রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৭৩
ভূমিকা অধ্যায়
মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং লম্বা-চওড়া আশা না রাখা
প্রত্যেক প্রাণীই মরণশীল। মৃত্যু বড় কঠিন জিনিস। শরীর ও রূহ একসঙ্গে থাকায় পরস্পরের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উভয়ে মিলে একই বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়। তাই কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু মরণে বিচ্ছেদ অনিবার্য। ফলে দেহ ও রূহ উভয়ের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়। কোনও মানুষ জীবনলাভের পর মৃত্যুতে যে কষ্ট পায়, অতটা কষ্ট এ দুনিয়ায় আর কখনও কোনওকিছুতে পায় না। এ কষ্ট আরও বেড়ে যায় যখন মুমূর্ষু ব্যক্তি উপলব্ধি করে রূহ চলে যাওয়ার পর তার দেহ পচে-গলে যাবে, তা পোকা-মাকড়ের খাদ্যে পরিণত হবে। কষ্ট আরও বাড়ে যখন ভাবে তার রূহের স্থান কোথায় হবে- পাপিষ্ঠদের স্থান জাহান্নামে, না নেককারদের ঠিকানা জান্নাতে। জীবনভর পাপকর্ম করতে থাকলে মৃত্যুর সময় এ ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে যে, হয়তো তার রূহকে জাহান্নামেই নিয়ে যাওয়া হবে। তখন কষ্ট আরও বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে বিখ্যাত তাবি'ঈ রাবী' ইবন খুছায়ম রহ. বলতেন, তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো। কারণ তোমরা এর আগে কখনও এরূপ কঠিন কষ্ট ভোগ করনি।
মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করলে বহুবিধ উপকার পাওয়া যায়। এতে মানুষের লম্বা-চওড়া আশা করার মাত্রা কমে আসে। অতি আশা ভীষণ ক্ষতিকর। তাতে নেক আমলে গড়িমসি করার মনোভাব জন্মায়। আশা পূরণের ব্যতিব্যস্ততা নেক আমলকে পিছিয়ে দেয়। মনে করা হয় এখনই তাড়াহুড়ার কী আছে। সামনে আরও কত সময় রয়েছে। তখন তাওবাতিল্লা করে ঠিক হয়ে যাব। তখন দান-খয়রাত করব, হজ্জ করব এবং পুরোপুরি মুসল্লি-পরহেযগার হয়ে যাব। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য জমিয়ে নিই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। এছাড়া আরও যেসব পরিকল্পনা আছে সেগুলো গুছিয়ে নিই। কিন্তু গোছানো আর হয় না। যত গোছায়, পরিকল্পনাও ততো লম্বা হয়। তাতে নিত্য-নতুন শাখা-প্রশাখা জন্ম নেয়। এভাবে বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার এমন জটাজালে সে জড়িয়ে যায়, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব সহজ হয় না। অপ্রস্তুত অবস্থায়ই মালাকুল মাওত তার প্রাণ সংহার করে নেয়। দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষার এ অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। মৃত্যুর স্মরণ আশা-আকাঙ্ক্ষার রশি টেনে ধরে। অন্তরে অল্পেতুষ্টির সদগুণ জন্ম দেয়। যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে, তার অন্তর থেকে লোভ-লালসা দূর হয়ে যায়। সে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ হয়ে ওঠে। আখিরাতের প্রতি আগ্রহী হয়। তার পক্ষে দুনিয়ার বালা-মসিবত তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় ধন-সম্পদও। ক্ষমতার প্রতিও কোনও আগ্রহ থাকে না। এভাবে অন্তর থেকে অহংকার-অহমিকাও লোপ পেয়ে যায়। মোটকথা মৃত্যুচিন্তা সর্বাংশে কল্যাণই কল্যাণ। তাই কুরআন ও হাদীছে মানুষকে বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে, সে তাগাদাও দেওয়া হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছগুলো সে সম্পর্কেই।
‘মৃত্যুকে স্মরণ করা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (185)
অর্থ: প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তোমাদের সকলকে (তোমাদের কর্মের) পুরোপুরি প্রতিদান কিয়ামতের দিনই দেওয়া হবে। অতঃপর যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম হবে। আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮৫)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হল মৃত্যু। যা-কিছুরই প্রাণ আছে, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। এর থেকে নিস্তার নেই কারও। এ দুনিয়ায় কেউ অনন্তকাল বাঁচে না। না কোনও মানুষ, না অন্য কোনও জীবজন্তু। এটা সর্বাপেক্ষা চরম সত্য। আজ পর্যন্ত কেউ এটা অস্বীকার করতে পারেনি। কেউ অস্বীকার করেও না। সুতরাং মৃত্যু যখন অবধারিত, তখন প্রত্যেকেরই এর জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। নিজের জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার, অন্যের ক্ষেত্রেও মেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই কারও মৃত্যুতে অভিযোগ না তুলে বা হতাশ না হয়ে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং নিজ করণীয় কাজে অবিচল থাকা উচিত।
‘মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে, মৃত্যু যতই স্বাভাবিক হোক না কেন, তার একটা যন্ত্রণা আছে। মৃত্যুকালে সে যন্ত্রণা কিছু না কিছু সকলকেই ভোগ করতে হয়। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। সকল কাজে সে কথা মাথায় রাখা উচিত। তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তারপর কিয়ামত দিবসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। একদিন এ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় তা থাকবে দীর্ঘকাল। তারপর সকলকে পুনর্জীবিত করা হবে। সকল মানুষ আপন আপন স্থান থেকে জীবিত হয়ে বিচারের মাঠে সমবেত হবে। সকলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, তারপর পুনরায় জীবিত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হওয়া- এই সবটার সমষ্টির নাম কিয়ামত। এটা হবেই হবে। এর উপর বিশ্বাস রাখা ফরয। এর সারকথা হল মৃত্যুতেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সমাপ্তি নয় বরং এর পর আরেক জীবন আছে। তার নাম আখিরাত। সেই জীবনে সকলকেই ফিরতে হবে এবং এ জীবনের যাবতীয় কাজ সে জীবনের সফলতার লক্ষ্যেই আঞ্জাম দিতে হবে। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُونِ (56) كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ثُمَّ إِلَيْنَا تُرْجَعُونَ (57)
‘হে আমার মুমিন বান্দাগণ! নিশ্চয়ই আমার ভূমি অতি প্রশস্ত। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো। জীব মাত্রকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তারপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।’(সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৫৬-৫৭)
কিয়ামতের দিন তথা বিচারসভায় প্রত্যেককে আপন আপন কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি ভালো কাজ করেছে, সেদিন সে ভালো ফল পাবে। যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করেছে, সে পাবে মন্দ ফল। আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। সেদিন কারও প্রতি কোনও অন্যায় করা হবে না। এটা সুস্পষ্ট করার জন্য আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে তার ভেতর আপন আপন কাজের পূর্ণ বিবরণ দেখতে পাবে। ছোটবড় যাই করেছে, তার কোনওটারই অনুল্লেখ পাবে না। যে যা করেছে, সে সম্পর্কে সাক্ষীও পেশ করা হবে। সে সাক্ষীদের মধ্যে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও থাকবে। প্রত্যেক অঙ্গ সাক্ষ্য দেবে তাকে দিয়ে কি কি কাজ করানো হয়েছে। তদুপরি আমলের ওজন করা হবে। দেখা হবে কার নেক আমলের ওজন বেশি, কার ওজন বেশি বদ আমলের। যার যে আমলের ওজন বেশি হবে, সেই অনুযায়ী ফয়সালা হবে।
কর্মের পুরোপুরি প্রতিফল যেহেতু আখিরাতেই দেওয়া হবে, তাই ইহজগতে তা দেখার আশা বৃথা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মন্দকাজ করে, তাকে দুনিয়ায় শাস্তি পেতে না দেখায় এ কথা মনে করা ঠিক না যে, সে বেঁচে গেল। তার শাস্তি আখিরাতের জন্য জমা রাখা হয়েছে। সেখানে তাকে তা ভোগ করতে হবে। তাই পাপকর্ম সত্ত্বেও আরামে জীবন কাটতে থাকলে তার নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়; বরং আখিরাতে কঠিন শাস্তিভোগের ভয়ে নিজেকে সংশোধন করে ফেলা উচিত। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ভালো কাজ করে, তাকে সুফল পেতে না দেখে এ কথা মনে করা ভুল যে, তার চেষ্টা বৃথা গেল। তার তো আখিরাতই লক্ষ্যবস্তু। তাই সে দুনিয়ায় বিনিময়লাভের আশাই করবে না। সে তার নেককাজ দ্বারা জাহান্নাম থেকে বাঁচা ও জান্নাতলাভের প্রত্যাশায় থাকবে।
আয়াতে তারপর জান্নাত ও জাহান্নামের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাত মুমিনদের ঠিকানা। জাহান্নাম কাফের ও ফাসেকদের। যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে জান্নাত লাভ করবে। যার বদ আমলের ওজন বেশি হবে, সে জাহান্নামে যাবে। শেষগতি যদি হয় জাহান্নাম, তবে তা মানবজীবনের চরম ব্যর্থতা। সফল সেই ব্যক্তি, যে জান্নাত লাভ করবে। আয়াতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, তোমরা জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে যাতে জান্নাতবাসী হতে পার আর এভাবে মানব হয়ে জন্মানোকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পার, সেটাকেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নাও এবং সে লক্ষ্যবস্তু সামনে রেখেই ইহজীবন নির্বাহ করো।
সবশেষে সতর্ক করা হয়েছে, পার্থিব জীবনের ধোঁকা ও প্রতারণা সম্পর্কে। অর্থাৎ ইহজীবন নির্বাহের লক্ষ্যবস্তু তো থাকবে পরকালীন জীবনের সফলতা লাভ। তবে সেই লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হতে হলে সতর্কতা অবলম্বন খুব জরুরি। কেননা দুনিয়া বড় প্রতারণাময়। এর সবকিছুতে প্রচণ্ড আকর্ষণ। এর প্রতিটি বস্তু আখিরাত ভুলিয়ে মানুষকে নিজের মধ্যে লিপ্ত রাখতে চায়। এর প্রতিটি বস্তু বড় আকর্ষণীয়রূপে মানুষকে হাতছানি দেয়। সে হাতছানি যে উপেক্ষা করতে পারে, কেবল সেই পরকালীন সফলতা লাভের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে। তা উপেক্ষা করা সহজ হয় মন ও মস্তিষ্কে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত রাখার দ্বারা। তাই এ আয়াত মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং তাকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন কোনও অবস্থায়ই সে তার এ অবধারিত পরিণতির কথা ভুলে না যায়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. মৃত্যু প্রত্যেক প্রাণীর অবধারিত পরিণতি। কোনও অবস্থায়ই এ কথা ভুলতে নেই।
খ. মৃত্যু বড় যন্ত্রণাময় ও এক কঠিন পরীক্ষা। তখন যাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়, জীবনের যাবতীয় কাজে সে আশার স্পর্শ থাকা উচিত।
গ. কিয়ামত সত্য। এ বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ।
ঘ. কিয়ামতে মানুষের ইহজীবনের যাবতীয় কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।
ঙ. কর্মফল ভোগের আসল জায়গা যেহেতু আখিরাত, তাই দুনিয়ায় পাপীকে পাপের শাস্তি ভোগ করতে না দেখলে মনে করা উচিত নয় সে বেঁচে গেল।
চ. নেককার ব্যক্তিকে দুনিয়ায় তার নেককাজের সুফল পেতে না দেখলে ভাবা উচিত নয় তার কর্ম বৃথা গেল।
ছ. পরকালের প্রতিদান লাভ করাই হওয়া উচিত যাবতীয় নেককাজের লক্ষ্যবস্তু।
জ. জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য। জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে জান্নাত লাভ করতে পারাই মানবজীবনের সফলতা।
ঝ. ইহজীবন বড় প্রতারণাময়। এর মোহে পড়তে নেই।
দুই নং আয়াত
وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ
অর্থ : কোনও প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনও প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এটা সূরা লুকমানের সর্বশেষ আয়াতের একটি অংশ। এ আয়াতে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তার প্রকৃত ও পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ (34)
‘নিশ্চয়ই কিয়ামত (-এর ক্ষণ) সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে আছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কী আছে। কোনও প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনও প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত, সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ খবর রাখেন।’
প্রথমে বলা হয়েছে, কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ সম্পর্কে কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন, অন্য কেউ জানে না। কিয়ামত হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কবে হবে, সেই জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা নিজের কাছে গোপন রেখেছেন। তবে তিনি তার কিছু আলামত বলে দিয়েছেন। সে আলামতগুলো প্রকাশ পেতে থাকলে মনে করতে হবে কিয়ামত দিন দিন কাছে আসছে। কিয়ামতের একটি আলামত সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন। তাঁর পর আর কোনও নবী আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর নিয়ে আসা দীনই কার্যকর থাকবে। সুতরাং এ উম্মতই সর্বশেষ উম্মত এবং এর পরে কিয়ামত। যত দিন যেতে থাকবে, ততোই এক এক করে কিয়ামতের নানা আলামত প্রকাশ পেতে থাকবে। সর্বশেষ বড় বড় আলামতগুলোর মধ্যে রয়েছে ইমাম মাহদীর আগমন, আসমান থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দুনিয়ায় নেমে আসা, দাজ্জালের আবির্ভাব, ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব, সবশেষে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা। তারপর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারপর কিয়ামত সংঘটিত হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হল বৃষ্টিবর্ষণ। বৃষ্টি মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি‘আমত। এর দ্বারা মানুষ বহুবিধ উপকার লাভ করে। কোথায় কখন কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বিভিন্ন আলামত দেখে মানুষ এ সম্পর্কে কিছুটা অনুমানমাত্র করতে পারে। কিন্তু পরিপূর্ণ জ্ঞান কেউই লাভ করতে পারে না। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে যা ধারণা হয় তা অনুমানমাত্র, নিশ্চিতসত্য নয়। অনেক সময়ই তা ভুলও প্রমাণিত হয়। সঠিক হলেও ঠিক কতক্ষণ কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা আগেভাগে কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। তা জানেন কেবলই আল্লাহ তা'আলা।
তৃতীয় বিষয় হল মাতৃগর্ভে কী আছে? যা আছে তা পূর্ণ আকৃতির মানবশিশুরূপে দুনিয়ায় আগমন করবে, নাকি আগেই ঝরে পড়বে? তার রং ও রূপ কী হবে? তার শারীরিক শক্তি কেমন হবে? মেধা ও মননশীলতা কী মানের হবে? লম্বা হবে না খাটো? কী আয়ু লাভ করবে? সৎকর্মশীল হবে না পাপী? তার পেশা হবে কী? এরকম আরও কত কী প্রশ্ন! এই যাবতীয় বিষয় গর্ভস্থ ভ্রুণের মধ্যে নিহিত আছে। এমনকি তা লুক্কায়িত রয়েছে গর্ভাশয়ে স্থিত মিশ্র এক বিন্দুর মধ্যে। আল্লাহ ছাড়া এসব বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান আর কার আছে? কোনও একটি শিশুর নয়; বরং জগতে যত মানবশিশু এসেছে ও আসবে, তাদের সকলের এ যাবতীয় বিষয় আল্লাহ তা'আলার জ্ঞানে পরিপূর্ণরূপে অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান। অপরদিকে কোনও একটি শিশু সম্পর্কেও এই যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান কোনও একজন মাখলুকেরও নেই।
চতুর্থত বলা হয়েছে- وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا (কোনও প্রাণী জানে না আগামীকাল সে কী করবে)। একজন মানুষ প্রতিদিন কত রকম কাজ করে থাকে! একেক অঙ্গের কত বিচিত্র ব্যবহার সে করে! চোখ দিয়ে কত দেখা, কান দিয়ে কত শোনা, মুখের কত বলা, হাতের কত স্পর্শ, পায়ের কত চলা, রয়েছে পেশাগত কাজ, সে কাজের পরিমাণ-পরিমাপ, সময়-স্থান, ধরন-প্রকৃতি, আছে আকস্মিক এসে পড়া কাজ, যা কল্পনায়ও থাকে না, আছে করণীয় কাজ, আছে বর্জনীয় কাজ, বহু বৈচিত্র্যের সমাহারে ঠাসা যে কাজের ফিরিস্তি, সে সম্পর্কে পুরোপুরি তো দূরের কথা, এক-শতাংশও কি আগাম কারও জানা থাকে? কিন্তু মহান আল্লাহ কেবল প্রত্যেকের নয়; সমস্ত সৃষ্টির যাবতীয় কাজ সম্পর্কে আগাম সবকিছু জানেন। সেই অনাদিকাল থেকেই তিনি জানেন কোন গাছের কোন পাতাটি ঠিক কখন ঝরে পড়বে। আল্লাহু আকবার! কী বিপুল ও কী অসীম তাঁর জ্ঞান!
সবশেষে আছে- وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ (কেউ জানে না সে কোন ভূমিতে মারা যাবে)। যেমন জানে না কোথায় মারা যাবে, তেমনি কখন মারা যাবে তাও তার অজানা। ভাবে মারা যাবে এক জায়গায়, কিন্তু সকল ভাবনা-কল্পনা মিথ্যা প্রমাণ করে মারা যায় অন্য কোথাও। এটা যেমন নিজের বেলায় সত্য, তেমনি সত্য অন্যের বেলায়ও। কারও মৃত্যুর স্থান-কাল সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আগাম কেউ কিছুই বলতে পারে না। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার ঘটনা আছে। ঘটনা তো আছে হাজারও। তবে আব্বাসীয় যুগের দুর্দান্ত খলীফা আবূ জা'ফর মানসূরের বড় আগ্রহ ছিল- যদি জানতে পারতেন ঠিক কবে তিনি মারা যাবেন! একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন সাগর থেকে কোনও এক ছায়ামূর্তি হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে কী ইশারা করছে। পরের দিন তিনি বিজ্ঞজনদের কাছে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলেন। কেউ বলল, এর দ্বারা পাঁচ বছর বোঝানো হয়েছে। কেউ বলল, পাঁচ মাস। কেউ বলল, পাঁচ দিন। নানা জনে নানা কথা বলল। কিন্তু খলীফা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, ইমাম আবূ হানীফা রহ.- কে। তিনি বললেন, এর দ্বারা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। অর্থাৎ আপনি কবে মারা যাবেন তা এ পাঁচটি বিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। কেউ আগাম তা বলতে পারবে না।
হযরত আবূ আযযাহ (ইয়াসার ইবন আব্দ) হুযালী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِذَا قَضَى اللَّهُ لِعَبْد أَنْ يَمُوْتَ بِأَرْضِ جَعَلَ لَهُ إِلَيْهَا حَاجَةً، أَوْ قَالَ: بِهَا حَاجَةً
‘আল্লাহ তা'আলা যে বান্দার মৃত্যু যে স্থানে নির্ধারণ করে রাখেন, সে স্থানে তার কোনও প্রয়োজন দাঁড় করিয়ে দেন (ফলে সেখানে সে পৌঁছে যায়, আর তখন তার জান কবজ করে নেওয়া হয়)।(জামে তিরমিযী: ২১৪৭; মুসনাদুল বাযযার: ১৮৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ৭০৬; হাকিম, আল মুসতাদরাক: ১২৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৪২৪)
প্রকাশ থাকে যে, যেসকল বিষয় কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন, অন্য কেউ জানে না, তা এ পাঁচটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও আছে। যেমন আল্লাহ তা'আলার ফিরিশতার সংখ্যা কত, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
‘তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।’( সূরা মুদ্দাচ্ছির (৭৪), আয়াত ৩১)
সূরা লুকমানের আলোচ্য আয়াতে বিশেষভাবে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে শানে নুযূলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ পাঁচটি বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, আমার স্ত্রী গর্ভবতী। আপনি বলুন সে কী সন্তান জন্ম দেবে? আমাদের এলাকায় খরা চলছে। বলুন কখন বৃষ্টি হবে? আমি কবে জন্ম নিয়েছি তা তো জানি। আপনি বলুন কবে মারা যাব? আজ আমি কী করেছি তা আমার জানা আছে। আপনি বলুন আগামীকাল কী করব? আর বলুন কিয়ামত কবে হবে? সে পরিপ্রেক্ষিতেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট তারিখ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
খ. কোথায় কখন কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তার পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে।
গ. গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আল্লাহ তা'আলারই আছে। মানুষ যা জানতে পারে তা আংশিক জ্ঞান বা অনুমান মাত্র।
ঘ. আগামীকাল কে কী করতে পারবে, তা আগাম কেউ বলতে পারে না।
ঙ. কে কখন কোথায় মারা যাবে, কারও পক্ষেই তা আগাম বলা সম্ভব নয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান অসীম। আপন সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণরূপে জানা আছে। খুঁটিনাটি কোনওকিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।
তিন নং আয়াত
فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ (61)
অর্থ: তারপর যখন তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে পড়বে, তখন তারা মুহূর্তকালও পেছনে যেতে পারে না এবং সামনেও যেতে পারে না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৬১)
ব্যাখ্যা
এ আয়াত জানাচ্ছে, প্রত্যেকের আয়ু নির্ধারিত। আয়ু ফুরালে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুর সে নির্ধারিত ক্ষণ কেউ টলাতে পারে না। এক মুহূর্ত আগেও আনতে পারে না, এক মুহূর্ত পেছাতেও পারে না। সুতরাং প্রত্যেকের মৃত্যু তার নির্ধারিত সময়েই হয়ে থাকে, তা দুর্ঘটনায় মারা যাক কিংবা কারও হাতে নিহত হোক। যে ব্যক্তি কারও হাতে নিহত হয়, তার মৃত্যু আগে হয়ে যায় এমন নয়। স্বাভাবিক সময়েই হয়। ঘাতককে যে দায়ী করা হয় এবং এজন্য তাকে শাস্তিও দেওয়া হয় তা এ কারণে নয় যে, সে নির্ধারিত সময়ের আগে তার মৃত্যু ঘটিয়েছে। সে হত্যা না করলেও ওই সময়ে তার মৃত্যু হতোই। তার শাস্তি এ কারণে যে, সে তার উপর সীমালঙ্ঘন করল কেন? সে তার উপর প্রাণঘাতী হামলা কেন চালাল, যা কিনা তার জন্য জায়েয ছিল না?
আয়াতটি দ্বারা বোঝা যায় কারও আয়ু বাড়েও না কমেও না। এর উপর প্রশ্ন আসে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও তো জানা যায় বিশেষ আমল দ্বারা আয়ু বাড়ে, যেমন আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, পিতা-মাতার সেবাযত্ন ইত্যাদি, এর উত্তর কী?
