রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৪৩
ভূমিকা অধ্যায়
উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
الكرم অর্থ উদারতা, দানশীলতা। যেখানে যে পরিমাণ খরচ করা দরকার, সেখানে সেই পরিমাণ খরচ করাকে اَلْكَرَمُ বলা হয়। আরবীতে এ অর্থে আরও কয়েকটি শব্দ আছে। যেমন- اَلْجُوْدُ، اَلسَّخَاءُ، اَلسَّمَاحَةُ। ইমাম কাযী ইয়ায রহ.-এর মতে সবগুলো শব্দের অর্থ কাছাকাছি। কেউ কেউ এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্যও করেছেন। তবে সাধারণভাবে সবগুলো দ্বারাই উদারতা ও দানশীলতা বোঝানো হয়ে থাকে।
উদারতা ও দানশীলতা ইসলামের নৈতিক শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। পুণ্যার্জন বা আখিরাতের মুক্তিলাভের পক্ষে এটা অনেক বড় উপায়। কুরআন ও হাদীছে বিভিন্নভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং এর প্রতি উৎসাহ যোগানো হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)
‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৯২)
অপর এক আয়াতে পুণ্য ও ছাওয়াবের কাজের একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে। তার অনেকগুলো ধারাই আল্লাহর পথে অর্থব্যয় সম্পর্কে। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ
‘বরং পুণ্য হল (সেই ব্যক্তির কার্যাবলি), যে ঈমান রাখে আল্লাহর, শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৭৭)
এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
السَّخِيُّ قَرِيبٌ مِنَ اللهِ ، بَعِيدٌ مِنَ النَّارِ ، قَرِيبٌ مِنَ الْجَنَّةِ ، قَرِيبٌ مِنَ النَّاسِ
‘দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী এবং মানুষেরও নিকটবর্তী।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৩৬৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৫২
قال الإمام أبو حاتم : هذا حديث باطل، وسعيد (بن مسلمة الراوي عن يحي بن سعيد) ضعيف الحديث، أخاف أن يكون أدخل له. (علل ابن أبي حاتم ٩٧/٦ (٣٢٥٢). وقال أيضا (٢٣٥٣): هذا حديث منكر فيه سعيد بن محمد الوراق (الراوي عن يحي بن سعيد) قال الدارقطني متروك. قال العقيلي : ليس لهذا الحديث أصل من حديث يحي ولا غيره)
অপর এক বর্ণনায় এসেছে-
الْجَنَّةُ دَارُ الْأَسْخِيَاءِ
‘জান্নাত দানশীলদের নিবাস।(খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৫৯৭; ইবন শাহীন, আত-তারগীব: ২৬৮
قال الدارقطني في العلل ۱۲٥/١٤ (٣٤٧٣) : لا يصح هذا الحديث. قال المحرر: فيه جَحْدَر، واسمه عبد الرحمن بن الحارث، قال ابن عدي : يسرق الحديث وهو بين الضعف جدا. قال الذهبي في ميزان الاعتدال: هذا حديث منكر، ما آفته سوى جحدر. قال عبد الله معروف: وما ذكر في الإحالة من رواية الترغيب لابن شاهين، فهو غير إسناد جحدر، لكن فيه عبد ربه بن سليم مجهول، كما قال ابن أبي حاتم في علله عن أبيه.)
মূলত ধন-সম্পদ দুনিয়ার জরুরত পূরণ ও আখিরাতের মুক্তিলাভের জন্যই। সম্পদ যদি সে উদ্দেশ্যে ব্যয় না করে বিলাসিতার পেছনে খরচ করা হয়, তবে তা কেবল ক্ষতিই বয়ে আনে। হযরত আবু যার্র রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছলাম। তখন তিনি কা'বার ছায়ায় বসা ছিলেন। তিনি বলছিলেন, কা'বার রব্বের শপথ! তারাই সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি এ কথা তিনবার বলেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার কী হল? আমার ভেতর অপ্রীতিকর কিছু দেখা যাচ্ছে কি? আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে বসলাম। আমার পক্ষে চুপ থাকা সম্ভব হল না। শেষে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত। তারা কারা? তিনি বললেন-
الْأَكْثَرُوْنَ أَمْوَالًا ، إِلَّا مَنْ قَالَ هكَذَا، وَهكَذَا، وَهكَذَا
‘যাদের ধন-সম্পদ বেশি। তবে যারা এরূপ, এরূপ ও এরূপ করে (অর্থাৎ ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে সবদিকে খরচ করে) তারা ব্যতিক্রম।(সহীহ বুখারী : ৬৬৩৮; সহীহ মুসলিম: ৯৯০; জামে' তিরমিযী: ৬১৭; সুনানে নাসাঈ ২৪৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪৩৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ২১৩৫১; সহীহ ইবন খুযায়মা ২২৫১)
আল্লাহর পথে খরচ করার দ্বারা পরকালীন ফায়দা তো আছেই, দুনিয়ায়ও এর উপকার বহুবিধ। সর্বাপেক্ষা বড় একটি উপকার হল দানশীল ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহ তা'আলার সাহায্য উন্মুক্ত থাকে এবং দান-খয়রাতের বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করা হয়। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَجَافُوْا عَنْ ذَنْبِ السَّخِيِّ، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى آخِذٌ بِيَدِهِ كُلَّمَا عَثَرَ
‘তোমরা দানশীল ব্যক্তির ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করো। কেননা যখনই তার পদস্খলন ঘটে, আল্লাহ তা'আলা তার হাত ধরেন।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৬৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭১০
عده الصغاني من الموضوعات، وقال الذهبي في سير أعلام النبلاء ٢٦١/١٧ (ترجمة خلف ابن محمد الواسطي): هذا حديث منكر)
প্রকৃতপক্ষে আখিরাতের মুক্তিই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। তাই দুনিয়ায় আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু দিয়েছেন, তা সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ব্যয় করা উচিত। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
‘আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না।'(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৭)
একবার হযরত মু'আবিয়া রাযি. হযরত আমর ইবনুল আস রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেন, মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দানশীল কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার দীন গড়ার লক্ষ্যে দুনিয়া ব্যয় করে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মহান গুণাবলির অধিকারী ছিলেন, দানশীলতা তার অন্যতম। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দানবীর ছিলেন। তাঁকে উম্মতের জন্য আদর্শ করে বানানো হয়েছে। প্রত্যেকের কর্তব্য তাঁর অন্যান্য গুণের মতো দানশীলতার গুণটিও আয়ত্ত করা। কেননা এর রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ। আল্লাহর পথে দান করার দ্বারা বিপুল ছাওয়াব অর্জন করা যায়। এতে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। এটা আখিরাতে মুক্তিলাভ করার পক্ষে সহায়ক। দুনিয়ায়ও এর নানা উপকার রয়েছে। এর ফলে সম্পদে বরকত হয়, মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় এবং গায়েবীভাবে আল্লাহ তা'আলার সাহায্যও লাভ হয়। তাই মানুষের উচিত অভাবের ভয় করে কিংবা কমে যাবে এ আশঙ্কা করে দান-খয়রাত হতে পিছিয়ে না থাকা। বরং আল্লাহ তা'আলার ভাণ্ডার অফুরন্ত, বান্দা তাঁর পথে দান-খয়রাত করতে থাকলে তিনি তার জন্য নিজ অফুরন্ত ভাণ্ডারের দরজা খুলে দেবেন- এ বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী সৎকর্মের খাতসমূহে খরচ করতে থাকা চাই। মুমিন বান্দা যাতে সেই আস্থা ও তাওয়াক্কুলের সাথে আল্লাহর পথে অকুণ্ঠভাবে দান-খয়রাত করে, সে লক্ষ্যে কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু হাদীছে এর প্রতি উৎসাহদান করা হয়েছে। ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
