রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৫১
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
ব্যয় ও সঞ্চয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা
হাদীছ নং: ৫৫১

হযরত আবূ উমামা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আদম সন্তান! তোমার অতিরিক্ত সম্পদ (সৎপথে) খরচ করাটা তোমার পক্ষে ভালো আর তা আটকে রাখা তোমার পক্ষে মন্দ। প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ রাখার কারণে তুমি নিন্দনীয় হবে না। তুমি যাদের ব্যয়ভার বহন কর, তাদের থেকে খরচের সূচনা করবে। উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১০৩৬; জামে তিরমিযী: ২৩৪৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮৭৪৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৭৬২৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৭৮১; শু'আবুল ঈমান : ৩১১৪)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
551 - وعن أَبي أُمَامَة صُدّيِّ بن عَجْلانَ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَا ابْنَ آدَمَ، إنَّكَ أن تَبْذُلَ الفَضْلَ خَيْرٌ لَكَ، وَأَن تُمْسِكَه شَرٌّ لَكَ، وَلاَ تُلاَمُ عَلَى كَفَافٍ، وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ، وَاليَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম বলা হয়েছে-
يَا ابْنَ آدَمَ ، إِنَّكَ أَنْ تَبْذُلَ الْفَضْلَ خَيْرٌ لَكَ ‘হে আদম সন্তান! তোমার অতিরিক্ত সম্পদ (সৎপথে) খরচ করাটা তোমার পক্ষে ভালো'। অর্থাৎ তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা করে না রেখে আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলো। এতেই তোমার কল্যাণ। কারণ আল্লাহর পথে যা খরচ করবে, তা তোমার জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে। তুমি তা আখিরাতে পাবে। আর যা জমা করবে তা মৃত্যুতেই শেষ। আখিরাতে তা তোমার কোনও কাজে আসবে না।

দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে- وَأَنْ تُمْسِكَهُ شَرٌّ لَكَ (আর তা আটকে রাখা তোমার পক্ষে মন্দ)। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা করে রেখো না। আল্লাহর পথে খরচ না করে জমা করে রাখার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। আখিরাতে তার হিসাব নেওয়া হবে। সেখানে এর বিনিময়ে কিছু পাওয়া যাবে না। উল্টো যেসব জায়গায় খরচ করা ফরয, তাতে খরচ না করলে, এ সম্পদ তার সঞ্চয়কারীকে আখিরাতে আগুন হয়ে জ্বালাবে। সাপ হয়ে দংশন করবে, যেমন বিভিন্ন হাদীছে সতর্ক করা হয়েছে।

যদি যাকাতসহ অন্যান্য হকসমূহ আদায় করা হয়, তারপরও অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করে রাখার মধ্যে ঝুঁকি থাকে। তা নাজায়েয খাতে ব্যয় হতে পারে, মৃত্যুর পর ওয়ারিছগণ তার অপব্যবহার করতে পারে। অন্ততপক্ষে এতটুকু তো হয়ই যে, আল্লাহর পথে খরচ করার যে ছাওয়াব নির্ধারিত আছে তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই জমা করে রাখার চেয়ে আল্লাহর পথে খরচ করার মধ্যেই কল্যাণ। হাঁ, ওয়ারিছগণ যদি আল্লাহভীরু হয় এবং তাদের মধ্যে দীনের বুঝ থাকে, তবে তাদের জন্য কিছু রেখে গেলে সে ক্ষেত্রে কল্যাণের আশা আছে। কোনও কোনও হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিরিক্ত সম্পদের সবটা খরচ না করে ওয়ারিছদের জন্য কিছু রেখে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন।

হাদীছটির তৃতীয় নির্দেশনা হল- وَلَا تُلَامُ عَلَى كَفَافٍ (প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ রাখার কারণে তুমি নিন্দনীয় হবে না)। অর্থাৎ নিজের ও নিজ পরিবারের পানাহার, পোশাক, বাসস্থান ও অন্যান্য জরুরত পূরণের জন্য যে সম্পদ প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া দোষের নয়। অর্থাৎ এতটুকু সম্পদ রাখার কারণে কাউকে দুনিয়াদার বা আয়েশপ্রিয় বলা হবে না। বরং এর মধ্যেই নিরাপত্তা। এতটুকু সম্পদ থাকলে মাখলুকের কাছে হাত পাতা থেকে বাঁচা যায়। আবার এতটুকু সম্পদের মালিককে যেহেতু ধনীও বলা হয় না, তাই ধনের অহমিকা থেকেও আত্মরক্ষা হয়। যাদের ঈমান তেমন মজবুত নয়, তাদের পক্ষে বর্তমানকালে ইজ্জত-সম্মান রক্ষার মতো সম্পদ থাকাই শ্রেয়।