এর উত্তর হচ্ছে, আয়ু বাড়া দ্বারা আয়ুতে বরকত হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সেবাযত্ন করবে, আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, আল্লাহ তা'আলা তার আয়ুতে বরকত দেবেন। সে তার নির্ধারিত আয়ুতে এত বেশি কাজ করতে পারবে, যা অন্যরা অনেক বেশি দীর্ঘ আয়ুতেও করতে পারে না।
অনেক আলেম এরকম উত্তরও দিয়েছেন যে, আয়ু বাড়া-কমার বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান হিসেবে নয়; বরং ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসেবে হয়ে থাকে। অর্থাৎ কার মৃত্যু ঠিক কখন হবে তার চূড়ান্ত জ্ঞান আল্লাহ তা'আলারই আছে। সংশ্লিষ্ট ফিরিশতাদেরও এ সম্পর্কে একটা জ্ঞান আছে। তবে তা চূড়ান্ত জ্ঞান নয়। তাদেরকে এভাবে জানিয়ে রাখা হয়েছে যে, অমুক বান্দার আয়ু এত বছর। যদি সে এই এই কাজ করে, তবে তার আয়ু এত বছর বাড়বে। যদি না করে, তবে এরকমই থাকবে। কিন্তু সে তা করবে কি করবে না, তা আল্লাহ তা'আলারই জানা আছে, অন্য কারও নয়। যখন সে ওই কাজটি করে, তখন তার আয়ু বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ বাড়াটা হয় ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসেবে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তো জানেন যে, এ কাজটি সে করবে এবং তার আয়ু হবে এই। তাঁর হিসেবে কিছুই বাড়ল না। সে কথাই আয়াতে বলা হয়েছে যে, কারও আয়ু নির্ধারিত সময় থেকে কিছু বাড়ে-কমে না। আর হাদীছে যে বাড়া-কমার কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহর জ্ঞান হিসাবে নয়; ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসাবে।
আয়াতটির শিক্ষা
প্রত্যেকের মৃত্যুর একটা নির্ধারিত সময় আছে। সেই নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু হবেই হবে। আগে বা পরে হবে না। কিন্তু তা ঠিক কখন হবে তা কেউ জানে না। সুতরাং প্রত্যেকের প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (9) وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ (10) وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (11)
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এরকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় করো, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। যখন কারও নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত।(সূরা মুনাফিকুন (৬৩), আয়াত ৯-১১)
ব্যাখ্যা
এগুলো সূরা মুনাফিকূনের শেষ তিন আয়াত। এ সূরায় মুনাফিকের স্বভাব বর্ণিত হয়েছে। পরিশেষে মুমিনদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, তারা যেন মুনাফিকদের মতো না হয়। মুনাফিকরা শরী'আতের হুকুমের উপর সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের আসক্তিকে প্রাধান্য দিত। আল্লাহর হুকুম পালনে গড়িমসি করত। কিন্তু পার্থিব কোনও ক্ষতি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের লক্ষ্য করে বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ (হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির খাতিরে নামায আদায়ে গাফলতি করো না। হজ্জ করতে গড়িমসি করো না। যাকাত দিতে টালবাহানা করো না। মোটকথা আল্লাহ তা'আলার কোনও আদেশ-নিষেধ পালনে সন্তান-সন্ততি ও মালের মহব্বত যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থেকো। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (14) إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ (15)
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। যদি তোমরা মার্জনা কর ও উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহরই কাছে আছে মহা প্রতিদান।(সূরা তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৪-১৫)
অর্থাৎ স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। দেখা হয় মানুষ এসবের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায় কি না। অন্ধ হওয়ার মানে বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলা, ফ লে শরী‘আতের উপর এদের ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এরূপ হলে সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী, অর্থ-সম্পদ মানুষের পক্ষে শত্রুতুল্য হয়ে যায়। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে তাদের কারণে দীন ও ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিণামে আখিরাতের জীবন ধ্বংস হয়। কোনও কোনও স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দীনদার না হওয়ায় দীন ও ঈমানের ক্ষতিতে সক্রিয় ভূমিকাও রাখে। তাই তাদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অবশ্য সব স্ত্রী ও সকল সন্তান-সন্ততিই এ রকম নয়। এমন বহু নারী আছে, যারা তাদের স্বামীদের দীন ও ঈমান হেফাজত করে এবং নেককাজে তাদের সৎ পরামর্শক ও উত্তম সহযোগী হয়। এমনিভাবে অনেক সৌভাগ্যবান সন্তানও আছে, যারা তাদের পিতা-মাতার দীন ও ঈমানের উন্নতির কারণ হয় এবং তাদের জন্য হয়ে থাকে ‘সদাকায়ে জারিয়া’স্বরূপ।
وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘যারা এরকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে( তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত'। অর্থাৎ যারা সন্তান-সন্ততি ও অর্থ-সম্পদের মোহে আল্লাহর আনুগত্য ভুলে যাবে, আর এভাবে আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেবে ও নশ্বর জগতের ভোগ-উপভোগে লিপ্ত হয়ে অনন্ত স্থায়ী জগতের অকল্পনীয় নি'আমত হাতছাড়া করবে, তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাতে তাদের অর্থ-সম্পদ যত বিপুলই হোক এবং সন্তান- সন্ততির সংখ্যা যত বেশিই হোক আর তারা যত খ্যাতিমানই হোক। কেননা মানবজীবনের সফলতা ধনবান হতে পারার মধ্যেও নয় এবং ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠালাভের মধ্যেও নয়। মানবজীবনের সফলতা হল আখিরাতের নাজাত ও মুক্তিলাভের ভেতর। তা যদি লাভ না হয়, তবে সবকিছুই কেবল ক্ষতিই ক্ষতি। সুতরাং হে মুমিনগণ সতর্ক থেকো, তোমরা যেন সেই ক্ষতির মধ্যে পড়ে না যাও। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় কী? পরের আয়াতে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে-
وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ ‘আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় করো, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে'। অর্থাৎ মৃত্যুর আলামত শুরু হয়ে যাওয়ার আগে আগেই আমার দেওয়া জীবিকা থেকে আমার পথে ব্যয় করো। তোমাদের ধন-সম্পদ তো আমারই দেওয়া। আমি তা এজন্য দিইনি যে, তোমরা তার মোহে পড়ে যাবে, তা দ্বারা বিলাসিতা করবে এবং তার সঞ্চয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। বরং দিয়েছি এজন্য যে, আমার দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক সঠিক খাতে খরচ করবে এবং তা দ্বারা কে কতবেশি ছাওয়াব হাসিল করতে পার, পরস্পরে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে। সুতরাং তোমরা তা-ই করতে থাকো। গড়িমসি করো না। যে-কোনওদিন মৃত্যু এসে পড়বে। কবে আসবে তা কেউ জানে না। তাই আগে আগেই আল্লাহর পথে খরচ করে তা দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় করতে থাকো। মৃত্যু এসে গেলে তখন কেবল আক্ষেপই করতে পারবে। কিন্তু সে আপেক্ষ কোনও কাজে আসবে না। তখন আল্লাহকে ডেকে সময় চাবে আর বলবে, একটু সময় পেলে আমি তোমার পথে দান-খয়রাত করব এবং নেককার লোকদের মতো কাজকর্ম করে আমিও তাদের একজন হয়ে যাব। কিন্তু আল্লাহর বিধান অটল।তিনি যার জন্য মৃত্যুর যে সময় নির্দিষ্ট করে রখেছেন, তার কোন ব্যতিক্রম হবে না। ফলে আক্ষেপ নিয়েই তোমাদের কবরে যেতে হবে। তারচে' এখনই সাবধান হও এবং সমস্ত উদাসীনতা পরিত্যাগ করে আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয়ে সচেষ্ট হও।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে পড়ে আল্লাহর আনুগত্যে অবহেলা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
খ. অর্থের প্রাচুর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রতিষ্ঠালাভের মধ্যে কোনও সফলতা নেই, যদি না তা দীনী উন্নতিলাভে সহায়ক হয়।
গ. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে আল্লাহর আনুগত্যে অবহেলার করতে নেই। কেননা তা মানবজীবনের চরম ক্ষতি বয়ে আনে।
ঘ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতসমূহে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে হবে এখনই। ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা যাবে না।
ঙ. মৃত্যু যে-কোনও সময় হাজির হয়ে যেতে পারে। তাই আখিরাতের জন্য যা-কিছু করার তা করতে হবে এখনই।
চ. আল্লাহর পথে খরচ করাসহ যে-কোনও দীনী কাজে বিলম্ব করলে তা মৃত্যুকালে আক্ষেপের কারণ হবে।
ছ. মৃত্যু তার নির্ধারিত সময়ে হবেই। কোনওরূপ আবেদন-নিবেদনে তা পেছাবে না।
পাঁচ নং আয়াত
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ (99) لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ (100) فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (101) فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (102) وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (103) تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ (104) أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ (105) قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ (106) رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ (107) قَالَ اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ (108) إِنَّهُ كَانَ فَرِيقٌ مِنْ عِبَادِي يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ (109) فَاتَّخَذْتُمُوهُمْ سِخْرِيًّا حَتَّى أَنْسَوْكُمْ ذِكْرِي وَكُنْتُمْ مِنْهُمْ تَضْحَكُونَ (110) إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (111) قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (112) قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ (113) قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (114) أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (115)
অর্থ : পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে,হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ওয়াপেস পাঠিয়ে দিন, যাতে আমি যা (অর্থাৎ যে দুনিয়া) ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে সৎকাজ করতে পারি। কখনও না। এটা একটা কথার কথা, যা সে মুখে বলছে মাত্র। তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে ‘বরযখ’, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে। আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে। (তাদেরকে বলা হবে) তোমাদেরকে কি আমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো হতো না? কিন্তু তোমরা তা অবিশ্বাস করতে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব। আল্লাহ বলবেন, এরই মধ্যে তোমরা হীন অবস্থায় পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না। আমার বান্দাদের একটি দল দু'আ করত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। তোমরা তখন তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিলে। এমনকি তা (অর্থাৎ তাদেরকে উত্ত্যক্তকরণ) তোমাদেরকে আমার স্মরণ পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তোমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতে। তারা যে সবর করেছিল সে কারণে আজ আমি তাদেরকে এমন প্রতিদান দিলাম যে, তারাই হয়ে গেল কৃতকার্য। (তারপর) আল্লাহ (জাহান্নামীদেরকে) বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছ? তারা বলবে, আমরা এক দিন বা এক দিনেরও কম থেকেছি। (আমাদের ভালো মনে নেই) কাজেই যারা (সময়) গুনেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন। আল্লাহ বলবেন, তোমরা অল্পকালই থেকেছিলে। কতইনা ভালো হতো যদি এ বিষয়টা তোমরা (আগেই) বুঝতে! তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না?(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৯-১১৫)
ব্যাখ্যা
এখানে সূরা মুমিনূনের ৯৯ থেকে ১১৫ পর্যন্ত মোট ১৭টি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মৃত্যুকালীন অবস্থা, বরযখের বর্ণনা, কিয়ামতের পরিস্থিতি, মীযানে আমল ওজন করার বর্ণনা, জাহান্নামের বিভীষিকাময় শাস্তির বিবরণ, জাহান্নামে জাহান্নামীদের আক্ষেপ ও সেখান থেকে তাদের মুক্তিদানের আবেদন এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার উত্তর ও তাদের কৃতকর্মের জন্য তিরস্কার প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা। সর্বপ্রথম মৃত্যুকালে পাপীগণ আক্ষেপ করে যা বলবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ (পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ওয়াপস পাঠিয়ে দিন)। এ বাক্যটির সম্পর্ক এর আগের ৯০ বা ৯১ নং আয়াতের সঙ্গে। তাতে বলা হয়েছিল, অবিশ্বাসীগণ অনবরত সত্য অস্বীকার করে ও মিথ্যাচার করে এবং তারা আল্লাহ সম্পর্কে নানা অবান্তর ও অসত্য কথাবার্তা বলে। তারা তা থেকে কোনওক্রমেই ক্ষান্ত হয় না। সারাটা জীবন এভাবে অবাধ্যতার মধ্যে কাটিয়ে দেয়। তারপর এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, মৃত্যুর ফিরিশতাদের দেখতে পায় এবং কঠিন মৃত্যুযন্ত্রণার সম্মুখীন হয়, তখন তাদের হুঁশ হয়। তখন বুঝতে পারে নবী- রাসূলগণ যা বলেছেন তাই সত্য। সে সত্য অস্বীকার করে তারা চরম ভুল করেছে। তখন তারা সে ভুলের প্রতিকার করার পথ খোঁজে। তাই আল্লাহ তা'আলার কাছে আবেদন জানায় যে, আমাকে ফিরিয়ে দিন। আমার মৃত্যু পিছিয়ে দিন। শেষবারের মতো সুযোগ দিন।
لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ ‘যাতে আমি যা (অর্থাৎ যে দুনিয়া) ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে সৎকাজ করতে পারি'। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আমি যে ঈমান ও সৎকর্ম পরিত্যাগ করেছি, যাতে তা অবলম্বন করতে পারি। অর্থাৎ সময় দিলে আমি ঈমান আনব এবং সৎকর্ম করব। আরেক অর্থ হতে পারে- আমি দুনিয়ায় যে সম্পদ ছেড়ে এসেছি, যা আমি আপনার মর্জি মোতাবেক খরচ করিনি এবং তা দ্বারা কোনও পুণ্য কামাই করিনি, এবার সময় পেলে আমি সে সম্পদ দ্বারা সৎকাজ করব। তা আপনার সন্তুষ্টির পথে খরচ করব। মোটকথা মৃত্যু অবস্থা দেখে পাপী ব্যক্তি তার পরবর্তী অশুভ পরিণাম আঁচ করতে পারে। তাই সে মৃত্যু থেকে বাঁচতে চায়। সামনে অগ্রসর হতে চায় না। পেছনের জীবনে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মুমিনদের অবস্থা হয় এর বিপরীত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ أَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ، وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللَّهِ كَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ» قَالَتْ عَائِشَةُ أَوْ بَعْضُ أَزْوَاجِهِ: إِنَّا لَنَكْرَهُ المَوْتَ، قَالَ: «لَيْسَ ذَاكِ، وَلَكِنَّ المُؤْمِنَ إِذَا حَضَرَهُ المَوْتُ بُشِّرَ بِرِضْوَانِ اللَّهِ وَكَرَامَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ، فَأَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ وَأَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ، وَإِنَّ الكَافِرَ إِذَا حُضِرَ بُشِّرَ بِعَذَابِ اللَّهِ وَعُقُوبَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَكْرَهَ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ، كَرِهَ لِقَاءَ اللَّهِ وَكَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ»
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করে, আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করে, আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করেন। এ সময় উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্য কোনও স্ত্রী বলে ওঠেন, আমরা তো অবশ্যই মৃত্যুকে অপসন্দ করি (তাহলে তো আল্লাহও আমাদের সাক্ষাৎকে অপসন্দ করে থাকবেন)! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বিষয়টা তা নয়। বস্তুত যখন কোনও মুমিনের মৃত্যু হাজির হয়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর পক্ষ থেকে সম্মান দেওয়ার সুসংবাদ শোনানো হয়। তখন তার কাছে তার সামনে যা আছে (মৃত্যু ও তার পরবর্তী ধাপসমূহ) তার চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছু হয় না। তখন সে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে পসন্দ করে। আর আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে পসন্দ করেন। অপরদিকে যখন কোনও কাফের ব্যক্তির মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর আযাব ও অশুভ পরিণামের সংবাদ দেওয়া হয়। তখন তার কাছে তার সামনে যা-কিছু আছে তারচে' বেশি অপসন্দনীয় আর কিছুই থাকে না। ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করে এবং আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করেন।’(সহীহ বুখারী: ৬৫০৭; সহীহ মুসলিম: ২৬৮৩; জামে' তিরমিযী : ২৩০৯; সুনানে নাসাঈ : ১৮৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৪৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০০৯)
কাফেরগণ যখন উল্লিখিত ফরিয়াদ করবে, তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হবে-كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا (কখনও না। এটা একটা কথার কথা, যা সে মুখে বলছে মাত্র)। অর্থাৎ তারা শাস্তির ভয়ে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে ফরিয়াদ করে যে বলবে 'আমাকে ফিরিয়ে দিন, আমি সৎকর্ম করব', এটা কখনও ঘটার নয়। কেননা মৃত্যুর যে সময় নির্ধারিত করা আছে তা কিছুতেই টলার নয় এবং মৃত্যুর পর দুনিয়ায় ফিরে আসারও কোনও অবকাশ নেই। আর তারা যে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা বলছে, তাও সত্য নয়। সারকথা এটা তাদের একটা কথা মাত্র, যা কোনওভাবেই পূর্ণ হওয়ার নয়।
وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে ‘বরযখ’, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে'। ‘বরযখ’ বলা হয় কবরকে। কারও মতে মৃত্যু হতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়কে। উভয় মতের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। বোঝানো উদ্দেশ্য তারা যে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে, এটা ঘটবেই এবং এর পর পুনরুত্থান দিবস তথা কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে কবরেই অবস্থান করতে হবে। সেখান থেকে দুনিয়ায় ফিরে আসার কোনও অবকাশ নেই। এ বরযখের জগৎও বড় কঠিন। সেখানে ইহজগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। আবার আখিরাতের আযাবেরও কিছু নমুনা সেখানে প্রকাশ পায়। পুনরুত্থান না হওয়া পর্যন্ত সে আযাবের মধ্যেই কাটাতে হবে। এখন এ মৃত্যুতেই তোমরা এমন ঘাবড়াচ্ছ। তাহলে সেই বরযখের জগতে তোমাদের কেমন অবস্থা হবে? তারপর সেখান থেকে জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে। সেখানকার পরিস্থিতি আরও কঠিন। ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (অতঃপর যখন সিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এর ব্যাখ্যা করেন যে, আখিরাতে মানুষ বংশ-গোত্র নিয়ে গৌরব করবে না, যেমন দুনিয়ায় করে থাকে। এবং সেখানে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করবে না যে, তুমি কোন গোত্রের, তোমার বংশতালিকা কী, যেমন দুনিয়ায় জিজ্ঞেস করে থাকে। কিয়ামত বড় বিভীষিকাময়। সে বিভীষিকা মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে। হযরত ইবন আব্বাস রাযি. আরও বলেন, এটা শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সময়কার কথা। সে ফুৎকারে মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সকলেই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। আল্লাহ তা'আলা যাকে চান কেবল সেই ব্যতিক্রম থাকবে। তারপর শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে আপন স্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যাবে এবং হয়রান হয়ে তাকিয়ে থাকবে। সে সময় সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (27)
‘তারা একে অন্যের অভিমুখী হয়ে পরস্পরে সওয়াল-জওয়াব করবে।(সূরা সাফ্ফাত (৩৭), আয়াত ২৭)
তবে বিশুদ্ধ মত হল আলোচ্য আয়াতে শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়ার পরের কথা বলা হয়েছে, যে ফুঁকের পর সকলেই জীবিত হয়ে উঠবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. বলেন, কিয়ামতের দিন বান্দা বা বান্দীর হাত ধরে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষের সামনে দাঁড় করানো হবে। তারপর একজন ঘোষক ঘোষণা করবে, এ ব্যক্তি অমুকের পুত্র অমুক। এর কাছে কারও কিছু পাওনা থাকলে সে যেন এসে তার পাওনা নিয়ে নেয়। তখন সে ব্যক্তি বড় খুশি হবে। কারণ তার প্রাপ্য রয়েছে তার পিতার কাছে, তার সন্তানের কাছে, তার স্ত্রীর কাছে বা তার ভাইয়ের কাছে। সে তার হক আদায় করে নেবে। তারপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. পাঠ করেন- فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না)।(ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ ওয়ার-রাকাইক: ১৪১৬)
সূরা ‘আবাসায় ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (34) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (35) وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (36) لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ (37)
‘যেদিন মানুষ তার ভাই থেকেও পালাবে এবং নিজ পিতা-মাতা থেকেও এবং নিজ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকেও। (কেননা) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে।’(সূরা ‘আবাসা (৮০), আয়াত ৩৪-৩৭)
উল্লেখ্য, এটা কাফেরদের অবস্থা। মুমিনদের অবস্থা এর থেকে ভিন্ন। মুমিনদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ
‘যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের ক্ষেত্রে তাদের অনুগামী হয়েছে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে তাদের সাথে মিলিয়ে দেব।’(সূরা তৃর (৫২), আয়াত ২১)
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন মুসলিম সন্তানগণ তাদের পিতা- মাতাকে পানি পান করাবে। এমনকি মায়ের পেট থেকে যে শিশু অসম্পূর্ণরূপে জন্ম নেয়, সেও সেদিন আল্লাহর কাছে আরয করবে যে, আমি আমার পিতা-মাতা ছাড়া জান্নাতে যাব না। এর দ্বারা বোঝা যায় মুমিনদের মধ্যকার বংশীয় সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।
এ আয়াতে যে বলা হয়েছে 'সেদিন কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না', অপরদিকে সূরা সাফ্ফাতে বলা হয়েছে- وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (তারা একে অন্যের অভিমুখী হয়ে পরস্পরে সওয়াল-জওয়াব করবে), এর মধ্যে বাহ্যত বিরোধ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা কিয়ামতের দিন বিভিন্ন রকম অবস্থা হবে। কখনও এমন কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হবে যে, মানুষ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, ভয়ে আতঙ্কে কারও দিকে ফিরে তাকানোরও অবকাশ পাবে না। প্রত্যেকে নিজের চিন্তায় বিভোর থাকবে। আবার কখনও ভয়-ভীতি কিছুটা হালকা হবে। তখন একে অন্যের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে এবং খোঁজখবর নেবে।
فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে)। অর্থাৎ সেদিন মীযান ও দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে। যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে মুক্তিলাভ করবে এবং জান্নাতের অধিকারী হবে। যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পায় ও জান্নাতের অধিকারী হয়, সেই প্রকৃত সফলকাম।
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে)। অর্থাৎ যারা ঈমান আনেনি; বরং কুফর অবলম্বন করেছিল, তারা জান্নাতের বদলে জাহান্নাম খরিদ করেছে। নিঃসন্দেহে জান্নাতের বিনিময়ে জাহান্নাম গ্রহণ করাটা ভয়ানক লোকসানের ব্যবসা। তাদেরকে চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনওদিন তারা মুক্তি পাবে না।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে কাফেরদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, আর এর আগের আয়াতে সৎকর্মশীল মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছিল। গুনাহগার মুমিনদের অবস্থা এখানে বর্ণনা করা হয়নি। অন্যান্য আয়াত ও হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, তাদের বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি ক্ষমা করলে শুরুতেই তারা জান্নাতে যাবে। অন্যথায় তারা তাদের পাপ অনুপাতে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। শাস্তিভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ঈমানের বদৌলতে তারা মুক্তি পাবে। পরিশেষে তারাও জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে যাবে। সেখানে তারা অনন্তকাল বাস করবে।
تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ (আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে)। এরূপ অবস্থা হবে কাফেরদের। পাপী মুমিনদের চেহারা আগুনে দগ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ قَوْمًا يُخْرَجُوْنَ مِنَ النَّارِ يَحْتَرِقُوْنَ فِيْهَا، إِلَّا دَارَاتِ وُجُوهِهِمْ حَتَّى يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ
‘একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে, যারা জাহান্নামে দগ্ধীভূত হবে, তবে তাদের মুখমণ্ডল নয়। পরিশেষে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।(সহীহ মুসলিম : ১৯১; ইবন মান্দাহ, আল-ঈমান: ৮৫৯)
আয়াতে বলা হয়েছে, জাহান্নামে তাদের চেহারা বীভৎস হয়ে যাবে। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
تَشْوِيهِ النَّارُ فَتَقَلَّصُ شَفَتُهُ العُلْيَا حَتَّى تَبْلُغَ وَسَطَ رَأْسِهِ وَتَسْتَرْخِي شَفَتُهُ السُّفْلَى حَتَّى تَضْرِبَ سُرَّتَهُ
‘জাহান্নাম তাকে এমনভাবে দগ্ধ করবে যে, তার উপরের ঠোঁট সংকুচিত হয়ে যাবে। এমনকি তা মাথার তালু পর্যন্ত পৌছে যাবে। আর নিচের ঠোঁট যাবে ঢিলা হয়ে। এমনকি তা নাভি স্পর্শ করবে।’(জামে' তিরমিযী: ২৫৮৭; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা: ১৩৬৭;; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪৪১৭)
أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ (তাদেরকে বলা হবে) তোমাদেরকে কি আমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো হতো না? কিন্তু তোমরা তা অবিশ্বাস করতে'। অর্থাৎ কাফেরদের তিরস্কার করে বলা হবে যে, তোমাদের কাছে তো আমার আয়াতসমূহ পৌঁছানো হয়েছিল। তোমাদের সামনে তা পাঠ করা হয়েছিল। কিন্তু তোমরা তা অস্বীকার করেছিলে। তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলে। এখন দেখো তা কতটা সত্য ছিল। যদি তখন তোমরা এতে বিশ্বাস করতে, তবে আজ তোমাদের এ পরিণতি হতো না।
قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ (তারা বলবে,হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়)। দুর্ভাগ্য বলে সম্ভবত তাদের কুপ্রবৃত্তি ও মনের খেয়াল-খুশি বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের খেয়াল-খুশির কাছে হেরে গিয়েছিলাম। মন যখন যা চাইত তাই করতাম। মনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আপনার আয়াত অস্বীকার করেছিলাম। আর এভাবে আমরা সত্য-সঠিক পথ গ্রহণ না করে ভুল পথে চলেছিলাম।
رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ (হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব)। অর্থাৎ আপনি আমাদেরকে আরেকবার সুযোগ দিন। আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন। আমরা ওয়াদা করছি এবার আমরা আপনার অনুগত হয়ে চলব। আপনার অবাধ্যতা করব না। যদি পুনরায় সেরকম করি, তবে আমরা জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হব। নিজেদের প্রতি অবিচারকারী বলে গণ্য হব। তখন আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দিলে আমরা মুক্তিলাভের জন্য আপনার কাছে ফরিয়াদ করব না। এর উত্তরে আল্লাহ বলবেন-
اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ (এরই মধ্যে তোমরা হীন অবস্থায় পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না)। অর্থাৎ আবেদন-নিবেদনের স্থান ছিল দুনিয়া। তোমরা সে জায়গা পার হয়ে এসেছ। এটা শাস্তিভোগের জায়গা। কাজেই আর কোনও অনুনয়-বিনয় নয়, এখানে লাঞ্ছিত অবস্থায় পড়ে থাকো। তোমরা এ শাস্তি হতে নিষ্কৃতি পাবে না। অতঃপর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে তারা মুক্তিলাভের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে যাবে।
হাসান বসরী রহ. বলেন, এটাই হবে দোযখবাসীদের সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ কথা। তারপর তারা অনুতাপে কুকুরের মতো চিৎকার করতে থাকবে, যা তারা নিজেরাও বুঝবে না, অন্য কাউকেও বোঝাতে পারবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. বলেন, জাহান্নামবাসীরা (জাহান্নামের দায়িত্বে নিযুক্ত ফিরিশতাদের প্রধান) মালেককে ডেকে বলবে, হে মালেক! তোমার রব্ব আমাদের কাজ শেষ করে দিন। মালেক ৪০ বছর তাদের উপেক্ষা করবেন, কোনও উত্তর দেবেন না। তারপর এই বলে উত্তর দেবেন যে, তোমাদেরকে এখানেই থাকতে হবে। তারপর তারা তাদের রব্বকে ডেকে বলবে, হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে এখান থেকে বের করুন। আমরা যদি আবারও আগের মতো করি, তবে আমরা অবশ্যই জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হব। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দুনিয়ার বয়সের দ্বিগুণকাল পরিমাণ উপেক্ষা করবেন। কোনও উত্তর দেবেন না। তারপর এই বলে উত্তর দেবেন যে, তোরা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামের ভেতর থাক। আমার সঙ্গে কোনও কথা বলিস না। ফলে তারা নিরাশ হয়ে যাবে। এরপর আর তারা একটি কথাও বলবে না। কেবল তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাবে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন- إِنَّهُ كَانَ فَرِيقٌ مِنْ عِبَادِي يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ (আমার বান্দাদের একটি দল দু'আ করত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু)। অর্থাৎ আমার বান্দাদের এক দল আমার প্রতি বিশ্বাস রাখত। তারা আমার আনুগত্য করত। আমার আদেশ-নিষেধ মেনে চলত। কখনও ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে সেজন্য ইস্তিগফার ও ক্ষমাপ্রার্থনা করত। তারা আমার দয়া ও রহমতের আশাবাদী ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল আমি পরম দয়ালু, তাদের প্রতি দয়ার আচরণ করব। সে বিশ্বাসে তারা আমার কাছে রহমত প্রার্থনা করত এবং রহমতলাভের উপযুক্ত আমল করতে সচেষ্ট থাকত (বলাবাহুল্য রহমত পাওয়ার উপযুক্ত আমল হচ্ছে শরী'আত অনুযায়ী আমল করা)। তাদের সে আমল ছিল তোমাদের আমলের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এ কারণে তোমরা তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاتَّخَذْتُمُوهُمْ سِخْرِيًّا حَتَّى أَنْسَوْكُمْ ذِكْرِي وَكُنْتُمْ مِنْهُمْ تَضْحَكُونَ (তোমরা তখন তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিলে। এমনকি তা তোমাদেরকে আমার স্মরণ পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তোমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতে)। অর্থাৎ তারা দীন ও শরী'আত মানত বলে তোমরা তাদেরকে নানাভাবে উপহাস করতে। তাদেরকে পাগল বলতে। নির্বোধ ঠাওরাতে। সেকেলে ও পশ্চাদপদ গণ্য করতে। তার বিপরীতে নিজেদেরকে মনে করতে সভ্য ও প্রগতিশীল। তোমরা তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও নিজেদের অহংকার-অহমিকায় মত্ত থাকার কারণে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। আমি যে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা, তোমাদের পালনকর্তা আর এ কারণে আমার আনুগত্য করা তোমাদের অবশ্যকর্তব্য, সে কথা একবারও মনে করনি। উল্টো আমার অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকেছিলে। আর এভাবে তোমরা আমার হকও নষ্ট করেছিলে এবং বান্দার হকও নষ্ট করেছিলে। ফলে তোমরা ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত থাকনি। এখন জাহান্নামে চিরদিন শাস্তি ভোগ করতে থাকো।
إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (তারা যে সবর করেছিল সে কারণে আজ আমি তাদেরকে এমন প্রতিদান দিলাম যে, তারাই হয়ে গেল কৃতকার্য)। অর্থাৎ তোমরা যে আমার অনুগত বান্দাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে ও নানাভাবে কষ্ট দিতে, তাতে তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। তারা ধৈর্যের সঙ্গে নিয়মিত আমার ইবাদত-বন্দেগীও আঞ্জাম দিয়েছিল। আজ আমি তাদেরকে সে ধৈর্যের সুফল দিয়েছি। আমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত রেখে জান্নাতের বাসিন্দা করে দিয়েছি। সুতরাং আজ তারাই সফল আর তোমরা ব্যর্থ।
قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছ)? অর্থাৎ তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু মনে করেছিলে। আখিরাতের কথা ভুলে দুনিয়া নিয়েই মত্ত থেকেছিলে। তারপর তোমাদের মৃত্যু হল। তোমরা কবরে একটা দীর্ঘকাল কাটালে। হাশরের ময়দানে বিচারের অপেক্ষায়ও থাকলে দীর্ঘ সময়। তারপর এখন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করছ। তা যেই দুনিয়াকে সবকিছু মনে করেছিলে এবং যার জন্য কবরের আযাব, হাশরের বিভীষিকা ও জাহান্নামের শাস্তি সবই গ্রহণ করে নিলে, এবার বলো সেই দুনিয়ায় তোমরা কতদিন কাটিয়েছিলে? দুনিয়ার তুচ্ছ ভোগ-উপভোগ কতদিনের জন্য পেয়েছিলে?
قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ ‘তারা বলবে, আমরা এক দিন বা এক দিনেরও কম থেকেছি। (আমাদের ভালো মনে নেই) কাজেই যারা (সময়) গুনেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন'। অর্থাৎ কাফেরগণ পৃথিবীতে তাদের অবস্থানকালকে খুবই অল্প মনে করবে। একদিন বা তারও কম। এত অল্প মনে করবে এ কারণে যে, কবর-হাশর ও জাহান্নামবাসের কালটা অনেক দীর্ঘ। সে তুলনায় দুনিয়ার জীবন এমনিতেই অতি অল্প। তারপর আবার শাস্তি ও দুঃখ-কষ্টের সময়টা বাস্তব অপেক্ষাও দীর্ঘ মনে হয়। যে ব্যক্তি সে কষ্টের মধ্যে থাকে, সে তার আগের সুখের কালটাকে অতি সংক্ষিপ্ত মনে করে। তাছাড়া তাদের পার্থিব জীবন তো অতীতের কথা। তা শেষ হয়ে গেছে। এখন আখিরাতের জীবন ভোগ করছে, যার কোনও শেষ নেই। অনন্ত অশেষ কালের তুলনায় সীমিত ও শেষ হয়ে যাওয়া কালের কোনও তুলনা চলে কি?
যাহোক চরম কষ্টের মধ্যে থাকার কারণে তারা দুনিয়ার জীবনের পরিমাণটা সঠিক মনে করতে পারবে না। তাই তারা বলবে, আপনি গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন। অর্থাৎ সেসব ফিরিশতাদেরকে, যারা মানুষের আমল ও কাজকর্মের হিসাব রাখে। তারা পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে ভালো জানে। তারাই এর সঠিক হিসাব দিতে পারবে।
قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘আল্লাহ বলবেন, তোমরা অল্পকালই থেকেছিলে। কতইনা ভালো হতো যদি এ বিষয়টা তোমরা (আগেই) বুঝতে'। অর্থাৎ এই আখিরাতের দৈর্ঘ্য ও স্থায়িত্বের তুলনায় দুনিয়ার জীবন ছিল অতি ক্ষণস্থায়ী। তোমরা যদি দুনিয়ায় থাকা অবস্থায়ই বুঝতে যে, তা অতি সংক্ষিপ্ত জীবন, অল্পদিন পরেই শেষ হয়ে যাবে, তারপর এই অনন্ত জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে, তবে তা তোমাদের জন্য কতইনা কল্যাণকর হতো! তখন তোমরা আমার অবাধ্যতা করতে না। মনের কামনা-বাসনা পূরণের পেছনে পড়ে জীবন নষ্ট করতে না। বরং আখিরাতের এ জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। ফলে আজ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেয়ে মুমিনদের মতো জান্নাতবাসী হয়ে যেতে। কিন্তু আফসোস! তোমরা এসব চিন্তা করনি। দুনিয়া নিয়েই বিভোর ছিলে। ফলে আজ তোমাদেরকে তার খেসারত তো দিতেই হবে।
আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন যে কত সংক্ষিপ্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ করেছেন-
واللَّهِ ما الدُّنْيا في الآخِرَةِ إلَّا مِثْلُ ما يَجْعَلُ أحَدُكُمْ إصْبَعَهُ هذِه -وأَشارَ يَحْيَى بالسَّبَّابَةِ- في اليَمِّ، فَلْيَنْظُرْ بمَ تَرْجِعُ؟
‘আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এরকম, যেমন তোমাদের কেউ তার তর্জনী আঙ্গুল সাগরে রাখল, তারপর উঠিয়ে নিল, এবার দেখুক আঙ্গুলটি কী পরিমাণ পানি নিয়ে এসেছে।’(সহীহ মুসলিম : ২৮৫৮; জামে' তিরমিযী : ২৩২৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১০৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ১১৭৯৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪৩০৬; সহীহ ইবন হিব্বান। ৪৩৩০)
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না)? অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى (36)
‘মানুষ কি মনে করে তাকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে?(সূরা কিয়ামাহ (৭৫), আয়াত ৩৬)
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে মোটেই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। বরং আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এজন্য যে, তোমরা আমাকে চিনবে এবং আমার আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগী করবে। তোমরা তার ঠিক কতখানি কর, তা লক্ষ রাখা হবে। এটা তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। দুনিয়ার গোটা জীবনই তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা। একসময় তোমাদের মৃত্যু হবে। তারপর তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন তোমাদেরকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় বিষয়ের হিসাব দিতে হবে। তোমরা আমার কতটুকু আনুগত্য করেছ এবং কতটুকু অবাধ্যতা করেছ, কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছ এবং কতটুকু অকৃতজ্ঞতা করেছ, তার পরিপূর্ণ হিসাব তোমাদের থেকে নেওয়া হবে। তোমাদেরকে এমনি এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে না। হিসাব দেওয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ তোমরা জান্নাত লাভ করবে। আর হিসাব দিতে ব্যর্থ হলে তোমাদের পরিণাম হবে জাহান্নামের শাস্তি। সুতরাং এসব বিষয় স্মরণ রেখেই তোমাদের ইহজীবন যাপন করা উচিত। হাকীম তিরমিযী রহ. বলেন, আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর বান্দা ও দাসরূপে। তাদের কর্তব্য তাঁর বন্দেগী ও দাসত্ব করা। তা করলে তিনি তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন আর না করলে শাস্তি দেবেন। তারা তাঁর বন্দেগী করলে একদিকে তারা হবে আল্লাহর গোলাম, অন্যদিকে দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু হতে থাকবে মুক্ত ও স্বাধীন এবং থাকবে সম্মানিত ও ইসলামী জগতের বাদশা হয়ে। আর যদি তাঁর বন্দেগী পরিহার করে, তবে তারা সাব্যস্ত হবে পলাতক গোলাম। থাকবে হীন ও লাঞ্ছিত। আর আখিরাতে তারা আল্লাহর দুশমনরূপে বহুস্তরবিশিষ্ট আগুনের কারাগারে বন্দি থাকবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. মৃত্যু মানুষের অবধারিত পরিণতি। সে কথা ভুলতে নেই।
খ. মৃত্যুকালে পাপী বান্দাগণ আক্ষেপ করবে। কিন্তু সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না।
গ. যা-কিছু সৎকর্ম করার, তা এখনই করা চাই। যে-কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। তখন কিছু করার অবকাশ থাকবে না।
ঘ. আল্লাহর দেওয়া জীবন, ধন-সম্পদ ও অন্যসব নি'আমত সৎকর্মে ব্যবহার করা চাই।
ঙ. মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়কে বরযখের জগৎ বলা হয়। সুদীর্ঘ সে সময়টা যাতে আযাব থেকে নিরাপদ থাকা যায়, তাই নেক আমলের মধ্যে জীবন কাটানো চাই।
চ. কিয়ামত হবে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার দ্বারা। এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
ছ. আখিরাতে দুনিয়ার বংশপরিচয় ও বংশগৌরব কোনও কাজে আসবে না।
জ. হাশরের ময়দান বড় বিভীষিকাময়। সেখানে কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না।
ঝ. মীযানে মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে। এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা ফরয।
ঞ. যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে হবে জান্নাতবাসী। আর যার বদ আমলের ওজন বেশি হবে, তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।
ট. জাহান্নামের আযাবে পাপীদের চেহারা বীভৎস হয়ে যাবে।
ঠ. আল্লাহ তা'আলার প্রতিটি আয়াতকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং আয়াত পাঠকালে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া ও বিনয় প্রদর্শন করা কর্তব্য।
ড. শরী'আত উপেক্ষা করে মনের খেয়াল-খুশিমতো চলা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।
ঢ. কাফের ব্যক্তিকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে। কখনও সেখান থেকে মুক্তি পাবে না।
ণ. মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করা, তাঁর কাছে দু'আ করা, তাওবা ও ইস্তিগফার করা এবং আল্লাহ তা'আলার রহমতের আশাবাদী থাকা।
ত. দীনদার ও গরীব-দুঃখীকে উপহাস করা কাফের ও ফাসেকদের কাজ। মুমিনদেরকে এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
থ. যে ব্যক্তি অন্যকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, সে আল্লাহ তা'আলার যিকির ও স্মরণ ভুলে যায়।
দ. অন্যের ঠাট্টা-বিদ্রুপে সবর করা চাই। এটা আখিরাতে সফলতালাভের একটি উপায়।
ধ. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন নিতান্তই অল্প।
ন. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার নগণ্যতা স্মরণ রাখা নেক আমলে মশগুল থাকার পক্ষে সহায়ক।
প. মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী। এটা না করার দ্বারা মানবজীবন বৃথা হয়ে যায়।
ফ. বেহুদা কাজ করা আল্লাহ তা'আলার শান নয়। মানুষেরও কোনও বেহুদা কাজ করা উচিত নয়।
ব. পুনরুত্থান ও আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রত্যাবর্তন মানুষের জন্য আল্লাহর অবধারিত বিধান।
ছয় নং আয়াত
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (16)
অর্থ: যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে? এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে মুমিনদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে- তারা যেন অলসতা ছেড়ে আমলে যত্নবান হয়। যেন গুনাহ পরিহার করে সৎকর্মে মনোযোগী হয়। মনের খেয়াল-খুশি দমন করে শরী'আতের অনুসরণে বদ্ধপরিকর হয়। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে যাবে। আত্মসংশোধনের এখনই সময়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ (যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণে)? যিকির অর্থ স্মরণ। আল্লাহর স্মরণ মানে আল্লাহ তা'আলা যে আমাদের খালেক ও মালিক, এ কথা চিন্তা করা। আরও চিন্তা করা যে, তিনি সর্বশক্তিমান ও অন্তর্জামী এবং তিনি দয়াময় ও শাস্তিদাতা। সুতরাং তিনি মানুষকে তাদের ভালোমন্দ কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল দেবেন। যারা ভালো কাজ করবে তাদেরকে জান্নাতে পুরস্কৃত করবেন এবং যারা মন্দ কাজ করবে তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দেবেন। এসব কথা চিন্তা করে আল্লাহ তা'আলার শাস্তির ভয়ে মনে মনে কেঁপে ওঠা আর তার ফলশ্রুতিতে যাবতীয় পাপকর্ম ছেড়ে দেওয়া। এমনিভাবে তাঁর রহমতের আশায় মন মাতানো আর তার ফলশ্রুতিতে সৎকর্মে লেগে পড়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
‘মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২)
যিকিরের আরেক অর্থ উপদেশ। সে হিসেবে এর অর্থ হবে- মুমিনদের কি সে সময় আসেনি যে, আল্লাহর উপদেশ শুনে তাদের মন গলবে? অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদে মানুষকে নানাভাবে যে উপদেশ দিয়েছেন এবং তা ছাড়াও জগতের বিচিত্র ঘটনাবলি দ্বারা যে উপদেশগ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন, মানুষের উচিত সময় ক্ষেপণ না করে এখনই সেসব উপদেশ গ্রহণ করা আর তার ফলস্বরূপ অলসতা ছেড়ে শরী'আতের আদেশ-নিষেধ মানায় তৎপর হয়ে যাওয়া। কারণ অলসতার সময় একদম নেই। যে- কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। তখন আর কোনওকিছু করার সুযোগ থাকবে না।
وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে (তাদের অন্তর বিগলিত হবে)'? 'সত্য' দ্বারা কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে। কুরআন মাজীদ আল্লাহ তা'আলার সত্য কিতাব। এটা কোনও মানুষের রচনা নয়। কুরআনের ভাষার সৌন্দর্য ও শক্তি, ভাবের গভীরতা ও ব্যপ্তি, এর দুর্দান্ত প্রভাব ও তাছির এবং তত্ত্ব ও তথ্যের ঐশ্বর্যের ভেতর দৃষ্টিপাত করলেই এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সুতরাং সত্যগ্রহণের মনোভাবে যে ব্যক্তি এ পবিত্র গ্রন্থ পড়বে বা শুনবে আর এর আয়াতসমূহে চিন্তা করবে, সে অবশ্যই মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে যাবে। এর প্রতিটি শব্দ ও বাক্য তার হৃদয় স্পর্শ করবে। সে রোমাঞ্চিত হবে। তার দেহমন কেঁপে উঠবে এবং অবিলম্বে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হয়ে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনে বদ্ধপরিকর হয়ে যাবে।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর স্মরণে মন নরম হওয়া ও মন গলে যাওয়ার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। মনের এ গুণ ঈমান-আমলে অগ্রগতির পক্ষে খুব সহায়ক। তাই এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা জরুরি। অন্যথায় ক্ষতির আশঙ্কা যথেষ্ট। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَوَّلُ مَا يُرْفَعُ مِنَ النَّاسِ الْخُشُوعُ
‘মানুষের ভেতর থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিস তুলে নেওয়া হবে তা হল খুশু' (মনের ভয় ও বিগলন)।(তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৭১৮৩; সহীহ ইবন হিব্বান : ৪৫৭২)
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ ‘এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য'। অতীতের কিতাবী জাতিসমূহ নিজ নিজ কিতাবের নির্দেশনা ভুলে মনের খেয়াল-খুশিমতো চলতে শুরু করে। তারা ধরে নিয়েছিল দুনিয়ায় অনেক দিন বাঁচব। তাই কিছুদিন ফুর্তি করে নিই। এভাবে তারা পাপকর্মে মগ্ন হয়ে যায়। এর ফলে তাদের অন্তর আস্তে আস্তে শক্ত হতে থাকে। অন্তর যখন শক্ত হয়ে যায়, তখন কোনও উপদেশ কাজে আসে না। শাস্তির ধমক শুনলেও মনে কোনও পরিবর্তন দেখা দেয় না। শেষপর্যন্ত বেঈমানরূপে কবরে যেতে হয়। অতীত জাতিসমূহের তাই হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ উম্মতকে সতর্ক করছেন যে, তোমরা তাদের মতো হয়ো না। ইহজীবনকে লম্বা মনে করো না। তা মনে করলে মন শক্ত হয়ে যাবে। তখন কোনও আদেশ-উপদেশের তাছির তোমাদের অন্তরে পড়বে না। মৃত্যুর কথা স্মরণ করো। তাতে মন নরম থাকবে। দুনিয়ার সময় বড় সংক্ষিপ্ত। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে। তাই গড়িমসি না করে দ্রুত নেককাজে লেগে পড়ো।
এ আয়াত দ্বারা মন শক্ত হয়ে যাওয়ার কুফল সম্পর্কে জানা গেল। তাই এ সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকা দরকার। যেসব কাজে মন শক্ত হয়, কিছুতেই তাতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ، وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ الْقَلْبُ الْقَاسِي
‘আল্লাহর যিকির ছাড়া অন্য কথা বেশি বলো না। কেননা আল্লাহর যিকির ছাড়া বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। আর মানুষের মধ্যে আল্লাহ হতে সর্বাপেক্ষা দূরে থাকে ওই ব্যক্তি, যার মন শক্ত।’(জামে' তিরমিযী: ২৪১১; মুআত্তা মালিক: ২০৭৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩১৮৭৯)
হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. একবার বসরাবাসীদের সামনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর সে বক্তৃতায় তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
وَلَا يَطُولَنَّ عَلَيْكُمُ الأمَدُ فَتَقْسُوَ قُلُوبُكُمْ، كما قَسَتْ قُلُوبُ مَن كانَ قَبْلَكُمْ،
‘সাবধান! তোমরা কিছুতেই তোমাদের আয়ুকে দীর্ঘ মনে করো না। তাহলে তোমাদের অন্তর শক্ত হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের মন শক্ত হয়ে গিয়েছিল।(সহীহ মুসলিম: ১০৫০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ৩৪৮২৩; তহাবী: ২০৩৫)
উল্লেখ্য, আলোচ্য এ আয়াত অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। মনোযোগের সঙ্গে পড়লে বা শুনলে অন্তরে এর দারুণ প্রভাব পড়ে। আয়াতটি বহু লোকের জীবন বদলের কারণ হয়েছিল। বুযুর্গ ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ. ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. উল্লেখযোগ্য। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. শুরুতে এক আয়েশী ও ফুর্তিবাজ যুবক ছিলেন। গানবাদ্য করে বেড়াতেন। এক রাতে তিনি তাঁর ফলের বাগানে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। খুব পানাহার চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর তানপুরা(বীণাসদৃশ তারযন্ত্র) ও বেহালা নিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুতেই সুর ওঠে না। তিনি আনমনা হয়ে যান। এমন তো কখনও হয় না! সহসা তিনি হাতের বাদ্যযন্ত্র থেকে এক অপূর্ব ধ্বনি শুনতে পান। তিনি কান পাতেন। লক্ষ করে দেখেন তাতে ধ্বনিত হচ্ছে- …أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?...’। অমনি তিনি বলে উঠেন, অবশ্যই সেই সময় এসে গেছে হে আল্লাহ! এই বলে তিনি বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলেন। বন্ধুদের বিদায় করে দেন। তারপর তাওবা করে নতুন জীবন শুরু করে দেন। অতঃপর তিনি ইলম, আমল, আখলাক তথা মানবীয় উৎকর্ষে কত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, তা দীনদার মুসলিমমাত্রই জানে।
ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-এরও জীবনবদলে এ আয়াতখানি ভূমিকা রেখেছিল। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন এক দস্যু। এক তরুণীর জন্য পাগল ছিলেন। কোনও এক রাতে সেই তরুণীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তিনি দেয়াল টপকে যেই না বাড়ির ভেতর ঢুকবেন, অমনি শুনতে পান কোথা এক পাঠক পাঠ করছে - …أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?...’। আয়াতখানি যেন তাঁর বুকের উপর এক চাপড় মারল। বুকের দেয়াল ভেদ করে সে চাপড়ে তাঁর হৃদয় কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, অবশ্যই হে আল্লাহ! আমার সেই সময় এসে গেছে। এই বলে তিনি দৌড় দিলেন এবং পাশের এক জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এরই মধ্যে সেখান থেকে এক যাত্রীদল যাচ্ছিল। তাদের একজন বলছিল, সাবধান হও! দস্যু ফুযায়লের দল কিন্তু এরই আশেপাশে থাকে। কথাটি ফুযায়ল রহ, শুনে ফেললেন। তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, ওহে কুযায়ল! রাতের বেলা পাপ করতে বের হয়েছ। আবার তুমি এতটাই বরবাদ হয়েছ যে, মুসলিম যাত্রীদল তোমার ভয়ে তটস্থ থাকে। তিনি আর সময় নিলেন না। তখনই তাওবা করলেন। তারপর চলে গেলেন বায়তুল্লাহ শরীফে। সারাটা জীবন সেখানেই কাটিয়ে দিলেন। আজ মহান বুযুর্গ ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে কে না চেনে?