‘উদারতা ও দানশীলতা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
অর্থ: ‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।(সূরা সাবা' (৩৪), আয়াত ৩৯)
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আল্লাহর পথে ও নিজ প্রয়োজনে খরচ করতে থাকো। কৃপণতা করো না। ভয় করো না যে, খরচ করলে সম্পদ কমে যাবে বা অভাবে পড়ে যাবে। খরচ করলে রিযিক কমে না। আল্লাহ তা'আলা যার ভাগ্যে যা রেখেছেন তা সে পাবেই। বরং খরচ করলেই লাভ। আল্লাহর হুকুম মোতাবেক খরচ করার দ্বারা অর্থ-সম্পদে বরকত হয় এবং আখিরাতে ছাওয়াব পাওয়া যায়।
বলা হয়েছে- 'তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন', এ দেওয়াটা আখিরাতের ছাওয়াব আকারেও হতে পারে এবং দুনিয়াবী বদলাও হতে পারে। খরচ করার দ্বারা মনের ঐশ্বর্য তো লাভ হয়ই, যা কিনা প্রকৃত ঐশ্বর্য। সেইসঙ্গে লাভ হয় বরকতও। বরকত হওয়ার মানে অল্প খরচেই অনেক বড় প্রয়োজন মিটে যাওয়া, অহেতুক খরচ থেকে রক্ষা পাওয়া, যা খরচ হয় তা বৃথা না যাওয়া; বরং যে উদ্দেশ্যে খরচ করা হয় তা অর্জিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব অর্জন খরচ করার দ্বারাই হয়। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-
أَنْفِقْ يَا بِلَالُ ، وَلَا تَخْشَ مِنْ ذِي الْعَرْشِ إِقْلَالًا
‘হে বিলাল! খরচ করো। আরশওয়ালার কাছ থেকে কমানোর ভয় করো না।(শুআবুল ঈমান : ১৩৯৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ১০২৬)
আয়াতে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, খরচ করলে আল্লাহ তার বিনিময় দান করেন। এর দ্বারা বোঝা যায় খরচ করতে হবে বৈধ খাতে। কেননা বিনিময় দান করাটা আল্লাহর খুশির আলামত। অবৈধ খাতে খরচ করলে খুশি নয়; বরং তিনি নারাজ হন। সে ক্ষেত্রে বিনিময়লাভের আশা করা যায় না। এমনিভাবে খরচ করতে হবে পরিমিতভাবে। অপব্যয় বা অপচয় করা জায়েয নয়। কুরআন-হাদীছে তা নিষেধ করা হয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহপ্রদত্ত অর্থ-সম্পদ প্রয়োজনীয় খাতে অকৃপণভাবে খরচ করা চাই।
খ. খরচ যাতে বৈধ খাতে হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
গ. শরী'আত মোতাবেক খরচ করলে দুনিয়া ও আখিরাতে বিনিময়লাভের আশা থাকে।
দুই নং আয়াত
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ (272)
অর্থ: ‘তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণার্থে হয়ে থাকে। আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় কর না। আর তোমরা যে সম্পদই ব্যয় করবে, তোমাদেরকে তা পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭২)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে কয়েকটি বাক্য আছে। প্রথম বাক্য হল- وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنْفُسِكُمْ (তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণার্থে হয়ে থাকে)। خير শব্দের মূল অর্থ কল্যাণ। এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য ধন-সম্পদ। অনেকে ব্যাপক অর্থে যে-কোনও কল্যাণকর বিষয়কেই এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন বিদ্যা, বুদ্ধি, কায়িক শ্রম ইত্যাদি। আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থ-সম্পদ বা যে-কোনও কল্যাণকর বস্তু খরচ করলে তার ফায়দা ও সুফল খরচকারী ব্যক্তির নিজেরই লাভ হয়। কোথায় খরচ করা হবে, তা আয়াতে বলা হয়নি। তবে সাধারণত এর দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ বোঝানো হয়। নিজ প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় খরচ করা, পারিবারিক প্রয়োজনে খরচ করা, আল্লাহর সৃষ্টির সেবায় খরচ করা, আল্লাহর দীন কায়েম ও প্রচারে খরচ করা, এ সবই আল্লাহর পথে খরচ করার অন্তর্ভুক্ত। তো এসব খাতে অর্থ-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি ইত্যাদি যা-ই খরচ করা হোক, তাতে ব্যক্তির নিজেরই কল্যাণ সাধিত হয়। কেননা এর সুফল দুনিয়ায়ও পাওয়া যায় এবং আখিরাতেও পাওয়া যাবে। দুনিয়ায় পাওয়া যায় এভাবে যে, যাদের পেছনে খরচ করা হয় তারা খরচকর্তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও তার সুহৃদ হয়ে যায়। আর সুনাম-সুখ্যাতি তো হয়ই। যদিও খরচ করার পেছনে এরকম নিয়ত রাখা ঠিক নয়।
আর আখিরাতের কল্যাণ লাভ হয় বিপুল ছাওয়াব অর্জনের মাধ্যমে। খাঁটি নিয়তে খরচ করলে আল্লাহ তা'আলা দশগুণ থেকে সাতশ'গুণ পর্যন্ত বেশি ছাওয়াব দান করেন। আল্লাহ চাইলে তার বেশিও দিতে পারেন। কুরআন-হাদীছে সেরকম দেওয়ার ওয়াদা রয়েছে। বলাবাহুল্য, ছাওয়াব যত বেশি অর্জন করা যায়, ততোই আখিরাতে নাজাতলাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। আখিরাতের নাজাত লাভই সর্বাপেক্ষা বড় কল্যাণ।
প্রকাশ থাকে যে, অর্থব্যয়ের উল্লিখিত লাভ কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে, যখন সে ব্যয় হবে বৈধ উপার্জন থেকে। আয়াতের মধ্যেই সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যে 'খায়র' ব্যয় কর। 'খায়র'-এর মূল অর্থ কল্যাণ ও উত্তম। দানের বস্তুকে 'খায়র' শব্দে ব্যক্ত করার মধ্যে ইশারা পাওয়া যায় যে, সে বস্তুটি উত্তম ও কল্যাণপূর্ণ হতে হবে। বলাবাহুল্য তা হতে পারে কেবল হালাল উপার্জনেই। হারাম উপায়ে অর্জিত সম্পদে কোনও কল্যাণ নেই; বরং তা নিকৃষ্ট মাল।
দান-খয়রাতের ফায়দা যখন ব্যক্তির নিজেরই হাসিল হয়, তখন যার প্রতি দান- খয়রাত করা হয়, তাকে খোঁটা দেওয়ার কোনও বৈধতা থাকে না। খোঁটা দিলে দান- খয়রাতের ছাওয়াব নষ্ট হয়। এ আয়াত ইঙ্গিত করছে, খরচ করার দ্বারা যেমন তুমি নিজেই লাভবান হচ্ছ, তখন অন্যকে খোঁটা দিবে কেন? অর্থাৎ কোনও অবস্থায়ই খোঁটা দিয়ো না।
আয়াতের দ্বিতীয় বাক্য হল- وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ (আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় কর না)। এটাই মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا (9)
‘আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না।(সূরা দাহর (৭৬), আয়াত ৯)
