রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৪৬
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতা
হাদীছ নং: ৫৪৬

হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এমন কখনও হয়নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনও জিনিস চাওয়া হয়েছে আর তিনি না বলেছেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৬০৩৪; সহীহ মুসলিম: ২৩১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩১৮১০; মুসনাদুল হুমায়দী: ১২৬৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৯২০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৬৮৫)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
546 - وعن جابرٍ - رضي الله عنه - قَالَ: مَا سُئِلَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - شَيْئًا قَطُّ، فقالَ: لاَ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবারিত দানশীলতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। হযরত জাবির রাযি. ছিলেন তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষের প্রতি তাঁর আচরণ সর্বদাই তাঁর চোখে পড়ত। তাছাড়া তাঁর চরিত্র ও গুণাবলি নিয়ে সাহাবীগণ পরস্পরে আলোচনাও করতেন। ফলে অন্যান্য গুণের মতো তাঁর দানশীলতার বিষয়টিও তাদের সকলের ভালোভাবে জানা ছিল। সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন-
كَانَ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ أَجْوَدَ النَّاسِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দানশীল।(সহীহ বুখারী: ৬; সহীহ মুসলিম: ২৩০৮; সুনানে নাসাঈ: ২০৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩৪৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২৬৬২৪; মুসনাদে আহমাদ: ২৬১৮; শু'আবুল ঈমান : ২০৫১)

তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে হাদীছ গ্রন্থসমূহে বিপুল সংখ্যক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যাহোক হযরত জাবির রাযি. বলছেন যে-
مَا سُئِلَ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ شَيْئًا قَطْ فَقَالَ : لَا (এমন কখনও হয়নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনও জিনিস চাওয়া হয়েছে আর তিনি না বলেছেন)। অর্থাৎ যা চাওয়া হতো তা তাঁর কাছে থাকলে তো দিয়ে দিতেন, আর না থাকলে ভবিষ্যতে দেওয়ার ওয়াদা করতেন কিংবা তার জন্য দু'আ করতেন ও নম্র-কোমল কথায় বিদায় করতেন। সরাসরি 'না' বলতেন না। দিতে না পারলে অপারগতা প্রকাশ করতেন। 'দেব না' বা 'দিতে পারব না', এরকম বলতেন না। এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় কুরআন মাজীদের এক আয়াতে। তাবুকের যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে কিছু সংখ্যক সাহাবী তাঁর কাছে এসে বাহন চাইলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ
আমার কাছে তো তোমাদেরকে দেওয়ার মতো কোনও বাহন নেই।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৯২)

বলাবাহুল্য, 'দিতে পারব না' আর 'আমার কাছে তো দেওয়ার মতো কোনও বাহন নেই'- এ দুই কথার মধ্যে দুস্তর পার্থক্য। দ্বিতীয় কথার ভেতর কোমলতা ও মমত্ব প্রকাশ পায়। প্রথম বাক্যে প্রকাশ পায় রূঢ়তা ও কঠোরতা। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ বলতেন না। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةٍ مِنْ رَبِّكَ تَرْجُوهَا فَقُلْ لَهُمْ قَوْلًا مَيْسُورًا (28)
‘যদি কখনও তাদের (অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের) থেকে এ কারণে তোমার মুখ ফেরানোর দরকার হয় যে, তুমি তোমার প্রতিপালকের রহমতের প্রত্যাশায় রয়েছ, তবে সে ক্ষেত্রেও তাদের সাথে নম্রতার সাথে কথা বলো।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৮)
অর্থাৎ নিজের কাছে টাকা-পয়সা না থাকা অবস্থায় যদি কোনও অভাবগ্রস্ত আসে আর তখন তাকে কিছু দেওয়া সম্ভব না হয় কিন্তু এই আশায় থাক যে, আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দিলে তখন তাদেরকে সাহায্য করবে, সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে নম্র ভাষায় অপারগতা প্রকাশ করবে।

প্রশ্ন হতে পারে, আশ'আর গোত্রের একদল লোক তাঁর কাছে এসে বাহন চাইলে তো তিনি বলেছিলেন-
وَاللَّهِ لَا أَحْمِلُكُمْ، وَمَا عِنْدِي مَا أَحْمِلُكُمْ
‘আল্লাহর কসম, আমি তোমাদেরকে বাহন দেব না এবং আমার কাছে তোমাদেরকে দেওয়ার মতো বাহন নেই।’(সহীহ বুখারী: ৩১৩৩)
এর উত্তর হল, তিনি তাদেরকে এরূপ বলেছিলেন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে। কেননা সময়টা ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতিকালীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যে অতিরিক্ত বাহন নেই তা সকলেরই জানা ছিল। এ অবস্থায় তাদের চাওয়া ঠিক হয়নি। তাঁর কাছে না থাকা সত্ত্বেও চাওয়ার দ্বারা তাঁকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছিল। মহানুভব নবী তো দিতে পারলেই আনন্দ বোধ করতেন। কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইল আর তিনি দিতে পারছেন না, এটা তাঁর পক্ষে কষ্টদায়ক ছিল। তাঁর এ মহৎ চরিত্রের কথা সকলেরই জানা। এ অবস্থায় তাঁর কাছে যা নেই তা চেয়ে কেন তাঁকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়া? প্রিয় সাহাবীদের এ বিষয়টা শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল। আগামীতে তারা সারা জাহানের শিক্ষক হবেন। জীবনসংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় তারা মানুষকে শিক্ষা দেবেন। এমন এমন পরিস্থিতি এসে পড়ে, যখন মানুষের কোনও না কোনও জিনিস অন্যের কাছে চাইতে হয়। তো প্রয়োজনীয় জিনিসটি কার কাছে চাবে, তা জানা থাকা দরকার। যার কাছে তা নেই তার কাছে যদি চাওয়া হয়, তবে তাকে শুধু শুধুই বিব্রত করা হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এ শিক্ষা তুলে ধরার জন্য প্রিয় সাহাবীদের এ বিষয়ে সচেতন করা দরকার ছিল। সে প্রয়োজনেই তিনি তাদেরকে এভাবে সরাসরি বলে দেন যে, আমি তোমাদের কিছু দেব না। তবে প্রথমে এ কথা বললেও তিনি তো ছিলেন দয়ার সাগর, তাই তারা যাতে মনে কষ্ট না পান সে লক্ষ্যে সঙ্গে সঙ্গে দিতে না পারার কারণটিও জানিয়ে দেন যে, আমার কাছে তো তোমাদেরকে দেওয়ার মতো কোনও বাহন নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অবারিত দানশীলতা ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের এক বিশেষ দিক। তাঁর উম্মতরূপে আমাদেরও এ গুণ আয়ত্ত করতে হবে।

খ. কেউ কিছু চাইলে সরাসরি না বলতে নেই। বরং কোমল ভাষায় যুক্তিসঙ্গত ওজর দেখানো চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)