রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৪৭
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
প্রতিদিন ভোরে দানশীল ও কৃপণের জন্য ফিরিশতাগণ যে দু'আ করেন
হাদীছ নং: ৫৪৭
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিদিন আল্লাহর বান্দাগণের যখন ভোর হয়, তখন দু'জন ফিরিশতা নেমে আসেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন। অন্যজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে দিন বিনাশ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১৪৪২; সহীহ মুসলিম: ১০১০; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৫২; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩৩২৯, নাসাঈ, আস্সুনানুল কুবরা ৭৮১৬; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা: ৭৮১৬)
হাদীছ নং: ৫৪৭
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিদিন আল্লাহর বান্দাগণের যখন ভোর হয়, তখন দু'জন ফিরিশতা নেমে আসেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন। অন্যজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে দিন বিনাশ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১৪৪২; সহীহ মুসলিম: ১০১০; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৫২; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩৩২৯, নাসাঈ, আস্সুনানুল কুবরা ৭৮১৬; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা: ৭৮১৬)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
547 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَا مِنْ يَوْمٍ يُصبحُ العِبَادُ فِيهِ إِلاَّ مَلَكَانِ يَنْزلانِ، فَيَقُولُ أحَدُهُمَا: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُولُ الآخَرُ: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে দানশীলতার মাহাত্ম্য ও কৃপণতার মন্দত্ব বর্ণিত হয়েছে। এ মর্মে হযরত আবুদ্ দারদা রাযি.-এর সূত্রেও একটি হাদীছ বর্ণিত আছে। তাতে আছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا طَلَعَتْ شَمْسٌ قَطُّ إِلَّا بُعِثَ بِجَنْبَتَيْهَا مَلَكَانِ يُنَادِيَانِ يُسْمِعَانِ أَهْلَ الْأَرْضِ إِلَّا الثَّقَلَيْنِ يَا أَيُّهَا النَّاسُ هَلُمُّوا إِلَى رَبِّكُمْ فَإِنَّ مَا قَلَّ وَكَفَى خَيْرٌ مِمَّا كَثُرَ وَأَلْهَى وَلَا آبَتْ شَمْسٌ قَطُّ إِلَّا بُعِثَ بِجَنْبَتَيْهَا مَلَكَانِ يُنَادِيَانِ يُسْمِعَانِ أَهْلَ الْأَرْضِ إِلَّا الثَّقَلَيْنِ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَأَعْطِ مُمْسِكًا مَالًا تَلَفًا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক সূর্যোদয়কালে সূর্যের দুপাশে দুজন ফিরিশতা পাঠানো হয়। তারা মানুষ ও জিন ছাড়া পৃথিবীর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে ডেকে বলে, হে মানুষ! এসো তোমাদের প্রতিপালকের দিকে। (ব্যক্তির জন্য) যে 'অল্প' যথেষ্ট হয়ে যায় (অর্থাৎ যাতে বান্দা পরিতুষ্ট থাকে) তা ওই 'বেশি' অপেক্ষা উত্তম, যা মানুষকে (আল্লাহ ও আখিরাত সম্পর্কে) উদাসীন করে দেয়। আর যখনই সূর্যাস্ত হয় তখন দুজন ফিরিশতা তার দুপাশে পাঠানো হয়। তারা মানুষ ও জিন ছাড়া পৃথিবীর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে ডেকে বলে, হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন আর কৃপণকে দিন নিষ্ফল ধন।(মুসনাদে আহমাদ: ২১৭২১; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩৩২৯; তাবারানী, আল্-মুজামুল আওসাত : ২৮৯১; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৮৮৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪০৪৫)
সূর্যের উদয় ও অস্তকালে কীভাবে ফিরিশতাদেরকে তার দুপাশে পাঠানো হয় এবং মানুষ ও জিন ছাড়া আর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে তারা কীভাবে এইসব এবং বলে তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টির কতটুকুই বা আমরা বুঝতে পারি? আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا (85)
‘তোমাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে সামান্যমাত্র।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৮৫)