আয়াতটির শিক্ষা
ক. সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। যে-কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। কাজেই নিজেকে শোধরানোর এখনই সময়।
খ. আল্লাহর স্মরণে মন নরম ও বিগলিত হওয়া ঈমানের দাবি।
গ. কুরআন আল্লাহর নাযিল করা কিতাব ও পরম সত্য বাণী।
ঘ. দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আশা ও মৃত্যুকে দূরবর্তী মনে করার দ্বারা মন শক্ত হয়ে যায়।
ঙ. পক্ষান্তরে আল্লাহর যিকির, মৃত্যুর স্মরণ ও আয়কে স্বল্প মনে করার দ্বারা মন নরম ও বিগলিত হয়।
চ. শক্ত মন নেক আমলে আগ্রহী হয় না এবং তা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকে।
ছ. ঈমানদারদের অতীত জাতিসমূহের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।
প্রত্যেক প্রাণীই মরণশীল। মৃত্যু বড় কঠিন জিনিস। শরীর ও রূহ একসঙ্গে থাকায় পরস্পরের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উভয়ে মিলে একই বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়। তাই কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু মরণে বিচ্ছেদ অনিবার্য। ফলে দেহ ও রূহ উভয়ের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়। কোনও মানুষ জীবনলাভের পর মৃত্যুতে যে কষ্ট পায়, অতটা কষ্ট এ দুনিয়ায় আর কখনও কোনওকিছুতে পায় না। এ কষ্ট আরও বেড়ে যায় যখন মুমূর্ষু ব্যক্তি উপলব্ধি করে রূহ চলে যাওয়ার পর তার দেহ পচে-গলে যাবে, তা পোকা-মাকড়ের খাদ্যে পরিণত হবে। কষ্ট আরও বাড়ে যখন ভাবে তার রূহের স্থান কোথায় হবে- পাপিষ্ঠদের স্থান জাহান্নামে, না নেককারদের ঠিকানা জান্নাতে। জীবনভর পাপকর্ম করতে থাকলে মৃত্যুর সময় এ ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে যে, হয়তো তার রূহকে জাহান্নামেই নিয়ে যাওয়া হবে। তখন কষ্ট আরও বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে বিখ্যাত তাবি'ঈ রাবী' ইবন খুছায়ম রহ. বলতেন, তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো। কারণ তোমরা এর আগে কখনও এরূপ কঠিন কষ্ট ভোগ করনি।
মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করলে বহুবিধ উপকার পাওয়া যায়। এতে মানুষের লম্বা-চওড়া আশা করার মাত্রা কমে আসে। অতি আশা ভীষণ ক্ষতিকর। তাতে নেক আমলে গড়িমসি করার মনোভাব জন্মায়। আশা পূরণের ব্যতিব্যস্ততা নেক আমলকে পিছিয়ে দেয়। মনে করা হয় এখনই তাড়াহুড়ার কী আছে। সামনে আরও কত সময় রয়েছে। তখন তাওবাতিল্লা করে ঠিক হয়ে যাব। তখন দান-খয়রাত করব, হজ্জ করব এবং পুরোপুরি মুসল্লি-পরহেযগার হয়ে যাব। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য জমিয়ে নিই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। এছাড়া আরও যেসব পরিকল্পনা আছে সেগুলো গুছিয়ে নিই। কিন্তু গোছানো আর হয় না। যত গোছায়, পরিকল্পনাও ততো লম্বা হয়। তাতে নিত্য-নতুন শাখা-প্রশাখা জন্ম নেয়। এভাবে বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার এমন জটাজালে সে জড়িয়ে যায়, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব সহজ হয় না। অপ্রস্তুত অবস্থায়ই মালাকুল মাওত তার প্রাণ সংহার করে নেয়। দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষার এ অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। মৃত্যুর স্মরণ আশা-আকাঙ্ক্ষার রশি টেনে ধরে। অন্তরে অল্পেতুষ্টির সদগুণ জন্ম দেয়। যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে, তার অন্তর থেকে লোভ-লালসা দূর হয়ে যায়। সে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ হয়ে ওঠে। আখিরাতের প্রতি আগ্রহী হয়। তার পক্ষে দুনিয়ার বালা-মসিবত তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় ধন-সম্পদও। ক্ষমতার প্রতিও কোনও আগ্রহ থাকে না। এভাবে অন্তর থেকে অহংকার-অহমিকাও লোপ পেয়ে যায়। মোটকথা মৃত্যুচিন্তা সর্বাংশে কল্যাণই কল্যাণ। তাই কুরআন ও হাদীছে মানুষকে বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে, সে তাগাদাও দেওয়া হয়েছে। এ অধ্যায়ের আয়াত ও হাদীছগুলো সে সম্পর্কেই।
‘মৃত্যুকে স্মরণ করা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (185)
অর্থ: প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তোমাদের সকলকে (তোমাদের কর্মের) পুরোপুরি প্রতিদান কিয়ামতের দিনই দেওয়া হবে। অতঃপর যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম হবে। আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮৫)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হল মৃত্যু। যা-কিছুরই প্রাণ আছে, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। এর থেকে নিস্তার নেই কারও। এ দুনিয়ায় কেউ অনন্তকাল বাঁচে না। না কোনও মানুষ, না অন্য কোনও জীবজন্তু। এটা সর্বাপেক্ষা চরম সত্য। আজ পর্যন্ত কেউ এটা অস্বীকার করতে পারেনি। কেউ অস্বীকার করেও না। সুতরাং মৃত্যু যখন অবধারিত, তখন প্রত্যেকেরই এর জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। নিজের জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার, অন্যের ক্ষেত্রেও মেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই কারও মৃত্যুতে অভিযোগ না তুলে বা হতাশ না হয়ে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং নিজ করণীয় কাজে অবিচল থাকা উচিত।
‘মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে, মৃত্যু যতই স্বাভাবিক হোক না কেন, তার একটা যন্ত্রণা আছে। মৃত্যুকালে সে যন্ত্রণা কিছু না কিছু সকলকেই ভোগ করতে হয়। সে এক কঠিন পরিস্থিতি। সকল কাজে সে কথা মাথায় রাখা উচিত। তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তারপর কিয়ামত দিবসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। একদিন এ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় তা থাকবে দীর্ঘকাল। তারপর সকলকে পুনর্জীবিত করা হবে। সকল মানুষ আপন আপন স্থান থেকে জীবিত হয়ে বিচারের মাঠে সমবেত হবে। সকলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, তারপর পুনরায় জীবিত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হওয়া- এই সবটার সমষ্টির নাম কিয়ামত। এটা হবেই হবে। এর উপর বিশ্বাস রাখা ফরয। এর সারকথা হল মৃত্যুতেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সমাপ্তি নয় বরং এর পর আরেক জীবন আছে। তার নাম আখিরাত। সেই জীবনে সকলকেই ফিরতে হবে এবং এ জীবনের যাবতীয় কাজ সে জীবনের সফলতার লক্ষ্যেই আঞ্জাম দিতে হবে। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُونِ (56) كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ثُمَّ إِلَيْنَا تُرْجَعُونَ (57)
‘হে আমার মুমিন বান্দাগণ! নিশ্চয়ই আমার ভূমি অতি প্রশস্ত। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো। জীব মাত্রকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তারপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।’(সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৫৬-৫৭)
কিয়ামতের দিন তথা বিচারসভায় প্রত্যেককে আপন আপন কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি ভালো কাজ করেছে, সেদিন সে ভালো ফল পাবে। যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করেছে, সে পাবে মন্দ ফল। আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। সেদিন কারও প্রতি কোনও অন্যায় করা হবে না। এটা সুস্পষ্ট করার জন্য আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে তার ভেতর আপন আপন কাজের পূর্ণ বিবরণ দেখতে পাবে। ছোটবড় যাই করেছে, তার কোনওটারই অনুল্লেখ পাবে না। যে যা করেছে, সে সম্পর্কে সাক্ষীও পেশ করা হবে। সে সাক্ষীদের মধ্যে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও থাকবে। প্রত্যেক অঙ্গ সাক্ষ্য দেবে তাকে দিয়ে কি কি কাজ করানো হয়েছে। তদুপরি আমলের ওজন করা হবে। দেখা হবে কার নেক আমলের ওজন বেশি, কার ওজন বেশি বদ আমলের। যার যে আমলের ওজন বেশি হবে, সেই অনুযায়ী ফয়সালা হবে।
কর্মের পুরোপুরি প্রতিফল যেহেতু আখিরাতেই দেওয়া হবে, তাই ইহজগতে তা দেখার আশা বৃথা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মন্দকাজ করে, তাকে দুনিয়ায় শাস্তি পেতে না দেখায় এ কথা মনে করা ঠিক না যে, সে বেঁচে গেল। তার শাস্তি আখিরাতের জন্য জমা রাখা হয়েছে। সেখানে তাকে তা ভোগ করতে হবে। তাই পাপকর্ম সত্ত্বেও আরামে জীবন কাটতে থাকলে তার নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়; বরং আখিরাতে কঠিন শাস্তিভোগের ভয়ে নিজেকে সংশোধন করে ফেলা উচিত। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ভালো কাজ করে, তাকে সুফল পেতে না দেখে এ কথা মনে করা ভুল যে, তার চেষ্টা বৃথা গেল। তার তো আখিরাতই লক্ষ্যবস্তু। তাই সে দুনিয়ায় বিনিময়লাভের আশাই করবে না। সে তার নেককাজ দ্বারা জাহান্নাম থেকে বাঁচা ও জান্নাতলাভের প্রত্যাশায় থাকবে।
আয়াতে তারপর জান্নাত ও জাহান্নামের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাত মুমিনদের ঠিকানা। জাহান্নাম কাফের ও ফাসেকদের। যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে জান্নাত লাভ করবে। যার বদ আমলের ওজন বেশি হবে, সে জাহান্নামে যাবে। শেষগতি যদি হয় জাহান্নাম, তবে তা মানবজীবনের চরম ব্যর্থতা। সফল সেই ব্যক্তি, যে জান্নাত লাভ করবে। আয়াতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, তোমরা জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে যাতে জান্নাতবাসী হতে পার আর এভাবে মানব হয়ে জন্মানোকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পার, সেটাকেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নাও এবং সে লক্ষ্যবস্তু সামনে রেখেই ইহজীবন নির্বাহ করো।
সবশেষে সতর্ক করা হয়েছে, পার্থিব জীবনের ধোঁকা ও প্রতারণা সম্পর্কে। অর্থাৎ ইহজীবন নির্বাহের লক্ষ্যবস্তু তো থাকবে পরকালীন জীবনের সফলতা লাভ। তবে সেই লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হতে হলে সতর্কতা অবলম্বন খুব জরুরি। কেননা দুনিয়া বড় প্রতারণাময়। এর সবকিছুতে প্রচণ্ড আকর্ষণ। এর প্রতিটি বস্তু আখিরাত ভুলিয়ে মানুষকে নিজের মধ্যে লিপ্ত রাখতে চায়। এর প্রতিটি বস্তু বড় আকর্ষণীয়রূপে মানুষকে হাতছানি দেয়। সে হাতছানি যে উপেক্ষা করতে পারে, কেবল সেই পরকালীন সফলতা লাভের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে। তা উপেক্ষা করা সহজ হয় মন ও মস্তিষ্কে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত রাখার দ্বারা। তাই এ আয়াত মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং তাকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন কোনও অবস্থায়ই সে তার এ অবধারিত পরিণতির কথা ভুলে না যায়।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. মৃত্যু প্রত্যেক প্রাণীর অবধারিত পরিণতি। কোনও অবস্থায়ই এ কথা ভুলতে নেই।
খ. মৃত্যু বড় যন্ত্রণাময় ও এক কঠিন পরীক্ষা। তখন যাতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়, জীবনের যাবতীয় কাজে সে আশার স্পর্শ থাকা উচিত।
গ. কিয়ামত সত্য। এ বিশ্বাস ঈমানের অঙ্গ।
ঘ. কিয়ামতে মানুষের ইহজীবনের যাবতীয় কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।
ঙ. কর্মফল ভোগের আসল জায়গা যেহেতু আখিরাত, তাই দুনিয়ায় পাপীকে পাপের শাস্তি ভোগ করতে না দেখলে মনে করা উচিত নয় সে বেঁচে গেল।
চ. নেককার ব্যক্তিকে দুনিয়ায় তার নেককাজের সুফল পেতে না দেখলে ভাবা উচিত নয় তার কর্ম বৃথা গেল।
ছ. পরকালের প্রতিদান লাভ করাই হওয়া উচিত যাবতীয় নেককাজের লক্ষ্যবস্তু।
জ. জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য। জাহান্নাম থেকে রেহাই পেয়ে জান্নাত লাভ করতে পারাই মানবজীবনের সফলতা।
ঝ. ইহজীবন বড় প্রতারণাময়। এর মোহে পড়তে নেই।
দুই নং আয়াত
وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ
অর্থ : কোনও প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনও প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে।(সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এটা সূরা লুকমানের সর্বশেষ আয়াতের একটি অংশ। এ আয়াতে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তার প্রকৃত ও পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ (34)
‘নিশ্চয়ই কিয়ামত (-এর ক্ষণ) সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে আছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কী আছে। কোনও প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনও প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত, সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ খবর রাখেন।’
প্রথমে বলা হয়েছে, কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ সম্পর্কে কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন, অন্য কেউ জানে না। কিয়ামত হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কবে হবে, সেই জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা নিজের কাছে গোপন রেখেছেন। তবে তিনি তার কিছু আলামত বলে দিয়েছেন। সে আলামতগুলো প্রকাশ পেতে থাকলে মনে করতে হবে কিয়ামত দিন দিন কাছে আসছে। কিয়ামতের একটি আলামত সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন। তাঁর পর আর কোনও নবী আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর নিয়ে আসা দীনই কার্যকর থাকবে। সুতরাং এ উম্মতই সর্বশেষ উম্মত এবং এর পরে কিয়ামত। যত দিন যেতে থাকবে, ততোই এক এক করে কিয়ামতের নানা আলামত প্রকাশ পেতে থাকবে। সর্বশেষ বড় বড় আলামতগুলোর মধ্যে রয়েছে ইমাম মাহদীর আগমন, আসমান থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দুনিয়ায় নেমে আসা, দাজ্জালের আবির্ভাব, ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব, সবশেষে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা। তারপর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারপর কিয়ামত সংঘটিত হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হল বৃষ্টিবর্ষণ। বৃষ্টি মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি‘আমত। এর দ্বারা মানুষ বহুবিধ উপকার লাভ করে। কোথায় কখন কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বিভিন্ন আলামত দেখে মানুষ এ সম্পর্কে কিছুটা অনুমানমাত্র করতে পারে। কিন্তু পরিপূর্ণ জ্ঞান কেউই লাভ করতে পারে না। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে যা ধারণা হয় তা অনুমানমাত্র, নিশ্চিতসত্য নয়। অনেক সময়ই তা ভুলও প্রমাণিত হয়। সঠিক হলেও ঠিক কতক্ষণ কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা আগেভাগে কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। তা জানেন কেবলই আল্লাহ তা'আলা।
তৃতীয় বিষয় হল মাতৃগর্ভে কী আছে? যা আছে তা পূর্ণ আকৃতির মানবশিশুরূপে দুনিয়ায় আগমন করবে, নাকি আগেই ঝরে পড়বে? তার রং ও রূপ কী হবে? তার শারীরিক শক্তি কেমন হবে? মেধা ও মননশীলতা কী মানের হবে? লম্বা হবে না খাটো? কী আয়ু লাভ করবে? সৎকর্মশীল হবে না পাপী? তার পেশা হবে কী? এরকম আরও কত কী প্রশ্ন! এই যাবতীয় বিষয় গর্ভস্থ ভ্রুণের মধ্যে নিহিত আছে। এমনকি তা লুক্কায়িত রয়েছে গর্ভাশয়ে স্থিত মিশ্র এক বিন্দুর মধ্যে। আল্লাহ ছাড়া এসব বিষয়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান আর কার আছে? কোনও একটি শিশুর নয়; বরং জগতে যত মানবশিশু এসেছে ও আসবে, তাদের সকলের এ যাবতীয় বিষয় আল্লাহ তা'আলার জ্ঞানে পরিপূর্ণরূপে অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান। অপরদিকে কোনও একটি শিশু সম্পর্কেও এই যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান কোনও একজন মাখলুকেরও নেই।
চতুর্থত বলা হয়েছে- وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا (কোনও প্রাণী জানে না আগামীকাল সে কী করবে)। একজন মানুষ প্রতিদিন কত রকম কাজ করে থাকে! একেক অঙ্গের কত বিচিত্র ব্যবহার সে করে! চোখ দিয়ে কত দেখা, কান দিয়ে কত শোনা, মুখের কত বলা, হাতের কত স্পর্শ, পায়ের কত চলা, রয়েছে পেশাগত কাজ, সে কাজের পরিমাণ-পরিমাপ, সময়-স্থান, ধরন-প্রকৃতি, আছে আকস্মিক এসে পড়া কাজ, যা কল্পনায়ও থাকে না, আছে করণীয় কাজ, আছে বর্জনীয় কাজ, বহু বৈচিত্র্যের সমাহারে ঠাসা যে কাজের ফিরিস্তি, সে সম্পর্কে পুরোপুরি তো দূরের কথা, এক-শতাংশও কি আগাম কারও জানা থাকে? কিন্তু মহান আল্লাহ কেবল প্রত্যেকের নয়; সমস্ত সৃষ্টির যাবতীয় কাজ সম্পর্কে আগাম সবকিছু জানেন। সেই অনাদিকাল থেকেই তিনি জানেন কোন গাছের কোন পাতাটি ঠিক কখন ঝরে পড়বে। আল্লাহু আকবার! কী বিপুল ও কী অসীম তাঁর জ্ঞান!
সবশেষে আছে- وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ (কেউ জানে না সে কোন ভূমিতে মারা যাবে)। যেমন জানে না কোথায় মারা যাবে, তেমনি কখন মারা যাবে তাও তার অজানা। ভাবে মারা যাবে এক জায়গায়, কিন্তু সকল ভাবনা-কল্পনা মিথ্যা প্রমাণ করে মারা যায় অন্য কোথাও। এটা যেমন নিজের বেলায় সত্য, তেমনি সত্য অন্যের বেলায়ও। কারও মৃত্যুর স্থান-কাল সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আগাম কেউ কিছুই বলতে পারে না। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার ঘটনা আছে। ঘটনা তো আছে হাজারও। তবে আব্বাসীয় যুগের দুর্দান্ত খলীফা আবূ জা'ফর মানসূরের বড় আগ্রহ ছিল- যদি জানতে পারতেন ঠিক কবে তিনি মারা যাবেন! একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন সাগর থেকে কোনও এক ছায়ামূর্তি হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে কী ইশারা করছে। পরের দিন তিনি বিজ্ঞজনদের কাছে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলেন। কেউ বলল, এর দ্বারা পাঁচ বছর বোঝানো হয়েছে। কেউ বলল, পাঁচ মাস। কেউ বলল, পাঁচ দিন। নানা জনে নানা কথা বলল। কিন্তু খলীফা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, ইমাম আবূ হানীফা রহ.- কে। তিনি বললেন, এর দ্বারা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। অর্থাৎ আপনি কবে মারা যাবেন তা এ পাঁচটি বিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। কেউ আগাম তা বলতে পারবে না।
হযরত আবূ আযযাহ (ইয়াসার ইবন আব্দ) হুযালী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِذَا قَضَى اللَّهُ لِعَبْد أَنْ يَمُوْتَ بِأَرْضِ جَعَلَ لَهُ إِلَيْهَا حَاجَةً، أَوْ قَالَ: بِهَا حَاجَةً
‘আল্লাহ তা'আলা যে বান্দার মৃত্যু যে স্থানে নির্ধারণ করে রাখেন, সে স্থানে তার কোনও প্রয়োজন দাঁড় করিয়ে দেন (ফলে সেখানে সে পৌঁছে যায়, আর তখন তার জান কবজ করে নেওয়া হয়)।(জামে তিরমিযী: ২১৪৭; মুসনাদুল বাযযার: ১৮৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ৭০৬; হাকিম, আল মুসতাদরাক: ১২৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৪২৪)
প্রকাশ থাকে যে, যেসকল বিষয় কেবল আল্লাহ তা'আলাই জানেন, অন্য কেউ জানে না, তা এ পাঁচটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও আছে। যেমন আল্লাহ তা'আলার ফিরিশতার সংখ্যা কত, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
‘তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।’( সূরা মুদ্দাচ্ছির (৭৪), আয়াত ৩১)
সূরা লুকমানের আলোচ্য আয়াতে বিশেষভাবে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে শানে নুযূলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ পাঁচটি বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, আমার স্ত্রী গর্ভবতী। আপনি বলুন সে কী সন্তান জন্ম দেবে? আমাদের এলাকায় খরা চলছে। বলুন কখন বৃষ্টি হবে? আমি কবে জন্ম নিয়েছি তা তো জানি। আপনি বলুন কবে মারা যাব? আজ আমি কী করেছি তা আমার জানা আছে। আপনি বলুন আগামীকাল কী করব? আর বলুন কিয়ামত কবে হবে? সে পরিপ্রেক্ষিতেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কিয়ামতের সুনির্দিষ্ট তারিখ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
খ. কোথায় কখন কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তার পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে।
গ. গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আল্লাহ তা'আলারই আছে। মানুষ যা জানতে পারে তা আংশিক জ্ঞান বা অনুমান মাত্র।
ঘ. আগামীকাল কে কী করতে পারবে, তা আগাম কেউ বলতে পারে না।
ঙ. কে কখন কোথায় মারা যাবে, কারও পক্ষেই তা আগাম বলা সম্ভব নয়।
চ. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান অসীম। আপন সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণরূপে জানা আছে। খুঁটিনাটি কোনওকিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।
তিন নং আয়াত
فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ (61)
অর্থ: তারপর যখন তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে পড়বে, তখন তারা মুহূর্তকালও পেছনে যেতে পারে না এবং সামনেও যেতে পারে না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৬১)
ব্যাখ্যা
এ আয়াত জানাচ্ছে, প্রত্যেকের আয়ু নির্ধারিত। আয়ু ফুরালে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুর সে নির্ধারিত ক্ষণ কেউ টলাতে পারে না। এক মুহূর্ত আগেও আনতে পারে না, এক মুহূর্ত পেছাতেও পারে না। সুতরাং প্রত্যেকের মৃত্যু তার নির্ধারিত সময়েই হয়ে থাকে, তা দুর্ঘটনায় মারা যাক কিংবা কারও হাতে নিহত হোক। যে ব্যক্তি কারও হাতে নিহত হয়, তার মৃত্যু আগে হয়ে যায় এমন নয়। স্বাভাবিক সময়েই হয়। ঘাতককে যে দায়ী করা হয় এবং এজন্য তাকে শাস্তিও দেওয়া হয় তা এ কারণে নয় যে, সে নির্ধারিত সময়ের আগে তার মৃত্যু ঘটিয়েছে। সে হত্যা না করলেও ওই সময়ে তার মৃত্যু হতোই। তার শাস্তি এ কারণে যে, সে তার উপর সীমালঙ্ঘন করল কেন? সে তার উপর প্রাণঘাতী হামলা কেন চালাল, যা কিনা তার জন্য জায়েয ছিল না?
আয়াতটি দ্বারা বোঝা যায় কারও আয়ু বাড়েও না কমেও না। এর উপর প্রশ্ন আসে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও তো জানা যায় বিশেষ আমল দ্বারা আয়ু বাড়ে, যেমন আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, পিতা-মাতার সেবাযত্ন ইত্যাদি, এর উত্তর কী?
এর উত্তর হচ্ছে, আয়ু বাড়া দ্বারা আয়ুতে বরকত হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সেবাযত্ন করবে, আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, আল্লাহ তা'আলা তার আয়ুতে বরকত দেবেন। সে তার নির্ধারিত আয়ুতে এত বেশি কাজ করতে পারবে, যা অন্যরা অনেক বেশি দীর্ঘ আয়ুতেও করতে পারে না।
অনেক আলেম এরকম উত্তরও দিয়েছেন যে, আয়ু বাড়া-কমার বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান হিসেবে নয়; বরং ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসেবে হয়ে থাকে। অর্থাৎ কার মৃত্যু ঠিক কখন হবে তার চূড়ান্ত জ্ঞান আল্লাহ তা'আলারই আছে। সংশ্লিষ্ট ফিরিশতাদেরও এ সম্পর্কে একটা জ্ঞান আছে। তবে তা চূড়ান্ত জ্ঞান নয়। তাদেরকে এভাবে জানিয়ে রাখা হয়েছে যে, অমুক বান্দার আয়ু এত বছর। যদি সে এই এই কাজ করে, তবে তার আয়ু এত বছর বাড়বে। যদি না করে, তবে এরকমই থাকবে। কিন্তু সে তা করবে কি করবে না, তা আল্লাহ তা'আলারই জানা আছে, অন্য কারও নয়। যখন সে ওই কাজটি করে, তখন তার আয়ু বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ বাড়াটা হয় ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসেবে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তো জানেন যে, এ কাজটি সে করবে এবং তার আয়ু হবে এই। তাঁর হিসেবে কিছুই বাড়ল না। সে কথাই আয়াতে বলা হয়েছে যে, কারও আয়ু নির্ধারিত সময় থেকে কিছু বাড়ে-কমে না। আর হাদীছে যে বাড়া-কমার কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহর জ্ঞান হিসাবে নয়; ফিরিশতাদের জ্ঞান হিসাবে।
আয়াতটির শিক্ষা
প্রত্যেকের মৃত্যুর একটা নির্ধারিত সময় আছে। সেই নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু হবেই হবে। আগে বা পরে হবে না। কিন্তু তা ঠিক কখন হবে তা কেউ জানে না। সুতরাং প্রত্যেকের প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (9) وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ (10) وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (11)
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এরকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় করো, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। যখন কারও নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত।(সূরা মুনাফিকুন (৬৩), আয়াত ৯-১১)
ব্যাখ্যা
এগুলো সূরা মুনাফিকূনের শেষ তিন আয়াত। এ সূরায় মুনাফিকের স্বভাব বর্ণিত হয়েছে। পরিশেষে মুমিনদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, তারা যেন মুনাফিকদের মতো না হয়। মুনাফিকরা শরী'আতের হুকুমের উপর সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের আসক্তিকে প্রাধান্য দিত। আল্লাহর হুকুম পালনে গড়িমসি করত। কিন্তু পার্থিব কোনও ক্ষতি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের লক্ষ্য করে বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ (হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে)। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির খাতিরে নামায আদায়ে গাফলতি করো না। হজ্জ করতে গড়িমসি করো না। যাকাত দিতে টালবাহানা করো না। মোটকথা আল্লাহ তা'আলার কোনও আদেশ-নিষেধ পালনে সন্তান-সন্ততি ও মালের মহব্বত যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থেকো। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (14) إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ (15)
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। যদি তোমরা মার্জনা কর ও উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহরই কাছে আছে মহা প্রতিদান।(সূরা তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৪-১৫)
অর্থাৎ স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। দেখা হয় মানুষ এসবের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায় কি না। অন্ধ হওয়ার মানে বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলা, ফ লে শরী‘আতের উপর এদের ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এরূপ হলে সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী, অর্থ-সম্পদ মানুষের পক্ষে শত্রুতুল্য হয়ে যায়। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে তাদের কারণে দীন ও ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিণামে আখিরাতের জীবন ধ্বংস হয়। কোনও কোনও স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দীনদার না হওয়ায় দীন ও ঈমানের ক্ষতিতে সক্রিয় ভূমিকাও রাখে। তাই তাদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অবশ্য সব স্ত্রী ও সকল সন্তান-সন্ততিই এ রকম নয়। এমন বহু নারী আছে, যারা তাদের স্বামীদের দীন ও ঈমান হেফাজত করে এবং নেককাজে তাদের সৎ পরামর্শক ও উত্তম সহযোগী হয়। এমনিভাবে অনেক সৌভাগ্যবান সন্তানও আছে, যারা তাদের পিতা-মাতার দীন ও ঈমানের উন্নতির কারণ হয় এবং তাদের জন্য হয়ে থাকে ‘সদাকায়ে জারিয়া’স্বরূপ।
وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘যারা এরকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে( তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত'। অর্থাৎ যারা সন্তান-সন্ততি ও অর্থ-সম্পদের মোহে আল্লাহর আনুগত্য ভুলে যাবে, আর এভাবে আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেবে ও নশ্বর জগতের ভোগ-উপভোগে লিপ্ত হয়ে অনন্ত স্থায়ী জগতের অকল্পনীয় নি'আমত হাতছাড়া করবে, তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাতে তাদের অর্থ-সম্পদ যত বিপুলই হোক এবং সন্তান- সন্ততির সংখ্যা যত বেশিই হোক আর তারা যত খ্যাতিমানই হোক। কেননা মানবজীবনের সফলতা ধনবান হতে পারার মধ্যেও নয় এবং ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠালাভের মধ্যেও নয়। মানবজীবনের সফলতা হল আখিরাতের নাজাত ও মুক্তিলাভের ভেতর। তা যদি লাভ না হয়, তবে সবকিছুই কেবল ক্ষতিই ক্ষতি। সুতরাং হে মুমিনগণ সতর্ক থেকো, তোমরা যেন সেই ক্ষতির মধ্যে পড়ে না যাও। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় কী? পরের আয়াতে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে-
وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ ‘আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় করো, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে'। অর্থাৎ মৃত্যুর আলামত শুরু হয়ে যাওয়ার আগে আগেই আমার দেওয়া জীবিকা থেকে আমার পথে ব্যয় করো। তোমাদের ধন-সম্পদ তো আমারই দেওয়া। আমি তা এজন্য দিইনি যে, তোমরা তার মোহে পড়ে যাবে, তা দ্বারা বিলাসিতা করবে এবং তার সঞ্চয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। বরং দিয়েছি এজন্য যে, আমার দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক সঠিক খাতে খরচ করবে এবং তা দ্বারা কে কতবেশি ছাওয়াব হাসিল করতে পার, পরস্পরে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে। সুতরাং তোমরা তা-ই করতে থাকো। গড়িমসি করো না। যে-কোনওদিন মৃত্যু এসে পড়বে। কবে আসবে তা কেউ জানে না। তাই আগে আগেই আল্লাহর পথে খরচ করে তা দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় করতে থাকো। মৃত্যু এসে গেলে তখন কেবল আক্ষেপই করতে পারবে। কিন্তু সে আপেক্ষ কোনও কাজে আসবে না। তখন আল্লাহকে ডেকে সময় চাবে আর বলবে, একটু সময় পেলে আমি তোমার পথে দান-খয়রাত করব এবং নেককার লোকদের মতো কাজকর্ম করে আমিও তাদের একজন হয়ে যাব। কিন্তু আল্লাহর বিধান অটল।তিনি যার জন্য মৃত্যুর যে সময় নির্দিষ্ট করে রখেছেন, তার কোন ব্যতিক্রম হবে না। ফলে আক্ষেপ নিয়েই তোমাদের কবরে যেতে হবে। তারচে' এখনই সাবধান হও এবং সমস্ত উদাসীনতা পরিত্যাগ করে আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয়ে সচেষ্ট হও।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে পড়ে আল্লাহর আনুগত্যে অবহেলা করা প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।
খ. অর্থের প্রাচুর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রতিষ্ঠালাভের মধ্যে কোনও সফলতা নেই, যদি না তা দীনী উন্নতিলাভে সহায়ক হয়।
গ. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে আল্লাহর আনুগত্যে অবহেলার করতে নেই। কেননা তা মানবজীবনের চরম ক্ষতি বয়ে আনে।
ঘ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতসমূহে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে হবে এখনই। ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা যাবে না।
ঙ. মৃত্যু যে-কোনও সময় হাজির হয়ে যেতে পারে। তাই আখিরাতের জন্য যা-কিছু করার তা করতে হবে এখনই।
চ. আল্লাহর পথে খরচ করাসহ যে-কোনও দীনী কাজে বিলম্ব করলে তা মৃত্যুকালে আক্ষেপের কারণ হবে।
ছ. মৃত্যু তার নির্ধারিত সময়ে হবেই। কোনওরূপ আবেদন-নিবেদনে তা পেছাবে না।
পাঁচ নং আয়াত
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ (99) لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ (100) فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (101) فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (102) وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (103) تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ (104) أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ (105) قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ (106) رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ (107) قَالَ اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ (108) إِنَّهُ كَانَ فَرِيقٌ مِنْ عِبَادِي يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ (109) فَاتَّخَذْتُمُوهُمْ سِخْرِيًّا حَتَّى أَنْسَوْكُمْ ذِكْرِي وَكُنْتُمْ مِنْهُمْ تَضْحَكُونَ (110) إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (111) قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (112) قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ (113) قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (114) أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (115)
অর্থ : পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে,হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ওয়াপেস পাঠিয়ে দিন, যাতে আমি যা (অর্থাৎ যে দুনিয়া) ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে সৎকাজ করতে পারি। কখনও না। এটা একটা কথার কথা, যা সে মুখে বলছে মাত্র। তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে ‘বরযখ’, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে। আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে। (তাদেরকে বলা হবে) তোমাদেরকে কি আমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো হতো না? কিন্তু তোমরা তা অবিশ্বাস করতে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব। আল্লাহ বলবেন, এরই মধ্যে তোমরা হীন অবস্থায় পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না। আমার বান্দাদের একটি দল দু'আ করত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। তোমরা তখন তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিলে। এমনকি তা (অর্থাৎ তাদেরকে উত্ত্যক্তকরণ) তোমাদেরকে আমার স্মরণ পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তোমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতে। তারা যে সবর করেছিল সে কারণে আজ আমি তাদেরকে এমন প্রতিদান দিলাম যে, তারাই হয়ে গেল কৃতকার্য। (তারপর) আল্লাহ (জাহান্নামীদেরকে) বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছ? তারা বলবে, আমরা এক দিন বা এক দিনেরও কম থেকেছি। (আমাদের ভালো মনে নেই) কাজেই যারা (সময়) গুনেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন। আল্লাহ বলবেন, তোমরা অল্পকালই থেকেছিলে। কতইনা ভালো হতো যদি এ বিষয়টা তোমরা (আগেই) বুঝতে! তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না?(সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৯৯-১১৫)
ব্যাখ্যা
এখানে সূরা মুমিনূনের ৯৯ থেকে ১১৫ পর্যন্ত মোট ১৭টি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মৃত্যুকালীন অবস্থা, বরযখের বর্ণনা, কিয়ামতের পরিস্থিতি, মীযানে আমল ওজন করার বর্ণনা, জাহান্নামের বিভীষিকাময় শাস্তির বিবরণ, জাহান্নামে জাহান্নামীদের আক্ষেপ ও সেখান থেকে তাদের মুক্তিদানের আবেদন এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার উত্তর ও তাদের কৃতকর্মের জন্য তিরস্কার প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা। সর্বপ্রথম মৃত্যুকালে পাপীগণ আক্ষেপ করে যা বলবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ (পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যাবে, তখন তারা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ওয়াপস পাঠিয়ে দিন)। এ বাক্যটির সম্পর্ক এর আগের ৯০ বা ৯১ নং আয়াতের সঙ্গে। তাতে বলা হয়েছিল, অবিশ্বাসীগণ অনবরত সত্য অস্বীকার করে ও মিথ্যাচার করে এবং তারা আল্লাহ সম্পর্কে নানা অবান্তর ও অসত্য কথাবার্তা বলে। তারা তা থেকে কোনওক্রমেই ক্ষান্ত হয় না। সারাটা জীবন এভাবে অবাধ্যতার মধ্যে কাটিয়ে দেয়। তারপর এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, পরিশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, মৃত্যুর ফিরিশতাদের দেখতে পায় এবং কঠিন মৃত্যুযন্ত্রণার সম্মুখীন হয়, তখন তাদের হুঁশ হয়। তখন বুঝতে পারে নবী- রাসূলগণ যা বলেছেন তাই সত্য। সে সত্য অস্বীকার করে তারা চরম ভুল করেছে। তখন তারা সে ভুলের প্রতিকার করার পথ খোঁজে। তাই আল্লাহ তা'আলার কাছে আবেদন জানায় যে, আমাকে ফিরিয়ে দিন। আমার মৃত্যু পিছিয়ে দিন। শেষবারের মতো সুযোগ দিন।
لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ ‘যাতে আমি যা (অর্থাৎ যে দুনিয়া) ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে সৎকাজ করতে পারি'। এর আরেক অর্থ হতে পারে- আমি যে ঈমান ও সৎকর্ম পরিত্যাগ করেছি, যাতে তা অবলম্বন করতে পারি। অর্থাৎ সময় দিলে আমি ঈমান আনব এবং সৎকর্ম করব। আরেক অর্থ হতে পারে- আমি দুনিয়ায় যে সম্পদ ছেড়ে এসেছি, যা আমি আপনার মর্জি মোতাবেক খরচ করিনি এবং তা দ্বারা কোনও পুণ্য কামাই করিনি, এবার সময় পেলে আমি সে সম্পদ দ্বারা সৎকাজ করব। তা আপনার সন্তুষ্টির পথে খরচ করব। মোটকথা মৃত্যু অবস্থা দেখে পাপী ব্যক্তি তার পরবর্তী অশুভ পরিণাম আঁচ করতে পারে। তাই সে মৃত্যু থেকে বাঁচতে চায়। সামনে অগ্রসর হতে চায় না। পেছনের জীবনে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মুমিনদের অবস্থা হয় এর বিপরীত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ أَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ، وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللَّهِ كَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ» قَالَتْ عَائِشَةُ أَوْ بَعْضُ أَزْوَاجِهِ: إِنَّا لَنَكْرَهُ المَوْتَ، قَالَ: «لَيْسَ ذَاكِ، وَلَكِنَّ المُؤْمِنَ إِذَا حَضَرَهُ المَوْتُ بُشِّرَ بِرِضْوَانِ اللَّهِ وَكَرَامَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ، فَأَحَبَّ لِقَاءَ اللَّهِ وَأَحَبَّ اللَّهُ لِقَاءَهُ، وَإِنَّ الكَافِرَ إِذَا حُضِرَ بُشِّرَ بِعَذَابِ اللَّهِ وَعُقُوبَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَكْرَهَ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ، كَرِهَ لِقَاءَ اللَّهِ وَكَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ»
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করে, আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পসন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করে, আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করেন। এ সময় উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্য কোনও স্ত্রী বলে ওঠেন, আমরা তো অবশ্যই মৃত্যুকে অপসন্দ করি (তাহলে তো আল্লাহও আমাদের সাক্ষাৎকে অপসন্দ করে থাকবেন)! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বিষয়টা তা নয়। বস্তুত যখন কোনও মুমিনের মৃত্যু হাজির হয়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর পক্ষ থেকে সম্মান দেওয়ার সুসংবাদ শোনানো হয়। তখন তার কাছে তার সামনে যা আছে (মৃত্যু ও তার পরবর্তী ধাপসমূহ) তার চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছু হয় না। তখন সে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে পসন্দ করে। আর আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে পসন্দ করেন। অপরদিকে যখন কোনও কাফের ব্যক্তির মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর আযাব ও অশুভ পরিণামের সংবাদ দেওয়া হয়। তখন তার কাছে তার সামনে যা-কিছু আছে তারচে' বেশি অপসন্দনীয় আর কিছুই থাকে না। ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করে এবং আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অপসন্দ করেন।’(সহীহ বুখারী: ৬৫০৭; সহীহ মুসলিম: ২৬৮৩; জামে' তিরমিযী : ২৩০৯; সুনানে নাসাঈ : ১৮৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৪৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩০০৯)
কাফেরগণ যখন উল্লিখিত ফরিয়াদ করবে, তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হবে-كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا (কখনও না। এটা একটা কথার কথা, যা সে মুখে বলছে মাত্র)। অর্থাৎ তারা শাস্তির ভয়ে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে ফরিয়াদ করে যে বলবে 'আমাকে ফিরিয়ে দিন, আমি সৎকর্ম করব', এটা কখনও ঘটার নয়। কেননা মৃত্যুর যে সময় নির্ধারিত করা আছে তা কিছুতেই টলার নয় এবং মৃত্যুর পর দুনিয়ায় ফিরে আসারও কোনও অবকাশ নেই। আর তারা যে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা বলছে, তাও সত্য নয়। সারকথা এটা তাদের একটা কথা মাত্র, যা কোনওভাবেই পূর্ণ হওয়ার নয়।
وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে ‘বরযখ’, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে'। ‘বরযখ’ বলা হয় কবরকে। কারও মতে মৃত্যু হতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়কে। উভয় মতের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। বোঝানো উদ্দেশ্য তারা যে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে, এটা ঘটবেই এবং এর পর পুনরুত্থান দিবস তথা কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে কবরেই অবস্থান করতে হবে। সেখান থেকে দুনিয়ায় ফিরে আসার কোনও অবকাশ নেই। এ বরযখের জগৎও বড় কঠিন। সেখানে ইহজগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। আবার আখিরাতের আযাবেরও কিছু নমুনা সেখানে প্রকাশ পায়। পুনরুত্থান না হওয়া পর্যন্ত সে আযাবের মধ্যেই কাটাতে হবে। এখন এ মৃত্যুতেই তোমরা এমন ঘাবড়াচ্ছ। তাহলে সেই বরযখের জগতে তোমাদের কেমন অবস্থা হবে? তারপর সেখান থেকে জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে। সেখানকার পরিস্থিতি আরও কঠিন। ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (অতঃপর যখন সিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এর ব্যাখ্যা করেন যে, আখিরাতে মানুষ বংশ-গোত্র নিয়ে গৌরব করবে না, যেমন দুনিয়ায় করে থাকে। এবং সেখানে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করবে না যে, তুমি কোন গোত্রের, তোমার বংশতালিকা কী, যেমন দুনিয়ায় জিজ্ঞেস করে থাকে। কিয়ামত বড় বিভীষিকাময়। সে বিভীষিকা মানুষকে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে। হযরত ইবন আব্বাস রাযি. আরও বলেন, এটা শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সময়কার কথা। সে ফুৎকারে মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সকলেই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। আল্লাহ তা'আলা যাকে চান কেবল সেই ব্যতিক্রম থাকবে। তারপর শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে আপন স্থান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যাবে এবং হয়রান হয়ে তাকিয়ে থাকবে। সে সময় সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (27)
‘তারা একে অন্যের অভিমুখী হয়ে পরস্পরে সওয়াল-জওয়াব করবে।(সূরা সাফ্ফাত (৩৭), আয়াত ২৭)
তবে বিশুদ্ধ মত হল আলোচ্য আয়াতে শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়ার পরের কথা বলা হয়েছে, যে ফুঁকের পর সকলেই জীবিত হয়ে উঠবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. বলেন, কিয়ামতের দিন বান্দা বা বান্দীর হাত ধরে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষের সামনে দাঁড় করানো হবে। তারপর একজন ঘোষক ঘোষণা করবে, এ ব্যক্তি অমুকের পুত্র অমুক। এর কাছে কারও কিছু পাওনা থাকলে সে যেন এসে তার পাওনা নিয়ে নেয়। তখন সে ব্যক্তি বড় খুশি হবে। কারণ তার প্রাপ্য রয়েছে তার পিতার কাছে, তার সন্তানের কাছে, তার স্ত্রীর কাছে বা তার ভাইয়ের কাছে। সে তার হক আদায় করে নেবে। তারপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. পাঠ করেন- فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না)।(ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ ওয়ার-রাকাইক: ১৪১৬)
সূরা ‘আবাসায় ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (34) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (35) وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (36) لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ (37)
‘যেদিন মানুষ তার ভাই থেকেও পালাবে এবং নিজ পিতা-মাতা থেকেও এবং নিজ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকেও। (কেননা) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে।’(সূরা ‘আবাসা (৮০), আয়াত ৩৪-৩৭)
উল্লেখ্য, এটা কাফেরদের অবস্থা। মুমিনদের অবস্থা এর থেকে ভিন্ন। মুমিনদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ
‘যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের ক্ষেত্রে তাদের অনুগামী হয়েছে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে তাদের সাথে মিলিয়ে দেব।’(সূরা তৃর (৫২), আয়াত ২১)
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন মুসলিম সন্তানগণ তাদের পিতা- মাতাকে পানি পান করাবে। এমনকি মায়ের পেট থেকে যে শিশু অসম্পূর্ণরূপে জন্ম নেয়, সেও সেদিন আল্লাহর কাছে আরয করবে যে, আমি আমার পিতা-মাতা ছাড়া জান্নাতে যাব না। এর দ্বারা বোঝা যায় মুমিনদের মধ্যকার বংশীয় সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।
এ আয়াতে যে বলা হয়েছে 'সেদিন কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না', অপরদিকে সূরা সাফ্ফাতে বলা হয়েছে- وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (তারা একে অন্যের অভিমুখী হয়ে পরস্পরে সওয়াল-জওয়াব করবে), এর মধ্যে বাহ্যত বিরোধ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা কিয়ামতের দিন বিভিন্ন রকম অবস্থা হবে। কখনও এমন কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হবে যে, মানুষ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, ভয়ে আতঙ্কে কারও দিকে ফিরে তাকানোরও অবকাশ পাবে না। প্রত্যেকে নিজের চিন্তায় বিভোর থাকবে। আবার কখনও ভয়-ভীতি কিছুটা হালকা হবে। তখন একে অন্যের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে এবং খোঁজখবর নেবে।
فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে)। অর্থাৎ সেদিন মীযান ও দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে। যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে মুক্তিলাভ করবে এবং জান্নাতের অধিকারী হবে। যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পায় ও জান্নাতের অধিকারী হয়, সেই প্রকৃত সফলকাম।
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে)। অর্থাৎ যারা ঈমান আনেনি; বরং কুফর অবলম্বন করেছিল, তারা জান্নাতের বদলে জাহান্নাম খরিদ করেছে। নিঃসন্দেহে জান্নাতের বিনিময়ে জাহান্নাম গ্রহণ করাটা ভয়ানক লোকসানের ব্যবসা। তাদেরকে চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনওদিন তারা মুক্তি পাবে না।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে কাফেরদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, আর এর আগের আয়াতে সৎকর্মশীল মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছিল। গুনাহগার মুমিনদের অবস্থা এখানে বর্ণনা করা হয়নি। অন্যান্য আয়াত ও হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, তাদের বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি ক্ষমা করলে শুরুতেই তারা জান্নাতে যাবে। অন্যথায় তারা তাদের পাপ অনুপাতে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। শাস্তিভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ঈমানের বদৌলতে তারা মুক্তি পাবে। পরিশেষে তারাও জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে যাবে। সেখানে তারা অনন্তকাল বাস করবে।
تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ (আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে)। এরূপ অবস্থা হবে কাফেরদের। পাপী মুমিনদের চেহারা আগুনে দগ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ قَوْمًا يُخْرَجُوْنَ مِنَ النَّارِ يَحْتَرِقُوْنَ فِيْهَا، إِلَّا دَارَاتِ وُجُوهِهِمْ حَتَّى يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ
‘একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে, যারা জাহান্নামে দগ্ধীভূত হবে, তবে তাদের মুখমণ্ডল নয়। পরিশেষে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।(সহীহ মুসলিম : ১৯১; ইবন মান্দাহ, আল-ঈমান: ৮৫৯)
আয়াতে বলা হয়েছে, জাহান্নামে তাদের চেহারা বীভৎস হয়ে যাবে। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
تَشْوِيهِ النَّارُ فَتَقَلَّصُ شَفَتُهُ العُلْيَا حَتَّى تَبْلُغَ وَسَطَ رَأْسِهِ وَتَسْتَرْخِي شَفَتُهُ السُّفْلَى حَتَّى تَضْرِبَ سُرَّتَهُ
‘জাহান্নাম তাকে এমনভাবে দগ্ধ করবে যে, তার উপরের ঠোঁট সংকুচিত হয়ে যাবে। এমনকি তা মাথার তালু পর্যন্ত পৌছে যাবে। আর নিচের ঠোঁট যাবে ঢিলা হয়ে। এমনকি তা নাভি স্পর্শ করবে।’(জামে' তিরমিযী: ২৫৮৭; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা: ১৩৬৭;; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪৪১৭)
أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ (তাদেরকে বলা হবে) তোমাদেরকে কি আমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো হতো না? কিন্তু তোমরা তা অবিশ্বাস করতে'। অর্থাৎ কাফেরদের তিরস্কার করে বলা হবে যে, তোমাদের কাছে তো আমার আয়াতসমূহ পৌঁছানো হয়েছিল। তোমাদের সামনে তা পাঠ করা হয়েছিল। কিন্তু তোমরা তা অস্বীকার করেছিলে। তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলে। এখন দেখো তা কতটা সত্য ছিল। যদি তখন তোমরা এতে বিশ্বাস করতে, তবে আজ তোমাদের এ পরিণতি হতো না।
قَالُوا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ (তারা বলবে,হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়)। দুর্ভাগ্য বলে সম্ভবত তাদের কুপ্রবৃত্তি ও মনের খেয়াল-খুশি বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের খেয়াল-খুশির কাছে হেরে গিয়েছিলাম। মন যখন যা চাইত তাই করতাম। মনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আপনার আয়াত অস্বীকার করেছিলাম। আর এভাবে আমরা সত্য-সঠিক পথ গ্রহণ না করে ভুল পথে চলেছিলাম।
رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ (হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব)। অর্থাৎ আপনি আমাদেরকে আরেকবার সুযোগ দিন। আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন। আমরা ওয়াদা করছি এবার আমরা আপনার অনুগত হয়ে চলব। আপনার অবাধ্যতা করব না। যদি পুনরায় সেরকম করি, তবে আমরা জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হব। নিজেদের প্রতি অবিচারকারী বলে গণ্য হব। তখন আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দিলে আমরা মুক্তিলাভের জন্য আপনার কাছে ফরিয়াদ করব না। এর উত্তরে আল্লাহ বলবেন-
اخْسَئُوا فِيهَا وَلَا تُكَلِّمُونِ (এরই মধ্যে তোমরা হীন অবস্থায় পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না)। অর্থাৎ আবেদন-নিবেদনের স্থান ছিল দুনিয়া। তোমরা সে জায়গা পার হয়ে এসেছ। এটা শাস্তিভোগের জায়গা। কাজেই আর কোনও অনুনয়-বিনয় নয়, এখানে লাঞ্ছিত অবস্থায় পড়ে থাকো। তোমরা এ শাস্তি হতে নিষ্কৃতি পাবে না। অতঃপর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে তারা মুক্তিলাভের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে যাবে।
হাসান বসরী রহ. বলেন, এটাই হবে দোযখবাসীদের সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার সর্বশেষ কথা। তারপর তারা অনুতাপে কুকুরের মতো চিৎকার করতে থাকবে, যা তারা নিজেরাও বুঝবে না, অন্য কাউকেও বোঝাতে পারবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. বলেন, জাহান্নামবাসীরা (জাহান্নামের দায়িত্বে নিযুক্ত ফিরিশতাদের প্রধান) মালেককে ডেকে বলবে, হে মালেক! তোমার রব্ব আমাদের কাজ শেষ করে দিন। মালেক ৪০ বছর তাদের উপেক্ষা করবেন, কোনও উত্তর দেবেন না। তারপর এই বলে উত্তর দেবেন যে, তোমাদেরকে এখানেই থাকতে হবে। তারপর তারা তাদের রব্বকে ডেকে বলবে, হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে এখান থেকে বের করুন। আমরা যদি আবারও আগের মতো করি, তবে আমরা অবশ্যই জালেম ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হব। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দুনিয়ার বয়সের দ্বিগুণকাল পরিমাণ উপেক্ষা করবেন। কোনও উত্তর দেবেন না। তারপর এই বলে উত্তর দেবেন যে, তোরা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামের ভেতর থাক। আমার সঙ্গে কোনও কথা বলিস না। ফলে তারা নিরাশ হয়ে যাবে। এরপর আর তারা একটি কথাও বলবে না। কেবল তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাবে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন- إِنَّهُ كَانَ فَرِيقٌ مِنْ عِبَادِي يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ (আমার বান্দাদের একটি দল দু'আ করত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু)। অর্থাৎ আমার বান্দাদের এক দল আমার প্রতি বিশ্বাস রাখত। তারা আমার আনুগত্য করত। আমার আদেশ-নিষেধ মেনে চলত। কখনও ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে সেজন্য ইস্তিগফার ও ক্ষমাপ্রার্থনা করত। তারা আমার দয়া ও রহমতের আশাবাদী ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল আমি পরম দয়ালু, তাদের প্রতি দয়ার আচরণ করব। সে বিশ্বাসে তারা আমার কাছে রহমত প্রার্থনা করত এবং রহমতলাভের উপযুক্ত আমল করতে সচেষ্ট থাকত (বলাবাহুল্য রহমত পাওয়ার উপযুক্ত আমল হচ্ছে শরী'আত অনুযায়ী আমল করা)। তাদের সে আমল ছিল তোমাদের আমলের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এ কারণে তোমরা তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاتَّخَذْتُمُوهُمْ سِخْرِيًّا حَتَّى أَنْسَوْكُمْ ذِكْرِي وَكُنْتُمْ مِنْهُمْ تَضْحَكُونَ (তোমরা তখন তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিলে। এমনকি তা তোমাদেরকে আমার স্মরণ পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তোমরা তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতে)। অর্থাৎ তারা দীন ও শরী'আত মানত বলে তোমরা তাদেরকে নানাভাবে উপহাস করতে। তাদেরকে পাগল বলতে। নির্বোধ ঠাওরাতে। সেকেলে ও পশ্চাদপদ গণ্য করতে। তার বিপরীতে নিজেদেরকে মনে করতে সভ্য ও প্রগতিশীল। তোমরা তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও নিজেদের অহংকার-অহমিকায় মত্ত থাকার কারণে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। আমি যে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা, তোমাদের পালনকর্তা আর এ কারণে আমার আনুগত্য করা তোমাদের অবশ্যকর্তব্য, সে কথা একবারও মনে করনি। উল্টো আমার অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকেছিলে। আর এভাবে তোমরা আমার হকও নষ্ট করেছিলে এবং বান্দার হকও নষ্ট করেছিলে। ফলে তোমরা ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত থাকনি। এখন জাহান্নামে চিরদিন শাস্তি ভোগ করতে থাকো।
إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ (তারা যে সবর করেছিল সে কারণে আজ আমি তাদেরকে এমন প্রতিদান দিলাম যে, তারাই হয়ে গেল কৃতকার্য)। অর্থাৎ তোমরা যে আমার অনুগত বান্দাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে ও নানাভাবে কষ্ট দিতে, তাতে তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। তারা ধৈর্যের সঙ্গে নিয়মিত আমার ইবাদত-বন্দেগীও আঞ্জাম দিয়েছিল। আজ আমি তাদেরকে সে ধৈর্যের সুফল দিয়েছি। আমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত রেখে জান্নাতের বাসিন্দা করে দিয়েছি। সুতরাং আজ তারাই সফল আর তোমরা ব্যর্থ।
قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ (আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে বছরের গণনায় কত কাল থেকেছ)? অর্থাৎ তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু মনে করেছিলে। আখিরাতের কথা ভুলে দুনিয়া নিয়েই মত্ত থেকেছিলে। তারপর তোমাদের মৃত্যু হল। তোমরা কবরে একটা দীর্ঘকাল কাটালে। হাশরের ময়দানে বিচারের অপেক্ষায়ও থাকলে দীর্ঘ সময়। তারপর এখন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করছ। তা যেই দুনিয়াকে সবকিছু মনে করেছিলে এবং যার জন্য কবরের আযাব, হাশরের বিভীষিকা ও জাহান্নামের শাস্তি সবই গ্রহণ করে নিলে, এবার বলো সেই দুনিয়ায় তোমরা কতদিন কাটিয়েছিলে? দুনিয়ার তুচ্ছ ভোগ-উপভোগ কতদিনের জন্য পেয়েছিলে?
قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلِ الْعَادِّينَ ‘তারা বলবে, আমরা এক দিন বা এক দিনেরও কম থেকেছি। (আমাদের ভালো মনে নেই) কাজেই যারা (সময়) গুনেছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন'। অর্থাৎ কাফেরগণ পৃথিবীতে তাদের অবস্থানকালকে খুবই অল্প মনে করবে। একদিন বা তারও কম। এত অল্প মনে করবে এ কারণে যে, কবর-হাশর ও জাহান্নামবাসের কালটা অনেক দীর্ঘ। সে তুলনায় দুনিয়ার জীবন এমনিতেই অতি অল্প। তারপর আবার শাস্তি ও দুঃখ-কষ্টের সময়টা বাস্তব অপেক্ষাও দীর্ঘ মনে হয়। যে ব্যক্তি সে কষ্টের মধ্যে থাকে, সে তার আগের সুখের কালটাকে অতি সংক্ষিপ্ত মনে করে। তাছাড়া তাদের পার্থিব জীবন তো অতীতের কথা। তা শেষ হয়ে গেছে। এখন আখিরাতের জীবন ভোগ করছে, যার কোনও শেষ নেই। অনন্ত অশেষ কালের তুলনায় সীমিত ও শেষ হয়ে যাওয়া কালের কোনও তুলনা চলে কি?