উদ্দেশ্য যখন আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি, তখন যাকে দেওয়া হল তার কাছ থেকে কোনও প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাওয়ার কোনও প্রশ্ন আসে না। বরং নিজেরই তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, যেহেতু তাকে দিতে পারা ও তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের সুযোগ হচ্ছে। যারা কাউকে কিছু দেওয়ার পর তার পক্ষ থেকে বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা না পেলে খোঁটা দিয়ে ফেলে, তাদের জন্য এর মধ্যে সতর্কবার্তা রয়েছে। কেননা খোঁটা দেওয়ার দ্বারা ইঙ্গিত হয় যে, দান করার মধ্যে পুরোপুরি ইখলাস ছিল না এবং একান্তভাবে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিই লক্ষ্যবস্তু ছিল না। আয়াতটি বলছে, মুমিন ব্যক্তির দান হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে। অন্যথায় সে দানের মাধ্যমে তাঁর কাছে কিছু পাওয়া যাবে না। তা হবে বৃথা দান এবং সম্পদের অপচয়। সম্পদের অপচয় করা নাজায়েয কাজ।
আয়াতে ইশারা রয়েছে, কারও পেছনে খরচ করলে কিংবা অন্য কোনওভাবে কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করলে সে লোকটি কেমন সেদিকে লক্ষ করার প্রয়োজন নেই। সাহায্য করার দ্বারা যদি দীনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, তবে সে লোকটি কাফের-ফাসেক যাই হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার কাছে অবশ্যই ছাওয়াব পাওয়া যাবে। উদ্দেশ্য যদি থাকে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ করা, তবে অমুসলিম ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণ করলেও নেকী লাভ হবে। এমনকি পশু-পাখিকে খাওয়ালেও ছাওয়াব পাওয়া যাবে। অবশ্য এ কথা কেবল নফল দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যাকাত- ফিতরা, মানত ইত্যাদি ফরয দান কেবল মুমিন-মুসলিমকেই দেওয়া যায়।
আয়াতের তৃতীয় বাক্য হল- وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ (আর তোমরা যে সম্পদই ব্যয় করবে, তোমাদেরকে তা পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না)। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা তার প্রাপ্য ছাওয়াব ও পুরস্কার পরিপূর্ণরূপে দান করবেন। কম দেবেন না মোটেই; বরং নিজ মেহেরবানীতে প্রাপ্যের চেয়ে বেশিই দেবেন। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (261)
‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম, যেমন একটি শস্যদানা সাতটি শীষ উদ্গত করে (এবং) প্রতিটি শীষে একশ দানা জন্মায়। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন (ছাওয়াবে) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় (এবং) সর্বজ্ঞ।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬১)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. এ আয়াতে দান-খয়রাত করার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
খ. অর্থ-সম্পদ খায়র বা কল্যাণকর বস্তু। তা বৈধ পথে উপার্জন করা ও তার সদ্ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
গ. আল্লাহর পথে ব্যয় বলতে কেবল মাল নয়, বিদ্যা-বুদ্ধি ও অন্যান্য কল্যাণকর বিষয়ের ব্যয়কেও বোঝায়।
ঘ. আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে কেবলই তাঁর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে।
ঙ. দান-খয়রাত করার সুফল মূলত ব্যক্তির নিজেরই লাভ হয়ে থাকে।
চ. দান-খয়রাত করার পর খোঁটা দেওয়া জায়েয নয়।
ছ. আল্লাহর পথে খরচ করলে প্রাপ্য বিনিময় তো বটেই, বরং আল্লাহ তা'আলা বহুগুণ বেশিই দিয়ে থাকেন।
জ. নফল দান-খয়রাত অমুসলিমদের প্রতিও করা যায়।
তিন নং আয়াত
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (273)
অর্থ: ‘তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর, আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭৩)
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ তোমরা কৃপণতা করো না। আল্লাহর পথে অকুণ্ঠভাবে খরচ করো। তোমাদের খরচ বৃথা যাবে না। কেননা আল্লাহ তা'আলা জানেন তোমরা কোথায় কী খরচ করছ এবং কী নিয়তে খরচ করছ। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে খরচ করে থাকলে তিনি তার পুরোপুরি বিনিময় তোমাদের দান করবেন। এভাবে আয়াতটিতে আল্লাহর পথে খরচ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
‘খায়র’ শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে এর অর্থ হবে- তোমরা তোমাদের ধন- সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রভৃতি কল্যাণকর যা-কিছু আছে, তা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে খরচ করো। তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখো এবং তা দ্বারা আল্লাহর মাখলুকের সেবা করো। যদি তা কর, তবে তা বৃথা যাবে না; বরং আল্লাহ তা'আলা নিজ জ্ঞান অনুযায়ী তোমাদেরকে তার প্রতিদান দেবেন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. এ আয়াতের ভেতর আল্লাহর পথে ব্যয় করার অনুপ্রেরণা মেলে।
খ. আল্লাহর পথে ব্যয় করলে তা বৃথা যায় না।
গ. অর্থ-সম্পদ কল্যাণকর বস্তু। তা কল্যাণকর কাজেই ব্যবহার করা চাই।
ঘ. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। যা-কিছু যে পরিমাণে খরচ করা হয়, যে খাতে খরচ করা হয় এবং যে উদ্দেশ্যে খরচ করা হয়, তার সবই তিনি জানেন।
ঙ. আল্লাহ তা'আলার নি'আমতের ব্যবহার ও খরচের বেলায় তাঁর সর্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন থাকা চাই।
الكرم অর্থ উদারতা, দানশীলতা। যেখানে যে পরিমাণ খরচ করা দরকার, সেখানে সেই পরিমাণ খরচ করাকে اَلْكَرَمُ বলা হয়। আরবীতে এ অর্থে আরও কয়েকটি শব্দ আছে। যেমন- اَلْجُوْدُ، اَلسَّخَاءُ، اَلسَّمَاحَةُ। ইমাম কাযী ইয়ায রহ.-এর মতে সবগুলো শব্দের অর্থ কাছাকাছি। কেউ কেউ এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্যও করেছেন। তবে সাধারণভাবে সবগুলো দ্বারাই উদারতা ও দানশীলতা বোঝানো হয়ে থাকে।
উদারতা ও দানশীলতা ইসলামের নৈতিক শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। পুণ্যার্জন বা আখিরাতের মুক্তিলাভের পক্ষে এটা অনেক বড় উপায়। কুরআন ও হাদীছে বিভিন্নভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং এর প্রতি উৎসাহ যোগানো হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)
‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে। তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ৯২)
অপর এক আয়াতে পুণ্য ও ছাওয়াবের কাজের একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে। তার অনেকগুলো ধারাই আল্লাহর পথে অর্থব্যয় সম্পর্কে। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ
‘বরং পুণ্য হল (সেই ব্যক্তির কার্যাবলি), যে ঈমান রাখে আল্লাহর, শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৭৭)
এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
السَّخِيُّ قَرِيبٌ مِنَ اللهِ ، بَعِيدٌ مِنَ النَّارِ ، قَرِيبٌ مِنَ الْجَنَّةِ ، قَرِيبٌ مِنَ النَّاسِ
‘দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী এবং মানুষেরও নিকটবর্তী।(তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৩৬৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৫২
قال الإمام أبو حاتم : هذا حديث باطل، وسعيد (بن مسلمة الراوي عن يحي بن سعيد) ضعيف الحديث، أخاف أن يكون أدخل له. (علل ابن أبي حاتم ٩٧/٦ (٣٢٥٢). وقال أيضا (٢٣٥٣): هذا حديث منكر فيه سعيد بن محمد الوراق (الراوي عن يحي بن سعيد) قال الدارقطني متروك. قال العقيلي : ليس لهذا الحديث أصل من حديث يحي ولا غيره)
অপর এক বর্ণনায় এসেছে-
الْجَنَّةُ دَارُ الْأَسْخِيَاءِ
‘জান্নাত দানশীলদের নিবাস।(খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৫৯৭; ইবন শাহীন, আত-তারগীব: ২৬৮
قال الدارقطني في العلل ۱۲٥/١٤ (٣٤٧٣) : لا يصح هذا الحديث. قال المحرر: فيه جَحْدَر، واسمه عبد الرحمن بن الحارث، قال ابن عدي : يسرق الحديث وهو بين الضعف جدا. قال الذهبي في ميزان الاعتدال: هذا حديث منكر، ما آفته سوى جحدر. قال عبد الله معروف: وما ذكر في الإحالة من رواية الترغيب لابن شاهين، فهو غير إسناد جحدر، لكن فيه عبد ربه بن سليم مجهول، كما قال ابن أبي حاتم في علله عن أبيه.)
মূলত ধন-সম্পদ দুনিয়ার জরুরত পূরণ ও আখিরাতের মুক্তিলাভের জন্যই। সম্পদ যদি সে উদ্দেশ্যে ব্যয় না করে বিলাসিতার পেছনে খরচ করা হয়, তবে তা কেবল ক্ষতিই বয়ে আনে। হযরত আবু যার্র রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছলাম। তখন তিনি কা'বার ছায়ায় বসা ছিলেন। তিনি বলছিলেন, কা'বার রব্বের শপথ! তারাই সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি এ কথা তিনবার বলেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার কী হল? আমার ভেতর অপ্রীতিকর কিছু দেখা যাচ্ছে কি? আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে বসলাম। আমার পক্ষে চুপ থাকা সম্ভব হল না। শেষে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত। তারা কারা? তিনি বললেন-
الْأَكْثَرُوْنَ أَمْوَالًا ، إِلَّا مَنْ قَالَ هكَذَا، وَهكَذَا، وَهكَذَا
‘যাদের ধন-সম্পদ বেশি। তবে যারা এরূপ, এরূপ ও এরূপ করে (অর্থাৎ ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে সবদিকে খরচ করে) তারা ব্যতিক্রম।(সহীহ বুখারী : ৬৬৩৮; সহীহ মুসলিম: ৯৯০; জামে' তিরমিযী: ৬১৭; সুনানে নাসাঈ ২৪৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪৩৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ২১৩৫১; সহীহ ইবন খুযায়মা ২২৫১)
আল্লাহর পথে খরচ করার দ্বারা পরকালীন ফায়দা তো আছেই, দুনিয়ায়ও এর উপকার বহুবিধ। সর্বাপেক্ষা বড় একটি উপকার হল দানশীল ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহ তা'আলার সাহায্য উন্মুক্ত থাকে এবং দান-খয়রাতের বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করা হয়। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَجَافُوْا عَنْ ذَنْبِ السَّخِيِّ، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى آخِذٌ بِيَدِهِ كُلَّمَا عَثَرَ
‘তোমরা দানশীল ব্যক্তির ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করো। কেননা যখনই তার পদস্খলন ঘটে, আল্লাহ তা'আলা তার হাত ধরেন।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৩৬৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৭১০
عده الصغاني من الموضوعات، وقال الذهبي في سير أعلام النبلاء ٢٦١/١٧ (ترجمة خلف ابن محمد الواسطي): هذا حديث منكر)
প্রকৃতপক্ষে আখিরাতের মুক্তিই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। তাই দুনিয়ায় আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু দিয়েছেন, তা সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ব্যয় করা উচিত। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
‘আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না।'(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৭)
একবার হযরত মু'আবিয়া রাযি. হযরত আমর ইবনুল আস রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেন, মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দানশীল কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার দীন গড়ার লক্ষ্যে দুনিয়া ব্যয় করে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মহান গুণাবলির অধিকারী ছিলেন, দানশীলতা তার অন্যতম। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দানবীর ছিলেন। তাঁকে উম্মতের জন্য আদর্শ করে বানানো হয়েছে। প্রত্যেকের কর্তব্য তাঁর অন্যান্য গুণের মতো দানশীলতার গুণটিও আয়ত্ত করা। কেননা এর রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ। আল্লাহর পথে দান করার দ্বারা বিপুল ছাওয়াব অর্জন করা যায়। এতে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। এটা আখিরাতে মুক্তিলাভ করার পক্ষে সহায়ক। দুনিয়ায়ও এর নানা উপকার রয়েছে। এর ফলে সম্পদে বরকত হয়, মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় এবং গায়েবীভাবে আল্লাহ তা'আলার সাহায্যও লাভ হয়। তাই মানুষের উচিত অভাবের ভয় করে কিংবা কমে যাবে এ আশঙ্কা করে দান-খয়রাত হতে পিছিয়ে না থাকা। বরং আল্লাহ তা'আলার ভাণ্ডার অফুরন্ত, বান্দা তাঁর পথে দান-খয়রাত করতে থাকলে তিনি তার জন্য নিজ অফুরন্ত ভাণ্ডারের দরজা খুলে দেবেন- এ বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী সৎকর্মের খাতসমূহে খরচ করতে থাকা চাই। মুমিন বান্দা যাতে সেই আস্থা ও তাওয়াক্কুলের সাথে আল্লাহর পথে অকুণ্ঠভাবে দান-খয়রাত করে, সে লক্ষ্যে কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু হাদীছে এর প্রতি উৎসাহদান করা হয়েছে। ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
‘উদারতা ও দানশীলতা…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
অর্থ: ‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।(সূরা সাবা' (৩৪), আয়াত ৩৯)
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আল্লাহর পথে ও নিজ প্রয়োজনে খরচ করতে থাকো। কৃপণতা করো না। ভয় করো না যে, খরচ করলে সম্পদ কমে যাবে বা অভাবে পড়ে যাবে। খরচ করলে রিযিক কমে না। আল্লাহ তা'আলা যার ভাগ্যে যা রেখেছেন তা সে পাবেই। বরং খরচ করলেই লাভ। আল্লাহর হুকুম মোতাবেক খরচ করার দ্বারা অর্থ-সম্পদে বরকত হয় এবং আখিরাতে ছাওয়াব পাওয়া যায়।
