রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৫২
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতা ও তার প্রভাব
হাদীছ নং: ৫৫২
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইসলাম গ্রহণের বিপরীতে যা-কিছুই চাওয়া হতো, তিনি তা অবশ্যই দিতেন। একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে আসলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা পরিমাণ বকরি দিলেন। লোকটি তার গোত্রে ফিরে বলল, হে আমার গোত্র! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কারণ মুহাম্মাদ এত পরিমাণ দান করেন যে, তিনি দারিদ্র্যের ভয় করেন না। কোনও কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করত কেবলই পার্থিব স্বার্থে। কিন্তু অল্পকাল যেতে না যেতেই ইসলাম তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয় অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয়ে উঠত। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ২৩১২; মুসনাদে আহমাদ: ১২৭৯০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৩৩০২; সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৩৭২: বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা : ১৩১৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ : ৩৬৯০)
হাদীছ নং: ৫৫২
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইসলাম গ্রহণের বিপরীতে যা-কিছুই চাওয়া হতো, তিনি তা অবশ্যই দিতেন। একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে আসলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা পরিমাণ বকরি দিলেন। লোকটি তার গোত্রে ফিরে বলল, হে আমার গোত্র! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কারণ মুহাম্মাদ এত পরিমাণ দান করেন যে, তিনি দারিদ্র্যের ভয় করেন না। কোনও কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করত কেবলই পার্থিব স্বার্থে। কিন্তু অল্পকাল যেতে না যেতেই ইসলাম তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয় অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয়ে উঠত। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ২৩১২; মুসনাদে আহমাদ: ১২৭৯০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৩৩০২; সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৩৭২: বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা : ১৩১৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ : ৩৬৯০)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
552 - وعن أنسٍ - رضي الله عنه - قَالَ: مَا سُئِلَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - عَلَى الإسْلاَمِ شَيْئًا إِلاَّ أعْطَاهُ، وَلَقَدْ جَاءهُ رَجُلٌ، فَأعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ، فَرجَعَ إِلَى قَوْمِهِ، فَقَالَ: يَا قَوْمِ، أسْلِمُوا فإِنَّ مُحَمَّدًا يُعطِي عَطَاءَ مَن لاَ يَخْشَى الفَقْرَ، وَإنْ كَانَ الرَّجُلُ لَيُسْلِمُ مَا يُريدُ إِلاَّ الدُّنْيَا، فَمَا يَلْبَثُ إِلاَّ يَسِيرًا حَتَّى يَكُونَ الإسْلاَمُ أحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا. رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে হযরত আনাস রাযি. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেনজির দানশীলতার কিছুটা পরিচয় দিয়েছেন। তা দিতে গিয়ে তিনি বলেন-
