রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫২৪
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৫৭ অল্পেতুষ্টি, অন্যের কাছে চাওয়া বা আশা করা হতে নিজেকে রক্ষা করা, জীবনযাত্রায় মধ্যপন্থা ও মিতব্যয়ের প্রতি উৎসাহদান এবং অপ্রয়োজনে মানুষের কাছে চাওয়ার নিন্দা
দীনের পথে সাহাবীগণের কঠিন ত্যাগ-তিতিক্ষা
হাদীছ নং: ৫২৪

আবু বুরদা রহ. থেকে বর্ণিত যে, (তার পিতা) হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এক যুদ্ধে বের হলাম। আমরা (আশআরী গোত্রের) ছয়জন লোক ছিলাম। আমাদের মধ্যে ছিল একটি উট। আমরা সেটিতে পালাক্রমে চড়তাম। ফলে আমাদের পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। আমার পা’ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। আমার পায়ের নখ পড়ে গেল। আমরা আমাদের পায়ে পট্টি বেঁধে নিয়েছিলাম। এ কারণে সে যুদ্ধটির নামকরণ করা হয় যাতুর্-রিকা' (পট্টিওয়ালা) যুদ্ধ, যেহেতু ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা পায়ে পট্টি বেঁধে নিয়েছিলাম।
আবূ বুরদা রহ. বলেন, আবু মূসা রাযি. এ হাদীছ বর্ণনা তো করে ফেলেন, কিন্তু পরক্ষণেই তা অপসন্দ করেন এবং বলেন, আমি যদি এটি বর্ণনা না-ই করতাম! আবু বুরদা রহ. বলেন, যেন তিনি নিজের কোনও আমল প্রকাশ করাকে অপসন্দ করেছিলেন। -বুখারী ও মুসলিম
( সহীহ বুখারী: ৪১২৮; সহীহ মুসলিম: ১৮১৬; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৭৩৪; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৭৩০৪; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৭৯৮)
مقدمة الامام النووي
57 - باب القناعة والعَفاف والاقتصاد في المعيشة والإنفاق وذم السؤال من غير ضرورة
524 - وعن أَبي بردة، عن أَبي موسى الأشعري - رضي الله عنه - قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - في غَزاةٍ وَنَحْنُ سِتَّةُ نَفَرٍ بَيْنَنَا بَعِيرٌ نَعْتَقِبُهُ، فَنقِبَت (1) أقدَامُنَا وَنَقِبَت قَدَمِي، وسَقَطت [ص:182] أظْفَاري، فَكُنَّا نَلُفُّ عَلَى أرْجُلِنا الخِرَقَ، فَسُمِّيَت غَزْوَةَ ذَاتِ الرِّقَاعِ لِمَا كُنَّا نَعْصِبُ عَلَى أرْجُلِنَا مِنَ الخِرَقِ، قَالَ أَبُو بُردَة: فَحَدَّثَ أَبُو مُوسَى بِهَذَا الحَدِيثِ، ثُمَّ كَرِه ذَلِكَ، وقال: مَا كُنْتُ أصْنَعُ بِأنْ أذْكُرَهُ! قَالَ: كأنَّهُ كَرِهَ أَنْ يَكُونَ شَيْئًا مِنْ عَمَلِهِ أفْشَاهُ. متفقٌ عَلَيْهِ. (2)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. যাতুর-রিকা'র যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ কী কঠিন অর্থসংকটের মধ্যে ছিলেন, তার খানিকটা বর্ণনা দিয়েছেন। যাতুর-রিকা'র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বনু গাতফান ও মুহারিবের বিরুদ্ধে। উহুদ ও বদরের যুদ্ধে তারা কুরায়শদের সাহায্য করেছিল। ৩য় হিজরিতে তারা একবার মদীনা আক্রমণেরও প্রস্তুতি নিয়েছিল। ৪র্থ হিজরী জুমাদাল উলা মাসে অথবা মুহাররাম মাসে তারা আবার মদীনা আক্রমণের উদ্যোগ নেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে চারশ' বা সাতশ' সাহাবীর একটি বাহিনী গঠন করেন এবং বনূ গাতফানের এলাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন।

মুসলিম বাহিনীর আগমন-সংবাদ পেয়ে বনূ গাতফান ও বনু মুহারিব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা প্রাণরক্ষার জন্য কাছের একটি পাহাড়ে আত্মগোপন করে। ফলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধের অবকাশ হয়নি। মুসলিম বাহিনী সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসে।