বলা হয়েছে- 'তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন', এ দেওয়াটা আখিরাতের ছাওয়াব আকারেও হতে পারে এবং দুনিয়াবী বদলাও হতে পারে। খরচ করার দ্বারা মনের ঐশ্বর্য তো লাভ হয়ই, যা কিনা প্রকৃত ঐশ্বর্য। সেইসঙ্গে লাভ হয় বরকতও। বরকত হওয়ার মানে অল্প খরচেই অনেক বড় প্রয়োজন মিটে যাওয়া, অহেতুক খরচ থেকে রক্ষা পাওয়া, যা খরচ হয় তা বৃথা না যাওয়া; বরং যে উদ্দেশ্যে খরচ করা হয় তা অর্জিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব অর্জন খরচ করার দ্বারাই হয়। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-
أَنْفِقْ يَا بِلَالُ ، وَلَا تَخْشَ مِنْ ذِي الْعَرْشِ إِقْلَالًا
‘হে বিলাল! খরচ করো। আরশওয়ালার কাছ থেকে কমানোর ভয় করো না।(শুআবুল ঈমান : ১৩৯৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ১০২৬)
আয়াতে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, খরচ করলে আল্লাহ তার বিনিময় দান করেন। এর দ্বারা বোঝা যায় খরচ করতে হবে বৈধ খাতে। কেননা বিনিময় দান করাটা আল্লাহর খুশির আলামত। অবৈধ খাতে খরচ করলে খুশি নয়; বরং তিনি নারাজ হন। সে ক্ষেত্রে বিনিময়লাভের আশা করা যায় না। এমনিভাবে খরচ করতে হবে পরিমিতভাবে। অপব্যয় বা অপচয় করা জায়েয নয়। কুরআন-হাদীছে তা নিষেধ করা হয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহপ্রদত্ত অর্থ-সম্পদ প্রয়োজনীয় খাতে অকৃপণভাবে খরচ করা চাই।
খ. খরচ যাতে বৈধ খাতে হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
গ. শরী'আত মোতাবেক খরচ করলে দুনিয়া ও আখিরাতে বিনিময়লাভের আশা থাকে।
দুই নং আয়াত
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ (272)
অর্থ: ‘তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণার্থে হয়ে থাকে। আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় কর না। আর তোমরা যে সম্পদই ব্যয় করবে, তোমাদেরকে তা পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭২)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে কয়েকটি বাক্য আছে। প্রথম বাক্য হল- وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنْفُسِكُمْ (তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণার্থে হয়ে থাকে)। خير শব্দের মূল অর্থ কল্যাণ। এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য ধন-সম্পদ। অনেকে ব্যাপক অর্থে যে-কোনও কল্যাণকর বিষয়কেই এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন বিদ্যা, বুদ্ধি, কায়িক শ্রম ইত্যাদি। আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থ-সম্পদ বা যে-কোনও কল্যাণকর বস্তু খরচ করলে তার ফায়দা ও সুফল খরচকারী ব্যক্তির নিজেরই লাভ হয়। কোথায় খরচ করা হবে, তা আয়াতে বলা হয়নি। তবে সাধারণত এর দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ বোঝানো হয়। নিজ প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় খরচ করা, পারিবারিক প্রয়োজনে খরচ করা, আল্লাহর সৃষ্টির সেবায় খরচ করা, আল্লাহর দীন কায়েম ও প্রচারে খরচ করা, এ সবই আল্লাহর পথে খরচ করার অন্তর্ভুক্ত। তো এসব খাতে অর্থ-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি ইত্যাদি যা-ই খরচ করা হোক, তাতে ব্যক্তির নিজেরই কল্যাণ সাধিত হয়। কেননা এর সুফল দুনিয়ায়ও পাওয়া যায় এবং আখিরাতেও পাওয়া যাবে। দুনিয়ায় পাওয়া যায় এভাবে যে, যাদের পেছনে খরচ করা হয় তারা খরচকর্তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও তার সুহৃদ হয়ে যায়। আর সুনাম-সুখ্যাতি তো হয়ই। যদিও খরচ করার পেছনে এরকম নিয়ত রাখা ঠিক নয়।
আর আখিরাতের কল্যাণ লাভ হয় বিপুল ছাওয়াব অর্জনের মাধ্যমে। খাঁটি নিয়তে খরচ করলে আল্লাহ তা'আলা দশগুণ থেকে সাতশ'গুণ পর্যন্ত বেশি ছাওয়াব দান করেন। আল্লাহ চাইলে তার বেশিও দিতে পারেন। কুরআন-হাদীছে সেরকম দেওয়ার ওয়াদা রয়েছে। বলাবাহুল্য, ছাওয়াব যত বেশি অর্জন করা যায়, ততোই আখিরাতে নাজাতলাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। আখিরাতের নাজাত লাভই সর্বাপেক্ষা বড় কল্যাণ।
প্রকাশ থাকে যে, অর্থব্যয়ের উল্লিখিত লাভ কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে, যখন সে ব্যয় হবে বৈধ উপার্জন থেকে। আয়াতের মধ্যেই সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যে 'খায়র' ব্যয় কর। 'খায়র'-এর মূল অর্থ কল্যাণ ও উত্তম। দানের বস্তুকে 'খায়র' শব্দে ব্যক্ত করার মধ্যে ইশারা পাওয়া যায় যে, সে বস্তুটি উত্তম ও কল্যাণপূর্ণ হতে হবে। বলাবাহুল্য তা হতে পারে কেবল হালাল উপার্জনেই। হারাম উপায়ে অর্জিত সম্পদে কোনও কল্যাণ নেই; বরং তা নিকৃষ্ট মাল।
দান-খয়রাতের ফায়দা যখন ব্যক্তির নিজেরই হাসিল হয়, তখন যার প্রতি দান- খয়রাত করা হয়, তাকে খোঁটা দেওয়ার কোনও বৈধতা থাকে না। খোঁটা দিলে দান- খয়রাতের ছাওয়াব নষ্ট হয়। এ আয়াত ইঙ্গিত করছে, খরচ করার দ্বারা যেমন তুমি নিজেই লাভবান হচ্ছ, তখন অন্যকে খোঁটা দিবে কেন? অর্থাৎ কোনও অবস্থায়ই খোঁটা দিয়ো না।
আয়াতের দ্বিতীয় বাক্য হল- وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ (আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় কর না)। এটাই মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا (9)
‘আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না।(সূরা দাহর (৭৬), আয়াত ৯)
উদ্দেশ্য যখন আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি, তখন যাকে দেওয়া হল তার কাছ থেকে কোনও প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাওয়ার কোনও প্রশ্ন আসে না। বরং নিজেরই তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, যেহেতু তাকে দিতে পারা ও তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের সুযোগ হচ্ছে। যারা কাউকে কিছু দেওয়ার পর তার পক্ষ থেকে বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা না পেলে খোঁটা দিয়ে ফেলে, তাদের জন্য এর মধ্যে সতর্কবার্তা রয়েছে। কেননা খোঁটা দেওয়ার দ্বারা ইঙ্গিত হয় যে, দান করার মধ্যে পুরোপুরি ইখলাস ছিল না এবং একান্তভাবে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিই লক্ষ্যবস্তু ছিল না। আয়াতটি বলছে, মুমিন ব্যক্তির দান হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে। অন্যথায় সে দানের মাধ্যমে তাঁর কাছে কিছু পাওয়া যাবে না। তা হবে বৃথা দান এবং সম্পদের অপচয়। সম্পদের অপচয় করা নাজায়েয কাজ।
আয়াতে ইশারা রয়েছে, কারও পেছনে খরচ করলে কিংবা অন্য কোনওভাবে কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করলে সে লোকটি কেমন সেদিকে লক্ষ করার প্রয়োজন নেই। সাহায্য করার দ্বারা যদি দীনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, তবে সে লোকটি কাফের-ফাসেক যাই হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার কাছে অবশ্যই ছাওয়াব পাওয়া যাবে। উদ্দেশ্য যদি থাকে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ করা, তবে অমুসলিম ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণ করলেও নেকী লাভ হবে। এমনকি পশু-পাখিকে খাওয়ালেও ছাওয়াব পাওয়া যাবে। অবশ্য এ কথা কেবল নফল দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যাকাত- ফিতরা, মানত ইত্যাদি ফরয দান কেবল মুমিন-মুসলিমকেই দেওয়া যায়।