مَا سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ عَلَى الْإِسْلَامِ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইসলাম গ্রহণের বিপরীতে যা-কিছুই চাওয়া হতো, তিনি তা অবশ্যই দিতেন)। অর্থাৎ কেউ যদি তাঁর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করত আর এর বিনিময়ে সে কোনও আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করত, তবে তিনি তাকে তা অবশ্যই দিতেন, তাতে লোকটি যা চাইত তার পরিমাণ অল্প হোক বা বেশি। তিনি ছিলেন রহমাতুল লিল-আলামীন। মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য তার অন্তরে ছিল উচ্ছ্বসিত আকুলতা। ঈমান আনা ছাড়া কেউ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে না। কাজেই অর্থের বিনিময়ে হলেও যদি কেউ ঈমান আনে, তার জন্যও তিনি প্রস্তুত থাকতেন। আজ হয়তো সে অর্থের প্রতি আকৃষ্ট। কিন্তু একবার যদি ঈমান এনে ফেলে, তবে যথেষ্ট আশা আছে ক্রমান্বয়ে সে ঈমান তার অন্তরে পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে। তখন আর দুনিয়া নয়, আখিরাতই হবে তার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু। কাজেই এ আশায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যা চাইত অকাতরে দিয়ে দিতেন। আর বাস্তবে তাই ঘটত যে, ঈমান আনার পর কেউ আর তা থেকে সরে দাঁড়াত না; বরং উত্তরোত্তর সামনেই অগ্রসর হতো। হযরত আনাস রাযি. সামনে এর দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন-
وَلَقَدْ جَاءَهُ رَجُلٌ، فَأَعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ (একবার এক ব্যক্তি তার কাছে আসলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা পরিমাণ বকরি দিলেন)। কে এই ব্যক্তি, তার নাম জানা যায় না। সম্ভবত তিনি ওইসকল লোকের একজন ছিলেন, যাদেরকে ‘আল-মুআল্লাফাতুল কুলুব’ (ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা বা ইসলামের উপর মজবুত করে তোলার লক্ষ্যে যাদের মন জয়ের চেষ্টা করা হয় এরূপ ব্যক্তিবর্গ) বলা হয়।
এ বর্ণনায় তিনি কিছু চেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়নি। হতে পারে তিনি চেয়েছিলেন, কিন্তু বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দিয়েছিলেন।
তিনি তাকে দিয়েছিলেন এত বিপুল সংখ্যক ছাগল, যাতে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা ভরে গিয়েছিল। অর্থাৎ ছাগলের পরিমাণ ছিল শত শত। এটা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসামান্য দানশীলতার নিদর্শন।
প্রকাশ থাকে যে, ইসলামগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কোনও অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ দেওয়া একসময় জায়েয ছিল। এটা ইসলামের শুরু যমানার কথা, যখন মুসলিমদের সংখ্যা ছিল খুব কম। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা ইসলামকে বিজয়ী করেছেন। দলে দলে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে। ফলে এ দীনের অনুসারী সংখ্যা বিপুল হয়ে গেছে এবং একটি শক্তিশালী দীনরূপে ইসলাম প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। কাজেই এখন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোনও অমুসলিমকে যাকাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই দেওয়া জায়েযও নয়।
فَرَجَعَ إِلَى قَوْمِهِ، فَقَالَ: يَا قَوْم، أَسْلِمُوْا (লোকটি তার গোত্রে ফিরে বলল, হে আমার গোত্র! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতা ও দানশীলতা তার মনে দারুণ রেখাপাত করল। ফলে সে নিজে ইসলাম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হল না; বরং ইসলামের প্রতি একজন দাওয়াতদাতায় পরিণত হল। সুতরাং নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকেও ইসলামগ্রহণের আহ্বান জানাল। আহ্বান জানাতে গিয়ে যে কথা বলল, তা ছিল-
فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِي عَطَاءَ مَنْ لَا يَخْشَى الْفَقْرَ (কারণ মুহাম্মাদ এত পরিমাণ দান করেন যে, তিনি দারিদ্র্যের ভয় করেন না)। অর্থাৎ তোমরা যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তবে তিনি আমার মতো তোমাদেরকেও বিপুল সম্পদ দান করবেন। ফলে তোমরা দুনিয়াবী দিক থেকে লাভবান হবে। বোঝা যাচ্ছে, একদম নবীন মুসলিম হওয়ায় ঈমানের আলো ও তার রূহানী কল্যাণকরতার সঙ্গে তখনও পর্যন্ত পরিচিত হতে পারেনি। কেবল বাহ্যিক লাভটাই দেখেছিল। তাই সেদিকেই নিজ কওমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
