রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫২১
ভূমিকা অধ্যায়
অল্পেতুষ্টি, অন্যের কাছে চাওয়া বা আশা করা হতে নিজেকে রক্ষা করা, জীবনযাত্রায় মধ্যপন্থা ও মিতব্যয়ের প্রতি উৎসাহদান এবং অপ্রয়োজনে মানুষের কাছে চাওয়ার নিন্দা
এ অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. কয়েকটি বিষয়ের হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। বিষয়গুলো হচ্ছে- القناعة (পরিতুষ্টি); العفاف (হারামে লিপ্ত হওয়া ও অন্যের কাছে চাওয়ার লাঞ্ছনা হতে আপন মর্যাদা রক্ষা করা); الاقتصاد (আয়-ব্যয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন) এবং বিনা জরুরতে অর্থসাহায্য চাওয়ার নিন্দা।
আল্লাহ তা'আলা সারা জাহানের সমস্ত মাখলুকের রিযিকদাতা। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে জীবিকা দান করেন তিনিই। তবে তিনি ইহজগৎকে আসবাব-উপকরণের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এখানে যে-কোনও প্রয়োজন পূরণের জন্য উপায় অবলম্বন করতে হয়। উপায় অবলম্বন ও চেষ্টা করা তাঁরই হুকুম। তবে উপায় অবলম্বন ও চেষ্টার ফলাফল তিনি নিজ হাতেই রেখেছেন। তিনি নিজ হিকমত অনুযায়ী সে ফলাফল দিয়ে থাকেন। কাউকে বেশি দেন, কাউকে কম। যেহেতু প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাই, তাই তিনি যাকে যা দেন তাতে তার সন্তুষ্ট থাকা কর্তব্য। একে কানা‘আত বলে।
আল্লাহ তা'আলাই যেহেতু প্রকৃত জীবিকাদাতা, তাই আয় ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই বান্দার কর্তব্য মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। অর্থাৎ আয়ের ক্ষেত্রে সে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, হারাম ও অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত হবে না, বৈধ পন্থায় চেষ্টা-পরিশ্রম করবে এবং তাতে মাত্রাও ছাড়াবে না। এমনিভাবে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে ও মিতব্যয়ী হবে। কৃপণতাও করবে না এবং অপব্যয়-অপচয়ও করবে না। একে ইকতিসাদ বলে।
অর্থ-সম্পদ কম থাকুক বা বেশি, সর্বাবস্থায় মিতব্যয় কাম্য। অপচয় করা কঠিন গুনাহ। অপচয়ের দ্বারা সম্পদের বরকত নষ্ট হয়। যে ব্যক্তি মিতব্যয়ী, তার অল্প সম্পদেই প্রয়োজন মিটে যায়। কেননা তার উপার্জনে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করেন। অপচয়কারী ব্যক্তি ধনী হলেও তার ধন বিশেষ কাজে আসে না। সে অন্যের উপকার করবে কি, নিজ প্রয়োজন মেটানোর বেলায়ও টানাটানিতে পড়ে যায়।
অপচয় ও অপব্যয় বরকতহীনতার একটি বড় কারণ। এতে কেবল বরকতই নষ্ট হয় না; দারিদ্র্যও ধেয়ে আসে। অনেক বড় ধনী ব্যক্তিও অপচয়ের কারণে নিঃস্ব-ফকীর হয়ে যায়। এমনকি অভাব-অনটনের কষাঘাতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেও বেড়াতে হয়। মানুষের কাছে হাত পাতা নিতান্তই লজ্জার বিষয়। মুসলিম ব্যক্তির পক্ষে এটা চরম অমর্যাদাকর। এ পর্যায়ে যাতে পৌঁছতে না হয়, সেই লক্ষ্যে মিতব্যয়কে আঁকড়ে ধরা একান্ত জরুরি।
কানা‘আত ও মানসিক পরিতুষ্টির অভাব থাকলেও মানুষ অন্যের দ্বারস্থ হয়। মনে সন্তুষ্টি থাকলে পেটের ক্ষুধা সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে মনের ক্ষুধা যোগ হলে লজ্জা-শরম ঘুচে যায়। তখন মানুষ অন্যের কাছে হাত পাততে এমনকি হারাম পন্থায় উপার্জন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
ইকতিসাদ ও কানা‘আতের গুণ থাকলে ব্যক্তির পক্ষে হারাম থেকে বাঁচা ও অন্যের দ্বারস্থ হওয়া থেকে আত্মরক্ষা সহজ হয়, পরিভাষায় যাকে ‘আফাফ (العفاف) বলে। আমাদের দীনে ‘আফাফ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যাতে কোনও অবস্থাতেই হারামে লিপ্ত না হয় এবং কিছুতেই যেন অন্যের কাছে হাত না পাতে, কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে।
যাহোক ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কান‘'আত, ‘আফাফ ও ইকতিসাদের গুরুত্ব এবং অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চাওয়ার নিন্দা সম্পর্কে কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা নিচে সেগুলোর বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘অল্পেতুষ্টি...এর প্রতি উৎসাহদান এবং অপ্রয়োজনে মানুষের কাছে চাওয়ার নিন্দা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا
অর্থ: পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিযিক আল্লাহ নিজ দায়িত্বে রাখেননি।(সূরা হূদ (১১), আয়াত ৬
ব্যাখ্যা
دَابَّةٍ এর অর্থ বিচরণকারী। এর দ্বারা সাধারণভাবে সর্বপ্রকার প্রাণী বোঝানো হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র পিঁপড়ে থেকে শুরু করে হাতি-তিমির মতো অতিকায় প্রাণী পর্যন্ত প্রতিটি জীবই এর অন্তর্ভুক্ত। আকাশের পাখি, পানির মাছ ও ভূপৃষ্ঠের জীবজন্তু সবকিছুর জন্যই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আয়াতটিতে জানানো হয়েছে, জগতে এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিযিক আল্লাহর দায়িত্বে নয়। অর্থাৎ তিনি প্রতিটি জীবের জীবিকা সরবরাহ করে থাকেন।
عَلَى اللهِ -এর দ্বারা ইশারা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি প্রাণীর জীবিকার ব্যবস্থা করে থাকেন। যে প্রাণীর যতদিন আয়ু আছে, ততোদিন তার জীবিকার ব্যবস্থা অবশ্যই করা হয়ে থাকে। কোনও প্রাণী বেঁচে থাকবে অথচ সে জীবিকা পাবে না, এর কোনও সম্ভাবনা নেই। কেউ অনাহারে মারা গেলে তার অর্থ এ নয় যে, আয়ু থাকা সত্ত্বেও সে জীবিকার অভাবে মারা গেছে। বরং এর অর্থ হল, তার আয়ুই ফুরিয়ে গেছে। আর আয়ু ফুরিয়ে গেলে রোগ-ব্যাধি, দুর্ঘটনা ইত্যাদি দ্বারা যেমন মৃত্যু ঘটানো হয়, তেমনি জীবিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার দ্বারাও মৃত্যু ঘটানো হয়ে থাকে। ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই গৃহীত হয়েছে।
জীবিকার দায়িত্ব যদিও আল্লাহ তা'আলার উপর, তবুও বান্দার কর্তব্য জীবিকার জন্য কোনও না কোনও উপায় অবলম্বন করা। বান্দা উপায় অবলম্বন না করলেও আল্লাহ তা'আলা তাকে জীবিকা দিতে পারেন। জীবিকা পৌছানোর জন্য তিনি আসবাব- উপকরণের মুখাপেক্ষী নন। কখনও কখনও তিনি আসবাব-উপকরণ ছাড়া জীবিকা দিয়ে তা দেখিয়েও দেন। তবে দুনিয়ায় তাঁর সাধারণ রীতি হল আসবাব-উপকরণের প্রক্রিয়ায় জীবিকা সরবরাহ করা। এর মাধ্যমে তিনি বান্দাকে পরীক্ষা করেন সে জীবিকার জন্য বৈধ উপায় অবলম্বন করে, না অবৈধ উপায়।
জীবিকার বিষয়টি যেহেতু আল্লাহ তা'আলা নিজ দায়িত্বে রেখেছেন, তাই চেষ্টা, মেহনত ও উপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রে বান্দার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার উপরই ভরসা রাখা। অর্থাৎ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে তার চেষ্টাকে ফলপ্রসূও করতে পারেন, আবার চাইলে নিষ্ফলও করে দিতে পারেন। কীভাবে কোন উপায়ে জীবিকা দেবেন, এটা একান্ত তাঁরই বিষয়। আমার কর্তব্য কেবল তাঁর হুকুম অনুযায়ী চেষ্টা করা, তাই চেষ্টা করছি; ফলাফল আল্লাহর হাতে। সারকথা, মনের সংযোগ আসবাব-উপকরণের সঙ্গে নয়; বরং এসবের স্রষ্টা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেই থাকবে।
