ক্ষতিকর, তা এড়িয়ে চলে, নিজেদের নেক আমলের কথা প্রচার করে বেড়ায় না; বরং সতর্ক থাকে যাতে তা প্রকাশ না পায়, ফলে মুত্তাকী-পরহেযগার ও ইবাদতগুযার হিসেবে লোকসমাজে তাদের খ্যাতি ছড়ায় না, এরূপ লোকদেরকে আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসেন।
এর আরেক অর্থ হতে পারে- যারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের অভাব-অনটনের কথা কারও কাছে প্রকাশ করে না; বরং তা গোপন রাখতে চেষ্টা করে এবং যা চাওয়ার তা কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছেই চায়, কোনও মাখলুকের কাছে নয়, ফলে কেউ তাদের অভাব-অনটন সম্পর্কে জানতে পারে না যে, তাদের কোনওরূপ আর্থিক সাহায্যের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তা'আলা এরূপ লোকদের ভালোবাসেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
খ. আমরা ধনী হই বা গরীব, সর্বাবস্থায় মনের দিক থেকে ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠার সাধনা করতে হবে।
গ. ইবাদত-বন্দেগীতে রিয়া বা লোকদেখানোর মানসিকতা বর্জন করা জরুরি।
ঘ. নিজ ঈমান ও আমলের হেফাজত করার লক্ষ্যে যদি লোকসংসর্গ এড়িয়ে নিভৃত জীবন যাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সেজন্যও প্রস্তুত থাকা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