যাহোক চরম কষ্টের মধ্যে থাকার কারণে তারা দুনিয়ার জীবনের পরিমাণটা সঠিক মনে করতে পারবে না। তাই তারা বলবে, আপনি গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন। অর্থাৎ সেসব ফিরিশতাদেরকে, যারা মানুষের আমল ও কাজকর্মের হিসাব রাখে। তারা পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে ভালো জানে। তারাই এর সঠিক হিসাব দিতে পারবে।
قَالَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘আল্লাহ বলবেন, তোমরা অল্পকালই থেকেছিলে। কতইনা ভালো হতো যদি এ বিষয়টা তোমরা (আগেই) বুঝতে'। অর্থাৎ এই আখিরাতের দৈর্ঘ্য ও স্থায়িত্বের তুলনায় দুনিয়ার জীবন ছিল অতি ক্ষণস্থায়ী। তোমরা যদি দুনিয়ায় থাকা অবস্থায়ই বুঝতে যে, তা অতি সংক্ষিপ্ত জীবন, অল্পদিন পরেই শেষ হয়ে যাবে, তারপর এই অনন্ত জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে, তবে তা তোমাদের জন্য কতইনা কল্যাণকর হতো! তখন তোমরা আমার অবাধ্যতা করতে না। মনের কামনা-বাসনা পূরণের পেছনে পড়ে জীবন নষ্ট করতে না। বরং আখিরাতের এ জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। ফলে আজ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেয়ে মুমিনদের মতো জান্নাতবাসী হয়ে যেতে। কিন্তু আফসোস! তোমরা এসব চিন্তা করনি। দুনিয়া নিয়েই বিভোর ছিলে। ফলে আজ তোমাদেরকে তার খেসারত তো দিতেই হবে।
আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন যে কত সংক্ষিপ্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ করেছেন-
واللَّهِ ما الدُّنْيا في الآخِرَةِ إلَّا مِثْلُ ما يَجْعَلُ أحَدُكُمْ إصْبَعَهُ هذِه -وأَشارَ يَحْيَى بالسَّبَّابَةِ- في اليَمِّ، فَلْيَنْظُرْ بمَ تَرْجِعُ؟
‘আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এরকম, যেমন তোমাদের কেউ তার তর্জনী আঙ্গুল সাগরে রাখল, তারপর উঠিয়ে নিল, এবার দেখুক আঙ্গুলটি কী পরিমাণ পানি নিয়ে এসেছে।’(সহীহ মুসলিম : ২৮৫৮; জামে' তিরমিযী : ২৩২৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১০৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ১১৭৯৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪৩০৬; সহীহ ইবন হিব্বান। ৪৩৩০)
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ (তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না)? অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى (36)
‘মানুষ কি মনে করে তাকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে?(সূরা কিয়ামাহ (৭৫), আয়াত ৩৬)
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে মোটেই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। বরং আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এজন্য যে, তোমরা আমাকে চিনবে এবং আমার আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগী করবে। তোমরা তার ঠিক কতখানি কর, তা লক্ষ রাখা হবে। এটা তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। দুনিয়ার গোটা জীবনই তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা। একসময় তোমাদের মৃত্যু হবে। তারপর তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন তোমাদেরকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় বিষয়ের হিসাব দিতে হবে। তোমরা আমার কতটুকু আনুগত্য করেছ এবং কতটুকু অবাধ্যতা করেছ, কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছ এবং কতটুকু অকৃতজ্ঞতা করেছ, তার পরিপূর্ণ হিসাব তোমাদের থেকে নেওয়া হবে। তোমাদেরকে এমনি এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে না। হিসাব দেওয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ তোমরা জান্নাত লাভ করবে। আর হিসাব দিতে ব্যর্থ হলে তোমাদের পরিণাম হবে জাহান্নামের শাস্তি। সুতরাং এসব বিষয় স্মরণ রেখেই তোমাদের ইহজীবন যাপন করা উচিত। হাকীম তিরমিযী রহ. বলেন, আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর বান্দা ও দাসরূপে। তাদের কর্তব্য তাঁর বন্দেগী ও দাসত্ব করা। তা করলে তিনি তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন আর না করলে শাস্তি দেবেন। তারা তাঁর বন্দেগী করলে একদিকে তারা হবে আল্লাহর গোলাম, অন্যদিকে দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু হতে থাকবে মুক্ত ও স্বাধীন এবং থাকবে সম্মানিত ও ইসলামী জগতের বাদশা হয়ে। আর যদি তাঁর বন্দেগী পরিহার করে, তবে তারা সাব্যস্ত হবে পলাতক গোলাম। থাকবে হীন ও লাঞ্ছিত। আর আখিরাতে তারা আল্লাহর দুশমনরূপে বহুস্তরবিশিষ্ট আগুনের কারাগারে বন্দি থাকবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. মৃত্যু মানুষের অবধারিত পরিণতি। সে কথা ভুলতে নেই।
খ. মৃত্যুকালে পাপী বান্দাগণ আক্ষেপ করবে। কিন্তু সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না।
গ. যা-কিছু সৎকর্ম করার, তা এখনই করা চাই। যে-কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। তখন কিছু করার অবকাশ থাকবে না।
ঘ. আল্লাহর দেওয়া জীবন, ধন-সম্পদ ও অন্যসব নি'আমত সৎকর্মে ব্যবহার করা চাই।
ঙ. মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়কে বরযখের জগৎ বলা হয়। সুদীর্ঘ সে সময়টা যাতে আযাব থেকে নিরাপদ থাকা যায়, তাই নেক আমলের মধ্যে জীবন কাটানো চাই।
চ. কিয়ামত হবে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার দ্বারা। এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
ছ. আখিরাতে দুনিয়ার বংশপরিচয় ও বংশগৌরব কোনও কাজে আসবে না।
জ. হাশরের ময়দান বড় বিভীষিকাময়। সেখানে কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না।
ঝ. মীযানে মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে। এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখা ফরয।
ঞ. যার নেক আমলের ওজন বেশি হবে, সে হবে জান্নাতবাসী। আর যার বদ আমলের ওজন বেশি হবে, তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।
ট. জাহান্নামের আযাবে পাপীদের চেহারা বীভৎস হয়ে যাবে।
ঠ. আল্লাহ তা'আলার প্রতিটি আয়াতকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং আয়াত পাঠকালে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া ও বিনয় প্রদর্শন করা কর্তব্য।
ড. শরী'আত উপেক্ষা করে মনের খেয়াল-খুশিমতো চলা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।
ঢ. কাফের ব্যক্তিকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে। কখনও সেখান থেকে মুক্তি পাবে না।
ণ. মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করা, তাঁর কাছে দু'আ করা, তাওবা ও ইস্তিগফার করা এবং আল্লাহ তা'আলার রহমতের আশাবাদী থাকা।
ত. দীনদার ও গরীব-দুঃখীকে উপহাস করা কাফের ও ফাসেকদের কাজ। মুমিনদেরকে এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
থ. যে ব্যক্তি অন্যকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, সে আল্লাহ তা'আলার যিকির ও স্মরণ ভুলে যায়।
দ. অন্যের ঠাট্টা-বিদ্রুপে সবর করা চাই। এটা আখিরাতে সফলতালাভের একটি উপায়।
ধ. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন নিতান্তই অল্প।
ন. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার নগণ্যতা স্মরণ রাখা নেক আমলে মশগুল থাকার পক্ষে সহায়ক।
প. মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী। এটা না করার দ্বারা মানবজীবন বৃথা হয়ে যায়।
ফ. বেহুদা কাজ করা আল্লাহ তা'আলার শান নয়। মানুষেরও কোনও বেহুদা কাজ করা উচিত নয়।
ব. পুনরুত্থান ও আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রত্যাবর্তন মানুষের জন্য আল্লাহর অবধারিত বিধান।
ছয় নং আয়াত
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (16)
অর্থ: যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে? এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে মুমিনদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে- তারা যেন অলসতা ছেড়ে আমলে যত্নবান হয়। যেন গুনাহ পরিহার করে সৎকর্মে মনোযোগী হয়। মনের খেয়াল-খুশি দমন করে শরী'আতের অনুসরণে বদ্ধপরিকর হয়। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে যাবে। আত্মসংশোধনের এখনই সময়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা বলেন-
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ (যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণে)? যিকির অর্থ স্মরণ। আল্লাহর স্মরণ মানে আল্লাহ তা'আলা যে আমাদের খালেক ও মালিক, এ কথা চিন্তা করা। আরও চিন্তা করা যে, তিনি সর্বশক্তিমান ও অন্তর্জামী এবং তিনি দয়াময় ও শাস্তিদাতা। সুতরাং তিনি মানুষকে তাদের ভালোমন্দ কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল দেবেন। যারা ভালো কাজ করবে তাদেরকে জান্নাতে পুরস্কৃত করবেন এবং যারা মন্দ কাজ করবে তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দেবেন। এসব কথা চিন্তা করে আল্লাহ তা'আলার শাস্তির ভয়ে মনে মনে কেঁপে ওঠা আর তার ফলশ্রুতিতে যাবতীয় পাপকর্ম ছেড়ে দেওয়া। এমনিভাবে তাঁর রহমতের আশায় মন মাতানো আর তার ফলশ্রুতিতে সৎকর্মে লেগে পড়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
‘মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২)
যিকিরের আরেক অর্থ উপদেশ। সে হিসেবে এর অর্থ হবে- মুমিনদের কি সে সময় আসেনি যে, আল্লাহর উপদেশ শুনে তাদের মন গলবে? অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদে মানুষকে নানাভাবে যে উপদেশ দিয়েছেন এবং তা ছাড়াও জগতের বিচিত্র ঘটনাবলি দ্বারা যে উপদেশগ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন, মানুষের উচিত সময় ক্ষেপণ না করে এখনই সেসব উপদেশ গ্রহণ করা আর তার ফলস্বরূপ অলসতা ছেড়ে শরী'আতের আদেশ-নিষেধ মানায় তৎপর হয়ে যাওয়া। কারণ অলসতার সময় একদম নেই। যে- কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। তখন আর কোনওকিছু করার সুযোগ থাকবে না।
وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে (তাদের অন্তর বিগলিত হবে)'? 'সত্য' দ্বারা কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে। কুরআন মাজীদ আল্লাহ তা'আলার সত্য কিতাব। এটা কোনও মানুষের রচনা নয়। কুরআনের ভাষার সৌন্দর্য ও শক্তি, ভাবের গভীরতা ও ব্যপ্তি, এর দুর্দান্ত প্রভাব ও তাছির এবং তত্ত্ব ও তথ্যের ঐশ্বর্যের ভেতর দৃষ্টিপাত করলেই এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সুতরাং সত্যগ্রহণের মনোভাবে যে ব্যক্তি এ পবিত্র গ্রন্থ পড়বে বা শুনবে আর এর আয়াতসমূহে চিন্তা করবে, সে অবশ্যই মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে যাবে। এর প্রতিটি শব্দ ও বাক্য তার হৃদয় স্পর্শ করবে। সে রোমাঞ্চিত হবে। তার দেহমন কেঁপে উঠবে এবং অবিলম্বে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হয়ে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনে বদ্ধপরিকর হয়ে যাবে।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর স্মরণে মন নরম হওয়া ও মন গলে যাওয়ার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। মনের এ গুণ ঈমান-আমলে অগ্রগতির পক্ষে খুব সহায়ক। তাই এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা জরুরি। অন্যথায় ক্ষতির আশঙ্কা যথেষ্ট। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَوَّلُ مَا يُرْفَعُ مِنَ النَّاسِ الْخُشُوعُ
‘মানুষের ভেতর থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিস তুলে নেওয়া হবে তা হল খুশু' (মনের ভয় ও বিগলন)।(তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৭১৮৩; সহীহ ইবন হিব্বান : ৪৫৭২)
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ ‘এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য'। অতীতের কিতাবী জাতিসমূহ নিজ নিজ কিতাবের নির্দেশনা ভুলে মনের খেয়াল-খুশিমতো চলতে শুরু করে। তারা ধরে নিয়েছিল দুনিয়ায় অনেক দিন বাঁচব। তাই কিছুদিন ফুর্তি করে নিই। এভাবে তারা পাপকর্মে মগ্ন হয়ে যায়। এর ফলে তাদের অন্তর আস্তে আস্তে শক্ত হতে থাকে। অন্তর যখন শক্ত হয়ে যায়, তখন কোনও উপদেশ কাজে আসে না। শাস্তির ধমক শুনলেও মনে কোনও পরিবর্তন দেখা দেয় না। শেষপর্যন্ত বেঈমানরূপে কবরে যেতে হয়। অতীত জাতিসমূহের তাই হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ উম্মতকে সতর্ক করছেন যে, তোমরা তাদের মতো হয়ো না। ইহজীবনকে লম্বা মনে করো না। তা মনে করলে মন শক্ত হয়ে যাবে। তখন কোনও আদেশ-উপদেশের তাছির তোমাদের অন্তরে পড়বে না। মৃত্যুর কথা স্মরণ করো। তাতে মন নরম থাকবে। দুনিয়ার সময় বড় সংক্ষিপ্ত। যে-কোনও সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে। তাই গড়িমসি না করে দ্রুত নেককাজে লেগে পড়ো।
এ আয়াত দ্বারা মন শক্ত হয়ে যাওয়ার কুফল সম্পর্কে জানা গেল। তাই এ সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকা দরকার। যেসব কাজে মন শক্ত হয়, কিছুতেই তাতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ، وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ الْقَلْبُ الْقَاسِي
‘আল্লাহর যিকির ছাড়া অন্য কথা বেশি বলো না। কেননা আল্লাহর যিকির ছাড়া বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। আর মানুষের মধ্যে আল্লাহ হতে সর্বাপেক্ষা দূরে থাকে ওই ব্যক্তি, যার মন শক্ত।’(জামে' তিরমিযী: ২৪১১; মুআত্তা মালিক: ২০৭৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩১৮৭৯)
হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. একবার বসরাবাসীদের সামনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর সে বক্তৃতায় তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
وَلَا يَطُولَنَّ عَلَيْكُمُ الأمَدُ فَتَقْسُوَ قُلُوبُكُمْ، كما قَسَتْ قُلُوبُ مَن كانَ قَبْلَكُمْ،
‘সাবধান! তোমরা কিছুতেই তোমাদের আয়ুকে দীর্ঘ মনে করো না। তাহলে তোমাদের অন্তর শক্ত হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের মন শক্ত হয়ে গিয়েছিল।(সহীহ মুসলিম: ১০৫০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ৩৪৮২৩; তহাবী: ২০৩৫)
উল্লেখ্য, আলোচ্য এ আয়াত অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। মনোযোগের সঙ্গে পড়লে বা শুনলে অন্তরে এর দারুণ প্রভাব পড়ে। আয়াতটি বহু লোকের জীবন বদলের কারণ হয়েছিল। বুযুর্গ ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ. ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. উল্লেখযোগ্য। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. শুরুতে এক আয়েশী ও ফুর্তিবাজ যুবক ছিলেন। গানবাদ্য করে বেড়াতেন। এক রাতে তিনি তাঁর ফলের বাগানে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। খুব পানাহার চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর তানপুরা(বীণাসদৃশ তারযন্ত্র) ও বেহালা নিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুতেই সুর ওঠে না। তিনি আনমনা হয়ে যান। এমন তো কখনও হয় না! সহসা তিনি হাতের বাদ্যযন্ত্র থেকে এক অপূর্ব ধ্বনি শুনতে পান। তিনি কান পাতেন। লক্ষ করে দেখেন তাতে ধ্বনিত হচ্ছে- …أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?...’। অমনি তিনি বলে উঠেন, অবশ্যই সেই সময় এসে গেছে হে আল্লাহ! এই বলে তিনি বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলেন। বন্ধুদের বিদায় করে দেন। তারপর তাওবা করে নতুন জীবন শুরু করে দেন। অতঃপর তিনি ইলম, আমল, আখলাক তথা মানবীয় উৎকর্ষে কত উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, তা দীনদার মুসলিমমাত্রই জানে।
ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-এরও জীবনবদলে এ আয়াতখানি ভূমিকা রেখেছিল। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন এক দস্যু। এক তরুণীর জন্য পাগল ছিলেন। কোনও এক রাতে সেই তরুণীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তিনি দেয়াল টপকে যেই না বাড়ির ভেতর ঢুকবেন, অমনি শুনতে পান কোথা এক পাঠক পাঠ করছে - …أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে?...’। আয়াতখানি যেন তাঁর বুকের উপর এক চাপড় মারল। বুকের দেয়াল ভেদ করে সে চাপড়ে তাঁর হৃদয় কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, অবশ্যই হে আল্লাহ! আমার সেই সময় এসে গেছে। এই বলে তিনি দৌড় দিলেন এবং পাশের এক জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এরই মধ্যে সেখান থেকে এক যাত্রীদল যাচ্ছিল। তাদের একজন বলছিল, সাবধান হও! দস্যু ফুযায়লের দল কিন্তু এরই আশেপাশে থাকে। কথাটি ফুযায়ল রহ, শুনে ফেললেন। তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, ওহে কুযায়ল! রাতের বেলা পাপ করতে বের হয়েছ। আবার তুমি এতটাই বরবাদ হয়েছ যে, মুসলিম যাত্রীদল তোমার ভয়ে তটস্থ থাকে। তিনি আর সময় নিলেন না। তখনই তাওবা করলেন। তারপর চলে গেলেন বায়তুল্লাহ শরীফে। সারাটা জীবন সেখানেই কাটিয়ে দিলেন। আজ মহান বুযুর্গ ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ.-কে কে না চেনে?
আয়াতটির শিক্ষা
ক. সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। যে-কোনও সময় মৃত্যু হাজির হয়ে যাবে। কাজেই নিজেকে শোধরানোর এখনই সময়।
খ. আল্লাহর স্মরণে মন নরম ও বিগলিত হওয়া ঈমানের দাবি।
গ. কুরআন আল্লাহর নাযিল করা কিতাব ও পরম সত্য বাণী।
ঘ. দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আশা ও মৃত্যুকে দূরবর্তী মনে করার দ্বারা মন শক্ত হয়ে যায়।
ঙ. পক্ষান্তরে আল্লাহর যিকির, মৃত্যুর স্মরণ ও আয়কে স্বল্প মনে করার দ্বারা মন নরম ও বিগলিত হয়।
চ. শক্ত মন নেক আমলে আগ্রহী হয় না এবং তা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকে।
ছ. ঈমানদারদের অতীত জাতিসমূহের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ইহজীবন যাপন করতে হবে যে দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে
হাদীছ নং: ৫৭৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থেকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বলতেন, তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ৬৪১৬; জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১১৪; মুসনাদে আহমাদ: ৪৭৬৪; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬৯৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫১২)
হাদীছ নং: ৫৭৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থেকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বলতেন, তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ৬৪১৬; জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১১৪; মুসনাদে আহমাদ: ৪৭৬৪; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬৯৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫১২)
مقدمة الامام النووي
65 - باب ذكر الموت وقصر الأمل
قَالَ الله تَعَالَى: {كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُورِ} [آل عمران: 185]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْري نَفْسٌ بأيِّ أرْضٍ تَمُوتُ} [لقمان: 34]، وقال تَعَالَى: {فَإذَا جَاءَ أجَلُهُمْ لاَ يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلاَ يَسْتَقْدِمُونَ} [النحل: 61]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تُلْهِكُمْ أمْوَالُكُمْ وَلاَ أوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ الله وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولئِكَ هم الْخَاسِرُونَ وَأنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأتِيَ أَحَدَكُمُ المَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلاَ أخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَريبٍ فَأصَّدَّقَ وأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللهُ خَبيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ} [المنافقون: 9 - 11]، وقال تَعَالَى: {حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ المَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلّي أعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلاَّ إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يبْعَثُونَ فَإذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلاَ أنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَومَئِذٍ وَلاَ يَتَسَاءلُونَ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأولئِكَ الَّذِينَ خَسرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ تَلْفَحُ وَجَوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي [ص:194] تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ} إِلَى قَوْله تَعَالَى: { ... كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْئَلِ العَادِّينَ قَالَ إنْ لَبِثْتُمْ إِلاَّ قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُم تَعْلَمُونَ أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لاَ تُرْجَعُونَ} [المؤمنون: 99 - 115]، وقال تَعَالَى: {أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِم الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ} [الحديد: 16]، وَالآيات في الباب كَثيرةٌ معلومة.
قَالَ الله تَعَالَى: {كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُورِ} [آل عمران: 185]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْري نَفْسٌ بأيِّ أرْضٍ تَمُوتُ} [لقمان: 34]، وقال تَعَالَى: {فَإذَا جَاءَ أجَلُهُمْ لاَ يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلاَ يَسْتَقْدِمُونَ} [النحل: 61]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تُلْهِكُمْ أمْوَالُكُمْ وَلاَ أوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ الله وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولئِكَ هم الْخَاسِرُونَ وَأنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأتِيَ أَحَدَكُمُ المَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلاَ أخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَريبٍ فَأصَّدَّقَ وأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللهُ خَبيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ} [المنافقون: 9 - 11]، وقال تَعَالَى: {حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ المَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلّي أعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلاَّ إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يبْعَثُونَ فَإذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلاَ أنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَومَئِذٍ وَلاَ يَتَسَاءلُونَ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأولئِكَ الَّذِينَ خَسرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ تَلْفَحُ وَجَوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي [ص:194] تُتْلَى عَلَيْكُمْ فَكُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ} إِلَى قَوْله تَعَالَى: { ... كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْئَلِ العَادِّينَ قَالَ إنْ لَبِثْتُمْ إِلاَّ قَلِيلًا لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُم تَعْلَمُونَ أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لاَ تُرْجَعُونَ} [المؤمنون: 99 - 115]، وقال تَعَالَى: {أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِم الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ} [الحديد: 16]، وَالآيات في الباب كَثيرةٌ معلومة.
573 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما، قَالَ: أخذ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - بِمِنْكَبي، فَقَالَ: «كُنْ في الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ».
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ رضي الله عنهما، يقول: إِذَا أمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أصْبَحتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ. رواه البخاري. (1)
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ رضي الله عنهما، يقول: إِذَا أمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أصْبَحتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ. رواه البخاري. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. হাদীসটি একটি বিখ্যাত হাদীস। আমাদের অনেকেরই তা মুখস্থ আছে। অন্তত এর সরল ভাব ও মর্ম তো প্রায় সকলেরই জানা আছে। হাদীসের ইমামগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এই মোবারক হাদীসটি সংকলন করেছেন।
উপরের হাদীসে দুটো অংশ আছে : প্রথমটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী। আর দ্বিতীয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর বাণী। হাদীস-শাস্ত্রের পরিভাষা-অনুসারে প্রথমটিকে বলা হবে ‘মারফূ‚’ বর্ণনা। অর্থাৎ যে বর্ণনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, কর্ম, সম্মতি কিংবা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে।
আর দ্বিতীয় অংশটি, যাতে ইবনে ওমর রা.-এর বাণী উল্লেখিত হয়েছে, তাকে বলা হবে, ‘মাওকূফ’। অর্থাৎ যে বর্ণনা সাহাবী পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় কোনো সাহাবীর কথা, কাজ বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে। সাধারণভাবে ‘মাওকূফ’ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এ শব্দের অন্য ব্যবহারও আছে, তবে তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
আমাদের হাদীসের ইমামগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এত সতর্ক ছিলেন যে, বর্ণনায় মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্যও খুব যত্নের সাথে পরীক্ষা করতেন। তাদের নীতি এই ছিল যে, বর্ণনাটি উপর থেকে যেভাবে আসছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। যা উপর থেকে সাহাবীর বাণী হিসেবে বর্ণিত হয়ে এসেছে তাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। প্রত্যেক বর্ণনা আপনরূপে থাকতে হবে। এরপর সেই বর্ণনার বিষয়বস্তুর সূত্র-সন্ধান, অর্থাৎ সাহাবী এই কথাটি কোত্থেকে বলেছেন- তা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। সাহাবী যখন বলেছেন তা তো আল্লাহর রাসূলের কথাই হবে, কিংবা কথাটি তো খুব সুন্দর কথা, ধর্মীয় কথা, কাজেই একে আল্লাহর রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করে দেওয়া যায়- এজাতীয় চিন্তা তাদের কাছে শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা হিসেবে গণ্য ছিল। আর তাই মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্য না করা ছিল তাঁদের দৃষ্টিতে অনেক বড় শাস্ত্রীয় দোষ।
সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রেই যখন এই কথা তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য। বস্তুত দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণের এরকম সচেতনতা ও সতর্কতার কারণেই দ্বীন সংরক্ষিত থেকেছে এবং তা আমাদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে।
হাদীস শরীফের প্রথম অংশ
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
কাঁধে হাত দেওয়া স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করে। উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে তা অধিকতর ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবীকে আন্তরিকতার সাথে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা মুমিন-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। প্রিয় সাহাবীকে সম্বোধন করলেও এ শিক্ষা সকল মুমিনের জন্য- ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
ভিনদেশী বা পথিকজনের মতো হওয়ার অর্থ কী? হাদীসের ভাষ্যকারগণ এর ব্যাখ্যায় যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-
পৃথিবীর এই ঘর মানুষের স্থায়ী ঘর নয়। এখানে সে ক্ষণস্থায়ী, তাকে তার স্থায়ী ঘরে ফিরে যেতে হবে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এই মহাসত্য স্মরণ রাখা তার কর্তব্য। এই সত্য স্মরণ রাখার যে প্রভাব তার চিন্তা ও কর্মে পড়বে তা নিম্নরূপ :
এক. মুমিন কিছুতেই দুনিয়ার ব্যাপারে মোহগ্রস্ত হবে না এবং দুনিয়াকেই তার স্থায়ী আবাস হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তাই আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সবকিছু থেকে সে নিজেকে যত্নের সাথে দূরে সরিয়ে রাখবে।
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় একথাটি এভাবে লিখেছেন-
مَعْنَى الْحَدِيثِ : لَا تَرْكَنْ إِلَى الدّنْيَا وَلَا تَتّخِذْهَا وَطَنًا، وَلَا تُحَدِّثْ نَفْسَكَ بِالْبَقَاءِ فِيهَا، وَلَا تَتَعَلّقْ مِنْهَا بِمَا لَا يَتَعَلّقُ بِهِ الْغَرِيبُ فِي غَيْرِ وَطَنِهِ.
দুই. দুনিয়ায় তার আগমনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে। মানুষ তো দুনিয়াতে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার জন্য আসেনি। সে এসেছে আল্লাহর বান্দা হয়ে, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য। দুনিয়ার জীবনে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব পালন করে তাকে তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে উপরের কথাটি এভাবে বলেছেন-
...فَالْمَرْءُ فِي الدّنْيَا كَعَبْدٍ أَرْسَلَهُ سَيِّدُهُ فِي حَاجَةٍ إِلَى غَيْرِ بَلَدِهِ، فَشَأْنُهُ أَنْ يُبَادِرَ بِفِعْلِ مَا أُرْسِلَ فِيهِ، ثُمّ يَعُودَ إِلَى وَطَنِهِ، وَلَا يَتَعَلّقُ بِشَيْءٍ غَيْرِ مَا هُوَ فِيهِ.
তিন. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলবে না। সর্বদা তা স্মৃতিতে জাগ্রত রাখবে। আখিরাতকে চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে। দুনিয়ার জীবনকে সে গ্রহণ করবে আখিরাতের জীবনের প্রস্তুতির সুযোগ ও অবসর হিসেবে।
ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে কথাটি এভাবে বলেছেন-
وَقَالَ غَيْرُهُ : الْمُرَادُ أَنْ يُنَزِّلَ الْمُؤْمِنُ نَفْسَهُ فِي الدّنْيَا مَنْزِلَةَ الْغَرِيبِ، فَلَا يَعْلَقُ قَلْبَهُ بِشَيْءٍ مِنْ بَلَدِ الْغُرْبَةِ، بَلْ قَلْبُهُ مُتَعَلِّقٌ بِوَطَنِهِ الّذِي يَرْجِعُ إِلَيْهِ، وَيَجْعَلُ إِقَامَتَهُ فِي الدّنْيَا لِيَقْضِيَ حَاجَتَهُ وَجِهَازَهُ لِلرّجُوعِ إِلَى وَطَنِهِ، وَهَذَا شَأْنُ الْغَرِيبِ، أَوْ يَكُونُ كَالْمُسَافِرِ لَا يَسْتَقِرّ فِي مَكَانٍ بِعَيْنِهِ، بَلْ هُوَ دَائِمُ السّيْرِ إِلَى بَلَدِ الْإِقَامَةِ.