এ বিশাল পৃথিবীতে মাখলুক অগণিত। ভূপৃষ্ঠে, ভূগর্ভে, পাহাড়-পর্বতে, গাছ- গাছালিতে, সাগর-নদীতে ছোট-বড় অগণ্য জীব ছড়িয়ে রয়েছে। আল্লাহ তা'আলাই যখন এদের সকলের জীবিকাদাতা, তখন এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, কোনটি কোথায় অবস্থান করছে তাও নিশ্চিতভাবে তিনি জানেন। এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সর্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয়।
এর দ্বারা আরও ধারণা লাভ হয় আল্লাহ তা'আলার রুবুবিয়্যাত ও প্রতিপালকত্বের মহিমা সম্পর্কে। তিনি কোনও মাখলুককে সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি। যতদিন আয়ু দিয়েছেন ততোদিন যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে, তার ব্যবস্থাও করেছেন। কতইনা মহান ও মহানুভব আমাদের সৃষ্টিকর্তা! তাঁরই সমস্ত প্রশংসা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলাই প্রকৃত রিযিকদাতা- এ বিশ্বাস রাখা অবশ্যকর্তব্য।
খ. আল্লাহ তা'আলাই যখন রিযিকদাতা, তখন রিযিকের ব্যাপারে কেবল তাঁরই উপর ভরসা রাখতে হবে।
গ. আল্লাহ তা'আলাই যখন রিযিকদাতা, তখন রিযিকের সন্ধান করতে হবে তাঁর বিধান অনুসারে।
ঘ. রিযিক যেহেতু আল্লাহ তা'আলাই দেন, সেহেতু তিনি যাকে যা দেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা একান্ত কর্তব্য।
ঙ. অভাব-অনটন দেখা দিলে মানুষের কাছে হাত না পেতে কেবল আল্লাহ তা'আলার দিকেই রুজু' করা উচিত।
দুই নং আয়াত
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا
অর্থ: (আর্থিক সহযোগিতার জন্য বিশেষভাবে) উপযুক্ত সেই সকল গরীব, যারা নিজেদেরকে আল্লাহর পথে এভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, (অর্থের সন্ধানে) তারা ভূমিতে চলাফেরা করতে পারে না। তারা যেহেতু (অতি সংযমী হওয়ার কারণে কারও কাছে) সওয়াল করে না, তাই অনবগত লোকে তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তুমি তাদের চেহারার আলামত দ্বারা তাদেরকে (অর্থাৎ তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা) চিনতে পারবে। (কিন্তু) তারা মানুষের কাছে না-ছোড় হয়ে সওয়াল করে না।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭৩)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াত। দান-সদাকা পাওয়ার কারা বেশি হকদার, এ আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, এ আয়াতটি 'আসহাবে সুফফা' সম্পর্কে অবতীর্ণ। আসহাবে সুফফা বলা হয় সেই সকল সাহাবীকে, যারা সর্বদা মসজিদে নববীর চত্বরে পড়ে থাকতেন। তারা দীনী ইলম শেখার জন্য নিজেদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। সর্বদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে থাকতেন এবং তাঁর নিকট থেকে দীনী ইলম শিখতেন। তাছাড়া কখনও জিহাদের অবকাশ আসলে তাতে অংশগ্রহণ করতেন। জিহাদে অংশগ্রহণ ও দীনী ইলম শেখায় নিয়োজিত থাকার কারণে তারা জীবিকা সংগ্রহের সুযোগ পেতেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন যে জীবিকার ব্যবস্থা হতো, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। তারা মানুষের কাছে হাত পাততেন না। দারিদ্র্যের সকল কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতেন।
এ আয়াত জানাচ্ছে, অর্থসাহায্য লাভের বেশি উপযুক্ত তারাই, যারা সমগ্র উম্মতের কল্যাণ সাধনের মহতি উদ্দেশ্যে কোথাও আবদ্ধ হয়ে থাকে, বিশেষত যারা ইলমে দীনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, যারা ইলমের চর্চায় মশগুল থাকার কারণে অর্থ উপার্জনে সময় দেওয়ার সুযোগ পায় না। তাদের ব্যস্ততা গোটা উম্মতের কল্যাণে নিবেদিত। উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তাদের পক্ষে যথাযথভাবে ইলমের চর্চা সম্ভব হবে না। ইলমে দীনের যথাযথ চর্চা না হওয়াটা সমগ্র উম্মতের পক্ষেই ক্ষতিকর। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে সকলের কর্তব্য ইলমে দীনের চর্চাকারীদের সেবা করাকে নিজেদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করা।
আয়াত জানাচ্ছে, নিদারুণ কষ্ট-ক্লেশ সত্ত্বেও যারা কারও সামনে নিজেদে প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করে না, তারাই অর্থসাহায্য লাভের বেশি হকদার। প্রশ্ন হচ্ছে যারা অন্যের সামনে নিজেদের অভাব-অনটনের কথা প্রকাশ করে না, তাদেরকে কীভাবে চেনা যাবে? কীভাবে বোঝা যাবে যে, তারা সাহায্য লাভের বেশি উপযুক্ত? আয়াতে বলা হয়েছে, এটা বোঝা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অনাহার-অভুক্ত থাকার কারণে তাদের চেহারায় কষ্ট-ক্লেশের ছাপ লক্ষ করা যায়। সচ্ছল ব্যক্তির কর্তব্য চেহারার সেই ছাপ দেখে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
নাছোড় হয়ে যাচনা করার অর্থ অনবরত চাইতে থাকা। বোঝা গেল, কারও কাছে এভাবে সাহায্য চাওয়া পসন্দনীয় নয়। অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া এমনিই ভালো নয়; নাছোড় হয়ে চাওয়াটা অধিকতর মন্দ। এরূপ ব্যক্তিকে সাহায্য করা জায়েয হলেও যারা নাছোড় হয়ে সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত থাকে, খুঁজে খুঁজে তাদেরকে দান-খয়রাত করাই উত্তম। আয়াতটি এর প্রতিই উৎসাহ যোগাচ্ছে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অভাব-অনটনে অন্যের কাছে হাত পাতা পসন্দনীয় নয়।
খ. নিজ অভাবের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নেই।
গ. দীনের কাজে আবদ্ধ থাকার কারণে যদি অর্থকষ্ট দেখা দেয়, তবে খুশিমনে তা মেনে নেওয়া চাই।
ঘ. সচ্ছল ব্যক্তিদের কর্তব্য যারা নিজ অভাব-অনটনের কথা লুকিয়ে রাখে, তাদেরকে খুঁজে খুঁজে অর্থসাহায্য করা।
তিন নং আয়াত
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا (67)
অর্থ: এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।( সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৭)
ব্যাখ্যা
يُسْرِفُوْا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি إِسْرَاف থেকে। এর অর্থ আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতামূলক ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা, তা বেশি হোক বা কম। এর আরেক অর্থ সীমালঙ্ঘন করা, অপব্যয় করা।
يَقْتُرُوا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি قتر থেকে। এর অর্থ কার্পণ্য করা, যে ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা জরুরি, সে ক্ষেত্রেও ব্যয় করা হতে বিরত থাকা। আয়াতে বলা হয়েছে, দয়াময় আল্লাহর প্রকৃত বান্দাগণ এমন কোনও ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা খরচ করে না, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা হয় এবং যে সকল ক্ষেত্রে ব্যয় করা জায়েয, তাতেও প্রয়োজনের বেশি ব্যয় করে না বা অপব্যয় করে না। অপব্যয় করা হারাম ও কঠিন গুনাহ। এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا (26) إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