আয়াতের তৃতীয় বাক্য হল- وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ (আর তোমরা যে সম্পদই ব্যয় করবে, তোমাদেরকে তা পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না)। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করলে আল্লাহ তা'আলা তার প্রাপ্য ছাওয়াব ও পুরস্কার পরিপূর্ণরূপে দান করবেন। কম দেবেন না মোটেই; বরং নিজ মেহেরবানীতে প্রাপ্যের চেয়ে বেশিই দেবেন। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (261)
‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম, যেমন একটি শস্যদানা সাতটি শীষ উদ্গত করে (এবং) প্রতিটি শীষে একশ দানা জন্মায়। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন (ছাওয়াবে) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় (এবং) সর্বজ্ঞ।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬১)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. এ আয়াতে দান-খয়রাত করার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
খ. অর্থ-সম্পদ খায়র বা কল্যাণকর বস্তু। তা বৈধ পথে উপার্জন করা ও তার সদ্ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
গ. আল্লাহর পথে ব্যয় বলতে কেবল মাল নয়, বিদ্যা-বুদ্ধি ও অন্যান্য কল্যাণকর বিষয়ের ব্যয়কেও বোঝায়।
ঘ. আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে কেবলই তাঁর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে।
ঙ. দান-খয়রাত করার সুফল মূলত ব্যক্তির নিজেরই লাভ হয়ে থাকে।
চ. দান-খয়রাত করার পর খোঁটা দেওয়া জায়েয নয়।
ছ. আল্লাহর পথে খরচ করলে প্রাপ্য বিনিময় তো বটেই, বরং আল্লাহ তা'আলা বহুগুণ বেশিই দিয়ে থাকেন।
জ. নফল দান-খয়রাত অমুসলিমদের প্রতিও করা যায়।
তিন নং আয়াত
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (273)
অর্থ: ‘তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর, আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭৩)
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ তোমরা কৃপণতা করো না। আল্লাহর পথে অকুণ্ঠভাবে খরচ করো। তোমাদের খরচ বৃথা যাবে না। কেননা আল্লাহ তা'আলা জানেন তোমরা কোথায় কী খরচ করছ এবং কী নিয়তে খরচ করছ। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে খরচ করে থাকলে তিনি তার পুরোপুরি বিনিময় তোমাদের দান করবেন। এভাবে আয়াতটিতে আল্লাহর পথে খরচ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
‘খায়র’ শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে এর অর্থ হবে- তোমরা তোমাদের ধন- সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রভৃতি কল্যাণকর যা-কিছু আছে, তা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে খরচ করো। তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখো এবং তা দ্বারা আল্লাহর মাখলুকের সেবা করো। যদি তা কর, তবে তা বৃথা যাবে না; বরং আল্লাহ তা'আলা নিজ জ্ঞান অনুযায়ী তোমাদেরকে তার প্রতিদান দেবেন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. এ আয়াতের ভেতর আল্লাহর পথে ব্যয় করার অনুপ্রেরণা মেলে।
খ. আল্লাহর পথে ব্যয় করলে তা বৃথা যায় না।
গ. অর্থ-সম্পদ কল্যাণকর বস্তু। তা কল্যাণকর কাজেই ব্যবহার করা চাই।
ঘ. আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। যা-কিছু যে পরিমাণে খরচ করা হয়, যে খাতে খরচ করা হয় এবং যে উদ্দেশ্যে খরচ করা হয়, তার সবই তিনি জানেন।
ঙ. আল্লাহ তা'আলার নি'আমতের ব্যবহার ও খরচের বেলায় তাঁর সর্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন থাকা চাই।
ঈর্ষণীয় দু’টি বিষয়
হাদীছ নং: ৫৪৩
হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দুই অবস্থা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থার প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭৩; সহীহ মুসলিম: ৮১৫; জামে তিরমিযী: ১৯৩৬; মুসনাদে আহমাদ : ৩৬৫১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০২৮১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩১৬২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৮২৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৩৮)
হাদীছ নং: ৫৪৩
হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দুই অবস্থা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থার প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭৩; সহীহ মুসলিম: ৮১৫; জামে তিরমিযী: ১৯৩৬; মুসনাদে আহমাদ : ৩৬৫১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০২৮১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩১৬২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৮২৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৩৮)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَا أنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ} [سبأ: 39]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلأنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُونَ إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأنْتُمْ لاَ تُظْلَمُونَ} [البقرة: 272]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فإنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ} [البقرة: 273].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَا أنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ} [سبأ: 39]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلأنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُونَ إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأنْتُمْ لاَ تُظْلَمُونَ} [البقرة: 272]، وقال تَعَالَى: {وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فإنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ} [البقرة: 273].
543 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لا حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ في الحَقّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً، فَهُوَ يَقْضِي بِهَا ويُعَلِّمُهَا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
ومعناه: يَنْبَغي أَنْ لاَ يُغبَطَ أحَدٌ إِلاَّ عَلَى إحْدَى هَاتَيْنِ الخَصْلَتَيْنِ.