হযরত হুযায়ফা রাযি. বলেন, তোমাদের মধ্যে ওই লোক শ্রেষ্ঠ নয়, যে আখিরাতের জন্য দুনিয়া পরিত্যাগ করে কিংবা দুনিয়ার জন্য আখিরাত পরিত্যাগ করে। শ্রেষ্ঠ তো সেই-ই, যে উভয়টা থেকেই তার অংশ নিয়ে নেয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
‘আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না।’(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৭)

তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- وَابْدَأ بِمَنْ تَعُوْلُ (তুমি যাদের লালন-পালন কর তাদের থেকে খরচ শুরু করো)। অর্থাৎ নিজ সত্তা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, পিতা-মাতা এবং আরও যারা নিজ লালন-পালনাধীন থাকে, প্রথম খরচটা তাদের পেছনেই করতে হবে। কেননা এটা করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। অন্যসব ক্ষেত্রে খরচ করা নফল কাজ। বলাবাহুল্য, নফল অপেক্ষা ফরযের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। কেননা নফলের ক্ষেত্রে কোনও জবাবদিহিতা নেই। পক্ষান্তরে ফরয কাজে অবহেলা করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

হাদীছটিতে সবশেষে বলা হয়েছে- وَالْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى (উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম)। উপরের হাত হল দাতার হাত, আর নিচের হাত গ্রহীতার হাত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- وَالْيَدُ الْعُلْيَا هِيَ الْمُنْفِقَةُ، وَالسُّفْلَى هِيَ السَّائِلَةُ (উপরের হাত হল দাতার হাত আর নিচের হাত হল যাচনাকারীর হাত) (সহীহ বুখারী: ১৪২৯; সহীহ মুসলিম: ১০৩৩; সুনানে নাসাঈ: ২৫৩৩; সুনানে আবু দাউদ: ১৬৪৮; মুসনাদে আহমাদ: ৫৩৪৪; সুনানে দারিমী: ১৬৯২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩৩৬৪)।

দান করার সময় দাতার হাত গ্রহীতার হাতের উপরে থাকে, আর গ্রহীতার হাত থাকে নিচে। উপর ও নিচের এ অবস্থাটা কেবল বাহ্যদৃষ্টিতেই নয়; বরং মর্যাদাগত দিক থেকেও বিষয়টা এরকমই। সে কারণেই রাসূলুল্লাহ উপরের হাতকে অর্থাৎ দাতার হাতকে নিচের হাত বা গ্রহীতার হাতের তুলনায় উত্তম বলেছেন। এর দ্বারা ইঙ্গিত করছেন যে, তুমি দাতা হও, গ্রহীতা হয়ো না।

উল্লেখ্য, এ হাদীছটি পেছনে ৫০৯ ক্রমিক নম্বরে গত হয়েছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা সেখানে দ্রষ্টব্য। হাদীছটির শেষ অংশ গত হয়েছে ৫২৩ ক্রমিক নম্বরে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ যথাসম্ভব আল্লাহর পথে খরচ করা চাই।

খ. কৃপণতা একটি মন্দ স্বভাব। এ স্বভাবের সংশোধন জরুরি।

গ. দীন ও ঈমান এবং ইজ্জত-সম্মান রক্ষার মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ হাতে রাখা দূষণীয় নয়।

ঘ. অর্থ-সম্পদ খরচের বেলায় নিজ পরিবারবর্গ ও পোষ্যজনদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ঙ. দাতার হাত শ্রেষ্ঠ। তাই যথাসম্ভব দান-খয়রাত জারি রাখা চাই।

চ. গ্রহীতার হাত নিচে থাকে। তাই গ্রহণে কোনও মর্যাদা নেই। যথাসম্ভব এর থেকে বেঁচে থাকা বাঞ্ছনীয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)