‘আর নিজেদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে উড়াবে না। জেনে রেখো, যারা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ উড়ায়, তারা শয়তানের ভাই।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৬-২৭)
এমনিভাবে দয়াময় আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দাগণ জরুরি ক্ষেত্রে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে না। তারা পরিবারবর্গকে অনাহারে রাখে না। তাদের পোশাক-আশাক দেয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ও পূরণ করে। তাছাড়া দীনের দাবি অনুযায়ী যেসব কাজে টাকা-পয়সা খরচ করা কাম্য, তাতে অকুষ্ঠভাবে খরচ করে। মোটকথা তারা অর্থ- সম্পদের অপব্যয় ও অপচয়ও করে না এবং শরী'আতের নির্দেশনা মোতাবেক খরচ করতে কার্পণ্যও করে না। তাদের অবস্থান এর মাঝখানে।
قَوَام অর্থ মাঝখান, ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। শরী'আত সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা শিক্ষা দেয়। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের কর্তব্য অর্থব্যয়ের সকল ক্ষেত্রে আপন অবস্থা অনুযায়ী মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। উপার্জন ও সামর্থ্য অনুযায়ী যে পরিমাণ খরচ দ্বারা নিজের উপর চাপও পড়ে না আবার সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুপাতে তা কমও হয় না, এ নীতিতে খরচ করাই কাম্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহপ্রদত্ত কোনও নি'আমত অপব্যয় ও অপচয় করা উচিত নয়।
খ. কৃপণতা নিন্দনীয় চরিত্র। এটা বর্জনীয়।
গ. ব্যয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন দয়াময় আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।
চার নং আয়াত
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (56) مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (57)
অর্থ: আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে কোনওরকম রিযিক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিক।( সূরা যারিয়াত (৫১), আয়াত ৫৬-৫৭)
ব্যাখ্যা
ইবাদত (العبادة) অর্থ আনুগত্য করা, চরম বিনয় প্রকাশ করা। এ অর্থে 'উবূদিয়াত (العبودية) বান্দার পক্ষ থেকে চরম আনুগত্য ও বিনয় প্রকাশ কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই হতে পারে। কেননা তিনিই তার সৃষ্টিকর্তা ও মালিক এবং তিনিই তার প্রতিপালক ও রক্ষাকর্তা। পরিভাষায় ইবাদত বলা হয় আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে শেখানো সুনির্দিষ্ট পন্থায় স্বেচ্ছায় তাঁর প্রতি চরম বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করাকে।
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা মানুষ ও জিন জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। নিজ ইচ্ছায় কাজ করার ক্ষমতা কেবল এ দুই জাতিকেই দেওয়া হয়েছে। অন্যসব মাখলুক স্বাধীন ইচ্ছায় কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। তারা আল্লাহ তা'আলার প্রাকৃতিক বিধানের অধীন। সে বিধান অনুযায়ী চলতে তারা বাধ্য। তারা তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতাই রাখে না। কিন্তু মানুষ ও জিন জাতিকে আল্লাহ তা'আলা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। তারা যেন সেই ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করে, সে লক্ষ্যে তিনি তাদেরকে শরী'আতের বিধান দিয়েছেন। সে বিধান অনুসরণ করারই অপর নাম ইবাদত করা। এটা তাদের জন্য পরীক্ষা। যারা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে অর্থাৎ শরী'আতের বিধান মেনে চলবে, তাদের জন্য আখিরাতে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। সে পুরস্কারস্বরূপ তারা জান্নাত ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমত লাভ করবে। আর যারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না অর্থাৎ শরী'আতের বিধান না মেনে নিজেদের মনমতো চলবে বা মানবরচিত বিধানের অনুসরণ করবে, আখিরাতে তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদেরকে জাহান্নামের ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আয়াত জানাচ্ছে, আল্লাহ তা'আলা যে ইবাদতের হুকুম করেছেন, তাতে আল্লাহ তা'আলার নিজের কোনও স্বার্থ নেই। আল্লাহ তা'আলা সর্বশক্তিমান। তাঁর কোনওকিছুর অভাব নেই। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তাঁর কোনও জীবিকার দরকার পড়ে না।
জীবিকার দরকার পড়ে বান্দার। আল্লাহ তা'আলাই বান্দার জীবিকা সরবরাহ করে থাকেন। পরের আয়াতেই আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ (58)
‘আল্লাহ নিজেই তো রিযিকদাতা এবং তিনি প্রবল পরাক্রমশালী।'
সুতরাং বান্দাকে যে ইবাদত-বন্দেগীর হুকুম দেওয়া হয়েছে, তা আল্লাহ তা'আলার নিজের কোনও প্রয়োজনে নয়; বরং বান্দারই প্রয়োজনে। অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক মনিবের সঙ্গে তার দাসের সম্পর্কের মতো নয়। দাস মনিবের যে হুকুম মানে, তাতে মনিবের উপকার হয়। কিন্তু বান্দা যদি আল্লাহর হুকুম মানে, তাতে আল্লাহর নয়; বরং বান্দার নিজেরই উপকার হয়। তা বান্দার দুনিয়ার জীবনেও কাজে আসে এবং আখিরাতেও তা দ্বারা মুক্তির ব্যবস্থা হয়। সুতরাং প্রত্যেক বান্দার কর্তব্য উভয় জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলার ইবাদতে লিপ্ত থাকা ও তাঁর হুকুম অনুযায়ী জীবনযাপন করা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী করাই আমাদের জীবনের আসল কাজ।
খ. পার্থিব প্রয়োজন পূরণের জন্য চেষ্টা-মেহনত করা জরুরি। তবে তাতে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে জীবনের আসল কাজে ব্যাঘাত ঘটানো উচিত নয়।
গ. আল্লাহ তা'আলা রিযিকদাতা। তাঁর নিজের কোনও জীবিকার প্রয়োজন হয় না।
এ অধ্যায়ে ইমাম নাওয়াবী রহ. কয়েকটি বিষয়ের হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। বিষয়গুলো হচ্ছে- القناعة (পরিতুষ্টি); العفاف (হারামে লিপ্ত হওয়া ও অন্যের কাছে চাওয়ার লাঞ্ছনা হতে আপন মর্যাদা রক্ষা করা); الاقتصاد (আয়-ব্যয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন) এবং বিনা জরুরতে অর্থসাহায্য চাওয়ার নিন্দা।