ومعناه: يَنْبَغي أَنْ لاَ يُغبَطَ أحَدٌ إِلاَّ عَلَى إحْدَى هَاتَيْنِ الخَصْلَتَيْنِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম বলেছেন- لا حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ (দুই অবস্থা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থার প্রতি হাসাদ করা যায় না)। 'হাসাদ' অর্থ ঈর্ষা বা হিংসা। কারও মধ্যে বিশেষ কোনও প্রাপ্তি (অর্থ-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, ক্ষমতা, সুখ্যাতি প্রভৃতি) দেখে অন্তর্জালা বোধ করা এবং তার থেকে তা লোপ পাওয়ার কামনা করাকে হাসাদ বলে। এটি একটি মন্দ গুণ ও আত্মিক ব্যাধি। মনের ভেতর এ গুণকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়; বরং এর চিকিৎসা জরুরি। কেননা মনের এ অবস্থা যদি অবদমিত হয়ে ওঠে, তবে একে কার্যে পরিণত করারও আশঙ্কা থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এ অবস্থাকে কার্যে পরিণত করা না হয় বা কার্যে পরিণত করার সংকল্প করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এতে কোনও গুনাহ নেই। যেমন কারও অন্তরে অন্যের ভালো দেখে অন্তর্জালা দেখা দিল এবং কামনা জাগল তার সে ভালোটা যেন দূর হয়ে যায়। কিন্তু তা দূর করার জন্য সে নিজে কোনও চেষ্টা করছে না বা চেষ্টার সংকল্পও করছে না। তবে এ অবস্থায় সে গুনাহগার হবে না। পক্ষান্তরে যদি সেরকম কোনও চেষ্টা করে বা চেষ্টার সংকল্প করে, তবে গুনাহগার হবে। তাই যাতে হাসাদ এ পর্যায়ে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নিয়ে এর চিকিৎসা করা চাই।
আলোচ্য হাদীছে যদিও ‘হাসাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর দ্বারা উল্লিখিত অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য ‘গিবতা’ (غِبطَةٌ)। কারও মধ্যে ভালো কিছু দেখে তার বিলুপ্তি কামনা না করে নিজের জন্যও অনুরূপ ভালোর আশা করাকে গিবতা বলে। যেমন কারও সুস্বাস্থ্য দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ সুস্বাস্থ্য কামনা করা বা কারও বিদ্যা-বুদ্ধির পরিপক্কতা দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ বিদ্যা-বুদ্ধি কামনা করা ইত্যাদি। কুরআনের ভাষায় একে 'মুনাফাসা' বলে। পার্থিব হালাল ও বৈধ বিষয়াবলিতে এটা জায়েয। ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে এটা কাম্য ও প্রশংসনীয়। কুরআন-হাদীছে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
‘এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।’(সূরা মুতাফফিফীন (৮৩), আয়াত ২৬)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
‘তোমরা পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৪৮)
হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝাচ্ছেন, হাসাদ তথা গিবতা যদি করতেই হয়, তবে দু'টি ক্ষেত্রে করবে। কোন দু'টি ক্ষেত্রে করবে, হাদীছের পরবর্তী অংশে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে-
رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ في الحَقّ (এক ঐ ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন)। উজাড় করে দেওয়ার অর্থ অকুন্ঠ ও অকৃপণভাবে খরচ করা। তবে তা যে-কোনও ক্ষেত্রে নয়; বরং ন্যায় খাতে। অর্থাৎ এমন কাজে, যাতে ছাওয়াব হয় এবং যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ হয়। যেমন আর্ত ও পীড়িতের সেবা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করার জন্য ধনী হওয়া জরুরি নয়। আল্লাহ তা'আলা যাকে যতটুকু মাল দিয়েছেন সে তা থেকেই খরচ করবে, তা বেশি হোক বা কম। সুতরাং অপর এক আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, (অর্থাৎ যে গরীব) সে, আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকেই খরচ করবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার উপর অর্পণ করেন না।’(সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৭)
وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقْضِي بِهَا ويُعَلِّمُهَا (আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়)। এখানে জ্ঞান দ্বারা কুরআন-হাদীছের জ্ঞান বোঝানো হয়েছে। যেমন এক বর্ণনায় আছে-
لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِي اثْنَتَيْنِ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَقُومُ بِهِ آنَاء اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তাতে লিপ্ত থাকে। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) খরচ করে।(সহীহ বুখারী : ৭৫২৯; সহীহ মুসলিম: ৮৫১; জামে তিরমিযী: ১৯৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪২০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৪৫৫০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩০২৮২; সহীহ ইবন হিব্বান: ১২৫)
কুরআন নিয়ে লিপ্ত থাকার মানে কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা, নামায ও নামাযের বাইরে তিলাওয়াত করা, অন্যকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং কুরআন অনুযায়ী ফাতওয়া দেওয়া ও বিচার করা। এ দুই ক্ষেত্রে গিবতা করার অর্থ এরূপ কামনা করা যে, আমারও যদি ওরকম থাকত, তবে আমিও ওইরকম আমল করতাম। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا حَسَدَ إلَّا في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ عَلَّمَهُ اللَّهُ القُرْآنَ، فَهو يَتْلُوهُ آناءَ اللَّيْلِ، وآناءَ النَّهارِ، فَسَمِعَهُ جارٌ له، فقالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ، ورَجُلٌ آتاهُ اللَّهُ مالًا فَهو يُهْلِكُهُ في الحَقِّ، فقالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ.