এককথায় এ হাদীসটি হচ্ছে মানব-জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শেষ গন্তব্য, দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ ও ক্ষণস্থায়িত্ব এবং এইসকল কিছুর আলোকে দুনিয়াতে মুমিনের জীবন যাপনের পন্থা সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ হাদীসে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার কথা বলা হয়নি। তা স্বাভাবিকও নয়, মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। হাদীস শরীফে দুনিয়ার বিষয়ে মোহগ্রস্ত না হওয়ার, হারাম ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার, পার্থিব বৈধ কাজকর্মে সীমাতিরিক্ত মগ্ন না হওয়ার এবং আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে শরীয়তের শিক্ষা ও বিধানের আলোকে জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরও বিভিন্ন স্তর হতে পারে। উপরোক্ত হাদীস শরীফেও তাকওয়ার একাধিক স্তরের দিকে ইশারা আছে। ‘ভীনদেশী’ ও ‘পথিক মুসাফিরের’ মধ্যকার পার্থক্যটুকু হচ্ছে এই দুই স্তরের মধ্যকার পার্থক্য। উভয়ের লক্ষ্য ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য অভিন্ন হলেও পর্যায়গত কিছু পার্থক্যও আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিল এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-
مَا لِي وَلِلدّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدّنْيَا إِلاّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمّ رَاحَ وَتَرَكَهَا.
দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে ঐ সওয়ারের মতো যে এক বৃক্ষের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে এরপর তা ছেড়ে চলে গিয়েছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৩৭৭
সাহাবায়ে কেরামের জীবনযাত্রা সাধারণভাবে ‘ভীনদেশী’ কিংবা ‘পথিক মুসাফির’- এই দুই পর্যায়ের কোনো এক পর্যায়েরই ছিল।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর নসীহত
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাঁর প্রিয় সাহাবীকে উপদেশ দিয়েছেন তেমনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্টদের নসীহত করেছেন। দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর নসীহত ও কল্যাণকামিতার ধারা অব্যাহত থাকা উচিত।
ইবনে ওমর রা.-এর উপদেশের মর্মবাণীও হচ্ছে, দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহ হওয়া এবং পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ করা।
إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ.
‘সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা কোরো না, আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কোরো না।’ অর্থাৎ পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ কর আর আখিরাতের সঞ্চয় যথাসম্ভব দ্রুত অর্জন কর।
পার্থিব আয়-উপার্জন ইত্যাদির ক্ষেত্রে লম্বা লম্বা প্রত্যাশা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ সত্যের উপলব্ধি খুবই কার্যকর যে, দুনিয়ার জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। যে কোনো সময় মৃত্যু এসে হাজির হয়ে যেতে পারে। কাজেই পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশার জালে জড়িয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। অতএব পার্থিব ক্ষেত্রে ঝামেলা কমিয়ে আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করাই বাঞ্ছনীয়।
কবি বলেন-
نسير إلي الآجال في كل لحظة+ وأيامنا تطوى وهن مراحل
ولم أر مثل الموت حقا كأنه+ إذا ما تخطته الأماني باطل
وما أقبح التفريط في زمن الصبا+فكيف به والشيب للرأس شاعل
ترحل من الدينا بزاد من التقى+ فعمرك أيام وهن قلائل
অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই ‘নির্ধারিত সময়’-এর দিকে। জীবনের প্রতিটি দিন এই অগস্ত্যযাত্রারই একেকটি মঞ্জিল, যা একে একে পিছিয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর মতো এমন অবধারিত সত্য আর দেখিনি, যা পার্থিব আশা-আকাক্সক্ষার ভীড়ে এমনই বিস্মৃত যে, তা যেন একেবারেই মিথ্যে।
জীবনের প্রভাতে শৈশবকালেও তো সময়ের অপচয় অগ্রহণযোগ্য, তাহলে প্রৌঢ়ত্বে যখন মাথার চুলে পাক ধরে- তখন তা কেমন?
কাজেই বন্ধু! সাবধান হও! পৃথিবী থেকে যখন যাবে, যেন তাকওয়ার সম্বল নিয়ে যেতে পার- সেই চিন্তা কর। পার্থিব জীবন তো অল্প কটি দিনই মাত্র।
আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উদ্যমী ও তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ইবনে ওমর রা. বলেছেন-
وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.
অর্থাৎ ভালো কাজের ক্ষেত্রে অলসতা না করে বর্তমানকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ একে তো জীবন ক্ষণস্থায়ী; যে কোনো সময় মৃত্যুর ডাক এসে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত জীবনের সময়টুকুও নির্ঝঞ্ঝাট-সক্ষমতার মধ্যে কাটবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই জীবন-যৌবন এবং সুস্থতা ও সক্ষমতার বিদ্যমান সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার কাম্য। যেন দিন শেষে অতীত সময়ের অপচয়ের জন্য আফসোস করতে না হয়।
اغتنم في الفراغ فضل ركوع+ عسى أن يكون موتك بغتة
كم صحيح مات من غير سقم+ ذهبت نفسه الصحيحة فلتة
অর্থাৎ অবসর সময়ে যদি একটি রুকুও বেশি করতে পার তাতে অবহেলা করো না/কে জানে, হঠাৎ কখন মৃত্যু এসে পড়ে/কত সুস্থ লোক রোগ-ব্যাধি ছাড়াই মারা গেছে/তার নিরোগ প্রাণ অকস্মাৎ উড়ে গেছে।
স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে সচেতন করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصِّحّةُ وَالفَرَاغُ.
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার ব্যাপারে বহু মানুষ লোকসান-গ্রস্ত : সুস্থতা ও অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে নসীহত করে বলেছেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচ বিষয়ের আগে গনীমত মনে করো : তোমার যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতা আসার আগে, তোমার সচ্ছলতাকে অসচ্ছলতা আসার আগে, তোমার অবসরকে ব্যস্ততা আসার আগে, আর তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার আগে। -আলমুসতাদরাক, হাকেম, হাদীস ৭৮৪৬
কাজেই কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সৎকর্মে মশগুল থাকার মাধ্যমে বিদ্যমান সময়-সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক নিয়ত এবং সৎ ও উপযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই মানুষের জীবন সাফল্যমণ্ডিত হয়। কবি বলেন-
إنا لنفرح بالأيام نقطعها+ وكل يوم مضى يدني من الأجل
فاعمل لنفسك قبل الموت مجتهدا+ فإنما الربح والخسران في العمل
আমাদের দিন কাটছে তাই আমরা আনন্দে মেতে উঠি/অথচ চলে যাওয়া প্রতিটি দিন আমাদের নিকটবর্তী করছে সেই নির্ধারিত সময়ের/মৃত্যু আসার আগেই নিজের কল্যাণে কর্ম-প্রয়াসে মগ্ন হও/দিন শেষে লাভ-লোকসান তো কর্মেরই নিরিখে।
مضى أمسك الماضي شهيدا معدِّلا+ واعقبه يوم عليك جديد
فإن كنت بالأمس اقترفت إساءة+ فثن بإحسان وأنت حميد
فيومك إن اعتبته عاد نفعه+ عليك وماضي الأمس ليس يعود
ولا ترجئ فعل الخير يوما إلى غدٍ+ لعل غدًا يأتي وأنت فقيد.
অর্থাৎ তোমার বিগত দিনটি ভালো-মন্দের সাক্ষী হয়ে চলে গেছে/এখন তার জায়গায় এসেছে একটি নতুন দিন। গতকাল যদি ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে আজ ভালো কাজের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ কর/যে দিন গেছে তা তো আর কিছুতেই আসবে না, তবে আজকের এই দিনটাকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তাহলে এর সুফল অবশ্যই পাবে/কাজেই আজ যে ভালো কাজ সম্ভব তা আগামীকালের জন্য রেখে দিও না/এমনও তো হতে পারে যে, আগামী কাল আসবে কিন্তু তুমি থাকবে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
২. এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে দুনিয়ায় অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এক মহান শিক্ষক। তাঁর শিক্ষার্থী সাহাবীগণকে বেজায় ভালোবাসতেন। যে ভালোবাসার পরিচয় মেলে এ শিক্ষাদানকালে সাহাবীর প্রতি তাঁর আচরণের ভেতরেও। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর দু'কাঁধ ধরেন, যাতে তিনি তাঁর শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন এবং অন্যসব লিপ্ততা থেকে বিমুখ হয়ে পরিপূর্ণরূপে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করেন। দু'কাঁধ ধরে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ভেতর শিক্ষার বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তারও ইঙ্গিত বহন করে। বলাবাহুল্য, এরূপ আচরণ এমন কারও সঙ্গেই করা হয়ে থাকে, যার প্রতি অন্তরে ভরপুর স্নেহ-মমতা বিরাজ করে। এমন গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি কাউকে শিক্ষা দেওয়া হয় তা সে শিক্ষার্থীর মনে গভীর রেখাপাত করে, ফলে সে তা কখনও ভুলতে পারে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বললেন- كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيْبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ (তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক)। غَرِيْب মানে প্রবাসী, বিদেশে বসবাসকারী। যে ব্যক্তি বিদেশে বসবাস করে সে ওই দেশকে কখনও তার নিজের দেশ মনে করে না। একদিন এ দেশ ছেড়ে তাকে তার নিজের দেশে চলে যেতে হবে, এ কথাটি মাথায় রেখেই সে সব কাজ করে। সে যা-কিছু উপার্জন করে তা ওই দেশে খরচ করে ফেলে না; বরং নিজ দেশে পাঠায়, যাতে নিজ দেশের ঘরবাড়ি আবাদ হয় এবং ফিরে আসার পর সুখে-শান্তিতে সেখানে বসবাস করতে পারে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বিদেশীর মত জীবনযাপনে উপদেশ দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে, তুমি ইহজগৎকে বিদেশ বলেই গণ্য করবে। এ জগৎকে নিজের দেশ মনে করবে না। সুতরাং তোমার মূল পুঁজি অর্থাৎ আয়ুষ্কাল এবং তোমার যাবতীয় যোগ্যতা ও সক্ষমতা ইহকাল নির্মাণে খরচ করে ফেলো না; বরং তোমার প্রকৃত দেশ আখিরাত গড়ার পেছনে খরচ করো। ইহকালের পেছনে খরচ করবে কেবল ততটুকুই, যতটুকু এখানে থাকার জন্য প্রয়োজন হয়। এর অতিরিক্ত সবটাই আখিরাতের কাজে ব্যবহার করবে।
عَابِرُ سَبيْلٍ এর অর্থ পথিক। তুমি দুনিয়ায় থাকবে পথিকের মত। প্রকৃতপক্ষে তুমি একজন পথিকই বটে। তুমি অবিরাম আখিরাতের পথে চলছ। তোমার এই চলা শেষ হবে মৃত্যুতে। পথিক ব্যক্তি ক্ষণিকের জন্য কোনও পান্থশালায় বা গাছতলায় বিশ্রাম করে। তারপর আবার চলা শুরু করে। সে পান্থশালা বা গাছতলাকে নিজের বাসস্থান ও ঠিকানা মনে করে না। তাই একে নির্মাণ করা বা এর সাজানো-গোছানোর প্রতি সে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয় না। ক্ষণিকের অবস্থানের জন্য যতটুকু ঝাড়পোছের দরকার হয়, ব্যস অতটুকুই করে। তো তুমি যখন আখিরাতের পথের পথিক, তখন এ দুনিয়াকে পান্থশালা বা গাছতলার বেশি কিছু মনে করবে না। একজন পথিক পান্থশালা বা গাছতলার প্রতি যতটুকু মন দেয়, কেবল ততটুকুই। তোমার মূল ফিকির থাকবে আখিরাত। কিভাবে সেখানে মুক্তি পাবে, কিভাবে সেখানে নিবাস গড়ে তুলবে, সেটাই হবে তোমার জীবনের মূল লক্ষ্যবস্তু। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
إِنَّمَا هٰذِهِ الْحَيُوةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ
‘এই পার্থিব জীবন তো তুচ্ছ ভোগ মাত্র। নিশ্চয়ই আখিরাতই অবস্থিতির প্রকৃত নিবাস।’ ২২৩
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য হাদীছের এ শিক্ষাটি সরাসরি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে দিলেও এর উদ্দেশ্য ব্যাপক। তাঁর মাধ্যমে উম্মতের সকলকেই এ নসীহত করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দুনিয়ায় এভাবেই বসবাস করতেন। তিনি বলেন-
مَا لِي وَلِلدُّنْيَا ؟ مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اِسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا
'দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়ায় তো আমি একজন মুসাফিরস্বরূপ, যে কোনও গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করে, তারপর তা ছেড়ে চলে যায়।' ২২৪
কুরআন-হাদীছের যাবতীয় শিক্ষার মূলকথা এটাই যে, দুনিয়াকে নিজের আসল ঠিকানা মনে করো না। তোমার আসল ঠিকানা জান্নাত। এখানে যতদিন থাক, সেই ঠিকানার নির্মাণ ও বিন্যাসে সচেষ্ট থেকো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
'আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। '২২৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ
'হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।' ২২৬
সারকথা, আমরা ওই গোলামের মত, যাকে তার মনিব বিশেষ কাজের জন্য কোথাও পাঠিয়েছে। সে গোলামের যেমন কর্তব্য সেখানে গিয়ে অন্য কাজে মশগুল না হয়ে যে কাজের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, তারপর কাজ শেষ হওয়ামাত্র মনিবের কাছে ফিরে আসা, তেমনি আমাদেরও কর্তব্য দুনিয়ায় আমাদেরকে যে কাজে পাঠানো হয়েছে মৌলিকভাবে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, অন্য কোনও কাজে বিভোর না হওয়া। পরিশেষে মৃত্যুর মাধ্যমে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যকর্ম সম্পাদনকারী বান্দারূপে মহামনিব আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা আমাদের পাঠিয়েছেন দুনিয়াদারী করার জন্য নয়; বরং ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। তাই ইবাদত-বন্দেগীই হবে আমাদের আসল ব্যস্ততা। দুনিয়ার কাজকর্ম করব যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। তাতেও দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা।
কোনও কোনও বর্ণনায় এ হাদীছটির শেষে আরও আছে-
وَعُدَّ نَفْسَكَ فِي أَهْلِ القُبُوْرِ
(নিজেকে কবরবাসীদের একজন গণ্য করো)। ২২৭
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর উপদেশ
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তিনি উপদেশটি দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য বিখ্যাত তাবি'ঈ মুজাহিদ রহ.-কে।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- إِذَا أَمْسَيتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الْمَسَاء (তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না)। অর্থাৎ তোমার যখন সন্ধ্যা হয় তখন আর এই ভরসা করো না যে, ভোর পর্যন্ত বাঁচবে এবং পরের দিনটি পাবে। এমনিভাবে যখন ভোর হয় তখনও সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার ও আগামী রাত পাওয়ার ভরসায় থেকো না। হতে পারে এটাই তোমার শেষ রাত বা এটাই তোমার শেষ দিন।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হল কেমন আছেন? তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি কেমন থাকতে পারে বলে মনে কর, যে ব্যক্তি প্রতিদিন আখিরাতের দিকে এক এক মঞ্জিল করে অগ্রসর হচ্ছে?
দাউদ তাঈ রহ. বলতেন, রাত ও দিন কতগুলো মঞ্জিলের নাম। মানুষ প্রতিদিন ও প্রতি রাতে এক এক মঞ্জিল করে সামনে এগোচ্ছে। তার শেষ মঞ্জিল হবে ওইখানে, যেখানে তার সফর শেষ হবে। তোমার কর্তব্য প্রতি মঞ্জিলে তার পরবর্তী মঞ্জিলের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা। সফর শেষ হওয়ার দিন খুব কাছে। অতি নিকটে। তাই পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। যা করার তা দ্রুত করে ফেলো।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. প্রতি রাতে ঘুমাবার সময় পরিবারের লোকজনকে বলতেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। হয়তো এ ঘুমই হবে আমার শেষ ঘুম। আমার আর জাগা হবে না।
সা'ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলতেন, মুমিন ব্যক্তি যে দিনটিই পায় সেটাই তার বাড়তি লাভ।
সুতরাং এই যে রাত তুমি পেলে, এটা নষ্ট করো না। এ দিন নষ্ট করো না। এ সময়ের যা কাজ তা এখনই করে ফেলো। রাতের কাজ রাতেই সেরে ফেলো, দিনের জন্য রেখে দিয়ো না। এমনিভাবে দিনের কাজ দিনেই সেরে ফেলো, রাতের জন্য রেখে দিয়ো না।
বেঁচে থাকার ভরসায় দিনের কাজ রাতের জন্য বা রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়া হলে তা আর সহজে করা হয়ে ওঠে না। এতে করে কাজ জমতে থাকে। কর্তব্যকর্ম পড়ে থাকে। আরও বেঁচে থাকার ভরসা অন্তরে আলস্য সৃষ্টি করে। যত বেশি কাল বেঁচে থাকার আশা রাখা হয়, কাজে অলসতাও ততো বেশি হয়। অলসতা অর্থাৎ কর্মবিমুখতা সকল দোষের মূল। এতে কর্তব্যকর্ম পিছিয়ে থাকে তাই নয়, মনে অসৎ চিন্তাও বাসা বাঁধে। শয়তান মন-মস্তিষ্কে নানা খটকা, নানা সংশয় ও নানা কুচিন্তা জাগিয়ে দেয়। এমনকি ঈমানহারা করে ফেলার সুযোগ পায়। তাই অলস সময় না কাটিয়ে ব্যস্ত থাকা চাই।
প্রতি রাতের সুনির্দিষ্ট কাজ আছে। কাজ আছে প্রতি দিনেরও। আছে দুনিয়ার কাজও, আখিরাতের কাজও। আখিরাতের জরুরি কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত অনেক কাজও আছে। সেসব নফল কাজ আখিরাতমুখী বান্দার পক্ষে প্রকৃত অর্থে অতিরিক্ত নয় মোটেই। তাও কাম্য। দিবারাত্রে সেরকম বহু কাজ আছে। আসলে মুমিন-মুসলিমের সবটা সময়ই বিপুল কাজে ঠাসা। সে কখনকার কোন্ কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দেবে? পরবর্তী সে সময়েও তো বিস্তর কাজ আছে। আবার আছে নানা উপসর্গ। নানা প্রতিবন্ধকতা ও ওজর-অজুহাত আছে। তাই বেকার থাকার সুযোগ নেই। আজকের কাজ কালকের জন্য বা দিনের কাজ রাতের জন্য ও রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ (তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য)। অর্থাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তুমি কাজ করতে পারবে না। অসুস্থতা তোমার নানা আমলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখন যখন তুমি সুস্থ, যতবেশি পার আমল করে নাও। অন্যথায় অসুস্থতাকালে তোমার আক্ষেপ করতে হবে যে, আহা, সুস্থ অবস্থায় কেন সময় কাজে লাগালাম না! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُوْن فِيْهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ : الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ.
‘দুটি নি'আমত এমন, যে ক্ষেত্রে বহুলোক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তা হল সুস্থতা ও অবসর সময়।’ ২২৮
وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ ‘এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য'। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোনও আমল করার সুযোগ থাকে না। আবার মৃত্যু যে-কোনও সময়ই এসে হানা দিতে পারে। কখন আসবে কেউ জানে না। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত ইবন উমর রাযি. সবশেষে বলেছিলেন-
فَإِنَّكَ لَا تَدْرِي يَا عَبْدَ اللَّهِ مَا اسْمُكَ غَدًا (হে আল্লাহর বান্দা! তুমি জানো না আগামীকাল তোমার কী নাম হবে)। অর্থাৎ জীবিত ব্যক্তি হিসেবে তোমার প্রচলিত নামেই তোমাকে ডাকা হবে, নাকি তোমার মৃত্যু হয়ে যাবে ফলে তোমাকে মায়্যিত বা লাশ ইত্যাদি বলা হবে।
তাই এখন যখন বেঁচে আছ, আমল করে নাও। এখন অবহেলা করলে মৃত্যুকালে আক্ষেপ করতে হবে। সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَبِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ وَأَنْفِقُوا مِنْ مَّا رَزَقْنَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْ لَا أَخرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصّلِحِينَ
'হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এ রকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ ২২৯
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَّبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ أَنْ تَقُوْلَ نَفْسٌ يّٰحَسْرَتى عَلَى مَا فَرَّطْتُ فِي جَنْبِ اللَّهِ وَإِنْ كُنْتُ لَمِنَ السّٰخِرِينَ.
'এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না। যাতে কাউকে বলতে না হয় যে, হায়! আল্লাহর ব্যাপারে আমি যে অবহেলা করেছি তার জন্য আফসোস! প্রকৃতপক্ষে আমি (আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান নিয়ে) ঠাট্টাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ ২৩০
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ سَبْعًا ، هَلْ تَنْتَظِرُوْنَ إِلَّا فَقْرًا مُنْسِيا، أَوْ غِنى مُطْغيًا، أَوْ مَرَضًا مُفْسِدًا، أَوْ هَرَمًا مُفْنِدًا ، أَوْ مَوْتَا مُجْهِرًا ، أَوِ الدَّجَّالَ فَشَرُّ غَائِب يُنتَظَرُ، أَوِ السَّاعَةَ فَالسَّاعَةُ أَدْهٰى وَأَمَرُّ.
'তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও। তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? না এমন প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে? না এমন রোগ-ব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে? না এমন বার্ধক্যের, যা বুদ্ধি লোপ করে দেয়? না আকস্মিক আগত মৃত্যুর? না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে? না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত?' ২৩১
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ ، شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
'পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে সুবর্ণ সুযোগ মনে করো- বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকাকে। '২৩২
সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য দ্রুত আমলে লেগে যাওয়া। না জানি কখন কোন্ বাধা সামনে দাঁড়িয়ে যায়! তাই প্রতিটি মুহূর্তকে শেষ মুহূর্ত মনে করে সবচে' বেশি প্রয়োজনীয় কাজটি করে ফেলা চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও আসবাব-উপকরণে বেশি জড়াতে নেই। পরকালই আসল ঠিকানা। সেখানকার পাথেয় সংগ্রহেই বেশি ব্যস্ত থাকা চাই।
খ. আগামীতে বেঁচে থাকার কোনও ভরসা নেই। তাই নগদ যে সময় হাতে আছে সেটাকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
গ. সুস্থতা ও অবসর সময় আমলের মহাসুযোগ। এ সুযোগ হারাতে নেই।দীর্ঘদীন বেঁচে থাকার আশা শয়তানের ধোকা। সে এ পথে মানুষের অন্তরে অলসতা সৃষ্টি করে। তারপর যখন অকস্মাৎ মৃত্যু এসে যায় তখন দেখা যায় কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। তাই শয়তানের এ ধোঁকায় পড়তে নেই।
২২৩. সূরা গাফির (৪০), আয়াত ৩৯
২২৪. জামে' তিরমিযী: ২৩৭৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৩৭০৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫২২৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৩৫২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১৮৯৮: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৯৩০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩৫
২২৫. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬
২২৬. সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ১৮
২২৭. জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩০৪; মুসনাদে আহমাদ: ৫০০২; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১১৪; শুআবুল ঈমান: ১০০৫৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩০
২২৮. সহীহ বুখারী: ৬৪১২; জামে' তিরমিযী: ২৩০৪; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮০০; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩৭৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৭৮৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫২৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২০;
২২৯. সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ৯-১০
২৩০. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৫-৫৬
২৩১. জামে' তিরমিযী: ২৩৬০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৫৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৩৯৪৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
২৩২. মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩১৯; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮৩২; বায়হাকী, আল-আদাব : ৮০৯; শু'আবুল ঈমান: ৯৭৬৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
উপরের হাদীসে দুটো অংশ আছে : প্রথমটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী। আর দ্বিতীয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর বাণী। হাদীস-শাস্ত্রের পরিভাষা-অনুসারে প্রথমটিকে বলা হবে ‘মারফূ‚’ বর্ণনা। অর্থাৎ যে বর্ণনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, কর্ম, সম্মতি কিংবা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে।
আর দ্বিতীয় অংশটি, যাতে ইবনে ওমর রা.-এর বাণী উল্লেখিত হয়েছে, তাকে বলা হবে, ‘মাওকূফ’। অর্থাৎ যে বর্ণনা সাহাবী পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় কোনো সাহাবীর কথা, কাজ বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে। সাধারণভাবে ‘মাওকূফ’ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এ শব্দের অন্য ব্যবহারও আছে, তবে তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
আমাদের হাদীসের ইমামগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এত সতর্ক ছিলেন যে, বর্ণনায় মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্যও খুব যত্নের সাথে পরীক্ষা করতেন। তাদের নীতি এই ছিল যে, বর্ণনাটি উপর থেকে যেভাবে আসছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। যা উপর থেকে সাহাবীর বাণী হিসেবে বর্ণিত হয়ে এসেছে তাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। প্রত্যেক বর্ণনা আপনরূপে থাকতে হবে। এরপর সেই বর্ণনার বিষয়বস্তুর সূত্র-সন্ধান, অর্থাৎ সাহাবী এই কথাটি কোত্থেকে বলেছেন- তা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। সাহাবী যখন বলেছেন তা তো আল্লাহর রাসূলের কথাই হবে, কিংবা কথাটি তো খুব সুন্দর কথা, ধর্মীয় কথা, কাজেই একে আল্লাহর রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করে দেওয়া যায়- এজাতীয় চিন্তা তাদের কাছে শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা হিসেবে গণ্য ছিল। আর তাই মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্য না করা ছিল তাঁদের দৃষ্টিতে অনেক বড় শাস্ত্রীয় দোষ।
সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রেই যখন এই কথা তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য। বস্তুত দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণের এরকম সচেতনতা ও সতর্কতার কারণেই দ্বীন সংরক্ষিত থেকেছে এবং তা আমাদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে।
হাদীস শরীফের প্রথম অংশ
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
কাঁধে হাত দেওয়া স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করে। উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে তা অধিকতর ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবীকে আন্তরিকতার সাথে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা মুমিন-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। প্রিয় সাহাবীকে সম্বোধন করলেও এ শিক্ষা সকল মুমিনের জন্য- ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
ভিনদেশী বা পথিকজনের মতো হওয়ার অর্থ কী? হাদীসের ভাষ্যকারগণ এর ব্যাখ্যায় যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-
পৃথিবীর এই ঘর মানুষের স্থায়ী ঘর নয়। এখানে সে ক্ষণস্থায়ী, তাকে তার স্থায়ী ঘরে ফিরে যেতে হবে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এই মহাসত্য স্মরণ রাখা তার কর্তব্য। এই সত্য স্মরণ রাখার যে প্রভাব তার চিন্তা ও কর্মে পড়বে তা নিম্নরূপ :
এক. মুমিন কিছুতেই দুনিয়ার ব্যাপারে মোহগ্রস্ত হবে না এবং দুনিয়াকেই তার স্থায়ী আবাস হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তাই আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সবকিছু থেকে সে নিজেকে যত্নের সাথে দূরে সরিয়ে রাখবে।
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় একথাটি এভাবে লিখেছেন-
مَعْنَى الْحَدِيثِ : لَا تَرْكَنْ إِلَى الدّنْيَا وَلَا تَتّخِذْهَا وَطَنًا، وَلَا تُحَدِّثْ نَفْسَكَ بِالْبَقَاءِ فِيهَا، وَلَا تَتَعَلّقْ مِنْهَا بِمَا لَا يَتَعَلّقُ بِهِ الْغَرِيبُ فِي غَيْرِ وَطَنِهِ.