আল্লাহ তা'আলা সারা জাহানের সমস্ত মাখলুকের রিযিকদাতা। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে জীবিকা দান করেন তিনিই। তবে তিনি ইহজগৎকে আসবাব-উপকরণের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এখানে যে-কোনও প্রয়োজন পূরণের জন্য উপায় অবলম্বন করতে হয়। উপায় অবলম্বন ও চেষ্টা করা তাঁরই হুকুম। তবে উপায় অবলম্বন ও চেষ্টার ফলাফল তিনি নিজ হাতেই রেখেছেন। তিনি নিজ হিকমত অনুযায়ী সে ফলাফল দিয়ে থাকেন। কাউকে বেশি দেন, কাউকে কম। যেহেতু প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাই, তাই তিনি যাকে যা দেন তাতে তার সন্তুষ্ট থাকা কর্তব্য। একে কানা‘আত বলে।
আল্লাহ তা'আলাই যেহেতু প্রকৃত জীবিকাদাতা, তাই আয় ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই বান্দার কর্তব্য মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। অর্থাৎ আয়ের ক্ষেত্রে সে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, হারাম ও অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত হবে না, বৈধ পন্থায় চেষ্টা-পরিশ্রম করবে এবং তাতে মাত্রাও ছাড়াবে না। এমনিভাবে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে ও মিতব্যয়ী হবে। কৃপণতাও করবে না এবং অপব্যয়-অপচয়ও করবে না। একে ইকতিসাদ বলে।
অর্থ-সম্পদ কম থাকুক বা বেশি, সর্বাবস্থায় মিতব্যয় কাম্য। অপচয় করা কঠিন গুনাহ। অপচয়ের দ্বারা সম্পদের বরকত নষ্ট হয়। যে ব্যক্তি মিতব্যয়ী, তার অল্প সম্পদেই প্রয়োজন মিটে যায়। কেননা তার উপার্জনে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করেন। অপচয়কারী ব্যক্তি ধনী হলেও তার ধন বিশেষ কাজে আসে না। সে অন্যের উপকার করবে কি, নিজ প্রয়োজন মেটানোর বেলায়ও টানাটানিতে পড়ে যায়।
অপচয় ও অপব্যয় বরকতহীনতার একটি বড় কারণ। এতে কেবল বরকতই নষ্ট হয় না; দারিদ্র্যও ধেয়ে আসে। অনেক বড় ধনী ব্যক্তিও অপচয়ের কারণে নিঃস্ব-ফকীর হয়ে যায়। এমনকি অভাব-অনটনের কষাঘাতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেও বেড়াতে হয়। মানুষের কাছে হাত পাতা নিতান্তই লজ্জার বিষয়। মুসলিম ব্যক্তির পক্ষে এটা চরম অমর্যাদাকর। এ পর্যায়ে যাতে পৌঁছতে না হয়, সেই লক্ষ্যে মিতব্যয়কে আঁকড়ে ধরা একান্ত জরুরি।
কানা‘আত ও মানসিক পরিতুষ্টির অভাব থাকলেও মানুষ অন্যের দ্বারস্থ হয়। মনে সন্তুষ্টি থাকলে পেটের ক্ষুধা সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে মনের ক্ষুধা যোগ হলে লজ্জা-শরম ঘুচে যায়। তখন মানুষ অন্যের কাছে হাত পাততে এমনকি হারাম পন্থায় উপার্জন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
ইকতিসাদ ও কানা‘আতের গুণ থাকলে ব্যক্তির পক্ষে হারাম থেকে বাঁচা ও অন্যের দ্বারস্থ হওয়া থেকে আত্মরক্ষা সহজ হয়, পরিভাষায় যাকে ‘আফাফ (العفاف) বলে। আমাদের দীনে ‘আফাফ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যাতে কোনও অবস্থাতেই হারামে লিপ্ত না হয় এবং কিছুতেই যেন অন্যের কাছে হাত না পাতে, কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে।
যাহোক ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কান‘'আত, ‘আফাফ ও ইকতিসাদের গুরুত্ব এবং অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চাওয়ার নিন্দা সম্পর্কে কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা নিচে সেগুলোর বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘অল্পেতুষ্টি...এর প্রতি উৎসাহদান এবং অপ্রয়োজনে মানুষের কাছে চাওয়ার নিন্দা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا
অর্থ: পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিযিক আল্লাহ নিজ দায়িত্বে রাখেননি।(সূরা হূদ (১১), আয়াত ৬
ব্যাখ্যা
دَابَّةٍ এর অর্থ বিচরণকারী। এর দ্বারা সাধারণভাবে সর্বপ্রকার প্রাণী বোঝানো হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র পিঁপড়ে থেকে শুরু করে হাতি-তিমির মতো অতিকায় প্রাণী পর্যন্ত প্রতিটি জীবই এর অন্তর্ভুক্ত। আকাশের পাখি, পানির মাছ ও ভূপৃষ্ঠের জীবজন্তু সবকিছুর জন্যই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আয়াতটিতে জানানো হয়েছে, জগতে এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিযিক আল্লাহর দায়িত্বে নয়। অর্থাৎ তিনি প্রতিটি জীবের জীবিকা সরবরাহ করে থাকেন।
عَلَى اللهِ -এর দ্বারা ইশারা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি প্রাণীর জীবিকার ব্যবস্থা করে থাকেন। যে প্রাণীর যতদিন আয়ু আছে, ততোদিন তার জীবিকার ব্যবস্থা অবশ্যই করা হয়ে থাকে। কোনও প্রাণী বেঁচে থাকবে অথচ সে জীবিকা পাবে না, এর কোনও সম্ভাবনা নেই। কেউ অনাহারে মারা গেলে তার অর্থ এ নয় যে, আয়ু থাকা সত্ত্বেও সে জীবিকার অভাবে মারা গেছে। বরং এর অর্থ হল, তার আয়ুই ফুরিয়ে গেছে। আর আয়ু ফুরিয়ে গেলে রোগ-ব্যাধি, দুর্ঘটনা ইত্যাদি দ্বারা যেমন মৃত্যু ঘটানো হয়, তেমনি জীবিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার দ্বারাও মৃত্যু ঘটানো হয়ে থাকে। ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই গৃহীত হয়েছে।
জীবিকার দায়িত্ব যদিও আল্লাহ তা'আলার উপর, তবুও বান্দার কর্তব্য জীবিকার জন্য কোনও না কোনও উপায় অবলম্বন করা। বান্দা উপায় অবলম্বন না করলেও আল্লাহ তা'আলা তাকে জীবিকা দিতে পারেন। জীবিকা পৌছানোর জন্য তিনি আসবাব- উপকরণের মুখাপেক্ষী নন। কখনও কখনও তিনি আসবাব-উপকরণ ছাড়া জীবিকা দিয়ে তা দেখিয়েও দেন। তবে দুনিয়ায় তাঁর সাধারণ রীতি হল আসবাব-উপকরণের প্রক্রিয়ায় জীবিকা সরবরাহ করা। এর মাধ্যমে তিনি বান্দাকে পরীক্ষা করেন সে জীবিকার জন্য বৈধ উপায় অবলম্বন করে, না অবৈধ উপায়।
জীবিকার বিষয়টি যেহেতু আল্লাহ তা'আলা নিজ দায়িত্বে রেখেছেন, তাই চেষ্টা, মেহনত ও উপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রে বান্দার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার উপরই ভরসা রাখা। অর্থাৎ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা চাইলে তার চেষ্টাকে ফলপ্রসূও করতে পারেন, আবার চাইলে নিষ্ফলও করে দিতে পারেন। কীভাবে কোন উপায়ে জীবিকা দেবেন, এটা একান্ত তাঁরই বিষয়। আমার কর্তব্য কেবল তাঁর হুকুম অনুযায়ী চেষ্টা করা, তাই চেষ্টা করছি; ফলাফল আল্লাহর হাতে। সারকথা, মনের সংযোগ আসবাব-উপকরণের সঙ্গে নয়; বরং এসবের স্রষ্টা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেই থাকবে।
এ বিশাল পৃথিবীতে মাখলুক অগণিত। ভূপৃষ্ঠে, ভূগর্ভে, পাহাড়-পর্বতে, গাছ- গাছালিতে, সাগর-নদীতে ছোট-বড় অগণ্য জীব ছড়িয়ে রয়েছে। আল্লাহ তা'আলাই যখন এদের সকলের জীবিকাদাতা, তখন এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, কোনটি কোথায় অবস্থান করছে তাও নিশ্চিতভাবে তিনি জানেন। এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সর্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয়।