বলেছিল যে, তিনি দারিদ্র্যের কোনও ভয় করেন না। তা করবেনই বা কীভাবে? তিনি তো আল্লাহ তা'আলার হাবীব ও তাঁর পেয়ারা রাসূল। একজন প্রকৃত মুমিনও দান-খয়রাত করার বেলায় দারিদ্র্যের ভয় করতে পারে না। কারণ তার তো নিজ হাতে যা থাকে তার চেয়ে বেশি নির্ভরতা থাকে আল্লাহ তা'আলার খাজানার উপর। আল্লাহ তা'আলার ভাণ্ডার অনিঃশেষ। আল্লাহ তা'আলার উপর যার প্রকৃত ভরসা থাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে নিজ ভাণ্ডার থেকে অপরিমিত ও অভাবিতরূপে দান করেন।
হাদীসে আছে, এ ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. সেই সময়কার এক বাস্তবতার কথা এভাবে তুলে ধরেন যে - وَإِنْ كَانَ الرَّجُلُ لَيُسْلِمُ مَا يُرِيدُ إِلَّا الدُّنْيَا، فَمَا يَلْبَثُ إِلَّا يَسِيرًا حَتَّى يَكُوْنَ الْإِسْلَامُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا (কোনও কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করত কেবলই পার্থিব স্বার্থে। কিন্তু অল্পকাল যেতে না যেতেই ইসলাম তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয় অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয়ে উঠত)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবারিত দান-অনুদানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভাসাভাসাভাবে ইসলাম গ্রহণ করত এবং বাহ্যিকভাবে নিজেকে মুসলিমদের দলভুক্ত করে নিত; অন্তর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হতো না এবং ইসলামের নূরানী দিকের সঙ্গেও তার পরিচয় থাকত না। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার আমূল পরিবর্তন ঘটে যেত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের পরশে ঈমানের নূর তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ লাভ করত। ইসলামের জ্যোতিতে তার দেহমন উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। আর এভাবে সে ঈমান ও ইসলামের উপর পুরোপুরি পাকাপোক্ত হয়ে যেত। ইসলাম তার কাছে এমন প্রিয় হয়ে উঠত যে, তার বিপরীতে সারাটা জগৎ তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যেত। তখন ইসলামের জন্য মাল তো মাল, অনায়াসে নিজ প্রাণটাও উৎসর্গ করে দিতে পারত।
এটা ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের প্রভাব। তাঁর সাহচর্য ছিল জিয়নকাঠিস্বরূপ। তাতে মৃত আত্মায় প্রাণ সঞ্চার হতো। তা ছিল এক পরশপাথর, যার ছোঁয়ায় দূষিত ভেজাল মানুষও খাঁটি সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যেত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁর সাহচর্যে গড়া মহান সাহাবীদের সাহচর্যেরও অসামান্য তাছির ছিল। সে তাছিরে অগণিত মানুষের জীবনে বদল এসেছিল। সাহচর্যের মাধ্যমে জীবনবদলের সে ধারা ওই যে শুরু হয়েছিল, আজও পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। তার তাছির আগের মতো অতটা শক্তিশালী নেই বটে, কিন্তু একেবারেই যে অকার্যকর হয়ে গেছে তাও নয়। আজও ঈমানের আলোয় জীবন উদ্ভাসিত করার প্রকৃষ্ট উপায় এটাই যে, তুমি কোনও প্রকৃত ঈমানওয়ালার সাহচর্যে চলে যাও এবং নিজ ঈমানী যিন্দেগীতে তার তারবিয়াতের স্পর্শ গ্রহণ করো।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কেমন দানবীর ছিলেন তা কিছুটা আঁচ করা যায়।
খ. দান-খয়রাত দ্বারা মানুষের মন জয় করা যায়, যদি উদ্দেশ্য হয় মহৎ।
গ. দান-খয়রাত করার বেলায় দারিদ্র্যের ভয় করতে নেই।
ঘ. কেউ পার্থিব স্বার্থে ইসলাম গ্রহণ করলেও সৎ সাহচর্য দ্বারা তার প্রকৃত মুসলিম হয়ে ওঠা সম্ভব।
ঙ. উত্তম সাহচর্য জীবনবদলের এক প্রকৃষ্ট উপায়।