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা তিলাওয়াত করে। এ কথা তার এক প্রতিবেশী শুনল। তখন সে বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (কুরআন) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে ন্যায় খাতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) উজাড় করে দেয়। তখন এক ব্যক্তি বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (সম্পদ) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব।(সহীহ বুখারী : ৫০২৬; মুসনাদে আহমাদ: ১০২১৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৭৮২৭)
বোঝা গেল এরূপ গিবতা করা পসন্দনীয়। অন্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, এর দ্বারাও আমলকারী ব্যক্তির সমান ছাওয়াব পাওয়া যায়। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لاَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلاَ يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللَّهُ مَالاً وَلاَ عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ
‘দুনিয়া তো চার ব্যক্তির। (ক) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম দিয়েছেন। সে তাতে তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তা রক্ষা করে, তার ভেতর আল্লাহর হক জেনে নেয় (ও তা আদায় করে)। এটা উচ্চতর স্তর। (খ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, কিন্তু সম্পদ দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আল্লাহ যদি আমাকে সম্পদ দিতেন, তবে অমুকের মতো আমল করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির ছাওয়াব ও প্রতিদান সমান। (গ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু ইলম দেননি। সে ইলম ব্যতিরেকে তার সম্পদ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, তাতে আল্লাহকে ভয় করে না, আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং তাতে আল্লাহর কোনও হক আছে বলে জানে না। এটা নিকৃষ্টতম স্তর। (ঘ) এবং ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মালও দেননি এবং ইলমও নয়। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে তাতে ওই ব্যক্তির মতো কাজ করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির গুনাহ সমান।'(জামে তিরমিযী: ২৩২৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৮০৩১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর : ৮৬৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও ভালো কিছু দেখে হাসাদ করতে নেই।
খ. গিবতা করা জায়েয। দীনের ক্ষেত্রে তা কাম্য।
গ. সম্পদ আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। ন্যায় খাতে তা খরচ করতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়। এ হাদীছ খরচ করতে উৎসাহ যোগায়।
ঘ. সম্পদহীন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যে সম্পদ কামনা করলে তা দূষণীয় নয়।
ঙ. দীনী ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ নি'আমত যার আছে তার উচিত আমলে যত্নবান হওয়া।
চ. যার ইলম নেই, তার উচিত আমলের লক্ষ্যে ইলমের আশা করা ও তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করা।
ছ. সঠিক খাতে ইলম ও মালের ব্যবহার আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এজন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওফীক প্রার্থনা করা উচিত।
জ. কুরআন শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া ও কুরআনের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারা বান্দার পক্ষে মহাসৌভাগ্য।
আলোচ্য হাদীছে যদিও ‘হাসাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর দ্বারা উল্লিখিত অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য ‘গিবতা’ (غِبطَةٌ)। কারও মধ্যে ভালো কিছু দেখে তার বিলুপ্তি কামনা না করে নিজের জন্যও অনুরূপ ভালোর আশা করাকে গিবতা বলে। যেমন কারও সুস্বাস্থ্য দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ সুস্বাস্থ্য কামনা করা বা কারও বিদ্যা-বুদ্ধির পরিপক্কতা দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ বিদ্যা-বুদ্ধি কামনা করা ইত্যাদি। কুরআনের ভাষায় একে 'মুনাফাসা' বলে। পার্থিব হালাল ও বৈধ বিষয়াবলিতে এটা জায়েয। ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে এটা কাম্য ও প্রশংসনীয়। কুরআন-হাদীছে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
‘এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।’(সূরা মুতাফফিফীন (৮৩), আয়াত ২৬)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
‘তোমরা পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৪৮)
হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝাচ্ছেন, হাসাদ তথা গিবতা যদি করতেই হয়, তবে দু'টি ক্ষেত্রে করবে। কোন দু'টি ক্ষেত্রে করবে, হাদীছের পরবর্তী অংশে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে-
رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ في الحَقّ (এক ঐ ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং তাকে তা ন্যায় খাতে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন)। উজাড় করে দেওয়ার অর্থ অকুন্ঠ ও অকৃপণভাবে খরচ করা। তবে তা যে-কোনও ক্ষেত্রে নয়; বরং ন্যায় খাতে। অর্থাৎ এমন কাজে, যাতে ছাওয়াব হয় এবং যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ হয়। যেমন আর্ত ও পীড়িতের সেবা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করার জন্য ধনী হওয়া জরুরি নয়। আল্লাহ তা'আলা যাকে যতটুকু মাল দিয়েছেন সে তা থেকেই খরচ করবে, তা বেশি হোক বা কম। সুতরাং অপর এক আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, (অর্থাৎ যে গরীব) সে, আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকেই খরচ করবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার উপর অর্পণ করেন না।’(সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৭)
وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ حِكْمَةً فَهُوَ يَقْضِي بِهَا ويُعَلِّمُهَا (আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন, তারপর সে তার সাহায্যে বিচার-আচার করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়)। এখানে জ্ঞান দ্বারা কুরআন-হাদীছের জ্ঞান বোঝানো হয়েছে। যেমন এক বর্ণনায় আছে-
لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِي اثْنَتَيْنِ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَقُومُ بِهِ آنَاء اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তাতে লিপ্ত থাকে। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) খরচ করে।(সহীহ বুখারী : ৭৫২৯; সহীহ মুসলিম: ৮৫১; জামে তিরমিযী: ১৯৩৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪২০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৪৫৫০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩০২৮২; সহীহ ইবন হিব্বান: ১২৫)
কুরআন নিয়ে লিপ্ত থাকার মানে কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা, নামায ও নামাযের বাইরে তিলাওয়াত করা, অন্যকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং কুরআন অনুযায়ী ফাতওয়া দেওয়া ও বিচার করা। এ দুই ক্ষেত্রে গিবতা করার অর্থ এরূপ কামনা করা যে, আমারও যদি ওরকম থাকত, তবে আমিও ওইরকম আমল করতাম। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا حَسَدَ إلَّا في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ عَلَّمَهُ اللَّهُ القُرْآنَ، فَهو يَتْلُوهُ آناءَ اللَّيْلِ، وآناءَ النَّهارِ، فَسَمِعَهُ جارٌ له، فقالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ، ورَجُلٌ آتاهُ اللَّهُ مالًا فَهو يُهْلِكُهُ في الحَقِّ، فقالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ.
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা তিলাওয়াত করে। এ কথা তার এক প্রতিবেশী শুনল। তখন সে বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (কুরআন) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে ন্যায় খাতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) উজাড় করে দেয়। তখন এক ব্যক্তি বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (সম্পদ) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব।(সহীহ বুখারী : ৫০২৬; মুসনাদে আহমাদ: ১০২১৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৭৮২৭)
বোঝা গেল এরূপ গিবতা করা পসন্দনীয়। অন্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, এর দ্বারাও আমলকারী ব্যক্তির সমান ছাওয়াব পাওয়া যায়। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لاَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلاَ يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللَّهُ مَالاً وَلاَ عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ
‘দুনিয়া তো চার ব্যক্তির। (ক) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম দিয়েছেন। সে তাতে তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তা রক্ষা করে, তার ভেতর আল্লাহর হক জেনে নেয় (ও তা আদায় করে)। এটা উচ্চতর স্তর। (খ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, কিন্তু সম্পদ দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আল্লাহ যদি আমাকে সম্পদ দিতেন, তবে অমুকের মতো আমল করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির ছাওয়াব ও প্রতিদান সমান। (গ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু ইলম দেননি। সে ইলম ব্যতিরেকে তার সম্পদ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, তাতে আল্লাহকে ভয় করে না, আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং তাতে আল্লাহর কোনও হক আছে বলে জানে না। এটা নিকৃষ্টতম স্তর। (ঘ) এবং ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মালও দেননি এবং ইলমও নয়। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে তাতে ওই ব্যক্তির মতো কাজ করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির গুনাহ সমান।'(জামে তিরমিযী: ২৩২৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৮০৩১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর : ৮৬৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও ভালো কিছু দেখে হাসাদ করতে নেই।
খ. গিবতা করা জায়েয। দীনের ক্ষেত্রে তা কাম্য।
গ. সম্পদ আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। ন্যায় খাতে তা খরচ করতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়। এ হাদীছ খরচ করতে উৎসাহ যোগায়।
ঘ. সম্পদহীন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যে সম্পদ কামনা করলে তা দূষণীয় নয়।
ঙ. দীনী ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ নি'আমত যার আছে তার উচিত আমলে যত্নবান হওয়া।
চ. যার ইলম নেই, তার উচিত আমলের লক্ষ্যে ইলমের আশা করা ও তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করা।
ছ. সঠিক খাতে ইলম ও মালের ব্যবহার আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এজন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওফীক প্রার্থনা করা উচিত।
জ. কুরআন শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া ও কুরআনের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারা বান্দার পক্ষে মহাসৌভাগ্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)