এর দ্বারা আরও ধারণা লাভ হয় আল্লাহ তা'আলার রুবুবিয়্যাত ও প্রতিপালকত্বের মহিমা সম্পর্কে। তিনি কোনও মাখলুককে সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি। যতদিন আয়ু দিয়েছেন ততোদিন যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে, তার ব্যবস্থাও করেছেন। কতইনা মহান ও মহানুভব আমাদের সৃষ্টিকর্তা! তাঁরই সমস্ত প্রশংসা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলাই প্রকৃত রিযিকদাতা- এ বিশ্বাস রাখা অবশ্যকর্তব্য।
খ. আল্লাহ তা'আলাই যখন রিযিকদাতা, তখন রিযিকের ব্যাপারে কেবল তাঁরই উপর ভরসা রাখতে হবে।
গ. আল্লাহ তা'আলাই যখন রিযিকদাতা, তখন রিযিকের সন্ধান করতে হবে তাঁর বিধান অনুসারে।
ঘ. রিযিক যেহেতু আল্লাহ তা'আলাই দেন, সেহেতু তিনি যাকে যা দেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা একান্ত কর্তব্য।
ঙ. অভাব-অনটন দেখা দিলে মানুষের কাছে হাত না পেতে কেবল আল্লাহ তা'আলার দিকেই রুজু' করা উচিত।
দুই নং আয়াত
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا
অর্থ: (আর্থিক সহযোগিতার জন্য বিশেষভাবে) উপযুক্ত সেই সকল গরীব, যারা নিজেদেরকে আল্লাহর পথে এভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, (অর্থের সন্ধানে) তারা ভূমিতে চলাফেরা করতে পারে না। তারা যেহেতু (অতি সংযমী হওয়ার কারণে কারও কাছে) সওয়াল করে না, তাই অনবগত লোকে তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তুমি তাদের চেহারার আলামত দ্বারা তাদেরকে (অর্থাৎ তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা) চিনতে পারবে। (কিন্তু) তারা মানুষের কাছে না-ছোড় হয়ে সওয়াল করে না।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৭৩)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াত। দান-সদাকা পাওয়ার কারা বেশি হকদার, এ আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, এ আয়াতটি 'আসহাবে সুফফা' সম্পর্কে অবতীর্ণ। আসহাবে সুফফা বলা হয় সেই সকল সাহাবীকে, যারা সর্বদা মসজিদে নববীর চত্বরে পড়ে থাকতেন। তারা দীনী ইলম শেখার জন্য নিজেদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। সর্বদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে থাকতেন এবং তাঁর নিকট থেকে দীনী ইলম শিখতেন। তাছাড়া কখনও জিহাদের অবকাশ আসলে তাতে অংশগ্রহণ করতেন। জিহাদে অংশগ্রহণ ও দীনী ইলম শেখায় নিয়োজিত থাকার কারণে তারা জীবিকা সংগ্রহের সুযোগ পেতেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন যে জীবিকার ব্যবস্থা হতো, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। তারা মানুষের কাছে হাত পাততেন না। দারিদ্র্যের সকল কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতেন।
এ আয়াত জানাচ্ছে, অর্থসাহায্য লাভের বেশি উপযুক্ত তারাই, যারা সমগ্র উম্মতের কল্যাণ সাধনের মহতি উদ্দেশ্যে কোথাও আবদ্ধ হয়ে থাকে, বিশেষত যারা ইলমে দীনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, যারা ইলমের চর্চায় মশগুল থাকার কারণে অর্থ উপার্জনে সময় দেওয়ার সুযোগ পায় না। তাদের ব্যস্ততা গোটা উম্মতের কল্যাণে নিবেদিত। উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তাদের পক্ষে যথাযথভাবে ইলমের চর্চা সম্ভব হবে না। ইলমে দীনের যথাযথ চর্চা না হওয়াটা সমগ্র উম্মতের পক্ষেই ক্ষতিকর। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে সকলের কর্তব্য ইলমে দীনের চর্চাকারীদের সেবা করাকে নিজেদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করা।
আয়াত জানাচ্ছে, নিদারুণ কষ্ট-ক্লেশ সত্ত্বেও যারা কারও সামনে নিজেদে প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করে না, তারাই অর্থসাহায্য লাভের বেশি হকদার। প্রশ্ন হচ্ছে যারা অন্যের সামনে নিজেদের অভাব-অনটনের কথা প্রকাশ করে না, তাদেরকে কীভাবে চেনা যাবে? কীভাবে বোঝা যাবে যে, তারা সাহায্য লাভের বেশি উপযুক্ত? আয়াতে বলা হয়েছে, এটা বোঝা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অনাহার-অভুক্ত থাকার কারণে তাদের চেহারায় কষ্ট-ক্লেশের ছাপ লক্ষ করা যায়। সচ্ছল ব্যক্তির কর্তব্য চেহারার সেই ছাপ দেখে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
নাছোড় হয়ে যাচনা করার অর্থ অনবরত চাইতে থাকা। বোঝা গেল, কারও কাছে এভাবে সাহায্য চাওয়া পসন্দনীয় নয়। অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া এমনিই ভালো নয়; নাছোড় হয়ে চাওয়াটা অধিকতর মন্দ। এরূপ ব্যক্তিকে সাহায্য করা জায়েয হলেও যারা নাছোড় হয়ে সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত থাকে, খুঁজে খুঁজে তাদেরকে দান-খয়রাত করাই উত্তম। আয়াতটি এর প্রতিই উৎসাহ যোগাচ্ছে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. অভাব-অনটনে অন্যের কাছে হাত পাতা পসন্দনীয় নয়।
খ. নিজ অভাবের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নেই।
গ. দীনের কাজে আবদ্ধ থাকার কারণে যদি অর্থকষ্ট দেখা দেয়, তবে খুশিমনে তা মেনে নেওয়া চাই।
ঘ. সচ্ছল ব্যক্তিদের কর্তব্য যারা নিজ অভাব-অনটনের কথা লুকিয়ে রাখে, তাদেরকে খুঁজে খুঁজে অর্থসাহায্য করা।
তিন নং আয়াত
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا (67)
অর্থ: এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।( সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৭)
ব্যাখ্যা
يُسْرِفُوْا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি إِسْرَاف থেকে। এর অর্থ আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতামূলক ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা, তা বেশি হোক বা কম। এর আরেক অর্থ সীমালঙ্ঘন করা, অপব্যয় করা।
يَقْتُرُوا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি قتر থেকে। এর অর্থ কার্পণ্য করা, যে ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা জরুরি, সে ক্ষেত্রেও ব্যয় করা হতে বিরত থাকা। আয়াতে বলা হয়েছে, দয়াময় আল্লাহর প্রকৃত বান্দাগণ এমন কোনও ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা খরচ করে না, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা হয় এবং যে সকল ক্ষেত্রে ব্যয় করা জায়েয, তাতেও প্রয়োজনের বেশি ব্যয় করে না বা অপব্যয় করে না। অপব্যয় করা হারাম ও কঠিন গুনাহ। এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا (26) إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
‘আর নিজেদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে উড়াবে না। জেনে রেখো, যারা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ উড়ায়, তারা শয়তানের ভাই।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৬-২৭)
এমনিভাবে দয়াময় আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দাগণ জরুরি ক্ষেত্রে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে না। তারা পরিবারবর্গকে অনাহারে রাখে না। তাদের পোশাক-আশাক দেয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ও পূরণ করে। তাছাড়া দীনের দাবি অনুযায়ী যেসব কাজে টাকা-পয়সা খরচ করা কাম্য, তাতে অকুষ্ঠভাবে খরচ করে। মোটকথা তারা অর্থ- সম্পদের অপব্যয় ও অপচয়ও করে না এবং শরী'আতের নির্দেশনা মোতাবেক খরচ করতে কার্পণ্যও করে না। তাদের অবস্থান এর মাঝখানে।