مَا سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ عَلَى الْإِسْلَامِ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইসলাম গ্রহণের বিপরীতে যা-কিছুই চাওয়া হতো, তিনি তা অবশ্যই দিতেন)। অর্থাৎ কেউ যদি তাঁর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করত আর এর বিনিময়ে সে কোনও আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করত, তবে তিনি তাকে তা অবশ্যই দিতেন, তাতে লোকটি যা চাইত তার পরিমাণ অল্প হোক বা বেশি। তিনি ছিলেন রহমাতুল লিল-আলামীন। মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য তার অন্তরে ছিল উচ্ছ্বসিত আকুলতা। ঈমান আনা ছাড়া কেউ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে না। কাজেই অর্থের বিনিময়ে হলেও যদি কেউ ঈমান আনে, তার জন্যও তিনি প্রস্তুত থাকতেন। আজ হয়তো সে অর্থের প্রতি আকৃষ্ট। কিন্তু একবার যদি ঈমান এনে ফেলে, তবে যথেষ্ট আশা আছে ক্রমান্বয়ে সে ঈমান তার অন্তরে পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে। তখন আর দুনিয়া নয়, আখিরাতই হবে তার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু। কাজেই এ আশায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যা চাইত অকাতরে দিয়ে দিতেন। আর বাস্তবে তাই ঘটত যে, ঈমান আনার পর কেউ আর তা থেকে সরে দাঁড়াত না; বরং উত্তরোত্তর সামনেই অগ্রসর হতো। হযরত আনাস রাযি. সামনে এর দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন-
وَلَقَدْ جَاءَهُ رَجُلٌ، فَأَعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ (একবার এক ব্যক্তি তার কাছে আসলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা পরিমাণ বকরি দিলেন)। কে এই ব্যক্তি, তার নাম জানা যায় না। সম্ভবত তিনি ওইসকল লোকের একজন ছিলেন, যাদেরকে ‘আল-মুআল্লাফাতুল কুলুব’ (ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা বা ইসলামের উপর মজবুত করে তোলার লক্ষ্যে যাদের মন জয়ের চেষ্টা করা হয় এরূপ ব্যক্তিবর্গ) বলা হয়।
এ বর্ণনায় তিনি কিছু চেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়নি। হতে পারে তিনি চেয়েছিলেন, কিন্তু বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দিয়েছিলেন।
তিনি তাকে দিয়েছিলেন এত বিপুল সংখ্যক ছাগল, যাতে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকা ভরে গিয়েছিল। অর্থাৎ ছাগলের পরিমাণ ছিল শত শত। এটা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসামান্য দানশীলতার নিদর্শন।
প্রকাশ থাকে যে, ইসলামগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কোনও অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ দেওয়া একসময় জায়েয ছিল। এটা ইসলামের শুরু যমানার কথা, যখন মুসলিমদের সংখ্যা ছিল খুব কম। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা ইসলামকে বিজয়ী করেছেন। দলে দলে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে। ফলে এ দীনের অনুসারী সংখ্যা বিপুল হয়ে গেছে এবং একটি শক্তিশালী দীনরূপে ইসলাম প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। কাজেই এখন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোনও অমুসলিমকে যাকাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই দেওয়া জায়েযও নয়।
فَرَجَعَ إِلَى قَوْمِهِ، فَقَالَ: يَا قَوْم، أَسْلِمُوْا (লোকটি তার গোত্রে ফিরে বলল, হে আমার গোত্র! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতা ও দানশীলতা তার মনে দারুণ রেখাপাত করল। ফলে সে নিজে ইসলাম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হল না; বরং ইসলামের প্রতি একজন দাওয়াতদাতায় পরিণত হল। সুতরাং নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকেও ইসলামগ্রহণের আহ্বান জানাল। আহ্বান জানাতে গিয়ে যে কথা বলল, তা ছিল-
فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِي عَطَاءَ مَنْ لَا يَخْشَى الْفَقْرَ (কারণ মুহাম্মাদ এত পরিমাণ দান করেন যে, তিনি দারিদ্র্যের ভয় করেন না)। অর্থাৎ তোমরা যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তবে তিনি আমার মতো তোমাদেরকেও বিপুল সম্পদ দান করবেন। ফলে তোমরা দুনিয়াবী দিক থেকে লাভবান হবে। বোঝা যাচ্ছে, একদম নবীন মুসলিম হওয়ায় ঈমানের আলো ও তার রূহানী কল্যাণকরতার সঙ্গে তখনও পর্যন্ত পরিচিত হতে পারেনি। কেবল বাহ্যিক লাভটাই দেখেছিল। তাই সেদিকেই নিজ কওমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