দুই. দুনিয়ায় তার আগমনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে। মানুষ তো দুনিয়াতে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার জন্য আসেনি। সে এসেছে আল্লাহর বান্দা হয়ে, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য। দুনিয়ার জীবনে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব পালন করে তাকে তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে উপরের কথাটি এভাবে বলেছেন-
...فَالْمَرْءُ فِي الدّنْيَا كَعَبْدٍ أَرْسَلَهُ سَيِّدُهُ فِي حَاجَةٍ إِلَى غَيْرِ بَلَدِهِ، فَشَأْنُهُ أَنْ يُبَادِرَ بِفِعْلِ مَا أُرْسِلَ فِيهِ، ثُمّ يَعُودَ إِلَى وَطَنِهِ، وَلَا يَتَعَلّقُ بِشَيْءٍ غَيْرِ مَا هُوَ فِيهِ.
তিন. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলবে না। সর্বদা তা স্মৃতিতে জাগ্রত রাখবে। আখিরাতকে চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে। দুনিয়ার জীবনকে সে গ্রহণ করবে আখিরাতের জীবনের প্রস্তুতির সুযোগ ও অবসর হিসেবে।
ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে কথাটি এভাবে বলেছেন-
وَقَالَ غَيْرُهُ : الْمُرَادُ أَنْ يُنَزِّلَ الْمُؤْمِنُ نَفْسَهُ فِي الدّنْيَا مَنْزِلَةَ الْغَرِيبِ، فَلَا يَعْلَقُ قَلْبَهُ بِشَيْءٍ مِنْ بَلَدِ الْغُرْبَةِ، بَلْ قَلْبُهُ مُتَعَلِّقٌ بِوَطَنِهِ الّذِي يَرْجِعُ إِلَيْهِ، وَيَجْعَلُ إِقَامَتَهُ فِي الدّنْيَا لِيَقْضِيَ حَاجَتَهُ وَجِهَازَهُ لِلرّجُوعِ إِلَى وَطَنِهِ، وَهَذَا شَأْنُ الْغَرِيبِ، أَوْ يَكُونُ كَالْمُسَافِرِ لَا يَسْتَقِرّ فِي مَكَانٍ بِعَيْنِهِ، بَلْ هُوَ دَائِمُ السّيْرِ إِلَى بَلَدِ الْإِقَامَةِ.
এককথায় এ হাদীসটি হচ্ছে মানব-জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শেষ গন্তব্য, দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ ও ক্ষণস্থায়িত্ব এবং এইসকল কিছুর আলোকে দুনিয়াতে মুমিনের জীবন যাপনের পন্থা সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ হাদীসে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার কথা বলা হয়নি। তা স্বাভাবিকও নয়, মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। হাদীস শরীফে দুনিয়ার বিষয়ে মোহগ্রস্ত না হওয়ার, হারাম ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার, পার্থিব বৈধ কাজকর্মে সীমাতিরিক্ত মগ্ন না হওয়ার এবং আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে শরীয়তের শিক্ষা ও বিধানের আলোকে জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরও বিভিন্ন স্তর হতে পারে। উপরোক্ত হাদীস শরীফেও তাকওয়ার একাধিক স্তরের দিকে ইশারা আছে। ‘ভীনদেশী’ ও ‘পথিক মুসাফিরের’ মধ্যকার পার্থক্যটুকু হচ্ছে এই দুই স্তরের মধ্যকার পার্থক্য। উভয়ের লক্ষ্য ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য অভিন্ন হলেও পর্যায়গত কিছু পার্থক্যও আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিল এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-
مَا لِي وَلِلدّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدّنْيَا إِلاّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمّ رَاحَ وَتَرَكَهَا.
দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে ঐ সওয়ারের মতো যে এক বৃক্ষের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে এরপর তা ছেড়ে চলে গিয়েছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৩৭৭
সাহাবায়ে কেরামের জীবনযাত্রা সাধারণভাবে ‘ভীনদেশী’ কিংবা ‘পথিক মুসাফির’- এই দুই পর্যায়ের কোনো এক পর্যায়েরই ছিল।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর নসীহত
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাঁর প্রিয় সাহাবীকে উপদেশ দিয়েছেন তেমনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্টদের নসীহত করেছেন। দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর নসীহত ও কল্যাণকামিতার ধারা অব্যাহত থাকা উচিত।
ইবনে ওমর রা.-এর উপদেশের মর্মবাণীও হচ্ছে, দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহ হওয়া এবং পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ করা।
إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ.
‘সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা কোরো না, আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কোরো না।’ অর্থাৎ পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ কর আর আখিরাতের সঞ্চয় যথাসম্ভব দ্রুত অর্জন কর।
পার্থিব আয়-উপার্জন ইত্যাদির ক্ষেত্রে লম্বা লম্বা প্রত্যাশা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ সত্যের উপলব্ধি খুবই কার্যকর যে, দুনিয়ার জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। যে কোনো সময় মৃত্যু এসে হাজির হয়ে যেতে পারে। কাজেই পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশার জালে জড়িয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। অতএব পার্থিব ক্ষেত্রে ঝামেলা কমিয়ে আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করাই বাঞ্ছনীয়।
কবি বলেন-
نسير إلي الآجال في كل لحظة+ وأيامنا تطوى وهن مراحل
ولم أر مثل الموت حقا كأنه+ إذا ما تخطته الأماني باطل
وما أقبح التفريط في زمن الصبا+فكيف به والشيب للرأس شاعل
ترحل من الدينا بزاد من التقى+ فعمرك أيام وهن قلائل
অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই ‘নির্ধারিত সময়’-এর দিকে। জীবনের প্রতিটি দিন এই অগস্ত্যযাত্রারই একেকটি মঞ্জিল, যা একে একে পিছিয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর মতো এমন অবধারিত সত্য আর দেখিনি, যা পার্থিব আশা-আকাক্সক্ষার ভীড়ে এমনই বিস্মৃত যে, তা যেন একেবারেই মিথ্যে।
জীবনের প্রভাতে শৈশবকালেও তো সময়ের অপচয় অগ্রহণযোগ্য, তাহলে প্রৌঢ়ত্বে যখন মাথার চুলে পাক ধরে- তখন তা কেমন?
কাজেই বন্ধু! সাবধান হও! পৃথিবী থেকে যখন যাবে, যেন তাকওয়ার সম্বল নিয়ে যেতে পার- সেই চিন্তা কর। পার্থিব জীবন তো অল্প কটি দিনই মাত্র।
আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উদ্যমী ও তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ইবনে ওমর রা. বলেছেন-
وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.
অর্থাৎ ভালো কাজের ক্ষেত্রে অলসতা না করে বর্তমানকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ একে তো জীবন ক্ষণস্থায়ী; যে কোনো সময় মৃত্যুর ডাক এসে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত জীবনের সময়টুকুও নির্ঝঞ্ঝাট-সক্ষমতার মধ্যে কাটবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই জীবন-যৌবন এবং সুস্থতা ও সক্ষমতার বিদ্যমান সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার কাম্য। যেন দিন শেষে অতীত সময়ের অপচয়ের জন্য আফসোস করতে না হয়।
اغتنم في الفراغ فضل ركوع+ عسى أن يكون موتك بغتة
كم صحيح مات من غير سقم+ ذهبت نفسه الصحيحة فلتة
অর্থাৎ অবসর সময়ে যদি একটি রুকুও বেশি করতে পার তাতে অবহেলা করো না/কে জানে, হঠাৎ কখন মৃত্যু এসে পড়ে/কত সুস্থ লোক রোগ-ব্যাধি ছাড়াই মারা গেছে/তার নিরোগ প্রাণ অকস্মাৎ উড়ে গেছে।
স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে সচেতন করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصِّحّةُ وَالفَرَاغُ.
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার ব্যাপারে বহু মানুষ লোকসান-গ্রস্ত : সুস্থতা ও অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে নসীহত করে বলেছেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচ বিষয়ের আগে গনীমত মনে করো : তোমার যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতা আসার আগে, তোমার সচ্ছলতাকে অসচ্ছলতা আসার আগে, তোমার অবসরকে ব্যস্ততা আসার আগে, আর তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার আগে। -আলমুসতাদরাক, হাকেম, হাদীস ৭৮৪৬
কাজেই কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সৎকর্মে মশগুল থাকার মাধ্যমে বিদ্যমান সময়-সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক নিয়ত এবং সৎ ও উপযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই মানুষের জীবন সাফল্যমণ্ডিত হয়। কবি বলেন-
إنا لنفرح بالأيام نقطعها+ وكل يوم مضى يدني من الأجل
فاعمل لنفسك قبل الموت مجتهدا+ فإنما الربح والخسران في العمل
আমাদের দিন কাটছে তাই আমরা আনন্দে মেতে উঠি/অথচ চলে যাওয়া প্রতিটি দিন আমাদের নিকটবর্তী করছে সেই নির্ধারিত সময়ের/মৃত্যু আসার আগেই নিজের কল্যাণে কর্ম-প্রয়াসে মগ্ন হও/দিন শেষে লাভ-লোকসান তো কর্মেরই নিরিখে।
مضى أمسك الماضي شهيدا معدِّلا+ واعقبه يوم عليك جديد
فإن كنت بالأمس اقترفت إساءة+ فثن بإحسان وأنت حميد
فيومك إن اعتبته عاد نفعه+ عليك وماضي الأمس ليس يعود
ولا ترجئ فعل الخير يوما إلى غدٍ+ لعل غدًا يأتي وأنت فقيد.
অর্থাৎ তোমার বিগত দিনটি ভালো-মন্দের সাক্ষী হয়ে চলে গেছে/এখন তার জায়গায় এসেছে একটি নতুন দিন। গতকাল যদি ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে আজ ভালো কাজের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ কর/যে দিন গেছে তা তো আর কিছুতেই আসবে না, তবে আজকের এই দিনটাকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তাহলে এর সুফল অবশ্যই পাবে/কাজেই আজ যে ভালো কাজ সম্ভব তা আগামীকালের জন্য রেখে দিও না/এমনও তো হতে পারে যে, আগামী কাল আসবে কিন্তু তুমি থাকবে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
২. এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে দুনিয়ায় অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এক মহান শিক্ষক। তাঁর শিক্ষার্থী সাহাবীগণকে বেজায় ভালোবাসতেন। যে ভালোবাসার পরিচয় মেলে এ শিক্ষাদানকালে সাহাবীর প্রতি তাঁর আচরণের ভেতরেও। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর দু'কাঁধ ধরেন, যাতে তিনি তাঁর শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন এবং অন্যসব লিপ্ততা থেকে বিমুখ হয়ে পরিপূর্ণরূপে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করেন। দু'কাঁধ ধরে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ভেতর শিক্ষার বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তারও ইঙ্গিত বহন করে। বলাবাহুল্য, এরূপ আচরণ এমন কারও সঙ্গেই করা হয়ে থাকে, যার প্রতি অন্তরে ভরপুর স্নেহ-মমতা বিরাজ করে। এমন গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি কাউকে শিক্ষা দেওয়া হয় তা সে শিক্ষার্থীর মনে গভীর রেখাপাত করে, ফলে সে তা কখনও ভুলতে পারে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বললেন- كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيْبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ (তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক)। غَرِيْب মানে প্রবাসী, বিদেশে বসবাসকারী। যে ব্যক্তি বিদেশে বসবাস করে সে ওই দেশকে কখনও তার নিজের দেশ মনে করে না। একদিন এ দেশ ছেড়ে তাকে তার নিজের দেশে চলে যেতে হবে, এ কথাটি মাথায় রেখেই সে সব কাজ করে। সে যা-কিছু উপার্জন করে তা ওই দেশে খরচ করে ফেলে না; বরং নিজ দেশে পাঠায়, যাতে নিজ দেশের ঘরবাড়ি আবাদ হয় এবং ফিরে আসার পর সুখে-শান্তিতে সেখানে বসবাস করতে পারে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বিদেশীর মত জীবনযাপনে উপদেশ দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে, তুমি ইহজগৎকে বিদেশ বলেই গণ্য করবে। এ জগৎকে নিজের দেশ মনে করবে না। সুতরাং তোমার মূল পুঁজি অর্থাৎ আয়ুষ্কাল এবং তোমার যাবতীয় যোগ্যতা ও সক্ষমতা ইহকাল নির্মাণে খরচ করে ফেলো না; বরং তোমার প্রকৃত দেশ আখিরাত গড়ার পেছনে খরচ করো। ইহকালের পেছনে খরচ করবে কেবল ততটুকুই, যতটুকু এখানে থাকার জন্য প্রয়োজন হয়। এর অতিরিক্ত সবটাই আখিরাতের কাজে ব্যবহার করবে।
عَابِرُ سَبيْلٍ এর অর্থ পথিক। তুমি দুনিয়ায় থাকবে পথিকের মত। প্রকৃতপক্ষে তুমি একজন পথিকই বটে। তুমি অবিরাম আখিরাতের পথে চলছ। তোমার এই চলা শেষ হবে মৃত্যুতে। পথিক ব্যক্তি ক্ষণিকের জন্য কোনও পান্থশালায় বা গাছতলায় বিশ্রাম করে। তারপর আবার চলা শুরু করে। সে পান্থশালা বা গাছতলাকে নিজের বাসস্থান ও ঠিকানা মনে করে না। তাই একে নির্মাণ করা বা এর সাজানো-গোছানোর প্রতি সে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয় না। ক্ষণিকের অবস্থানের জন্য যতটুকু ঝাড়পোছের দরকার হয়, ব্যস অতটুকুই করে। তো তুমি যখন আখিরাতের পথের পথিক, তখন এ দুনিয়াকে পান্থশালা বা গাছতলার বেশি কিছু মনে করবে না। একজন পথিক পান্থশালা বা গাছতলার প্রতি যতটুকু মন দেয়, কেবল ততটুকুই। তোমার মূল ফিকির থাকবে আখিরাত। কিভাবে সেখানে মুক্তি পাবে, কিভাবে সেখানে নিবাস গড়ে তুলবে, সেটাই হবে তোমার জীবনের মূল লক্ষ্যবস্তু। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
إِنَّمَا هٰذِهِ الْحَيُوةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ
‘এই পার্থিব জীবন তো তুচ্ছ ভোগ মাত্র। নিশ্চয়ই আখিরাতই অবস্থিতির প্রকৃত নিবাস।’ ২২৩
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য হাদীছের এ শিক্ষাটি সরাসরি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে দিলেও এর উদ্দেশ্য ব্যাপক। তাঁর মাধ্যমে উম্মতের সকলকেই এ নসীহত করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দুনিয়ায় এভাবেই বসবাস করতেন। তিনি বলেন-
مَا لِي وَلِلدُّنْيَا ؟ مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اِسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا
'দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়ায় তো আমি একজন মুসাফিরস্বরূপ, যে কোনও গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করে, তারপর তা ছেড়ে চলে যায়।' ২২৪
কুরআন-হাদীছের যাবতীয় শিক্ষার মূলকথা এটাই যে, দুনিয়াকে নিজের আসল ঠিকানা মনে করো না। তোমার আসল ঠিকানা জান্নাত। এখানে যতদিন থাক, সেই ঠিকানার নির্মাণ ও বিন্যাসে সচেষ্ট থেকো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
'আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। '২২৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ
'হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।' ২২৬
সারকথা, আমরা ওই গোলামের মত, যাকে তার মনিব বিশেষ কাজের জন্য কোথাও পাঠিয়েছে। সে গোলামের যেমন কর্তব্য সেখানে গিয়ে অন্য কাজে মশগুল না হয়ে যে কাজের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, তারপর কাজ শেষ হওয়ামাত্র মনিবের কাছে ফিরে আসা, তেমনি আমাদেরও কর্তব্য দুনিয়ায় আমাদেরকে যে কাজে পাঠানো হয়েছে মৌলিকভাবে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, অন্য কোনও কাজে বিভোর না হওয়া। পরিশেষে মৃত্যুর মাধ্যমে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যকর্ম সম্পাদনকারী বান্দারূপে মহামনিব আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা আমাদের পাঠিয়েছেন দুনিয়াদারী করার জন্য নয়; বরং ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। তাই ইবাদত-বন্দেগীই হবে আমাদের আসল ব্যস্ততা। দুনিয়ার কাজকর্ম করব যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। তাতেও দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা।
কোনও কোনও বর্ণনায় এ হাদীছটির শেষে আরও আছে-
وَعُدَّ نَفْسَكَ فِي أَهْلِ القُبُوْرِ
(নিজেকে কবরবাসীদের একজন গণ্য করো)। ২২৭
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর উপদেশ
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তিনি উপদেশটি দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য বিখ্যাত তাবি'ঈ মুজাহিদ রহ.-কে।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- إِذَا أَمْسَيتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الْمَسَاء (তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না)। অর্থাৎ তোমার যখন সন্ধ্যা হয় তখন আর এই ভরসা করো না যে, ভোর পর্যন্ত বাঁচবে এবং পরের দিনটি পাবে। এমনিভাবে যখন ভোর হয় তখনও সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার ও আগামী রাত পাওয়ার ভরসায় থেকো না। হতে পারে এটাই তোমার শেষ রাত বা এটাই তোমার শেষ দিন।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হল কেমন আছেন? তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি কেমন থাকতে পারে বলে মনে কর, যে ব্যক্তি প্রতিদিন আখিরাতের দিকে এক এক মঞ্জিল করে অগ্রসর হচ্ছে?
দাউদ তাঈ রহ. বলতেন, রাত ও দিন কতগুলো মঞ্জিলের নাম। মানুষ প্রতিদিন ও প্রতি রাতে এক এক মঞ্জিল করে সামনে এগোচ্ছে। তার শেষ মঞ্জিল হবে ওইখানে, যেখানে তার সফর শেষ হবে। তোমার কর্তব্য প্রতি মঞ্জিলে তার পরবর্তী মঞ্জিলের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা। সফর শেষ হওয়ার দিন খুব কাছে। অতি নিকটে। তাই পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। যা করার তা দ্রুত করে ফেলো।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. প্রতি রাতে ঘুমাবার সময় পরিবারের লোকজনকে বলতেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। হয়তো এ ঘুমই হবে আমার শেষ ঘুম। আমার আর জাগা হবে না।
সা'ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলতেন, মুমিন ব্যক্তি যে দিনটিই পায় সেটাই তার বাড়তি লাভ।
সুতরাং এই যে রাত তুমি পেলে, এটা নষ্ট করো না। এ দিন নষ্ট করো না। এ সময়ের যা কাজ তা এখনই করে ফেলো। রাতের কাজ রাতেই সেরে ফেলো, দিনের জন্য রেখে দিয়ো না। এমনিভাবে দিনের কাজ দিনেই সেরে ফেলো, রাতের জন্য রেখে দিয়ো না।
বেঁচে থাকার ভরসায় দিনের কাজ রাতের জন্য বা রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়া হলে তা আর সহজে করা হয়ে ওঠে না। এতে করে কাজ জমতে থাকে। কর্তব্যকর্ম পড়ে থাকে। আরও বেঁচে থাকার ভরসা অন্তরে আলস্য সৃষ্টি করে। যত বেশি কাল বেঁচে থাকার আশা রাখা হয়, কাজে অলসতাও ততো বেশি হয়। অলসতা অর্থাৎ কর্মবিমুখতা সকল দোষের মূল। এতে কর্তব্যকর্ম পিছিয়ে থাকে তাই নয়, মনে অসৎ চিন্তাও বাসা বাঁধে। শয়তান মন-মস্তিষ্কে নানা খটকা, নানা সংশয় ও নানা কুচিন্তা জাগিয়ে দেয়। এমনকি ঈমানহারা করে ফেলার সুযোগ পায়। তাই অলস সময় না কাটিয়ে ব্যস্ত থাকা চাই।
প্রতি রাতের সুনির্দিষ্ট কাজ আছে। কাজ আছে প্রতি দিনেরও। আছে দুনিয়ার কাজও, আখিরাতের কাজও। আখিরাতের জরুরি কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত অনেক কাজও আছে। সেসব নফল কাজ আখিরাতমুখী বান্দার পক্ষে প্রকৃত অর্থে অতিরিক্ত নয় মোটেই। তাও কাম্য। দিবারাত্রে সেরকম বহু কাজ আছে। আসলে মুমিন-মুসলিমের সবটা সময়ই বিপুল কাজে ঠাসা। সে কখনকার কোন্ কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দেবে? পরবর্তী সে সময়েও তো বিস্তর কাজ আছে। আবার আছে নানা উপসর্গ। নানা প্রতিবন্ধকতা ও ওজর-অজুহাত আছে। তাই বেকার থাকার সুযোগ নেই। আজকের কাজ কালকের জন্য বা দিনের কাজ রাতের জন্য ও রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ (তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য)। অর্থাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তুমি কাজ করতে পারবে না। অসুস্থতা তোমার নানা আমলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখন যখন তুমি সুস্থ, যতবেশি পার আমল করে নাও। অন্যথায় অসুস্থতাকালে তোমার আক্ষেপ করতে হবে যে, আহা, সুস্থ অবস্থায় কেন সময় কাজে লাগালাম না! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُوْن فِيْهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ : الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ.
‘দুটি নি'আমত এমন, যে ক্ষেত্রে বহুলোক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তা হল সুস্থতা ও অবসর সময়।’ ২২৮
وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ ‘এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য'। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোনও আমল করার সুযোগ থাকে না। আবার মৃত্যু যে-কোনও সময়ই এসে হানা দিতে পারে। কখন আসবে কেউ জানে না। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত ইবন উমর রাযি. সবশেষে বলেছিলেন-
فَإِنَّكَ لَا تَدْرِي يَا عَبْدَ اللَّهِ مَا اسْمُكَ غَدًا (হে আল্লাহর বান্দা! তুমি জানো না আগামীকাল তোমার কী নাম হবে)। অর্থাৎ জীবিত ব্যক্তি হিসেবে তোমার প্রচলিত নামেই তোমাকে ডাকা হবে, নাকি তোমার মৃত্যু হয়ে যাবে ফলে তোমাকে মায়্যিত বা লাশ ইত্যাদি বলা হবে।
তাই এখন যখন বেঁচে আছ, আমল করে নাও। এখন অবহেলা করলে মৃত্যুকালে আক্ষেপ করতে হবে। সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَبِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ وَأَنْفِقُوا مِنْ مَّا رَزَقْنَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْ لَا أَخرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصّلِحِينَ
'হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এ রকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ ২২৯
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَّبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ أَنْ تَقُوْلَ نَفْسٌ يّٰحَسْرَتى عَلَى مَا فَرَّطْتُ فِي جَنْبِ اللَّهِ وَإِنْ كُنْتُ لَمِنَ السّٰخِرِينَ.
'এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না। যাতে কাউকে বলতে না হয় যে, হায়! আল্লাহর ব্যাপারে আমি যে অবহেলা করেছি তার জন্য আফসোস! প্রকৃতপক্ষে আমি (আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান নিয়ে) ঠাট্টাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ ২৩০
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ سَبْعًا ، هَلْ تَنْتَظِرُوْنَ إِلَّا فَقْرًا مُنْسِيا، أَوْ غِنى مُطْغيًا، أَوْ مَرَضًا مُفْسِدًا، أَوْ هَرَمًا مُفْنِدًا ، أَوْ مَوْتَا مُجْهِرًا ، أَوِ الدَّجَّالَ فَشَرُّ غَائِب يُنتَظَرُ، أَوِ السَّاعَةَ فَالسَّاعَةُ أَدْهٰى وَأَمَرُّ.
'তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও। তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? না এমন প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে? না এমন রোগ-ব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে? না এমন বার্ধক্যের, যা বুদ্ধি লোপ করে দেয়? না আকস্মিক আগত মৃত্যুর? না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে? না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত?' ২৩১
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ ، شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
'পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে সুবর্ণ সুযোগ মনে করো- বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকাকে। '২৩২
সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য দ্রুত আমলে লেগে যাওয়া। না জানি কখন কোন্ বাধা সামনে দাঁড়িয়ে যায়! তাই প্রতিটি মুহূর্তকে শেষ মুহূর্ত মনে করে সবচে' বেশি প্রয়োজনীয় কাজটি করে ফেলা চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও আসবাব-উপকরণে বেশি জড়াতে নেই। পরকালই আসল ঠিকানা। সেখানকার পাথেয় সংগ্রহেই বেশি ব্যস্ত থাকা চাই।
খ. আগামীতে বেঁচে থাকার কোনও ভরসা নেই। তাই নগদ যে সময় হাতে আছে সেটাকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
গ. সুস্থতা ও অবসর সময় আমলের মহাসুযোগ। এ সুযোগ হারাতে নেই।দীর্ঘদীন বেঁচে থাকার আশা শয়তানের ধোকা। সে এ পথে মানুষের অন্তরে অলসতা সৃষ্টি করে। তারপর যখন অকস্মাৎ মৃত্যু এসে যায় তখন দেখা যায় কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। তাই শয়তানের এ ধোঁকায় পড়তে নেই।
২২৩. সূরা গাফির (৪০), আয়াত ৩৯
২২৪. জামে' তিরমিযী: ২৩৭৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৩৭০৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫২২৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৩৫২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১৮৯৮: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৯৩০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩৫
২২৫. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬
২২৬. সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ১৮
২২৭. জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩০৪; মুসনাদে আহমাদ: ৫০০২; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১১৪; শুআবুল ঈমান: ১০০৫৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩০
২২৮. সহীহ বুখারী: ৬৪১২; জামে' তিরমিযী: ২৩০৪; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮০০; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩৭৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৭৮৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫২৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২০;
২২৯. সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ৯-১০
২৩০. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৫-৫৬
২৩১. জামে' তিরমিযী: ২৩৬০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৫৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৩৯৪৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
২৩২. মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩১৯; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮৩২; বায়হাকী, আল-আদাব : ৮০৯; শু'আবুল ঈমান: ৯৭৬৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)