قَوَام অর্থ মাঝখান, ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। শরী'আত সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা শিক্ষা দেয়। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের কর্তব্য অর্থব্যয়ের সকল ক্ষেত্রে আপন অবস্থা অনুযায়ী মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। উপার্জন ও সামর্থ্য অনুযায়ী যে পরিমাণ খরচ দ্বারা নিজের উপর চাপও পড়ে না আবার সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুপাতে তা কমও হয় না, এ নীতিতে খরচ করাই কাম্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহপ্রদত্ত কোনও নি'আমত অপব্যয় ও অপচয় করা উচিত নয়।
খ. কৃপণতা নিন্দনীয় চরিত্র। এটা বর্জনীয়।
গ. ব্যয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন দয়াময় আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।
চার নং আয়াত
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (56) مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (57)
অর্থ: আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে কোনওরকম রিযিক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিক।( সূরা যারিয়াত (৫১), আয়াত ৫৬-৫৭)
ব্যাখ্যা
ইবাদত (العبادة) অর্থ আনুগত্য করা, চরম বিনয় প্রকাশ করা। এ অর্থে 'উবূদিয়াত (العبودية) বান্দার পক্ষ থেকে চরম আনুগত্য ও বিনয় প্রকাশ কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই হতে পারে। কেননা তিনিই তার সৃষ্টিকর্তা ও মালিক এবং তিনিই তার প্রতিপালক ও রক্ষাকর্তা। পরিভাষায় ইবাদত বলা হয় আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে শেখানো সুনির্দিষ্ট পন্থায় স্বেচ্ছায় তাঁর প্রতি চরম বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করাকে।
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা মানুষ ও জিন জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। নিজ ইচ্ছায় কাজ করার ক্ষমতা কেবল এ দুই জাতিকেই দেওয়া হয়েছে। অন্যসব মাখলুক স্বাধীন ইচ্ছায় কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। তারা আল্লাহ তা'আলার প্রাকৃতিক বিধানের অধীন। সে বিধান অনুযায়ী চলতে তারা বাধ্য। তারা তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতাই রাখে না। কিন্তু মানুষ ও জিন জাতিকে আল্লাহ তা'আলা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। তারা যেন সেই ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করে, সে লক্ষ্যে তিনি তাদেরকে শরী'আতের বিধান দিয়েছেন। সে বিধান অনুসরণ করারই অপর নাম ইবাদত করা। এটা তাদের জন্য পরীক্ষা। যারা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে অর্থাৎ শরী'আতের বিধান মেনে চলবে, তাদের জন্য আখিরাতে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। সে পুরস্কারস্বরূপ তারা জান্নাত ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমত লাভ করবে। আর যারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না অর্থাৎ শরী'আতের বিধান না মেনে নিজেদের মনমতো চলবে বা মানবরচিত বিধানের অনুসরণ করবে, আখিরাতে তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদেরকে জাহান্নামের ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আয়াত জানাচ্ছে, আল্লাহ তা'আলা যে ইবাদতের হুকুম করেছেন, তাতে আল্লাহ তা'আলার নিজের কোনও স্বার্থ নেই। আল্লাহ তা'আলা সর্বশক্তিমান। তাঁর কোনওকিছুর অভাব নেই। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তাঁর কোনও জীবিকার দরকার পড়ে না।
জীবিকার দরকার পড়ে বান্দার। আল্লাহ তা'আলাই বান্দার জীবিকা সরবরাহ করে থাকেন। পরের আয়াতেই আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ (58)
‘আল্লাহ নিজেই তো রিযিকদাতা এবং তিনি প্রবল পরাক্রমশালী।'
সুতরাং বান্দাকে যে ইবাদত-বন্দেগীর হুকুম দেওয়া হয়েছে, তা আল্লাহ তা'আলার নিজের কোনও প্রয়োজনে নয়; বরং বান্দারই প্রয়োজনে। অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক মনিবের সঙ্গে তার দাসের সম্পর্কের মতো নয়। দাস মনিবের যে হুকুম মানে, তাতে মনিবের উপকার হয়। কিন্তু বান্দা যদি আল্লাহর হুকুম মানে, তাতে আল্লাহর নয়; বরং বান্দার নিজেরই উপকার হয়। তা বান্দার দুনিয়ার জীবনেও কাজে আসে এবং আখিরাতেও তা দ্বারা মুক্তির ব্যবস্থা হয়। সুতরাং প্রত্যেক বান্দার কর্তব্য উভয় জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলার ইবাদতে লিপ্ত থাকা ও তাঁর হুকুম অনুযায়ী জীবনযাপন করা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী করাই আমাদের জীবনের আসল কাজ।
খ. পার্থিব প্রয়োজন পূরণের জন্য চেষ্টা-মেহনত করা জরুরি। তবে তাতে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে জীবনের আসল কাজে ব্যাঘাত ঘটানো উচিত নয়।
গ. আল্লাহ তা'আলা রিযিকদাতা। তাঁর নিজের কোনও জীবিকার প্রয়োজন হয় না।
প্রকৃত ঐশ্বর্য কাকে বলে
হাদীছ নং: ৫২১
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না; মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫১; জামে' তিরমিযী: ২৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩১৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৩৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৪০)
হাদীছ নং: ৫২১
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না; মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫১; জামে' তিরমিযী: ২৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩১৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৩৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৪০)
مقدمة الامام النووي
57 - باب القناعة والعَفاف والاقتصاد في المعيشة والإنفاق وذم السؤال من غير ضرورة
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَا مِنْ دَابَّةٍ في الأرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا} [هود: 6]، وقال تَعَالَى: {لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا في سَبِيلِ اللهِ لاَ يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لاَ يَسْأَلُونَ النَّاسَ إلْحَافًا} [البقرة: 273]، وقال تَعَالَى: {وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا} [الفرقان: 67]، وقال تَعَالَى: {وَمَا خَلَقْتُ الجِنَّ وَالإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ [ص:181] مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ} [الذاريات: 56 - 57].