যুদ্ধটির বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত আবূ মূসা রাযি. বলেন- وَنَحْنُ سِتَّةُ نَفَرٍ بيْنَنَا بَعِيرٌ نَعْتَقِبُهُ (আমরা ছিলাম ছয়জন লোক। আমাদের মধ্যে ছিল একটি উট। আমরা সেটিতে পালাক্রমে চড়তাম)। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল চারশ', কোনও মতে সাতশ'। হযরত আবু মুসা আশ'আরী রাযি. যে বলেছেন আমরা ছিলাম ছয়জন, তার অর্থ আশ'আর গোত্রের সৈন্য ছিল ছয়জন। সে ছয়জন কে কে, তাদের নাম জানা যায় না। এই ছয়জনের জন্য ছিল একটি মাত্র উট। তারা একজনের পর একজন সেটিতে চড়তেন। যখন একজন সেটিতে চড়তেন, তখন বাকি পাঁচজনকে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হতে হতো। এভাবে তারা পালাক্রমে কখনও উটে চড়ে, কখনও পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন। এতে করে তাদের পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। হযরত আবূ মূসা রাযি. বলেন, ফলে আমাদের পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। আমার পা’ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। আমার পায়ের নখ পড়ে গেল।

ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পায়ে পট্টি বেঁধে নিতে হয়েছিল। হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি.-এর বর্ণনা অনুযায়ী এ কারণেই যুদ্ধটির নাম হয়েছিল 'যাতুর-রিকা'-এর যুদ্ধ। ‘রিকা’ (رقاعٌ) শব্দটি رُقعَةٌ-এর বহুবচন। رُقعَةٌ অর্থ কাপড়ের টুকরা। তারা তাদের পায়ে কাপড়ের টুকরো দ্বারা পট্টি বেঁধেছিলেন বলে যুদ্ধটির এ নাম। কেউ কেউ এ নামকরণের ভিন্ন কারণও বলেছেন। যেমন কেউ বলেন, যাতুর- রিকা' একটি খেজুর বাগানের নাম। সে বাগানের নামেই এ যুদ্ধের নাম রাখা হয়েছে। কারও মতে সেখানকার এক প্রকার গাছের নাম। সে হিসেবে এ যুদ্ধের নাম 'গাযওয়া যাতুর-রিকা'। আবার কেউ বলেন, এখানকার ভূমির কোনও অংশ সাদা ও কোনও অংশ কালো বর্ণের ছিল। দেখলে মনে হয়- যেন বিভিন্ন রঙের কাপড়ের টুকরা দ্বারা তালি লাগানো হয়েছে। সে কারণেই এলাকাটির নাম হয়ে গেছে যাতুর-রিকা।

হাদীছটি বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ণনাকারী আবু বুরদা রহ. বলেন যে, হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. এ যুদ্ধকালে যে কঠিন কষ্ট-ক্লেশ ভোগ করেছিলেন, সে কথা আমাদের সামনে প্রকাশ তো করে ফেললেন, কিন্তু পরক্ষণেই এটা তাঁর কাছে অপসন্দ লাগল। কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে এরূপ কষ্ট-ক্লেশ ভোগ ও তাতে ধৈর্য-স্থৈর্যের পরিচয় দান করাটা ছিল তাঁর অতি উঁচু একটা নেক আমল। নিজ নেক আমলের কথা প্রকাশ করা পসন্দনীয় নয়। এতে এক তো আত্মপ্রশংসা করা হয়, দ্বিতীয়ত এতে রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা সৃষ্টির ভয় থাকে। তাই বিনা প্রয়োজনে নিজ সৎকর্ম প্রকাশ করা সমীচীন নয়। এটাই কুরআন- সুন্নাহর শিক্ষা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
‘আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর, তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়!(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭১)
এর দ্বারা বোঝা যায় দান-খয়রাত প্রভৃতি সৎকর্ম গোপনে করাই শ্রেয়। তবে কোনও দীনী উপকার থাকলে প্রকাশ্যেও করা যায়। সুতরাং সূরা বাকারার এ আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ
‘তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো'।

হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. যদিও নিজ তাকওয়া-পরহেযগারী ও বিনয়ের উচ্চতর অবস্থান থেকে তাঁর এ সৎকর্মের প্রকাশকে অপসন্দ করেছেন, কিন্তু বহুবিধ ফায়দার দিকে লক্ষ করলে এ প্রকাশ করাটাও তাঁর একটি উচ্চ নেক আমলরূপেই গণ্য হবে। কেননা এ প্রকাশের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম শিক্ষা। এর দ্বারা আমরা এক তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতী জীবনের ঘটনাবলি জানতে পারি, দ্বিতীয়ত এর দ্বারা আমরা দীনের জন্য আপন জান-মাল কুরবানী করার অনুপ্রেরণাও লাভ করি। এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যত লোক দীনের পথে ত্যাগ স্বীকার করবে, সে ত্যাগস্বীকারের কারণে এ মহান সাহাবীর আমলনামায়ও তাদের সমান ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যত কঠিন কষ্ট-ক্লেশই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় দীনের পথে সবরের পরিচয় দেওয়া চাই।

খ. অপ্রয়োজনে নিজ সৎকর্মের কথা প্রকাশ করতে নেই।

গ. দীনী ফায়দা লক্ষ করা গেলে নিজ সৎকর্ম প্রকাশ করারও অবকাশ আছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাতে সদাকায়ে জারিয়ার ছাওয়াব লাভেরও সম্ভাবনা থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)