আমাদের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন তা মেনে চলা। আমাদের লক্ষ্য করে যে আদেশ ও উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্ট। তা বোধ-বুদ্ধির অতীত নয়। সুতরাং এ হাদীছেরও উপদেশ পরিষ্কার। এর উপদেশ হচ্ছে, তোমরা দুনিয়ার মোহে বিভোর হয়ে থেকো না। আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ও আখিরাতের মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে অকাতরে দান-খয়রাত করতে থাকো। কৃপণতা করো না।
কল্যাণকর খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করলে ফিরিশতারা দু'আ করেন- اَللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفقًا خَلَفا ‘হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন'। খরচকারী বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো উদ্দেশ্য, যে তার অর্থ-সম্পদ পরিবারবর্গের মৌলিক ও বৈধ চাহিদা পূরণে ব্যয় করে। আত্মীয়-স্বজন ও অতিথিদের সেবা করে। অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করে। এছাড়াও যে-কোনও দীনী খাতে অকাতরে ব্যয় করে। বলাবাহুল্য ফিরিশতাদের দু'আ তো আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হবেই। কাজেই এটা নিশ্চিত যে, কল্যাণকর খাতে খরচকারীকে আল্লাহ তা'আলা উত্তম বদলা দিয়েই থাকেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তার বিনিময়ে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।’(সূরা সাবা' (৩৪), আয়াত ৩৯)
এখানে যে خَلَف (উত্তম বদলা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এর দ্বারা আসলে কী বোঝানো উদ্দেশ্য তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। নির্দিষ্ট না করার দ্বারা এর মধ্যে ব্যাপকতা এসে গেছে। কাজেই হতে পারে সে যা খরচ করেছে, আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ায়ই তাকে তা আরও বেশি পরিমাণে দেবেন। অর্থ-সম্পদ থেকে দান করা অর্থ-সম্পদের একরকম শোকরও বটে। শোকর আদায় করলে নি'আমত আরও বৃদ্ধি করা হয়। ইরশাদ হয়েছে
لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ
‘তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব।’(সূরা ইবরাহীম (১৪), আয়াত ৭)
এর দ্বারা আখিরাতের ছাওয়াবও বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। এমনও অনেক দানশীল আছে, যে দুনিয়া থেকে চলে যায় অথচ সে যা অর্থ-সম্পদ দান করেছে, দুনিয়ায় তার কোনও প্রতিদান দেখে যেতে পারে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিদানের অর্থ নেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হয়তো ছাওয়াবই বুঝতে হবে। অথবা হতে পারে, দান-খয়রাতের বিনিময়ে আল্লাহ তা'আলা তার দুনিয়ার কোনও বালা-মসিবত দূর করে দেন। বলাবাহুল্য, এর প্রত্যেকটিই উত্তম প্রতিদান এবং প্রত্যেক বান্দার কাঙ্ক্ষিতও বটে।
خلف এর দ্বারা উত্তম স্থলাভিষিক্তও বোঝানো হতে পারে। দু'আয় যেন বলা হয়েছে, হে আল্লাহ! এই দান-খয়রাতকারীকে এমন সুসন্তান দান করুন, যে তার মৃত্যুর পর তার দান-খয়রাতের ধারা অব্যাহত রাখবে। সে তার রেখে যাওয়া সম্পদ নষ্ট করবে না; বরং আপনার পথে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে সে সম্পদে আরও প্রবৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করবে। সন্দেহ নেই, এরূপ নেক সন্তান আল্লাহর পথে ব্যয় করা অর্থ-সম্পদের অতি উৎকৃষ্ট বদলা, যা যে-কোনও দীনদারের পরম কাম্য।
আর যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, তার জন্য ফিরিশতাগণ দু'আ করেন- وَأَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا ‘কৃপণকে দিন বিনাশ'। কৃপণ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যে ওয়াজিব ও ফরয খাতসমূহে ব্যয় করে না, মালের হক আদায় হতে বিরত থাকে এবং কোনওরকম নফল দান-খয়রাতের বিলকুল আগ্রহ রাখে না।
এখানে تَلَف শব্দটি خَلَف এর বিপরীতে আনা হয়েছে। কাজেই خَلَفَ এর ব্যাখ্যায় উপরে যা-কিছু উল্লেখ করা হল, তার বিপরীত সবকিছুই تَلَف এর অধীনে আসতে পারে। অতএব এর দ্বারা হয়তো বোঝানো হচ্ছে যে, কৃপণের মাল যেন এমনিই শেষ হয়ে যায়, এর কোনও আর্থিক প্রতিদান সে না পায়। অথবা কৃপণ ব্যক্তির জীবন বৃথাই ধ্বংস হয়ে যায়। দান-খয়রাত না করার কারণে আখিরাতে কোনও প্রতিদান তো সে পাবেই না। ফলে তার ইহজীবন বৃথাই নষ্ট হয়ে যায় বৈ কি। সঞ্চয়ের ধান্ধায় পড়ে সে নেক আমল করার সুযোগ পায় না। সম্পদ বাড়ানোর দৌড়ঝাঁপ করতে করতেই কবরে চলে যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ (1) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (2)