وَأَمَّا الأحاديث، فتقدم معظمها في البابينِ السابقينِ، ومما لَمْ يتقدم:
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَا مِنْ دَابَّةٍ في الأرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا} [هود: 6]، وقال تَعَالَى: {لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا في سَبِيلِ اللهِ لاَ يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لاَ يَسْأَلُونَ النَّاسَ إلْحَافًا} [البقرة: 273]، وقال تَعَالَى: {وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا} [الفرقان: 67]، وقال تَعَالَى: {وَمَا خَلَقْتُ الجِنَّ وَالإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ [ص:181] مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ} [الذاريات: 56 - 57].
وَأَمَّا الأحاديث، فتقدم معظمها في البابينِ السابقينِ، ومما لَمْ يتقدم:
521 - عن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَيْسَ الغِنَى عَن كَثرَةِ العَرَض، وَلكِنَّ الغِنَى غِنَى النَّفْسِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«العَرَضُ» بفتح العين والراءِ: هُوَ المَالُ.
«العَرَضُ» بفتح العين والراءِ: هُوَ المَالُ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
মানুষ স্বভাবগতভাবেই ঐশ্বর্য ভালোবাসে। সাধারণত মনে করা হয় টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ দ্বারাই সে ঐশ্বর্য অর্জিত হয়। তাই প্রচেষ্টা থাকে কীভাবে কত বেশি ধন-সম্পদ অর্জন করা যায়। এর জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সে প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী থাকার লক্ষ্যে অনেক সময়ই হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধের পার্থক্য উপেক্ষা করা হয়। এভাবে ব্যক্তিচরিত্র ধ্বংস হয়। মনের মধ্যে জন্ম নেয় লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-অহমিকাসহ নানা চারিত্রিক ব্যাধি। সে ব্যাধির ছোবলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়। ব্যক্তির নিজেরও শান্তি নষ্ট হয় এবং আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের বৃহত্তর অঙ্গনে পারস্পরিক শত্রুতার সৃষ্টি হয়। এতদসত্ত্বেও যে ঐশ্বর্য অর্জনের লক্ষ্যে এতসব ক্ষতি মেনে নেওয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তা আদৌ অর্জিত হয় না। অর্জিত যা হয়, তা কেবলই টাকা-পয়সা, জমি-জায়েদাদ ও অন্যান্য আসবাবসামগ্রী। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ (সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না)। الْعَرَض -এর অর্থ ওই মালামাল, যা দ্বারা মানুষ কোনও না কোনওভাবে উপকৃত হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে বলেছেন, প্রকৃত ঐশ্বর্য সম্পদের প্রাচুর্য নয়। সম্পদ বেশি হলেই কেউ সত্যিকারের ধনী হয়ে যায় না। কেননা এমন বহু লোক আছে, আল্লাহ তা'আলা প্রচুর ধন-সম্পদ দেওয়া সত্ত্বেও যারা সন্তুষ্ট হতে পারে না। কোনও কিছুতেই তাদের সম্পদের চাহিদা মেটে না। তাদের অন্তরে সীমাহীন লোভ সক্রিয় থাকে। যত সম্পদ হয়, ততোই তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। সে চাহিদা পূরণের জন্য সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করে। হালাল-হারামের কোনও তোয়াক্কা করে না। এরূপ লোককে ধনী বলা যায় কি? কোনও কিছুতেই যার লোভ মেটে না, সে তো ফকীরই বটে। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ যার্র রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ যার্র! তুমি কি মনে কর সম্পদ বেশি হওয়াটাই ঐশ্বর্য? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি মনে কর সম্পদ অল্প হওয়াটাই দারিদ্র্য? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাই তো। তিনি বললেন-
إنما الغنى غنى القلب ، والفقر فقر القلب
অন্তরের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য, আর মনের দারিদ্র্যই প্রকৃত দারিদ্র্য।(সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৮৫; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৭৮৫; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ২০২০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৯৮৬১)
হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত ঐশ্বর্যের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- إِنَّمَا الْغِنَى غِنَى الْقَلْبِ (অন্তরের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য)। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি যত বেশি অর্থ-সম্পদেরই মালিক হোক না কেন, অন্তরে যদি ঐশ্বর্য না থাকে, তবে তাকে প্রকৃত ধনী বলা যায় না। অপরদিকে কারও মালিকানায় খুব বেশি সম্পদ না থাকলেও মনে যদি ঐশ্বর্য থাকে, তবে সে-ই সত্যিকারের ধনী। কেননা কারও মনে ঐশ্বর্য থাকলে আল্লাহ তা'আলা যতটুকু সম্পদই দেন তাতে সে সন্তুষ্ট থাকে। সে অপ্রয়োজনে আরও বেশি সম্পদের প্রতি লালায়িত হয় না। সম্পদ বাড়ানোর মোহ তাকে অন্ধ করে না; যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। দেখলে মনে হয়ে তার কোনও অভাব নেই। পক্ষান্তরে মনে ঐশ্বর্য না থাকলে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাকে যতই দেওয়া হোক না কেন সে কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। তার লোভ-লালসা কোনও মাত্রায় গিয়ে প্রশমিত হয় না। মনের ক্ষুধা মেটানোর তাড়নায় সে অবিরাম দৌড়ঝাঁপ করতে থাকে। কোনও একটা প্রচেষ্টা বিফল হলে তার শোক-দুঃখের কোনও অন্ত থাকে না। মনে হয় যেন তার কিছুই নেই, একদম দেউলিয়া। সুতরাং বোঝা গেল মনের দিক থেকে যে ধনী, সে-ই আসল ধনী। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, মনের ঐশ্বর্য কীভাবে লাভ হয়? হাঁ, এটা লাভ হয় আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় সন্তুষ্টির দ্বারা, তিনি যা দিয়েছেন তাতে খুশি থাকার দ্বারা। [সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ ، تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ ‘আল্লাহ তোমার জন্য যা বণ্টন করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট হও, তাহলে সকল মানুষের মধ্যে তুমি হবে সর্বাধিক ঐশ্বর্যশালী।]( জামে তিরমিযী, হাদীছ ২৩০৫) মুমিনকে এ কথা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে যা আছে, তা-ই তার জন্য উত্তম ও স্থায়ী। তিনিই প্রকৃত দাতা। তিনি যাকে যে পরিমাণ ইচ্ছা করেন, দান করে থাকেন। তিনি যাকে যা দিতে চান তাতে কেউ বাধা দিতে পারে না। আর তিনি দিতে না চাইলে কেউ কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং সর্বদা মাখলুক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহ তা'আলারই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। এরই দ্বারা অন্তর ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত এ ঐশ্বর্যেরই অধিকারী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى
এবং তোমাকে নিঃস্ব পেয়েছিলেন, অতঃপর (তোমাকে) ঐশ্বর্যশালী বানিয়ে দিলেন।(সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ৮)
এর দ্বারা মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ের ঐশ্বর্যই বোঝানো হয়েছে। কেননা এ আয়াত তাঁর মক্কী জীবনে অবতীর্ণ হয়েছে। আর সকলেরই জানা তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সম্পদের মোহে পড়া বাঞ্ছনীয় নয়। হৃদয়ে ঐশ্বর্য আনাই কাম্য।
খ. আল্লাহ তা'আলা যাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকার দ্বারাই হৃদয়ের ঐশ্বর্য লাভ হয়।
لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ (সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না)। الْعَرَض -এর অর্থ ওই মালামাল, যা দ্বারা মানুষ কোনও না কোনওভাবে উপকৃত হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে বলেছেন, প্রকৃত ঐশ্বর্য সম্পদের প্রাচুর্য নয়। সম্পদ বেশি হলেই কেউ সত্যিকারের ধনী হয়ে যায় না। কেননা এমন বহু লোক আছে, আল্লাহ তা'আলা প্রচুর ধন-সম্পদ দেওয়া সত্ত্বেও যারা সন্তুষ্ট হতে পারে না। কোনও কিছুতেই তাদের সম্পদের চাহিদা মেটে না। তাদের অন্তরে সীমাহীন লোভ সক্রিয় থাকে। যত সম্পদ হয়, ততোই তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। সে চাহিদা পূরণের জন্য সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করে। হালাল-হারামের কোনও তোয়াক্কা করে না। এরূপ লোককে ধনী বলা যায় কি? কোনও কিছুতেই যার লোভ মেটে না, সে তো ফকীরই বটে। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ যার্র রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ যার্র! তুমি কি মনে কর সম্পদ বেশি হওয়াটাই ঐশ্বর্য? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি মনে কর সম্পদ অল্প হওয়াটাই দারিদ্র্য? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাই তো। তিনি বললেন-
إنما الغنى غنى القلب ، والفقر فقر القلب
অন্তরের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য, আর মনের দারিদ্র্যই প্রকৃত দারিদ্র্য।(সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৮৫; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৭৮৫; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ২০২০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৯৮৬১)
হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত ঐশ্বর্যের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- إِنَّمَا الْغِنَى غِنَى الْقَلْبِ (অন্তরের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য)। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি যত বেশি অর্থ-সম্পদেরই মালিক হোক না কেন, অন্তরে যদি ঐশ্বর্য না থাকে, তবে তাকে প্রকৃত ধনী বলা যায় না। অপরদিকে কারও মালিকানায় খুব বেশি সম্পদ না থাকলেও মনে যদি ঐশ্বর্য থাকে, তবে সে-ই সত্যিকারের ধনী। কেননা কারও মনে ঐশ্বর্য থাকলে আল্লাহ তা'আলা যতটুকু সম্পদই দেন তাতে সে সন্তুষ্ট থাকে। সে অপ্রয়োজনে আরও বেশি সম্পদের প্রতি লালায়িত হয় না। সম্পদ বাড়ানোর মোহ তাকে অন্ধ করে না; যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। দেখলে মনে হয়ে তার কোনও অভাব নেই। পক্ষান্তরে মনে ঐশ্বর্য না থাকলে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাকে যতই দেওয়া হোক না কেন সে কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। তার লোভ-লালসা কোনও মাত্রায় গিয়ে প্রশমিত হয় না। মনের ক্ষুধা মেটানোর তাড়নায় সে অবিরাম দৌড়ঝাঁপ করতে থাকে। কোনও একটা প্রচেষ্টা বিফল হলে তার শোক-দুঃখের কোনও অন্ত থাকে না। মনে হয় যেন তার কিছুই নেই, একদম দেউলিয়া। সুতরাং বোঝা গেল মনের দিক থেকে যে ধনী, সে-ই আসল ধনী। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, মনের ঐশ্বর্য কীভাবে লাভ হয়? হাঁ, এটা লাভ হয় আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় সন্তুষ্টির দ্বারা, তিনি যা দিয়েছেন তাতে খুশি থাকার দ্বারা। [সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ ، تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ ‘আল্লাহ তোমার জন্য যা বণ্টন করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট হও, তাহলে সকল মানুষের মধ্যে তুমি হবে সর্বাধিক ঐশ্বর্যশালী।]( জামে তিরমিযী, হাদীছ ২৩০৫) মুমিনকে এ কথা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে যা আছে, তা-ই তার জন্য উত্তম ও স্থায়ী। তিনিই প্রকৃত দাতা। তিনি যাকে যে পরিমাণ ইচ্ছা করেন, দান করে থাকেন। তিনি যাকে যা দিতে চান তাতে কেউ বাধা দিতে পারে না। আর তিনি দিতে না চাইলে কেউ কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং সর্বদা মাখলুক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহ তা'আলারই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। এরই দ্বারা অন্তর ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত এ ঐশ্বর্যেরই অধিকারী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى
এবং তোমাকে নিঃস্ব পেয়েছিলেন, অতঃপর (তোমাকে) ঐশ্বর্যশালী বানিয়ে দিলেন।(সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ৮)
এর দ্বারা মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ের ঐশ্বর্যই বোঝানো হয়েছে। কেননা এ আয়াত তাঁর মক্কী জীবনে অবতীর্ণ হয়েছে। আর সকলেরই জানা তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সম্পদের মোহে পড়া বাঞ্ছনীয় নয়। হৃদয়ে ঐশ্বর্য আনাই কাম্য।
খ. আল্লাহ তা'আলা যাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকার দ্বারাই হৃদয়ের ঐশ্বর্য লাভ হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)