বলেছিল যে, তিনি দারিদ্র্যের কোনও ভয় করেন না। তা করবেনই বা কীভাবে? তিনি তো আল্লাহ তা'আলার হাবীব ও তাঁর পেয়ারা রাসূল। একজন প্রকৃত মুমিনও দান-খয়রাত করার বেলায় দারিদ্র্যের ভয় করতে পারে না। কারণ তার তো নিজ হাতে যা থাকে তার চেয়ে বেশি নির্ভরতা থাকে আল্লাহ তা'আলার খাজানার উপর। আল্লাহ তা'আলার ভাণ্ডার অনিঃশেষ। আল্লাহ তা'আলার উপর যার প্রকৃত ভরসা থাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে নিজ ভাণ্ডার থেকে অপরিমিত ও অভাবিতরূপে দান করেন।
হাদীসে আছে, এ ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. সেই সময়কার এক বাস্তবতার কথা এভাবে তুলে ধরেন যে - وَإِنْ كَانَ الرَّجُلُ لَيُسْلِمُ مَا يُرِيدُ إِلَّا الدُّنْيَا، فَمَا يَلْبَثُ إِلَّا يَسِيرًا حَتَّى يَكُوْنَ الْإِسْلَامُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا (কোনও কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করত কেবলই পার্থিব স্বার্থে। কিন্তু অল্পকাল যেতে না যেতেই ইসলাম তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয় অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয়ে উঠত)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবারিত দান-অনুদানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভাসাভাসাভাবে ইসলাম গ্রহণ করত এবং বাহ্যিকভাবে নিজেকে মুসলিমদের দলভুক্ত করে নিত; অন্তর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হতো না এবং ইসলামের নূরানী দিকের সঙ্গেও তার পরিচয় থাকত না। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার আমূল পরিবর্তন ঘটে যেত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের পরশে ঈমানের নূর তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ লাভ করত। ইসলামের জ্যোতিতে তার দেহমন উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। আর এভাবে সে ঈমান ও ইসলামের উপর পুরোপুরি পাকাপোক্ত হয়ে যেত। ইসলাম তার কাছে এমন প্রিয় হয়ে উঠত যে, তার বিপরীতে সারাটা জগৎ তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যেত। তখন ইসলামের জন্য মাল তো মাল, অনায়াসে নিজ প্রাণটাও উৎসর্গ করে দিতে পারত।
এটা ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের প্রভাব। তাঁর সাহচর্য ছিল জিয়নকাঠিস্বরূপ। তাতে মৃত আত্মায় প্রাণ সঞ্চার হতো। তা ছিল এক পরশপাথর, যার ছোঁয়ায় দূষিত ভেজাল মানুষও খাঁটি সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যেত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁর সাহচর্যে গড়া মহান সাহাবীদের সাহচর্যেরও অসামান্য তাছির ছিল। সে তাছিরে অগণিত মানুষের জীবনে বদল এসেছিল। সাহচর্যের মাধ্যমে জীবনবদলের সে ধারা ওই যে শুরু হয়েছিল, আজও পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। তার তাছির আগের মতো অতটা শক্তিশালী নেই বটে, কিন্তু একেবারেই যে অকার্যকর হয়ে গেছে তাও নয়। আজও ঈমানের আলোয় জীবন উদ্ভাসিত করার প্রকৃষ্ট উপায় এটাই যে, তুমি কোনও প্রকৃত ঈমানওয়ালার সাহচর্যে চলে যাও এবং নিজ ঈমানী যিন্দেগীতে তার তারবিয়াতের স্পর্শ গ্রহণ করো।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কেমন দানবীর ছিলেন তা কিছুটা আঁচ করা যায়।
খ. দান-খয়রাত দ্বারা মানুষের মন জয় করা যায়, যদি উদ্দেশ্য হয় মহৎ।
গ. দান-খয়রাত করার বেলায় দারিদ্র্যের ভয় করতে নেই।
ঘ. কেউ পার্থিব স্বার্থে ইসলাম গ্রহণ করলেও সৎ সাহচর্য দ্বারা তার প্রকৃত মুসলিম হয়ে ওঠা সম্ভব।
ঙ. উত্তম সাহচর্য জীবনবদলের এক প্রকৃষ্ট উপায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)