‘(পার্থিব ভোগ-সামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্যলাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌছ।’(সূরা তাকাছুর (১০২), আয়াত ১,২)
এ অর্থও হতে পারে যে, তার যেন কোনও সুসন্তান জন্ম না নেয়। ফলে তার মৃত্যুর পর ওয়ারিছগণ তার রেখে যাওয়া সম্পদ নষ্ট করে ফেলবে, সৎকাজে খরচ করবে না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ফিরিশতার অস্তিত্ব সত্য এবং আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। তাদের একটা কাজ হচ্ছে নেককারদের জন্য নেকদু'আ করা ও বদকারদের জন্য বদদু'আ করা।
খ. সৎপথে খরচ করা একটি মহৎ কাজ। এর প্রতিদান কোনও না কোনওভাবে অবশ্যই পাওয়া যায়।
গ. কৃপণতা অতি মন্দ স্বভাব। এর অশুভ পরিণাম কোনও না কোনওভাবে ভোগ করতেই হয়।
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا طَلَعَتْ شَمْسٌ قَطُّ إِلَّا بُعِثَ بِجَنْبَتَيْهَا مَلَكَانِ يُنَادِيَانِ يُسْمِعَانِ أَهْلَ الْأَرْضِ إِلَّا الثَّقَلَيْنِ يَا أَيُّهَا النَّاسُ هَلُمُّوا إِلَى رَبِّكُمْ فَإِنَّ مَا قَلَّ وَكَفَى خَيْرٌ مِمَّا كَثُرَ وَأَلْهَى وَلَا آبَتْ شَمْسٌ قَطُّ إِلَّا بُعِثَ بِجَنْبَتَيْهَا مَلَكَانِ يُنَادِيَانِ يُسْمِعَانِ أَهْلَ الْأَرْضِ إِلَّا الثَّقَلَيْنِ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَأَعْطِ مُمْسِكًا مَالًا تَلَفًا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক সূর্যোদয়কালে সূর্যের দুপাশে দুজন ফিরিশতা পাঠানো হয়। তারা মানুষ ও জিন ছাড়া পৃথিবীর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে ডেকে বলে, হে মানুষ! এসো তোমাদের প্রতিপালকের দিকে। (ব্যক্তির জন্য) যে 'অল্প' যথেষ্ট হয়ে যায় (অর্থাৎ যাতে বান্দা পরিতুষ্ট থাকে) তা ওই 'বেশি' অপেক্ষা উত্তম, যা মানুষকে (আল্লাহ ও আখিরাত সম্পর্কে) উদাসীন করে দেয়। আর যখনই সূর্যাস্ত হয় তখন দুজন ফিরিশতা তার দুপাশে পাঠানো হয়। তারা মানুষ ও জিন ছাড়া পৃথিবীর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে ডেকে বলে, হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন আর কৃপণকে দিন নিষ্ফল ধন।(মুসনাদে আহমাদ: ২১৭২১; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩৩২৯; তাবারানী, আল্-মুজামুল আওসাত : ২৮৯১; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৮৮৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪০৪৫)
সূর্যের উদয় ও অস্তকালে কীভাবে ফিরিশতাদেরকে তার দুপাশে পাঠানো হয় এবং মানুষ ও জিন ছাড়া আর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে তারা কীভাবে এইসব এবং বলে তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টির কতটুকুই বা আমরা বুঝতে পারি? আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا (85)
‘তোমাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে সামান্যমাত্র।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৮৫)
আমাদের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন তা মেনে চলা। আমাদের লক্ষ্য করে যে আদেশ ও উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্ট। তা বোধ-বুদ্ধির অতীত নয়। সুতরাং এ হাদীছেরও উপদেশ পরিষ্কার। এর উপদেশ হচ্ছে, তোমরা দুনিয়ার মোহে বিভোর হয়ে থেকো না। আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ও আখিরাতের মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে অকাতরে দান-খয়রাত করতে থাকো। কৃপণতা করো না।
কল্যাণকর খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করলে ফিরিশতারা দু'আ করেন- اَللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفقًا خَلَفا ‘হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন'। খরচকারী বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো উদ্দেশ্য, যে তার অর্থ-সম্পদ পরিবারবর্গের মৌলিক ও বৈধ চাহিদা পূরণে ব্যয় করে। আত্মীয়-স্বজন ও অতিথিদের সেবা করে। অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করে। এছাড়াও যে-কোনও দীনী খাতে অকাতরে ব্যয় করে। বলাবাহুল্য ফিরিশতাদের দু'আ তো আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হবেই। কাজেই এটা নিশ্চিত যে, কল্যাণকর খাতে খরচকারীকে আল্লাহ তা'আলা উত্তম বদলা দিয়েই থাকেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তার বিনিময়ে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।’(সূরা সাবা' (৩৪), আয়াত ৩৯)
এখানে যে خَلَف (উত্তম বদলা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এর দ্বারা আসলে কী বোঝানো উদ্দেশ্য তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। নির্দিষ্ট না করার দ্বারা এর মধ্যে ব্যাপকতা এসে গেছে। কাজেই হতে পারে সে যা খরচ করেছে, আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ায়ই তাকে তা আরও বেশি পরিমাণে দেবেন। অর্থ-সম্পদ থেকে দান করা অর্থ-সম্পদের একরকম শোকরও বটে। শোকর আদায় করলে নি'আমত আরও বৃদ্ধি করা হয়। ইরশাদ হয়েছে
لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ
‘তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব।’(সূরা ইবরাহীম (১৪), আয়াত ৭)
এর দ্বারা আখিরাতের ছাওয়াবও বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। এমনও অনেক দানশীল আছে, যে দুনিয়া থেকে চলে যায় অথচ সে যা অর্থ-সম্পদ দান করেছে, দুনিয়ায় তার কোনও প্রতিদান দেখে যেতে পারে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিদানের অর্থ নেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হয়তো ছাওয়াবই বুঝতে হবে। অথবা হতে পারে, দান-খয়রাতের বিনিময়ে আল্লাহ তা'আলা তার দুনিয়ার কোনও বালা-মসিবত দূর করে দেন। বলাবাহুল্য, এর প্রত্যেকটিই উত্তম প্রতিদান এবং প্রত্যেক বান্দার কাঙ্ক্ষিতও বটে।
خلف এর দ্বারা উত্তম স্থলাভিষিক্তও বোঝানো হতে পারে। দু'আয় যেন বলা হয়েছে, হে আল্লাহ! এই দান-খয়রাতকারীকে এমন সুসন্তান দান করুন, যে তার মৃত্যুর পর তার দান-খয়রাতের ধারা অব্যাহত রাখবে। সে তার রেখে যাওয়া সম্পদ নষ্ট করবে না; বরং আপনার পথে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে সে সম্পদে আরও প্রবৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করবে। সন্দেহ নেই, এরূপ নেক সন্তান আল্লাহর পথে ব্যয় করা অর্থ-সম্পদের অতি উৎকৃষ্ট বদলা, যা যে-কোনও দীনদারের পরম কাম্য।
আর যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, তার জন্য ফিরিশতাগণ দু'আ করেন- وَأَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا ‘কৃপণকে দিন বিনাশ'। কৃপণ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যে ওয়াজিব ও ফরয খাতসমূহে ব্যয় করে না, মালের হক আদায় হতে বিরত থাকে এবং কোনওরকম নফল দান-খয়রাতের বিলকুল আগ্রহ রাখে না।
এখানে تَلَف শব্দটি خَلَف এর বিপরীতে আনা হয়েছে। কাজেই خَلَفَ এর ব্যাখ্যায় উপরে যা-কিছু উল্লেখ করা হল, তার বিপরীত সবকিছুই تَلَف এর অধীনে আসতে পারে। অতএব এর দ্বারা হয়তো বোঝানো হচ্ছে যে, কৃপণের মাল যেন এমনিই শেষ হয়ে যায়, এর কোনও আর্থিক প্রতিদান সে না পায়। অথবা কৃপণ ব্যক্তির জীবন বৃথাই ধ্বংস হয়ে যায়। দান-খয়রাত না করার কারণে আখিরাতে কোনও প্রতিদান তো সে পাবেই না। ফলে তার ইহজীবন বৃথাই নষ্ট হয়ে যায় বৈ কি। সঞ্চয়ের ধান্ধায় পড়ে সে নেক আমল করার সুযোগ পায় না। সম্পদ বাড়ানোর দৌড়ঝাঁপ করতে করতেই কবরে চলে যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ (1) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (2)
‘(পার্থিব ভোগ-সামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্যলাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌছ।’(সূরা তাকাছুর (১০২), আয়াত ১,২)
এ অর্থও হতে পারে যে, তার যেন কোনও সুসন্তান জন্ম না নেয়। ফলে তার মৃত্যুর পর ওয়ারিছগণ তার রেখে যাওয়া সম্পদ নষ্ট করে ফেলবে, সৎকাজে খরচ করবে না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ফিরিশতার অস্তিত্ব সত্য এবং আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। তাদের একটা কাজ হচ্ছে নেককারদের জন্য নেকদু'আ করা ও বদকারদের জন্য বদদু'আ করা।
খ. সৎপথে খরচ করা একটি মহৎ কাজ। এর প্রতিদান কোনও না কোনওভাবে অবশ্যই পাওয়া যায়।
গ. কৃপণতা অতি মন্দ স্বভাব। এর অশুভ পরিণাম কোনও না কোনওভাবে ভোগ করতেই হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)